#মেমবম্মা#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
আচারের বয়াম গুলো রোদে রাখেন বাসন্তী.. মনে মনে ভাবেন যাক বেশ কড়া রোদ উঠেছে আজই অনেকটা মজে যাবে।কিন্তু পাহারা না দিলে উপায় নেই।বুড়ো বয়েসে এতো পারা যায় নাকি?
যা ভেবেছেন তাই ঠিক পিছু পিছু দুই নেংটি ইঁদুর এসে হাজির। এদের জ্বালায় নাড়ু,মোয়া,মুড়কি কিছুই রাখার উপায় নেই ঘরে। তবে দুটোই বাসন্তীর নয়নের মণি।
" ও মেমবম্মা,তুমি নিচে যাও আমি আর সোনা দিদি ঐ ছায়াটাতে বসে কাটাকুটি গোল্লা খেলছি, আমরা পাহারা দেবো আচার।"
" তাহলেই হয়েছে আরকি,চোরের কাছে সিন্দুক খুলে যাওয়া পাহারা দিতে।এই তোরা নিচে যা রোদ লাগাসনি মোটে শরীর খারাপ করবে।"
বাসন্তী রুনা আর সোনার বড় ঠাম্মা, মানে ঠাম্মার শাশুড়িমা। সাদা ফটফটে চুল,সাদা,শাড়ি আর গায়ের সাদা রঙ সব মিলিয়ে সত্যিই মেমসাহেবই বটে। একটা সময় রঙের আর সৌন্দর্যের দেমাক ছিলো যথেষ্ট। আর থাকবেইনা কেন নাকে টানা নথ,গা ভর্তি গয়না চওড়া জড়ির পাড় শাড়ি আর বড় সিঁদুরের টিপ পরে যখন দুগ্গাদালানে অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে আসতেন তখন তো পাড়ার বৌয়েরা চোখ ফেরাতেই পারতোনা। হয়ত তার স্বামী নরেন্দ্রও কলারটা উঁচু করে চলতেন সুন্দরী বৌয়ের গর্বে গর্বিত হয়ে।
তবে সেদিন গেছে অনেকদিন কথায় বলে রূপ,যৌবন আর মন বড়ই চঞ্চল। কালে কালে বয়েস এখন লাফিয়ে সত্তর পেরিয়ে আশির সাথে কানাকানি করছে। শাশুড়ির সাথে সাথে এখন দিদিশাশুড়ি, ঠাম্মার পরে এখন বড় ঠাম্মা।তবে মেমবম্মাটা শুনতে ভারি ভালো লাগে মনে করিয়ে দেয় এখনো তিনি সুন্দরী।
নয়না আর অরিন তার ছেলে আর ছেলের বৌ।দুইমেয়ের পর ঐ ছেলে,বড় আদরের। বংশরক্ষের জন্য সেই কালে সন্তান এক এক করে তিনটি। অরিনের দুই ছেলে এক মেয়ে,মানে বাসন্তীর আদরের দুই নাতি সৌরীন আর আবীর নাতনি নিভা। সবারই বিয়ে হয়ে গেছে।দুই নাতবৌ,ছেলে বৌমা আর বড় নাতির ঘরের দুটো সুদ নিয়ে ভালোই আছেন এই বয়েসে।
রুনা আর সোনা বড় নাতির দুই মেয়ে। বড় নাতবৌয়ের দ্বিতীয় বাচ্চা হওয়ার সময় সবারই আশা ছিলো এবার ছেলে হোক একটা।এক মেয়ে আর ছেলে বেশ সুন্দর হবে। তাছাড়া নাই নাই করে এই গ্ৰামে যা সম্পত্তি আছে তারজন্যও তো দরকার একটা বংশধর। এখন তো আর সেই যুগ নেই ছেলে ছেলে করে চারটে পাঁচটা করে বাচ্চা। কিন্তু আবার মেয়ে হওয়াতে বড় নাতির সাথে সাথে মন বেশ খারাপ হয়েছিলো বাসন্তীরও।তবে মনে মনে একটু কষ্ট পেলেও মুখে কিছু বলতে পারেননি।
শুধু বৌমাই বলেছিলো.." ভেবেছিলাম বৌমা আমার ধাতেই হবে আমারও তো নিভা প্রথমে তারপর পর পর দুই ছেলে। সেই রকমই তো মনে হচ্ছিলো দেখে শুনে।"
" থাক বৌমা,ওদেরও তো আশা ছিলো হয়ত ছেলের।কি দরকার এই সব কথা বলার? মনের কথা মনেই থাক।"
তবে তখন যাই হোকনা কেন,এখন তো ঐ দুই মেয়ে রুনা আর সোনা বাড়িকে একদম মাতিয়ে রেখেছে।বাড়ির সবারই খুব প্রিয় ওরা। তবে এবারের এতো আচার বানানো বাড়ির বিশেষ একজনের জন্য। বাসন্তীর ছোট নাতবৌ মানে ছুটকি কদিনই আচার আচার করছে। এই সময় আচার তো খেতে ইচ্ছে হতেই পারে তাই নাতিদের বলে সব আনিয়ে একদম নিজের হাতে বানিয়েছেন টক,মিষ্টি,ঝাল এমনকি আমের জেলিও। তাই একটু আগলে রেখেছেন বয়ামগুলো। এখনই ওই বিচ্ছুদুটোর হাতে পড়লে শুধু আঁটিগুলোই থেকে যাবে হয়ত।
নিজের সংসারের দিকে তাকিয়ে শান্তির শ্বাস ফেলেন বাসন্তী। নরেন্দ্র চলে যাওয়ার পর একলা হয়ে গেলেও সংসার তাকে একলা থাকতে দেয়নি। এই বয়েসেও ছুটি দেয়নি ছেলে নাতি কেউই। " ও ঠাকমা একটু বলতো কি কি আনতে হবে দেখে। মা তো পুজোর ঘরে বললো তোমাকে জিজ্ঞেস করতে।"
" তোর বৌকে জিজ্ঞেস করনা গিয়ে।আমার কি ছুটি নেই নাকি?"
" ধুর ওরা কি বোঝে? মেয়েদের পড়াশোনা আর সিরিয়াল নিয়েই হিমসিম খাচ্ছে। মাথাই ঘামায়না কোন কাজে।"
মুখে যতই বলুননা কেন এই কাজের কতৃত্ব টুকুই আত্মতৃপ্তির হাসি ছুঁইয়ে দেয় তার চোখে মুখে। মনে হয় এখনো সংসারটা তার,তিনি অকেজো নন।
কখনো ছোট নাতবৌ এসে বলে," ময়দা কতটুকু নেবো দেখো ঠাম্মি। আর ময়ান এইভাবে দেবো তো?"
নিজের শাশুড়িমা যে কতটা সংসারকে ভালোবাসেন তা বিয়ের পরই বুঝতে পেরেছিলো নয়না তাই সেই ভাবেই বৌমাদের বুঝিয়েছিলো..." শোনো ওনার হাতেই গড়া সংসার।এইটুকু কতৃত্ব পেলে যদি খুশি হন দিতে আপত্তি কোথায়? একদিন তো তোমাদেরই সব থাকবে।"
দুই বৌমার কেউই অবশ্য কিছু বলেনি,ওদের কাছে শাশুড়িমায়ের চেয়ে ঠাম্মা বেশি কাছের। আর পারেও বটে ঠাম্মা..ওদের তো গাল লাল হয়ে গিয়েছিল ঠাম্মার কথা শুনে.." কি রে নাতিরা আদর টাদর করেছে তো ঠিকমতো? রাতে ঘুমোতে দেয় তো?"
ছোট নাতবৌ তো আরো আদরকাড়া তার সব আব্দার ঠাম্মার কাছে। বাসন্তীরও একটু বেশি আদরের ছোট নাতবৌ,সইয়ের নাতনী বলে কথা।তারপর কোন কালে মাকে হারিয়েছে। এই সময় মা থাকলে একটু যত্ন পেতো। তাই বাড়িশুদ্ধ সবাই খেয়াল রাখে ওর যত্ন যেন ঠিকমতো হয়। এটা অবশ্য বাসন্তীর কড়া হুকুম।
ছাদে তখনো দুই নেংটি ইঁদুর বসে ওদের চোখগুলো ঘুরছে বয়ামে,"ও মেম এই আচারটা খুব ভালো হয়েছে গো দেখতে।কি লোভ হচ্ছে গো।"
" আচ্ছা হোক খাস।"
" তুমি যে বললে কাম্মার জন্য বানিয়েছো।"
" বানিয়েছি তো,তবে আমার সোনা রুনা খাবেনা তাই হয়!"
" আচ্ছা মেম কাম্মার একটা ভাই হলে খুব ভালো হয় তাইনা?আমরা ভাইফোঁটা দেবো।"
" সত্যি যদি ভাই হয় তাহলে এতো বড় বড় ছানার জিলিপি খাওয়াবো তোদের। একটু বল তো ঠিক করে ভাই হবে।"
মনটা একটু হলেও ভরে যায় বাসন্তীর সত্যিই এবার বাড়িতে একটা ছোট্ট দাদুভাই আসুক দুই দিদি একটা ভাই পাবে।
আচার একদম তৈরি হওয়ার পর ছোট ছোট শিশিতে আগে ছুটকির জন্য তুলে তারপর বড় নাতবৌকে দিয়ে দিলেন বাসন্তী.." এই নে তোর কাছে দিলাম সবাইকে দিবি।"
" সবাইকে দেবো? ওত পেতে বসে আছে দুজন, কদিন রাখতে পারি দেখো।"
" তা খাবেই তো,আমি কি টক কম খেয়েছি এই বয়েসে?
কি রে ছুটকি,পেটের টা আচার খেয়ে কি বলছে? নড়ছে তো ঠিকমতো?"
" ঠাম্মি সারারাত ঘুমোতে দেয়না,যা লাথি মারে।"
" নির্ঘাত ফুটবল খেলে ব্যাটা পেটে।আর কি এরপর দুই দিদির সাথে বাড়ি মাতাবে। নাতির ঘরে পুতি দেখে তবে তো মরবো আমি। আর কি খেতে ইচ্ছে করে বলিস,লটে ঝুরি খাবি তো?"
বাসন্তী যেন নতুন করে উৎসাহ পেয়েছেন নতুন কেউ বাড়িতে আসার আনন্দে।
হই হই করে সাধও হয়ে গেলো।বেশ মজাও হলো। সবটাতেই বাসন্তী আছেন এই বয়েসে,না থেকে উপায় আছে?ছেলে ব্যস্ত ব্যবসা নিয়ে আর বৌমা তার ঠাকুর নিয়ে। অবশ্য সবটাই অরিনের ইচ্ছে মাকে সচল রাখার জন্য.." এইটুকু থাক। মা সংসার ভালোবাসে তাই থাক মা সংসারে।তুমি ঠাকুর পুজো ভালোবাসো তাই করো। সবাই খুশি থাকো। এমন সংসারই বা কজনের ভাগ্যে হয়?"
গতকাল থেকেই মনটা খুব অস্থির বাসন্তীর মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছিলো ভর্তি হয়েছে নার্সিংহোমে,নাতিরা যাতায়াত করছে।
" কি রে কি খবর? কোন খবর দিয়েছে ছোট দাদুভাই?"
" মা অত ভেবোনা,তোমার তো লটারির টিকিটের রেজাল্ট বেরোনোর মত অবস্থা দেখছি।"
" না রে চিন্তা হয়,মা মরা মেয়ে তো। আমাদেরই তো দায়িত্ব।"
পরদিন সকালেই খবর আসে তবে নয়নার মনটা খারাপ,মনটা একটু দোলা দেয় বাসন্তীরও আবার মেয়ে! আশা করেছিলেন এবার হয়তো ছেলে হবে।
পরক্ষণেই নিজেকে সামলে বলেন.." শোনো বৌমা প্রথম বাচ্চা মেয়েটার তাই আনন্দ করো।সে যে সুস্থ ভাবে এসেছে পৃথিবীতে এটাই অনেক।"
নয়না আশ্চর্য হয়ে যান তার শাশুড়িমায়ের কথায় হয়ত এতো আধুনিক তিনিও হতে পারেননি।
" ও মেম আমরা তো ঠাকুরকে বলেছিলাম তবুও বোন হলো তুমি ছানার জিলিপি আনবে তো?"
" একদম দিদি,অরিন পাঁচুর দোকানে অর্ডার দিবি যেন খুব বড় বড় ছানার জিলিপি বানায়। পরশুদিন নেবো,ছুটকি তো সেদিন আসছে।"
বাচ্চা কোলে নিয়ে ঢুকতে গিয়েই ঠাম্মাশাশুড়ির গলা পায়..." বৌমা উলু দাও,শাঁখ বাজাও লক্ষ্মী এলো ঘরে।"
" ঠাম্মি ওকে দেখতে একদম আমার মায়ের মতো হয়েছে গো।"
" তোর মা হয়ত আবার আদর খাবে বলে এসেছে ঘরে। যত্নে রাখিস মাকে। আয় দিদিরা ছানার জিলিপি এসে গেছে হাড়ি ভর্তি।"
বাড়ির মন খারাপের দমকা হাওয়াটাকে মমতার আঁচল দিয়ে আড়াল করলেন বাসন্তী। শুধু শুধু মন খারাপ হবে কেনো? যা পেয়েছেন তাকেই আগলে রাখবেন আদরে।
" শোন ওর ডাকনাম টা কিন্তু আমি দেবো।"
" তুমি সব নামই দাও ঠাম্মা।"
" না ভালো নাম তোমরা,ডাকনাম আমি। তোমাদের যদি পছন্দ হয় তাহলে ওর ডাক নাম এলিসা দিয়ো।"
" ও মেমবম্মা তুমি মেমসাহেব তাই ওর ঐ নাম দিলে?"
ছেলের আর নাতিদের দিকে তাকিয়ে হাসেন বাসন্তী। আবীর এগিয়ে একটা মিস্টি হাগ দিয়ে বলে..." হ্যাটস্ অফ ঠাম্মা, আচারের বয়ামে নজর দেওয়ার সাথে সাথে সারা পৃথিবীর খবরেও নজর রাখো তুমি! গ্ৰেট,ও ঠাম্মা তোমায় সেলাম।"©রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী
ভালো লাগলে নামসহ শেয়ার করুন।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment