#ইচ্ছে_উড়ান#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
প্রথম যখন মেয়ে হলো দীপনের নার্সিংহোমের বাইরে দাঁড়িয়ে খবরটা শুনেই অদ্ভুতভাবে পেছন ফিরে গেছিলো মাথায় হাত দিয়ে। জামাইয়ের কান্ড দেখে আশ্চর্য হয়েছিলেন অনুপবাবু । বুঝেছিলেন জামাই বাবাজী খুবই মনকষ্ট পেয়েছে মেয়ে জন্ম নেওয়াতে।পরে অবশ্য এ নিয়ে অনেক মজাও হয়েছে বাড়িতে। তবে মধুমিতাকে শুনতে হয়েছে.." আমার কিন্তু একটা ছেলেও চাই।খুব তাড়াতাড়ি।"
"এই যে তুমি বলো প্রথম বাচ্চা যা হয়েছে তাই ভালো তাহলে আবার একথা কেন?" অবাক হয়ে সেদিন বরের মুখের দিকে তাকিয়েছিলো বছর কুড়ির সদ্য মা হওয়া মধুমিতা।
" তা নয়,আসলে সবার তো ছেলে হয়েছে বাড়িতে আমারও তো হবে নাকি একটা?এর মধ্যে দোষের কি আছে? আমাদের এত সম্পত্তি।"
সমাজে কলার উঁচিয়ে চলার জন্য ছেলে চাই না সম্পত্তি রক্ষার জন্য ছেলে চাই তা ঠিক মাথায় ঢোকেনি ওর।তবে ওর আঁচল ধরে রাখা মেয়ের দিকে তাকিয়ে ভেবেছিলো খুব তাড়াতাড়ি হয়ত ওর আদর কাড়তে কেউ আসছে।
নয়নার বয়েস যখন তিন তার আগেই মধুমিতার একটা বাচ্চা নষ্ট হলো। শরীর তখন বেশ খারাপ ওর। তাছাড়া তখন আর কতটুকু বয়েস ওরই বা। শাশুড়িমা শোনালেন," এত মানত করলাম তবুও টিকলোনা।কে জানে এই জীবনে আর নাতির মুখ দেখতে পারবো কিনা?"
মায়ের শেষ ইচ্ছে নাতির মুখ দেখা তাই দীপন আবার চেষ্টার ত্রুটি রাখলোনা। কিন্তু তাও আশার মুখে ছাই দিয়ে এবারও মেয়েই হলো মধুমিতার। দীপন এবার প্রায় শুয়ে পড়লো আর শাশুড়িমা ভেঙে পড়লেন। কারণ ডাক্তার বলে দিলো এরপর বাচ্চা হলে সেটা মধুমিতার জীবন সংশয় হতে পারে। সেই জন্য বাচ্চা নেওয়া থেকে ক্ষান্ত হতেই হলো।
নয়না আর রায়না দুই মেয়েকে নিয়ে মধুমিতার অসম্পূর্ণ সংসার। অসম্পূর্ণ এই কারণে যে প্রায়ই শুনতে হয়..একটা ছেলে হলে ঠিক হত।এক ছেলে এক মেয়ে খুব সুখী সংসার। তবে দুই ফুটফুটে মেয়েকে সাজিয়ে গুজিয়ে পুতুলের মত যত্নে রাখতো মধুমিতা। আর দীপনও একটা সময় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল মেয়ের বাবা হয়েই। দীপনের ভালোবাসা একটু বেশিই ছিলো নয়নার জন্য।আর রায়না মায়ের ন্যাওটা। তবে নয়না যেমন বাধ্য আর শান্ত,রায়না ঠিক উল্টো অবাধ্য,জেদী আর বায়নাবাজ। নিজে যা মনে করে তাই করে। আর সেই জন্যই দীপন মাঝে মাঝে খুব বিরক্ত হয়।" প্রশ্রয় দিয়ে দিয়ে ওর মাথাটা খেয়েছো।মেয়ে মানুষ সারাক্ষণ প্যান্ট শার্ট পরছে সাইকেল নিয়ে পাই পাই করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসব কি? দুধের সাধ কি ঘোলে মেটে?ছেলে ছেলেই হয়।"
বরের এই খোঁচা মারা কথা শুনে শুনে গায়ের চামড়া মোটা হয়ে গেছে মধুমিতার। তারপর শাশুড়িমা তো আছেনই।তবে ছোট মেয়ে কাউকে তোয়াক্কা করেনা। তাই নয়না লক্ষ্মীমন্ত আর রায়না দুরন্ত,হাতে পায়ে অশান্ত।
তবে মেয়েরা একটা শান্তি দিয়েছে দীপনকে।দুই মেয়েই পড়াশোনাতে ভালো। উচ্চমাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করে বাবার পছন্দে অনার্স নিয়ে ভর্তি হলো নয়না। " আরে মেয়েমানুষ সাধারণ পড়াশোনাই ভালো। পাশ করুক বিয়ে দিয়ে দেবো এখন থেকেই দেখতে থাকি।"
বাবার বাধ্য মেয়ে নয়না একটু আপত্তি করে বলেছিলো," বাবা আমি এম এস সি করবো।তারপর চাকরি।"
" শোন মা অত জানিনা,ছেলে হলে থাকতিস যতদিন খুশি কিছু ছিলোনা।মেয়ে মানেই তো অন্যের জিনিস।আমি কতদিন রাখবো বল। খুব ভালো একটা ছেলে পেয়েছি।ওরাও চাকরি করা মেয়ে চায়না। তারপর ওরা যদি মনে করে পড়াবে তো পড়বি।"
ছোটবেলা থেকে বাবার প্রতিটা কথায় ছেলের সাথে তুলনা উঠে এসেছে।তাই নিজেকে বাধ্য মেয়ে করে বাবাকে ভালো রাখতে চেয়েছে নয়না তাই আর আপত্তি করেনা। বেশ ভালো আয়োজন করেই নয়নার বিয়ে দেয় দীপন। নয়নার শ্বশুরবাড়ি ভালো হয়েছে,মেয়ে সুখে আছে আর কি চাই। বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই যখন ছেলে হলো তখন বইগুলোর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো নয়না। তবে নাতি হওয়াতে খুব খুশি দীপন আনন্দে কি করবে ভেবে পায়না। দুবছর যেতে না যেতে আবার মেয়ে। নয়না দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে পুরো সংসারী। সুখী মাতৃত্বের মাঝেও কখনো হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নেরা উঁকি মারে।তবে চোখ বুজে নেয় নয়না,সবাই খুশি তাই ও নিজেও খুশি। ইচ্ছেরা মরে গেলো? যাক তাতে কি আর যায় আসে?মাকে দেখে মানিয়ে আর মেনে নিতে শিখেছে নয়না।
রায়না ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করলো,অনেক করেও বাবার কথা শোনেনি রায়না। " আমি পড়বো চাকরি করবো। মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে কি বা কম।যে এটা করতে পারবেনা সেটা করতে পারবেনা।"
" চাকরি করবি?কোথায় চাকরি হবে,কোথায় বিয়ে হবে কেমন ডিউটি হবে কেউ বলতে পারে।"
" আমি বিয়ে করবোনা।আগে চাকরি করবো তারপর বিয়ে।"
"মেয়েমানুষ বিয়ে করবেনা।কি কথা বলছে তোমার মেয়ে? গ্ৰামে থাকবো কি করে এবার?"
মধুমিতা জানে খারাপ কিছু হলেই তখন ওর মেয়ে হয়ে যায় রায়না।আর ভালো কিছু হলেই তখন দীপনের মেয়ে।
ছোট থেকেই বাবার দুঃখ দেখে এসেছে রায়না। ছেলে থাকলে এই হত আর ঐ হত। মাঝে মাঝে মনে হত কেন যে ভগবান ওকে ছেলে করে পাঠালোনা। নয়না মেনে নিয়েছে তবে ওকে প্রমাণ করতেই হবে।
মেয়ের কোন কথাকে পাত্তা না দিয়ে চরম অশান্তি শুরু করলো দীপন ওকে বিয়ে দেবার জন্য। " মা বাবাকে বলো আমি বিয়ে করবোনা।"
" তুই কি চাস আমি গলায় দড়ি দিই।ইঞ্জিনিয়ার ছেলে পাওয়া গেছে কেন করবিনা শুনি?"
" আমি আগে চাকরি করবো তারপর বিয়ে।"
" ছেলেটা ভালো, তুই তো দেখেছিস। নিশ্চয় তোকে চাকরি করতে দেবে তোকে।"
অশান্তির জন্য আর কিছু বলতে পারেনা রায়না।মনে হলো স্বপ্নগুলো অধরাই রয়ে গেলো।বাবা ওকে মেয়ে বলে বোঝাই করে রাখলো সারাজীবনের জন্য।
মাঝে মাত্র ছয়টা মাস একটু করে জোগাড় করছে দীপন এর মাঝে হঠাৎই চলে আসে আ্যপয়েন্টমেন্ট লেটারটা। রায়নার চোখের সামনে ঝিলমিল করে ওঠে স্বপ্নের তারাগুলো। চিঠিটা নিয়ে বাবার কাছে আস্তে আস্তে এসে দাঁড়ায় রায়না।
" সরকারী চাকরি? রেলের ড্রাইভার! মেয়েমানুষ রেলগাড়ি চালাবে?"
"আমি তো গাড়ি চালাই বাবা।"
" রেলগাড়ি আর চার চাকা এক?"
আত্মবিশ্বাসী গলায় বলে ওঠে রায়না," আমি রেলগাড়িই চালাবো।"
" বিয়েটা হয়ে যাক তারপর দেখা যাবে কি করবি?"
" তুমি ওদের না করে দাও বিয়েটা আমি করবোনা বাবা। চিরকাল আমি শুনে এসেছি ছেলেরা এই পারে ঐ পারে।মেয়েরা যে কি পারে এবার আমি করে দেখাতে চাই।"
" আমার ছয়মাসের ট্রেনিং আছে প্রথমে,তারপর পোস্টিং। স্বপ্নটাকে আমি মারতে পারবোনা।"
" তাহলে আমার সম্মানটা থাকলো কোথায়? আমি মুখ দেখাবো কি করে?"
" যেমন অন্য দিনগুলোতে মুখ দেখাও তেমনিই দেখাবে বাবা।বরং আরো বেশি গর্বের সাথে মুখ দেখিয়ে বলবে মেয়েরা ছেলেদের মত বা তাদের চেয়েও অনেক ভালো করে অনেক কাজই করতে পারে। তাই মেয়ের বাবা হওয়া আক্ষেপের বা লজ্জার নয়।"
মেয়ের দিকে তাকিয়ে বড় অবাক লাগে মধুমিতার সত্যিই কি রায়না ওর মেয়ে! নাকি মেয়ে হয়ে জন্মানোর জন্য যে অবহেলা সয়েছে সেটাই আত্মপ্রত্যয়ে পরিবর্তিত হয়ে আজ ও এক বলীয়ান স্বাবলম্বী নারী যে জয় করতে পারে সমস্ত বাধা ইচ্ছেউড়ানে ভর করে।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment