Skip to main content

বাঁকা চলন


#বাঁকা_চলন#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

কথায় আছে যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা ছোটবেলায় এই কথাটা অনেকবার শুনেছে ঠাকুমার কাছে লতা।কাকিমার সাথে ঝামেলা হলেই ঠাকুমা বলতেন এই কথা," দেখেছিস তো বুড়ি হলে কি হয়?অথচ একসময় সব একা হাতে করেছি।আর এখন যা করি সেটাই খারাপ। সংসারে অকেজো হয়ে গেলাম রে।"
     ওর মা বলতো," মা একটা বয়েসের পর সবাই অকেজো হয়ে যায়। আমরাও হয়ে যাবো।"
           কথাটা যে নিজের জীবনে এতটা সত‍্যি হয়ে যাবে ভাবেনি লতা। ভালোবেসে লতাকে বিয়ে করেছিলো রাজীব।এই যুগে এসেও বিনা পণে ছেলে একটা কালো মেয়ে তুলে এনেছে তা নিয়ে তার আক্ষেপের অন্ত ছিলোনা।
    " এতো মেয়ে দেখলাম শেষে তোর এই মেয়ে পছন্দ হলো? আগে থেকে বললে আমাদের এত খুঁজতে হতোনা।"
       মায়ের মুখে কখনোই কথা বলতে অভ‍্যস্ত নয় রাজীব। আর তাই হয়ত দাপুটে শাশুড়ি যখন বৌভাতের পরের দিন প্রেজেন্টেশন নিয়ে বসলেন দেখতে আর বলতে লাগলেন..." ইস্ সব ডিপ ডিপ লাল,নীল আর সবুজ রঙের শাড়ি। এগুলো কি ওকে মানাবে নাকি?"
       লতা নতুন বৌ তাই কিছু বলতে পারেনা,প্রথমেই বাড়িতে যে আপ‍্যায়ন পেয়েছিলো তাতে সাহস মোটামুটি তলানিতে ঠেকেছিলো। ওর খুব বলতে ইচ্ছে করছিলো ঐ রঙ গুলো আমার ভালো লাগে।আমার বন্ধুরা বলতো আমাকে লাল কালো পরলে খুব ভালো লাগে। ওর চোখের সামনেই ননদদের আর মাসি শাশুড়িদের ঝোলায় ঢুকে যায় কিছু শাড়ি।
                প্রথম সব কিছুই যেন কিভাবে মনের গভীরে গেঁথে যায়।শত চেষ্টাতেও মন থেকে বেরোয়না। বৌভাতের পর একদিন বাড়ির সবাই বায়না করলো লতা রান্না করবে।শ্বশুর বাড়িতে প্রথম হাতা খুন্তিতে ধার দেওয়া,মোটামুটি আগের দিন থেকেই ঘুম উঠে গেছে লতার।
        " এত ভোরে ঘুম থেকে উঠছো কেন?আরেকটু শুয়ে থাকো।"
    রাজীব জড়িয়ে ধরে লতাকে। " আজ রান্না করতে হবে তো।তাই একটু টেনশন হচ্ছে।"
" তুমি তো রান্না পারো,আমাকেও তো কষা মাংস খাইয়েছো টেনশন কি? মা আছে তো বলে দেবে সব।"
          রান্না করার আগেই শাশুড়িমা বললেন," শোন একঘটি জল আর মিষ্টি দিয়ে ঝোল কোরনা। আমরা একটু কষা কষা সব খাই।ঘটিরা তো রান্নায় ঘটি ঘটি জল আর মিষ্টিপোড়া তরকারি খায়। মিষ্টিপোড়া তরকারি যে হয় তা এই প্রথম শুনলো লতা।নুনে পোড়া কথাটা অনেক শুনেছে আগে।
            সবটা বুঝিয়ে বলে শাশুড়িমা বললেন.." আমি ওদিকে দেখি,তোমার সাথে লেগে থাকলে আবার তুমি ভাববে আমি সারাক্ষণ ছড়ি ঘোরালাম।"
         অপছন্দের মানুষের জন‍্য বোধহয় একটা ছড়ি সারাক্ষণ রাখাই থাকে তার আত্মবিশ্বাসকে
আর মনকে আহত করার জন‍্য। তাই খাওয়ার টেবিলে বসে সশব্দ প্রশংসা করতে গিয়ে ওনার চোখের দিয়ে তাকিয়ে শ্বশুরমশাই একটু মিনমিন করে বললেন," প্রথম চেষ্টা হিসেবে পাশ করে গেছে।".."কত নম্বর নিয়ে বাবা?" রাজীব বলে।
   শ্বশুরমশাই নম্বর দেওয়ার আগেই উনি বললেন,"তেল মশলা দিয়ে পুরো হোটেলের রান্না।
এই রোজ খেলে আর দেখতে হবেনা।"
                বরের কাছে চোখ মুছেছিলো লতা," খুব কম তেলই দিয়েছি গো,যতটা মাংসে দিতে হয়।কম আঁচে কষিয়েছি তাই তেল বেরিয়েছে।"
       " সব কিছু অত মাথায় নিয়োনা।আমার তো ফাটাফাটি লেগেছে।"
  " তাহলে মায়ের কাছে বললেনা কেন শুনি?"
একটু চুপ করে রাজীব বলে," তাতে হয়ত মায়ের রাগ আর অভিমান দুটোই বাড়তো। সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো একদিন।"
              ওর মায়ের কাছে বলতেই মা বললো," চলন বাঁকা হোক ওদের কাছে তুই নিজে যাসনি ওনাদের ছেলে পছন্দ করে নিয়ে গেছে।ছেলের নজরটা সোজা করতে পারেনি কেন?"
       " মা উনি কি আমাকে কোনদিন একটু ভালো বলবেন না?কিছুতেই যেন খুশি করতে পারিনা ওনাকে।সবেরই খুঁত ধরেন।"
  " এবার সোজা বাঁকা থেকে বাইরে এসে নিজে একটু মাথা উঁচু করে বাঁচতো দেখি। একটা চাকরির চেষ্টা কর। নিজের চলন নিজেই সোজা করে নে।"
        চাকরি হয়ত বলতে বলতেই হয়না,তবে চেষ্টা করতে করতেই লতা মা হতে চলেছে। ছেলে হবে না মেয়ে এই আলোচনার মধ‍্যেই শাশুড়িমা বললেন," বাবা যাই হোক একটু যেন ফুটফুটে হয়।"
         উনার মন যে খারাপ তা বুঝেছিলো লতা মানে উনিই তা বুঝিয়েছেন প্রতিপদেই। লতার থেকে একটু উজ্জ্বল হলেও ঝিনুককে ফর্সা বলা যায়না।মায়ের বাঁকা চলনের জন‍্যই মানে মায়ের চাপা রঙের জন‍্যই নাতনিটাও অমনই হলো।
            মায়ের পরামর্শে নিজের চলন আর মাথা সোজা করতে নিজেই চেষ্টা করে লতা।বুঝেছিলো ওনাকে খুশি করা আর সম্ভব নয়।
" চাকরি করবে তো মেয়েটাকে কে দেখবে শুনি।ভেবেছিলাম ছেলের বিয়ে দিয়ে একটু বাপের বাড়ি বোনের বাড়ি ঘুরবো তা আর হলোনা।"
         " মা আপনাকে দেখতে হবেনা,চাকরিতে গেলে আমি ওকে দেখার লোক রেখেই যাবো।"
  " বাইরের লোক আবার ঢোকাবে তাকে নজর রাখবে কে শুনি?"
    তবে আর ওনার কথা শোনেনি লতা চাকরিতে ঢোকার আগেই কমলাদিকে রাখে ঝিনুকের দেখাশোনার জন‍্য। শাশুড়িমাকে বলে," মা কমলাদি আপনার কাজেও সাহায্য করতে পারবে,ভীষণ ভালো মানুষ অনেকদিনের চেনা আমাদের।"
               শাশুড়িমায়ের গজগজ আর বাঁকা চাউনিকে পাত্তা না দিয়ে বাইরে পা রাখে লতা। প্রথম মাসের মাইনে পেয়ে ফিসফ্রাই,জলভরা সন্দেশ আর একটা ব‍্যথার হটপ‍্যাড কেনে লতা।
" মা এগুলো সবার জন‍্য,আর এটা দিয়ে সেক দিলে আপনার হাঁটু ব‍্যথাটা কম থাকবে।"
        " এগুলো আবার কি দরকার ছিলো।"
দরকার ছিলো মা,আপনি এটা ব‍্যবহার করবেন কিন্তু আমি মন থেকেই এনেছি আপনার জন‍্য।"
            আজ কেন যেন উনি আর বেশি কিছু বলতে পারেননা।আজ লতাও ভেবেছিলো উনি নেগেটিভ কিছু বললে ও ওটাকে পজেটিভ করে নেবে। সবাই যখন চলনে দোষ দেখে তখন নিজেকে একটু যত্ন আর গুরুত্ব দিয়ে বাঁকা চলনকে একটু শুধরে নিলে ক্ষতি কি?এতে হয়ত নিজের কাছে নিজের দাম অনেকটা বেড়ে যায়।

সমাপ্ত:-
     

                  

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...