#গোলাপের_ছোঁয়া#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
কেমন আছিস আজ?
প্রতিদিন ভোরে পাঠানো মেসেজের উত্তরে পাপড়ি ঘুমচোখে চোখের পাতা খুলেই রিমলেস চশমাটা পরে লিখতে বসে আজ একটু ভালো।জানিস তো ডাক্তার বাবু বলেছেন আর মাত্র কয়েকমাস একটু সাবধানে থাকতে হবে।তাহলেই আমি ভালো হয়ে যাবো। তুই ভালো থাকিস।
...আমি ভালো আছি আর দিন গুনছি কবে ফিরবি তুই।
গত কয়েকমাস ধরে পাপড়ি মুম্বাইয়ে,দিগন্ত ওকে খুব খুব ভালোবাসে। কোচিং ক্লাশে অঙ্ক করতে করতে কত সময় ভুল করে ফেলেছে পাপড়ির চোখের দিকে তাকিয়ে। ইমনদা বকুনি দিতো মাঝে মাঝে,"পাপড়ি তুই ওর পেছনে বসবি কাল থেকে। নাহলে ঠিক অঙ্কে কয়েকটা নম্বর কম পাবে গাড্ডাও খেতে পারে। ব্যাস গন্ডগোল পাকাবে,জয়েন্টে চান্স পাবেনা হয়ত বা ভালো কলেজেও আর তখন পাপড়ি বাতাসে ভেসে ভেসে উড়তে উড়তে..."
হাসির রোল উঠতো ক্লাশে। ইমনদা ওদের স্যার হলেও বন্ধুর মত আর তাই বোধহয় এত ভালো লাগে অঙ্কটা ওদের। সব ভয় এক নিমেষে কেটে যেতো শেখানোর জাদুতে।
ছোট ছোট কথা অঙ্ক শেখার ফাঁকে কখনো বা একটু লুকিয়ে তাকানো গুরুগম্ভীর পাপড়ির দিকে একদম ফিদা করে দিয়েছিলো দিগন্তকে। তবে ঐ বইপাগল আর পড়াপাগল মেয়েটাকে আই লাভ ইউ বলার সাহস ছিলোনা একদম।মায়ের সাথে দুই বিনুনীতে সাদা ফিতে লাগিয়ে একদম সোজা স্কুল থেকে এসেই মোটকা একটা ভারী বাঁধানো খাতা খুলে অঙ্ক করতে শুরু করতো। এতো সিরিয়াস যে কি করে হয় মেয়েরা কে জানে! মানে ঐ মেয়েটা।কখনো ফুচকা খায়না,কখনো আইসক্রিম খায়না মনে হয় যেন একটা বুড়ি ঠাকুমা।শুধু চোখে চশমা এঁটে অঙ্ক কষছে বসে। তবুও মন চাইলেই বোধহয় মনকে ছোঁয়া যায় খুব সহজেই আর তাই তো অঙ্কের ফর্মূলা বোঝাতে গিয়ে একদিন দিগন্তর মনের ভাষা পড়ে ফেলেছিলো পাপড়ি।
...."পড়াশোনা না করে দিনরাত মেসেজ করলে কিন্তু কাটা?"
..."কাটা আবার কি? লেজ তো আমার নেই।"
..." আছে তুই দেখতে পাসনা।কাটা মানে আমার বেস্টফ্রেন্ড থেকে তোর নাম কাটা।"
তবে দিগন্তর একদম সেই টুয়েলভ থেকে সিনসিয়ার লাভ মানে যাকে বলে একাগ্ৰচিত্তে প্রেম দেখে নামটা কেটে দিতে পারেনি পাপড়ি বরং আরো পাকাপোক্ত হয়ে গিয়েছিলো সম্পর্কটা।
খুব ভালো ভাবে পাশ করে গিয়েছিলো দুজনে আর ঢিপঢিপ করে দুটো প্রণাম ঠুকেছিলো ইমনদাকে মিষ্টির হাড়ি নিয়ে। একটা মিষ্টি খেয়ে ইমনদা বলেছিলো..." তুই একা,পাপড়ি আসেনি?"
" আসছে, আসছে ও বললো কি সব কিনবে তাই একটু লেট হচ্ছে।"
পাপড়ি আসতেই হাড়িটা বাড়িয়ে দেয় দিগন্তদা।
''আরে ওকে একটা খাইয়ে দে হাঁদুরাম নিজের হাতে। আমার আর্ধেক কাজ তো ও করে দিয়েছে,ও না থাকলে আমি কি তোকে পাশ করাতে পারতাম নাকি? বাবা আমি তো হালই ছেড়ে দিয়েছিলাম।"
লজ্জা লজ্জা করে মিষ্টি খাওয়াতে গিয়ে চোখটা কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলো দিগন্তর। আর ইমনদার মনে হয়েছিলো অঙ্কের খাতার মধ্যে রাখা গোলাপের পাপড়িগুলো মেলুক আনন্দে।স্বপ্ন দেখুক ওরা ভালো থাকুক সরল ছটফটে ছেলেটা পাপড়ির ভালোবাসায়।
কিন্তু সব খুশির মাঝে কেন মাঝে মাঝে একটা মেঘ এসে ঢাকা দেয় কে জানে?বেশ তো আলাদা কলেজ হলেও ছেলেমেয়ে দুটো ভালো জায়গাতে পড়ছিলো।দুজনেরই দু চোখ ভরা স্বপ্ন।তাহলে এমনটা হওয়া কি খুব দরকার ছিলো?
আর কিছু হলেই ছেলেটা এখনো ইমনদার কাছেই ছুটে আসে। " আরে কাঁদছিস কেন বলবি তো?রেজাল্ট খারাপ হয়েছে? সাপ্লি পেয়েছিস? বাবা বকেছে?পাপড়ির সাথে ব্রেক আপ?"
" পাপড়ি চলে যাচ্ছে অনেক দূরে। দেখা হবেনা আর আমার সাথে।"
"কেমন ছাত্র আমার!আস্কারা দিয়ে কেমন মাথায় তুলেছি! বিরহের কথাও এখানে বলতে এসেছে। আর পারিনা। পাপড়ির কি বিয়ে হয়ে যাচ্ছে নাকি?হঠাৎ পড়া ছেড়ে যাবেই বা কোথায়?"
কারণটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে যায় ওদের
ইমনদা,মনের মাঝে যেন হাজার হাজার ঘন কালো মেঘের মেলা।তবুও মুখে হাসি এনে বলে.."আর ধুর আমাদের সবার ভালোবাসা আছেনা,কিছু হবেনা দেখিস কিছু হবেনা। সব ঠিক হয়ে যাবে একদম ঠিক হয়ে যাবে।"
দিগন্তর মনখারাপের ভরা দীঘি আরো উপচে বৃষ্টি ঝরছে অঝোরে তখন। মাকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে দিগন্তদের বাড়ি এসেছে পাপড়ি ওদের বাড়ির ছাদটা ওর খুব প্রিয়। ওদের ফ্ল্যাটবাড়িতে বারান্দায় কিছু টব থাকলেও দিগন্তদের মত ছাদের বাগান নেই। শীতে যেন ফুলে ফুলে ভরে থাকে ছাদটা লাল,নীল,সবুজ হলুদের মেলায় হারিয়ে যায় মন। আর একদিকে লাল,সাদা আর গোলাপী গোলাপের মেলা। দিগন্তের মা বাবা খুব যত্ন করেন গাছগুলো।
" গাছকে বন্ধু করে আমরা খুব ভালো আছি জানিস।সকালে ঘুম ভেঙেই ওদেরকে দেখে যাই কার কটা নতুন পাতা হলো। আর কোন ফুলের পাপড়ি খুললো।"
আজ ছাদে ওরা শুধু একা,দিগন্তর বুকটা কেমন ফাঁকা হয়ে গেছে। ফুলের পাপড়ি দেখাতে মন নেই বেশ কদিন। ওর লাগানো গোলাপ গাছটা কত বড় হলো আর দেখেনা বেশ কয়েকদিন।
" আমি ভালো হতেই তো যাচ্ছি।ঠিক ফিরে আসবো দেখিস।তুই কিন্তু মন দিয়ে পড়িস,আমাকে সব বোঝাতে হবে তো।এই পরীক্ষাটা তো আমার আর দেওয়া হবেনা।"
চোখটা ভরে ওঠে জলে পাপড়ির। ভীতু ছেলেটা আজ কেমন যেন সাহসী হয়ে উঠেছে আজ। শক্ত করে পাপড়িকে জড়িয়ে বলে," আমার পাপড়ির কিছু হবেনা। আমি হতেই দেবোনা।"...হাত ধরতে যে ছেলেটা ভয় পেতো আজ পাপড়ির ঠোঁটে প্রথম ঠোঁট রাখে কেমন যেন এক নির্ভরতার আশ্রয় খোঁজে। ছাদের গাছের ফুলগুলোও মেখেছিলো ওদের চোখের জল সেদিন।
তারপর থেকে মুম্বাইয়ে গত ছমাস লড়াই করছে পাপড়ি। কেমো,রেডিয়েশন সব চলছে কষ্ট হলেও পাপড়ি সহ্য করছে লড়াই করছে ওর মা বাবা দিনরাত করে।হয়ত অন্য লড়াই করছে দিগন্তও।তাই ওকে ফিরতেই হবে।ডাক্তাররা বলেছেন আর কিছুদিন,তারপরেই ও সুস্থ হয়ে যাবে।তারপর রেগুলার চেকআপে থাকতে হবে।ইমনদা প্রায়ই ফোনে বলে," গ্ৰেট ফাইটার ফাইট কর,ভীতুরামটা যে কাঁদতে আসে আমার কাছে মাঝে মাঝে। কি মুশকিল বলতো!ওকে কে দেখবে শুনি?"
" মা আমরা যেন কবে ফিরবো? কতদিন বাড়িতে যাইনি। আবার সবাই একসঙ্গে থাকবো তাইনা। কলেজে যাবো।"
আদর করে মেয়ের মাথায় হাত রাখে ওর মা মনটা খারাপ হয়ে যায়।একমাথা চুল ছিলো।যদিও ডাক্তার বলেছে আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। কয়েকটা মাস পরে ঠিক হয়ে যাবে সব।
পাপড়ি বলে গেছিলো ছাদের বাগানে ফিরে আসবে খুব তাড়াতাড়ি। প্রতিদিন গাছগুলোর যত্ন নিতে আর পাপড়ি খোলা দেখতে এই করতে করতেই দিন শেষ হয়ে যাবে একদিন। দিগন্ত ভালো ছেলে হয়ত পাপড়ি কথা একটু বেশিই শোনে। ওর আটপৌরে মনটা ছাদের বাগানের আনাচে কানাচে প্রতিদিনই দেখে পাপড়িকে কখনো গোলাপের পাপড়িতে আবার কখনো পিটুনিয়ায়।আর মাঝে মাঝে মনে হয় সেই দিনটার কথা যেদিন পাপড়ি মুম্বাই যাওয়ার আগে ওদের বাড়ি এসেছিলো। পাপড়ির চুলের গন্ধ ওর নরম ঠোঁট আর ভেজা চোখ দুটো বার বার মনে উঁকি দিয়ে যায়।
" আজ কেমন আছিস?"
'' অনেকটা ভালো,আর তো কয়েকটা দিন বাদেই আসছি।"
"সত্যি বলছিস! আগে বলিসনি কেন? কবে?"
" ঠিক হলে জানাবো।"
" জানাস কিন্তু,আমার অনেক কাজ আছে।"
" কি কাজ শুনি?"
" আচ্ছা বলবো পরে।'
পাপড়িরা আর পনেরো দিন পরে যাবে।কিন্তু দিগন্তকে বলতে গলাটা কেমন যেন আটকে গেলো হঠাৎই। দিগন্ত যে পাপড়িকে ভালোবাসতো ও তো তেমন নয়। দিগন্ত যদি ওকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়!
না না ও কিছুতেই যেতে পারবেনা দিগন্তের সামনে। ও বলবেই না ফেরার কথা কবে।
বাগানের ফুলগাছ গুলোকে খুব যত্ন করে দিগন্ত।গোলাপী গোলাপে গাছগুলো ভরে গেছে। কি মিষ্টি রঙটা! একদম পাপড়ির ঠৌঁটের মত।
গতকাল সারাদিন পাপড়ির সাথে কথা হয়নি।যতবার ফোন করেছে হয় সুইচড অফ বা নট রিচেবল। কোন কাজেই মন দিতে পারেনি দিগন্ত। শেষে মাকেই বলে রাতে," মা আমি খেতেও পারছিনা।ভীষণ চিন্তা হচ্ছে,পাপড়ি ঠিক আছে তো? খারাপ কিছু হয়নি তো?"
" আচ্ছা আমি দেখবো,ওর মাকে মেসেজ করে যদি কিছু জানতে পারি।"
মুম্বাই থেকে কলকাতা এসে মনটা কেমন যেন কান্নাভেজা পাপড়ির। " এই তো ব্যস্ত হয়েছিলি কলকাতা আসার জন্য।তাহলে মুখে হাসি নেই কেন শুনি? আয় চশমাটা পরে একটু গল্পের বইগুলো দেখতো,নাকি পেপার পড়বি? ওঃ বেশ বাজছে দেখি কে এলো?"
মা চলে যেতেই পাপড়ি চোখ বুজে শুলো আবার । কিছুক্ষণ বাদে একটা চেনা গন্ধ নাকে এসে লাগলো..খুব হাল্কা মিষ্টি গন্ধ ও চেনে গন্ধটা। চোখটা খুলতেই দেখলো বিছানার পাশে ছোট্ট বেতের ঝুড়িতে সাজানো অনেকগুলো গোলাপি গোলাপ হাতে দিগন্ত দাঁড়িয়ে। দুটো চোখ আনন্দে ভেজা..." জানাসনি কেন?আমরা যে অনেক যত্নে এবার ছাদ ভর্তি গোলাপ করেছি তোর জন্য।তুই তো বলে গিয়েছিলি পাপড়ি খোলা দেখতে দেখতে দিন শেষ হয়ে যাবে।"
দুই মা তখন পাশের ঘরে গল্পে জমেছে.." ছেলেমেয়েগুলো কেমন বড় হয়ে গেলো না?আমার কিন্তু মনেই নেই আজ রোজ ডে।''
" হ্যাঁ রে দিন তো রোজই আসে আর গোলাপও ফোটে তবে ভালোবাসার মানুষের হাতে পাওয়া ঐ একটা গোলাপই হয়ত ভালোবাসার যত্ন নেয়।তাই বোধহয় ভালোবাসার আদর যত্নের জন্যও এখন দিন হয়েছে।"
অনেকদিন বাদে পাপড়ি হাসছে, দিগন্তের গলা শোনা যাচ্ছে.." গোলাপের হেয়ারব্যান্ড মা বানিয়েছে।বেশ মানিয়েছে তোকে কিন্তু।একদম পুতুল পুতুল লাগছে।"
" ধ্যাৎ আমার চুল নেই বলে মিছিমিছি বলছিস।''
" না রে একদম পাক্কা।''
দুই মায়ের চোখে হাসির ছোঁয়া দুজনেই দুটো গোলাপ মাথায় দিয়েছে, নিজের সেই ছোট্ট রাজকন্যাকে যখন কেউ রানীর মত ভালোবাসে তখন তো ভালোই লাগে।
প্রেমের রঙ লাল,সাদা,গোলাপী যাই হোকনা কেন ভালোবাসাকে যত্নে আদরে রাখতে এখনকার ছেলেরাও পারে। ভালো থাক পাপড়ি গোলাপের ছোঁয়া মেখে শুধু রোজ ডেতে নয় প্রতিদিনই।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment