#বোগেনভেলিয়া#
রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
তার শখের বারান্দায় টবের ওপর একটা দলাপাকানো গামছা ঝুলছে আর টুপটুপ করে গামছার জল বোগেনভেলিয়ার টবে পড়ছে দেখে কেমন যেন আঁতকে উঠেছিলেন সুলতা বাইরে থেকে। স্বামীর রিটায়ারমেন্টের পর যা টাকা পেয়েছিলেন তা দিয়ে কেনা ঐ দুকামরার ফ্ল্যাট।কলকাতাতে ফ্ল্যাট কেনার ইচ্ছে ছিলো অনেকদিনের কিন্তু পেরে ওঠেননি মানে সামর্থ্যে কুলিয়ে উঠতে পারেননি। তবে বাবলুর কলকাতাতে চাকরি পাওয়ার সুবাদে ঠিক করেন একটা ফ্ল্যাট হলে মন্দ হয়না।আর ঐ একটা মাত্রই তো ছেলে সব তো একটা সময় ওর থাকবে তাই সমস্যা কি আর এমন।
পছন্দ করে বেশ ছোট অথচ ছিমছাম সুন্দর ফ্ল্যাটটা কিনে ফেলেন। যদিও তিনটে ঘর হলে ভালো হত কিন্তু হলোনা বাজেটে তবে ডাইনিংটা বেশ বড় দরকারে একটা ডিভান পেতে নিলে হবে। ওদের কর্তা গিন্নীর আসানসোলেই বেশি ভালো লাগে থাকতে তবুও যখন ইচ্ছে হবে তখন ছেলের কাছে এসে থাকবেন দুটো ঘর তো আছেই তারপর ওদিকে সামলে কদিনই বা আসবেন?
তারপর থেকে যাওয়া আসা চলে। কলকাতার ফ্ল্যাট সুলতার অবসরের দক্ষিণের বারান্দার মতো তাই একদম পছন্দ করে নিজের মনমত ফ্ল্যাট সাজিয়েছেন সুলতা অনেকটা ছোট্ট ক্যানভাসে তুলির টানে আঁকা তার অন্দরসজ্জা। শান্তিনিকেতনের বেতের ওপরে বাটিকের কভারের মোড়া। ছিমছাম সুন্দর রট আয়রনের ডাইনিং টেবিলের ওপরের কাঁচে থ্রীডি নক্সা। বারান্দায় আর ঘরে ছোট ছোট টবে বেশ কিছু গাছ।টবগুলো সুন্দর করে নিজের মন মতো তুলিরঙ দিয়ে সাজিয়েছেন। ডাইনিংয়ে স্মার্ট টিভি,ডাবলডোর লেটেস্ট ডিজাইনের ফ্রীজ আর মডুলার কিচেন।
সুপ্রিয় মজা করে বলেন," এমন খেলনাবাটি খেলার শখ যে তোমার ছিলো তা তো জানিনা। যে সময় লোকে বাণপ্রস্থে যেতো একসময় সেই সময় আবার নতুন করে স্বপ্ন সাজালে একদম পরিপাটি করে।আর কতদিন ভোগ করবে শুনি?"
অবশ্য সুপ্রিয় বাধা দেননি একটা সময় সুলতা অনেক কষ্ট করেছে তাই এইটুকু সাধ মিটুক আরে জীবন তো একটাই।
তাই কেনা হয়েছে একটা ছোট গাড়িও,সময় পেলেই সুলতা আর সুপ্রিয় পুকুরের মাছ,বাগানের সব্জি অথবা গাছের আম নিয়ে চলে আসতেন তার সাজানো পরিপাটি সংসারে।তারপর এফ.এম বা মিউজিক সিস্টেম শোনার ফাঁকে ফাঁকে ছেলের পছন্দমতো রান্না আর টুকটাক কেনাকাটা করতে করতে কখন যে ফেরার দিন এসে যেতো। ছেলে বলতো," আরো কয়েকদিন থেকে যাওনা মা,তোমার রান্না খুব মিস্ করি।"
" আর আমাকে মিস্ করিসনা বুঝি?"
"করি তো,তখনই তোমাদের ঘরে গিয়ে বসে থাকি।নিজের থাকার ঘরটাও ইচ্ছেমত সাজিয়েছেন সুলতা। খাটের লাগোয়া দেওয়ালে ওদের তিনজনের একটা বড় ছবি,তাছাড়া সুপ্রিয় সুলতার কিছু একান্ত ছবিও আছে যা বাইরে বেড়াতে গিয়ে তোলা। খাটের সংলগ্ন ছিমছাম ওয়াড্রোবে সুলতার কিছু পছন্দের শাড়ি আর সুপ্রিয়র কিছু জামাকাপড়। বড় ঘরটা ছেলের জন্য সাজিয়েছেন সুলতা ওর পছন্দমত।দুই ঘরের সাথেই বাথরুম আছে।সুলতার ঘর সংলগ্ন বাথরুমে ডাইনিং দিয়েও আসা যায় এমন ব্যবস্থা করে নিয়েছেন।যদিও ছেলে একটু আপত্তি করেছিলো," একটা বাথরুম কমন থাকনা।"
" ওটা তো কমনই তবুও একটা অপশন রাখলাম ঘর দিয়ে যাওয়ার। কখনো শরীর টরীর খারাপ হলে তখন অসুবিধে হবেনা।টুক করে যেতে পারবো।"
" সত্যি মা কত ভাবনা তোমার! শরীর খারাপ হলে আমার ঘরে শোবে।আমি তোমাদের ঘরে চলে যাবো।"
ধুর বোকা,বাড়িতে বৌমা আসবেনা নাকি? তখন তো আমি পরিযায়ী পাখীর মত মাঝে মাঝে আসবো। সে কেন যখন তখন তার ঘর ছাড়বে? ঐটুকুই তো পারসোনাল স্পেশ নাকি?
আসলে এমন একটা ফ্ল্যাটের স্বপ্ন কতদিনের তার। আসানসোলে তাদের একটু ভেতরের দিকে পুরোনোদিনের বাড়ি। ভাগের বাড়ি হলে যা হয় অন্য জায়েরাও থাকে সেখানে।যদিও সবাই মিলে একসাথে অন্নকূট,নবান্ন বা দোল খেলার মজাও আছে তেমনি আছে পিএনপিসি বা আড্ডাও।তবুও ফ্ল্যাট মানে বেশ আধুনিক আধুনিক ব্যাপার হবে তেমন নেই।ঐ পুরোনো বাড়িতে বড় উঠোন আর একতলা দোতলা করতে মাঝে মাঝে হাঁফিয়ে ওঠেন সুলতা। আর তখনই মাঝে মাঝে এসে স্বাদবদল করে যান,ছেলেকেও দেখা হয় আবার একটু মনের জানলায় হাওয়াও লাগে।
মাঝে কেটে গেছে দুটো বছর ছেলের কাছ থেকে জানতে পেরেছেন ছেলের জীবনে কেউ এসেছে ভালোবাসার মানুষ তাহলে আর দেরি কেন শুভস্য শীঘ্রম। ছেলেই বলে," মা আমি ঠিক করছি ঠিক তবে তা বলে তুমি সব দায়িত্ব ছাড়তে পারোনা। একবার একটু দেখে তো নেবে।"
ওরা দুজনেই বলেন," দেখার আবার কি আছে? তোরা একসাথে থাকবি তুই দেখে নিয়েছিস ব্যাস আবার কি দরকার?"
বাবলুর যেন মনে হয়েছিলো একটু সূক্ষ্ম অভিমান কোথায় যেন লুকিয়ে। " মা তুমি রাগ করেছো?"
" ধ্যাৎ আমাদের কত ঝামেলা কমে গেলো। বাবা আমার যা চিন্তা ছিলো কত বাড়ি ঘুরে মেয়ে দেখবো আর মিষ্টি খাবো! আমার খুব বাজে লাগে। তা হ্যাঁ রে ওদের পরিবার ভালো তো?"
"হ্যাঁ মা,ওরা তো থাকার মধ্যে মা আর মেয়ে।ভালোই তো মনে হয়।তবে রোশনী কিন্তু তোমার মত অত কিছু জানেনা।"
" তাতে কি?সব শিখে যাবে ধীরে ধীরে। আর তুই তো অনেকটাই জানিস। করবি দুজনে ভাগ করে।"
" হ্যাঁ আমি তো তাই বলেছি। তারপর তুমিও তো আছো।"
" না বাবা,অনেক সংসার করেছি এবার আমি মুক্ত হবো। মাঝে মাঝে আসবো ছেলে বৌয়ের আদর খেয়ে চলে যাবো। এখন আমার ছুটি।"
যে কথাটা মজা করে বলেছিলেন তা যে এত তাড়াতাড়ি সত্যি হবে ঠিক ভাবেননি সুলতা।
রোশনী ওর মাকে নিয়েই একদিন ওদের বাড়ি এলো।সুলতা শুনলেন ওদের বাড়ি সারানো হচ্ছে তাই ওদেরকে ডাকতে পারলেননা তাই নিজেরাই চলে এলেন।
রোশনীই বললো ওর জামাকাপড় বাবলু মানে সুপ্রতিমের সাথে গিয়ে কিনে ফেলবে।আর যদি কিছু কিনতে হয় সেটাও কিনে নিতে পারে। রোশনীর বাবা বছর দুয়েক আগে মারা গেছেন চাকরি করতে করতে তাই চাকরিটা হয়ত ওর হয়ে যাবে তবে এখনো কোন খবর নেই।
ছেলের বিয়ের শপিং নিয়ে সুলতার একটু প্ল্যান ছিলো কিন্তু হলোনা।যাক ওদের পছন্দ হলেই হলো বাদবাকিটা উনি করলেন মানে আত্মীয়স্বজনের গুলো। বিয়েটা আসানসোল থেকেই হলো মানে রোশনীকে ওখানেই যেতে হলো বিয়ের পর।
ছেলের ঘরে যখন তখন ঢুকতে পারেননা সুলতা।তবুও সকালে একবার রোশনীকে ডাকতে গিয়ে দেখলেন ঘর ভর্তি এলোমেলো জামাকাপড়ে। চারিদিকে সব ছড়িয়ে আছে। একবার ভাবলেন গুছিয়ে দেবেন,তার গুছোনো বাতিকের জন্য সুপ্রিয়র কাছেও বকা খান..." লতা এই করে শুধু শুধু খেটে মরো আর পায়ে ব্যথা বাড়াও। থাকনা যেমন আছে,ঠিক গুছিয়ে নেবো।"
" আর গুছিয়েছো,আমি জানিনা আবার।"
তবুও ইতস্ততঃ করে বৌমাকে বলেন.." আমি একটু গুছিয়ে দেবো ঘরটা?"
" না না আমি গুছিয়ে নেবো,ও আসুক দুজনে করে নেবো।"
রোশনী বাবলু চলে গেছে কলকাতায়,আসানসোলে ওদের ঘরটা ফাঁকা। প্রায়দিনই ছেলের সাথে ফোনে কথা হয় বৌমার সাথেও হয় মাঝে মাঝে।তেমন করে আর সুযোগ হলো কোথায় বৌমার সাথে ভালো করে কথা বলার।অষ্টমঙ্গলাতে সেই যে গেলো তারপর থেকে তো কলকাতাতেই আছে।কি বা করবে ছেলের অফিসের চাপ। মাঝে ছেলে এসে একদিন ঘুরে গেলেও বৌমা আসেনি.." তুই একা? রোশনী এলোনা?"
" ও ওর মায়ের কাছে গেছে মা,উনিও তো একা থাকেন।তাই বললো তুমি ওদিকে যাও আমি এদিকে যাই।"
দেখতে দেখতে ছমাস কেটে গেছে সুলতার কলকাতা যাবার ইচ্ছে হলেও সুপ্রিয় বাধা দিয়েছেন," ওদের নতুন বিয়ে হয়েছে।এই সময় না যাওয়াই ভালো।"
" একবারও গেলাম না বিয়ের পর প্রায় ছমাস হতে চললো।ওদের সংসারটাও গুছিয়ে দিতে লাগে নাকি?"
" ওরা গুছিয়ে নেবে ওদের সংসার।তোমার ছেলের এখন বিয়ে হয়ে গেছে লতা।একবার ভাবো,তুমি এখন শাশুড়ি। আমরা এবার হরিদ্বার লছমনঝুলা যাবো ঝোলা কাঁধে।"
সুপ্রিয়র কথায় হেসে ফেলে সুলতা তবুও বুকটা একটু চিনচিন করে ওঠে ওর দক্ষিণের খোলা বারান্দার জন্য। কে জানে বারান্দার কোণে শখ করে লাগানো বোগেনভেলিয়া গাছটা কেমন আছে?আগেরবার থোকা থোকা ফুল ফুটেছিলো ঝুলে পড়া ডালটাতে। আর গ্লাসপেন্টিং করা শিশিতে রাখা মানিপ্ল্যান্টের গাছটা কত বড় হয়েছে কে জানে? ওদের শোবার ঘরের লাকি বাম্বু ট্রিটা নিশ্চয় এতদিনে বেশ বড় হয়েছে। সবই তার আর বাবলুর শখে কেনা। রোশনীকে বলতে সঙ্কোচ হয় বাবলুকে মাঝে মাঝে বলেন," হ্যাঁ রে গাছগুলোতে জল দিস তো? ফুল ফুটছে?"
" হ্যাঁ মা সব ঠিক আছে।"
" তোরা কবে আসবি?"
"গত মাসেই তো গিয়েছিলাম রোশনীকে নিয়ে। দেখি এবার হয়ত আমি একা যাবো।"
সেই মাসে বাবলু আসতে পারেনি অস্থির হয়েছেন সুলতা। শুনেছেন রোশনী মা হতে চলেছে,সত্যিই কি যে ভালো লাগছে! খুশি বাড়ির সবাই এবার সুপ্রিয়ই বলেন,"শোনো তুমি একবার গিয়ে ওখানে সপ্তাহ খানেক থেকে এসো। মেয়েটা তেমন কাজ করতে পারেনা।তার ওপর শরীর খারাপ কি জানি কি খাচ্ছে কি করছে?"
" আমি একা যাবো! তা কি করে হয়? তুমি এদিকে কি করে খাবে?"
" ও আমি ছোট ভাইয়ের ঘরে খেয়ে নেবো।"
" না না দুদিন হোক বা একসপ্তাহ হোক দুজনেই যাবো একসাথে।"
রাতে ছেলেকে ফোনে বললেন সে কথা।
" মা অত ব্যস্ত হয়োনা ধীরে সুস্থে এসো।ঠিকই আছে রোশনী কোন সমস্যা নেই।"
" তুই চুপ করতো..কি ভাববে মেয়েটা?এমনিতেই আমি বিয়ের পর থেকে কিছুই করতে পারিনি ওর জন্য। এই সময় একটু দেখতেও যাবোনা।"
সুপ্রিয়ই বুদ্ধি দেন," ছাড়ো তো, একদম সারপ্রাইজ দেবো একদিন।মাছ মাংস সব এখান থেকে নিয়ে যাবো।আর রান্না তো তুমিই করবে চিন্তা কি?"
" সেটাই ভালো, আমি বরং একটু আচার বানিয়ে রাখবো কি বলো। আর একটু কাঁচামিঠে আম এনো তো।"
ওদের ফ্ল্যাটে ঢোকার আগেই রাস্তা থেকে বারান্দাটা দেখা যায়।বাবলু আর সুপ্রিয় কতদিন বলেছে দূর থেকে নাকি দারুণ লাগে টবে টবে সাজানো বারান্দাটা। কতদিন সকালে ওখানে বসে কর্তাগিন্নী রাস্তা দেখতে দেখতে চা খেয়েছেন। আজও তাই প্রথমেই নজর পড়ে বারান্দায় অবাক হয়ে যান সুলতা আধময়লা একটা ভেজা গামছা দলা হয়ে ঝুলছে তার থেকে জল পড়ছে টবে। অনেকগুলো গাছ প্রায় শুকনো তবুও এরমধ্যে বোগেনভেলিয়া গাছটা এখনো আধা শুকনো হয়েও আকাশের দিকে ডালপালা মেলেছে হয়ত একটু আদরের আশায়।
বাবলুটা কি কান্ড করছে আজকাল আর রেখাই বা কোথায়? ও কি আসেনা আজকাল কাজে? বাবলু তো তোয়ালে নিতো।মেলার জায়গাও তো আছে। হাজার প্রশ্ন উঁকি দেয় সুলতার মেয়েলি মনে।
ভোর পাঁচটায় রওনা দিয়েছেন তখন দশটা পেরিয়েছে। কলিংবেল টিপে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়..বাবলু আর বৌমা খুব অবাক হবে বাবা মাকে বোকা বানানো! কেমন সারপ্রাইজ!
দরজাটা খুলে যায়,একটু অবাক হন সুলতা প্রথমে হাউসকোট পরা রোশনীর মাকে ঠিক বুজতে পারেননি। তারপরেই সামলে বলেন," ও দিদি আপনি? ওরা কোথায়?"
" আছে আছে বসুন,আমি ডেকে দিচ্ছি বোধহয় বাথরুমে গেছে।"
সুপ্রিয় আর সুলতা দেখেন দুই ঘরের পর্দা টানটান করে টানা। আজ যেন সুলতার পায়ে একটা আড়ষ্ট ভাব স্বচ্ছন্দ্য পায়ে নিজের ঘরে ঢুকতে পারছেননা আগের মত।কয়েকমাসে কেমন যেন অচেনা হয়ে গেছে তার দক্ষিণের খোলা বারান্দাটা।জিনিসপত্র নিয়ে সোফায় বসেন দুজনে রোশনীর মা একটু সংকুচিত হয়েছেন বোধহয় হঠাৎই বিয়াই বিয়ানকে দেখে তাই একটু আসছি দিদি বলে ঢুকে যান ওদের শোবার ঘরে ততক্ষণে সুলতার চোখ ঘুরছে,টেবিল ভর্তি জিনিস। ফুল সাজানোর কাঁচের বাটিতে কিছু শিশি বোতল রাখা। মানিপ্ল্যান্টের গাছটা নেই শিশিটার পাশে বিস্কুটের কোটো আর আপেল রাখা। একটা বেতের মোড়ার ওপর কিছু জামাকাপড় রাখা।
ততক্ষণে বাবলু ঘর থেকে বেরিয়েছে.." কালই তো কথা হলো,কিছু বললেনা তো? একবার বলতে পারতে আমরা একটু তৈরী হয়ে থাকতে পারতাম।"
" নিজেদের বাড়ি আসবো তা এতো তৈরী হওয়ার কি আছে? চলে এলাম হঠাৎই সারপ্রাইজ দেবো বলে। তা বৌমা কোথায়?"
" আসছে মা আসলে কাল রাতে ওর শরীরটা ভালো ছিলোনা তাই।"
" একটু বাথরুমে যাবো রে বাবু,অনেকক্ষণ বেরিয়েছি তো।"
" যাওনা মা এমন করছো যেন সব তোমার অচেনা।"
এতক্ষণে নিজের ঘরে আসেন সুলতা,বড় অপরিচিত আর অগোছালো ঘর আর বাথরুম। বুঝলেন এই ঘর আর তার নেই। বা সবই হয়ত আছে কিন্তু..কি যে ভাবছেন এইসব বাবলুর জন্যই তো কেনা হয়েছিলো ফ্ল্যাটটা।এটাই তো নিয়ম নিজের জিনিস একদিন তো ছেড়ে দিতেই হয়। একটা দুটো দিন থেকেই চলে যাবেন। কি দরকার মন খারাপে। ততক্ষণে সুপ্রিয় আর বাবলুও ঘরে ঢুকেছে। "মা আমি বিছানাটা ঠিক করে দিচ্ছি।আসলে রোশনীর শরীর ভালো নয় তাই উনি এসেছেন।তোমরা এই ঘরে থেকো রোশনী কদিন মায়ের কাছে শোবে।আমি ডাইনিংয়ে শুয়ে যাবো।"
সুপ্রিয় হাসেন,বলেন সুলতাও.." মা মেয়ের কাছে আসবে এতে বলার কি আছে। আর আমরাও চলে যাবো দুদিন বাদেই। ঘরে থাকবেননা তো যাবেন কোথায় উনি? হ্যাঁ রে রেখা আসেনা? একটু ঘরদোর পরিস্কারও করেনা।বৌমার শরীর খারাপ।"
বাবলু বলতে পারেনা রেখাদিকে রোশনী সহ্য করতে পারতোনা মাতব্বরি করতো বলে তাই ছাড়িয়ে দিয়েছে। শুধু বলে," কাজ ছেড়ে দিয়েছে মা।এখন অন্য একজন করছে দায়সারা করে আর কি?"
রান্নাঘরে ঢুকতে গিয়ে সুলতা বাধা পায় বাধা দেয় রোশনীই," এই তো অতটা জার্নি করে এসেছেন কি দরকার রান্না করার? একটু বিশ্রাম করুন,বাড়িতে তো করেন সবসময়।"
" ও আমার অভ্যেস আছে।মাছ আনলাম তোমাকে খাওয়াবো বলে আর গাছের এঁচোড় বাবলু ভালোবাসে। কেটেই এনেছি।"
" আমি ঝালমশলা খেতে পারছিনা।একটু বাদে রান্নার লোক আসবে ওকে বলে দেবেন ভালোই করে। আর যা করবে তাই খেতে হবে।"
সুলতার বড় পছন্দের জায়গা,কত শখ করে মডুলার কিচেন করিয়েছিলেন। ছেলেকে পছন্দমত রান্না করে খাইয়ে কত তৃপ্তি পেতেন। আজ বুঝলেন সেখানে অনুমতি ছাড়া তার প্রবেশ নিষেধ। বাবলুটা দুদিন ধরে ডাইনিংয়ে শুচ্ছে।অনেক বলেছিলেন সুলতা," আমরা শুই ডাইনিংয়ে।" গম্ভীর হয়ে রোশনী বলেছিলো," তা কি করে হয়,দুদিনের জন্য এসে বাইরে শোবেন তা কি করে হয়।আমাদের খারাপ লাগবে।"
সুলতা জিনিসগুলো রোশনীর হাতে দিয়ে বলেছিলেন আস্তে আস্তে করে খেয়ো বাবলু ভালোবাসে।আর এইগুলো তোমার জন্য। একসপ্তাহ থাকবো মনে মনে ভেবে এলেও দুদিন বাদেই চলে এলেন।
সাধের অনুষ্ঠান ছাড়া আর তেমন ভাবে দেখা হয়নি রোশনীর সাথে। আর যাননি ফ্ল্যাটে শুধু মাঝে মাঝে মনে হত বোগেনভেলিয়া গাছটার কথা। বাড়ি এসে কেন যেন কেঁদেছিলেন সুলতা,ছেড়ে দেবেন ভাবলেও কেন যেন কিছু জিনিস ছাড়তে বড় বুকে বাজে মায়েদের। মাঝে সুপ্রিয় হরিদ্বার নিয়ে গিয়েছিলেন সুলতাকে। "এবার একটু সংসার ধর্ম ছেড়ে ভগবানে মন দাও।ঠাকুমা হবে এবার লতা সে চিন্তা আছে।"
সত্যিই তো ঠাকুমা হলেন একদম ফুটফুটে নাতনি এলো ঘরে। আবার ছুটে গেলেন সব ভুলে,দেখলেন ছোট ছোট কত জামাকাপড় ঝুলছে বারান্দায় তার মাঝেই উঁকি দিয়েছে বোগেনভেলিয়া একগুচ্ছ ফুল নিয়ে। রোশনীর মা এখন পুরোপুরি ওদের কাছেই থাকেন সত্যিই তো অতটুকু বাচ্চা সামলানো একা কি করে পারবে মেয়েটা। বাবলুর কাছে শুনলো উনারও মাঝে শরীর খারাপ হয়েছিলো।
" আমি কি তাহলে কদিন থেকে যাবো? তোর বাবা বরং চলে যাক।"
" না মা লোক আছে তো,তাছাড়া ওখানকার বাড়িও তো দেখতে হবে তোমাকে।"
দুদিন থেকে সুলতার মনে হলো তার থেকে মায়ের যত্নের ওপর ভরসা অনেক বেশি রোশনীর। হয়ত সেটাই স্বাভাবিক।ছোট্ট মুখটা সবসময় ভাসতো চোখে সুলতার।এবার আর মন মানতোনা মাঝে মাঝেই মন কেমন করলেই ছুটে আসতেন মাঝে মাঝেই আবার দুএকদিন থেকেই চলে আসা হয়ত বা রোশনীর শীতল ব্যবহার উপেক্ষা করেই।
এর মাঝেই রোশনী চাকরি পেয়েছে,বাবার চাকরিটা। পরিস্কারই বলে বাবলুকে," শোনো বাবার চাকরি করবো মাকে দেখবোনা তা তো হয়না। মাকে আমাকে দেখতেই হবে।"
" নিশ্চয় দেখতে হবে আমি সবসময় চেষ্টা করি সবদিকে ব্যালেন্স করে চলতে।"
" তা তো চলতেই হবে মা আ্যটলিস্ট ডিজার্ভ করে এটা।"
" কেন তোমার কি মনে হয় আমি খারাপ ব্যবহার করি?"
" তা না তোমার মায়ের হয়ত মনে হয় ছেলের বাড়িতে তার অধিকার কমে যাচ্ছে।"
" মা কি এমন কথা কখনো বলেছে?"
" সব কি বলতে হয়? আমি বুঝিনা। বাবলু এটা ভালোবাসে ওটা ভালোবাসে।আমি কি জানিনা তুমি কি ভালোবাসো?"
" শুধু মনে এত অভিযোগ পুষে কষ্ট পাচ্ছো।"
" শুধু নয়, আমার মনে হয় আমার মা এখানে থাকে বলে ওনাদের অসুবিধা হয়। আসলে অধিকারের প্রশ্ন তো।"
" কিসের অধিকার?ফ্ল্যাট তো বাবার টাকাতেই কেনা।"
হঠাৎই খুব রেগে যায় রোশনী.." তাহলে আমি টাকা জমিয়ে নতুন ফ্ল্যাট কিনে সেখানে মাকে নিয়ে চলে যাবো।"
রোশনীকে কাছে টেনে নেয় বাবলু," এত জেদ ভালো নয়।আর কখনো বোলোনা।সবাই মিলেমিশে থাকাতেই আনন্দ।"
রোশনীর আলাদা ফ্ল্যাটে যাওয়া আর হোলোনা হঠাৎই ওর মা চলে গেলেন মেয়ের বয়েস তখন মাত্র দুবছর। অস্থির হয়ে গেলেন সুলতা.." বৌমার হসপিটালের ডিউটি বেশ অনেকদূরে। আমরা কি এসে থাকবো দিদিভাইকে কে দেখবে।"
বাবলু রোশনীকে বলতেই.." হ্যাঁ আমার মা চলে গেছে ব্যাস শান্তি। এবার দিদিভাইকে কে দেখবে মনে হয়েছে। লোকের কাছেই থাকবে মেয়ে।"
আশ্চর্য হয়ে যায় বাবলু এটা কি রোশনীর জেদ না অভিমান কিছুই বোঝেনা। তেমনভাবে মায়ের কাছাকাছি যেন কোনদিন হতে পারলোনা। মা কি কোনভাবে কোনো ক্ষোভ প্রকাশ করেছে? নাকি রোশনীর একতরফা অপরাধবোধ। ঠিকই তো ওর মাকে তো ওকেই দেখতে হবে। কি জানি কেন যে ওকেও একটা দোটানায় রাখলো, হয়ত কষ্ট পেলো মা বাবাও।
সারা পৃথিবী জুড়ে এক মহামারীর প্রকোপ সবাই গৃহবন্দী। মা বাবা খুব চিন্তায় থাকে সব সময় ফোন করছে কে কেমন আছে। হঠাৎই খবর দেয় রোশনী.." মালতীদি আর আসতে পারবেনা বলেছে। ওদের পাড়া থেকে আ্যলাউ করছেনা।আমারও টানা অনেকদিন এমার্জেন্সী ডিউটি এখন কি হবে? সোনাইকে কে দেখবে? তুমি পারবে তো? আমার কিছু মাথা কাজ করছেনা।"
" আমাকেও তো ব্যাঙ্কে যেতে হবে রোশনী,কি করবো আমি? কতদিন ছুটি নেবো?"
" ইশ্ এই সময় যদি মা থাকতো! কেন যে এত তাড়াতাড়ি মা চলে গেলো।"
কান্নায় ভেঙে পড়ে রোশনী মেয়েকে কোলে নিয়ে।
" তোমার ডিউটি কি কোনভাবেই আটকানো যায়না?"
" আমার নতুন চাকরি,তাছাড়া এখন কেউ কিছু শুনছেনা।"
" আচ্ছা মা বাবাকে বলবো আসতে? কিন্তু ওরাই বা কি করে আসবে লক ডাউনে?"
" আমি কিচ্ছু জানিনা যা হয় করো।"
ছেলের ফোন করে দিশাহারা লাগে সুপ্রিয়র আসলের থেকে বোধহয় সুদের দাম বেশি।
সারাদিন চেষ্টা করে অনুমতিপত্র জোগাড় করে গাড়ি নিয়ে বেরোন সুপ্রিয় সাথে সুলতা। পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় দুপুর পার হয়ে যায়। আজ নীলের উপোশ সারাদিন খাওয়া পুজো কিছুই হয়নি সুলতার। রোশনী বিকেলে বেরোবে ওর নাইট আছে পরপর চলবে। সুলতা স্নান করে পুজো করলেন,মোমবাতি উপকরণ কিছুই তেমন নেই। একটা প্রদীপ ধরিয়ে ঠাকুরকে দেখিয়ে হাত জোড় করে বলেন সব অসুস্থতা ধুয়ে মুছে দাও ঠাকুর। প্রদীপের শিখা হাতে করে ছেলে,বৌমা আর নাতনীর মাথায় ঠেকান। " মা আমাকেও!"
" কেন আমি তোমার মা না? শাশুড়িমা,তাও মা তো? সব বিপদ জয় করে সুস্থ শরীরে ঘরে ফিরে এসো। দিদিভাইকে আমরা আগলে রাখবো।"
" আমি মা মরা ছেলে তুমি বিশ্বজননী আমাকেও একটু প্রদীপের শিখা মাথায় দাও।"
সুপ্রিয় মজা করে মাথাটা এগিয়ে দেন। প্রদীপের থালাটা রোশনীর হাতে দিয়ে ইশারা করেন সুলতা। রোশনী আলতো ছোঁয়ায় মাখায় প্রদীপের শিখা।
" মা থাকতে মা মরা ছেলে হবে কেনো শুনি? মায়েরা কখনো সন্তানদের ছেড়ে যাননা।আমাদের কাছাকাছি থাকেন আর আগলে রাখেন শুধু খুঁজে নিতে হয়।"
সবারই কি মনটা আজ কেমন যেন ভিজে গেলো।তবে রোশনীর চোখটা জ্বালা করলো এই ভেবে সব ঠিক হয়ে যাবে।
সোনাইকে কোলে নিয়ে দক্ষিণের বারান্দায় বসে আছেন সুপ্রিয়।আস্তে আস্তে বোগেনভেলিয়া গাছের শুকনো পাতাগুলো তুলে ফেলছেন সুলতা। অভিমানের শুকনো পাতাগুলো ঝরে পড়েছে আজ যত্নের আদরে, আবার কোন এক নতুন ভোরে থোকা থোকা ফুল ফুটবে।বোগেনভেলিয়া গাছটার মত হয়ত পৃথিবীও হাসবে একদিন ঝড়ের শেষে।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment