#জীবনসুধা#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
ব্রেস্টফিড করায় যত্নে বুকের কাছে নিয়ে ছোট্ট সোহাকে সোফিয়া। মনে মনে বলে ভালো করে খেয়ে নে সোনা আমার।কতক্ষণ তোকে এভাবে কাছে পাবোনা। ও যতক্ষণ বাড়িতে থাকে সোহাকে আর অন্য কিছু খাওয়াতে হয়না।পরিতৃপ্ত সোহা ঘুমিয়ে পড়ে ওর কোলে মায়ের জামাটা মুঠো করে ধরে পরম নির্ভরতায়। আস্তে আস্তে ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে শাশুড়িমাকে ডাকে," ও ঘুমিয়ে গেছে,ভালো হয়েছে এবার তো আমাকে বেরোতে হবে মা। সময় হয়ে আসছে,একটু বাদেই গাড়ি আসবে আমার জন্য।"
" তোর ছুটিটা দিলোনা ওরা? বললিনা বাচ্চাটা ছোট এই সময় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ডিউটি করবি। কি হয় কেউ বলতে পারে?"
"অত ভেবোনা মা কিছু হবেনা,সবাই কাজ করছে। তোমার ছেলে বাড়িতে বসে এখন কোম্পানী বন্ধ ।আমার নতুন চাকরি এখন যদি বসিয়ে দেয় তো চলবে?"
নিজের পোশাক পরতে পরতে মেয়ের দিকে তাকায়।আবার কখন ফিরবে কে জানে? সরকারী উর্দি পরার এখন অনেক চাপ আছে।প্রতিদিন ঝামেলা হচ্ছে,সামলাতে হচ্ছে।
সোফিয়া বাঙালী খ্রীষ্টান বাপের বাড়ি কলকাতার কাছাকাছি। বিয়ে হয়ে এসেছে বিহার ইউপির বর্ডারে,এখানেই চাকরি পেয়েছে। এখন ঘুরে ঘুরে ডিউটি করতে হচ্ছে নানা জায়গায়। প্রচন্ড কাজের চাপ,তারমধ্যে ছোট বাচ্চা। লকডাউনে প্রতিদিন কত মানুষ আসছে পায়ে হেঁটে বাড়ির টানে তাদের কন্ট্রোল করা।নতুন যারা আসছে তাদের শিবিরে রাখা।যেদিন যেমন ডিউটি পড়ছে।
কতদিন বাপের বাড়িতে যায়নি সোফিয়া,ঐ যেটুকু ফোনে কথা হয়। এই পরিস্থিতিতে কে জানে কেমন আছে ওরা?
বাইরে জানলার কাছে পাখিগুলো এসে কিচমিচ করছে।সোহা দেখলে খুশি হয় ওদের হাত নাড়ে। গাছে ঘেরা সবুজের মাঝে ওর কোয়ার্টার,ওখানেই শ্বশুর,শাশুড়ি আর স্বামী নিয়ে ওর সংসার। কিছুদিন হলো ছোট সোহার মিঠে মিঠে বোলে ভরেছে ওদের কোয়ার্টারের ঘর দুটো। ওকে রেখে বেরোতেই ইচ্ছে করেনা তবুও চাকরিটা যে রাখতেই হবে।
বাইরে থেকে গাড়ির আওয়াজ পায় সোফিয়া,জিপের হর্ণটা শুনে টুপিটা হাতে নিয়ে সোহার দিকে একবার তাকিয়ে রওনা দেয়। অঙ্কিত হাতে টিফিনের কৌটোটা ধরিয়ে দিয়ে বলে," আপনা খেয়াল রাখনা।"
অঙ্কিত ভাঙা ভাঙা হিন্দী বাংলা মিশিয়ে কথা বলে। সোফিয়া গলার ক্রশটা কপালে আর গালে ঠেকায়।মনে মনে বলে..সবাইকে রক্ষা করো প্রভু।
..." আরে মাস্ক তো লেকে যা। সত্যিই মেয়েটা একটা পাগলী আছে। সব জিনিস হাতে হাতে দিতে হয়।"
" ব্যাগে এক্সট্রা আছে মা। হাত ধো লেনা আচ্ছেসে।"
শ্বশুরমশাই বারান্দায় চেয়ারে বসে খবরের কাগজে চোখ রেখেছেন। আরেকবার হাত নেড়ে সবাইকে বাই করে ছোট্ট পায়ে হাঁটা পথটুকু পেরিয়ে জিপে ওঠে সোফিয়া।
কিছুক্ষণ বাদেই ওদের গাড়ি অনেকটা এগিয়ে যায়।আর ওদের কোয়ার্টার দেখা যায়না তবুও মায়ের মনটাতে বারবার ভেসে ওঠে ছোট্ট মেয়ের মুখটা।
বার বার লকডাউনে বেরোতে বারণ করলেও কত মানুষ রাস্তায় ঘুরছে। ডিউটি দিতে দিতে প্রতিদিন এইভাবে কত বাইক আর গাড়ি আটকাতে হয়।কত মানুষকে ঘরে পাঠাতে হয় জোর করে।শিউলাল ডান্ডাটা নিয়ে এগিয়ে আসে। ওর কাজ লাঠিপেটা করে সহবত শেখানো।
" আরে পহেলে তো বাত করো ভাই।ফির ডান্ডা।"
" ম্যাডামজি ইয়ে হ্যয় এইসা বাতো সে থোড়া মানেগা?"
সেদিনই ভিডিওতে দেখে নিজে পুলিশ হয়েও কেন যেন মনটা ভিজে গেছিলো সোফিয়ার একবারও মনে হয়নি কাজটা ঠিক হয়েছে। কত মানুষেরই তো কামকাজ নেই তারা যদি একটু সব্জী নিয়ে ফেরি করে দিন গুজরান করে পুলিশ গাড়ি উল্টে ফেলে দেবে?
কে জানে একটা রোগ যে দেশ আর দেশের মানুষ গুলোকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কে জানে?
মানুষ রোদ জল মানছেনা তারা ভুখা পেটে ছুটছে শুধু পায়ের জোরেই ঘরের টানে। মরছে রাস্তায় কত মানুষ,রোগের আগেই ভুখে আর হেঁটে হেঁটেই মরছে। পেটের জন্য আর ঘরে ফেরার জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছে মানুষ। মানছেনা কোন বাধাই।
ডিউটি করতে করতে শাশুজিকে ফোন করে সোফিয়া," সোহা জেগেছে মা? দুধ খেয়েছে? কাঁদছে না তো?"
" আরে না রে ঠিক আছে,এই তো তোর বাবুজীর গদীতে বসে খেলছে আর চিড়িয়াকে আ আ করছে।"
..."ম্যাডামজি, দেখিয়ে এক লরী আ রহা হ্যায়।" শিউলালের ডাকে ফোনটা রেখে তাকায় সোফিয়া।
" রোকো,চেক করো পহেলে।"
ওরা হাত দেখাতেই লরীটা থেমে যায়।
উঁকি মারে সোফিয়া একি গাড়ি ভর্তি লোক।এটা কি সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং হচ্ছে! কোথায় যাচ্ছে এরা লকডাউনে?
"উতরো,উতরো,কাহা যা রহা হ্যায়?"
প্রথমে নামতে না চাইলেও কয়েকজন নামে,শোনে ওরা নাকি খুব অনুরোধ করেছে গাড়িটাকে ওদের তোলার জন্য। ওদের গাড়িতে একজন অসুস্থ আছে।
এবার সত্যিই চেক করতে হবে সবাইকে নামিয়ে।লকডাউনে একদল লোক মালের লরীতে উঠেছে,লরীতে ঢাকা দেওয়া বলছে বাড়ি যাবে।কি ব্যাপার?
ওদের ধমকে কয়েকজন পুরুষ মহিলা নামে,তারপর একটা যন্ত্রণার চিৎকার কানে আসে সোফিয়ার।
'' শিউলাল দেখো তো বাত ক্যায়া।"
শিউলাল উঁকি দিয়ে বলে এমার্জেন্সী আছে,একটা বৌয়ের বাচ্চা হবে ভেতরে কাতরাচ্ছে। নামতে গেছিলো কিন্তু নামতে পারছেনা।
শিউলাল তবুও তাড়া দেয় ওদের নামার জন্য।" জলদি নামো,উসকো নামাও দেখনা পড়েগা।"
ওদের দেরি দেখে সোফিয়া লরীতে উঠে উঁকি দেয়।দেখে আর কিছু বলতে পারেনা,জীর্ণ শীর্ণ চেহারার একটা বৌ।দেখে মনে হয় কতদিন খাওয়া জোটেনি। স্বামীর কাঁধে ভর দিয়ে পেটে হাত দিয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। বুঝতে পারলো সোফিয়া মেয়েটার অবস্থা।তাই চট করে ঠিক করে নিলো কি করতে হবে ওদের। প্রথমেই মেয়েটাকে একটা হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। যদিও অনেকটা দূরে হসপিটাল।
তাই একটু কড়া হয়ে অন্যদের বলে ওকে সাহায্য করতে নেমে আসার জন্য। মেয়েটা উঠে দাঁড়াতে যায় পারেনা। কয়েকজন মহিলা বলে ওঠে.." আভি হো জায়েগা ডেলিভারি, মালুম হোতা হ্যায় টাইম হো গয়া।"
ততক্ষণে মেয়েটার কাপড় ভিজেছে। সোফিয়ার ভেতরের নারীসত্ত্বা কেমন যেন ছটফট করে ওঠে উত্তেজনায় আর কষ্টে। মা হওয়ার যন্ত্রণাটা ও বোঝে,এই তো কিছুদিন আগেই সোহা এলো ওর কোলে। সব অনুভূতিটুকু এখনো ছুঁয়ে আছে শরীর মন।
সবার তৎপরতায় ওখানেই তৈরী হয়ে গেলো এক প্রাকৃতিক তাৎক্ষণিক আতুড়ঘর কাপড় ঘিরে।শিউলালকে ডেকে বেশ কিছুক্ষণ আগে একজন স্থানীয় ধাইমাকে খবর দিতে পাঠিয়েছে সোফিয়া।
সমস্ত রোগ যন্ত্রণা আর অভাবের মধ্যে জন্ম নিলো পরিযায়ী নবজাতক খোলা আকাশের তলায়। তার সদর্প চিৎকারে হাসি ফুটলো পরিযায়ী অভুক্ত বাবার মুখে। সোফিয়া শুনলো আগে একটা মৃতসন্তান প্রসব করেছিলো বৌটি। আর আজ হয়ত জন্ম দিলো এক অপরাজিতের যে দেশ,কাল,রাজ্য জেলা,রোগের তোয়াক্কা না করেই জন্ম নিলো পথে।
কিছুক্ষণের জন্য যেন অদ্ভুত একটা পরিবেশ হয়েছে।সোফিয়া কাপড় সরিয়ে দেখে হাত পা নাড়ছে সদ্যোজাত।আকাশের দিকে যেন মুঠো তুলে বলছে ম্যায় ভুখা হুঁ, কুছ খানে কো দো।"
শিউলালকে দিয়ে শাশুজিকে ফোন করে কয়েকটা ছোট নতুন জামা আর তোয়ালে আনিয়েছে সোফিয়া। বাচ্চাটাকে পরিস্কার করেছে ধাইমা..তোয়ালে জড়ানো সন্তানকে দেখে বাবার চোখ দিয়ে আনন্দে গড়িয়ে পড়ে জল। তবে মা তখনো ধুকছে।
বাচ্চাটর বাবা বলে দুঃখের দিনে এসেছে তাই ভিখুরামের ছেলের নাম দুখুরাম থাকবে। এ যে আকালের সন্তান,বাবার কাজ নেই,আশ্রয় নেই,মায়ের পেটে খাবার নেই।
সোফিয়া মনে মনে বলে ও দুখুরাম নয় ও যীশু।একদিন মা মেরীও তো এইভাবেই জন্ম দিয়েছেন যীশুকে আস্তাবলে। কে জানে এই অন্ধকার পৃথিবীতে জন্মানো শিশুই একদিন মুঠো তুলে আলো দেখাবে পৃথিবীকে,চাইবে নিজের অধিকার।
কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যায় সোফিয়া। অনেকটা সময় গড়িয়ে গেছে এবার ওকে থানা হয়ে ফিরতে হবে। এদিকের ব্যবস্থা করেছে মোটামুটি।যদিও ওরা থামতে নারাজ ঐ ছোট্ট বাচ্চাটাকে নিয়েই রওনা দিতে চায় বাড়ির পথে।ধমক দিয়ে সোফিয়া এগিয়ে যায় জীপের দিকে।
হঠাৎই কানে আসে বাচ্চাটা কাঁদছে,খুব কাঁদছে। ওর কান্নাটা কেমন যেন কানে লাগে সোফিয়ার হয়ত ব্যথা লাগে বুকেও। দুধের ব্যবস্থা ওরা করে দিয়েছে কিন্তু খাওয়ানো যাচ্ছেনা। ওরা বলাবলি করছে মায়ের দুধ পেলে ভালো হত, বাচ্চাটাকে রাখা যাচ্ছেনা। মায়ের শরীরে তো কিছু নেই। কতদিন ভালো করে খাওয়া জোটেনি।দুধ আসবে কোথা থেকে?
এগিয়ে এসে কাপড়টা সরিয়ে মুখটা বাড়ায় সোফিয়া। বাচ্চাটার কান্না দেখে ওর নিজের বুকটা কেমন যেন টনটন করে তখন। হাত বাড়ায় সোফিয়া। বাচ্চাটাকে ওর মা পরম নির্ভরতায় তুলে দিয়েছে ওর কোলে,নিজের পোশাকের বোতাম খুলে স্তন্যধারায় তৃপ্ত করছে সোফিয়া ওকে। মাতৃত্বের অমৃতধারায় তৃপ্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো শান্ত হয়ে পরিযায়ীর নবজাতক দুখুরাম যে হয়ত সোফিয়ার কল্পনার আগামীর যীশু।©রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী
ভালো লাগলে নামসহ শেয়ার করুন।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment