#বাঁধ_ভেঙে_যাক#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
"বৌমা সব্জী আর মাছগুলো ধুয়ে তুলে রেখেছো?
আর বাজারের ব্যাগটাও ধুয়ে নিয়ো বুঝলে।
আর তোমার বাবা বোধহয় উঠে পড়েছে একটু চা করে দিয়ো।
আমি আমারটা করে খেয়েছি।
সকালে চা না খেলে আমি কাজে হাত দিতে পারিনা বাপু।
পুজো করে আরেকবার খাবো।"
"আচ্ছা মা,আপনি যান আমি করে নেবো সব।
আমি আসছি একটু মুনিয়াকে অঙ্ক দিয়ে আসছি।
এখনি আমি ওদিকে গেলে পড়বেনা ফাঁকি দেবে।"
" এতো পড়া পড়া করে কি হবে বলতো? এখনো তো স্কুল খুলতে অনেক বাকি।
একটু খেলতে দাও।
এখন বরং কদিন একটু খেলুক।"
এবার সত্যিই বিরক্ত লাগে ঝিনুকের,সব ব্যাপারে কি উনি মতামত দেবেন! এতদিন ছেলের বৌ কি করবে আর কি করবেনা তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে এসেছেন সব সময়। এখন আবার নাতনিকে নিয়ে পড়েছেন। সকালে উঠে পড়তে বসবে না তো কি হৈ হৈ করে ঘুরে বেড়াবে?
ওদিক থেকে শৈবাল ডাকে.." কি গো জলখাবার কখন পাবো? অনেক সকালে উঠেছি,বাজার করে এসে খিদে পেয়ে গেছে।"
" আসছি..একটুখানি। একেবারে এসে সবার সবটা দিয়ে দেবো।"
" ও বৌদিভাই বাবাকে চা দেওয়ার সময় আমার গ্ৰীন টি এক কাপ দিয়ো।
তাড়া নেই,তুমি ফাঁকা হয়েই দিয়ো।
বলে রাখলাম।"
" মুনিয়া,আমার কিন্তু অনেক কাজ আছে।
তুই একদম দুষ্টু করিসনা।
মন দিয়ে অঙ্কগুলো কর তারপর আমি ইংরেজী কাজ দেবো।"
" মা খেলবো কখন?
একটু ছাদে যাবো,ওখান থেকে তুতুলের সাথে গল্প করবো।"
" আচ্ছা বাবা, যাস।তবে একা যাবিনা কিন্তু।
আমি রান্নাঘরে ঢুকছি।"
রান্নাঘরে ঢুকে কোথা থেকে শুরু করবে প্রতিদিন একবার ভেবে নেয়। আগে চা বানাতে হবে তিনরকমের দেওরের গ্ৰীনটি,শৈবালের দুধ চা ওর আর শ্বশুরমশাইয়ের চিনি ছাড়া লিকার। তারপরেই জলখাবারের পালা।সবার জলখাবার শেষ হতে হতেই আবার রান্নার দেরি হয়ে যাবে। সবাইকে চা পৌঁছে দিয়ে আটাতে হাত দেয় ঝিনুক,তার মাঝেই তরকারি বসিয়ে দিয়েছে।
ঠাকুরঘর থেকে ধূপের গন্ধ আর ঘন্টার আওয়াজ আসছে। শাশুড়ির পুজো হলেই উনি প্রসাদ দিয়ে আসবেন।এতোগুলো বছর হয়ে গেলো তবুও ঝিনুকের রুটি,লুচি বেলা ওনার পছন্দ হয়না। নিজে বেলে দেবেন তারপর যদি না ফোলে তাহলেও বাঁকা কথা আছে।আজকাল সয়ে গেছে ঝিনুকের, অবশ্য এখন ও মোটামুটি পাক্কা রাধুনী হয়ে উঠেছে।
অথচ একটা সময় রান্নার র জানতোনা। কখনো বাবাকে চা করে খাইয়েছে। বাবা মাকে বলতেন," ঝিনুক চা টা কিন্তু দারুণ বানায়। তুমিও পারোনা এমন।"
তবে রান্নাবান্না করতে মা দিতোনা বলতো,"মেয়েদের রান্না শিখতে হয়না,সময় ওদের সব শিখিয়ে নেয়।"
সত্যিই সংসার আর সময় সব শিখিয়ে নিয়েছিলো,যা কোনদিন শেখেনি।আর ভুলিয়েছিলো অনেক কিছু যা শিখেছিলো ভালোবেসে বাপের বাড়িতে। কি সবচেয়ে ভালো পারো? কেউ যদি জিজ্ঞেস করে ঝিনুককে ও বলবে..ভালো ফ্রায়েডরাইস চিলি চিকেন পারে,বিরিয়ানি আর চাপটাও দারুণ পারে। আজকাল একদম ফটফটে সাদা লুচি বানায়,ডালপুরীর পুরটা একদম ঝুরঝুরে হয় ওর বানানো ডালপুরীতে।
ঘর গোছানো,বাজার তোলা,জামাকাপড় কাচা,আয়রন করা সবই পারে।এমনকি নিখুঁত ভাবে শ্রী গড়তে পারে,লক্ষ্মীপুজোর জোগাড় একা হাতে করতে পারে তবে শাশুড়ির কথা অনুযায়ী সবই মোটামুটি।
কতটা আপডেটেড ঝিনুক তা বলতে গেলে সকালে সময় করে খবরের কাগজ পড়া হয়না, তাই সব খবর রাখতে পারেনা মাঝে মাঝে টিভিতে উঁকি দেওয়া ছাড়া। তবে কোন তাকে পাঁচফোড়ন, কোন শিশিতে রাঁধুনি আর কোন কৌটোতে ছোলার ডাল আছে তা চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারে। পড়াশোনার চর্চাটা মুনিয়াকে পড়াতে গিয়ে আবার একটু হচ্ছে। তবে ভালোবাসার জিনিসটা হারিয়ে গেছে কতদিন।
নাচ জানতো ঝিনুক, ভালোবাসতো নাচতে।তবে হয়ত খুব বেশি শিখতে পারেনি তবুও রবীন্দ্রজয়ন্তীতে বা পাড়ার ফাংশনে নিজের ছন্দে যখন পা রাখতো মন ভরতো আনন্দে।
ওকে দেখতে আসার দিনটা এখনো মনে হয় ঝিনুকের..শাশুড়িমা জিজ্ঞেস করেছিলেন.." কি কি জানো কাজ?"
অদ্ভুত লেগেছিলো শুনে যদিও আজকাল ও এইভাবেই ঠিকে মেয়ের ইন্টারভিউ নেয়।
ওর মা বলেছিলো.." রান্না টুকটাক জানে,তবে নাচটা ভালোবাসে। আর পড়াশোনা তো জানেই।"
" নাচ আর কি হবে? গানটা তো যখন তখন তবুও শোনা যায় তবে নাচ কি ঐ ভাবে হয় যখন তখন?"
তবুও বিয়ের পর দেওরের বায়নায় মাঝে মাঝে দুএকদিন এই বাড়িতে দরজা বন্ধ করে হয়েছে নাচ।তবে শাশুড়িমা বিরক্ত হয়েছেন বুঝেছে।তবে নাচটা একদমই বন্ধ হয়ে গেলো যখন মুনিয়ার আগে ওর প্রথম বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর মুনিয়ার সময় একদম শুইয়ে দিয়েছিলো ওকে ডাক্তার। তারপর মুনিয়া এলো,ওকে বড় করা,ওর স্কুল।আরো বেশি সংসারী আর গিন্নী বান্নী হওয়ার মাঝে কখন যে নাচুনি ঝিনুক হারিয়ে গিয়েছিলো বুঝতেই পারেনি। আর নাচার ইচ্ছেটা কখন যে একটু একটু করে মরে গেছে বুঝতেই পারেনি।
আজকাল তো সাহসই পায়না একেই তো সংসারের চাপ তারপর এখন একটু কোমরের সমস্যাও এসে গেছে মুনিয়া হওয়ার পর থেকে।
জলখাবারের পর রান্না বসিয়ে দিয়েছে ঝিনুক। মুনিয়াকে নিয়ে শৈবাল ছাদে উঠেছে। বৃষ্টি আসবে মনে হয় আকাশ জুড়ে মেঘের ঘনঘটা। কে জানে মুনিয়াটা কি করছে ছাদে। কোমরে সবুজ লাল তাঁতের শাড়ির আঁচলটা পেঁচিয়ে ছাদে ওঠে,অনেকগুলো কাপড় শুকোতে দেওয়া আছে ছাদে।
আকাশে মেঘের ঘনঘটা,ঠান্ডা বাতাস বইছে।আম গাছটা হাওয়ায় নড়ছে,নারকেল গাছের পাতাগুলো ঝিরঝির করছে হাওয়ায়। শৈবালের মোবাইলে বাজছে মন মোর মেঘের সঙ্গী উড়ে চলে দিক দিগন্তের পানে..
হঠাৎই হাওয়ায় আঁচল উড়িয়ে পা দুটো কেমন যেন অবাধ্য হয়ে ওঠে ঝিনুকের অনেকদিন বাদে ছাদে পাখা মেলে দেয় ঝিনুকের হাতদুটো,পা দুটো পায় ফিরে হারানো ছন্দ।
শৈবালের চোখে শুধুই মুগ্ধতা আপন খেয়ালে পা দুটো আজ গানের তালে মেতেছে। প্রকৃতির মত্ততায় মেতেছে ঝিনুকের মনও।
" মা তুমি এতো ভালো নাচো! আমাকে শিখিয়ে দাওনা মা। স্কুলের রবীন্দ্র জয়ন্তীতে করবো।"
কিছুক্ষণ কথা বলতে পারেনা ঝিনুক।
" ও মা কি হলো?"
" আমি ভুলে গেছি মা,আজ হঠাৎই কেন যেন মেঘ দেখে আর গানটা শুনে একটু হাত পা নেড়ে ফেললাম।"
" একটুও ভুলোনি ঝিনুক,এই দেখো।"
ভিডিও করেছে শৈবাল?ও তো খেয়ালই করেনি।
সত্যিই নিজেরই কেন যেন মনে হলো আবার হয়ত পারবো। ভালোবাসাকে ভুলে বোধহয় বেশিদিন থাকা যায়না।"
" ও ঠাম্মু,মায়ের নাচের ভিডিও দেখো।আমি মায়ের কাছে নাচ শিখবো।স্কুলে বলেছে নাচ করতে।"
নাতনি বলেছে তাই আর কোন কথাই হবেনা..." বৌমা মেয়েটাকে একটু শেখাওনা,ছেলেমানুষ বায়না করছে।"
কেমন যেন অবাক লাগে ঝিনুকের। আজ ঝিনুকের শাশুড়ি হেরে গেছেন মুনিয়ার ঠাম্মার কাছে।
ঝিনুক কি পারবে? অনেকদিন বাদে বটুয়া থেকে ঘুঙুরটা বার করে ঝিনুক।আদর করে হাত দিয়ে,ভালোবাসে ওর পুরোনো ভালোবাসাকে।
" বৌদিভাই শুরু করো ফটোগ্ৰাফার রেডি..."
আশমানি নীল শাড়ির লাল আঁচলটা জড়িয়ে নিয়েছে কোমরে ঝিনুক...শৈবাল ব্লু টুথ স্পীকারটা অন করে..
' নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার—
জানি জানি তোর বন্ধনডোর ছিঁড়ে যাবে বারে বার॥
সত্যিই সব ভয় জয় করে আজ মনের সবটুকু ভালোবাসা আর ইচ্ছে দিয়ে পুরোনো ছন্দে ফিরেছে ঝিনুক,হয়ত অনেকটাই মুনিয়ার জন্য। (Happy International Dance Day)©রুমাশ্রী সাহাচৌধুরী
ভালো লাগলে নামসহ শেয়ার করুন।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment