#অপেক্ষা#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
মাঝখানের দরজার পর্দাটা টানা,দরজার তলা দিয়ে আলোটা উঁকি দেয় মধুজার রাতজাগা চোখদুটোতে। আনন্দ জেগে আছে ঐ ঘরে। দুজনের মাঝে আজ একটা ভারী পর্দা।
ফোনটা হাতে নিয়ে বারবারই মেসেজ করছে অবন্তীকে আনন্দ.."সোনা,বেশ কয়েকটা দিন হয়ে গেলো একবারও ভিডিও কলে এলেনা।
একবার একটু অনলাইনে এসো।"
অনেকক্ষণ বাদে উত্তর এলো.." আমি এখন ভিডিও কলে আসতে পারবোনা,প্রবলেম আছে।"
"একবার প্লিজ..."
"এখন হবেনা।"
অবন্তীর ছবির পাশের সবুজ বাতিটা নিভে যায়। অপেক্ষায় অনেকটা সময় ফেসবুক স্ক্রল করে আনন্দ।
পাশের ঘরে আর এক অন্তহীন অপেক্ষায় মধুজা যে অপেক্ষার হয়ত কোন শেষ নেই। মনকে বুঝিয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছে এই একাকীত্বে মধুজা। নিজের চাকরি আর আনন্দর মা বাবার সাথে সময় কাটাতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। বরং আনন্দ এবার বাড়িতে এসে আটকে যাওয়াতে কেমন যেন অস্বস্তি হয়েছিলো।সেই মানুষটার সাথে একঘরে ঢুকতে হবে যে আগেরবার এসে বলেছিলো ও একজনকে ভালোবাসে মানে সম্পর্কটা হঠাৎই এমনভাবে তৈরী হয়েছে যে সেখান থেকে বেরোনো আর সম্ভব নয়।
আনন্দর জাহাজের চাকরি,বছরের অনেকটা সময় বাইরে থাকতে হয়। তাই এই একাকীত্ব একান্তই পরিচিত মধুজার। শুধু অপরিচিত আনন্দকে চিনেছিলো হঠাৎই একদিন,যখন আনন্দ ফিরে আসার প্রথম রাতে স্বচ্ছ রাতের পোশাকে আসতে চেয়েছিলো খুব কাছে খুবই কাছে দীর্ঘ বিরহের পরে।
" আমি তোমাকে ঠকাতে চাইনা মধুজা, তোমার সাথে খারাপ ব্যবহারও করতে চাইনা। এটা ঠিক যে আমি বাবা মায়ের পছন্দে তোমাকে বিয়ে করেছিলাম। তবুও তোমাকে আমারও ভালো লেগেছিল। কিন্তু এখন যেন মনে হয় কেন যেন ভালোবাসা তৈরি হয়নি আমাদের মধ্যে। কতদিনই বা কাছে পেয়েছি তোমাকে? তার মধ্যে কেমন যেন একটা ফাঁক রয়ে গিয়েছিলো। হয়ত সেই জন্যই অবন্তী জায়গা করে নিয়েছিলো।"
ফাঁক কথাটাতে কেমন যেন চমকে উঠেছিলো মধুজা,কেউ যেন চাবুক মেরেছিলো ওকে। ফাঁকটা কি ঐ কাছাকাছি না থাকার ছমাসেই তৈরী হলো?নাকি মধুজা সংসার,চাকরি, অসুস্থ বাবাকে নিয়ে ব্যস্ততাতে খুব বেশি সময় দিতে পারেনি আনন্দকে। মানে আনন্দ যেভাবে ওকে চেয়েছিলো সেটা কি পায়নি?এটাকেই কি ফাটল বলে?মাত্র তো দুবছর বিয়ে হয়েছে ওদের এর মধ্যেই সব শেষ হয়ে গেলো!
কষ্টের ঝড়ে মনটা এলোমেলো হয়ে গেলেও কেন যেন মধুজার মনে হয়েছিলো আনন্দ ওকে ঠকায়নি বরং সত্যিটাই বলেছে। হয়ত অতিরিক্ত ভালোবাসা থেকেই কেন যেন দোষী করতে পারেনি আনন্দকে।
বছরে ছমাস যে বাইরে থাকে সে তো পরকীয়া করে ভালোমানুষী করতেই পারতো। দু নৌকাতেই পা দিয়ে চলতে পারতো?
" তুমি এই বাড়িতে থাকতে পারো যতদিন তোমার খুশি একদম নিজের বাড়ির মতো।মা বাবা তো তোমাকে খুবই ভালোবাসেন।"
কান্নাটা গলার কাছে দলা পাকিয়ে গেছিলো মধুজার যার কাছে ভালোবাসা পাবার সে পর হলেও তারই ঘর আগলে বেঁচে থাকা। তবুও হয়ত এভাবেই থাকতে হবে কিছুদিন। কারণ ওর বাবা খুব অসুস্থ হয়তো ওর ঘর ভাঙাটাকে নিতেও পারবেননা এখনই।শ্বশুর শাশুড়িও এই দুবছরেই ওর ওপর অনেকটা নির্ভর করেন।
নিজের শোয়ার ঘরটা ও আলাদা করে নিয়েছিলো।মধুজার শ্বশুরবাড়িতে দুটো ঘর পাশাপাশি মাঝখানে দরজা আনন্দ এলে বড়ঘরে রাত্রে ঢুকলেও রাতটা পাশের ঘরে কাটিয়ে সংযম রক্ষা করে মধুজা।
টুকটাক হোয়াটস আ্যপে কথা হলেও কদিন অবন্তী যোগাযোগ করছেনা তেমন।অথচ বলেছিলো এর মধ্যে সবটুকু বাড়িতে বলে পুরোপুরি ভাবে আনন্দর হয়ে যাবে।
অবন্তীর কথা,ওর হাসি ওর মায়াবী চোখ কেমন যেন তাড়া করে আনন্দকে। মুম্বাইয়ে একান্তে কফির কাপ হাতে কত সন্ধ্যা দুজনে কাটিয়েছে। অথচ সবই যেন আউট অফ সাইট আর আউট অফ মাইন্ড হয়ে গেছে।
কাল একটু রেস্টলেস হয়ে পড়েছিলো হঠাৎই আনন্দ। বেশ কয়েকবার ফোন করে অবন্তীর সেলফোনে ধরেনা একটা সময় দেখে ফোনটা সুইচড অফ। পরেরদিন ছোট্ট একটা মেসেজ পেয়েছিলো,শরীরটা খারাপ তাই ফোন ধরতে পারিনি।
মাথাটা অদ্ভুতভাবে ধরে গেছে আনন্দর,অবন্তীর এড়িয়ে যাওয়াটা কেন যেন নিতে পারেনা।পাশের ঘরের পাখাটা বন্ধ বুঝতে পারে।তার মানে মধুজা উঠে পড়েছে।ঘড়িতে তখন পাঁচটা বাইরে ভোরের আলো ফুটেছে। মা বাবার সামনে এমনিতে স্বাভাবিক কথাবার্তা বলার চেষ্টা করে মধুজার সাথে।
এই কদিন এখানে এসে দেখেছে মুখে আওয়াজ ছাড়া কি ব্যস্ত রাখতে পারে একটা মেয়ে নিজেকে। সারাদিন একটার পর একটা কাজ করে যাচ্ছে। মা বাবাও কেমন যেন শান্ত চুপচাপ সবাই নিরাপদ দূরত্বে নিজের কাজে ব্যস্ত।
মধুজা কি কিছু বলেছে বাড়িতে?
দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়ায় আনন্দ একঝাঁক পাখি আকাশে কলরব করতে করতে যেন বলে যাচ্ছে পৃথিবীটা শুধু আমাদেরই।তোমরা থাকো কিছুদিন খাঁচাবন্দি।মধুজাকে দেখেনা কোথাও..এত ভোরে কোথায় গেলো?
আস্তে আস্তে ছাদে উঠে আসে আনন্দ এবার এসে ছাদে ওঠাই হয়নি।অথচ একটা সময় কতটা সময় কেটে যেতো ছাদে। একটা মোহের ঘোর,অবন্তী কি শুধুই মোহ যার জন্য সব ছেড়ে আজ একঘরে নিজেকে আটকে রেখেছে? অবহেলা করছে মধুজাকেও। নাকি এটাই পুরুষের স্বভাব..এক নারীতে সন্তুষ্ট হতে পারেনা? ভাবতে ইচ্ছে করেনা আর।
চোখ চলে যায় ছাদের এককোণে... গাছে জল ছড়িয়ে দিচ্ছে মধুজা। কত ফুল ফুটেছে গাছে! নীচু হয়ে বসে পাতাগুলোতে হাত বুলিয়ে আদর করছে আপনমনে।
রাতের অন্ধকারে শরীর ছুঁতে হয়ত ভালো লাগে নেশা ধরায় মনে। কিন্তু আজ মধুজাকে শুধুই দেখতে ইচ্ছে করলো,অনুভব করতে ইচ্ছে করলো ওর নিস্তব্ধতা।
মাঝে কেটে গেছে প্রায় দেড়মাস অনেক সময়ই অফিসের কিছু কাজ করতে করতে দেরি হয়ে যায়। সেদিন অবন্তীর সাথে টুকরো কিছু কথাতে ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলে আনন্দ.." তুমি কি আমাকে ইগনোর করছো?"
" আমি একটু বিজি আছি,শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা।"
" এখন তো বাড়িতেই আছো কি এত বিজি তুমি?"
" তোমাকে বলা হয়নি আসলে আমি কনসিভ করেছি,আমার পক্ষে আর সম্পর্কটা টেনে নেওয়া সম্ভব নয়।ও এখন অনেক কেয়ারিং আমার প্রতি।"
" ও তাহলে আমি কি টাইমপাস ছিলাম?"
ফোনটা কেটে দেয় অবন্তী।
নিজেকে কেমন যেন লুজার আর বেগার লাগে আনন্দর। সারারাত ঘুমোতে পারেনা..ভোরবেলা খুব ইচ্ছে করে মধুজাকে সবটা বলতে। বুঝতে পারে মধুজা নেই ছাদে আছে। আস্তে আস্তে পা ফেলে ছাদের দিকে, ওপরের সিঁড়িতে এসে পা দুটো আটকে যায়...ছাদের একটা কোণে মা বসে মায়ের হাঁটুতে মাথা রেখে কাঁদছে মধুজা।
মা বলছে,"শিবের ঘরে অন্নপূর্ণা থাকতেও শিব ভিক্ষা করে। হায় ভগবান এতো ভালোবাসা নিয়ে যে মেয়েটা বসে আছে তার স্বামী যায় অন্য কারো কাছে ভালোবাসা ভিক্ষা চাইতে।
ভাবিসনা ও ঠিক ফিরে আসবে এই ভোরবেলা আমি বললাম।"
মায়ের কোলে মাথা রেখে আজ আনন্দরও খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে হারিয়ে ফেলার দুঃখে নয় হয়ত ভালোবাসা খুঁজে পাওয়ার আনন্দে।
" ও আর আসবেনা মা।"
" আসবে,ঠিক আসবে। এলে কিন্তু তাকে ফেরাসনা ও যে শিবের মতই ভিখারি আর তুই অন্নপূর্ণা।"
মধুজার লাগানো গাছগুলো আলো করে রেখেছে ছাদ..পূব আকাশ সূর্যের আলোতে মাখামাখি। আজ আনন্দরও মধুজাকে বলতে ইচ্ছে করলো.." তোমার ভালোবাসা থেকে একটু ভিক্ষা দেবে আমাকে?"©রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী।
ভালো লাগলে নামসহ শেয়ার করুন।
ছবি:-গুগল থেকে নেওয়া
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment