#প্রার্থনা#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
রান্নাঘরে সকালেই টুংটাং আওয়াজ শোনেন সুকুমার বাবু,ললিতা কি তাহলে রান্নাঘরে কাজ করছে?
এত সকালে উঠে যে মেয়েটা কি করে কে জানে? বাড়িতে তো দুটো প্রাণী কি আর এমন কাজ!
আজকাল যে কি হয়েছে বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছেই করেনা সকালে। তাই কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করা। জানলা দিয়ে রোদের আভা ঘরে ঢুকেছে।বসন্তের আনাগোনা বলে দেয় রাস্তার পাশের শিমূল গাছটা। ফুলে ফুলে লাল হয়ে আছে। লালের কথা মনে হতেই লীলার কথা মনে হলো। দোকানে গেলেই লালপাড় শাড়ি ছাড়া তার পছন্দই হতনা। মাঝে মাঝে রাগ করেই বলতেন সুকুমারবাবু," সবই তো একই রকম শাড়ি তোমার। একটু নীল,লাল,সবুজ রঙও দেখো। দোকানে এলেই লালে আটকে যাও।"
" বেশ করেছি,আমার যা ভালো লাগে তাইতো নেবো।এই তো বলো নিজের পছন্দে নাও।আবার টিপ্পনিও কাটবে।"
" আচ্ছা বাপু নাও,তোমার যা ভালো লাগে।"
যে মানুষের লাল পাড় ছাড়া চলতোনা সে হঠাৎই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো লালের থেকে। তবে যাওয়ার সময় মন ভরে আলতা সিঁদুর আর লাল চওড়া পাড়ের গরদে সাজিয়ে দিয়েছিলো ললিতা। কাঁদতে কাঁদতে কানে কানে কি যেন বলছিলো মেয়েটা। নিজেরও মাথার ঠিক নেই তাই অত খেয়াল করেননি তখন। শুধু মনে হয়েছিলো সবটা এলোমেলো হয়ে গেছে।
" বাবা এবার উঠে পড়ো,বেলা হয়েছে আর ঠান্ডা লাগবেনা।তুমি মুখ ধুয়ে নাও আমি চা আনছি।"
" তুই বা সাতসকালে উঠে কি করিস?তোর খুটখাট শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়।"
" কি করবো বাবা,ঘুম ভেঙে গেলে আর বিছানায় থাকতে পারিনা।তারপর আজ শিবরাত্রি তাই ভাবলাম সকালের কাজগুলো সেরে নিই তাড়াতাড়ি।তারপর স্নান করে পুজো দেবো।"
" তোকে তোর মা বারণ করেছিলো আর কোন পুজোর উপোশ করতে। লোকটা যেই চলে গেলো আবার শুরু করেছিস?কি দরকার আর এইসব করে শরীর পাত করার?"
" আমার কিছু হবেনা,তুমি অত ভেবোনা।"
" কি পুণ্যি হবে শুনি? কার জন্য শিবরাত্রির উপোস? তোর আছে টা কে? না আছে সন্তান না আছে..."
বাকি কথাটা মুখেই আটকে যায় সুকুমারবাবুর। বলতে বলতে যে কখন অনেক বড় কথা বলে ফেলেছেন বুঝতেই পারেননি।
হঠাৎই দেখেন তাকিয়ে মেয়েটার চোখের কোণটায় এক ফোঁটা জল জমেছে। তবুও সামলে নিয়ে বলে.." মন চাইলো তাই,একদিন ফলমূল খেলে শরীর ভালো থাকবে।"
" হুঁ ছাই শরীর ভালো থাকবে।তোর মা যেমন কান্ড করতো সন্ধ্যের পর একদম কাত।তখন আমাকেই।"
মুখটা হাসিতে ভরে যায় সুকুমারবাবুর মনে করে পুরোনো কথা..লীলাকে বলতেন ঐ পাথরের শিবের পুজো করো জ্যান্ত শিব ছেড়ে এখন মাথা ধরেছে আর শিবকে দিয়েই সেবা নিচ্ছো।
আদুরে গলায় লীলা বলতো,"ছাড়ো দিতে হবেনা।"
কাছে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতেন," দশটা নয় পাঁচটা নয় একটা মাত্র বৌ আমার তাকে আগলে রাখবোনা? নাই বা পেলাম পুজো।"
"এত পুজো পেয়েও মন ভরছেনা।শ্বশুর হয়েছো মনে আছে কি?"
