Skip to main content

ছোট্ট স্বপ্ন

#ছোট্ট_স্বপ্ন#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

দুশো এক বেড নম্বরের কাছে এসে দাঁড়ায় অনন্যা,কাল যখন ও এসেছিলো তখনও কথা বলছিলো বৌটা। সারারাত খুব কষ্ট পেয়েছে,মনিটরিং চলছে।দেখা যাচ্ছে অক্সিজেন স‍্যাচুরেশন কমে যাচ্ছে তাই অবশেষে ভেন্টিলেটরে দেওয়া হয়েছে।
  অমিতদা আ্যনেস্থেসিস্ট এই ব‍্যাপারে খুব স্কিলড। ওর থেকে সিনিয়র তাই এক্সপিরিয়েন্স বেশি। অনন‍্যা গিয়ে অমিতদার পাশে দাঁড়ায়.." ওকে একটু স্পেশাল কেয়ার নিয়ে দেখো অমিতদা।তুমি তো ভালো বুঝতে পারো ব‍্যাপারগুলো।"
  " চেষ্টা করছিরে যতটা সম্ভব।তুই অত ভাবিসনা। এরা সবাই আমাদের কাছে সমান। দুশো তিনের পেশেন্টও তো ভালো না। সমানে হাঁফাচ্ছে,শ্বাসকষ্ট খুবই বেড়েছে।যদিও বয়স্ক,সাতাশি বছর বয়েস।"
       " তবুও তুমি দুশো এককে একটু ভালো করে দেখো প্লিজ অমিতদা।ওর একটা বাচ্চা হয়েছে এই সবে দুদিন আগে। ইনকিউবেটরে আছে বাচ্চাটা। ওর বেঁচে থাকাটা খুব জরুরী।"
              " জানি রে, তবে শুনলাম বাচ্চাটার রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। তবে পেশেন্ট পার্টি হাওয়া হয়ে গেছে মায়ের করোনা হয়েছে শুনে।কেউ নিয়ে যায়নি বাচ্চাটাকে।"
                   সারারাত নাইট ডিউটিতে নিজের কষ্টের থেকেও যেন বেশি ছুঁয়ে গেছে অসহায় মানুষগুলোর কষ্ট অনন্যাকে। সত‍্যিই কি অসহায় মানুষ এই মারণ রোগের কাছে। আত্মীয় পরিজনবিহীন হয়ে এ যেন এক অন্তহীন অপেক্ষা জীবন মৃত‍্যুর মাঝে দাঁড়িয়ে।দুশো একের পেশেন্ট মেয়েটার বয়েস কত হবে? এর মধ‍্যে দুটো মেয়ে হয়ে গেছে। হয়ত এবারও শ্বশুরবাড়ির আশা পূরণ করতে পারেনি তারপর আবার ছোঁয়াচ রোগের কবলে পড়েছে।কে জানে বাঁচবে কি না? আর বাচ্চাটা,তার কি হবে? ওকেও বাতিলের খাতায় ফেলে চলে গেছে বাড়ির লোকজন।
            ভোরের দিকে চোখটা একটু লেগে গিয়েছিলো অনন‍্যার। অমিতদা ডাকেন.." ঘাড়ে লাগবে রে,সময় হয়ে আসছে প্রায় পাঁচটা আর একঘন্টা বাদেই শিফ্ট শেষ হবে।"
                অমিতদা ব্লাড টানছে,পাশে দাঁড়ায় অনন‍্যা। ওরা ভালো নেই,অনেকেই ভালো নেই।কে জানে কাল এসে কজনকে দেখতে পাবে মানে খরচের খাতায় চলে যাওয়া মানুষগুলো একদমই খরচ হয়ে যাবে? তবুও যেন ভালো হয়ে ওঠে ওরা,বাড়ি ফিরে যেতে পারে আপনজনের কাছে।
                       সারা রাতের ক্লান্তি নিয়ে অবসন্ন অনন‍্যা চেঞ্জরুমে এসে পিপিই চেঞ্জ করে হোটেলে ফেরার জন‍্য তৈরি হয়। কদিনের আশ্রয় এখন এটাই। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বাস এলো,বাসে উঠেই দুটো ফোন করলো একটা মাকে আর একটা অনিকে। " আমি ফিরছি ডিউটি শেষ।তোমরা ভালো থেকো।এখন খুব টায়ার্ড লাগছে পরে কথা বলবো।"
               দুবছর হলো ওর বিয়ে হয়েছে,শ্বশুরবাড়ি দুর্গাপুরে।অনিরুদ্ধও ডাক্তার,ওর সিনিয়র ছিলো।দুর্গাপুরেই হসপিটালে আছে। অনন্যা পিজিটি করছে। হয়ত আগের বছরই হয়ে যেতো,পরীক্ষায় বসতেই পারেনি অসুস্থতার জন‍্য।
             হোটেলে এসে প্রথমেই বাথরুমে ঢুকে সারা শরীর জীবাণুমুক্তর কাজে লেগে পড়ে অনন‍্যা। অনেকক্ষণ জল না খাওয়া,টয়লেট আটকে রাখা তাই প্রতিদিনই অদ্ভুত একটা শরীর খারাপ লাগে।
             কিছুক্ষণ একদম লম্বা হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকে,কিছু ভালো লাগেনা। আবার কাল যেতে হবে।
                  পরেরদিন এসেই গলাটা বুজে আসে মেয়েটা নেই,আর পারেনি যুদ্ধ করতে চলে গেছে হার স্বীকার করে চিরশান্তির দেশে। যথারীতি নিজের কাজ শেষ করে আবার সেদিনের মত বুকচাপা কষ্ট নিয়ে।

    ****************
                           অনন‍্যার ডিউটি শেষ হয়ে গেছে,ওর সেল্ফ কোয়ারেন্টাইনে থাকার মেয়াদ শেষ করে আবার ডিউটিতে এসেছে আউটডোরে। বাচ্চাটাকে কেউ নিয়ে যায়নি এখনো,এখানেই রয়ে গেছে। এক অন্ধকার পৃথিবীতে পা রেখেছে জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই যেখানে অনাদৃত হয়ত বা অনাহূত যে এখনো কেউ ওকে দাবী করেনি।বাড়িও নিয়ে যায়নি। অনন‍্যা বাচ্চাটার কাছে এসে দাঁড়ায়,কেমন নিশ্চিন্তে হাত পা নাড়াচ্ছে আনন্দে। ওর নিষ্পাপ মুখটা কিছুক্ষণের জন‍্য দেখে ভুলে যায় পৃথিবীর অসুখের কথাও।
             মনে মনে একটা ছোট্ট আশার গল্প সাজিয়ে নেয় অনন‍্যা। মা হওয়া ওর হবেনা টিউমার অপারেশনের পর সেই আশা ওরা ছেড়ে দিয়েছে। অনি মজা করে বলেছিলো," তুই সারাদিন বাড়ি থাকিসনা ডাক্তারি করিস। আমিও তাই সারাদিন অপারেশন করি। কে দেখতো বাচ্চা হলে বলতো? তার থেকে এই ভালো মানুষের পাশে আছি। কত মাকে বাবাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি তাদের সন্তানের কাছে। আবার সন্তানকে ফিরিয়ে দিচ্ছি তাদের মা বাবার কাছে।"
        " কেঁদে ফেলেছিলো অনন‍্যা কিন্তু তোমার মা বাবা কি বলবে? আমিও তো চেয়েছিলাম মা হতে।"
         "তাতে কি? এই তো কত বাচ্চা তোর হাত দিয়ে পৃথিবীর আলো দেখবে সেটাই বা কি কম বলতো?"
                  আচ্ছা এই অনাদৃত বাচ্চাটাকে যদি ও আদর করে কাছে টেনে যশোদার মত মাতৃত্বে বড় করতে পারে তাহলে হয়ত আদরে যত্নে একটা প্রাণ বেড়ে উঠবে। কি সুন্দর মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে আছে ওর নিষ্পাপ মুখটাতে।ওর মায়ের মুখটা খুব মনে পড়ে অনন‍্যার খুব শ্বাসকষ্টের মধ‍্যেও যেন বার বার হাত বাড়িয়ে খুঁজছিলো সন্তানকে। হয়ত স্তন‍্যপান করাতে চাইছিলো সদ‍্যোজাত বাচ্চাটাকে।
           অনিকে ফোন করে," শোনো না আমি যদি একটা সিরিয়াস কিছু ভেবে ফেলি বাচ্চাটার ব‍্যাপারে তুমি সাথে থাকবে তো?"
                   " আমার ভালোমানুষ পাগলী বৌটাকে তো আমি চিনি,কি বলবি আমি জানি..ঐ বাচ্চাটার বাবা বানাতে চাইছিস নিশ্চয়।
এই স্টেথো হাতে নিয়ে প্রমিস করছি সাথে আছি সবসময়।"
                কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলো অনন‍্যা কিছুক্ষণের জন‍্য ভুলেই গেছিলো অসুখটার কথা। ওদিক থেকে মেসেজ আসে.."কি রে কি হলো? শরীর আর মনকে যত্নে রাখিস যুদ্ধটা যদিও বড় তবুও আমরা জিতবোই।"
                    চোখটা বড় ভেজা লাগে একবার মুছলে ভালো হত,কিন্তু পিপিই পরা যে। স্ক্রীনে টাইপ করে...মিস্ ইউ অনি।©রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী
ভালো লাগলে নামসহ শেয়ার করুন।

সমাপ্ত:-

                    

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...