Skip to main content

মিশর এক বিস্ময়(part 2)

#মিশর_এক_বিস্ময়#
      (৩)
#লাক্সার#

বাড়ি থেকে ইজিপ্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলাম ক‍্যাবে করে তারপর দুবার করে ফ্লাইট চেঞ্জ।প্রথমে ভিস্তারার উড়ানে মুম্বাই,তারপর মুম্বাই এয়ারপোর্টে বেশ অনেকটা অপেক্ষা আর ঢুলুনির পর প্রায় ভোর রাতে যান্ত্রিক গোলযোগে লেট করা ইজিপ্ট এয়ারের ফ্লাইটে করে একদম ছয় ঘন্টায় কায়রোতে। এয়ারপোর্ট থেকে বাসে করে একদম হোটেলে এসেছি। তারপর ট্রেনে করে আসোয়ান,তারপর নাইলের বুকে ক্রুজে ভ্রমণ। চড়েছি ওদের নৌকো ফেলুকাতেও আরে সব যখন হলো তাহলে এক্কাগাড়িই বা বাকি থাকে কেন? আমি বলছিলাম ঘোড়াগাড়ির কথা। রাতে খাওয়ার আগেই আমাদের হাবিবি বলে দিলো পরের দিন একদম সকাল সাড়ে পাঁচটায় রেডি হতে হবে। ব‍্যাস আমরা ভোরে উঠে একদম রেডি,সারারাত ভাসতে ভাসতে ক্রুজ এসে পৌঁচেছে এডফুতে। ক্রুজ থেকে নেমে মোটামুটি ভোরের অন্ধকারের মধ‍্যেই সিঁড়ি বেয়ে জলের থেকে ডাঙায় উঠি। উরিব্বাস বিশালাকার ঘোড়া আর বেশ উঁচু গাড়ি আর তেমনি লম্বা আফ্রিকান সহিস বেশ হুকুমের গলায় উঠে আসতে বললো। তার সাথে মনে রাখতে হলো ঘোড়ার গাড়ির নম্বর কারণ ফেরার সময় ঐ গাড়িতেই ফিরতে হবে। বেশ কসরৎ করে উঠে পড়লাম গাড়িতে,একটা গাড়িতে চারজন করে। বাইরে বেশ হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। এডফু বেশ ঘিঞ্জি এবং বাড়ি ঘর সাধারণ মানের লোকজনের অবস্থা মনে হলো খুব একটা ভালোনা। ঘোড়া বেশ বাধ‍্য হয়ে ছুটলো সাই করে আওয়াজ হলো চাবুকের...আমার নজরুলগীতি মনে পড়ে গেলো..'আরবি ঘোড়ার সওয়ার হয়ে বাদশাজাদা বুঝি সাহারাতে ফেরে কোন মরীচিকায় খুঁজি।'আমরাও তেমন আরবি ঘোড়ার সওয়ার হয়ে ভোরের অন্ধকার কাটিয়ে ছুটে চললাম। নিজেকে কেমন যেন একটা বেশ রাণী রাণী মনে হলো।খুব অল্প সময়ের মধ‍্যেই ঘোড়াওয়ালা একদম তাড়াহুড়ো করে আমাদের প্রায় অন্ধকারে নামিয়ে চলে গেলো ওখানে তখন অনেক ঘোড়াগাড়ি। লেখাপড়া শিখেছি তাই গাড়িঘোড়া চাপা পড়ার ভয়ে এককোণে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমাদের টিমের লোকজন সব এলো এক জায়গায় হয়ে রওনা দিলাম এডফু মন্দিরের দিকে,কিছুটা সমতল আর কিছু সিঁড়ি পার হয়ে এসে গেলাম মন্দির চত্বরে।একটা কথা বলে রাখি মিশরে পিরামিড সহ সব দর্শনীয় স্থানেই কিন্তু টিকিটের ব‍্যবস্থা তবে সবটাই প‍্যাকেজের মধ‍্যে ধরা ছিলো। এডফু এক বিরাট আকৃতির মন্দির দেখে যেন মনে হয় কাদা মাটি দিয়ে বানানো হয়েছে তবে আদল ও ঢোকার পথের ডিজাইন অনেকটাই ফিলে টেম্পলের মত। একদিকের পাঁচিল অক্ষত ও অনেক উঁচু,আরেক দিকের নতুন করে বানানো হয়েছে শুনলাম। এডফু হোরাসের মন্দির যার কথা ফিলে টেম্পলের সময় বলেছি।আইসিস এবং ওজাইরিসের ছেলে যিনি মিশরীয়দের দেবতা তার মাথা বাজপাখির এবং আইসিসের অর্থাৎ তার মায়ের গরুর মাথা লাগানো প্রতিকৃতি।গ্ৰিক রোমান আমলে এডফুর নাম ছিলো আ্যপোলোনোপলিশ ম‍্যাগনা, সূর্যের দেবতা হোরাস-আ্যপোলোর নামে।এই মন্দির খ্রীষ্টপূর্ব ২৩৭ থেকে ২৫৭র মধ‍্যে তৃতীয় টলেমি থেকে দ্বাদশ টলেমির রাজত্বকালের মধ‍্যে বানানো হয়। অসাধারণ শিল্পকর্ম ও সৃষ্টির সামনে মাথা নত করতে হয়।কথিত আছে কারনাক টেম্পলের পরেই বৃহৎ মন্দির এটি। ভেতরের খোদাই এবং মুদ্রিত চিত্র অসাধারণ।গ্ৰীক রোমান স্থাপত‍্য ছাড়াঝ মিশরীয় পুরাণের অনেক চিত্র অসামান‍্য ভাবে খোদাই করা আছে দেওয়ালে এবং ছাদে।
         তবে ভেতরে মোটামুটি পর্যটক আর গাইডে পুরো ঠাসাঠাসি। তারমধ‍্যে কয়েকটা সিঁড়ি বেয়ে বোধহয় ওপরে কোন দেবতার স্থান কিন্তু সেখানে এতটাই ভীড় যে আমার আর ওঠা হলোনা। ঠেলাঠেলি বাঁচিয়ে কোনরকমে সবাই বাইরে আসি তবে আমার কর্তাটি দেখে এলেন ওপরে উঠে। বাইরে এসে গ্ৰুপফোটো হলো তারপর অন‍্য ছবি যার যার নিজের মত। বাজপাখির পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার জন‍্য মোটামুটি লাইন দেওয়ার অবস্থা।যাইহোক সবটা সামলে আবার ফিরে আসা ঘোড়াগাড়ির সন্ধানে,আমাদের পাঁচশো এক নম্বর দেখলাম হাজির।বড্ড তাড়াহুড়ো করে আমাদের তুলে রওনা দিলো নীলনদের ধারে ক্রুজের কাছে। এডফুর সাধারণ বাড়ি ঘর আর গরীব মানুষজনকে দেখে মনে হলো আমাদেরই দেশের কোন ছোট শহর।যাক যুদ্ধজয় করে ঘোড়াগাড়ি থেকে নেমে সোজা চলে যাওয়া ব্রেকফাস্টের জন‍্য যেখানে আমাদের জন‍্য রকমারি বেকারি আইটেম,ডিম,সসেজ,স‍্যুপ, ফল,দই,দুধ,কর্ণফ্লেক্স,ফল অপেক্ষা করছে।সুতরাং চলো লেটস্ ইট ইয়াম ইয়াম।
             কদিন ধরে ভোরে রওনা দেওয়ার চক্কর তাই সেদিন খুব ভালো করে স্নান সারলাম তারপর দুপুরে খেয়ে একটা টানা দিবানিদ্রা ততক্ষণে আমাদের ঘরে রোদের আগমন তাই উষ্ণতাকে আলিঙ্গন করে একদম ঘুম। বিকেলে উঠে যথারীতি ছাদে গিয়ে চা কফি খেয়ে মন জুড়োলো।হাবিবি আগে থেকেই বলে রেখেছিলো সন্ধ‍্যের প্ল‍্যানের কথা,আমিও বেশ রোমাঞ্চিত কারণ ক্রুজ একটু একটু করে পাড়ি জমিয়েছে লাক্সারে।সেই বিখ‍্যাত লাক্সার,ট্রেনের জানলা থেকে যে স্টেশন দেখেছিলাম একসময় লাক্সার মিশরের রাজধানী ছিলো।
      যদিও রাতে কমোম্বো টেম্পল দেখেছি ভালোই লেগেছে তবুও দিনের আলোয় নীল আকাশের তলায় আর নীলনদের পাশে ফিলে টেম্পল দেখে খুবই মুগ্ধ হয়েছি।তাই মনে হলো ইশ্ যদি দিনের আলোয় লাক্সার দেখা যেতো!কিন্তু সেই এক কথা আবার বলবো মনের মত করে দেখা কিন্তু গ্ৰুপট‍্যুরে হবেনা।ওরা ওদের সুবিধা আর নিয়মমত চলবে। যেহেতু সকালে আমরা লাক্সার ছাড়বো তাই রাতেই মন্দির দেখা। তবে ওখানে গিয়ে দেখলাম শুধু আমরাই নই আরো হাজার হাজার লোক ভীড় জমিয়েছে মন্দির দেখতে। অসাধারণ অসাধারণ এই কথাটাই বার বার আমার মুখ দিয়ে বেড়িয়ে এসেছে মিশরে আর আমি একটু কল্পনাপ্রবণ তাই বারবার মনে হয়েছে এগুলো কি করে মানুষ সৃষ্টি করেছে! ধ‍্যাৎ হতেই পারেনা এগুলো মিশরীয় দেবতাদের বানানো। কি করে এত বড় বড় আকাশছোঁয়া থাম আজও এইভাবে দাঁড়িয়ে! আমি শুধু দেখেছি,গাইডের সব কথা কানে ঢোকেনি মানে কিছু ঢুকেছে কিছু ভুলেছি।আমি দেখেছি,ছবি তুলেছি আর ঠ‍্যালাঠুলির মধ‍্যেও অনুভব করার চেষ্টা করেছি।লাক্সার নীলনদের পূর্বতীরে অবস্থিত।যীশুর জন্মের প্রায় চোদ্দশো বছর আগের পুরোনো শহর।এখানে পূর্ব ও পশ্চিম দিক মিলে প্রায় চারটে মন্দির আছে তারমধ্যে রামেসেস টু এবং থ্রীর মন্দির বিখ‍্যাত যার একটার নাম লাক্সার এবং অন‍্যটির নাম কারণাক মন্দির।মিশরের অন‍্য মন্দিরের মত এই মন্দির কখনোই কোন দেবতার পূজোর জন‍্য বা মৃতমানুষের সমাধির জন‍্য ব‍্যবহার হয়নি।
        লাক্সার টেম্পল তৈরী হয়েছিলো রাজার শ্রেষ্ঠত্বর জন‍্য। রাজার রাজত্বের তিরিশ বছর পূর্ণ হলে হত এক বিরাট অনুষ্ঠান অনেকটা আমাদের পুরাকালের অশ্বমেধ যজ্ঞের মত এবং সেইরকম এক অনুষ্ঠানের সূচনায় রামেসেস বা অন‍্য রাজারা তার বংশের এখানে জয়ের উৎসব পালন করতেন।এমনকি অভিষেকের সূচনাও হত এখানে। রামেসেস এবং তার ছেলেদের মূর্তি আমরা দেখতে পাই এই মন্দিরে।ফ‍্যারাও এবং রানীরও মূর্তি আছে।শুধুমাত্র অবাক হওয়ার পালা যত ভেতরে প্রবেশ করেছি।বড় বড় থাম আকাশছোঁয়া তবে অনেকটাই ধ্বংসের মুখে তবুও যা আছে শুধুই বিস্ময় জাগায়। মন্দিরে ঢোকার মুখে ডান দিকে লাইন দিয়ে সিংহের মূর্তি দেখার মতই।শুনলাম বিশেষ ট্রেনলাইনের ব‍্যবস্থা হবে যাতে ছোট ট্রেনে করে পর্যটক একদম সেই সারিবদ্ধ সিংহের সামনে দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করতে পারবেন। গাইডের দেওয়া সময়ে চলে আসতে হলো কারণ ক্রুজে ফিরে ডিনার খেতে হবে।তবে মনটা আটকে রইলো সেই বিশালাকার মন্দিরের স্থাপত‍্যে,থামে আর রামেসেসের মূর্তিতে।স‍্যালুট রামেসেস,অনবদ‍্য তার চিন্তা আর ক্ষমতাকে বাস্তবায়িত করার দক্ষতা।যার জন‍্য গ্ৰীক বীর আলেকজান্ডারকেও আকর্ষণ করেছিলো মিশরের সভ‍্যতা।শোনা যায় আলেকজান্ডারের অভিষেকও হয়েছিলো এই লাক্সার টেম্পলে তবে তা ভিত্তিহীন বলা হয় কারণ আলেকজান্ডার লাক্সারে আসেননি শোনা যায়। যাই হোক যেতে যেতেও ফিরে চাইলাম বারবার,বাসে উঠেও চেয়ে রইলাম মুগ্ধতায়।
           ফিরে এলাম ক্রুজে, তাড়াতাড়ি করে যাওয়া ডাইনিং হলে রাতের ডিনারের জন‍্য। রাতে খাবার পর আবার মেতে ওঠা বেলিডান্সারের ডান্সে। তারপর শুভরাত্রি জানিয়ে রুমে ফিরে আসা। কালই শেষ ক্রুজে, কালকের পথ বেশ লম্বা ভ‍্যালি অফ কিংস আর সবচেয়ে বড় কারণাক টেম্পল দেখে একদম সোজা চলে যাওয়া হারগাদার দিকে।মরুভূমির পর সমুদ্রে চোখ রাখা দেখবো রেড সি। আজ এইটুকু থাক।
সমাপ্ত:-

#মিশর_এক_বিস্ময়#
            ( ৫)
#ভ‍্যালি_অফ_কিংস#
#কারনাক_টেম্পল#

শরীরের আলসেমি দূরে সরিয়ে সকাল সকাল ওঠা থাকে প্রতিদিনই।ক্রুজে থাকা শেষ তাই নীলের বুকে ভেসে বেড়ানো ছেড়ে পা রাখা মাটিতে একদম ব‍্যাগপত্র সমেত। আগে থেকেই জানতাম ভ‍্যালি অফ কিংস দেখে কারনাক টেম্পল হয়ে একদম চলে যাবো হারগাদা। তাই বাসের জানলায় বসে চোখ রাখা বাইরের দিকে।  অনেকেরই ইচ্ছে ছিলো হট এয়ার বেলুনে ওঠার তবে শুনলাম আবহাওয়া খারাপ আর খুব ভীড়ের কারণে বেলুনে ওঠা হলোনা।পরে বুঝলাম সবটাই হয়ত সময়ের টানাটানির জন‍্যই। প্রথমে আমরা যাবো ভ‍্যালি অফ কিংস,ভ‍্যালি অফ কিংস এক বিস্তৃত সমাধিক্ষেত্র যা মরুভূমির মধ‍্যে উঁচু ঢিবিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে । ভ‍্যালি অফ কিংসে পৌঁছনোর পর ছোট্ট কু ঝিক্ ঝিক্ গাড়ির মত হলুদ একটা ছোট চারিদিকে খোলা টয়ট্রেন আমাদের সামনে এলো আর আমরাও লাফ দিয়ে উঠে গেলাম সেটাতে।দুপাশে হলুদ হলুদ উঁচু ঢিপি মত।কি সুন্দর যে দেখতে লাগছিলো! ফটো তুলতে তুলতে পৌঁছে গেলাম রামেসেস ফোর এর সমাধির সামনে। আসলে একটা সময় ফ‍্যারাও আর রাজারা বুঝতে পেরেছিলেন সমাধি দেওয়ার জন‍্য সুউচ্চ পিরামিড বানানো সম্ভব নয় তাই মাটির নিচে প্রকোষ্ঠ করে এবং ধাপ কেটে সিঁড়ি বানিয়ে রীতিমতো অপূর্ব সুন্দর কারুকার্য করে ঘরগুলো সাজিয়ে তাতেই মমি রাখা হতো।ভ‍্যালি অফ কিংসে মোটামুটি প্রায় তেষট্টিটা সমাধি রয়েছে তার মধ‍্যে পাঁচ থেকে ছয়টা খুলে দেওয়া আছে দেখার জন‍্য।প্রত‍্যেকটাতেই ঢোকার জন‍্য টিকিটের ব‍্যবস্থা আছে।গাইডরা মোটামুটি তিন থেকে চারটে দেখায়।এখানে আছে সবচেয়ে কনিষ্ঠ ফ‍্যারাও তুতেনখামেনের সমাধিও।তার জন‍্য আলাদা টিকিটের ব‍্যবস্থা আছে অবশ‍্য। যদিও আমাদের ভ্রমণ সূচীর মধ্যে ছিলোনা তুতেনখামেনের সমাধি দেখানো।রামেসেস থ্রি,ফোর এবং ফাইভের সমাধির ভেতরে প্রবেশ করলাম।শুনে আশ্চর্য লাগলো প্রায় পাঁচশো বছর ধরে ভ‍্যালি অফ কিংস ফ‍্যারাওদের সমাধিক্ষেত্র হিসেবে ব‍্যবহার হয়েছে।এখানে তুতেনখামেনের সমাধি ছাড়াও টুথমোসিস ওয়ানেরও সমাধি আছে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে আশ্চর্য হলাম যীশুখ্রীষ্টের জন্মের বেশ কয়েক হাজার বছর আগে মিশরের উন্নত সংস্কৃতি, সভ‍্যতা এবং তাদের স্থাপত‍্য ও হাতের কাজ দেখে।মন কাড়লো দুপাশের দেওয়ালে আঁকা মিশরীয় দেবদেবীর চিত্র ও হায়ারোগ্লিফিক লিপিতে রঙের ব‍্যবহার‌।এখনো বেশ কিছু দেওয়াল খুব সুন্দর রঙের ছোঁয়ায় সাজিয়ে রেখেছে নিজেদের ভূপ্রকৃতির বিপর্যয়ের সাথে লড়াই করে।ধন‍্য.. ধন‍্য সৃষ্টি এছাড়া আর কিছুই বলতে ইচ্ছে করেনা। ঢোকার মুখ এবং ভেতরেও বেশ চওড়া,দরকারে হয়ত সেই সময় মানুষের প্রবেশও ছিলো সেখানে অর্থাৎ মৃত্যুর পরেও।মৃত‍্যুর পরেও যে আত্মা নশ্বর থাকে হয়ত সেই ধারণাতেই পরের জন্মের জন‍্য ব‍্যবহার্য অনেক কিছুই রেখে দেওয়া হত সেখানে।মানুষের লোভ এবং লুন্ঠন প্রবৃত্তির ফলে ধন সম্পত্তির কোন চিহ্ন না থাকলেও রয়ে গেছে অনাবিল সৃষ্টির নিদর্শন আজও।
                     সমাধিক্ষেত্র দেখে আমরা চলে এলাম হাতসেপসুতের মন্দিরের সামনে।যাকে বলে টেম্পল অফ হাতসেপসুত। তিন তলা এই মন্দির দূর থেকে দেখতে অপূর্ব লাগে। এই মন্দির নির্মিত হয়েছিলো রাণীর জয়ের নিদর্শন হিসেবে।হাতসেপসুত ছিলেন প্রথম মহিলা ফ‍্যারাও।তিনি ছিলেন প্রথম থুতমোস এবং তার রাণী আহমোসের সন্তান। পিতার মৃত‍্যুর পর তিনি তার সৎভাই দ্বিতীয় থুতমোসকে বিয়ে করেন এবং সিংহাসনে বসেন।অথচ তখন মহিলা ফ‍্যারাও ছিলো বিধি বহির্ভূত। প্রথমে আমি তো রীতিমতো রোমাঞ্চিত হলাম ভেবে খ্রীষ্টপূর্ব সময়েও একজন মহিলা প্রায় কুড়ি থেকে পঁচিশ বছর রাজত্ব করে গেছেন। মন্দিরের দ্বিতীয় তল নির্মিত হয়েছিলো রাণীর সোমালিয়া জয়ের নিদর্শন হিসেবে।
                  তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম সেই মন্দির যা আজও একজন নারীর জয়ের স্বীকৃতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। ভ‍্যালি অফ কিংস থেকে বেড়িয়ে বাসে উঠে একটু দূরেই চোখে পড়লো সুউচ্চ দুই মূর্তি যা অবশ‍্য যাওয়ার সময়েই দেখেছিলাম।আর সেখানেই দেখলাম ভাসমান হট এয়ার বেলুন। সত‍্যিই খুব সুন্দর লাগছিলো।ঠিক যেন নীল আকাশে লাল নীল সবুজ সাদা হলুদের মেলা। গাইডের কাছে শুনলাম এই দুই সুবিশাল মূর্তিকে কলোসি অফ মেমনন বলা হয়।আমেনহোটেপের ষাট ফুট উঁচু দুই মূর্তি হাঁটুতে হাত রেখে যেন পাহারায় বসে।আ্যগামেমননের নাম অনুসারে নাকি এই নাম তবে ভোরবেলা যখন হাওয়া বয় তখন নাকি এক সময় অদ্ভুত আওয়াজ বের হত এই মূর্তির মধ‍্যে দিয়ে যা শুনে কখনো মনে হত কান্নার আওয়াজ, কখনো বা চিৎকার,বাঁশীর শব্দ অথবা দৈববাণী।যাদের মুখগুলো এখন কালের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত তবুও সেই ষাট ফুট উঁচু মূর্তি দুটো আজও যেন পাহারা দিচ্ছে ভ‍্যালি অফ কিংসকে। তাকিয়ে বসে আছে নীলনদের দিকে অপার বিস্ময়ে। শোনা যায় এক সময় রোমান সম্রাট সেপ্তেমুস সেমেরুস এই মূর্তির মধ‍্যে দিয়ে বেরোনো অলৌকিক আওয়াজ শুনবেন বলে এসেছিলেন কিন্তু দুর্ভাগ‍্যবশতঃ কিছুই শুনতে পাননি।তাই তিনি মূর্তিদুটো সারানোর ব‍্যবস্থা করেন এবং সারানোর পর চিরতরেই আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়‌। আর আমিও মুগ্ধতায় আর বিস্ময়ে চেয়ে রইলাম ষাটফুট উঁচু মূর্তি দুটোর দিকে। যতক্ষণ দেখা গেলো।জানলা দিয়ে আমিও ফটো তুললাম, তবে নামা হলোনা।
                এর পরে ক্রোকোডাইল রেষ্টুরেন্টে খেয়ে যাবো কারনাক মন্দিরের দিকে।ক্রোকোডাইল রেষ্টুরেন্টে বাচ্চা কুমীরের তন্দুর দেখলাম। তবে আমাদের বুফে লাঞ্চে সেটা ছিলোনা।স‍্যালাড ভাত, রুটি, চিকেন, ফিসফ্রাই,ডেজার্ট, ফ্রুট ইত্যাদি দিয়ে বেশ জমিয়ে খেয়ে আবার চলা কারনাকের দিকে। কারনাক এক বিরাট,বিশাল সৃষ্টি।মিশরের মন্দির গুলোর মধ‍্যে বৃহত্তম।ঢোকার মুখেই দেখলাম ভেড়ার রাশি লাইন দিয়ে বানানো পাথরে খোদাই করে। কয়েকটার মুখ ভেঙে গেছে তবুও মুগ্ধতা রাখে।কারনাক সহ মিশরের সব মন্দিরের অন‍্যতম বৈশিষ্ট্য স্তম্ভের স্থাপত‍্য এবং খোদাই ও আকাশচুম্বী স্তম্ভগুলোকে সঠিকভাবে বসানো। কে করেছিলো এগুলো?মানুষ নাকি কোন দেবতা? শুধুই যা বিস্ময়ের ছাপ রেখে যায়।
        কারনাক টেম্পল আধুনিক লাক্সারে যার পুরোনো নাম ছিলো থিবস সেখানে নীলনদের পূর্বতীরে অবস্থিত।প্রায় একশো হেক্টর একর জুড়ে এই মন্দির। মন্দিরের মূল অংশ দেবতা আমুন রাকে উৎসর্গ করা হয়েছে এবং ছোট অংশ তার পত্নী মুটকে উৎসর্গ করা হয়েছে। উত্তরের অংশ যুদ্ধদেবতাকে এবং পূর্বের অংশ সূর্য দেবতা আটেনকে উৎসর্গ করা হয়েছে। মন্দির শুরুর কাজ চারহাজার বছর আগে শুরু হলেও দুহাজার বছর আগে রোমানরা মিশরের দখল নেওয়া পর্যন্ত এই কাজ চলেছিলো।ওয়াং আখ ইন্টেফ এই মন্দির বানানোর কাজ শুরু করলেও থুতমোস, হাতসেপসুত এবং তৃতীয় থুতমোসের আমলে এই মন্দির অনেকটাই সম্প্রসারিত হয়েছিলো।আগেই বলেছি কারনাক মন্দিরের স্তম্ভ গুলো দেখার মত এখানে আছে প্রথম থুতমোসের তৈরী ওয়াজেত হল যার দৈর্ঘ্য দুশো ছেচল্লিশ ফুট এবং প্রস্থ ছেচল্লিশ ফুট। এখানে হত ফ‍্যারাওদের অভিষেক এবং অন‍্যান‍্য গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান।মনে মনে কল্পনা করলাম বিশাল বিশাল স্তম্ভের সারি মাঝখান দিয়ে পথ।নিশ্চয় জাঁকজমকপূর্ণ সাজানো সমস্ত সুন্দর জিনিস ও মূল‍্যবান সজ্জায় তার মধ‍্যে দিয়ে ঘোড়াতে চড়ে আসছেন ফ‍্যারাও অথবা হাতসেপসুত একদম সোনায় মোড়ানো সাজে।উঃ! কি যে রোমাঞ্চিত হলাম বলার নয়।আমার কল্পনা তখন পিছিয়ে চলে গেছে এক নিমেষে চারহাজার বছর আগে।এরপর দেখলাম হাইপোস্টাইল হল যেখানে সুউচ্চ স্তম্ভের ওপরে ছাদ দিয়ে হল বানানো হয়েছে।বানিয়েছিলেন দ্বিতীয় রামেসেসের পিতা প্রথম সেটি। একশো চৌত্রিশটি স্তম্ভ ছিলো এই হলে যার দৈর্ঘ‍্য তিনশো সাত ফুট এবং প্রস্থ একশো সত্তর ফুট।
বারোটা থাম সবচেয়ে উঁচু,প্রায় সত্তর ফুট উঁচু। এই হলটা তৈরী হবার পর রাজ‍্যাভিষেকের অনুষ্ঠান এখানেই হত। এটা এত বড় যে প‍্যারির নোত্র দাম ক‍্যাথিড্রাল এর ভেতরে ঢুকে যেতে পারে।মন্দিরের শেষ বানানোর কাজ করেন মিশরের ত্রিশতম ফ‍্যারাও প্রথম নেকটানিবো। এরপর পারস‍্য,গ্ৰীক আর রোমানরা যথাক্রমে মিশরের সাম্রাজ্য দখল করে একে একে
রাজত্ব করে এবং কারনাক মন্দির পুরাতাত্ত্বিক সৌধে পরিণত হয়। দেখা শেষ হয়েও শেষ হয়না যেন হয়ত ভালো করে দেখতে এক মাস লাগবে সবটা।তবুও সীমিত সময় তাই সময়ের গন্ডীতে আবদ্ধ হয়ে মুঠোফোনে আর ক‍্যামেরায় কিছু মুহূর্ত বন্দী করলাম গোগ্ৰাসে জানি আর কোনদিন আসা হবেনা এখানে এই দেখাই শেষ দেখা। তারমধ্যে একটু ক্লান্ত হয়ে পায়ে ব‍্যাথা নিয়ে  বসেছি একখন্ড পাথরের ওপর।দেখছি সামনেই বেশ শান বাঁধানো জলাশয়,হয়ত রাজা ফ‍্যারাওদের প্রয়োজনীয় জল নেওয়া হত একসময়।তার সামনেই দেখলাম একটা পিলার মত কিন্তু চারপাশটা ঘেরা দেওয়া।আমাদের টিমের ছোট ছেলেমেয়েদের উৎসাহ আর হাসি শুনে উঠে গেলাম। তারপরেই শুনলাম এক প্রচলিত কথার কথা। ঐ থামকে পরিক্রমা করলে সাতবার ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে বন্ধন আরো দৃঢ় হয় মনের ইচ্ছে পূরণ হয়। সবার মত আমিও আমার জীবনসঙ্গীর হাত ধরে পায়ে ব‍্যাথা নিয়েও সাতবার ঘুরলাম এই প্রার্থনা নিয়েই ভালো রেখো ভালোবাসাকে। সেই বিয়ের সময়ের সাতপাকের বাঁধনকে আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়া অদ্ভুতভাবে সবাই স্বামী স্ত্রী যারা গ্ৰুপে ছিলো কেউই বাদ গেলোনা। আমরা ঘুরলাম আর ব‍্যাচেলার এক ভদ্রলোক আর হাবিবি হিসেব রাখলেন। বেশ একচোট হাসি আর মজা হলো।তারপর প্রচন্ড রোদে ঢকঢক করে কিছুটা জল খেয়ে আবার হাঁটা দিলাম।এবার ফেরার পালা..পেছনে ফেলে কারনাক টেম্পলকে পা বাড়ালাম বাসের দিকে জানি হেঁটে হেঁটে যেতে হবে অনেকটা পথ। রাস্তায় কিছু স্থানীয় মানুষ পসরা সাজিয়েছে আমাদের দেখেই মিষ্টি করে বললো..হ‍্যালো ইন্ডিয়া..শাহরুখ খান,অমিতাভ বচ্চন,করিনা কাপুর।বুঝলাম আমাদের দেশের হিন্দী সিনেমার ফ‍্যান এরাও। বাসে বসলাম,শরীরটা যেন বাঁচলো যেতে হবে অনেকটা পথ হারগাদা একদম রেড সির ধারে আফ্রিকান সৈকত শহর। ওখানেই বছরের শেষ দিনটা কাটিয়ে বর্ষবরণ করবো আমরা।
 সমাপ্ত:
          
             

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...