শ্বশুরমশাইয়ের মুখের হাসিটা মনে করিয়ে দেয় রনজয়ের কথাগুলো," আরেকটু ভালোবাসো আরেকটু।"
" বাসছি তো আর কত? আমার কাছে আর ভালোবাসা নেই।"
" বাবা এখনো মায়ের সাথে কেমন প্রেমে আছে দেখেছো এই পঁয়ত্রিশ বছর বাদেও।আর তোমার কাছে এখনই ভালোবাসা নেই? কি করে কাটবে এতগুলো বছর?"
দুষ্টুমি মাখানো হাসি হেসে ললিতা বলতো বাবা মায়ের ভালোবাসা পাক দিয়ে দিয়ে ক্ষীর হয়ে গেছে।আমিও পাক দিচ্ছি ভালোবাসা মনের কড়াইয়ে ঘন হোক..."
" খুব কথা না? হচ্ছে দাঁড়াও দেখছি কেমন পাক দিচ্ছো।"
কয়েক মুহূর্তের জন্য দুজনের মনই ডুব দেয় অতীতে।
আজকাল কি যে হয়েছে মনের কথা না ভেবেই বলে ফেলেন। যতই তুই বলে দাবী খাটান যার ওপর অধিকার ছিলো সেই তো বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ড্যাং ড্যাং করে ঐ মেয়েটাকে একলা করে রেখে চলে গেছে। আর ছেলে চলে যাওয়ার শোকে লীলাও ছুটলো পিছু পিছু স্বর্গে গিয়ে ছেলের দেখাশোনা আর রান্না করে ভালোমন্দ খাওয়ানোর জন্য। পেটুক ছেলে ভালোমন্দ ছাড়া রুচতো না মুখে। আর ঐ ভালোমন্দ খেয়ে শুলো আর ঘুম ভাঙলোনা।অনেকেই বললো সুখের মৃত্যু এমন ভাগ্য কজনের হয়। কিন্তু কেউ বুঝলোনা বাপ মা আর ঐ কচি বৌটা কি নিয়ে বাঁচবে? তাই তো লীলা লাল পরা ছেড়ে দিলো। দুটো বছর আর লাল ঠেকায়নি শরীরে। বলতো," ঐ কচি বৌটা লাল পরেনা আমি কি করে পরবো? আমি বলেছি পর কিছু হবেনা। ওর নাকি অন্য রঙই পছন্দ।"
তাই বোধহয় হারিয়ে গেছিলো বাড়ি থেকে লালের ছোঁয়া।
"লীলার চলে যাবার সময় কানে কানে কি বলেছিলি রে?" অনেকদিনই ভেবেছিলেন বলবেন একদিন জিজ্ঞেস করেই ফেললেন।
" ও আমাদের মা মেয়ের কথা,বলেছিলাম ও পারে গিয়ে ছেলেকে যত্ন কোরো,ভালো থেকো তোমরা মায়ে পোয়ে। তোমাকে বেশি ভালোবাসতো তাই তোমাকে নিয়েই গেলো।"
মৃত্যুর পর এমনও কোন কথা থাকে শাশুড়ি বৌয়ের! শুনে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারেননি সুকুমারবাবু। ছোটবেলায় মাকে দেখতেন ঠাকুরকে বরণ করে কানে কানে কথা বলতে। জিজ্ঞেস করতে বলতো.." ঐ বললাম সাবধানে যেয়ো এসো মা আসছে বছর।"
এ কেমন চাওয়া আবার? কোথায় যেন চিন্ময়ী মা আর মৃণ্ময়ী মা একাকার হয়ে গিয়েছিলো।মাঝে মাঝে সুকুমারবাবু ভাবতেন এ কেমন শাশুড়ি বৌ বাপু ঝগড়াঝাটি নেই,অশান্তি নেই দিব্যি আছে। হয়ত বা মা বাপ মরা মেয়েটাকে নিজেই পছন্দ করে এনেছিলেন তাই অথবা মেয়েটা সত্যিই ভালো। লীলাকে বললে চোখ পাকিয়ে বলতো," কেন আমি কি খারাপ শাশুড়ি নাকি?"
তবে ঝগড়াও হতো খাওয়া নিয়ে,চরম খাওয়া নিয়ে অনীহা বৌয়ের। " শোন এরপর আ্যনিমিয়া হবে,দিন দিন রোগা কাঠি হচ্ছিস।এরপর লোকে বলবে শুধু ছেলেকে খাওয়ায় বাপ মা বৌমাকে খেতে দেয়না।"
ললিতার তাড়ায় উঠে সব সারতে হয় সুকুমারবাবুকে। কড়া আদেশ তোমার খাওয়া দাওয়া সব গুছিয়ে আমি স্নান করে পুজো দিতে যাবো মন্দিরে।
" কি দরকার উপোস করে শরীর পাত করার?শুনলিনা তো মায়ের কথা?"
" মায়ের কথা শুনলে আমার বুড়ো ছেলেটার জন্য পুজো দেবে কে?তুমি আমাকে মা বলেই তো ডাকো।"
এই জবাবটার জন্য তৈরী ছিলেন না সুকুমারবাবু। এর নামই কি বন্ধন?ছেলের আর স্ত্রীর মৃত্যুর পর প্রতিনিয়ত মৃত্যু কামনা করেছেন হয়নি মৃত্যু।তবুও এখন মনে হয় বাঁচতে হবে তাকে অনেকদিন এই মায়ের জন্য। ও যে বড় একা হয়ে যাবে।
শিব মন্দিরে যাওয়ার আগে বাবাকে বলে বেরোয় ললিতা একটা ঘিয়ে রঙের সোনালী পাড়ের শাড়ি ওর পরনে।হাতে পুজোর থালা আর সদ্য স্নান করা স্নিগ্ধ ললিতাকে দেখে মায়ের কথা মনে হলো সুকুমারবাবুর।
মেয়েটা তো অনেকক্ষণ গেছে এখনো এলোনা ভাবতে ভাবতেই ললিতা এসে দাঁড়ায়.." একটু বোসো বাবা এখানে আমি দাদুকে প্রসাদ দিই।"
" এই মহারাজকে আবার কোথায় পেলি?"
" মন্দিরে বাবা ওর পিসির সাথে গিয়েছিলো,আমাকে দেখতেই আমার আঁচল ধরে পেছন ধরলো । মৌ বললো নিয়ে যা আমি পরে নিয়ে যাবো।"
ললিতার দূর্বলতা জানেন সুকুমারবাবু আজ যেন মনে হলো পার্বতীর কোলে ছোট গণেশ মনটা ভরে গেলো ইশ্ যদি এমন একটা দুষ্টু আসতো মেয়েটার কোলে।
ললিতার আঁচল তখনও ধরে আছে মুঠোয়,নামবে না কোল থেকে।
" এই বেটা নাম,আমার মায়ের কোলে উঠেছিস কেন? আমি প্রসাদ নেবো।"
" শক্ত করে আঁচল ধরে থাকে মহারাজ।"
" দেখেছিস মনে হচ্ছে ওরই জোর বেশি আমার থেকে।"
ললিতার বন্ধু মৌ পাশেই থাকে ওর দাদার ছেলে মহারাজ ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বকবক করলেও দীর্ঘশ্বাস ফেলেন সুকুমারবাবু মহারাজই বটে জন্মেই যে মা হারা তার থেকে আর অভাগা কে। ছেলেকে জন্ম দিয়েই মা টা মরলো আর তারপর থেকেই ঠাকুমা আর পিসিদের কোলে মানুষ। ললিতার দূর্বলতা হয়ত সেই জন্যই।আর ছেলেটাও হয়েছে তেমন ন্যাওটা।ভালোবাসার মানুষ বোধহয় সবাই খুব তাড়াতাড়ি চিনে নেয়।
মৌ যেন কি একটা বলেছিলো..একটু কানে এসেছিলো। মনে হলো কথাটা..." তোর কোলে উঠে এমন খুশি হয় মনে হয় যেন মায়ের কোলে উঠেছে। দাদাকে বলি আবার বিয়ে করতে,কিছুতেই রাজী হয়না ওর অযত্ন হবে ভেবে।"
আজ শিবের প্রসাদ নিয়ে পুজোর ফুলটা মাথায় ঠেকিয়ে প্রার্থনা করেন সুকুমারবাবু..মেয়েটার আবার সিঁথি আর কোল ভরুক। মৌকে এবার বলতেই হবে কথাটা ,তবে ললিতা কি রাজী হবে? মনে মনে ভাবেন মহারাজের জন্য নিশ্চয় হবে...করাতেই হবে। উনি আর কদিন।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment