#চেনা_ভালোবাসা#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
"আমার দাদুভাই ঠিক আছে তো শেলি? দেখিস যেন বাইরে না যায়।একটু চোখে চোখে রাখিস ওকে।"
" হ্যাঁ, মা ঠিক আছে ও এত ভেবোনা।চোখে চোখেই তো আছে।আমাকে বিরক্ত করছে আর কি।এদিকে আমার তো নাজেহাল অবস্থা বাড়ির সব কাজ করতে হচ্ছে।আবার অফিসও।"
" অফিস আবার কি করছিস? সব তো ছুটি!"
" তুমি সেই আনন্দেই থাকো মা,আরে পেপার টিভি কিছুই কি দেখোনা নাকি? ওয়ার্ক ফ্রম হোম দেখাচ্ছে না। সেটাই করছি মন দিয়ে।"
" সব কাজ মানে?লছমী আসছেনা? আর পায়েল?"
" মানে? কি বলছো তুমি! তোমার আরতি,শোভা এরা আসছে নাকি?"
মেয়ের কথার কি উত্তর দেবেন বুঝতে পারেননা অপর্ণা। শুভেন্দুর পেসমেকার বসানো,ওনার পায়ে প্লেট,কোমরের সমস্যা কি করে চলবে সংসার?
" না মানে ইয়ে শোভা আসছেনা,মানে আমিই বলেছি রান্নাটা আমি করে নেবো। তবুও বলছিলো সপ্তাহে তিনদিন এসে করে দিয়ে যাবে।আমার কষ্ট হবে বলে। তবে আরতি..."
"কি! আরতি আসছে? ও না বস্তিতে থাকে?ওখানে কতরকমের মানুষের সংস্পর্শে ও আসে জানো?"
" এই তো রাস্তার ওপারেই থাকে মা। এত বড় বাড়ি একদম লোকছাড়া আমি কি করে চলবো? আমি হাত ধুইয়ে নিই।খুব ভালো করে একদম কনুই অবধি।আমরা অনেক দূরে থাকি ওর থেকে বিশ্বাস কর। আমি বলেছিলাম না আসতে।ওই বললো,'দিদা তুমি এত কাজ করে তো করোনা না হলেও মরে যাবে।"
"বাহ্ বেশ তো ওদের সাথে নাতনি,ছেলে,মেয়ে সম্পর্ক করে আছো। কতবার বলেছি ঐ বাড়িটা বিক্রি করে একটা ছোট ফ্ল্যাটে উঠে যাও।অনেক সমস্যা কমে যাবে।তা না ঐ অত বড় বাড়িতে তুমি আর বাবা আছো শরীর খারাপ হলে যে কি হবে? তাছাড়া কম ঝামেলা নাকি অত বড় বাড়ি মেনটেন করতে?"
" অত ভাবিসনা,ভগবান সব ঠিক রাখবেন। হ্যাঁ রে তুই সাবধানে থাকিস মা।আর একতলাতে আছে তো ছেলেটা.."
" নাহ্ আর কিছু বলবোনা,তোমাদের যা খুশি তাই করো।বেশি বললে ভাববে মেয়ে আমাদের সব ব্যাপারে নাক গলায়। সাবধানে থেকো আর বুঝে সিদ্ধান্ত নিয়ো।"
মনটা খুব দমে যায় অপর্ণার, গুটিগুটি পায়ে শুভেন্দুর চেয়ারের পাশে এসে দাঁড়ান।
"কি হলো,নিশ্চয় মেয়ে বকুনি দিয়েছে? আরে ওদের কম বয়েস,ওরা এখন সব পারে।ওদের চাপও বেশি তাই মাথা গরম থাকে।কি দরকার খুটিনাটি সব কথা বলার?"
" ও তো খুব বকছে আরতি আসছে বলে।বলছে মানা করে দাও নাহলে নিজে বোঝো।"
" ছাড়ো,আমাদেরটা আমরাই বুঝি,ছেলে সংসার, চাকরি সামলে বছরে একবার আসতে পারেনা।সবটাই বুঝি,কি করবে ওরা?"
মেয়ে সবসময় বলে বাড়ি বিক্রি করে দাও অথচ একসময় এই বাড়িতেই বৌ হয়ে এসেছিলেন অপর্ণা।তখন একতলা দোতলা মিলে জমজমাট বাড়ি।শাশুড়ি, শ্বশুর আর দিদিশাশুড়ি বাড়িতে।থাকতেন পিশিশাশুড়ি এবং খুড়শ্বশুরও। অনেকগুলো বয়স্ক লোকের মাঝে একমাত্র ছেলের বৌ অপর্ণা। সত্যি বলতে কি সবাই আদর করেই রাখতো এমনকি বিধবা পিশিশাশুড়িও।
এখনো চোখ বুজলে এই বাড়িতে প্রথম আসার দিনটা দেখতে পান অপর্ণা।এ বাড়ি ও বাড়ির কত লোকের সমাবেশ।গা ভর্তি গয়না পরে মল ঝমঝমিয়ে এসেছিলো অপর্ণা।শাশুড়িমা প্রথমেই বলেছিলেন.." গরমে মাথায় ঘোমটা দিতে হবেনা বৌমা।খুব মেয়ের শখ ছিলো আমার তবে বাড়িতে ঐ একটাই শিবরাত্রির সলতে তাই মেয়ের মতই থেকো।" সকালে উঠে হাতে সাজি নিয়ে বাগানে যেতো অপর্ণা কত ফুলে ভরে উঠতো সাজি।খুশি হতেন শাশুড়িমা বলতেন," কি যে ভালো হয়েছে বৌ এসে বাড়িতে পায়ে ব্যথার জন্য তো সিঁড়ি ভাঙতে খুব কষ্ট হয়।"
একসাথে শিবরাত্রির ব্রত,দোলে রাধামাধবের ভোগ রান্না আর শুভেন্দুর সাথে ছাদে গিয়ে রঙ খেলা। প্রথম রঙ সবসময়েই শুভেন্দুর কাছেই মাখতো অপর্ণা। শিহরণ জাগতো শরীরে আর মনে। আসতো পাশের জ্ঞাতি দেওর আর ননদেরা তারপর কি হইচই সবাই মিলে।বিকেলে শাশুড়িমা ভাজতে বসতেন মালপোয়া। কি যে অপূর্ব স্বাদ তার! এখনো জিভে লেগে আছে। সেই বাড়ি কি এক কথায় বিক্রি করে দেওয়া যায়? যদিও শুভেন্দুর ইচ্ছে মেয়ে যা বলছে তাই হোক দেখতে হবে মানে চেষ্টা করতে হবে বিক্রির। মনের ভেতরটা কেমন যেন হু হু করে অপর্ণার।পরের বাড়ির মেয়ে হয়েও যেন বড় ভালোবেসে ফেলেছিলেন এই বাড়িটাকে। এক সময় মা হয়েছেন,বাড়ি জমজমাট হয়েছে কচি মিঠে গলার আওয়াজে। সবাই মেতে উঠেছিলো কচিমুখের মিঠে কাকলিতে।
তারপর আনন্দ,কখনো বিষাদ,কখনো যোগ আর বিয়োগে কেটে গেছে এতগুলো বছর। মন মুক্তি খুঁজেছে কখনো বাগানে গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলের মাঝে আবার কখনো আকাশে ভোকাট্টা ঘুড়ির রামধনু রঙে। অনেক বছর বিয়ে হয়ে গেছে শেলির।শেলি এখনকার মেয়ে,আধুনিকা,যুক্তি দিয়ে কথা বলে।অপর্ণার মত তার মন আবেগে ভাসেনা। ভালোবাসেও হিসেব করে,আলাপের গন্ডীও সীমিত রাখে।কাউকে দেখলেই বলে ওঠেনা অপর্ণার মত তুমি আমার মেয়ের মত অথবা আমাকে মাসিমণি বলো বাবা।শোভা বা আরতিকে একদম মাথায় তুলে ফেলা,তাদেরকে ঘরের মেয়ে করে নেওয়া। এসব আবার কি! ভাড়াটে ভাড়াটের মত থাকবে বাড়ির মেড তার জায়গায় থাকবে। অনেকবার চেষ্টা করেছে পারেনি মাকে বোঝাতে শেলি।মেয়েকে একটু ভয়ই পায় অপর্ণা,ছোট থেকেই কিছু বলেননি সবসময় সবাই চোখে হারিয়েছেন মেয়েকে।
সবই ঠিক চলছিলো কোথা থেকে এই মারণ রোগ এসে সব যেন ওলট পালট করে দিলো। রোজকার নিয়মে বাঁধা জীবন হয়ে গেলো এলোমেলো।
দিন দিন পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে,কড়াকড়ি বাড়ছে। যেদিন মেয়ের কাছে সোনামুখ করে বলতে গিয়েছেন," হ্যাঁ রে তোরা কাঁসর ঘন্টা বাজিয়েছিলি?"
" মা,তুমি যে কি করছো না আজকাল! অবশ্য তোমার কি দোষ আমাদের এখানে কেন সারা দেশ জুড়েই লোকে এইসব করছে। আমার অনেক কাজ থাকে মা এত সময় নেই।"
" আমি তা করিনি রে আমি সেদিন ছেলেটাকে খেতে বলেছিলাম। কি তৃপ্তি করে খেলো রে ছেলেটা! মা মরা ছেলে তো,বললো.."মাসিমণি কতদিন এত ভালো কিছু খাইনি।মা এমন রান্না করতেন। চেটেপুটে বিউলির ডাল পোস্ত সব খেলো।ছেলেটা সত্যিই সরল আর ভালো।"
" আর কি,এই বলো তোমার পায়ে ব্যথা পারোনা।তারমধ্যেই এইসব করছো! শোনো ভাড়াটেকে বেশি মাথায় তুলোনা। এরপর হয়ত বাড়িটাই দখল করে বসবে।আছে তো বেশ কয়েক বছর।"
" কয়েক বছর কি রে? দুই বছর হলো মাত্র।এগ্ৰিমেন্ট করা আছে তো।আর ও ছিলো বলেই তো তোর বাবা যেদিন অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলো বেঁচে গিয়েছিল শেষ পর্যন্ত।ভাবলেই আমার মাথা ঘুরতে থাকে এখনো।"
নিজের মাথা সেদিন কাজ করছিলোনা কোনভাবেই।সবেই হসপিটালের থেকে এসেছে তখন পার্থ। পাগলের মত ফোন করে কেঁদেছিলেন অপর্ণা," আমি কিছু বুঝতে পারছিনা।তুমি এখনই এসো বাবা।" মেয়ের আগেই ছেলেটাকে জানিয়েছিলেন সেদিন। তারপর হসপিটালের সবটা ভালোভাবে হয়ে গিয়েছিলো পেসমেকার নিয়ে বেঁচে ফিরেছিলেন শুভেন্দু। অপর্ণার কেন যেন মনে হয়েছিলো মেয়ে জামাইয়ের কেন যেন একটু ইগোর সমস্যা হয়েছিলো হঠাৎই একজন বাইরের লোককে অপর্ণা এতখানি নির্ভর করায়।
ছেলেটা এই পরিস্থিতিতে কি করছে কে জানে।ব্যথার জন্য সবসময় নিচে নামতে পারেননা অপর্ণা।আর এখন তো নামেনই না। ফোন করেছিলেন দুএকবার। প্রথমে ধরেনি কিছুক্ষণ বাদে ফোন করে বলেছিলো," খুব ব্যস্ত এখন।সবদিন বাড়িতে ফিরতে পারছিনা। অনেকদিন অনেক রাতে ফিরি। কয়েকদিন বোধহয় ফেরা হবেনা খুব চাপ যাচ্ছে।তারপর গাড়ি চলছেনা তো।"
হঠাৎই সেদিন পাড়ার কয়েকজন নিচে ডাকেন শুভেন্দুবাবুকে। বারান্দায় দাঁড়ায় অপর্ণা।ওরা যা বললো শুনে অপর্ণার মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করে...কানে আসে ওরা বলছে ,"শুনুন দাদা,আপনার বাড়ির ডাক্তারবাবু কে আপনি এর মধ্যেই বাড়িতে ঢুকলেই একদম বের করে দেবেন।আরে এরা করোনার চিকিৎসা করছে।আপনারা তো আক্রান্ত হবেন,আর তার সাথে পুরো পাড়াটাই আমরা আক্রান্ত হবো। আপনি বুঝতে পারছেননা। ওকে ফোন করে বলুন,বাড়ি ওকে ছাড়তেই হবে আমরা ওকে এই বাড়িতে থাকতে দেবোনা কিছুতেই। নাহলে আপনাদের বাড়িতে পচতে হবে কিন্তু।"
শুভেন্দু ফেরার আগেই হাত পা কাঁপতে থাকে অপর্ণার।সত্যিই ছেলেটা থাকলে ওদেরও রোগে মরতে হবে? দুজনেই তো বুড়ো মানুষ ওরা কি হবে? কিন্তু ঐ ছেলেটার কাছে যে ঋণের শেষ নেই তার।মা মরা ছেলেটা,বয়সই বা কত যাবে কোথায় ছেলেটা? কতদিনই হয়ত ভালো করে খায়না,নিজের মত নিজে থাকে।অনেক সময় দুদিন নাইট ডিউটি দিয়েও আসে।হায় ভগবান ওর বাড়ি তো অনেক দূরে,কোথায় যাবে ছেলেটা!
শুভেন্দু শুকনো মুখে ওপরে উঠে এসেছেন ততক্ষণে।" শুনলে তো ওদের কথা,আমাদের পাড়াতে মুদি বাজার সব বন্ধ করে দেবে ওরা।এমনকি আরতি শোভাকেও ঢুকতে দেবেনা বাড়িতে। আমরা বাঁচবো কি করে? তার থেকে ও যাক যেখানে খুশি।নিশ্চয় হসপিটালে ব্যবস্থা হবে কিছু।না হলে হস্টেলে,আমি অত ভাববো কেন?"
শুভেন্দুকে কেমন অচেনা লাগে অপর্ণার, বিপদে পড়লে মানুষ বোধহয় এমন স্বার্থপর হয়ে যায়।তখন আর নিজের ভালো ছাড়া আর কিছু চায়না।
ফোনটা হাতে তুলে নেন শুভেন্দু রিং হয়ে যায় ধরেনা ওপাশে কেউ। একটু বাদেই ফোন আসে.." ও মেসোমশাই,খুব ব্যস্ত এখন।বলুন।"
" তুমি কি করোনার পেশেন্ট দেখছো?"
" আমাদের এখানে এখনো তেমন কেউ আসেনি।তবে কথা চলছে করোনা সেন্টার করার।ওদের তো আপনি জানেন কোথায় পাঠানো..."
" শোনো তুমি আজ ফিরছো তো? কালই বাড়ি ছেড়ে দেবে।"
বড় অসহায় লাগে পার্থর,হঠাৎ কি হলো? কি করে ছাড়বে এত তাড়াতাড়ি বাড়ি? যাবেই বা কোথায়?
" কি হয়েছে মেসোমশাই? ভয়ের কিছু নেই।করোনার পেশেন্ট দেখলে তখন আর বাড়ি ফিরবোনা।একদম একুশদিন বাদে টেস্ট করে আসবো।"
" আমি যা বলার বলেছি,রাখছি এখন।"
চেনা মানুষগুলোকে বড় অচেনা লাগে পার্থর।সত্যিই মানুষ বোধহয় সত্যিই মুখোশে মুখ ঢাকে।
" ছেলেটাকে একটা সপ্তাহ তো সময় দেবে? এভাবে বললে! কোথায় যাবে?কেউ তো ভাড়া দেবেনা।"
" অত ভাবতে পারবোনা অপর্ণা,ওর জন্য কি আমরা একঘরে হয়ে মরবো?"
দুপুরে গলা দিয়ে ভাত নামেনা অপর্ণার। শুভেন্দু ঘুমোলে মেয়েকে ফোন করেন।জানেন ও একই কথা বলবে কোন লাভ হবেনা।এমনিতেই পার্থর ওপর ওনার পক্ষপাতিত্ব পছন্দ করেনা মেয়ে জামাই কেউই।
তবুও ওর জানা উচিত।একটু একটু করে সবটা বললেন অপর্ণা.." কি রে কিছু বলছিসনা কেন? কিছু তো বল? কিছু হলে তোকেই তো বলি মা।"
" শুনছি মা,এইজন্য তো সেদিন খুব রাগ হয়েছিলো মা। এই না বলছিলে পাড়ার লোকেরা কাঁসর ঘন্টা বাজাচ্ছিলো ডাক্তার আর স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য।বাজছিলো শঙ্খ। তুমিই না বিউলির ডাল আর পোস্ত খাওয়ালে ন্যাকামি করে।সরি মা তোমাদের এগুলোকে আমি এছাড়া কিছু বলতে পারছিনা। সেই ছেলেটাকে আজ গলাধাক্কা দিচ্ছো! হয়ে গেলো ভগবান থেকে শয়তান ছেলেটা।"
" যা খুশি বল,আমার মাথা কাজ করছেনা।"
" আমাকে একটু সময় দাও মা।ওর সাথে কথা বলে দেখি। বাবাকে বোঝাও দুএকটা দিন সময় দিতে বলো।"
তারপর শেলি আর জামাই হয়ত বা ওদের মত আরো কিছু মানুষের সহযোগিতায় প্রশাসনের কাছে চলে গিয়েছিলো খবরটা। প্রশাসনই বলেছিলো যারা বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করবে ডাক্তারদের বা স্বাস্থ্যকর্মীদের তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পার্থকে বাড়ি ছাড়তে হয়নি।শেলির মনে হয়েছিলো সত্যিই হয়ত দূরে থেকেও ঐ ছেলেটার জন্য ও অনেকটা নিশ্চিন্তে থাকতে পারে। ওর আদরে একটু ভাগ বসিয়েছে ছেলেটা এটা ঠিক।মা সবসময় পার্থ পার্থ করে।ওর ছোটভাইটা আজ পৃথিবীতে থাকলে হয়ত এমনি হত।কত আবদার করতো দিদি দিদি করে। এই তো পুপাইয়ের জ্বর হয়েছিল বলে কত চিন্তায় পড়েছিলো ওরা। ডাক্তার আর পরীক্ষা নিরীক্ষা ছিলো বলেই তো ওরা আজ নিশ্চিন্তে আছে। তাই ওর সাংবাদিক স্বামী আর ও কোন ত্রুটি রাখেনি ব্যাপারটা যাতে প্রশাসনের নজরে যায় সেটা করতে। মায়ের দূর্বলতার জায়গা ঐ ছেলেটা,হয়ত ওদের কেউ নয় তবুও মাকে মাসিমণি ডাকে। যারা ভালো রাখে তাদেরও ভালো থাকতে দিতে হয়।
বাড়ি না ছাড়লেও শুভেন্দুর ব্যবহারে খুবই আহত হয়েছে পার্থ।কেন যেন এক ঠান্ডা সম্পর্কের মাঝখানে ওরা। কেউ কারো সামনাসামনি হতে চায়না।অপর্ণারও ফোন করতে অদ্ভুত একটা সংকোচ হয়। কি খারাপই না ভেবেছে ছেলেটা ওদের। কতদিন দেখতে পাননা ছেলেটাকে! কখন ঢোকে আর বেরোয় কে জানে?একদিন ফোন করেছেন অপর্ণা ধরেনি হয়ত রাগ করেছে।
সত্যিই আর মাসিমণি ডাকতে ইচ্ছে করেনা পার্থর।সবটাই টাকার সম্পর্কে গিয়ে ঠেকেছে মানে বাড়িওয়ালা আর ভাড়াটে সম্পর্ক।যাকগে এই লকডাউন উঠে গেলে অন্য একটা ফ্ল্যাট দেখে উঠে যাবে। হয়ত আর একটা দুটো মাস এখানে। বিছানায় শুয়ে আছে ভোরের আলো চোখে এসে লাগে ওর ঘুম ভেঙে গেছে একটু আগেই,তবুও চোখ বুজেই আছে।আজ একটু দেরিতে যাবার কথা।হঠাৎই ফোনটা বেজে ওঠে হাত বাড়িয়ে ফোনটা ধরে.." হ্যালো"
" আমি ওপরের মেসোমশাই বলছি,একটু তাড়াতাড়ি উঠে এসো বাবা।তোমার মাসিমা সকালে উঠে বাথরুমে গিয়ে পড়ে গেছে কপালটা বেশ কেটে গেছে।"
ফোনটা রেখে তাড়াতাড়ি টিশার্ট গলিয়ে দরজা লক করে ওপরে ওঠে পার্থ।
বেলে হাত দেয়।বেশ অনেকদিন বাদে ওপরে উঠেছে, ভাড়া তো ব্যাঙ্কের মাধ্যমেই দেয় তাই আর ওঠেনা।বেল বাজাতেই দরজাটা খুলে যায়...
" উনি কোথায়?"
ওকে হাতের ইশারায় ভেতরের ঘরের দিকে দেখান শুভেন্দুবাবু।এই ঘরে এর আগে কখনো ঢোকেনি পার্থ। ঢুকতেই একটা হাততালির আওয়াজ পায় ততক্ষণে জ্বলে উঠেছে ঘরের আলোটা..." হ্যাপি বার্থডে ডাক্তারবাবু।কেমন এপ্রিলফুল করলাম।"
অপর্ণার ছেলেমানুষীতে চোখটা হঠাৎই ঝাপসা হয় শুভেন্দুর।
" মাসিমণি আপনার মনে আছে?"
" আছে তো?গতবার কি কারণে যেন জেনে ফেলেছিলাম তোমার জন্মদিন আজ।আর ভুলিনি,কখনো হয়ত ভুলবোনা। তুমি তো খুব রাগ করেছো তোমার খারাপ মাসিমণির ওপর তাই এপ্রিলফুল করলাম। আমার মাথা ফেটে গেছে বললাম।"
সব অভিমান মুহূর্তেই কেমন যেন একচিলতে ভালোবাসার রোদে মুছে গেলো পার্থর।অপর্ণাকে প্রণাম করতেই চোখে পড়লো মালা দেওয়া একটা ছবির দিকে।আগে দেখেনি।
" আমার ছেলে জানো,শেলির ছোট ছিলো।অনেক বছর আগে ছেড়ে গেছে আমাদের।থাকলে তোমার মতই হতো আজ। গতবার তোমার জন্মদিন শুনে আর ভুলিনি আসলে এইদিনেই তো দুষ্টুটা মাত্র কিছুদিনের জন্য এপ্রিলফুল করতে আমার জীবনে এসেছিলো।"
ডাক্তারদের চোখে জল মানায়না,তবে পার্থর চোখে মাঝে মাঝেই জল আসে কখনো একলা ঘরে,অথবা কখনো ভোরে ওর মায়ের জন্য।আজও চোখটা কেমন যেন জ্বালা করলো। আচ্ছা মায়ের মত কথাটা বোধহয় এইজন্যই হয় তাই মাসিমণির ভালোবাসাটাও কেন যেন বড় চেনা লাগে কোন এক জন্মদিনের সকালে।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment