#ভালোবাসার_এক_ঘর#
কলিংবেলে হাত রাখার আগে তাড়াতাড়ি চিঠির বাক্সের দরজাখানা খোলে রুদ্র প্রতিদিনের অভ্যেসমত। জানে মা এই কষ্টটুকু খুব একটা আর করেনা এখন। রুদ্রর হাজার একটা কাগজপত্র এসে জমা হয় ঐ পুরোনো আমলের লেটার বক্সটাতে যেখানে এখনো জ্বলজ্বল করছে ডঃ শুভ্র রায়চৌধুরী নামখানা। অনেকবারই মা বলেছে," তোর নামটা ওখানে লিখিয়ে নে এবার।কত চিঠিপত্র আসে তোর,সুবিধা হবে।"
" থাক না মা,সেই কবেকার চিঠির ঝাঁপি এটা,এখনো কি সুন্দর করে লেখা আছে শুভ্র রায়চৌধুরী আর লীলা রায়চৌধুরী নামটা। কি দরকার ওখানে জায়গা নেবার? তার থেকে এই বেশ ভালো আছি।"
তবে রুদ্রর বেশ লাগে চিঠির ঝাঁপির ঢাকা খুলতে,প্রতিদিনই কিছু না কিছু কাগজ আসছেই। কাগজের সাথে ছোটবেলা থেকেই বন্ধুত্ব রুদ্রর,নতুন বইয়ের গন্ধে মনটা কেমন যেন আনচান করতো ছোট থেকেই। আর যত বড় হয়েছে সেই নেশা বেড়েছে,আলমারিতে বই বাড়ছে তো বাড়ছেই।বিছানা ভর্তি বই,কাগজ আর নানান জার্নাল।
বইয়ের সাথে প্রেমে বেশ মজে রয়েছে এতদিন অবশ্য মাঝে মাঝেই এ মুখ সে মুখ উঁকি দিতে চাইলেও বইরা ভিড়তে দেয়নি কাউকেই এখনো পর্যন্ত। তাই ঝকঝকে সুন্দর, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী,মেধাবী, হাইপাওয়ারের চশমা পরা প্রফেসর রুদ্র রায়চৌধুরী এখনো সিঙ্গেল। আর সময় কোথায় প্রেম করার? আপাততঃ বই বান্ধবীদের নিয়ে বেশ আছে। আর মা তো আছেই,মাঝে মাঝে একটু বিরক্ত করার জন্য। মা ছেলের খুনশুটিতে সময়টা বেশ কেটে যায় ওদের।বাবা মারা গেলেন যখন তখন ওর সবে ক্লাশ টেন।সরকারী হাসপাতালের ডাক্তার ছিলেন বাবা,সেই সময় খুব একটা মাইনেপত্র ছিলোনা সরকারী চাকরীতে। আর তারমধ্যে হঠাৎই বাবার কার অ্যাক্সিডেন্ট।
কেমন ছিলো সেই বিষণ্ণ দিনগুলো? ছোট থাকায় খুব একটা বুঝতে না পারলেও অনেকটাই বুঝতে পেরেছিলো রুদ্র। প্রথমে কিছুদিন কোমায়,তারপর একদম বিছানায় শোয়া দেখেছিলো ওর পরিচিত মানে খুব আপন এক অন্য বাবা। মন খারাপের মেঘে ভেসে মাঝে মাঝেই ওর ইচ্ছে হতো তখন স্কুল থেকে বাড়িতে দেরি করে ফিরতে।
আর্থিক কষ্ট মানসিক কষ্ট কেমন যেন গলা টিপে ধরেছিলো একেবারে। তারমধ্যেই মাধ্যমিক দিয়েছিলো রুদ্র,আর ভালো রেজাল্টও করেছিলো। রেজাল্টের খবর যেদিন কাগজে বেরিয়েছিলো অনেকদিন বাদে মাকে হাসতে দেখেছিলো,মা গিয়ে বাবার কানে কানে বলেছিলো.." শুনছো বাবু আমাদের মাধ্যমিকে তৃতীয় হয়েছে। আজ কত আনন্দের দিন।তোমাকে সুস্থ হয়ে উঠতে হবে খুব তাড়াতাড়ি।"
বাবার অকেজো হয়ে যাওয়া হাতটা,যেটা একসময় ভীষণ কেজো ছিলো মা কোনরকমে তুলে ওর মাথায় রেখেছিলো। চোখ বেয়ে জল পড়েছিলো অঝোরে রুদ্রর। মনে পড়ে গেছিলো ছোটবেলার দিনগুলোর কথা যখন ও ভালো রেজাল্ট করতো বাবা জড়িয়ে ধরতো ওকে। তারপর বাবার চামড়ার ব্যাগ মানে যেটাকে রুদ্র বলতো ম্যাজিসিয়ানের থলে সেখান থেকে বেরোতো কত কি জিনিস। রঙ পেন্সিলের বাক্স,গল্পের বই,চকলেটের বাক্স,কলম,খেলনা গাড়ি। সব যত্ন করে গুছিয়ে রাখতো রুদ্র।
মাকে বাবা বলতো," খুব তো বলো ছেলেকে পড়াইনা,দেখিনা সারাদিন শুধু রোগী দেখি। আরে বেটা তো আমার।তাই এমনিতেই সব হয়ে গেছে মানে বাপ কা বেটা।"
মা হাসতো মুক্তো ঝরানো হাসি,রুদ্র একবার মায়ের দিকে একবার বাবার দিকে তাকিয়ে মাপতো ওদের খুশির পরিমাণটা।
" ছেলে শুধু তোমার বুঝি? মাত্র দুআনা তোমার। আর চোদ্দআনা আমার বুঝলে।অনেক হয়েছে,এবার তোমার ঝোলা বন্ধ করো নাহলে একটু বাদেই সেখান থেকে বেরোবে ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ,প্রেসার মাপার যন্ত্র। উহ্ আর পারিনা বাবা।চলো এবার খেয়ে নেবে চলো,সকাল থেকে তো কিছু খাওয়া হয়নি মনে হচ্ছে।"
কি মিঠে আনন্দ ভরা দিন ছিলো সেগুলো। শুধু প্রজাপতির উড়ে যাওয়া দিন। সেই দিনগুলোর সাথে বাবাকে এমনভাবে শুয়ে থাকার দিনটাকে মেলাতে পারেনা রুদ্র। দেখে বাবার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে,মা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছে সেই জল। অসুস্থ বাবার চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছিলো মা। রুদ্র সেই বয়েসেই অনুভব করেছিলো অপ্রয়োজনীয় হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে চলে যাওয়া ভালো।
কিছুদিন বাদেই বাবা মুক্তি দিয়েছিলো ওদের।বাবা চলে যাওয়ার শোক তেমনভাবে ছোঁয়নি ওকে বরং বাবার কষ্ট কমলো এই ভেবে অনেকটা হাল্কা লেগেছিলো রুদ্রর। মনে হয়েছিলো মা কিছুটা হলেও বাঁচলো,আর বাবার ঠাঁই হলো বিছানা ছেড়ে দেওয়ালে। তবে দেওয়ালের ফটোতে বাবা আবার সেই চেনা বাবা,ফর্সা টুকটুকে রঙ চোখে হাইপাওয়ারের চশমা আর মুখে মুচকি হাসি। অনেক ভেবে আর দেখেশুনে মা আর ছোটমামু মিলে ঐ ছবিখানা বাঁধিয়েছিলো।তবে ঐ হসপিটালের গন্ধটা অনেকদিন বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছিলো। অনেকদিন পরেও মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখতো রুদ্র বাবাকে এলেই ঐ গন্ধটা সাথে করে আনতো।
বাবার স্বপ্ন দেখেছে শুনলেই মায়ের মুখটা কেমন যেন শুকিয়ে যেতো,মাকে বলতে শুনেছে বাবার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে," যেখানেই থাকো ভালো থাকো।আর দেখা দিয়োনা,আমাদের কষ্ট হয়। ছেলে ছাড়া আমার কে আছে বলতো? ওকে ভালো রেখো,আশীর্বাদ কোরো।"
দেখতে দেখতে অনেকগুলো বছর কেটে গেছে বাবার আশীর্বাদের শীতল ছোঁয়া জীবনের প্রতি পরীক্ষাতেই পেয়েছে রুদ্র তবে জয়েন্টে র্যাঙ্ক করেও কেন যেন ডাক্তারী পড়তে ইচ্ছে করেনি।
বুঝতে পেরেছিলো মায়ের খুব ইচ্ছে ও বাবার মত ডাক্তার হোক।ওর মধ্যে বোধহয় বাবাকে খুঁজতে চায় মা। মামা আর বাবার বন্ধুরা বলে রুদ্রকে দেখতে একদম বাবার মত হয়েছে। তবুও মাকে বলেছিলো," তুমি চেয়েছিলে তাই আমি পরীক্ষায় বসেছিলাম মা..তোমাকে তো বলেছি ঐ ওষুধের গন্ধটা কেন যেন আমার আর ভালো লাগেনা। খুব কষ্ট হয় মা বিশ্বাস করো।আমি পারবোনা মা,সত্যি বলছি।"
********************
লেটার বক্স খুলে চিঠির গোছা নিয়ে ঘরে আসে রুদ্র। জামাকাপড়ের বোঝা নামিয়ে হাল্কা হয়েই বিছানায় ছড়িয়ে বসে খামগুলো আয়েসে। মা এসে তাড়া দেয়," ওরে এসেই চিঠি নিয়ে বসলি? খাম খুলবি আর আবার ডুবে যাবি চিঠির পাতায় পাতায়।চা জলখাবার খেয়ে নে বাবা।"
" হ্যাঁ মা দাও দাও শিগ্গিরি সত্যিই তো খুব খিদে পেয়েছে।ভুলেই গেছি বলতে।"
" ভুলেই গেছি! কত যেন বলে খাবার কথা?আজ লুচি করেছি,এই গরম ভেজে আনলাম তোর জন্য।"
" লুচি! দারুণ,দাও দাও তাড়াতাড়ি।সাদা আলু আর লুচি ওহ্ আর কি চাই।"
" পায়েশও আছে সাথে,একটু বানালাম তুই ভালোবাসিস বলে।"
" তোমার আজ খুব কষ্ট হলো এত কিছু বানাতে তাইনা মা?"
রুদ্রর পরিতৃপ্তি লীলার সব কষ্ট মুছে দেয়। আজকাল যেন মনে হয় যত বড় হচ্ছে একদম বাবার মত দেখতে হচ্ছে রুদ্রকে। হঠাৎই চিন্তার জালটা ছিঁড়ে যায় রুদ্র লুচির টুকরোটা মায়ের মুখে দেয় আদরে।
" একটু খাও,তখন থেকে জুলজুল করে তাকিয়ে আছো আমার প্লেটে। তোমাকে সাথে নিয়ে না খেলে আমার ঠিক ভালো লাগেনা।"
" ওরে পাজি ছেলে,মায়ের অভ্যেসটা যে খারাপ করছিস সে খেয়াল আছে? এরপর বৌ এসে রাগ করবে।"
" সে এখন অনেক দেরি মা। আর রাগ করবে কেন? দুজকেই খাইয়ে দেবো একসাথে।"
" যাক ভালো তাহলে বুঝবো মানুষ হয়েছে আমার ছেলে।"
কাগজপত্র অনেক তারমধ্যে গোছা চিঠি। আগে চিঠিটাই খুলবে ঠিক করলো রুদ্র।পুরোনো বন্ধুর চিঠি বলে কথা। একসময় ভীষণ দোস্তি ছিলো ওর সাথে,কত যে ওর টিফিন খেয়েছে তার কোন হিসেব নেই। সত্যিই সেই সময় অনেকদিন লীলা টিফিন করে দিতে পারতোনা। মাকে নিজেই বলে দিতো সকালে উঠে," মা বুঝলে তোমার এই সপ্তাহ ঝামেলা নেই,একদম আমার টিফিন বানিয়োনা অভি নিয়ে আসবে বলেছে। আর তারপরের সপ্তাহে মৌমি।
একদলা কান্না গলায় এসে আটকে যেত লীলার। বিপদের দিনের বন্ধুই আসল বন্ধু।
খামের গন্ধ আর চিঠির আনন্দ বরাবর টানে রুদ্রকে।একটা সময় দাদু বহরমপুর থেকে এই রকম খামে ভরে রুদ্রকে চিঠি আর কার্ড পাঠাতো।ওগুলো ভাবলে খুব নস্টালজিক লাগে।
চিঠিতে একগাদা বন্ধুত্ব আর পড়াশোনা নিয়ে কথা তারপর একটা হুশিয়ারি.. মৌমিকে পরীক্ষার জন্য তৈরী করছিস ভালো। ওকে আবার কোটে ভরে ফেলিসনা।তাহলে কিন্তু মরে যাবো।শেষে প্রস্তাব দিয়েছে, নৈনিতাল যাবি? ফেরার পথে একদম লক্ষ্ণৌ মানে আমার শহর ঘুরে যাস। আসলে মৌমিও যাচ্ছে, বিয়ের আগে একা একা প্রেমিকা নিয়ে যাওয়া! তাই আরো কয়েকজনকে জুটিয়েছি। প্লিজ চল।
*************************
একেই বন্ধুর মনে বেড়ানোর প্রেম তারপর আবার ফরমায়েশ হয়েছে মৌমিকে সাথে করে নিয়ে যাবার।সুতরাং মায়ের কাছে বলতেই হলো," মা অভি খুব বলছে বেড়াতে যেতে,আর আমারও ছুটি তখন।তারপর আমি না গেলে মৌমির যাওয়া হবেনা। তুমি তো সবটাই জানো।"
এক বাক্যে রাজি হতেই হলো লীলাকে।
তাই নরম হাসির ছোঁয়া মাখিয়ে বলে," একদম বাবু ঘুরে আয়। ওরা তোর খুব ভালো বন্ধু।যা ঘুরে আয়।"
" মা তোমার অসুবিধা হবে না? মানে আমার তো কয়েকদিন লাগবে।"
" কিছু হবেনা,আছে তো টুকু মাসি।তারপর গোপালের মা আছে। ঠিক কেটে যাবে কয়েকদিন।"
একদম যাওয়ার ইচ্ছে যে রুদ্ররও নেই তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এমনিতেই পাহাড় ভীষণ ভালো লাগে তারপর আবার সঙ্গে বন্ধুরা থাকবে সুতরাং আনন্দই আনন্দ।শুধু মায়ের জন্য একটু মনটা খারাপ করছে। যাক হয়ত ম্যানেজ হয়ে যাবে সবটাই। সুতরাং রুদ্রর মন উড়ে যায় নৈনিতাল পাহাড়ে।
জানিয়ে দেয় যে যাচ্ছে ও,মৌমিও খুব খুশি।সাথে রুদ্র যাচ্ছে সুতরাং মা বাবা আর আপত্তি করবেনা।
অনেকদিন বাদে পাহাড়ের নরম ঠান্ডা আদরে মনটা একদম তুলতুলে নরম হয়ে গেছিলো রুদ্রর। মৌমি আর অভিও একদম ফুরফুরে মন নিয়ে উড়েছে কয়েকদিন।তবুও ভাগ্য ভালো ওকে কেউ কাবাবে হাড্ডি ভাবেনি। বরং রুদ্র ওদের কাছে রীতিমতো মশলা মানে অভির ভাষায় গরম মশালা," আরে ভাই তুই না থাকলে এত সহজে পাহাড়ের ঠান্ডায় প্রেমটা রান্নাই হতোনা।"
প্রতিদিনই মায়ের সাথে কথা হয়েছে,খবর পেয়েছে।ওদিকে লীলার ভালো লেগেছে ছেলেটা ভালো আছে জেনে।যাক কটা দিন একটু আনন্দ করে আসুক ছেলেটা। সত্যিই দুহাত বাড়িয়ে পাহাড়কে ধরতে চাওয়া মনে মেখে নেওয়া সবুজের ছোঁয়া আর লেকের জলের শীতলতা।
" শোন ফেরার কথা আগেই বলেছিলাম, লক্ষ্ণৌ হয়ে কিন্তু ফিরবি।মানে ফিরবি তো ঐ পথেই।তার মাঝেই অন্ততঃ দুটো দিন কাটিয়ে যাওয়া।" অভির কথা শুনে মৌমির গাল লাল হয়। বুঝতে পারে বিয়ের আগেই শ্বশুরবাড়ির আদর খেতে হবে অভির আব্দারে। কিছু করার নেই,মামনি নাকি বারবার বলে দিয়েছেন ফেরার সময় দুটোকেই ধরে আনবি। রুদ্রর অবশ্য এই সুযোগে লক্ষ্মৌ ঘুরে দেখা হয়ে যাবে। তাই খুব একটা আপত্তি করার জায়গা ছিলোনা। আর টিকিট তো সেইভাবেই কেটেছে অভি মহারাজ।
তবে লক্ষ্মৌ গিয়ে যে মনটা ওখানেই আটকে যাবে ভুলভুলাইয়াতে ব্যাচেলর রুদ্রর তা ভাবতে পারেনি যাবার আগে।
"হয়ত সব কলকাঠি ওপরওয়ালা নেড়ে রাখে আমরা কেবল পুতুল তাইনা রুদ্র? তা আরো কিছুদিন এখানে থেকে যাবি নাকি সবেই ভালো লাগার শুরু। সত্যিই খুব খারাপ অবস্থা।" মুখ টিপে হাসে মৌমি।
একবার রাগী মুখ করে তাকাতে গিয়েও হেসে ফেলে হাইপাওয়ারের চশমার আড়ালে রুদ্রর দুই বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। অশ্রুতা,একদম নতুন একটা নাম অথচ এর মধ্যেই অদ্ভুতভাবে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে রুদ্রকে। অভি দুদিনের নামে পাঁচদিনের বন্দোবস্ত করেছে থাকার। তারমধ্যে দ্বিতীয় দিনেই নিয়ে গেছিলো অশ্রুতার একটা নাচের অনুষ্ঠানে, আর প্রথম বলেই একদম ওভার বাউন্ডারি। রুদ্রর চোখের সামনে তখন শুধুই অশ্রুতা।
ওখানে থাকার চারদিন জুড়ে শুধুই অশ্রুতা,ওদের বাড়িতে নেমন্তন্নও খেতে হলো একদিন। তারপর ওদের দলেই ঢুকে গেলো অশ্রুতা।বেড়ানোর ফাঁকে মন হারানো চোখের ছোঁয়াতে আর টুকরো হাসিতে ডুবে যাওয়া। কে যে মেয়েটার নাম অশ্রুতা রেখেছিলো কে জানে? সারাক্ষণ ঠোঁটের কোণে হাসি আর চোখদুটো নাচছে হাসির ইশারায় আর সেই হাসি রীতিমতো দস্যি হাসি। একদিন ওর স্কুটির পেছনেও বসতে হয়েছে রুদ্রকে।অবশ্য পরে বুঝতে পেরেছে পুরোটাই মৌমি আর অভির পাতা ফাঁদ।অবশ্য ভালোই হয়েছিলো সেই ফাঁকে পুরোনো ইতিহাসের পাতা উল্টোতে উল্টোতে মনের গভীরে দাগ কেটে যায় কিছু বলা শব্দ।অশ্রুতা কলকল করে ওঠে," আমি আছি তো আর গাইড লাগবেনা। আমি সব চিনি।কোন চিন্তা নেই। আর এক সপ্তাহ থাকলে তো আপনার সাথে লক্ষ্মৌর গলি গলি জান পহেচান করিয়ে দিতাম।"
" থাকতে পারলে তো খুব ভালো হত কিন্তু উপায় নেই অনেক কাজ পড়ে আছে ওদিকে। তবে খুব মিস্ করবো লক্ষ্মৌর সব কিছু।"
অশ্রুতার টানা চোখে হাসি খেলে যায় টোল পড়ে ওর গালে।
*************************
রুদ্র ফিরে আসার পর লীলা বুঝতে পারেন,ছেলেটা কিছু একটা হারিয়ে এসেছে। মৌমি এসে অবশ্য বুঝিয়ে দেয় সবটা," তুমি যদি বলো কাকিমা তাহলে অভি কথা বলবে।"
লীলার বুকটা একটু নড়ে ওঠে আনন্দে না আশঙ্কায় বোঝেনা,ছেলেটা বদলে যাবেনা তো? সেই মেয়ে কেমন হবে কে জানে? বয়েসও তো খুব বেশি নয় এখন কলেজে পড়ছে।রুদ্রর থেকে বেশ কিছুটা ছোট। যাক মিল হলেই ভালো।
সুতরাং প্রজাপতির পাখায় ভর করে প্রেমফুলের রেণু একদম সোজা উড়ে গেলো লক্ষ্মৌতে পরাগ মিলনের বাহানায়।
অশ্রুতার মা রাজি হলেও বাবা একটু আপত্তি করছিলেন। "ইশ,আদরের মেয়েকে অত দূরে পাঠিয়ে দিতে হবে!"
" শোনো অভির বন্ধু,ভালো ছেলে। তুমি তো তখনই বলছিলে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ায় আর কি চাই বলতো?"
" সব ঠিক আছে,কিন্তু অশ্রুতার চেয়ে তো বয়েসেও বেশ বড়। মেয়ে আমার এখনো ছেলেমানুষ। আর দুটো বছর যাক।"
" তা ওরা অপেক্ষা করবে। তোমার মেয়েরও তো মন পড়েছে ঐ সম্বন্ধে। আমি কি এমনি বলছি। মনে হয় ছেলেকে পছন্দ ওর।"
সব ঠিক হলেও সত্যিই বিয়ে হতে হতে আরো দুটো বছর কাটলো। তখন অশ্রুতার এম,এ ফাইনাল ইয়ারে পা আর রুদ্রর বত্রিশ।
মাঝের দুটো বছর প্রেমের পানসি ছুটলো জোরে।একদিক দিয়ে ভালোই হলো দুজনেরই প্রথম প্রেম তাই মিঠে ভালোবাসা ভরে নেওয়া একটু একটু করে মনে। আর তার ছোঁয়া নিয়ে পা রাখা একে অপরের জীবনে।তার মাঝে লীলাও দেখে এসেছেন মেয়েকে। কথা বলে মনে আর কোন দোটানা থাকেনা লীলার,পারবে এই মেয়ে নিশ্চয় ঐ বইপাগল ছেলেটাকে বাঁধতে। তার আর কদিন? মাঝে মাঝেই বুকে একটা ব্যথা হয়,সে যা পারুক হোকগে। ভালো থাক ছেলেটা,আসুক ওকে আগলে রাখার কেউ একজন।
*********************
অশ্রুতা পায়ে আলতা মেখে এ বাড়িতে এসেছে তাও বেশ কয়েকটা বছর হয়ে গেলো। লীলা অবশ্য নাতির মুখ দেখে কিছুদিন সবাইকে নিয়ে আনন্দ করে খুশি মনে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন গত তিনবছর আগের কোন একটা সকালে হঠাৎই। খুব ভেঙে পড়েছিলো রুদ্র,"সুখের সময়টাই তুমি চলে গেলে মা।"
অবাক হয়েছিলো রুদ্র অশ্রুতাকে দেখে,মেয়েরা কি সত্যিই মা দুর্গার অংশ? তাই বোধহয় কাজপাগল রুদ্রকে একদম আগলে রেখেছিলো ওর মন খারাপের দিনগুলোতে অশ্রুতা। রুদ্রর পৃথিবী ছোট হতে হতে তুমি আমি আর আমাদের সন্তানে সীমাবদ্ধ হয়েছিল।
তারপর থেকে বাবা মায়ের আদুরে অশ্রুতা একাই সামলায় ছেলে, বর এমন কি রুদ্রর ছাত্রছাত্রীদেরও।
রাতে বইটা বন্ধ করে অশ্রুতাকে কাছে টেনে নেয় রুদ্র," ভাগ্যিস মা তোমাকে দিয়ে গেছে আমার কাছে। নাহলে আমার যে কি হত? মায়ের কাছে আদর না খেলে আমার ঘুমই আসতোনা।"
চোখ পাকায় অশ্রুতা," খোকা একেবারে। এত আদর আমার কাছে নেই। আমার ছেলে কি খাবে শুনি?"
ভালোবাসার মুখে সুখের আঁচল চাপা দিয়ে যত্নে রাখে অশ্রুতা। আদরে যত্নে সামলে রাখে তার নতুন সংসার। রুদ্রর থেকে প্রায় আটবছরের ছোট অশ্রুতা এখন বুদ্ধিদীপ্ত আর লক্ষ্মীমন্ত পাকা গিন্নী।
***********************
স্যান্ডউইচ গুলো বানিয়ে তাড়াতাড়ি করে কফি বসাচ্ছিলো অশ্রুতা।
" মা আমাকে একটু কোলে নাও এক্ষুণি।"
"বায়না করেনা সোনা,মা কাজ করছেনা।তুমি বরং বাপির কাছে যাও।বাপি তোমায় কোলে নেবে।"
অভিমানের সুরে ছেলে বললো," আমি গেছিলাম তো।বাপির কোলে তো নীলা পিপি বসে গলা জড়িয়ে ছিলো। আমাকে দেখলোই না বাপি।"
কিছুক্ষণ কেমন বোবা হয়ে যায় ছেলের কথা শুনে অশ্রুতা। ইশ্ কতটা কফি চলকে পড়ে গেলো! তাড়াতাড়ি করে শাড়ির আঁচল দিয়ে নামিয়ে ফেলে সসপ্যানটা।
একটু আগেই তো রুদ্র ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরলো একাই তো ফিরেছে।বললো নিচে স্টাডিতে আছে খুব খিদে পেয়েছে কফি আর স্যান্ডউইচ খাবে। রুদ্রর কথা শুনে মায়া হয় অশ্রুতার তাই তাড়াতাড়ি ছুটে আসে রান্নাঘরে।
একটু বাদেই আবার ওর স্টুডেন্টরা এসে যাবে। কিন্তু নীলা আবার কখন এলো? অন্য সময় তো এসেই আগে ওর কাছে রান্নাঘরে এসে ঢোকে রাতুলকে নিয়ে চটকায়। বকুনি দেয় অশ্রুতা," তুই হাতমুখ ধুয়েছিস?রাতুল ছোট না?একেবারে রান্নাঘরে এসে ঢুকেছিস?"
এই দেখো হাত ধুয়েছি,হাত ভেজা বলে ওকে জড়িয়ে ধরে নীলা। " উঃ একদম গায়ে পড়া মেয়ে। আরে ছাড় ছাড় চল কফি ঠান্ডা হচ্ছে।"
" স্যার কি লাকি গো মাঝে মাঝে হিংসে হয় আমার।"
অশ্রুতার জোড়া ভুরুতে একটা ঢেউ খেলে যায়।আর গালের টোলটা আরো গভীর হয় হাসির ঢেউয়ে,"কেন রে? কি হলো?
" তোমাকে দেখে ওহ্ জাস্ট ফিদা আমি।আমারই এই অবস্থা।স্যারের না জানি?"
" কেন শুনি?"
" আহা জানেনা যেন।কোনদিন কি স্যার বলেনি তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।"
" খুব পেকেছিস,শোন তোর আর রিসার্চ হবেনা। তার চেয়ে বরং তোর বাড়িতে বলি তোর জন্য ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দিতে।"
" ইশ্ বিয়ে কে করবে শুনি?আমি তো প্রেম করবো। হ্যাঁ তবে বিয়ে করতে পারি যদি আমার মনের মত কাউকে পাই।"
" কেমন পাত্র চাই শুনি? ডাক্তার?ইঞ্জিনিয়ার?না ডক্টরেট?"
"অবশ্যই ডক্টরেট একদম আমাদের স্যারের মত।"
একদম হো হো করে হেসেছিলো অশ্রুতা।" শেষে বুঢ্ঢা প্রফেসর।ধুর তোর পছন্দই নেই। কি বইমুখো গোমড়ামুখো হয় লোকগুলো জানিস।একদম বেরসিক।"
" তাই নাকি তাহলে প্রেমটা হয়েছিলো কি করে শুনি ঐ বেরসিক লোকটার সঙ্গে?"
অশ্রুতার গালের টোলের পাশে একটু রক্তিম আভার ছোঁয়া লাগে। অশ্রুতারা তখন লক্ষ্ণৌতে থাকে বাবার তখন ওখানেই চাকরি হঠাৎই অভিদা একদিন এলো ,
বাড়িতে মাঝে মাঝেই আনন্দের হাট বসতো অভিদা এলেই। কত গল্প মজা আর গানের লড়াই। আর ছাদে উঠে মাঝে মাঝে হত অশ্রুতার নাচ।
" আচ্ছা ছোটু,তোর এই অশ্রুতা নামটা মেসো কেন দিয়েছিলো রে? এত সুন্দর হাসি তোর।আর তোর নাচ দেখলে তো আনন্দে যে কোন মানুষের মন নেচে উঠবে।"
" দাদাভাই মনে আছে তো আমাদের প্রোগ্ৰামের কথা? তুমি আসছো তো?"
" ইশ্ কার্ডটা দিস তো একদম নাকের ডগায় টাঙিয়ে রাখবো।"
" না এলে আর ঢুকতে দেবোনা বাড়িতে।"
ওর কথা শুনে ওর মা বকেছিলো ওকে " ঢুকতে দেবেনা..খুব পেকেছিস ছোটু।দাদা হয়না?বড় দাদা।"
আগের দিন থেকেই খুব ব্যস্ত ওরা,এত বড় অনুষ্ঠান। সকাল থেকে খুব উৎকন্ঠা।মা বাবা আদর করে বলেছে.." প্রত্যেকবারই এইরকম করিস।কি সুন্দর নেচেছিলি আগের বছর!এবারও খুব ভালো হবে।"
কস্টিউম পরে একবার উঁকি দিয়েছিলো একটু মা দেখে দূর থেকেই একটা আদরের চুমু দিয়ে দিয়েছিলো।
তারপর তো আর খেয়াল করেনি কিছু তখন শুধুই মন দেওয়া পারফরমেন্সে। সত্যিই খুব ভালো হয়েছিলো অনুষ্ঠান হয়ত গতবারের চেয়েও ভালো।
নাচের কস্টিউম পরেই বাইরে বেরিয়েছে অনুষ্ঠান শেষে। মা জড়িয়ে ধরে," বলেছিলাম না ছোটু আগেরবারের থেকেও আরো ভালো হবে। ভীষণ ভালো হয়েছে রে।"
বাবা ওর প্রিয় ক্যাডবেরি দিয়ে গালে একটা টোকা মারে।বাবার এটাই আদর মাঝে মাঝে বলে অশ্রুতা," ছোট থেকে গালে টোকা মেরে মেরে তুমিই গালে গর্ত করে দিয়েছো।ইশ্ হাসলে কি বাজে লাগে।"
" মোটেই না ওটা ডিম্পল সোনা আর তাইতো আমার বেটাকে এতো মিঠি লাগে।" দাদা থাকলেও সবসময় বাবা বেটাই বলতো ওকে।
" আরে আমাকে একটু দেখ,তোর বায়না মেটাতে এলাম। আর আমাকেই দেখছিসনা।"
" সত্যিই গ্ৰেট পারফরমেন্স, ভীষণ সুন্দর নাচো তুমি।"
এতক্ষণ সত্যিই পেছনে দাঁড়ানো দলটার দিকে তাকায়নি উত্তেজনায় অশ্রুতা। ওর দাদা সাথে অভিদা ছাড়াও আরো দুজন। তার মধ্যেই একজন বললো।
" আরে অবাক হোস না ওরা আমার বন্ধু নিয়ে এসেছিলাম। আরে ওকে তুইও বলতে পারিস।অনেক ছোট আমার থেকে। শোন এ মৌমি আর ও রুদ্র।"
এবার সত্যিই একটু লজ্জা পায় অশ্রুতা,সত্যিই ওদের লক্ষ্য করেনি এতক্ষণ।সেই প্রথম দেখা রুদ্রর সাথে। রুদ্র পরে বলেছে ওর নাচ দেখে নাকি চোখই সরাতে পারেনি ওর থেকে।
প্রেমটা কবে হয়েছিলো ঠিক মনে পড়েনা অশ্রুতার।রুদ্রকে তখন দাদাই বলতো।
মাঝে তিনটে মাস চলে যাওয়ার পর দুজনেই বোধহয় বুঝতে পেরেছিলো দুজন দুজনকে মিস্ করছে। তখনো ভালোবাসার কোন কথাই বলা হয়ে ওঠেনি।তারপর আবার ছয়মাস বাদে রুদ্র এলো তখন সত্যিই মন আর কোন বাধাই মানলোনা। ঐ সাতদিন যেন ছিলো স্বপ্নের মত এখনো মনে হলে ভালোলাগাতে মনটা ভরে যায় ওর। তারপর মাঝে মাঝে দেখা বাকি সময় ফোনে কথা।
একটুু সমস্যা ছিলো অশ্রুতার তাই রাতুল হবার আগে একদম বিছানায় শোয়া। কতদিন ঘুঙুর পায়ে পরে দেখেইনি বাচ্চার জন্য। সত্যিই বোধহয় মা হওয়া মুখের কথা নয়।রুদ্রর ব্যস্ততার জন্য পুরো সময়টা ছেলেকে দেয় অশ্রুতা। ওর ভালোবাসাকে একপাশে সরিয়ে রেখেছিলো অনেকদিন।শুধু স্কুলের চাকরিটা রুদ্রই বলেছিলো নিতে," না অশ্রুতা,চাকরিটা তুমি নাও।অত সংসারী বৌ আমার ভালো লাগেনা।আর সকালে স্কুল তো।কোন সমস্যা হবেনা,ইচ্ছে করলে বিকেলে একটা নাচের স্কুলও করতে পারো।"
সেটা অবশ্য হয়নি কারণ রাতুল একটু পিছিয়ে,ডাক্তার বলে ওর একটু আই কিউ কম।তবে ঠিক হয়ে যাবে সময়ের সাথে সাথে।একটু শুধু যত্ন আর ভালো করে সময় দিতে হবে ওকে।তাই অশ্রুতা ওর পুরোটাই ছেলেকে দেয়।
" আচ্ছা মেয়েরা বিয়ের পর এত পাল্টে যায় কেন?"
" কি করবে? যার বর সারাদিন বইয়ে ডুবে থাকে তার বৌয়ের তো পাল্টাতেই হবে।"
আদর করে ওকে কাছে টানে রুদ্র," আমি সেই ছোটুকে খুব খুঁজি যে ডানপিটে ছিলো,সাইকেল চালাতো আর ধেই ধেই করে নাচতো।"
" তাই নাকি? এখনো তো স্কুটি চালিয়ে বাজারে যাই।আর নাচিও ধেই ধেই করে।"
অশ্রুতার গায়ের গন্ধে মুখ ডোবায় রুদ্র," সেই নাচ নয়।যে আমার গানের সাথে নাচতো।"
" প্রফেসরের এখনো সেই প্রেমিক মনটা আছে তো? আমি তো খুঁজেই পাইনা।ভাবি মনটা বই পড়ে পড়ে আর পড়িয়ে বুড়ো হয়ে গেছে।"
" আটবছরের বড় বলে বুড়ো বলা? প্রমাণ দেবো নাকি?"
" ছেলে উঠে যাবে এবার কিন্তু।"
অশ্রুতার ভালোবাসার বর আর যত্নে মোড়ানো ঘরে আনাগোনা করে প্রতিনিয়ত রুদ্রর ছাত্র ছাত্রীরা।অশ্রুতাকে ওরা দিদি বা বৌদি বলে,রাতুল সবারই আদরের। তার মধ্যেই নীলাটা একটু বেশি আদুরে।মেয়েটার মা বাবা নেই দাদা অনেকটা বড় ওর থেকে।দাদা বৌদির কাছে থাকে,তাই অশ্রুতার হয়ত একটু দূর্বলতা আছে ওর জন্য। মাঝে মাঝেই বলে," বৌদি তোমার কাছে কত আবদার করি তুমি রাগ করোনা। আমার বৌদি যেন কেমন।সব সময় রাগ ভাব।যেন আমাকে দেখতেই পারেনা।"
" সে কি এত মিষ্টি একটা মেয়ে তাকে দেখতে পারেনা আবার কি? পড়াশোনা করে চাকরি কর দেখবি খুব ভালোবাসবে।তুই যা চঞ্চল,নিশ্চয় বাড়িতে উৎপাত করিস কথা শুনিসনা বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারিস তাই বৌদি রেগে যায়।শোন একটা বড় ননদ থাকা অনেক দায়িত্ব তাই একটু শাসনে রাখে।"
সবটা বলতে পারেনা নীলা,শাসন করলেও ভালো ছিলো।বৌদি তো ওর সাথে কথাই বলেনা।সব কথা দাদাকে লাগায়।আজকাল দাদাও কেন যেন ওকে সহ্য করতে পারেনা।কেন যে মা বাবা এত তাড়াতাড়ি চলে গেলো। আজকাল ওদের কারো সুখ ওর সহ্য হয়না। বৌদি এসে দাদাাকে কেড়ে নিলো।
" কি ভাবছিস এত? আমি তো মোটামুটি সকালের সময়টা বাদ দিয়ে বাড়িতেই থাকি চলে আসবি ইচ্ছে হলেই।"
তারপর আর বলতে হয়নি,সত্যিই চলে আসতো ইচ্ছেমত।রাতুলকে সামলাতো কখনো।আবার অশ্রুতাকে সাহায্যও করতো.." দাও দাও আমি দিয়ে আসি কফিটা।"
কফির কাপের সামনে দাঁড়িয়ে রাতুলের কথা শুনে কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলো অশ্রুতা।অনেকটা কফি পড়ে গেছে। আবার বানাতে হবে।মনের জানলায় ছেঁড়া ছেঁড়া কালো মেঘ উঁকি দেয়।তারপরেই ভাবে রাতুলের কথাতে ও বিশ্বাস করলো! রাতুল তো কল্পনার জগতেই থাকে কত সময়। কফিটা আরেকটু বসায় অশ্রুতা।
"বৌদি,তোমার কফি হয়েছে?স্যারই বললেন দ্যাখ তো অনেকক্ষণ হলো কফি আসছেনা কেন?
প্রথমে কোন কথা বলতে ইচ্ছে করেনা কেন যেন অশ্রুতার,আবার কানের কাছে বাজে রাতুলের কথাগুলো। একটু বোধহয় বেশি প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেছে নীলাকে। তবে কি সব ভাবছে? রুদ্র অনেকটা বড় নীলার থেকে। মোটামুটি ওর কাকুও বলা যায়। কিন্তু রাতুলটা বায়না করে গেলো কোথায়?
" তুই যা আমি যাচ্ছি কফি নিয়ে।রাতুলকে দেখি বায়না করে কোথায় গেলো।"
রাতুল সোনা,নীলা হাঁক মারে,অশ্রুতা পা বাড়ায় ওকে দেখতে। রাতুল এসে দাঁড়িয়েছে তখন ওর হাতে ওর প্রিয় গাড়ি।
" এই তো দুষ্টুটা এসে গেছে।"
রাতুল অশ্রুতার দিকে ঘেঁষে দাঁড়ায়..
" আয় কোলে আয় চল নিচে যাবি বাবার কাছে।"
" আমি মায়ের কাছে যাবো তুমি বাবার কোলে উঠেছো।"
" ওমা তুই দেখেছিস!ইশ আর বোলোনা বৌদি।আজ আমার কোমরটাই ভাঙতো স্যারের বই সিঁড়িতে উঠে নামাতে গিয়ে। আমাকে দেখেই স্যার অর্ডার মারলেন বই নামাতো। কি ভারী গো! আমি সামলাতে না পেরে একদম যাচ্ছিলাম ধপাস হয়ে।ভাগ্যিস স্যার ধরলো আমায়। নাহলে যে কি হতো!"
খুবই সরল স্বীকারোক্তি তাই আর অন্য কিছু ভাবার অবকাশই নেই। সত্যিই কেন যে এই সব ভাবে।রুদ্রর স্টাডি তো একটা লাইব্রেরী বটে আর ওর ছাত্রছাত্রীরা অনেক সময়ই বই নামায়।নীলাও তাই করে।সত্যিই তো কোন আক্বেল নেই লোকটার, পরের মেয়ে কি যে হত একটা বিপদ হলে!
নীলার হাতে কফি না দিয়ে নিজেই নেমে আসে একতলাতে অশ্রুতা।নীলা তখন ওপরে রাতুলের সাথে বন্ধুত্ব জমিয়ে ফেলেছে আবার।
" তুমি কি গো? মেয়েটা যদি আজ হাড় ভাঙতো কি হত বলতো? তোমার ঐ কাঠের সিঁড়িটা এবার পাল্টাও তো,পুরোনো হয়েছে।"
" কিছু হতোনা,বাচ্চা মেয়ে ছুটোছুটি করে।হবে আবার কি? তারপর যা চিৎকার দিয়েছে আমি তো একদম সময়ে ধরে ফেলেছি।"
"কফি নাও,তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও।অন্যেরা তো এসে পড়বে এবার।তারপর আর সময় পাবেনা।"
ওপরে উঠে আসে অশ্রুতা,নীলাকে ডাকে," স্যান্ডউইচটা খেয়ে নিচে যা। খাওয়া বোধহয় হয়নি তাইনা?"
" তুমি এত কিছু বোঝো কি করে গো?"
হাসে অশ্রুতা,তারপর ওকে খাইয়ে বিদায় করে।রাতুলকে ড্রয়িং করতে দিয়ে তুলি রঙ নিয়ে বসে। কয়েকদিন ধরেই একটা পাঞ্জাবিতে ফেব্রিক করছে,আজ শেষ করবেই। তারপর ওর শাড়িটা হাতে নেবে।"
রুদ্রর কলিগের মিসেস ডালিয়া বলছিলো," কত গুণ অশ্রুতার রুদ্রদা।আমি তো যে কোন অনুষ্ঠানে তোমাদের ম্যাচিং ড্রেস দেখবো বলে বসে থাকি।"
অশ্রুতা সবসময় ক্রিয়েটিভ, নতুন কিছু করতে ভালোবাসে। এখন তাই অবসরে রাতুলকে সময় দেওয়ার পাশাপাশি ড্রেস ডিজাইনিং করে,ফেব্রিক করে রাতুলের বা রুদ্রের পাঞ্জাবীতে।আবার কখনো বানায় ওদের পছন্দের খাবার।অনেক সময় নাচেও নিজের একান্তে সময় পেলে।
আজ স্যারের পড়াতে মন দিতে পারলোনা নীলা।সারা শরীরে কেমন যেন এক শিরশিরে উত্তেজনা, বুকের ভেতর কাঁপছে মনে হলেই। উঃ আজ একটু হলেই কি যে হত! ও তখন চোখই বন্ধ করে দিয়েছে ভাবছে আজ মাথা ফাটবে নাহয় পা ভাঙবে।হঠাৎই একটা বলিষ্ঠ হাত ওকে জড়িয়ে ধরলো একদম বুকের কাছে।নীলাও নিজের অজান্তেই গলাটা জড়িয়ে ধরেছিলো স্যারের। ভয়ে চোখ খোলেনি কিছুক্ষণ, স্যারও ওকে জড়িয়ে ছিলেন।থরথর করে কাঁপছিলো ও।চোখ খুলেই খুব লজ্জা পেলো,তাড়াতাড়ি করে স্যারের বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ব্যাস একচোট বকুনি খেলো।
টেবিল থেকে জলের বোতল নিয়ে ঢকঢক করে গলায় ঢালে নীলা। তখনও বুকটা কাঁপছে,শরীরটা গরম। গায়ে স্যারের স্পর্শের ছোঁয়া।মনে হলো ইউনিভার্সিটিতে স্যারের গলার আওয়াজে গমগম করে অডিটোরিয়াম। কিন্তু আজ যেন স্যারের পুরুষালি স্পর্শটাই বেশি মনকে নাড়া দিয়ে গেলো। এতো নিবিড়ভাবে আগে কোন পুরুষ ওকে জড়িয়ে কোলে তুলে নেয়নি। সত্যি কথা বলতে নীলার জীবনে ছোটখাটো ভালোলাগা ছাড়া প্রেম এখনো আসেনি।
নিজেকে একটু সামলে দোতলায় গিয়েছিল নীলা।অন্যদিন এসেই আগে দোতলায় ওঠে।আজ বইয়ের চক্করে সব মাটি। ওপরে উঠেও এক অস্বস্তি,রাতুল কখন এসেছিলো বুঝতেই পারিনি।ছি ছি বৌদি কি ভাবলো! কিছুটা ম্যানেজ হয়েছে যদিও। আজ বাড়িতে এসে নেশায় নেশায় কাটলো নীলার সারাক্ষণ অনুভব করলো একটা স্পর্শ আর গন্ধ ওকে জড়িয়ে রেখেছে।সত্যিই বৌদি কি লাকি এমন একটা মানুষ তার স্বামী। একদিন এই কথাটা বৌদিকে বলেছিলো গল্প করতে করতে। একটু কঠিন হয়ে উঠেছিলো অশ্রুতার মুখটা উত্তর দিয়েছিলো.." কেন রে আমরা কি ফেলনা নাকি?তোর স্যারও লাকি আমার মত বৌ পেয়েছে বলে। বাবা মা অনেক যত্নে আমাকে মানুষ করেছেন সব শিখিয়েছেন।নাচ,পড়াশোনা,রান্না সেলাই,এমনকি গাড়ি চালানোও। সব সময় আমরাই ভাগ্যবতী এমন স্বামী পেয়ে।আর ওরা ভাগ্যবান নয় এমন স্ত্রী পেয়ে। ঠাকুমাদের মত কথা বলিসনা তো।অনেক শিবপুজো করে এমন বর পেয়েছিস ইত্যাদি ইত্যাদি।"
সেদিন কেন যেন এক অন্য অশ্রুতাকে দেখেছিলো নীলা। পরে ভেবেছিলো বৌদি কি নারীবাদী নাকি নিজের আত্মসম্মান সচেতন?
হবে হয়ত,তবে স্যারের ওপরে যত ছাত্রীদের ক্রাশ এখনো সেখানে বৌদি চার দেওয়ালের মাঝে স্যারকে একদম নিজের করে পায় ভাবাই যায়না। ও তো কয়েক মিনিটের জন্য একদম নিজের মত পেয়েছিলো স্যারকে।মাঝখানে কেউ ছিলোনা...কি অনুভূতি হয়েছিলো তা থাক নাহয় ডায়েরি বন্দী।সেদিন রাতের মত লেখা শেষ করে চোখ বন্ধ করে পরম পরিতৃপ্তিতে নীলা।
রাতুলকে ঘুম পাড়িয়ে রুদ্রর পাশে এসে শোয় অশ্রুতা।সত্যি কি যে বইপাগল লোকটা! মাঝে মাঝে খুব রাগ হয় বইগুলোর ওপর তবুও আবার ভালোও লাগে হয়ত অপেক্ষা করে থাকে এই সময়টুকুর জন্য যখন রুদ্রকে একদম কাছ থেকে খুব কাছ থেকে দেখতে পায়।নিজের মত করে আদর করতে পারে। আলতো হাতে চশমাটা খুলে রাখে চোখ থেকে,ঘুমিয়ে পড়েছে এইভাবেই।
লাইটের নিভু আলোতে রুদ্র জড়িয়ে ধরে ওকে.." কত দেরি করো আজকাল,প্রত্যেকদিন ঘুমিয়ে পড়ি।"
" ভালোই তো,এমনি করে যায় যদি দিন যাকনা।"
"মানে,দিন যেতে দিচ্ছে কে? রাত তো আছে।"
খুঁজে পায় এক অন্য রুদ্রকে অশ্রুতা।আলতো গলায় বলে," যত দিন যাচ্ছে আরো বেশি দুষ্টু হচ্ছো নাকি?"
" আর শাসন মানছিনা দিদিমণি।"
খুনসুটিতে ভরে যায় সেদিনের রাতের টুকরো মুহূর্তগুলো।
অশ্রুতা জানে রুদ্র পড়াশোনা পাগল,অবশ্য অনেকেই বলে তার সাথে বৌ পাগলও। কিছুদিনের মধ্যেই হয়ত আরেকটা ভালো খবর পাবে অশ্রুতা তবে তার থেকেও ওর মন খারাপ রুদ্রকে ছেড়ে থাকতে হবে বলে।
" এখনো তো কোন চিঠি আসেনি অশ্রুতা,আগে আসুক তারপর দেখা যাবে। তুমিও যাবে মাঝে মাঝে। আর একটা বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে।"
কিছুদিন রুদ্র নিজেকে প্রস্তুত করছে,ছাত্রছাত্রীদের বাড়িতে আনাগোনা কমেছে। যেটুকু সময় ইউনিভার্সিটিতে থাকতে হয় তার বাইরে শুধুই পড়াশোনা। অশ্রুতার মাঝে মাঝে অবাক লাগে ওকে দেখে।তবুও নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে আরো বেশি দায়িত্ব আর একলা থাকার অবসরকে কাজে লাগায় শাড়ি পাঞ্জাবি এঁকে। রাতুলের দিন দিন উন্নতি হচ্ছে।
ছেলের জন্য বুক ফোলায় রুদ্রও," আমার তোমার ছেলে। তাছাড়া বাবাও ভীষণ ভালো ছাত্র ছিলেন মায়ের কাছে শুনেছি। ওর আই কিউ কম হবে কেন শুনি?"
মুখ টিপে হাসে অশ্রুতা অভিমান ঝরে কথায়," সারাদিন ছেলে আগলাবো আমি আর এখন আমার ছেলে আমাদের বাড়ির ছেলে।"
অশ্রুতাকে জড়িয়ে ধরে রুদ্র "আমাদের ছেলে।"
নীলা এখন প্রতিদিন না হলেও মাঝে মাঝে আসে। এরমধ্যে দীর্ঘ দশদিন বাদে হঠাৎই এলো। ও নিজেও একটু ব্যস্ত পড়াশোনায়। বাড়ি থেকে বিয়ের চাপটা এতদিনে কমেছে অনেক ঝামেলা করে।
বৌদি ডাকটা শুনেই অশ্রুতা বুঝতে পারে নীলা। অশ্রুতা তখন শাড়ির আঁচলে দুর্গার কোলে গণেশের মোটিফ আঁকছিলো। পাশে রুদ্রর পাঞ্জাবি রাখা। নীলার ডাক শুনেই দরজার দিকে তাকায়, একটু বাদে রুদ্র আর রাতুলও আসবে।
নীলা অবাক হয়ে যায় শাড়িটা দেখে।" কি সুন্দর গো বৌদি! আমি এইসব পারিনা গো। আমাকে শেখাবে?"
অশ্রুতা কিছুক্ষণ ভাবে ওর গালে টোল পড়ে হঠাৎ হাসিতে তারপর বলে," আচ্ছা তোর বিয়েতে দেবো এমন একটা শাড়ি নিজে কাজ করে। আর পাঞ্জাবিও। নেমন্তন্ন করবি তো?"
" কি যে বলো বৌদি? তোমাকেই তো সাজাতে হবে আমাকে।"
নীলার কথায় গালের টোল আরো গভীর হয় অশ্রুতার চুলের গোছা অবাধ্য হয়ে চোখেমুখে পড়ে। দুহাত জড়ো করে খোঁপার বাঁধনে সামলায় চুলটা অশ্রুতা। হঠাৎই নীলার নজর পড়ে যায় অশ্রুতার গলার পাশের লাল দাগটায়। গা টা কেমন যেন শিরশির করে ওঠে আর তাকাতে পারেনা। স্যার এখনো রোমান্টিক ভীষণ রকমের এটা বোঝে।
অশ্রুতা রঙ করতে করতে আপন খেয়ালেই বলে যায়," এতদিন ছিলি কোথায়?"
" বলছি গো,আচ্ছা স্যার কখন আসবেন?"
" এই তো এসে পড়বে।"
" আমি সামনে সপ্তাহে দিল্লী চলে যাচ্ছি বৌদি। ওখানে একটা প্রোজেক্ট নিয়েছি আপাততঃ তারপর দেখি কি হয় । অনেকদিন আসা হয়না তাই এলাম দেখা করতে।"
" বাহ্ এই তো তোর দরজা খুলে গেছে।আর তোকে পায় কে? এখানে এলে চলে আসিস মাঝে মাঝে। রুদ্র খুশি হবে শুনে।"
স্যারের সঙ্গে অনেকটা সময় আজ কথা বলতে পারলো নীলা। যদিও সবটাই পড়াশোনার তবুও ভালোলাগা ছুঁয়ে রইলো অনেকটা রাত অবধি।
তবুও বারবার উঁকি দিলো বৌদির গলার কাছের দাগটা। কেন যেন মনে হলো ওকে ভালোবাসা বাসি দেখাতেই বৌদি তখন উঁচু করে খোঁপা বাঁধলো। ঘরে বাইরে ভালোবাসা দেখতে দেখতে গায়ে জ্বালা ধরে নীলার হয়তো বা শরীরেই।তাইতো বাড়ি ছাড়ছে,এরমধ্যে ওর গয়না আর জমানো টাকা আদায় করেছে দাদার কাছ থেকে। নিজের জীবন নিজের মত করে বাঁচবে। যদিও বৌদি বলেছে দাদাকে," দাও দিয়ে দাও যা চায়,অন্ততঃ একটু শান্তি দিক আমাদের।"
নীলা সুখী দাম্পত্য কেন যেন দেখতে পারেনা তা বৌদিরই হোক আর নীলা বৌদিরই হোক।
*****************
মাঝে কেটে গেছে মাস ছয়েক,সামনের সপ্তাহে রুদ্র বাইরে যাচ্ছে। মা থাকলে সত্যিই খুব খুশি হত।রুদ্রর মুকুটে যোগ হবে বিদেশী ইউনিভার্সিটির পালক হয়ত কিছুদিনের মধ্যেই।সবাই এই সুযোগ পায়না।তবে মনটা পড়ে থাকবে অশ্রুতা আর রাতুলের জন্য। এখন এই ভিসাতে কিছুতেই ওদের নিয়ে যাওয়া যায়না।তাছাড়া অশ্রুতার চাকরিও আছে। তবে একবার ওদের ওখানে ঘুরতে যাওয়ার ব্যবস্থা করতেই হবে। অশ্রুতা ঠাণ্ডা মাথায় সব গোছালেও কোথায় যেন মন খারাপের মেঘলা রোদ্দুর এসে কাঁপুনি ধরায় একলা মনে। তবুও রুদ্রর স্বপ্ন পূরণ হোক। যদিও অভিদা বলছিলো," এখানে থেকে কি কিছু হতনা? রুদ্র চিরকালই একটু খামখেয়ালী। তুই তো একা রয়ে যাবি এখানে।"
তা হোক মাত্র তো এক দেড়বছর ঠিক কেটে যাবে এই ভেবে নিজের মন খারাপকে গুছিয়ে নেয় অশ্রুতা অল্প একটু জল ঝরিয়ে সাবধানী চোখে। পাছে রুদ্র না দেখে ফেলে।তাহলে হয়ত বলবে থাক তুমি কষ্ট পাচ্ছো আর যাবোনা। তাছাড়া রাতুল দেখলেও মুশকিল, ছেলেটা বড্ড মা ন্যাওটা মায়ের একটু চোখের জলে ওর মন ভারী হবে।
রুদ্র চলে যাওয়ার সময় নিজেকে তাই হাসিমুখে ধরে রাখে অশ্রুতা, জয়ী হয়ে ফিরে এসো মুখে বলে।
রুদ্র ওকে জড়িয়ে ধরে বলে," জয় তিলক এঁকে দাও কপালে তবে তো। অনেকগুলো চুমু চাই কিন্তু আমার।"
রুদ্র চলে গেছে অনেকগুলো দিন হলো,ফোনে প্রতিদিনই কথা হয়। অশ্রুতার চাপ বেড়েছে কিছুটা একা হাতে সবটা সামলাতে হয় অবশ্য মনিকা মাসি আছে তাই অনেকটা নিশ্চিন্ত। তার সাথে মন ভালো রাখার জন্য নিজেকে বেশ কিছুটা সময় দেয় অশ্রুতা রাতুলের স্কুলে থাকার অবসরে।
মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো মাস।সেদিন দুপুরে হঠাৎই ফোন আসে ল্যান্ডফোনে। ওপাশ থেকে হাসির ঝনঝন শব্দ বলে দেয় নীলা। অশ্রুতা অবাক," সেই যে দিল্লী গেলি আর কোন খবর নেই কেন?"
" এই তো খবর দিলাম গো,তারপর বলো তোমরা কেমন আছো? আচ্ছা বৌদি স্যার কোথায়?"
" ওহ্ তোকে বলাই হয়নি স্যার তো এখন ক্যালিফোর্ণিয়ায়। তবে বেশিদিনের জন্য নয়।"
" ইশ্ আমি তো কিছুই জানিনা। তুমি একা সব সামলাচ্ছো। নিশ্চয় মন খারাপ খুব তোমার?"
নিজের মনের হদিশ সবাইকে দেয়না অশ্রুতা তাই হাসে," না রে সব ঠিক চলছে। ফোন করিস মাঝে মাঝে আর বিয়ের আগে জানাস তোর একটা শাড়ি পাওনা আছে মানে আব্দার করা আছে তো।"
"ছাড়ো তো বিয়ের কথা,আগে পড়াশোনা শেষ হোক"..বলেই তাড়াতাড়ি ফোন ছাড়ে নীলা। ওর মনে তখন একটা খুশির ফানুস। স্যারকে একটা ভালো খবর দেবে ভেবেছিলো ফোনে। তা এভাবে দিতে পারবে ভাবেনি। তবে বৌদিকে তো? থাক বরং....
************************
ইউনিভার্সিটি থেকে বাইরে এসে এককাপ কফি খেয়ে সূর্যের ডুবে যাওয়া দেখা অভ্যেস হয়ে গেছে রুদ্রর। তবে সবদিন আবহাওয়া ভালো থাকেনা। হঠাৎই একটা স্যার বলে একটা উচ্ছ্বাসের ডাকে অবাক হয়ে যায় রুদ্র "আরে নীলা তুই এখানে? আমি হাসিতেই চিনেছি।"
" স্যার আমি ফোন করেছিলাম আপনাকে খবর দেবো বলে এখানে আসছি।বৌদি বললো আপনি এখানেই আছেন তাই একদম ফলো করে সারপ্রাইজ দিয়ে দিলাম।"
অবাক হয়ে যায় রুদ্র সত্যিই মেয়েটার ক্ষমতা আছে রীতিমতো স্কলারশিপ নিয়ে চলে এসেছে এখানে।
" অশ্রুতা তো কিছু বলেনি আমাকে তোর খবর।"
" আসলে গল্পে গল্পে আমারই বলা হয়নি। আচ্ছা আমি আবার একদিন ফোন করে বলবো বৌদিকে।"
নীলার আব্দারে সেদিন ওর অ্যাপার্টমেন্ট হয়েই ফিরতে হলো রুদ্রকে। আসলে অশ্রুতার আদরে ছাত্রীর চেয়েও ঘরের মেয়েই বেশি হয়ে গেছিলো মেয়েটা। সব সময় ও বলতো মা বাবা মরা মেয়ে মায়া লাগে আমার।
তবে রুদ্রর কাছ থেকে ফোনে নীলার কথা শুনে অশ্রুতা কেন যেন অনেক কষ্ট করেও খুশি হতে পারলোনা। বারবার মনে হলো মাসখানেক আগেই তো ফোন করেছিলো একবারও তো বললোনা কিছু। কেন যেন নীলাকে অদ্ভুত রহস্যময়ী বলে মনে হয় অশ্রুতার।
হয়ত ভাঙনের শব্দ তৃতীয় নয়ন থাকার জন্য মেয়েরাই আগে পায়। কেন যেন হঠাৎই মনে হয়েছিলো রাতুলের দুবছর আগে বলা কথাগুলো। তাহলে নীলা কি প্ল্যান করেই গেছে ওখানে? কত গল্পই তো শোনে এমন।
তারপর নিজেকে নিজেই বুঝিয়েছিলো রুদ্র কোথায় আর কোথায় নীলা একটা পুচকে মেয়ে। তবুও হেসে রুদ্রকে বলেছিলো," ওকে বেশি মাথায় তুলোনা বুঝলে। জানোই তো কোন কান্ডজ্ঞান নেই ওর।
আচ্ছা নীলার কি একটু খোঁজখবর নেবে? ঈশান তো একসময় রুদ্রর কাছে পড়তো মনে হয় নীলাকে পছন্দও করতো। ওর সাথে মাঝে মাঝে দেখা হয় ওকে কি বলবে?নিজেকে বকুনি দেয় অশ্রুতা ইশ্ কি ভাবছে!
*****************************
ক্যালিফোর্ণিয়ায় এসে নীলার মনে হলো স্যারকে বোধহয় ওর জন্য না না ওকেই রুদ্রস্যারের জন্য এখানে পাঠিয়েছেন ভগবান নাহলে হঠাৎই এমন যোগাযোগ হবে কেন? স্যার দুবছর আগের মত এখনো আগুন জ্বালায় ওর মনে।নীলা এখন আরো পরিণত আর ওর জ্বালানো আগুন নেভানোর জন্য বৌদিও এখানে নেই। কতদিন কেউ ওকে ভালোবাসেনা, ঐ আদরের চিহ্নগুলো ওর চাই।
মাঝে কেটে গেছে বেশ কয়েকদিন, নীলা জানে প্রতিদিন স্যারের ওখানে গেলে বা স্যারকে ডাকলে উনি বিরক্ত হবেন। হয়ত বা সন্দেহও হতে পারে। এমনিতে রুদ্র রাশভারী সে কথা ছাত্রছাত্রীদের সবার জানা । তবুও ও একদম নিজের করে পেতে চায় স্যারকে।বৌদি তো এখানে নেই যদিও ও জানে বৌদি ওখানে থেকেও এখনও স্যারের মন জুড়ে বসে আছে।কথায় কথায় শুধু অশ্রুতা। কিছু মানুষ বোধহয় সব পায় জীবনে যেমন বৌদি। ওর হিংসে হয় বৌদিকে, খুব হিংসে হয়।
মাঝে কেটে গেছে বেশ অনেকগুলো দিন। হঠাৎই সেদিন রাতে ফোন এলো রুদ্র তখন ডিনার করছে।নীলার ল্যান্ডলেডির ফোন,খুব জ্বর নীলার। ভুল বকছে। ও ফোন নম্বরটা দিলো,একবার এলে ভালো হয়।
কম্বলের ভেতরে স্বচ্ছ্ব রাতের পোষাকে ঢাকা নীলার দেহটা থরথর করে কাঁপছে।সারা শরীরে আগুন জ্বলছে উত্তেজনায়। বাঘিনীর মত ওত পেতে বসে আছে নীলা।
দরজায় নক হতেই নিজেকে আরো জড়িয়ে জড়ানো গলায় বলে কাম ইন স্যার। আবার একবার দেখে নেয় ব্ল্যাক কফির ফ্লাক্সটা।সব ঠিকঠাক আছে,ও জানে ব্ল্যাক কফি স্যারের খুব পছন্দ। তাই একদম রেডি করে রেখেছে। ওটা খাওয়ার পরই শুরু হবে সবটা ততক্ষণ ঐ অসুস্থ সেজে থাকা।
নেভা আলোতে ঘরটা ডুবে রয়েছে।রুদ্র ঘরে আসছে বুঝতে পারে নীলা। এখনি হয়ত ওর কপালে হাত দিয়ে জ্বর মাপবে। কাতরাতে থাকে নীলা হঠাৎই অনুভব করে একটা হাতের ছোঁয়া কপালে। কিন্তু এটা তো স্যারের ছোঁয়া নয়।
তাহলে? চমকে ওঠে নীলা। ততক্ষণে শুনতে পায়.." রুদ্র ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে দাও। এবার তোমার ছাত্রীর সত্যিই একটা বিয়ে দেওয়া দরকার। নাহলে একলা ঘরে থেকে এভাবে আতঙ্কেই কোনদিন মরে যাবে। কি রে উঠে বোস,কিছু হয়নি। কোথায় জ্বর? আর জ্বর হলে তো ডঃ কে ফোন করবি। স্যার তো ডক্টরেট।"
বৌদির গলায় একটা ঠাট্টার সুর ভেসে ওঠে।কোন কথার উত্তর দিতে পারেনা নীলা। ওর লালচে চোখদুটো দেখে অশ্রুতা,অদ্ভুত লাগে। ও বলে ওঠে," একি বৌদি! তুমি কখন?"
" আজই এসেছি রে।"
" কই কিছু বলোনি তো?
মানে স্যারও তো।"
" তোর স্যার তো এমনিই, বইপাগল।আর তুইও তো আমাকে বলিসনি সেদিন তুই এখানে আসছিস।কেন বলিস নি?"
বৌদির গলাটা অদ্ভুত কঠিন লাগে নীলার।
রুদ্রকে একটু বাইরে যেতে বলে অশ্রুতা নীলাকে ডাকে.." ওঠ কিছু খেয়ে নে।আমি একটু খাবার নিয়ে এসেছি।"
নীলাকে দেখে অবাক হয়ে যায় অশ্রুতা, তাহলে ঈশান ঠিকই বলেছিলো নীলা অদ্ভুত এক স্বভাবের মেয়ে।এ কেমন পোশাক নীলার? এভাবে রুদ্রর সামনে! আর কিছু ভাবতে পারেনা অশ্রুতা। দেওয়ালে ঝোলানো হাউসকোটটা ওকে এগিয়ে দিতে দিতে বলে," মাস খানেকের জন্য এসেছি ছুটিতে।রাতুলটা অসুস্থ হয়ে পড়ছিলো বাবাকে না দেখতে পেয়ে। তোর শরীর খারাপটা ভালো দিনেই হয়েছে মানে আমি এসে পড়েছি। "
নীলার শরীরটা কাঁপতে থাকে,অশ্রুতা ওকে কোন কথা বলতে দেয়না।
নিজেই বলতে থাকে,"আর হ্যাঁ তোর স্যার হয়ত এবার আমাদের সাথেই চলে যাবে,বাকি কাজটা ওখান থেকেই করবে। আগে তো ছেলেটা। তারপর দরকার হলে আবার আসবে।"
নীলার সামনে গড়া ঠুনকো কাঁচের দেওয়ালটা চুরমার হয়ে ভেঙে পড়ে অশ্রুতার ভালোবাসার ঘরের সামনে।
*****************************
অনেকটা আগেই ওরা ফিরে এসেছে রুদ্রর অস্থায়ী ঠিকানায়। রাতুলটা ঘুমোচ্ছে অঘোরে,বাধ্য হয়ে ওকে নিয়েই যেতে হয়েছিলো গাড়িতে শুইয়ে। অনেকদিন বাদে আবার রুদ্রর বুকে মাথা রেখেছে অশ্রুতা। ওর গালের টোল দুটো ভেজা রুদ্রর আদরে। তবুও অশ্রুতার মনটা অশান্ত। হয়ত ওর ভালোবাসার ঘরের অন্দরে একটু বেশিই ঢুকে পড়েছিলো নীলা।
দুঃখ,ভালোবাসা আর সুখ সবটাই বোধহয় আগলে রাখতে হয় অন্যের নজর বাঁচিয়ে। আজ ও না থাকলে কি হত? খারাপ কিছু? হয় তো এমন কত ঘটনাই। কত ভালোবাসার ঘর ভেঙেচুরে যায় এমন ভাবেই হঠাৎ। কার দোষে এমন হলো ভাবতে ভাবতে ভালোবাসার ঘরে থাকা কত মানুষই ক্ষতবিক্ষত হয়। কেউ বা উড়ে যায় নতুন বাসার খোঁজে যেখানে ঘর বাঁধে নতুন কোন সঙ্গীর সাথে। আর কেউ পড়ে থাকে পুরোনো ঘরেই,সারাতে চেষ্টা করে ফুটো ছাদটাকে আর ভাঙা দেওয়ালটাকে খুব কষ্টে।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment