ুশ_ভাবনার_একুশ_দিন#
ভোর বেলা ঠিক সাড়ে চারটার সময় উঠে শুরু হয় আমার ছোটাছুটি।ঘড়ির দিকে তাকানো আর ছুটে বেড়ানো..বরের খাবার গোছানো,টিফিন বানানো।আগে ছেলেমেয়েদের টা করতে হত এখন হয়না ওরা দুধ কর্নফ্লেক্স খেয়ে বেরোয় তাই।তার মধ্যেই চট করে নিজেরটা গুছিয়ে নি।বেশিরভাগই ওটস বা কর্নফ্লেক্স খাই আর সাথে ফল।তারপর শুরু করি নিজেকে গোছানো স্কুলে বেশিরভাগ শাড়ি পরতেই ভালোবাসি আমি।আরে গাদাগুচ্ছের শাড়ি।না পরলে কি হবে ওগুলো? আজকাল যত নিজে ভারী হচ্ছি তত শাড়ি হাল্কা খুঁজি।কপালে ছোট টিপ হাল্কা লিপস্টিক আর গলায় বা কানে কিছু ম্যাচিং এই করতে করতেই বারবার ডাইনিং স্পেসের ঘড়ির দিকে তাকাই।তারপর পাঁচটা চল্লিশ বাজলেই টা টা করে একদম ছুট।ওদিকে সাড়ে ছটায় পৌঁছতে হবে।আর তার পরেরটা ইতিহাস আমি তখন চার্লি চ্যাপলিন।
ষোলো তারিখে শেষ স্কুলে গিয়েছিলাম,মানে দরকারে যেতে হয়েছিলো। তারপর দুদিন বিশেষ কাজে বেরোলাম সাবধানতা নিয়ে ভয়ে ভয়ে। বাড়িতে আছি,আগেও সময় পেতামনা এখনো পাইনা।ইচ্ছে করেই অবকাশ নিইনা।আমরা যেহেতু কর্মরতা তাই অবসাদ আসবেই এভাবে দিনের পর দিন বাড়ি থাকতে। তবে অবসাদ বেশি আমার পতিদেবের গৃহবন্দী হয়ে। কোন কাজই মনঃপূত হচ্ছেনা। এটা কোরো, আচ্ছা আজকে বরং ব্রেকফাস্ট বানাও। ঠোঁট উল্টে বলে কিছু দিলে দাও না দিলে খাচ্ছিনা। বিরক্ত না হয়ে হাসি বুঝতে পারি হঠাৎই বেরোনো বন্ধ হয়ে যাওয়াতে মানসিক অস্থিরতা বাড়ছে।তাই মুখ বন্ধ রাখাটা জরুরী।
এখন সকাল শুরু হয় সাড়ে ছটায়, ঘুম ভাঙে যথারীতি পাঁচটায় তবে একটু গড়াগড়ি করতে থাকি। তারপর শুরু করি যা করতাম আগে। এখন সকালে একটু সময় দিই গাছগুলোকে।মন ভালো করি ওদের দেখে,নতুন পাতা গজালো কিনা দেখতে দেখতে সকালের সূর্যকে বলি মুছে দাও রোগ জীবাণু।মোছাও অন্ধকার,ভালো রেখো পৃথিবীর সবাইকে আর পৃথিবীটাকেও।
একটু হাল্কা গভীর শ্বাস নিই মনকে শান্ত ও উদ্বেগমুক্ত করতে। তারপর জানলায় দাঁড়িয়ে দেখি বাইরেটা। কতজন বেরোচ্ছে মুখে মাস্ক আছে কি না। একটু শুনতে চেষ্টা করি বাইরের শব্দ অনেকদিন শুনিনা তো তাই। আমাদের আবাসনের মাসিমাকে দেখি বাজারের থলে নিয়ে প্রতিদিন মাস্ক পরে বাজারে যান। মনে মনে ভাবি নিরামিষ খান তাহলে কেন যান প্রতিদিন? একা মানুষের কত কি লাগে? বয়েস তো আমার মায়ের কাছাকাছি হবে,মানে সত্তর পেরিয়েছে। হয়ত নাতির জন্য মাছ কিনতে বেরোন। এখনকার প্রজন্ম যদি একটু বুঝতো। মায়ের কথা মনে হয়,মা চলে গেছে দেড়বছর প্রায় হলো ভাগ্যিস মা বাবাকে এইদিন গুলো দেখতে হয়নি। গৃহবন্দী অবস্থা,মানসিক চাপ ভয় আরো কত কি।
টুকটুক করে রান্নাঘরে যাই,ইলেকট্রিক কেটলিতে জল গরম করা দিয়ে দিন শুরু।চা ভেজাবো,কেউ না উঠলে একাই খাই।তারপর স্বামী ছেলে মেয়ে উঠলে শুরু হয় মাল্টিটাস্কিং।বরের গ্ৰীন টি,মেয়ের দুধ চা।জলখাবার বানানো তারপর দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা।
একটু সংযম করে চলছি পরিস্থিতি ভালোনা।যতটা কমে চালানো যায়। একটা দুটো ভালো পদ বানাচ্ছি তার মধ্যেই বরের পছন্দের বা ছেলেমেয়েদের পছন্দের।আজ দইমাছের সাথে বানালাম কচুর শাক ইলিশের মাথা দিয়ে।ফ্রীজে রাখা ছিলো মাথা। বরকে বেরোতে দিচ্ছিনা,সত্যিই প্যানিকে অনেক কিছুই এনে রেখেছে।একটা একটা করে বানাচ্ছি। মেয়েকে তুষ্ট করার জন্য মাছের ডিমের বড়া,সাথে ডাল।
ছুটি অথচ একটা দমবন্ধ করা আবহাওয়া তাই নিজেকে কখনো কুর্তা,কখনো স্কার্ট পরিয়ে একটু চাঙা রাখছি।সবাই টিপটপ থেকো মন ভালো থাকবে। আর লেখাতে মন দিই দুপুরে যদিও মন লাগেনা।তবুও কখনো উদ্ধৃতি কখনো নিজের কথা এইসব লিখছি। মহাযুদ্ধের একুশদিনে ভালো তো থাকতে হবে।সবাইকে ভালো রাখতে হবে।মেয়ের সাথে একটু মজা করেনি।একসাথে বসে কার্টুন দেখি।বিকেলে টুকটাক খুচমুচ খাবার মেয়েই বানায়। তারপর চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চেষ্টা করি বরের পাশে বসে সিনেমা দেখতে।ছেলে বাড়ি থাকলে ওকে ডেকে নিই।কাল সুপার থার্টি দেখলাম ভীষণ ভালো লাগলো।
অপেক্ষায় আছি সবার মত ভালো দিন দেখার আর ভালো থাকার আশায়।
#আজ_আঠাশ#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
দেখতে দেখতে বেশ গরম আবহাওয়ার হাতছানি মানে গরম আসছে।বসন্তের শেষ রেশটুকুকে চোখ রাঙানি বলেই মনে হয়েছে এই কটা দিন।সেই দোলের আগে থেকেই করোনা ত্রাশে অনেকেই নেননি আবিরের ছোঁয়াটুকু। আমি যদিও চোখ দিয়ে আর মন দিয়ে সবটুকু স্বাদ নিতে চেয়েছি বসন্তের বড় প্রিয় ঋতু যে আমার। এই কদিন বাইরে বেরোচ্ছিনা।আগে স্কুলের পথে আমাদের পাড়ার গাছের সারি দেখতে দেখতে যেতাম তারপর সদ্য উদিত সূর্যের আলোয় স্নান করা সবুজের শোভায় মনটা মেতে উঠতো ময়দানের কাছে এলেই।সবুজে কখনো হলুদের তুলি কখনো বা লালের তুলির টান মনকে ছুঁয়ে যেতো। দেখিনা,কতদিন দেখিনা তাই হাত দিয়ে ছুঁয়ে নিই বারান্দার গাছগুলো।আবার কবে দেখবো কে জানে? মাঝে মাঝে সত্যিই মনে হয় দেখবো তো আবার? ভয় হয় আবার আশা খুঁজি।বরকে বললাম গতকাল ঘরের কোথায় কি আছে।ওগুলো আমাকে দেখতে হয়,সবাই তো জানেও না কোথায় কি।আশার মধ্যেও মানসিক প্রস্তুতিও জরুরী।ভালো থাকতে হবে, ভালো রাখতে হবে আর পরিকল্পনাও করতে হবে।যেমন কিভাবে বেরোবো প্রয়োজনে।যাতে না বেরোতে হয় বা সপ্তাহে একদিন বেরোবো দরকারে তারজন্য গুছিয়ে রাখতে হবে রেশন প্ল্যানিং করতে হবে একটু রান্নাঘরেও। অল্পের মধ্যে কি করে মুখরোচক কিছু করা যায় বা কম সামগ্ৰীতে রান্না হবে তা ভাবি।আজ রান্নার দায়িত্ব নিয়েছে মেয়ে ও তারাতলায় হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়ে।সব বন্ধ তাই ও বা কি করবে?সবাই তো আমরা কাজ খুঁজি।বেশি কাজে যেমন হাঁফিয়ে উঠি,তেমন অকেজো হয়ে থাকলেও মন খারাপ হয়।তাই সকালের ব্রেকফাস্ট করে আমি রান্নাঘর ছেড়েছি।কাজের সময় সামনে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে পুরো স্বাধীনতা দিতে ভালোবাসি।এতে বাচ্চারা আনন্দে কাজ করে। ও বানাবে জিরা রাইস আর মালাই পনীর।ওর রান্নাও একটা মিঠে স্বাদ আমাদের এই করোনা সংকটে। দেখলাম কম পদ হবে অথচ মুখরোচক ওরা তৃপ্তি করে খাবে। এর মধ্যেই ছেলে বললো এমার্জেন্সীতে ওদের আইসিউতে ডিউটি দিতে হবে টানা সাতদিন।তারপর থাকতে হবে কোয়ারেন্টাইনে চোদ্দ দিন যে কোন হোটেলে। তারপর কি হবে?হয়ত রিস্কও আসতে পারে।মনটা ভারী হয়ে গেলো কিন্তু কিছু করার নেই সেই আবার মেনে নেওয়া মনে সাহস রাখা। একদিকে নিজেরা গৃহবন্দি থেকে ওকে ছেড়ে দেওয়া অন্ধকারের দিকে না না কি সব বলছি ওরাই তো আলো দেখাবে নিয়ে আসবে অনেক মানুষকে আলোর দিকে।আলোর পথের সহযাত্রী ওরা,নিশ্চয় ওরা ভালো থাকবে,থাকবেই ওরা ভালো।মায়েদের ভালোবাসা ঘিরে রাখবে ওদের। আকাশের দিকে তাকাই বেশ রোদ উঠেছে সকাল থেকে পাখিরা আনন্দে কিচকিচ করছে,মুক্তির আনন্দে ওরা আজ অনেক সুখী মানুষের চেয়ে। মনের সুখে প্রেম,ভালোবাসা আর ঝগড়া সব করছে।গ্ৰীলবন্দী আমি মনটাকে উড়িয়ে দিলাম ওদের সাথে আর মনে মনে কবিগুরুর ভাষায় বললাম এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়।
আশার আলো ছড়িয়ে পড়ুক সারা পৃথিবীতে,গৃহকোণ থেকে মন্দিরে। ধুয়ে মুছে যাক সব অভিশাপ আর করোনা নামের অভিশাপ।ভালো থাকবো সবাই,শুধু একটু সচেতনতা আর সংযমে রেখো নিজেকে।
#অন্য_রবিবার#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
সারা সপ্তাহ কাজের পর শুক্রবার থেকেই মনটা উড়ু উড়ু হয়ে যায়। যদিও আমাদের শনিবার স্কুল থাকে তবুও মনে হত আরেকটা দিন হলেই একদিন ছুটি। গরমের ছুটি আজ পুজোর ছুটির আগেই দিন গুনতাম,দেখা হয়ে যেতো হলিডে লিস্ট আগে থেকেই।আর চলতো প্ল্যানিং বেড়াতে যাবার।অনেক মিটিং আর সিটিং করে ঠিক হত জায়গা। এবারও গরমের ছুটির টিকিট কাটা হয়ে গেছে,কত স্বপ্ন আবার দেখতে শুরু করা পাহাড়ে যাবো।আমার পছন্দের পাহাড় দেখবো তার বিশালতা অনুভব করবো চোখ বুজে ছোঁয়া নেবো নিঃশব্দতার প্রাণভরে।
আমাদের হোমস্টের ছবিটাও দেখেছি,ছোট্ট পাহাড়ের কোলে হোমস্টে।চারিদিকে সবুজে সবুজ আর সামনেই একটা ছোট্ট পাহাড়ি নদী তিরতির করে বয়ে চলেছে। আমি তো স্বপ্নে কবেই পৌঁছে গেছি। আগে থেকেই ভাবি কি পোশাক পরবো, অনেক ছবি তুলবো। কতই তো আছে পোশাক তবুও ভাবি,সাজতে ভালোবাসি তাই হয়ত।
কিন্তু স্বপ্নের জাল কেন ছিঁড়ে যায় কে জানে। কোথা থেকে এলো করোনা,কত রোগই তো আসে আবার মানুষ সুস্থ হয়ে যায়।কিন্তু এ কেমন রোগ? ক্যান্সারের থেকে এডসের থেকেও কি ভয়ঙ্কর? সত্যিই মাঝে মাঝে আমি কেমন যেন বোকা হয়ে যাই।চিন্তাশক্তি লোপ পেয়ে যায়।ঠাকুরকে বলি,কি এমন চেয়েছি বলতো আমরা।একটু ভালোই তো থাকতে চেয়েছি। সেটা কেন দিচ্ছোনা? হোয়াপ ফেসবুক খুলতেও যেন কেমন একটা ভয় লাগে।ভালো কিছু দেখতে আর ভাবতে বরাবরই ভালো লাগে,অনেক সময় অতিরিক্ত হয়ত আকাশ কুসুম কল্পনাও করে ফেলি এই জন্য।তবুও অনেক ভালো আমার সেই জগত তাই আমি এই থার্ড স্টেজের একশো চুয়াল্লিশ ধারার বাইরে থাকতে চাই। ভালো হোক সব ভালো থাক সবাই।
এখন সব দিনই রবিবার, সকালে উঠে আমার কর্তা শনিবার বলে ভুল করলো। এখন বারে কি এসে যায়? একটা সময় ছুটির দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে আক্ষেপ করেছি।এখন তাকিয়ে রয়েছি কবে আসবে নিয়ম ভাঙার দিন। যেদিন আবার বাইরে বেরোবো,আকাশ দেখবো।নিশ্চিন্তে কারো কাছে দাঁড়িয়ে কথা বলবো।পাশের বাড়ির কাকিমার সোফায় বসে জমিয়ে গল্প করবো।
ছেলেটা সারারাত হসপিটালে ছিলো,কি জানি কি মনে হলো জানিনা।রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো মা ডিমসেদ্ধ করেছে। আমাদের রবিবার সাধারণত মাংসই হয়।কর্তাকে বাইরে যেতে দেবোইনা পণ করেছি তাই ডিম ভরসা। ডেকে বললো," মা একটু মাংস আনবো?রান্না করে দেবে?আর কি আনতে হবে বলো এনে দিচ্ছি।বাবাকে যেতে দিয়োনা।আমি যাবো।"
" কাউকে যেতে হবেনা,একদিন খা না বাবা।"
" কিছু হবেনা তুমি দেখো।"
গলার কাছটা দলা পাকিয়ে গেলো,না করতে পারলাম না।শুধু বললাম দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াস।
বেশ মাতব্বরি করে বললো," আমি সব জানি মা।"
নিজের পার্সটা নিয়ে বেরোলো।ওর বাবা গজগজ করলো,"আমার বেলা যত নিয়ম।আর ওকে বেরোতে দিলে।"
উত্তর দিতে পারলাম না।হয়ত দায়িত্ব তুলে দিচ্ছি উত্তরসূরীর হাতে। ওর বাবা বলছিলো তাহলে একটু পোলাও হলে ভালো হত। আজ ভেবেছিলাম সংক্ষেপে সারবো।পারলাম না, সত্যিই পারলাম না ধৈর্য্য ধরে রাঁধলাম সব। ছেলে বললো," আবার পোলাও করেছো?"।করলাম তোর বাবা বলছিলো।ওরা পরিতৃপ্তি করে খেলো আমি মন ভরে দেখলাম।অশান্তির পৃথিবীতে এ যেন এক শান্তির ছোঁওয়া। ভালো থাক সবার গৃহের কোণ এভাবেই,আশাটুকু থাক যাতে কোন এক ভোরে জানলা খুলেই দেখতে পাবো মাস্কবিহীন একদল লোক শান্তিতে বাজার করছে,মর্ণিং ওয়াকে যাচ্ছে অথবা আমার মত কাজের জায়গায় যাচ্ছে।বাচ্চারা দল বেঁধে যাচ্ছে স্কুলে।আবার ক্লাশরুম গুলো সজীব হয়েছে অঙ্কের ফর্মূলায়,কবিতায় অথবা ইতিহাসে।
( আজকের দিনলিপি)
সমাপ্ত
#ভালোবাসার_চিঠি#
রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
"ঠোঁটে ঠোঁট রাখো আজ,সব শব্দ আজ মুছে যাক নিঃশব্দতায়।মুছে যাক কিছুক্ষণের জন্য সমস্ত দুঃখ আর চিন্তা,ভাবনারা না হয় বন্দি হলো আজ শেষ বসন্তের পদচিহ্নের অন্তরালে।"
বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মনে মনে ভাবছিলো বীথি লাইনগুলো। প্রতিদিনের মত আজও ঘুম ভেঙেছে সাত সকালেই। পাশের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে এসেছে পাশ ফিরে ঘুমের নেশায় এখনো বুঁদ হয়ে আছে সোম।ওর ছুটি চলছে,মানে ও ঘেরা গৃহবন্দিত্বের নাগপাশে নাকি বাহুডোরে? সঠিক শব্দটা পুরুষদের জন্য কি কিছুক্ষণ ভাবে বীথি।
যদিও বীথি ভেবেছিলো এই কয়েকটা দিন আবার নতুন করে গাঁথবে ভালোবাসার বিনি সুতোয় প্রেমের মালা।এমন করে কাছাকাছি থাকার সুযোগ আর হয় কোথায়? তবুও মাঝখানে আজ একান্ত মিটারের দূরত্বে লুকোচুরি খেলছে ভালোবাসা। সোম বেছে নিয়েছে স্বেচ্ছা একান্ত অবসর। হয়ত এটাও এক প্রকার কয়েদ,যেখানে মানুষ নিজেই নিজেকে খাঁচাবন্দি করে রাখে।
ঠোঁটে ঠোঁট রাখতেও ভয়,মাঝে মারণ রোগ আর ডাক্তারদের সাবধানতা। আচ্ছা সত্যিই কি রোগ কেড়ে নেয় সবটাই? অথচ কি নিশ্চিন্তে ওরা মানে ঐ পাখিগুলো ঠোঁটে ঠোঁট রেখেছে কাছাকাছি আসছে দুজনের।কোন ভয় আর দূর্বলতাই ওদের নেই।আসলে ওরা যে মানুষের মত সাবধানী নয়।ওদের প্রেম,ভালোবাসা সবটাই শুধু ইচ্ছে।
সোম ভয় পাচ্ছে ওকে ছুঁতে, তাই আলাদা ঘরেই শুচ্ছে একদম।নিজেকে আলাদা করে নিয়েছে একদম ওর থেকে। খুব অভিমান হয়েছিলো বীথির,কদিনই বা বিয়ে হয়েছে ওদের।এখনো এক বছরই হয়নি।সামনের বৈশাখে এক বছর হবে। এর মধ্যে কি যে হলো?
অফিসের কাজেই মুম্বাই গিয়ে আটকে পড়েছিলো সোম। হঠাৎই সব বন্ধ হয়ে গেছিলো তারমধ্যেই এসে কয়েকদিন হোটেলে ছিলো তারপর বাড়িতে স্বেচ্ছাবন্দিত্ব।এও এক নির্বাসন,রামের চোদ্দ বছরের বনবাসের মত এক স্বেচ্ছাবন্দি জীবন।উদ্দেশ্য বাঁচা আর বাঁচানো।
ওকে খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে বীথির। কতদিন কাছে আসেনি,আদর করেনি,জড়িয়ে ধরেনি। আবেগী মনটা ছিলো ভালোবাসার প্রতীক্ষায়।কবে নিজেকে উজাড় করে দেবে ওর কাছে।দীর্ঘ বিরহের পর এক অন্য অভিসারে সাজবে নতুন করে।খুব অভিমান হয়,তাহলে কি মানুষটা সত্যিই পাল্টে গেছে? ওর মধ্যে কোন আবেগ নেই,ভালোবাসা নেই।তেমন প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা কথাও বলেনা আজকাল। সময় পেলে কানে হেডফোন দিয়ে গান শোনে আর অফিসের কাজ করে ল্যাপটপে। রাত্রে ঘরের পরদাটা সরিয়ে অনেকদিন দেখেছে কিছু লিখছে,হয়ত হিসেবপত্র কিছু করে।
সারাদিন আর কত কাজ করা যায়?বীথি অত সংসারী নয়।সোম অবশ্য বলতো," সেই ভালো, আমাদের মধ্যে ভালোবাসাটাই থাক।সংসার সংসার করে সবটা চাপা দিয়ে দিয়োনা।"
তবুও কখন যে সংসারটাই প্রেমকে চাপা দিয়ে প্রয়োজন হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি বীথি।এই কদিন মনে হয় ভাগ্যিস পরদা পাল্টানো,চাদর গুছোনো,টেবিলের ধুলো মোছা ছিলো।নাহলে কি করতো এই দীর্ঘ স্বেচ্ছাবসরে?
এখন ভালো লাগে ওর চা করতে,সকালের জলখাবার করতে অথবা ঘরে যা আছে তা দিয়েই একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সোমের পছন্দমত কিছু করে দিতে।এই তো কালই আলু আর ডিম দিয়ে আলু বিরিয়ানি বানালো।
প্লেটটা বাড়িয়ে দিয়েছিলো,খাবার পর বললো.." কেমন হয়েছে খেতে?"
" ভালো হয়েছে,সত্যিই তুমি এখন সংসারী।"
সংসারের আনাচে কানাচে হাতের ছোঁয়া দিয়ে আদর করে।কখনো বা বাইরে গিয়ে পাখিদের দেখে সময় কাটায় বীথি। কত পাখির কিচিরমিচির আর আনাগোনা।মানুষের স্বেচ্ছাবন্দিত্বে ওরা যেন আজ পুরোপুরি নির্ভয় আর নিশ্চিন্ত। আজ আমরা গন্ডীবদ্ধ আর ওরা উন্মুক্ত নির্ভীক।
বীথি শোনে কান পেতে পদধ্বনি, আসছে নিশ্চয় আসছে মানে আসবেই নতুন বছর।নতুন বছর কি রোগ ব্যাধি মুছে দিয়ে নতুন পাতার মধ্যে দিয়ে দেখাবে নতুন আশার আলো? হয়ত দেখাবে,নিশ্চয় দেখাবে। ভালো থাকবে পৃথিবীর সব মানুষেরা। কবিতার খাতাটা টেনে নেয় বীথি..রাতে যখন সোমকে জড়িয়ে ধরে শুতে ইচ্ছে করে অথচ শূন্যস্থানে কেউ থাকেনা তখন ও কবিতা লেখে নিজের মনে।
সত্যিই কেটে গেছে ভয়ের দিনগুলো, সবাই আবার নিশ্চিন্তে ঘুরছে। সকালে বাচ্চাগুলো আবার কলকল করে রওনা দিয়েছে স্কুলের পথে। ওর বিছানার পাশে আজ ফুলের গন্ধ।সকাল থেকে কত ফোন,আজ ওদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী।সোম চায় আজকের দিনটা শুধু নিজেরা নিজেদের মত করে কাটাবে।মুছে যাবে অদৃশ্য গন্ডী।আবার চেনা ছন্দে ফেরা একে অপরের শরীরের গন্ধে। অনেকদিন বাদে আজ ওরা পাখিদের মতই বাধনহারা।নিভু নিভু আলোয় সোম টেনে নেয় বীথিকে একদম শক্ত করে ওর বুকের কাছে।নিশ্চিন্ত বীথি অনুভব করে সোমের উত্তাপটুকু অভিমানী গলায় বলে ওঠে,"এতদিন কেন কাছে আসোনি।আমার যে খুব একা লাগছিলো।"
" আমরা যে সবাই সবাইকে খুব ভালোবাসি বীথি,তাই নিজেকে আর অন্য সবাইকে ভালো রাখার জন্য কেউ কারো কাছে আসিনি। এবার আবার সবাই সবার কাছে আর পাশে থাকবো। চোখ বন্ধ করে হাতটা দাও আমায়।"
বীথি বাড়িয়ে দেয় ওর হাতটা.."এক মুঠো কাগজ ওর হাতে দেয় সোম।"
"এগুলো কি গো?"
"দেখোই না খুলে।"
বীথির হাতে ধরা,একুশখানা চিঠি। একুশদিনের একুশ ভাবনা।কত কথা,ভালোবাসা, আর এই পৃথিবীর খবর সেখানে লেখা।
একটা একটা করে পড়তে পড়তে প্রায় ভোর হয়ে যায় ওদের।সেই ফুলশয্যার রাত জাগার মত।
"আমাদের চেনা পৃথিবীটা আজ ক্লিষ্ট,রোগে আমরা ধুকছি সবাই। ধুকছে অর্থনীতি,ভুগছে মানুষ। আপনজনের কাছে পৌঁছনোর আগেই কত মানুষ মারা গেছে পথে। কে তার হিসেব রাখবে বলো। হয়ত ভালো না থাকার মধ্যেই ভালো থাকতে হবে সবাইকে।"
চোখটা ছলছল করে ওঠে বীথির,সত্যিই তো কত মানুষের ঘরেই ফেরা হলোনা বাড়িতে ফেরার জন্য দুশো কিলোমিটার হেঁটে শেষে আর পারলোনা।প্রাণ হারালো পথে,হয়ত শেষ সময়ে খুব মনে হয়েছিলো আপনজনের কথা।একবার তাদের দেখতে চোখদুটো এদিক ওদিক খুঁজেছিলো।
ভালোবাসা বোধহয় সত্যিই বোবা,সবসময় তার ভাষা হয়না শুধুই বুঝে নিতে হয়।
" এই খামটা রেখে দাও,কিছু টাকা আছে।তুমি বলছিলেনা যদি পারতাম আমার সাধ্যমত এগিয়ে আসতাম।
ঝড় থামবেই বীথি আর আমাদেরও এগিয়ে যেতে হবে।আবার আমরা হাঁটবো পৃথিবীতে, আমাদের সাধ্যমত ধরবো সেই সব মানুষের হাত যাদের একটু সাহায্যের দরকার। ভালো থাকবো আর ভালো রাখবোই আমরা,কারণ আমরাই পারি সব।"
আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে সোমকে বীথি। হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে যায়,বাইরের সদ্য ফোটা আলো জানলা দিয়ে ঘরে উঁকি মারছে।
একি সোম! ও তো সোমকেই জড়িয়ে ধরে আছে। তাহলে কি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলো?
" তুমি এখানে কেন?"
"আমার স্বেচ্ছানির্বাসনের শেষ হয়েছে বীথি। আবার আমরা একসঙ্গে থাকবো।"
কেমন যেন সবটা স্বপ্নের মত মনে হয় বীথির " সত্যি।"
" সত্যিই একদিন এই ঝড় থামবে আর আবার আমরা সবাই দূরত্বের গন্ডী ভেঙে আসবো কাছাকাছি।"
নিশ্চিন্তে সোমের বুকে মাথা রাখে বীথি..সবাই ভালো থাকবে, জীবাণুমুক্ত হবে পৃথিবী।শুধু আমাদের একটু সংযমী হতে হবে। ভালোবাসতে হবে পৃথিবীকে আর ভালো রাখতে হবে সবাইকে।
আমি আপনি আমরা সবাই আজ দূরত্বেই সুখী তবুও ভালোবাসার চিঠি আদানপ্রদান যেন বন্ধ না হয়।মনের জানালাটুকু খোলা থাক এই কদিন।(একুশ দিনের একুশ ভাবনা)
সমাপ্ত:-
#মেঘ_ছেঁড়া_রোদ্দুর#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
সূর্যের ঘুমভাঙা আর পাখির কিচিমিচি দিয়ে ভোর হয় প্রতিদিনের মতই।শুধু আমি উঠতে একটু দেরি করে ফেলি।ততক্ষণে সূর্য হামাগুড়ি শেষ করে উঠে দাঁড়িয়েছে।আজ সকালে চার দেওয়ালের মাঝে আর মন বসলোনা।আমাদের আবাসনের ঘুম তখনো ভাঙেনি ভালো করে। আমি ফুলের সাজিটা হাতে নিয়ে নিচে নামি আজ।কদিন আমার বারান্দার গাছ দুচারটে ছোট টগরেই কাজ চলছিলো আজ উঁকি দিয়ে দেখলাম শুধু সবুজ কচি পাতারা মুখ বাড়িয়েছে ফুলের দেখা নেই।তাই আবাসনের বাগানে যাই গুটিগুটি পায়ে বেশ অনেকদিন বাদে সকালে এইভাবে নেমে আসা নিচে। টগর,বেল,জবা সব গাছই আছে আছে কল্কে ফুলের গাছও। টগর গাছটা ফুলে ফুলে ভরা যেন মাথা নামিয়ে বলছে আলতো করে তুলে নাও তো দেখি। নিজের প্রয়োজনে খুব অল্পই নিলাম সাজি করে।বাকিদের বললাম গাছেই থাক আলো করে আবার কাল হবে দেখা।আজ যাই রে। অনেক দিন বাদে আবার মনে হলো ছোটবেলার গন্ধ পেলাম। আমাদের যখন পুজোর ছুটি থাকতো দেশের বাড়ি বা মালদার বাড়িতে পুজোর ফুল তুলতাম একদম সাজি ভরে।হলুদে,লালে,সাদায় ভরতো সাজি কখনো বা থাকতো গোলাপি স্থলপদ্মও।
কতদিন আগের কথা তবুও মনে হয় এই তো সেদিন।হঠাৎই চোখ আটকে গেলো পাশের বাড়ির একটা গাছে,সরু লম্বা পাতা গাছটার থোকা থোকা গোলাপি গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলে সেজে সুন্দরী হয়ে উঁকি দিয়েছে। আহা মনটা ভরে গেলো আমার।কত রূপ,রস আর গন্ধে প্রকৃতি সাজিয়ে রেখেছে নিজেকে অথচ আমাদের ব্যস্ততায় আমরা দেখিইনা ভালো করে চারিদিকে।
পা রাখলাম লকডাউনের আরেকটা দিনে।এই মাসটা যেন মনে হচ্ছিলো কিছুতেই শেষ হচ্ছেনা।কত যে ঘটনা ঘটলো এই মাসটাকে ঘিরে। এক সময় ইতিহাসে পড়েছিলাম লঙ মার্চ বলে একটা কথা। কথাটার মানে দীর্ঘ পদযাত্রা।হয়েছিলো চীনেই আর এবার সব দেশেই দীর্ঘ গৃহবন্দিত্বের লং টার্ম শুরু চীন থেকেই।যদিও দুটো একদম আলাদা জিনিস তবু কেন যেন মনে হলো।
আজ বাসন্তী পুজোর শুরু আমাদের এখানে ঠাকুর বানানো হয়।ঠাকুররা রঙ না হওয়া অবস্থায় দাঁড়িয়ে রাস্তায়। আসল দুর্গাপুজো এটাই ছিলো। শরৎ কালে যেটা হয় সেটা অকালবোধন। আজ সপ্তমী,তবুও সব জায়গায় নীরবতা।এবার দেব দেবীরাও কিছুদিনের জন্য স্বর্গে থাকবেন বলে ঠিক করেছেন।মর্ত্যের রোগ দূষণ তারাও এড়িয়ে চলছেন।মনে হলো ছোটবেলায় বাসন্তীপুজো দেখতে যাবার দিন।মালদার যে গ্ৰামে আমরা থাকতাম তার নাম ভালুকাবাজার, সামনে দিয়ে বইতো মহানন্দার শাখা নাম ফুলহার। কত টাটকা তাজা মাছ পাওয়া যেতো ঐ নদীতে।ঐ নদী পেরোলেই ওপারে মহানন্দাটোলা গ্ৰাম।তবে নৌকায় ওঠার আগে আর নৌকা থেকে নেমে দুদিকেই বেশ কিছুটা হাঁটতে হত। একবার বাসন্তীপুজো দেখতেই সেখানে গিয়েছিলাম। অবাক হয়েছিলাম দেখে,এত লোক থাকে এখানে। অথচ নৌকো ছাড়া আর কোন যাতায়াতের পথই নেই।কিভাবে ওরা থাকে এখানে! এক দ্বীপে যেন বসতির স্বপ্ন দেখেছে ওরা,বন্যা হলেই ভাসতো প্রায়ই গ্ৰামগুলো।
কলকাতায় বাড়ির কাছের মন্দিরে অন্নপূর্ণা পুজো হয় দেখেছি,আসলে যে কোন অনুষ্ঠান আমি উপভোগ করি। গন্ধটা আমার ভালো লাগে,পুজোর গন্ধ। সামনের রাস্তায় দূরত্ব বজায় রেখে কিছু মহিলা নবরাত্রির জন্য গেলো হাতে ঘটি। আমার সকাল এখন জানালায় কাটে,ওখান থেকেই কত কি দেখি।
পেপার আবার পাচ্ছি,মন ভারী হয়ে যায়।সত্যিই কি বড় প্রিয় আর নিরাপদ জায়গা বাড়ি!
কখনো যে বাড়ির আনাচে কানাচে জমে অসুখ আর অভাব সেই বাড়ির উদ্দেশ্যে আজ পাড়ি জমিয়েছে কাজহারা কত মানুষ।যাদের ঘাম আর শ্রম মিশে আছে আমাদের ভারতের কত শহরের নিঃশ্বাসে আর নিরাপত্তায়।যানবাহনের অভাবে আজ দিশাহারা মানুষ,কারো বা শেষ নিশ্বাসে ভারী হচ্ছে শহরের বাতাস।সত্যিই কি মৃত্যুর দিন আর কারণ ধার্য করা থাকে? না কি কখনো তার কারণ আমরাই? নানা খবরে আর ছবিতে মনে জমে প্রশ্নের মেঘ।আজ নাইবা জমালাম মেঘ সবার মনে।একটুকরো মেঘ ছিঁড়ে আসুক উজ্জ্বল আলোর রশ্মি,সে আলো শুধুই আশার।মন বলছেই সত্যিই একদিন ঝড় কেটে যাবে আর সেদিন সবাই ভালো থাকবো সমস্ত অপেক্ষার অবসানে আসবে সুদিন।কেটে যাবে সমস্ত দুশ্চিন্তা।ওরা বাড়ি ফিরে যাবে বাক্সভরা কাঁচের চুড়ি আর লাল শাড়ি নিয়ে। ঝিমলি,পূজা,নাসরিন আর রোশনিরা যাবে দলবেঁধে স্কুলে। এক সাথে বসে খাবে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত গাইবে মনের খুশিতে জাতীয় সংগীত। এর পরের বছরের বইয়ে লেখা থাকবে এক ভাইরাসের কথা যা মুছে দিয়েছিলো মানুষের জীবন থেকে অনেকগুলো আনন্দের দিন।সংযমী হতে বলেছিলো মানুষকে। হয়ত এও এক শিক্ষা সারা বিশ্ববাসীর কাছে যার খারাপের সাথেও কিছু ভালো দিক আছে তাই আজও বরাবরের মত পজেটিভ ভাবনা নিয়েই শেষ করলাম।#একুশ_দিনের_একুশ_ভাবনা#
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment