#মাধবীর_ডায়েরি#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
বৌয়ের সায়া ব্লাউজ কিনতে যাওয়া যেমন অলোকের কাছে অসম্মানের তেমন বাড়ির ঝাড়পোছ করা বা তরকারি কাটাও মেয়েদের কাজ বলেই পরিচিত। এই গুলোতে সাহায্য করতে তার পৌরুষে লাগে। বিয়ের রাতেই বেড়াল মারার প্রবাদ অনুযায়ী কি কি কাজ তার স্বভাববিরোধী তা সেদিন রাতেই বলে দিয়েছিলো মাধবীকে। মাধবী অবশ্য একটা কথাও ভোলেনি সেই থেকে চেষ্টা করেছে কোন কারণেই যেন অলোকের অপছন্দের কাজ তাকে না করতে হয়।
তাই একা হাতেই সংসারের মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট কাজগুলো করার চেষ্টা করে। এই যেমন তরকারি কাটা,রান্না করা,টিফিন করা,কাজের লোক না এলে ঘর ঝাড় দেওয়া,মোছা,বাসন মাজা,কাপড় কাচা সবই। এমন কি ওয়াশিং মেসিনেও কাপড় কাচাও মাধবীর মানে মেয়েদেরই কাজ।এছাড়া ঘর গোছানো,কাপড় মেলা আর তোলা,আসবাবপত্র মোছা সবই মেয়েদের কাজের মধ্যেই পড়ে অলোকের কাছে। নিজের জিনিস যে ব্যবহার করে জায়গা মত রাখতে হয় তা ঠিক জানেনা তাই এই বাড়িতে মাধবীর ছেলেমেয়েরাও। অভিমান হয় খুব মাধবীর মাঝে মাঝে একদিন বলেছিলো অলোককে.." আচ্ছা সব কাজই তো শুনি মেয়েদের কাজ।ছেলেদের করণীয় কি কাজ আছে বলতে পারো?"
" একদম বলতে পারি,বাজার থেকে ভালোমন্দ আনা।মানে গুছিয়ে বাজার করা,খাওয়া,অফিসের কাজ করা,দরকারে ব্যাঙ্কে যাওয়া।"
আত্মসম্মান মাধবীরও আছে হয়ত এটুকু সবারই থাকা উচিত যদিও ওর বোন প্রীতি সবসময় বলে.." শোন দিদি সংসারটা সবার সবাই এখানে থাকে তাই সবাই মিলেমিশে কাজ করবে।এরমধ্যে ছেলেদের কাজ আর মেয়েদের কাজ বলে কি আছে শুনি? তুই কিছু বলিসনা বলে পেয়ে বসেছে। সারাদিন খেটে মরছিস তবুও ওদের কিছুই যায় আসবেনা।"
সত্যিই বোধহয় যায় আসেনা,মানে সেই মানসিকতাই তৈরী হয়নি ওদের। হয়ত সর্বংসহা মাধবীও অনেকটা দায়ী ঐ জন্য,মানবিকতাতে যে পরিবর্তন হয়নি বিদ্রোহ করে সেই পরিবর্তন নিজেও আনতে চায়না সে।
সত্যিই কি সব কথা ভাগ করে নেওয়া যায়?অনেক সময় মনই হয়ত লুকিয়ে রাখে মনের খবর।চুপটি করে বলে ভালো থাকতে হবে এভাবেই অনেক খারাপ লাগা সয়েই । তাই একদিন হঠাৎ বৃষ্টিতে মাধবীর ইনার তুলে অলোক যে ইঙ্গিত করেছিলো তা খুব খারাপ লাগলেও প্রত্যেকদিন অলোকের ইনার শুকনো করে তুলে জায়গা মত রাখার কাজ যত্নে করে মাধবী। অলোক এখনো সামন্ততান্ত্রিক যুগেই হয়ত বাস করে যারা মানতো বালক,ঢোলক এবং স্ত্রীলোককে মাঝে মধ্যে থাবড়াতে হয় নাহলে সব ঠিকঠাক চলেনা। কথার থাপ্পড় খাওয়াটাই অবশ্য যথেষ্ট তাই যাতে কথা শুনতে না হয় তার জন্য কোনরকম তর্কে না গিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে যখন সে রান্নাঘরে কাজ করে যখন বাড়ির অন্যরা পাখার তলায় বা আজ খুব গরম বলে এসিতে থাকে।
ছুটির দিন দুপুরে বা অন্যদিন রাতে কাজ করে ঘরে আসতে আসতে মাধবী দেখে অলোক নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার মধ্যে অবশ্য যেদিন মাধবীকে দরকার হয় সেদিন জেগে ওঠে অলোক। প্রয়োজনের শরীরী সুখে কিছুক্ষণের জন্য মাতোয়ারা হয় শরীর।
কাপড় মেলার ফাঁকে বা কখনোও ফুল তুলতে গিয়ে মাঝে মাঝে হারিয়ে যায় মাধবী। কখনো পাতার ফাঁকে জমে থাকা জলের ফোঁটার সঙ্গে সবুজের মিশে যাওয়া দেখে কখনো বা ফুলের কুঁড়ির গায়ে বাতাসের দোলায় পাতার আদর দেখতে দেখতে হঠাৎই মনে হয় এই যাহ্ ডালের সিটি বাজছে আবার দৌড়তে থাকে।
গতির সাথে জীবনের মেলবন্ধনে তাল মেলাতে মেলাতে মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে যায় মাধবী মনে মনে ভাবে ইশ্ যদি একটা দিন এমন হতো সকাল থেকে উঠে চলতে পারতো নিজের মত থাকতো না সংসারের কোন মেয়েদের কাজ,সংসারটা হত সবার। মানে দায়িত্বহীন একটা সকাল যেখানে সকাল থেকেই বাজতো ছুটির ঘন্টা আসতো রোদ্দুরের ছেঁড়া খাতা থেকে টুপ করে খসে পড়া কোন অনিয়মের চিঠি তাহলে বেশ হতো।
কদিন মাধবী হিমসিম খাচ্ছে আশা মানে ওর সাহায্যকারী বেশ কয়েকদিন আসছেনা।অলোকের কড়া বারণ অবশ্য মাধবীও মেনেছে সেই কথা...করোনায় বাইরের লোক ঘরে ঢোকাবোনা। সুতরাং আশার করা সমস্ত মেয়েদের কাজ মাধবীর ঘাড়ে পড়েছে। লকডাউনে অলোকের আরো মুড অফ কারণ বাজারে নিয়মিত যাওয়া হচ্ছেনা,অফিস বন্ধ। তাই বাড়িতে কোন কাজ বাড়তি করে ফেলা মানেই বেড়ালকে ভাঙা বেড়া দেখানো।আজ যা অবসরে মাধবীকে সাহায্য করতে করবে তা একসময় মাধবীর দাবী হয়ে দাঁড়াবে। ছেলে মেয়েরাও ছুটি উপভোগ করছে। মাধবী নিজের আনন্দ কাজেই খুঁজে নিয়েছে তাই ক্লান্তিকে সে চাপা দেয় শান্তির উদ্দেশ্যে।
হঠাৎই এলো মাধবীর আকাঙ্খিত সেই চিঠি ছুটির ফরমান কিন্তু তা মেঘলা মনের মনখারাপের পিয়ন আনলো। সেদিন সকালে মাধবীর উঠতে ইচ্ছে করলোনা। অলোক অনেকক্ষণ এদিক ওদিক করে উঠলো ঘড়িতে দেখলো নটা বেজে গেছে।এতক্ষণে চা করে জলখাবারের প্রস্তুতি নিতে নিতে সবার ঘুম ভাঙায় মাধবী।
গম্ভীর আওয়াজে বিছানার কাছে এসে বলে.." কাল তো বিরক্ত করিনি কোনো। আজ কি চা পাবোনা?"
চমকে উঠে বসতেও মাথাটা কেমন টলে যায় মাধবীর বড় ভারী মাথাটা জ্বর জ্বর লাগছে। মনে মনে ভাবে ইশ্ কত বেলা হয়ে গেছে! কত কাজ বাকি! অথচ শরীরটা ভালো লাগছেনা হয়ত কাজ করতে করতেই ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু না ঠিক হয়না জ্বর বাড়ে। " কখন থেকে জ্বর তোমার? তুমি তো বাইরে যাওনা তাহলে হঠাৎ!"
অপরাধী মুখ করে মাধবী বলে," কি জানি আসলে খুব জল ঘাটতে হয় তো তাই হবে। জ্বরের ওষুধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।"
আজ তৃতীয়দিন মাধবীর আর জ্বর নেই। তবুও মাধবী হঠাৎই ছুটি পেয়ে গেছে। একদিন দুদিন নয় একদম চোদ্দ দিনের ছুটি। কিন্তু এমন ছুটি তো সে চায়নি,সে চেয়েছিলো সবাই যেমন ছুটি উপভোগ করে তেমনি এক হাসিমাখা ছুটির দিন। এ যেন এক কয়েদির জীবন।অনন্ত অবসর তার কিন্তু চারদিকে তার লক্ষ্মণরেখা। আজ মাধবীর মনে হয় এর চেয়ে তার ব্যস্ত হাঁফিয়ে ওঠা সংসারই ঢের ভালো ছিলো । আজ অনেক সময় পেলেও ফুল পাতা দেখাতে তার মন নেই শুধু মনে হচ্ছে কে জানে ওরা কি করছে? দেখাসেল্ফ কোয়ারেন্টাইনে আছে মাধবী। ছাদের এই ঘরটাতে আপাতত ওর ঠাঁই হয়েছে অবশ্য ও নিজেই বলেছিলো এখানেই থাকবে। একটু আপত্তি করেছিলো ছেলেমেয়েরা তবুও একটু জোরই করেছিলো মাধবী হয়ত এই প্রথমবারই ওর মেনে নেওয়া জীবনে। আসলে মেয়েদের কাজ করতে অনভ্যস্ত অলোককে মেয়েদের কাজ করতে হয়ত দেখতে চায়না বলেই। তার চেয়ে এই ভালো,কটা দিন কাটুক শুধুই নিজের মত করে এই ছোট্ট ডায়েরিতে নিজের জমে থাকা ছোট ছোট মেয়েদের অনুভূতির কথাগুলো লিখে। চোদ্দদিন বাদে অলোকের এলোমেলো হাতে চালানো ওদের অগোছালো সংসারটাকে আবার ওর মেয়েলী হাতের যত্নে সাজিয়ে নেবে। আর তো মাত্র এগারোটা দিন দেখতে দেখতেই কেটে যাবে।@ কলমে রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী
ভালো লাগলে নামসহ শেয়ার করুন।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment