#অপ্রেমে#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
"লাভ মানে প্রেমে সেক্স থাকবেনা তা কি করে হয়!তোরা যা বলিস বল আমি কিন্তু একদম শরীরী প্রেমে বিশ্বাসী।আরে প্রেমে দেহমন মিলেমিশে এক হয়ে যাবে তবেই তো সেটা প্রেম।কোন মানুষকে ভালোবেসে মন এতটাই আবেগের স্রোতে ভেসে যাবে তখন শুধুই শুধুই থাকবে শরীরের উষ্ণতা। আমি একদম ঐ সব প্লেটোনিক লাভে বিশ্বাসী নই ভাই। "
চোখের ইশারা করে রাজেন," এখনো কেমন রসে বশে আছে দেখেছিস তো। আরে ঘরে বাইরে সমান তালে ব্যাটিং করছে একদম ব্যালেন্স রেখে।তাই সারাক্ষণ রসে টইটম্বুর।আরে পঞ্চাশ পেরোনোর পর মেয়েগুলো তো মানে বৌগুলো তো একদমই কেলিয়ে যায়।সারাক্ষণ ঐ খিচখিচ খ্যাচখ্যাচ আর না হলে ছেলেপুলে আর রোগভোগ। ছেলেরাও কি ভাঙেনা?হ্যাঁ তবে একটু পরে তারাও কেমন যেন চুপশে যায় অথবা ফুলে যায় । কারো ভুঁড়ি হয় আবার কারো বা মাথায় টাক আর গাল চোপড়া ভাঙে। সেখানে সমীরের তো গ্ন্যামার বাড়ছে দিনদিন। নিত্যনতুন জামা,এখন তো লালেও অরুচি নেই।যেখানে আমরা অনেকেই শান্তির রঙ সাদা বেছে নিয়েছি সেখানে ও বিপ্লবের লালেই আটকে। "
যাদের দেখে এত কথা তারা কোথায় থেকে গেলো আর ওরা এখন পুরো মজে রয়েছে আলোচনাতে।অবশ্য শীতের সন্ধ্যায় এমন আলোচনা স্বাস্থ্যের জন্য বেশ ভালো। যেমন সমীরের প্রেমের কথা বলতে বলতে গালদুটো চকচক করছে। তবে অন্যদেরও মন্দ লাগছেনা।শুধু একটু দমে গেছে দিব্যেন্দু ইশ্ কি মরতে যে বলেছিলো," আরে দেখ দেখ,ওহ্ ট্রেনের জানলায় বসে যে আর কত কি দেখবো ভাই।এখনকার ছেলেমেয়েদের প্রেম মানেই শরীরটাই বেশি।মাঠে ঘাটে কোথাও একটা পেলেই হলো।"
আর তাতেই শুরু হয়েছে সমীরের পাল্টা যুক্তির বেশ একটা জমাটি আলোচনা।
"অনেক হয়েছে যাও ভাই এবার বাড়ি,এই শীতে কফির সাথে আজ বেশ চনমনে প্রেম হবে মনে হচ্ছে সমীরের। কারণ মনটা একদম সেই প্রেমিকই রয়ে গেছে।"
"আরে মনটাকে প্রেমিকই রাখতে হয়,মনটাই আসল বয়েসটা তো শুধু একটা সংখ্যা।"
"যাক আমরা সবাই অনুপ্রেরণা নিয়ে গেলাম আজ তুমিও প্রেম হাতেই বাড়ি ফেরো বন্ধু।" মাঝবয়েসী আড্ডা বেশ জমে গেলো প্রেমের বন্যায়।
ট্রেন থেকে নামার আগে কল লিস্টে চোখ রাখে সমীর।হোয়াটস আ্যপটাও দেখে। প্রয়োজনীয় কিছু নম্বর রেখে অপ্রয়োজনীয় নম্বরগুলো ডিলিট করে দেয় কললিস্ট থেকে। চ্যাটটা ডিলিট করে দিতে গিয়ে মনটা কেমন যেন করে ওঠে। তবুও সাবধানী হওয়াই ভালো, আজকাল মৌ একটু যেন বেশিই সব কিছু জিজ্ঞেস করে। মাঝে মাঝে অসহ্য লাগে এমন তো আগে করতোনা কখনো।একটা মানুষ সংসারে বাজার হাট সবই করে দিচ্ছে,ছেলেকেও মানুষ করেছে একটা সময় দুজনে মিলে এখন তো একটু নিঃশ্বাস ফেলবে নাকি? তা নয় সারাক্ষণ কোথায় যাচ্ছো কি করছো কখন আসবে?লেগেই রয়েছে। আর কিছুদিন ধরে তো অযথা সন্দেহ করে চলেছে ওকে। তবে যা পারে করুক,অনেক কম্প্রোমাইজ করেছে জীবনে এইটুকু বন্ধুত্ব থেকে সরে আসবেনা কিছুতেই।
বাড়ির কাছে আসার আগেই ফোন বেজে ওঠে.."তুমি কোথায়?অনেকটা রাত হয়ে গেলো তো?"
"আরে কি মুশকিল, ট্রেনে ছিলাম।আজ ট্রেনের গন্ডগোল।"
"একটা ফোন করতে পারতে তো।"
"করা হয়নি,আর খুব দেরি তো হয়নি।এই চলে আসছি মিনিট দশেকের মধ্যে।"
"আচ্ছা শোন একটা সাদা তেলের প্যাকেট আর আলু নিয়ো।"
মৌয়ের কথাগুলো শেষ না হতেই অসহ্য বলেই ফোনটা কেটে দেয় সমীর। এই জন্যই এত ফোনে তলব।প্রেম শরীর সবটাই গিয়ে ঠেকেছে ঐ আলু আর তেলে।বাড়ি ঢুকে দেখবে মোটা শরীরটাকে একটা ঢলঢলে নাইটিতে ঢেকে থপথপ করে এগিয়ে আসছে ব্যাগ নিতে।আর তারপর কি কিছু থাকে?এদিকে শাড়ি কেনা চাই গাদাগাদা সব আলমারিতে জমছে।
সেক্স?সেটা তো মোটামুটি তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।আজকাল ওর নিজেরও ভালো লাগেনা নির্জীব শরীরটাকে জাগাতে।আরে মুখে যতই বলুক বয়েসটা তো হচ্ছে। তাই পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমোনো ছাড়া আর কিই বা করার আছে।
আলু তেলের প্যাকেট ঝুলিয়ে বাড়ি ফেরে সমীর।দরজাটা খুলে ওর দিকে তাকায় মৌ,আজকাল ওর মুখের দিকেও তাকায়না যেন সমীর ভালো করে।হাতে প্যাকেটটা ধরিয়ে জুতো খুলতে ব্যস্ত হয়ে যায়।
"তুমি চা খাবে তো?চা করি?"
আজকাল প্রায়দিন বাইরে থেকে চা খেয়েই ঢোকে সমীর। কেন যেন মনে হয় চাটাও মন দিয়ে বানাতে পারেনা মৌ। সংসার আর ছেলের চিন্তা ছাড়া জীবনে কিছুই নেই।
"না আমি চা খেয়ে এসেছি।"
একটা সময় সন্ধ্যেতে সমীরের হাতের ঠোঙার খাবার আর চা নিয়ে ওদের তিনজনের বেশ একটা জমাট আড্ডা হত। তার আগে তো বাড়িতে শ্বশুর শাশুড়ি আরো লোকজন ছিলো।মাঝে মাঝে চলে আসতো মৌয়ের মা বাবাও।তারপর একদম জমজমাট গল্প।কোথা দিয়ে যে সময় কেটে যেত। একটা সময় বোধহয় মানুষের জীবনে যোগ হয় আর তারপর শুরু হয় বিয়োগের খেলা। মৌয়েরও আজকাল তেমনই মনে হয়। বিয়োগের খেলাটা খেলতে যেন আর ভালো লাগছেনা ওর তবুও জানে এই খেলাটাই খেলতে হবে জীবনের বাকি বছরগুলোতেও। সমীরকে একদিন দুদিন বলতে গেছিলো।"সারাদিন রান্নাবান্না ছেড়ে একটু আউটলুক বাড়াও তো।বাইরের খোঁজখবর একটু রাখো। আমি ছেলেকে বলছি দাঁড়াও।"
যে মানুষটাকে এতদিন সব বলে এসেছে মন খারাপ,রাগ,দুঃখ,অভিমান আর প্রেম সেও কেমন যেন আজকাল ছেলেকে দেখিয়ে দেয় ওকে।মৌ বুঝতে পারে মেয়েরা প্রথমে বাবার কাছে পালিত,তারপর স্বামীর কাছে আর তারপর সন্তানের কাছে কথাটা কতটা সত্যি। কে জানে একটু কি বেশিই করে ফেলেছে সংসারের জন্য?একটা সময় সবাইকে খুশি করার জন্য সবার পছন্দমত রান্না,ঘর গোছানো এমনকি বাজার সব এক হাতে।এছাড়া ছেলের আনা নেওয়া,টিউশন,পড়া দেখা সবটাই। এখন কেমন যেন আর মনের জোর পায়না মৌ। হয়ত একটা সময় প্রশংসা আর ভালোবাসা মনের জোর বাড়িয়ে দিয়েছিলো অনেকটাই।শ্বশুরমশাই পাত চেটে খেতেন,রাতে সমীর কাছে টেনে আদর করে বলতো,"আমার মিষ্টি বৌটাকে কতক্ষণ বাদে কাছে পেলাম।" অথবা রাত জেগে গান শুনতে শুনতে সমীরের আদরে ঘুমিয়ে পড়া ওকে জড়িয়ে ধরে।
আদুরে গলায় মৌ বলতো,"আমাকে অনেক অনেক পরেও এতটা ভালোবাসবে।মানে আমি যখন বুড়ি হয়ে যাবো তখনো।"
মৌকে নিজের শরীরের উষ্ণতায় ভিজিয়ে দিতে দিতে সমীর বলতো," আমি আরো বেশি বেশি ভালোবেসে তোমাকে কখনো বুড়োই হতে দেবোনা।দেখো তুমি। এখন আদর করতে দাও সময় নষ্ট হচ্ছে কিন্তু।"
রান্নাঘরে ঢোকে মৌ রাতের কাজগুলো গোছাতে।সমীর ফ্রেস হবার উদ্যোগ নেয়। পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতে মৌয়ের হাসি পায় সময়ের নিয়মে মানুষ বুড়ো হয় আর ভালোবাসাও বোধহয় কমতে থাকে।হয়ত এইভাবেই মায়া কেটে যায়। তাই তো সমীর সারাদিনে একবারও ফোন করে জিজ্ঞেস করেনা একা বাড়িতে ও কি করছে?একদিন বলাতে বলেছিলো.."অফিসে যে কি চাপে থাকি তা বুঝবেনা তুমি।"
আর অভিযোগ করেনা মৌ তবে অভিমান হয়।আচ্ছা বয়েস বাড়ে,আবেগটা তো কমতে পারে।এত অভিমানে কষ্ট হয় কেন কে জানে? " মা তুমি একটা কিছু করো, খুব ইনসিকিওরড হয়ে যাচ্ছো মনে হচ্ছে।বাবাও তাই বলছিলো।"
"আরে তোদের জন্য চিন্তা করবোনা?সারাজীবন তো সংসারই করেছি বাবা।"
অভিযোগ না করে ওরা যদি ওকে একটু বুঝতো।যদি একটু ভালো করে কথা বলতো। খাবার গুলো গরম করে রেডি করে মৌ।সমীর খুব হেসে কথা বলছে। কে ফোন করেছিলো?
"ঐ পরের উইকএন্ডে দুদিনের জন্য একটু বেরোবো তাই প্ল্যান হচ্ছিলো।"
"কোথায় যাবে?আমিও যাবো তো?"
"আরে না না আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে যাবো।একদম পুরুষদের ট্রিপ।তোমাকে নিয়ে যাওয়া যাবেনা।আর ঐ সময় তো ছেলে থাকবে বাড়িতে।"
সমীরের খাঁটি পুরুষদের ট্রিপ এখন মাঝেমাঝেই হয়। মৌয়ের প্রচন্ড ব্লিডিং হচ্ছে বসলেই কাপড় নষ্ট হবার জোগাড়। বলেছিলো,সমীর পাত্তা দেয়নি.."আরে রেস্ট নাও ঠিক হয়ে যাবে।মাত্র তো দুটো দিন ঠিক কেটে যাবে।"
কেটে গিয়েছিলো খুব কষ্টে কোনরকমে দিন শুধু মনের কোণে কিছু ব্যথা রয়ে গিয়েছিলো জমে যা কাটেনি।
সমীরকে মাঝে মাঝেই মিসিং দেখে বন্ধুরা। একঘেয়ে দাম্পত্যের মধ্যে সমীরের একফালি চাঁদ চন্দনা।চন্দনাও মাঝবয়েসী তবে মৌয়ের মত নয়।বাস্তবে পা রেখে চলে..সিঙ্গেল মাদার হয়েও বেশ সামলাচ্ছে ঘরে বাইরে। ওর গোছানো পরিপাটি চেহারা আর সব কিছুই, তাছাড়া অফিসের ব্যাপারে অনেকটাই সাহায্য পায় ওর কাছে।আবার কখনো নিজেও করে চন্দনার সমস্যা হলে।
" বাহ্ সমীরদার তো গ্ল্যামার দিন দিন বাড়ছে। বেশ লাগছে মানে বয়েস কমে গেছে তো টি শার্ট পরে।দাঁড়ান একটা ছবি তুলি বৌদিকে পাঠিয়ে দিন।"
চন্দনার কথায় বুকটায় হাল্কা একটা স্রোত বয়ে যায় কুলকুল করে।বেশ হিরো পোজ নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। "বাহ্ দারুণ লাগছে আমাদের সাথেও একটা হয়ে যাক এবার।"
চন্দনার ঘা ঘেঁষে দাঁড়ায় সমীর,ওর শরীরের পারফিউমের গন্ধটা বেশ লাগে। মৌটা আজকাল গন্ধও মাখেনা,বিয়ে বাড়ি গেলেও অনেক সময় মিস্ করে যায় ভুলে গেছে বলে। চন্দনার সঙ্গে কথা বলতে আজকাল বেশ ভালো লাগে এ যেন হঠাৎই এক ফালি রোদ এসে ঢুকেছে সমীরের মাঝবয়েসী বারান্দায়।প্রায়দিনই অফিসের ব্রেকে ক্যান্টিনে বা ছুটির পর একসাথে যতটুক থাকতে পারে সেটাকেই মন ভরে উপভোগ করে নেয় সমীর। তাই মাঝেমাঝেই মৌকে আর টিফিন করতে হয়না। কেউ খাওয়াবে বলে দেয়।
আজকাল শরীরটাও খুব একটা সঙ্গ দেয়না মৌয়ের,এটা সেটা লেগেই আছে।নিজেরও মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে। মন কি শরীর চালায়?নাকি মন ভালো থাকেনা তাই শরীরও ভালো থাকেনা? কে জানে? এই কয়েক মাসে বেশ ওজনও বেড়েছে বুঝতে পারে। সমীরকেই বা কি বলবে মাঝে সবকিছুই পরীক্ষা হলো। তেমন কিছু ধরা পড়েনি। সকাল থেকেই গাটা বেশ গরম লাগছে শরীরটা ভালো নেই,তবুও কাজগুলো করে নেয় মৌ।এই সময় সমীরেরও খুব তাড়া থাকে আর না থাকলেই বা কে ওর খোঁজ নেয়।কত রাতই তো পাশ ফিরে শুয়ে মৌ ভাবে হয়ত সমীর আদর করে ওকে টেনে বুকের কাছে জড়িয়ে রাখবে। কিন্তু দিব্যি ও রান্নাঘর সেরে আসার আগেই ঘুমিয়ে যায় দেখেছে। সমীরের চলে যাবার পর আর ভালো লাগেনা শুয়ে পড়ে মৌ,সারাটা দিনই জ্বরে বেহুশ লাগে।কোনরকমে দুপুরে একটু খেয়ে ওষুধটা খেয়ে শুয়ে থাকে বিকেলের দিকে একটু ভালো লাগে। বেশ অনেকটা রাত হয়ে যায় দেখতে দেখতে এতক্ষণ তো সমীরের চলে আসার কথা,আজ সারাদিন ফোনও করেনি।অভিমানে ও নিজেও করেনি। তবুও আর পারেনা ফোন করে, ফোনটা রিঙ হয়ে যায়..কিছুটা বাদে রিঙ ব্যাক করে সমীর।নিশ্চয় কিছু আনতে হবে,পেয়েছে এক গাধাকে।আর না এবার ও চুটিয়ে বাঁচবে ঘরে আর অফিসে ব্যাটিং করবে নিজের মত। যে যা খুশি ভাবুক।সংসার সংসার করে বন্ধু বান্ধব,শখ আহ্লাদ সবই তো ছেড়েছে।
"তুমি কোথায়?"
"কেন?খুব জ্যাম আটকে আছি। আসছি।"
"অফিস তো অনেক আগে ছুটি হয়ে গেছে তাইনা?
"মুশকিল তো তুমি কি জেরা করার জন্য ফোন করেছো?"
বিরক্ত হয়ে ফোনটা কেটে দেয় সমীর। বাড়িতে আসার একটু বাদেই চন্দনার ফোন আসে.."হ্যাঁ হ্যাঁ নো প্রবলেম।পৌঁছে গেছি ঠিকমতো।তুমি পৌঁচেছো তো?"
" কে ফোন করেছিলো?"
গলাটা কড়া হয়ে যায় সমীরের তোমারও তো ফোন আসে আমি কি জিজ্ঞেস করি?
চন্দনা ফোন করেছিলো। এক জায়গায় গিয়েছিলাম তাই পৌঁছালাম কিনা জানলো।"
"আমার খুব জ্বর এসেছে।"
"ওষুধ তো ঘরেই ছিলো খাওনি?"
"খেয়েছি,তবুও ভালো লাগছেনা।মাথাটা খুব ভার।"
"ঘুমিয়ে যাও ঠিক হয়ে যাবে।"
সমীর দিব্যি পাশ ফিরে শুলো একবারও মৌয়ের গায়ে হাত দিয়েও দেখলোনা জ্বর কেমন। কেমন যেন সব বদলে গেলো খুব তাড়াতাড়ি বাবান হস্টেলে চলে যাবার পর। অথচ আগে এমনটা ছিলোনা,কত সময়ই ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে যত্নে সমীর।আলতো আদরে টেনে রেখেছে একদম বুকের কাছে,কথা বলতে গেলে চুমুতে ঠোঁট বুজিয়ে দিয়েছে। মৌয়ের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে ফোঁটা ফোঁটা অজান্তেই ভিজে যায় বালিশটা এভাবেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলো।
সকালে ঘুম ভাঙতে দেরি হয় মৌয়ের,কালকের কিছু রান্না আছে তাই দিয়ে হয়ত সমীরেরটা হয়ে যাবে। দেখে সমীর ততক্ষণে মর্ণিং ওয়াকে চলে গেছে। ও ফিরতেই মৌ বলে শরীরটা ভালো লাগছেনা প্যারাসিটামলে কাজ করছেনা ডাক্তার দেখাতে হবে মনে হয়।
" এমন কিছুনা মৌ, ডাক্তার দেখানোর মত,তবে আমাকে বেরোতেই হবে বিশেষ দরকার আছে অফিসে।আচ্ছা আমি রূপাকে ফোন করে দিচ্ছি ও তোমাকে নিয়ে যাবে তেমন হলে।"
রূপা রাজেনের বৌ,আসে মাঝে মাঝে ওদের বাড়ি।
হঠাৎই গলাটা চড়ে যায় মৌয়ের "তুমি একদম কাউকে বলবেনা আমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা। আমি একাই পারবো।তুমি যাও অফিসে।"
অফিস যাওয়ার আগে কথা না বাড়িয়ে চুপ করে চলে যায় সমীর।
বিকেলের দিকে একাই ডাক্তার দেখিয়ে আসে মৌ,ডাক্তার আশ্চর্য হয়ে যান ওকে একা দেখে। ওষুধ খেয়েও টানা পাঁচ ছয়দিন ভুগলো মৌ।সেরে উঠতে উঠতে এক সপ্তাহ গেলো তাও পুরো নয়। ঐ কদিন সমীরের কোন সহানুভূতি যা হয়ত ওর একান্ত চাওয়ার তা পেলোনা।মৌয়ের খুব মন খারাপ হলো।ভেতরের অভিমান ফেটে বেরোলো যেদিন সমীর ওকে অসুস্থ দেখেও ছুটির দিনে থিয়েটার দেখতে চলে গেলো কোন কথা না বলে।
"আমি অসুস্থ আর তুমি আনন্দ করে বেড়াচ্ছো। একবারও তোমার মনে হলোনা একা বাড়িতে আমি এভাবেই পড়ে থাকবো।"
"তুমি তেমন কিছু অসুস্থ নও মৌ,অনেকটাই তোমার মানসিক।ওখানে একটা আমন্ত্রণ ছিলো।"
" সব বুঝি আমি আর চন্দনার যেদিন কি একটু শরীর খারাপ হলো সেদিন তুমি রাত্রি সাড়ে এগারোটার পর বাড়ি এলে।"
"ছিঃ মৌ!ছিঃ ছিঃ আমি ভাবতেও পারিনা তুমি এত নীচু মনের। বেশ করেছি গিয়েছি,হ্যাঁ বেশ করেছি।ওর দরকার ছিলো আমাকে।তোমার দরকার ছিলো বলে আমি মনে করিনা। এত সন্দেহ তোমার!"
কথায় কথা বাড়লো আর মৌয়ের বুকে ছিঃ ছিঃ ছিঃ কথাটা তীরের মত বিঁধলো।এত বছরেও যা হয়নি তাই করলো সমীর মৌকে একা ঘরে রেখে পাশের ঘরে ঘুমোলো।মৌয়ের সাথে শুতেও আর ওর ইচ্ছে নেই। চোখের জলে আবার ভিজলো বালিশ। কোনদিনই সমীর ওকে ছেড়ে আলাদা শোয়নি,ও তো জানে মৌ একা শুতে পারেনা তবুও!
মাঝে কেটে গেছে তিনদিন মৌ অনেক অনুরোধ করে ফিরিয়ে আনে সমীরকে বেডরুমে ওদের মাঝে যেন এক অনন্তকালের দূরত্ব।একটা সময় মৌ রাগ করলে যে করেই হোক রাগ ভাঙাতোই আর তারপর আদরে আদরে ভিজিয়ে একদম কাছে টেনে নিতো।
মাঝে কেটে গেছে বেশ কিছুদিন অগোছালো মন আর অগোছালো ঘরকে আবার নতুন করে সাজাতে চায় মৌ।সমীর একটু সাবধানী হয়েছে তবে চন্দনার সঙ্গে বন্ধুত্ব বেড়েছে অনেকটা। মৌয়ের সঙ্গে যতটা শীতলতা বাড়ছে চন্দনার সঙ্গে ততটাই উষ্ণতা বাড়ছে। আজকাল ছুটির দিনেও সমীরকে অস্থির দেখে মৌ,হঠাৎ হঠাৎই না বলে বাইরে চলে যায়। সমীর শনিবার রবিবারেও চন্দনাকে ফোন না করে থাকতে পারেনা। কথা বললে মনটা ভরে যায় না বলতে পারলেই ছটফট করে মনটা।
মৌয়ের সেদিনের অভিযোগ ভালোই মনে ছিলো সমীরের তাই হঠাৎই বলে," অনেকদিন দুজনে থিয়েটার দেখিনা যাবে সামনের সপ্তাহের শেষে তাহলে টিকিট কাটি?"
সম্পর্কের বরফটুকু গলাতে চাইলো মৌ ও.."হ্যাঁ যেতে পারি।আগে তো কত যেতাম।এখন তুমিই একা চলে যাও।"
নাহ্ তোমাকে নিয়ে আর পারিনা কবে গেছি একা তোমায় ছাড়া?আচ্ছা টিকিট কেটে তোমাকে বলবো। মনে মনে প্ল্যান করে মৌ,আলমারি খোলে ভাবে কোন শাড়িটা পরবে। নীল না সবুজ,নাকি লাল?নাহ্ বেশ অন্যরকম সাজবে সেদিন।
দেখতে দেখতে সপ্তাহ প্রায় শেষের দিকে সমীর কিছু বলেনা।মৌ ভাবে টিকিট পায়নি হয়ত যাওয়া হবেনা। দুপুরে ফোন করে সমীর অবাক হয় মৌ,আজকাল তো ফোন করাই ছেড়ে দিয়েছে তাহলে নিশ্চয় যাওয়া হবে থিয়েটারে।অনেকদিন বাদে সেজেগুজে রবীন্দ্রসদনে অপেক্ষা করবে সমীর অফিস ফেরার পথে এসে দাঁড়াবে মুগ্ধ চোখে ওকে দেখবে আগের মত।ঠিক আগে যেমন হত....
ফোনের কথাগুলোতে হঠাৎই স্বপ্নের জালটা কেটে যায়.."শোনো আমার আজ ফিরতে দেরি হবে এই দশটা সাড়ে দশটা।"
"কেন?"
"ঐ থিয়েটার দেখে আসবো।"
মৌয়ের খুব ইচ্ছে করছিলো বলতে,"আমারও তো যাওয়ার কথা ছিলো,তুমি বলেছিলে।আমি যাবোনা?"
কেন যেন এক অদ্ভুত অভিমান গলাটা আটকে দেয় সেখানে জমে শুধু কান্না আর ক্ষোভ আর সন্দেহ।কে যাচ্ছে তাহলে ওর সাথে?চন্দনা?মনটাকে ঘুণপোকা কুরে কুরে শেষ করে।সমীর তখন রবীন্দ্রসদনে সাথে চন্দনা। থিয়েটারের কথা শুনেই বলেছিলো.."সমীরদা,থিয়েটার কতদিন দেখিনি।"
তাই সমীর পারেনি মৌকে ছেঁটে ওকে লিস্টেড করে নিয়েছিলো। সত্যিই মেয়েটার জন্য খারাপ লাগে,সিঙ্গেল অনেক কিছু লড়াই করে বাঁচে।
সমীর ফিরেছিলো রাতে মৌয়ের ইচ্ছে হয়নি ওর সাথে ভালো করে কথা বলতে।বোবা কর্তব্যটুকু করে যাচ্ছিলো কোন রকমে। মৌ এক সময় অন্ধের মত বিশ্বাস করতো সমীরকে,হয়ত নিজের থেকেও বেশি কখনো। কিন্তু সমীর একটু একটু করে সেই বিশ্বাস ভেঙেছে,মৌকে ঠেলে দিয়েছে এক অন্ধকার গুহার দিকে যেখানে শুধুই অবিশ্বাসের পাহাড়। কেন এমন হলো?মৌ তো চায় বিশ্বাস করতে,আপনজনের সংখ্যা কমতে কমতে সমীর আর ছেলে ছাড়া আর তেমন কেই বা আছে ওর জীবনে?তবুও কেন এমন হলো?কত কষ্ট করেছে এক সময় হাসিমুখে সংসারটা দাঁড় করাতে।কখনো কোনদিনই নিজের কোন দাবী রাখেনি।তাহলে কি কিছু দাবী সত্যিই রাখতে হয়?যেমন রূপা বলে.."আমি ভাই জোর করে আদায় করে নিই আমার যেটুকু লাগবে।''
মৌ তা করেনি উল্টে স্পেশ দিয়েছে বরাবরই সমীরকে সব সময় খেয়াল রেখেছে ওর শরীরের মনের,খাবার দাবারের,জামাকাপড়েরও। তাই কি আজ এমন হলো?কিন্তু কাকে বলবে ও?ছেলেকে?সমীরকে?কে বুঝবে ওর ছোটছোট কষ্টগুলো আর না পাওয়ার যন্ত্রণা? কখনো ঝগড়া,কখনো রাগ,কখনো কথা কাটাকাটি আর নির্বাক অভিমানে ওদের সম্পর্কটা কেমন যেন হয়ে গেছে।দুজনেরই দুজনকে অসহ্য লাগে আজকাল মৌ বোঝে।কিন্তু ওর জীবনে সমীরই একমাত্র পুরুষ, ও সমীরকে ভালোবাসে সারাজীবন ভালোবাসতে চায়।তবুও এই যন্ত্রণাগুলো ওকে পাগল করে তোলে।মনটাকে ছিঁড়ে কেটে টুকরো টুকরো করে দেয়। অস্থির লাগে,অসুস্থ লাগে কখনো মাথার পেছনে ব্যথা করে বমি পায়।
"ভাবছিলাম একটু কাউন্সেলিং করালে কেমন হয়?আমার মনটা ভালো যাচ্ছেনা।"
"মনের ভেতরে সন্দেহ আর রাগ পুষে রাখলে হবেনা।ওসব কাউন্সেলিং এ কিছু হবেনা সাইক্রিয়াটিক ডঃ দেখাতে হবে।"
মাথাটা গরম হয়ে যায় মৌয়ের.."কেন আমি কি পাগল?আর কত অকর্মণ্য প্রমাণ করবে আমাকে?
"মানে আমি কি করেছি?তুমিই তো বলছো তোমার মন ভালো নেই সমস্যা হচ্ছে।"
"আমি কথা বলতে চাই,আমার মনের কথাগুলো।মনের ছোট ছোট দুঃখগুলো শেয়ার করতে চাই যেগুলো তোমরা কেউ বুঝবেনা।এত সন্দেহ আর অবিশ্বাস নিয়ে আমি বাঁচতে পারছিনা।"
একটা আর্তনাদের সুর খান খান হয়ে ভেঙে দেয় ওদের ঘরের ভারী বাতাসটা। তবে সেই বাতাসে জমে যাওয়া বাষ্প আর মৌয়ের চোখের জল কোনটাই যেন তেমনভাবে ছুঁলো না সমীরকে। মৌ একটু শুধু একটু ভালোবাসার ছোঁয়া চাইলো যা হয়ত সারিয়ে দিতে পারে অনেক যন্ত্রণা এক নিমেষে। "আমাকে তুমি একটু বোঝো প্লিজ।আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি,এভাবে আর আমাকে কষ্ট দিয়োনা।তুমি শুধু তুমিই পারো সবটা ঠিক করে দিতে।কোন ডাক্তার আমার লাগবেনা।"
একটা তাচ্ছিল্যের হাসি খেলে যায় সমীরের মুখে,"আমি কি করলাম বলতো?বাড়ি আসছি,বসছি,শুচ্ছি,বাজার করছি,তোমাকে নিয়ে এইতো সেদিন সিনেমায় গেলাম,ঘুরে এলাম।আর কি করবো?আমি তো বুঝতেই পারছিনা কেন এমন করছো?"
মৌয়ের গলায় কান্না জড়ানো অভিমান ঝরে পড়ে " তুমি সেদিন আমাকে বলেও আমাকে নিয়ে থিয়েটারে যাওনি। বলো সেদিন চন্দনাকে নিয়ে গিয়েছিলে কিনা?বলো?"
" হ্যাঁ গেছিলাম।বলছি তো গেছিলাম।তবে সঙ্গে আরেকটা বন্ধু ছিলো দুজনে একা যাইনি।"
যা সন্দেহে ছিলো এতদিন সমীর তা স্বীকার করলো অপকটে আর মৌ যেন ভেঙে গেলো চুরমার হয়ে ওর নির্লজ্জ বেপরোয়া ভাবে।
একটু আদর,একটু ভালোবাসা, একটু নির্ভরতার আশ্রয় হয়ত সমীর দিতে পারতো সেদিন যখন মৌ লুটিয়ে কেঁদে অস্থির হচ্ছিলো। না সমীর সেভাবে কাছে টেনে নেয়নি ওকে,নিজেকে খুব দামি মনে হয়েছিলো সেই সময় কারণ দুজন নারী তাকে কাছের করে চায়। একজনকে অনেক দিয়েছে এবার চন্দনাকেও ভালো রাখবে।আর মৌকে তো ও ছেড়ে যাইনি।এই বয়েসে এর থেকে আর বেশি কি দেবে? সংসার সংসার করে তো নিজেকে নিংড়ে দিয়েছে একদম।এবার নিজের পছন্দ অপছন্দ নিয়ে বাঁচবে।
পরদিন যথারীতি অফিস চলে যায় সমীর। অফিসের হাসি মজায় আর কাজের ব্যস্ততায় বাড়ির সুইচটা অনেকক্ষণ অফ হয়ে গেছে। আজকাল সমীরেরও দমবন্ধ লাগে মৌয়ের ভালোবাসায়।একসময় যেটা ফুলের মালা ছিলো আজ যেন পরাধীনতার শিকল মনে হয়।
সন্ধ্যের দিকে ছেলের ফোন আসে.."হ্যালো বাবা,তোমার সাথে মায়ের কথা হয়েছে?আমাকে প্রতিদিনই ফোন করে একবার দুপুরে আজ করলোনা। বিকেল থেকে অনেকবারই ফোন করছি ধরছেনা অথচ রিং হয়ে যাচ্ছে।"
" দ্যাখ হয়ত ফাঁকা বাড়িতে ঘুম দিচ্ছে তাই ধরছেনা। আরেকবার দ্যাখ করে।আচ্ছা আমিও দেখছি একবার।"
অনেকদিন বাদে সমীর ফোন করছে মৌয়ের ফোনে।আজকাল মৌ ফোন করে ঘুরে ফিরে বিরক্ত হয় সমীর। রিং হয়ে গেলো বারবার।দশমিনিট বাদে আবার করলো তখনো নো আনসার। অগত্যা পাশের ফ্ল্যাটে ফোন করলো,ধুস্ ওরাও নাকি বাড়ি নেই তখন। কেয়ারটেকার গিয়ে বেল বাজিয়ে বাজিয়ে ফিরলো। এবার সমীরের কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে,কালকে রাতে মৌয়ের লুটিয়ে লুটিয়ে কান্না চিৎকার সবটাই মনে হলো।তাহলে কি খারাপ কিছু?না না ছেলেকে চোখে হারায় মৌ,সংসারকেও খুব ভালোবাসে আর ওকে,হ্যাঁ ওকেও ভালোবাসে হয়ত অনেক অনেক বেশিই ভালোবাসে... আজ যেন এক কথায় উত্তর পেয়ে গেলো সমীর।ছেলে বার বার ফোন করছে,কাউকে তেমন কিছু না বলেই ট্যাক্সি নিয়ে বাড়িতে ছুটে আসে সমীর।তার মাঝেই চন্দনার ফোন আসে ফোনটা ধরতে ইচ্ছে করেনা সমীরের।নিশ্চয় বাড়ি যাবে বলে ওকে খুঁজছে।ওর সারা শরীর তখন কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে বার বার মৌয়ের মুখটা মনে পড়ছে। কি হলো এমন?এরপর কি হবে?..."মৌ প্লিজ তুমি কিছু কোরনা,আমি যদি কিছু করে থাকি শুধরে নেবো..শুধু তুমি থেকো,তুমি থেকো এই পৃথিবীতে।" আবার ফোন বাজে,ছেলেটা ফোন করছে,"তুমি কোথায় এখনো যাওনি?প্লিজ জানাও আমাকে প্লিজ।"
ওর গলাটাও খুব কান্নাভেজা লাগে।ছোট থেকে মাকে জড়িয়ে বড় হয়েছে ছেলে।ও আর কতটুকু সময় দিতে পারতো।ফ্ল্যাটের নিচে দুএকজন কথা বলছে ওকে দেখে এগিয়ে আসে। সমীরের মাথা তখন কাজ করছেনা....কি জানি কি দেখবে?
দরজা ভেঙেও মৌকে দেখা গেলোনা সমীর তখন পাগলের মত ঘরগুলো খুঁজছে।আ্যটাচড্ বাথরুমটা বন্ধ,সেখান থেকে মৌকে পাওয়া যায়।মেঝেতে পড়ে আছে। ছুটোছুটি আ্যম্বুলেন্স,ডাক্তার,আইসিউ..একটা সাঙ্ঘাতিক ট্রমা আর আ্যটাক। মেয়েদের এই বয়েসটা নাকি ভালোনা,খুবই বিপদজনক। চারদিন পর মৌ চোখ খোলে। এই চারদিনে সমীর বুঝতে পেরেছে, মৌ সংসারে কি করত।অথচ একটা সময় মনে হত কত কিছু করতে পারে অথচ করেনা,শুয়ে বসেই দিন কাটায়।ছেলেটাও এসে গেছে।বাড়িটা বড় প্রাণহীণ,অগোছালো। সত্যিই কি মেয়েরা ঘরের সৌন্দর্য্য?কে জানে হয়ত বা তাই,তাই হয়ত ওদের ঘরের লক্ষ্মী বলে। হসপিটাল থেকে চোখ খোলার খবরটা শুনে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয় সমীর।তাড়াতাড়ি ছেলেকে নিয়ে যায় সেখানে।
"হ্যাঁ একশো সাত নম্বরের বাড়ির লোক এখান থেকে ফোন করেছিলো কিছুটা আগে।দেখা করবো।"
"একটু ওয়েট করুন,আমি কথা বলে জানাচ্ছি।"
"ওরা অপেক্ষা করে। "হ্যাঁ আসুন তবে একজন,পেসেন্টের ক্রাইসিস কাটলেও উত্তেজনা চলবেনা।"
"তুমি যাও বাবা,তারপর আমি যাচ্ছি।"
"দাঁড়ান,এক মিনিট। সায়ন কে?সে আসুন।"
ছেলেকে পাঠিয়ে দেয় সমীর হয়ত মৌ ছেলের নামই করছে।আর করবেই তো,হয়ত খুব কষ্ট পেয়েছে মনে মনে। কিন্তু ভালো করে বুঝিয়ে বললেই তো পারতো সমীরকে ওভাবে ঝগড়া না করে ।এখন মনে মনে যাই ভাবুক সমীর হয়ত মৌয়ের ভালো মন্দ তখন কিছুই ভালো লাগতোনা ওর।
সাতদিন পার হয়ে গেছে মৌ এখনো সুস্থ নয় পুরোপুরি।তবে সমীরকে এখনো দেখা করার অনুমতি দেয়নি ডঃ।সারাদিনে খুব বেশি হলে নাকি চারটের বেশি কথা বলেনা।
"শুনুন, ওনার খুব যত্নের দরকার।মনে হয় অনেকদিন ধরে চাপা কোন মানসিক চাপে আর কষ্টে এতটা অসুস্থ হয়েছেন।আমরা স্ক্যানও করেছি ব্রেনের,খুব একটা খারাপ কিছু নয়।তবে একটু সময় লাগবে।বেশিরভাগ সময় শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন,নাহলে ভয় পান। মনে হয় অনেক মানুষ মিলে ওর সব কেড়ে নিচ্ছে। দেখছি আমরা কাউন্সেলিং করাতে হবে,ফিজিও চলছে।"
প্রায় দশদিন বাদে মুখোমুখি হয়েছে সমীর মৌয়ের।তার আগে দেখে গেছে বেশ কয়েকবার ঘুমন্ত মৌকে। কেমন একটা শুকনো, সাদা মুখ, হাতগুলো বুকের কাছে রেখে ঘুমোচ্ছে।মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে।চিরকাল দেখে এসেছে মৌ একা সব সামলাচ্ছে,দৌড় ঝাঁপ করছে কখনো চ্যাঁচামেচি করছে ও যে এতটা নরম কোনদিন বোঝেনি সমীর।
"শুনুন মানুষের মন বড়ই স্পর্শকাতর, অবশ্য সবাই সমান নয়।এক সময় অনেক মানুষের মধ্যে বড় হওয়া বা সংসারে আসা মানুষ একা হতে থাকে।তখন সে আঁকড়ে ধরতে চায় স্বামী সন্তানকে স্বভাবতই সন্তান একটা সময় নিজের জগতে পা রাখে তখন স্বামীই ভরসা মানে একে অন্যের অবলম্বন।"
"আমি চাই ও মিশুক সবার সাথে একটু বাইরে বেরোক,ঘুরুক নিজের মত। বাধা দিইনি তো কখনো।"
"যে মানুষটাকে আপনি আগলে রেখেছেন তার যৌবনে যখন সে যৌবন হারানোর পথে শরীর তার ক্ষয়িষ্ণু তখন তাকে হঠাৎই বাইরে ছেড়ে দিলে সে পারবে কেন?এক সময় আমরাই গন্ডী কেটে দিই তাদের ডুজ এন্ড ডোন্ট দিয়ে।"
পরপর সিটিং হয়,মৌ বিশেষ কথা বলেনা প্রথম দিকে।সমীরকেই বলতে হয়।
"আচ্ছা ওনার কি কি আপনার ভালো লাগে?মানে ভালো লাগতো?ভালো গুলো বলুন এরপর খারাপ গুলো শুনবো।"
সমীর বলতে গিয়েও ঠিক গুছিয়ে বলতে পারেনা..."আচ্ছা আমি বলছি..রান্নাবান্না,ঘরগোছানো,ছেলে পড়ানো,মিশুকে,হাসিখুশি, ভালোমানুষ,আপনাকে বা পরিবারকে ভালোবেসে যত্নে রাখে?সেক্স মানে আপনাদের পার্সোনাল লাইফ?"
সবটাতেই হ্যাঁ ছাড়া না বলতে পারেনা,শুধু শেষটা বলতে গিয়ে একটু ঢোক গেলে সমীর.."ওটা ঠিক আজকাল হয়না তেমন।''
"আচ্ছা আপনি আগে যতটা জোরে দৌড়তেন বা খেতেন এখন তেমন পারেন? এমনিতে পা ব্যথা করলেও বেড়াতে গিয়ে ভালো হাঁটেন তাইনা?কারণ মনটা ভালো থাকে।"
মৌ মানে মিসেস মিত্র বলেছেন আপনি ওনাকে ভালোবাসেননা আপনার ছিঃ কথাটা ওনার ভেতরে ঢুকে গেছে।তাছাড়া উনিও আপনাকে সন্দেহ করেন।একজন যদি আরেকজনকে ভালোবেসে জড়িয়ে না ধরেন স্পর্শ না করেন সেক্সটা আসবে কি করে?
মিসেস মিত্র আপনিও বলুন মিস্টার মিত্রর খারাপ ভালো দিকগুলোর কথা। কি বলবে মৌ?সমীরের এতটাই ভালো ছিলো তাইতো ওকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসতো আর বিশ্বাস করতো মৌ।শুধু ঐ অসুখের দিনগুলোতে অবহেলা আর মিথ্যে কথার জাল ছিঁড়ে ও বেরোতে পারছেনা।আর চন্দনা?চন্দনার প্রতি হঠাৎই সমীর এত কেয়ারিং কেন?তাই সন্দেহ ও আছে যেটা ওকে বাঁচতে দিচ্ছেনা,ভালোবাসতে দিচ্ছেনা।
মুখটা একটু কঠিন হয় সমীরের,"আসলে কিছুইনা,সবটাই ওর মনগড়া। জাস্ট অফিস কলিগ।"
" তাহলে তো ভালোই মাঝে মাঝে আপনাদের খাঁটি পুরুষদের পার্টিতে বা থিয়েটারে অন্যদের সাথে মিসেস মিত্রকেও নিয়ে যান। আর দেখুন আমাদের দেশে বহু অসহায় সিঙ্গেল মহিলা আছেন।কজনের দায়িত্ব আমরা নিতে পারি?তার থেকে যে আপনার ওপর নির্ভরশীল তার খেয়ালটাই আগে রাখুন। একটু ভালোবাসতে আর ভালো বলতে কি খুব ইগোতে লাগে?আমি তো চুটিয়ে বৌয়ের প্রশংসা করি।আর অসুখের কথা তো আপনাকেই বলবে আপনিও ওনাকে বলবেন আরে আমাদের মা বাবা থাকতে ছোটবেলায় তাদের বলতাম এখন তো তুমি হো মাতা,পিতা,বন্ধু সখা সবটাই। আপনিও যেমন লড়াই করেছেন উনিও। তাই ফ্রী টাইমটা নাহয় একটু নিজেরা নিজেদের মত ভালোবাসায় ভালো বাসায় শেয়ার করলেন।"
মৌ এখন অনেকটা সুস্থ হঠাৎই একটু কেমন জেদী হয়ে উঠেছিলো সায়ন ওদের ছেলে.."আমি তো এত কিছু জানতাম না। ভাবতাম আমি যাওয়াতে মা বোধহয় লোনলি।বাবা তুমি মাকে ডিভোর্স দিয়ে দাও।আমি কিন্তু মায়ের সাথেই থাকবো।"
মৌ শুকনো মুখে জড়িয়ে ধরেছিলো ছেলেকে,"কি যে বলিস!বাবাকে কে দেখবে আমরা ছাড়া?"
ডাক্তার বাবুর কথাগুলো মনে হলো সমীরের..একটু ভুল হয়েছে হয়ত সামান্যই।কি করবেন তাতে সন্দেহের বশে যদি সীতাকে বারবার অগ্নিপরীক্ষা দেওয়ানো হয়।আপনিই বা একটু পরীক্ষা দিলেন ভালোবাসাকে মুঠোয় রাখার জন্য।
অনেক কিছুই হতে পারতো হয়ত ভাঙতেও পারতো তবে মৌ তা করেনি। সুযোগ দিতে চেয়েছে সমীরকে। সমীরের হাতটা ধরে আস্তে আস্তে।সমীর বুকের মধ্যে রেখে শক্ত বাঁধনে বাঁধে মৌকে। সত্যিই প্রেমটা মনে বেশ জমাটি থাকলে শরীরও যেন অদ্ভুতভাবে এগিয়ে আসে মিলে যেতে হয়ত কোন বাধাই তখন আর বাধা হয়ে দাঁড়ায়না।
" ঐ শোনো এবার আ্যনিভার্সারিতে যাবো শুধু তুমি আর আমি। বেশি দূর নয় মন্দারমণি বা দীঘা যেমন গেছিলাম বিয়ের পরই তোমার হাতে হাত রেখে আবার শুনবো ঢেউয়ের শব্দ।মনে পড়ে সেই রাতটার কথা যেদিন তোমাকে প্রথম..."
বুকটা এখনো তিরতির করে কাঁপে মৌয়ের সেই রাতটা মনে করে। " বাবানটা যাবেনা,তা হয় নাকি?"
মৌয়ের ঠোঁটে ঠোঁট রাখে সমীর,"ছেলে বড় হয়েছে সোনা আইডিয়াটা ওরই। তাহলে যাচ্ছি কিন্তু।"
অনেকদিন বাদে আবার সেই পাগল করা গন্ধটা পাচ্ছে মৌ সমীরের বুকের মাঝে নিশ্চিন্তে মুখ রাখে পরম নির্ভরতায়।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment