কঠিন_পরীক্ষা
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
আজকাল মাঝে মধ্যে মনে হয় আমি ডাক্তারের মা না আর্মির মা?একবার বেড়াতে গিয়ে একটু মন কষাকষি প্রথমে তারপর রীতিমতো ঝগড়া আর মনান্তর হয়ে গেলো আমাদের এক বন্ধুর সঙ্গে শুধুমাত্র ঐ পেশাগত তর্কে। আমি ছেলেকেই শাসন করলাম বকলাম তবুও প্রথমটা থামাতে পারলাম না। শেষ পর্যন্ত সম্পর্ক বাঁচাতে আমি ক্ষমাও চেয়েছি তাদের কাছে ছেলের হয়ে। আসলে আমি সম্পর্ককে হয়ত জীবনে একটু বেশিই গুরুত্ব দিই।
ছোট থেকে কখনোই ছেলেমেয়ের প্রশংসা মানুষের কাছে করতে আমি অভ্যস্ত নই।মানে আমার ছেলে অমুক আমার ছেলে তমুক সবসময় পরীক্ষাতে একশো পেয়েছে।অবশ্য আমার ছেলেমেয়ে কখনোই অত ভালো ছিলোনা
পড়াশোনাতে চিরকালই মিডিওকার বা কোন সময় বেশ খারাপ তবে যেটুকু যা করেছে নিজেদের চেষ্টায়। আমার ছেলে বরাবরই সরকারী স্কুলে পড়েছে।তারপর সরকারী মেডিক্যাল কলেজে এখন পিজিটি করছে তাও সরকারী কলেজ থেকে। ওদেরকে সবসময়ই বলেছি লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে সন্তান মানুষ করার বা ডিগ্ৰী কেনার ক্ষমতা আমার নেই। হয়ত সেটা ওরাও ভেবেছে।
আমি দুই সন্তান চাকরি যৌথ পরিবারের কূটনীতি আর ঝামেলা সামলে ওদেরকে তেমন সময় দিতে পারিনি একটা সময়ে। তবে ওরাই ছিলো আমার অবসরের সঙ্গী।
কখনো বা নিজের স্ট্রেসে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কড়া হয়ে গেছি। তবুও ওরা নিজেদের আকাশে কখনো রোদ্দুর আর মেঘলা দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেছে। এখন মাঝে মাঝে ভাবি কোথা থেকে এতোগুলো দিন কাটালাম। ছেলের জয়েন্টের রেজাল্টের পর যাদবপুরে আর মেডিক্যালে দুটোতেই সুযোগ পাওয়ার পর কি করবো বুঝতে পারিনি।সবাই বলেছিলো এত ভালো করেছে তোমার মুখ এত শুকনো কেন?
কোথায় যেন এক অস্বস্তি কুড়ে খেয়েছিলো অথচ বাধ্য ছেলেটা অদ্ভুতভাবে চলে এসেছিলো মেডিক্যাল লাইনে বলেছিলো আমি সব পারবো। কিন্তু আমার যেন মনে হয়েছিলো কোথাও কি স্বপ্নেরা আঘাত পেলো?
তবে ওর বাবা সবসময় এক কথাই বললো এই সুযোগ বারবার আসবেনা জীবনে। হয়ত বা মেনে নিলো সবার ইচ্ছে,মানিয়ে নিলো নিজেকে।আমার বান্ধবী যার ছেলে প্রাইভেট কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে আমায় বললো,"ছেলেকে ডাক্তারি পড়াচ্ছিস! আজকাল ডাক্তারি কেউ পড়েনা।" তখন হাসি পেয়েছিলো শুনে পরে বুঝেছিলাম ছেলেকে ডাক্তার করতে গিয়ে খাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছি তাকে।তারপর চললো জীবন প্রতিনিয়ত এক সমস্যার মুখোমুখি হয়ে।তবে কখনোই আমার অশান্তি বাড়ায়নি ছেলে অদ্ভুতভাবে নিজের চাপটা নিজে নিয়েছে।
আমার মেয়ে আবার উল্টো এইটুকু সমস্যাকে অনেকটা করে মায়ের কাছে উপস্থিত করে কেঁদেকেটে একসা হয়।মাঝে মাঝে নিজেরই খারাপ লাগে বকুনি খায়।বলি বড় হয়েছিস একটু বুদ্ধি করে চল এতো অধৈর্য্য হলে হবে?
ছেলেকে ডাক্তার করতে গিয়ে দেখলাম সংবাদের শিরোনামে প্রত্যেকদিন ডাক্তারদের অপকর্ম নিয়ে কথা।ডাক্তারদের হেনস্থা চলছে,কখনো তাদের গালে পটি মাখিয়ে দেওয়া,কোথাও চোখ উপড়ে নেওয়া।কখনো মাথার খুলি ফাটানো পাথর মেরে আবার কোথাও একদম হাত পা ভেঙে প্রাণে মেরে দেওয়া। এছাড়া মামলা মোকদ্দমা,ভাঙচুর,রোগীর বাড়ির লোকের হাতে মার খাওয়া এই সব তো আছেই। প্রত্যেকটা দিন জঘন্য অত্যাচারের সাক্ষী হতে হতে একরাশ ক্লান্তি বুকে নিয়ে ছেলের দুশ্চিন্তায় রাত জেগেছি আমি প্রতিনিয়ত। জানিনা কোনদিন ছেলেটার সুখ হয়ত দেখতে পাবো কিনা আমার জীবনে।
সফলতা এসেছে প্রতিটা পরীক্ষায়,তাতেও নিশ্চিন্ত হতে পারিনি,আনন্দ পাইনি তেমনভাবে। মনে হয়েছে ওর এই দুর্ভাগ্যের জন্য কোথাও আমরা দায়ী।যেখানে ওর বন্ধুবান্ধব বা জুনিয়র জার্মানি বা ইউ এসএ তে বড় গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে স্টেটাস দিচ্ছে সেখানে আমার ছেলে সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে আটচল্লিশ ঘন্টা ডিউটি করছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। বিনিময়ে প্রাপ্তি ডাক্তাররা পিশাচ,অথবা বদমায়েশ।জীবনে যাদের এত স্ট্রেস তাদের পাশে কি কেউ থাকে?বোধহয় কেউ থাকেনা। যেমন আমিও থাকতে পারছিনা আমার আদরের যোদ্ধার পাশে।
আজ জীবনের যুদ্ধে এক মহামারী রোগের বিরুদ্ধে ওর লড়াই একা দাঁড়িয়ে কিছু অসুস্থ মানুষকে বাঁচাতে। বড় ভারী মন নিয়ে একটাই প্রার্থনা জীবন যুদ্ধে জয়ী হয়ে অন্যের পাশে থেকে তাকে সুস্থ করে নিজেও যেন ফিরতে পারে সুস্থ শরীরে। তবুও হায় ভগবান! আমার আদরের সন্তানকে ছোঁয়ার আগে অশুচি থেকে শুচি করে নিতে হবে আমায়,এ যে বড় কঠিন পরীক্ষা।
Comments
Post a Comment