#অন্নপূর্ণা#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
লক্ষ্মী যেদিন পা রেখেছিলো সুশোভনের হাত ধরে মুখার্জী বাড়িতে সেদিন সরলা বরণডালা নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন।ছোট দেওরের বৌ বলে কথা, না হয় বাড়িতে কাউকে না জানিয়ে দুম করেই বিয়ে করে ফেলেছে। তবুও নতুন বৌ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে তা হয় নাকি? লোকেই বা কি বলবে?
এই বাড়িতে যখন বৌ হয়ে এসেছেন তখন তার স্বামীর থেকে প্রায় পনেরো বছরের ছোট ভাইটি সবসময় তার গায়ে গায়ে ঘুরেছে।কখনো তার ঘুড়ি কিনতে হবে আবার কখনো বা সে মাছ ধরতে যাবে এমনি সব হরেক বায়না। রাশভারী দাদাকে চিরকালই ভয় পেয়েছে সুশোভন।দাদা তারপর দিদি আর তারপরে এই ছোটভাই।ওর জন্মের দশবছর বাদেই সরলার শ্বশুরমশাই মারা যান।আর তারপর থেকেই বড়ভাইয়ের ওপর সব দায়িত্ব।অনেক কষ্ট করে নিজে দাঁড়িয়ে বোনকে বিয়ে দেওয়ার পর নিজে বিয়ে করেছে। কিন্তু ভাইটাই শুধু বাউন্ডুলে হয়ে উঠেছে প্রশ্রয় পেয়ে। মায়ের প্রশ্রয়,বোনের প্রশ্রয় আর তার বিয়ের কিছুদিন বাদে মা মারা যাওয়াতে বৌদির পুরো প্রশ্রয়ে একদম বেয়াড়া হয়ে উঠেছে। সরলার সাথে এই নিয়ে অনেকবার ঝামেলা হয়েছে কমলের আর শেষে কান্নাকাটিতে জয়ী হয়েছে সরলা। দেরিতে মা হয়েছে বিয়ের প্রায় পাঁচবছর বাদে সন্তান। সেই সুবাদে মা মরা দেওর চোখের মণি হয়ে উঠেছে বৌদির। আর তেমনি হয়েছে ওদের ছেলেটাও কাকা ছাড়া কিছু বোঝেনা ছোট থেকেই।গাছ থেকে আম পেড়ে দেওয়া থেকে সবটাতেই কাকা ভরসা।একটা সময় কমল ভেবেছিলো ছেলেটার আর পড়াশোনা হবেনা।কাকা যদিও বা প্রাইমারী স্কুলে মাস্টারি জুটিয়েছে ওর কিছু হবেনা,ঘুড়ি লাটাই,আম পাড়া আর মাছ ধরা করে জীবন কাটবে। যত নাটের গুরু ঐ ভাইটা আর সরলা।
অথচ বিয়ে দিয়ে তাকে সংসারী করবেন সেদিকেও ব্যাটা ঘাড় পাতেনা।উনি নাকি সমাজসেবা করেন। ছুটিছাটা পেলেই চলে যান আদিবাসী গ্ৰামে,সেখানে ওদের নাকি লেখাপড়া শেখান।এদিকে দোকানে বসার নাম নেই।
তবুও রক্ষা ছেলেটা উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত গেছে।উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর শহরে পড়ার সুযোগ পেতেই একদম দিয়ে এসেছেন হস্টেলে। সরলা কদিন খুব কান্নাকাটি করলো। " একটা বাঁদর তৈরি হোক ছেলে তাই চাও তো নাকি কাকার মত বাউন্ডুলে আর ভবঘুরে।"
ছোটভাইয়ের ওপর যে খুবই খাপ্পা কমল তা জানেন সরলা। স্নেহটা পুরো ঢাকা চাপা দিয়ে রাখেন কমল সরলা ভালো বোঝেন। তিনিও যে বিয়ের কথা বলেননি এমন নয়..." এবার একটা বিয়ে কর,মেয়ে দেখবো? অনেকেই বলছে।"
" তুমি যদি খাওয়াতে পারো তো দেখো।আমার দ্বারা হবেনা। বাবুর বিয়ে দিয়ো কবছর বাদে।"
আর বিশেষ কিছু বলেননি সরলা।কিন্তু সেই দেওর যে এভাবে বিয়ে করে হঠাৎ একদিন হাজির করবে বুঝতে পারেননি সরলা।
কাকে সামলাবেন বুঝতে পারেননি।নতুন বৌ বরণ করে ঘরে আনবেন না স্বামীকে সামলাবেন?
" শোনো আমার শোনা হয়ে গেছে কেমন মেয়ে এনেছে ও।তুমি যদি ঘরে তোলো তাহলে আমি বাড়ি থেকে চলে যাবো।"
" সে কি বাড়ির ছেলে কোথায় যাবে? এই বাড়িটা তো ওরও নাকি?"
বরের বকুনি শুনেও বরণ করে তোলেন লক্ষ্মীকে মা বাপ মরা মেয়ে শুনেছেন।কাকারা প্রায় বিক্রি করে দিতে গিয়েছিলো কোন মাতালের কাছে তারপর যে কি হত কেউ জানেনা। সুশোভন আর ওর দলের ছেলেরা বিয়ের আসর থেকে উদ্ধার করেছে।কোন প্রস্তুতি ছাড়াই বিয়ে হয়ে গেছে।এমনকি বাড়িতে খবর দেওয়ার সুযোগও পায়নি।
তারপর থেকেই মোটামুটি ভাইয়ের মুখ দেখা বন্ধ করেছেন কমল। সরলা কোন কারণ বোঝেন না অযথা জাতপাতের বিভেদ তুলে দিয়ে একটা দেওয়াল খাড়া করে দিয়েছে মাঝখানে।মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যান সরলা স্বামীর জেদ দেখে।ছোটভাইয়ের ওপর বোধহয় ভালোবাসার টানটা বেশি ছিলো তাই বোধহয় অভিমানও বেশি হয়েছে কমলের। সরলারও বারণ ওদের ওদিকে যাবার। মাঝে উঁচু পাঁচিল উঠেছে।মনটা বড় খারাপ করে সরলার একলা ঘরে,ছেলেটাও নেই।সেই পুজোর সময়ে আসবে।অনেকটা দূরের পথ সবসময় আসা হয়না। এতদিন সুশোভন মাতিয়ে রাখতো ওর প্রাণখোলা হাসিতে তারপর বায়না তো ছিলোই আজ এটা রান্না করো কাল সেটা রান্না করো। " বৌদি আজ মাছটা খুব ঝালঝাল করে করো বুঝলে। লাউটা চিংড়ি দিয়ে করো পেছনের বাগানে ঝুলছিলো নিয়ে এলাম বুঝলে।
আজ কতগুলো পুঁটিমাছ ধরেছি পেঁয়াজ দিয়ে চচ্চড়ি করবে নাকি?"
এখন যেন আর রান্নাতে তেমন মনই লাগেনা বায়না করার তেমন কেউ তো নেই,না ছেলে না দেওর।কমলের কোনদিনই খাওয়াতে বিলাসিতা নেই।ঐ একটা ঝোল ভাত হলেই হলো।
দু তিন মাস ভালো করে ছেলেটার মুখই দেখেননি। বৌটাও ঘরে সারাদিন কি করে কে জানে? উঁচু প্রাচীরের ওপারে কিছুই দেখা যায়না। হঠাৎই একটা রোগ এসেছে শুনছেন সরকারের ঘোষণা কেউ বাইরে যাবেনা,বাইরে খাবেনা,কাউকে ছোঁবেনা আরো কত কি নিয়ম। যদিও কমলের মুদিখানা দোকানটা চলছে এই রক্ষে। নাহলে সংসার চালাতে তো কম খরচ হয়না,ছেলে বাইরে পড়ছে। কেজানে ওদিকে ওরা কি করছে,কি খাচ্ছে? ছাদে উঠে ওদিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করেন সরলা কাউকেই দেখতে পাননা। কে জানে সারাদিন ঘরে ঢুকে কি করে বৌটা?
এরা দুই ভাই হয়েছে তেমনি,কারো জেদ কম নয়।মাঝে হয়েছে তার যত জ্বালা। কোথাকার একটা ছেলেমানুষ বৌ,সেই একদিন দেখেছিলেন তারপর দিনই পাঁচিল উঠলো আর তেমন করে দেখতে পাননি।
মাঝে কেটে গেছে কয়েকটা দিন সেদিন দুপুরে বারোটায় রেগেমেগে বাড়ি ফেরেন কমল।
এসেই চ্যাঁচামেচি শুরু করেন বাড়িতে..." আরো লাই দাও দেওরকে।হতভাগা ছোটলোক,দায়িত্বজ্ঞান নেই কোন।সারাজীবন আমাকে জ্বালিয়ে গেলো। বিয়ে করে মুখ পুড়িয়েছে, থাক নিজের মত।তাতেও শান্তি নেই এখনো আমাকে মারবে,হাতকড়া পরাবে সেই ব্যবস্থা করেছে।"
কিছুই বুঝতে পারেননা সরলা ব্যাপারটা কি হয়েছে? সুশোভনের কোন বিপদ হলোনা তো? হায় ভগবান! কি করবেন এখন?
" আরে কি হলো বলো? আমার তো খুব ভয় করছে।"
" হতভাগা নাকি বাড়ি নেই,কোথায় সমাজসেবা করতে গেছে।সেখানে আটকে পড়েছে এখন বাড়ি আসতে পারবেনা। ওদিকে বৌয়ের নাকি বাচ্চা হবে,সে মাথা ঘুরে বমি টমি করে বিছানায় শুয়ে আছে। খায়না,দায়না কান্নাকাটি করছে।তার বাজারই বা কে করে আর রান্নাই বা কে করে। এই অবস্থায় কে কার বাড়িতে গিয়ে সাহায্য করবে? না খেয়ে মরুক এবার বুঝুক হতভাগা। একটা ফোনও করে বলতে পারেনা এত তার জেদ!"
চোখের কোলটা টলটল করে সরলার," তুমিও বা কম কি? একটা ফোন করো,আসতে বলো তাকে।"
" তুমি যা করার করো,আমাকে কিছু বলতে এসোনা।"
সরলা বুঝতে পারেন মন টলেছে কর্তার,হাজার হোক মা হতে চলেছে মেয়েটা বংশধর আসছে বাড়িতে।
" আমি ঐদিক দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে পারবোনা।আর সেই বা আসবে কেন? তারপর রাতে ওভাবে বাইরের দিক দিয়ে আসা যাওয়া আমি করতে পারবোনা।"
অগত্যা মুখে ভাত তোলার আগেই লোক দিয়ে প্রাচীরের মাঝখানে ভেঙে আসা যাওয়ার মত পথ বের করে দেন কমল।
" এত তাড়ার কি ছিলো? এই ভরদুপুরে খাওয়া দাওয়া নেই কিছুনা!"
" তুমি আগে ওপাশে গিয়ে দেখো কি হচ্ছে সেখানে।"
সরলা আধভেজানো দরজার কাছে গিয়ে ডাকেন," লক্ষ্মী,কি করছিস? আমি দিদি।"
নেতিয়ে পড়া মুখটার দিকে তাকিয়ে খুব মায়া হয় সরলার। পাশে জলমুড়ির বাটিটা দেখতে পান।
আর দেরি করেনা,একদম হাত ধরে নিয়ে আসেন ঘরে। খুব সংকুচিত হয়ে লক্ষ্মী বলে," আমি ঠিক আছি দিদি,ও গাড়ি পেলেই চলে আসবে বলেছে।আমি ঘর ছেড়েছি জানলে খুব রাগ করবে।''
"তুই ফোনটা ধরতো তারপর আমি দেখছি কত বড় ল্যাজ গজিয়েছে তার।"
অতি যত্নে ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে দুই জায়ে মিলে খেতে বসেন।
কমল আড়াল থেকে দেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন কেন যেন আজ একটা অদ্ভুত রোগ এসে সব জেদ আর অহংকার ধুয়ে মুছে দিয়ে গেছে।কে জানে জীবনটাই থাকবে কিনা?
জেদের বশে যে অন্যায় করেছেন তা যদি ধুয়ে মুছে যায় মৃত্যু ভয়ে তবে তাই ভালো।
বৌদির সাথে অনেকক্ষণ কথা বলে সুশোভন,গলাটা কেমন যেন ধরে যায়।কেঁদে ফেলেন সরলাও," সাবধানে ঘরে ফিরে আয় বাবা।এই সময় মেয়েটার পাশে থাকা দরকার।"
বাজারের থলে হাতে নিয়ে সকাল সকাল তৈরি কমল। " একি এত সকালে বাজারে যাচ্ছো কেন? দোকান থেকে আসার সময় তো আনলেই হত।"
" তখন আর ভালো কিছু পাওয়া যাবেনা। বাজার বন্ধ হয়ে যাবে। ওকে জিজ্ঞেস করো কি খেতে ইচ্ছে করে কি আনবো?"
মুচকি হাসেন সরলা।
" হ্যাঁ রে তোর কি মাছ খেতে ইচ্ছে করে? আর অন্য কোন কিছু খাবি?"
" আমরা খুব গরীব ছিলাম দিদি,মা বড়ির গুড়ো ভেজে তেল নুন কাঁচালঙ্কা দিয়ে ভাত মেখে দিতো।কখনো আলুভাতে বা কাকাদের ফেলে দেওয়া লাউয়ের খোসাভাজা বা কাঁচকলার খোসাবাটা খেয়েছি গো ওগুলো খুব খেতে ইচ্ছে করে।"
চোখটা আজ ভেজা দুজনেরই বারান্দায় দাঁড়িয়ে কমল।কি বলবেন ভেবে পাননা।বাজারের ব্যাগটা নিয়ে আস্তে আস্তে বেড়িয়ে যান। একটা বড় লাউ,কাঁচকলা আর তার সাথে মাছ কিনে বাড়িতে দিয়ে যান।
" আর এই নাও বড়ি,ঘরে আছে কি না জানিনা দোকানে যেটুকু ছিলো দিলাম।"
কাঁচকলা সেদ্ধ করে খোসা ছাড়িয়ে তাকে বেটে কড়াতে কষিয়ে দিলেন একটু কাঁচালঙ্কা, মিষ্টি আর নুন হলুদ দিয়ে। বড়ি,লবণ,লঙ্কা আর রাঁধুনি শুকনো খোলায় নেড়ে গুড়ো করে দিলেন সরলা। এই আকালের দিনে হয়ত এমন খাওয়াই উচিত।
কেন যেন মনে হলো অনেকদিন বাদে বড় তৃপ্তিতে দুটো ভাত খাচ্ছে মেয়েটা। মুখে বড় পরিতৃপ্তি ছুঁয়ে আছে, কত অল্পেই সন্তুষ্ট মেয়েটা। বাউন্ডুলে ছেলেটার পছন্দ আছে,সত্যিই খুব লক্ষ্মীমন্ত মেয়েটা। ভাত খেতে খেতে বারবারই মায়ের কথা মনে হচ্ছিলো লক্ষ্মীর,কোন ছোটবেলায় মা চলে গেছে ওকে ছেড়ে।কতদিন বাদে এইরকম যত্নে ভাত বেড়ে কেউ ওকে খাওয়াচ্ছে। মায়ের মুখটা যেন আজ সরলার মধ্যে দেখতে পেলো লক্ষ্মী।
রান্নাঘরে বসে ওরা খাচ্ছে দূর থেকে দেখেন কমল।অন্নপূর্ণা আর লক্ষ্মী যেন রান্নাঘর আলো করে আছে। হতভাগাটা ফিরে আসুক ওকে দিয়ে বাদবাকি পাঁচিলটা ভাঙিয়ে কান ধরে যদি ওঠবোস না করান তাহলে ওনার নাম কমল মুখার্জী নয়। খুব জেদ বেড়েছে হতভাগার!
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment