#ঋতুর_ভেদ#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
টিভিতে স্যানিটারি ন্যাপকিনের আ্যড দেখে আমি কোনদিনই প্রশ্ন করিনি বা মায়েরও অস্বস্তি হয়নি।কারণ আমি ক্লাশ ফোর থেকে জানতাম মেয়েদের পিরিয়ডস হয় এটা শরীরের একটা স্বাভাবিক নিয়ম।আর এটা শুধু মেয়েদেরই হয় এবং স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে কোন সমস্যা নেই এতে।বরং স্বাভাবিক থাকলে সমস্যা অনেক কম হয়।মাকে বলেছিলাম একটু ভয় পেয়ে.." কি বাজে! শুধু মেয়েদের এই সব হয় কেন? আর দাদাটা বেঁচে যাবে ওর কোন ঝামেলা নিতে হবেনা।
মিষ্টি হেসে আমার বায়োলজির টিচার মা বলেছিলো আমরা হচ্ছি নদীর মত আর এ হচ্ছে ভরা নদীর ঢেউ।আর এই জন্যই তো আমরা শীতলতা দিতে পারি,আমরা এত সুন্দর, আমরা মা হতে পারি। এই যে তোর যখন অসুখ করে তুই মা মা করিস কেন?
আমি কেটে কেটে বলেছিলাম করি কারণ তোমার হাতে ম্যাজিক আছে।আমার ভালো লাগে তোমার হাতের ছোঁয়া। ঠিক তাই এটাও হয়ত মেয়েদের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটা।তাই আমি যদি বাড়িতেও না থাকি ওষুধের বাক্সের মধ্যে একটা প্যাকেট সব সময় থাকে ওখান থেকে নিয়ে এভাবে আটকে নিবি। একটু লজ্জা লজ্জা করে মায়ের বাধ্য ছাত্রীর মত দেখে নিয়েছিলাম। আর দুবছর বাদে সেটাই কাজে লেগেছিলো। তারপর থেকে চলছে সেই প্রতি মাসে নদীর ঢেউয়ের শব্দ শোনা। এক সময় মা বলেছে..খুব ওস্তাদ হয়েছিস তো জানাই যায়না কখন কি হচ্ছে। খুব ভালো সামলাতে শিখেছিস তো। আমি গলা জড়িয়ে বলতাম সবটাই আমার বেস্ট টিচারের জন্য।
মায়ের গালে টোলটা হাসির ছন্দে কাঁপতো..তাই?
একদম তাই মাই বেস্টফ্রেন্ড, টিচার এন্ড ফিলোসফার। এমন মা কজনের কাছে আছে?
তখন অবশ্য অত জানতাম না মানে ভাবিনি আরকি মেয়েদের জীবনে দুই মায়ের প্রভাব অত্যন্ত বেশি।ছোটবেলার কিছু স্মৃতি যেমন মনে থেকে যায় তা বকুনি আদর যাই হোকনা কেন। বড় বেলার ভালো অভিজ্ঞতা যেমন এগিয়ে যেতে আর ভালো থাকতে সাহায্য করে তেমন খারাপ অভিজ্ঞতা গুলো মনকে পিছিয়ে নিয়ে যায় কখনো বা এগোতে না দিয়ে ডুবিয়ে দেয় অন্ধকারে।
প্লাবনকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছি,ওকে আমি একদম তুই তোকারি করি। তবে বিয়ের পর মায়ের বকা খেয়ে একটু কমিয়েছি তুই বলাটা। ভীষণ ভালো বন্ধু আর বর দুটোই। তবে বাবা মায়েরও খুব বাধ্য ছেলে। আমাকে প্রথমেই বলে একদম পথ পরিস্কার করে রেখেছে সুবোধ বালকের মত.. এই শোন মা একটু হাইপার বুঝলি।অবশ্য তুই বা কি কম। ঐ দিকটা একটু ম্যানেজ করে নিস বুঝলি। সব কথাকে পাত্তা দিসনা, তবে কায়দা করে। বাবাকে নিয়ে চাপ নেই। আর আমার বোন টিকলি তো একদম তোর ন্যাওটা তাই কোনদিনই রাইবাঘিনী হবেনা।"
ধ্যাৎ বিয়ে করেই কেমন বর বর হয়ে গেলি,খুব সেয়ানা তো তুই। আমি নাচবো আর তুই মজা দেখবি,তা হবেনা। আমাকে নাচালে আমিও নাচিয়ে ছাড়বো।
ধ্যাৎ কে কাকে নাচাবে।সারাক্ষণ আমার হাইপার শাশুড়িমা নাচছেন।কোন কাজের জন্য সবুর হয়না।আমাকে কিছু করতে বললো,আমি যেই সাথে সাথে হুকুম মেরে আকা বলে হাজির হলাম না ব্যাস্ নিজে লেগে গেলেন কাজ করতে।
এসে ধমক লাগালাম যেই আচ্ছা মা তোমার কি একটুও সবুর সয়না? নাকি সারাক্ষণ নিজে কাজ করে দেখাচ্ছো যে আমি খেটে মরছি আর দেখো বৌমা ঘরে বসে প্রেম করছে।
যাচ্ছেতাই বৌ একটা,মুখে কিছুই আটকায় না। না আটকায়না,তুমিই বা সবসময় এত তাড়াতাড়ি সব করে একদম হিরোইন সাজতে চাও কেন?বর আর বরের বাড়ি দুটোই আগের চেনা বলে হয়ত আমিও একটু বেশিই দাপটে থাকি।
আমার বিয়ের পর বাড়িতে কালীপুজো হচ্ছে। মানে প্রতিবারই হয়,তবে এবার বৌ হিসেবে এই বাড়িতে আমার শ্রীচরণ রাখার পর।আমরা সকলেই বেশ খুশি খুশি মুডে আছি আর আমার শাশুমা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন আর ওড়াচ্ছেন নিয়মের ধ্বজা।এটা করতে হবে ওটা করতে হবে,বলির পাঁঠা হয়ে শ্বশুরমশাই বারবার বাজার যাচ্ছে আর আসছে,ছেলে আগের দিন যথারীতি অফিসে।আমি আর ননদও বেরোবো অফিসে একটু বাদেই। সব মিলিয়ে বাড়িতে তান্ডব চলছে।
তার মধ্যেই আমরা ননদ বৌদি আওয়াজ দিলাম আজকে এত চাপ নিয়োনা আমরা কাল করে দেবো হাতে হাতে। ওদিকের কোন কথা শোনা যায়না দুমদাম শব্দ ছাড়া।
রাতে ফেরার পর থেকেই জঙ্গীদের মত হুমকি চলতে লাগলো কাল এটা করবি ওটা করবিনা।নাহলে খুব সমস্যা হবে।এমনকি ওঠার সময়ও নির্দিষ্ট হয়ে গেলো। আমার বরটা গজগজ করলো কোথায় কাল একটু বৌকে আদর টাদর করে দেরিতে ঘুম থেকে উঠবো তা নয়।
ভোরে আর কাউকে ডাকতে হলোনা,ওদিকের তান্ডবেই উঠে গেলাম। আমার মাকে এই ব্যাপারে কিছু বললেই উনি শান্তির বার্তা প্রচার করেন.." বয়স্ক মানুষ গুরুজন অমন বলেনা ছিঃ।"
এমন একটা লেডি হিটলার শাশুড়ি তোমার হলে বুঝতে।
মুচকি হেসে আমার দিদিমণি মা বলেন," তুমিই তো দেখে করেছো মা।"
ব্যাস্ আমি চুপ,এর মানে নিজের ম্যাও নিজে সামলাও এই রকম একটা কিছু।
আমি বাথরুমে যাবো ভাবছি এমন সময় আমার অত্যন্ত বাধ্য ননদটি এসে কাচুমাচু মুখে দাঁড়ায়.."বৌদিভাই খুব সমস্যা হয়েছে গো।আমার পিরিয়ড হয়েছে। কি করবো গো?"
এ আবার কি,সেই ছোটবেলার মত ওকে প্যাড পরানো শেখাতে হবে নাকি? কি আবার করবি প্যাড নে.. তোর কাছে নেই নাকি? আমার ড্রয়ারে আছে নিয়ে নে।
ও ফিসফিস করে বলে," আরে মা জানলে কুরুক্ষেত্র করবে।"
সে আবার কি এটা তো তোর প্রতি মাসেই হয়।নাকি এই প্রথম হলো?
কুরুক্ষেত্রটা কিছুক্ষণ বাদেই বোঝা গেলো যখন টিকলি কাচুমাচু হয়ে এক কোণে দাঁড়িয়ে আর আমাকে ওর ছোঁয়া বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে পুজোর কাজ করতে হলো।
ওকে তুমি কিছু করতে দিলেনা এমনকি আমাকে ওর ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলতে হবে কেন? দেখো তো ওর কি বাজে লাগছে।বাড়িতে যারা আসছে সবাই জানছে ওর পিরিয়ড হয়েছে। ও যদি পুজোর কাজ করতো কি হত?
মনে হলো যেন হঠাৎই সুনামি বা আয়লা এসে গেছে।আর উনি মায়ের চরণে স্থান নিতে পারলে বেঁচে যান।
" পড়াশোনা শিখে কি ভেবেছিস বলতো তোরা,কালীপুজো কত নিষ্ঠাভরে করে জানিস। ও সব ছুঁয়ে দিলে যদি কোন অনর্থ হয় কে সামলাবে শুনি?"
অনর্থের কোন অর্থ না বুঝে বললাম কেন কালী ঠাকুরের পিরিয়ড হয়না?
" শোন আমার এখন অনেক কাজ,এত কথা বলে মাথা খাবিনা। তুই হেল্প করতে পারলে কর।নাহলে ছাড় করতে হবেনা। টিকলি কিছু করবেনা।"
ও পাশ থেকে দুজন সমানে হাত নাড়ছিলো আর দেখাচ্ছিলো শান্তি শান্তি। আমিও জানি উনি হাইপ্রেশারের পেশেন্ট তাই চুপ করতেই হলো। আর বুঝলাম যতই মেয়েদের স্বাধীনতা করে আমরা চেঁচাই,মেয়েদের পায়ে শিকলগুলো আমরাই বেঁধেছি শক্ত হাতে। আর এই বাঁধন এতোটাই শক্ত হয়ে বসে মরচে ধরে গেছে যে খোলাটাই দুষ্কর।তাইতো ঘরে বাইরে মন্দিরে সবাই আঙুল দিয়ে এঁকেছে নিয়মের গন্ডী।
মাঝে কেটে গেছে একটা বছর টিকলি চাকরি নিয়ে এখন বিদেশে। আমিই এখন বাড়িতে নিয়মনিষ্ঠা কিছু মেনে কিছু অবমাননা করে আছি। সাপোর্ট পাওয়ার জন্য মাঝে মাঝে আমার গর্ভধারিণীকে ফোন করি। উনি আবার গান্ধীবাদী তাই কিছু লাভ হয়না।
দিন পনেরো আগে আমার হিটলার শাশুমা ঠ্যাং না না বড্ড বাজে মুখ হয়ে গেছে আমার। খুব খারাপ অবস্থা ওনার পা ভেঙে।সত্যিই খুব খারাপ লাগছে যে মানুষটা দাপিয়ে বেড়ায় সে বিছানায় শুয়ে মিনমিন করছে। তবে ওখানে শুয়েই মনিটরিং চলছে তবে ওটা খুব খারাপ লাগেনা।আসলে চরম নারীবাদী আমিও যে কখন শান্তির খোঁজে ওনার বশ্যতা স্বীকার করেছি বুঝতেই পারিনি।
এর মাঝেই বিপর্যয় আমার পিরিয়ড হয়েছে। পুজো করার দায়িত্ব আমার। কি করবো,পুজো করে নেবো।নাকি নেবোনা?
বুঝলাম সংস্কারের ছোঁয়া আমাকেও ছাড়েনি।
তাই বললাম শোন আমার পিরিয়ড হয়েছে আমি পুজো কি করবো? না তোমার গোপাল আজ না খেয়ে থাকবে?
সেদিন আবার বর শ্বশুরমশাই কেউ বাড়িতে নেই। মানে বর তো সেই রাতে ফিরবে,আর শ্বশুরমশাই বিকেলে।
তাড়াতাড়ি বলো,কি করবো?আমাকেও বেরোতে হবে একটু বাদেই। গোপাল একটা বেলা না খেয়ে থাক রাতে এসে ও দেবে তাইনা?
মুখটা খুব করুণ দেখায় ওনার কিছুক্ষণ ভাবেন কি করবেন।
আমিও পেছন ফিরেছি স্নানে যাবো বলে। হঠাৎই শুনি.." মা হয়ে নিজে খাবো আর বাড়ির বাচ্চা গোপাল না খেয়ে থাকবে।তাহলে আমার খাওয়া হবেনা।"
তোমাকে তো খেতেই হবে,ওষুধ আছে তাছাড়া সুগার বাড়বে।
" তুই যা ভালো বুঝিস কর,গোপাল যেন না খেয়ে না থাকে।"
চোখটা ঝাপসা হলো ওনার কথাগুলো বলতে বলতে। আমিও যেন সাক্ষাৎ করলাম এক মাতৃরূপ। স্নান করে গোপালকে থালায় ননী মিছরি দিয়ে বললাম,তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও তো।তুমি না খেয়ে থাকলে আবার আমাদের মা কষ্ট পাবে।সবই তো বোঝো।তাই জলদি জলদি খাও।আমাকে আবার অফিসে যেতে হবে।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment