Skip to main content

ফ্রেন্ডশিপ অ্যান্ড মোর2

কে আবার ফোন করছে এখন উঃ শান্তি নেই..ওহ্।
ফোনটা ধরতেই ওপার থেকে কানে আসে," হাঁফাচ্ছিস কেন?
ছেলে বাড়িতে আছে?
যদি না থাকে কথা বলবো।"

        চোখে চশমা না থাকায় বুঝতে পারেনি রাধিকার ফোন..." নিশ্চিন্তে বল। অঙ্কু বেরোলো এইমাত্র বন্ধুর বাড়ি ওখানে ডিনার করে ফিরবে।"

              হা হা করে হেসে ফেলে রাধিকা,তোর ছেলের গার্লফ্রেন্ডকে দেখলাম আজ মানে আগেও দেখেছি হয়ত কিন্তু খেয়াল করিনি আজ শুধু দেখার জন‍্যই ডাকলাম।"

        চোখদুটো নেচে ওঠে শান্তনুরও মজাও লাগে মনে হয় একসময় এই মজার দিনগুলো তাদের জীবনেও ছিলো।হাসি মজা আনন্দ আর খুনশুটির দিন।তারমধ‍্যে ছিলো না বলা প্রেমের ছোঁয়া আর মনছুঁয়ে যাওয়া কিছু মিঠে স্মৃতি।

      " কি দেখলি? মানে কেমন দেখলি? অঙ্কুর সাথে মানাবে তো?"
      " হুঁ বাবা আমিই আগে দেখলাম তোর ছেলের হবু বৌকে।" রাধিকা বলে।

       " ধ‍্যুৎ ছেলের বৌ আবার কি?
এখন কি আর আমাদের সময়?
মানে ঐ এক প্রেমেই জীবন কাটিয়ে দিলাম।
আমি মায়ার প্রেমে আর তুই কৃষ্ণপ্রেমে।"

         একটু চুপ করে যায় রাধিকা আর ফোনের এপারে শান্তনুও। মায়ার সাথে সম্পর্ক হওয়ার আগে প্রথমে রাধিকাকেই ভালো লাগতো শান্তনুর কিন্তু তা রয়ে গিয়েছিল মনে মনেই প্রকাশ করতেই পারেনি।
তারপর বয়ে গেছে অনেক জল নদী দিয়ে। আসলে সম্পর্ক বোধহয় তৈরি হয়ে আসে ওপরেই। ওপরওয়ালা কি সব চালটাল মেপেটেপে পাঠান শুনেছে ছোটবেলায়।

      রাধিকা বলতে শুরু করে.." আর বলিসনা  বেচারা মেয়েটা তো ভয়ে কাচুমাচু একদম। বসতে বললেও বসছেনা।যদিও তোর ছেলের মত অত সুন্দর নয় তবে খুব মিষ্টি আর বুদ্ধিদীপ্ত।কথা বলে মনে হলো মাথাটাও ঠান্ডা। আসলে আমাদের পেশায় মাথা ঠান্ডা না হয়ে উপায়ও নেই তবে অঙ্কুর জন‍্য কিন্তু পারফেক্ট ম‍্যাচ হবে। তবে ও তো কলকাতাতে পড়ছে আর এখানেই থাকে তোর ছেলের বাইরে চাকরি ব‍্যাপারটা ম‍্যাচিওর করবে কি করে?"

               অঙ্কিত যখন অহনার বাড়িতে এসে গল্পে  আর আড্ডায় জমে গেছে তখন শান্তনু ব‍্যস্ত রাধিকার সঙ্গে ফোনে আড্ডা দিতে। বেশ ভালো লাগছে ছেলের ব‍্যাপারে মজা করতে। মায়া থাকলে তো ওর সাথেই কথা হত। যদিও মায়া দেখেশুনে একটা বৌ আনবে এমন ইচ্ছেই ছিলো।

"সত‍্যিই মেয়েটার খুব বাজে অবস্থা ম‍্যাডাম ডেকে জেরা করছে,তুই পারিস বটে।" শান্তনু বলে।

    " আমি কি বোকা নাকি? অঙ্কুকে আমি চিনি সেকথা ওকে কিছুই বলিনি,জাস্ট পড়াশোনার কথা বলেই দুই কাজই সারলাম।"

      " তুই তো ডাক্তার প্লাস উকিল দেখছি।কি বুদ্ধি রে তোর! জানিনা আমার মেয়েটাকে দেখা হবে কিনা?"
        " কেন হবেনা অঙ্কু তো দিন পনেরো থাকবে ওকে বলবি একদিন অহনাকে আনতে। মানে ইনভাইট করবি বাড়িতে নিশ্চয় আসবে। আর নাহলে আমি তো আছিই ডেকে পাঠাবো আবার,ব‍্যাস দেখে নিবি।"

    হা হা করে হাসে শান্তনু রাধিকার কথা শুনে গাম্ভীর্যের আড়ালে মনটা এখনো সুন্দর রাধিকার তবুও ছেলেটা কেন যে ওকে দেখতে পারেনা....  " হুঁ দেখি।ছেলের মেজাজ তো জানিস। বললে হয়ত রেগে যাবে।"

**************

      অহনার ডিরেকশন ফলো করে আসতে কোন অসুবিধা হয়নি অঙ্কিতের। হলুদ টিউনিক আর লাল পালাজোতে বেশ সুন্দর লাগছে অহনাকে। মজা করে অঙ্কিত..." বাড়িতে এত সেজেগুজে থাকিস? নাকি আমি আসবো বলে সেজে বসে আছিস?"
      " এই অঙ্কু সেন্ট আমি সেজেছি মনে হচ্ছে তোর? আমাদের যা প্রফেশন সাজগোজ কিছুই হয়না তেমন। তুই আসবি বলে একটু ভদ্রসভ‍্য হয়ে আছি।"
            " ভদ্রসভ‍্য নাহলে কেমন থাকিস? আমি কিন্তু সবই দেখতে অভ‍্যস্ত এখন।"
       " পাজি ছেলে একটা,চল ভেতরে।"

  অহনার শুধু বারবার মনে হলো এত কিছু দেখিস আর প্রেমটাই দেখতে পাসনা নাকি ভয় পাস ভালোবাসায় ডুবতে। অভিমান হয় অহনার মনে মনে ভাবে থাক ভালোবাসা অব‍্যক্তই থাক। শুধু বন্ধুত্বের মজার ঝুড়িটাই দুজনে ভাগ করে নেবে।

অঙ্কিতকে হাসিখুশি দেখে অহনার খুব ভালো লাগছে কি সুন্দর মা বাবার সাথে ওর ওখানের গল্প করছে।
       " আন্টি তোমরা একবার এসো ইউরোপ ট্রিপে,আমি ঘুরিয়ে দেখাবো সব। একবার চলে এলে আর চিন্তা করতে হবেনা। দেখবে ভালো লাগবে।"
     " মা দেখেছো শুধু তোমাদের বলছে কি রে আমি যাবোনা নাকি?" বলে অহনা।

      " তোর ডাক্তারী করার পর ছুটি পেলে যেতে পারিস আমার আপত্তি নেই।"
          সবাই হেসে ওঠে একদম। ওদের কথার মাঝেই অহনার বাবা বলে.." ইশ্ আমি তো আগে জানতাম না তাহলে শান্তনুদাকেও আসতে বলতাম। একটা সময় তো ভালোই আলাপ ছিলো।অনেকদিন পর দেখা হলে ভালো লাগতো।"
       অহনা জানে বাবার কথাটা অঙ্কিতের ভালো লাগবেনা হয়ত একটু বেশি গম্ভীর হয়ে যাবে এবার, যা মুডি ও। তবে দেখলো হাসিমুখেই অঙ্কিত বললো..." আমি ফোননম্বর দিয়ে যাবো কথা বলে চলে যেয়ো একদিন আমাদের বাড়িতে। বাবা খুশিই হবে।"

                অহনার মায়ের তো অঙ্কিতকে দেখে মন ভরে গেছে।একটা সময় এই ছেলেটাকে নিয়ে মেয়ে তো কম ঝামেলা করেনি। আর এত বছর পর কেমন বন্ধুত্ব ফিরে এসেছে আবার। হয়তো এইভাবেই জীবনে আসে রাগের পরে অনুরাগ।

              অহনার আনা গোলাপের রঙ মাঝে মাঝেই রক্তিম করছিলো ওকে আর অঙ্কিতের ছেলেমানুষী দেখে বারবার প্রেমে পড়ে যাচ্ছিলো। ওর দুই চোখ ঘুরে ঘুরে দেখছিলো অঙ্কিতকে। ওর কথা শুনে বোঝাই যাচ্ছেনা হৃদয়টা গোলাপের কাঁটাতে ক্ষতবিক্ষত। অহনা মন থেকে চায় ওদের বাবা ছেলের সম্পর্কটা যেন ভালো হয়ে যায়।আঙ্কেলের জন‍্যও খারাপ লাগে অহনার সত‍্যিই তো খুব একলা একটা মানুষ কতই আর বয়েস হবে ওর বাবার মতই। যদি বন্ধুত্ব থাকেই কারো সাথে কি করা যাবে। তবে রাধিকা ম‍্যামকে মেলাতে পারেনা কিছুতেই অঙ্কিতের বর্ণনার সাথে। সবাই বলে উনি খুব ভালো মানুষ।
     

           অহনার মা একদম পাশে বসে খাওয়াচ্ছে অঙ্কিতকে ঠিক যেমন ওর মা খাওয়াতো। যেটাই বলছে ভালো হয়েছে খেতে সেটাই জোর করে পাতে তুলে দিচ্ছে।

        " দাও দাও মা ও লজ্জা করছে ও খেতে ভালোবাসে।
আরো একটা ফ্রাই দাও,পাতুরি দাও আরেক পিস্।"অহনা বলে।

          " এই তুই যা এখান থেকে,আন্টি আমি সত‍্যিই আর পারছিনা খেতে। এবার এখানেই শুয়ে পড়বো মনে হচ্ছে।"

      ফোড়ন কাটে অহনা.." শুয়ে যা এখানে কোন সমস‍্যা নেই অনেক ঘর আছে।"

           খেতে খেতে নাজেহাল হয়ে অহনার দুষ্টুমি ভরা হাসিটা দেখে কেমন যেন ফিদা লাগে অঙ্কিতের।
তবুও কেন যে মন খুলে কিছুই করতে পারছেনা।মাথার ওপর যেন একটা বোঝা চেপে বসে আছে।এখন মনে হচ্ছে কেন যে হঠাৎই চলে এলো? না এলেই হয়ত ভালো ছিলো। অহনা থাকায় একটু ভালো লাগছে,তাছাড়া কি আছে এখানে ওর?

*******************

         ফেরার পথে অহনাদের হাসিখুশি ভরা বাড়িটার কথা খুব মনে হলো অঙ্কিতের। তার পাশাপাশি ওদের বাড়িটা ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো। অত বড় বাড়িতে বাবা একা থাকে, এখন ও এসেছে তাও কোথায় যেন একটা অদৃশ‍্য পর্দা যা কিছুতেই বাবার কাছাকাছি আসতে দেয়না ওকে।
      নাহ্ বাবার সাথে কথা বলতেই হবে ওকে। এভাবে চলতে পারেনা বাবাকে কিছু ভাবতেই হবে। মা চলে যাবার পর এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াবে অন‍্য কারো সাথে তা কিছুতেই চলবেনা।

           কেন যেন এটা মেনে নিতে পারছেনা কিছুতেই অঙ্কিত। ও কি একটু বেশিই ভাবছে? অহনা তো বললো ওরা বন্ধু হতেই পারে। আর বন্ধুত্ব তো কোন অপরাধ নয়।

    *************

    ওর পৌঁছতে বেশ রাত হয়ে গেছে আসলে গল্পে গল্পে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলো অনেকদিন বাদে এমন মিঠে ঘরোয়া আনন্দের স্বাদ পেলো অঙ্কিত। আজকাল এই বাড়ি বাড়ি গন্ধটাই খুব মিস্ করে যেটা অহনাদের বাড়িতে পেলো অনেকটা।
             ওকে দরজা খুলে দিয়ে বাবা ভেতরে আসার পর জিজ্ঞেস করে.." তুই কি কফি খাবি এখন? বানিয়ে দেবো?"
         বাবা জানে যে ও রাতে কফি খায়।কখনো বারণও করে ঘুম হবেনা বলে।

       " না আমি আর কিছু খাবোনা তুমি শুয়ে পড়ো অনেকটা রাত হয়েছে।"

       " খেয়ে নিই আগে তারপর শোবো।"
" মানে এতোটা রাত হয়েছে তুমি এখনো খাওনি? তোমার নাকি সুগার বেড়েছে বললে। কি শুরু করেছো দেরিতে খাচ্ছো,রাত অবধি জেগে ফোনে কথা বলছো। অসুস্থ হয়ে পড়লে আমি কিন্তু সবসময় আসতে পারবোনা।"
        কালকের জমে থাকা রাগটা মুখ দিয়ে বেড়িয়ে আসে অঙ্কিতের।

        বাবা তখন খাবার বাড়ছে টেবিলে, বাবার মুখটা বেশ কঠিন দেখায়। খাবার বাড়তে বাড়তে বলে..." আমি জানি তুমি আসতে পারবেনা। ভেবোনা কিছু রাধিকা তো আছেই। ওরই উৎপাতে আমাকে নিয়ম করে টেস্ট করতে হয় চেকআপ করাতে হয়।"

           অঙ্কিত জানে রেগে গেলে বাবা তুমি করে কথা বলে। ওর ইচ্ছে করছিলো চিৎকার করে বলতে.." আমি তোমার কেউ নই সব সময় শুধু রাধিকা আর রাধিকা। এতো যখন তো রাধিকাকেই বিয়ে করো।আমি জানবো আমার মা বাবা আর কেউ নেই।"

         কথাগুলো মনে হলেও বলতে পারলোনা বাবা তখন খাবার নিয়ে বসেছে। মা খুব রাগ করতো খাবার সময় অশান্তি করলে বলতো বাড়িতে লক্ষ্মী থাকেনা।

        ঘরে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দেয় অঙ্কিত। ঢকঢক করে অনেকটা জল খায়। অহনা ফোন করেছে তিনটে মিসড কল।আসলে ফোনটা ঘরে রেখে বাইরে গেছিলো।

          " ভীষণ পচা হয়ে যাচ্ছিস আজকাল,আর অভদ্রও। একটা ফোন করবি তো পৌঁছে। বেশ রাত হয়ে গেছে আমার চিন্তা হচ্ছিলো।"

         " না না একদম ঠিকঠাক পৌঁছে গেছি ওয়াশরুমে ছিলাম।
বাবা এখনো খায়নি এত দেরিতে খেতে বসলো তাই বকলাম।"

      " একটা কথা বলবো রাগ করিসনা আসলে আঙ্কেল তোকে খুব ভালোবাসে আর এটাই নরমাল।
তুই মনের মধ‍্যে জমে থাকা রাগগুলো একটু ঠান্ডা জলে ধুয়ে নে দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।"

      কি করে মাথা ঠান্ডা করবো বলতো..." সারাক্ষণ রাধিকা আর রাধিকা...উনিই নাকি খেয়াল রাখছেন এখন বাবার। আমি কেউ না।"

        ওরে হাঁদু " সত‍্যিই ম‍্যাম ভীষণ ভালো, কারো কাছে ওনার নিন্দা শুনিনি। বিলিভ মি....
আর সেটা তো ভালো তুই অনেকটা নিশ্চিন্ত আছিস যে এতোদূরে কেউ অন্ততঃ বাবার খেয়াল রাখছে।
আর সি ইজ আ ডক্টর।
শুধু বন্ধুত্ব ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য নেই।
কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে এই বয়েসে ওরা দুজনেই প্রায় সেম এজ দেন আমি কি বলছি বুঝে নে। সবটাই মেন্টাল ডিপেনডেন্স নট রিলেটেড উইথ ফিজিক‍্যাল রিলেশন।"

        অহনা ডাক্তার তবুও অঙ্কিতকে কথাগুলো বলতে বলতে কেমন যেন ওর গাল দুটো লাল হয়ে যায় মনে হয় অঙ্কিতের বলিষ্ঠ হাতের বাঁধনে ওর হাতদুটো নিয়ে ঘড়িটা দেওয়ার কথা।

        ওর টেবিলে ঘড়িটা নিরলস ভাবে সময় দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু অহনা মাচ ইগারলি ওয়েটিং ফর লাভটাইম। আবার কদিন বাদেই তো অঙ্কু চলে যাবে আবার কবে ফিরবে কে জানে?

****************
        অহনার সাথে অনেকক্ষণ কথা বলার পর বাইরে আসে অঙ্কিত।
মাথাটা কেমন যেন ভারী লাগছে একটু কফি খেলে হত।
হঠাৎই দেখে টেবিলে দেখে ফ্লাক্সটা রাখা।ওর পরীক্ষার আগে বাবা ঠিক এমন করে বানিয়ে রাখতো।

        পাশে কাপটাও রাখা যত্নে। মনে মনে ভাবে হয়ত ভালোবাসাটা বেঁচে আছে নিঃশব্দে। বাবারা হয়তো এমনি হয় তবে কি ওর বোঝার ভুল?

             পরেরদিন সকালে উঠতে একটু দেরি হয়। রান্নাঘর থেকে লুচির গন্ধ আসছে বাবাও রান্নাঘরে অঙ্কিত শুনতে পায় রান্নার লোককে বলছে বাবা..." লুচিগুলো যেন সাদা হয় আর তরকারিটা দেখি এতে আরেকটু মিষ্টি দাও। আজকাল তো এগুলো আমার খাওয়া হয়না। অঙ্কু খেতে ভালোবাসে খুব লুচি আর সাদা আলুর তরকারি তাই একটু বানিয়ে দাও।"

                ওকে লুচি দিতে দিতে বাবার মুখে পরিতৃপ্তির হাসি..." তরকারিটা ঠিকঠাক আছে তো? খা ভালো করে খা।"
       পাশে রাখা ফোনে অহনা নামটা ফুটে ওঠে.. অঙ্কিত খেতে খেতে বলে.." লুচি খাচ্ছি,একটু বাদে ফোন করছি।"

   ওদিক থেকে খিলখিল করে হাসে অহনা.." সকাল সকাল ফুলকো লুচি আহা আহা খা ভালো করে খা। পরে কথা হবে।"

       ফোনটা রাখতেই ওর বাবা বলে.." একটা কথা বলবো তুই তো ওদের বাড়িতে কাল খেয়েদেয়ে এলি। তা ওদেরকে একদিন আসতে বল আমাদের বাড়িতে।"

          " হঠাৎ ওদেরকে আসতে বলবো কেন? অবশ‍্য আঙ্কেল বলছিলো তোমার কথা।আমি ফোন নম্বর দিয়ে দিয়েছি। আচ্ছা বলবো অহনাকে।"

     " একদিন অহনাকেই নাহলে নিয়ে আসিস।"

         ওদের কথার মাঝেই বেলটা বাজে...বাবা দরজা খুলে দিলে একটা কমবয়েসী ছেলে একটা বড় ব‍্যাগ নিয়ে আসে। তার পেছনে আসে রাধিকা মাসি। এবার ওর আসা এই পাঁচদিনের মধ‍্যে একবারও আসেননি উনি। একটু অবাকই হয়েছিলো অঙ্কিত,খাবার রান্না করে পাঠিয়ে দিয়েছেন অথচ আসেননি।

          অঙ্কিতকে দেখে কোন জড়তা ছাড়াই কাছে এসে দাঁড়ান। কদিন ধরেই আসবো ভাবছি আর আসা হয়নি।
"ভালো আছিস বাবু?
একটু ঝরে গেছিস মনে হচ্ছে আর একটু কালোও হয়েছিস।
অবশ‍্য রোগা থাকাই ভালো।
এদিকে তোর বাবা তো নাকি তোর চিন্তায় চিন্তায় চানাচুর খেয়ে মোটা হয়ে যাচ্ছে।"

                  বাবা ইশারা করছে প্রণাম করার জন‍্য। বাবার এই অভ‍্যেসটা এখনো রয়ে গেছে। অনিচ্ছাকৃত একটা প্রণাম সারে অঙ্কিত।

        উনি তখনো কথা বলছেন..." শান্তনু কৌটোগুলো একটু আলগা করে রাখিস।
অবশ‍্য সকালেই বানিয়ে এনেছি বিউলির ডাল আর পোস্ত আর মোচার চপ।
চপটা একটু গরম করে দিস আমি জানি বাবু ভালোবাসে।
আমি চলি আমাকে হসপিটালে যেতে হবে।"

        উনি নাকি ব‍্যক্তিত্বসম্পন্না তবে বকবক করেন কেন এতো? নাকি বাবাকে দেখেই উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ছেন। এর মধ‍্যেই বাবা লুচি আর তরকারি এনে দেয়।

       " আমার এখন সময় নেই একদম।
একটা খাচ্ছি যখন দিলি সামনে।
আর তুই এইসব খাচ্ছিস নাকি?
টেস্ট করিয়েছিস? কি এসেছে?" বেশ চোখ পাকাচ্ছেন ভদ্রমহিলা।

বাবা হেসে অস্থির..." উঃ এদের জ্বালায় আমি আর বাঁচবোনা।"

      বেশ বিরক্ত লাগে অঙ্কিতের না বলে পারেনা.." বাড়িতে তো রান্নার লোক আছেই রান্না হচ্ছে।আপনার এতো কাজের মধ‍্যে কি দরকার এইসব করে আনার?"
             হয়ত এমনি একটা কথার জন‍্য প্রস্তুত ছিলোই রাধিকা তাই বলে.." আমি জানি তুই এগুলো খেতে ভালোবাসিস।
মায়ার মত হয়ত অত ভালো হবেনা ভালো লাগলে খাস।"

        রাধিকার চোখের নীরব অভিমান ছুঁয়ে যায় শান্তনুকে।ছেলেটা কেন যে ওকে সহ‍্য করতে পারেনা কে জানে অথচ মায়ার জন‍্য কত কি করেছে। মায়া কি বলেছে কিছু ওকে নাকি কে জানে!
        শেষ সময়টা রাধিকাকে আর মায়া সহ‍্য করতে পারতোনা। শান্তনুর সাথে কথা বললে রাগ করতো অশান্তি করতো।

        রাধিকা চলে গেছে...খুব একটা বেশি কিছু বলেনি ওর ড্রাইভার নিচেই ছিলো। গাড়ির আওয়াজটা চেনা অঙ্কিতের। শান্তনুর মুখটা একটু থমথমে খুব খারাপ লেগেছে ছেলের কথায়।

   "অত ব‍্যস্ততার মধ‍্যে রান্না করে নিয়ে এসেছে তোর জন‍্য নিজের হাতে।
এই কথাগুলো না বললেই পারতিস।
কষ্ট পেলো কত।"

      রেগে ওঠে অঙ্কিত," আমি তো চাইনি খেতে আর আনতেও বলিনি রান্না করে কি দরকার আনার?"

      " তোকে ভালোবাসে বলেই এনেছে। "

       " ওনার ভালোবাসার আমার দরকার নেই। আচ্ছা বাবা মা যে ওনাকে পছন্দ করতোনা তুমি জানোনা?
মা আমাকে বলেছিলো 'রাধিকা চায় আমি মরি তাহলে এই ঘর সংসার সব ওর হবে।'

       আমার তো মনে হয় মায়ের চিকিৎসা ঠিকমতো হয়নি মানে তুমি করাওনি।তোমার ঐ রাধিকা করতে দেয়নি।"

        " তুই জানিসনা তোর মাকে আমি এই রাজ‍্যের বাইরেও নিয়ে গেছি দেখাতে সেখানে একই কথা বলেছে।তোর মায়ের ছোট থেকেই হার্টের এমন সমস‍্যা যা একশো জনের মধ‍্যে একজনের হয়।পাহাড়ে গেলেও অসুস্থ হয়ে যেতো কোন ভারী কাজও করতে পারতোনা।"

           " আমি তাও মনে করি চিকিৎসা হয়নি মানে তোমরা করাওনি। ঐ রাধিকা করতে দেয়নি।"
        গলাটা বুজে আসে অঙ্কিতের এই ভদ্রমহিলাকে দেখে হঠাৎই মাথাটা গরম হয়ে যায় নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারেনা কিছুতেই।
      অথচ একটা সময় এই মাসিকে খুব ভালোবাসতো অঙ্কিত।ছোটবেলায় একসাথে কত বেড়াতেও গেছে ওরা। কিন্তু মায়ের শেষ কথাগুলো ভুলতে পারেনা। সব সময় কানে বাজে।

       " তুই ভুল করছিস রাধিকা সবসময় আমাদের হিতাকাঙ্খী ও আমাদের ভালোবাসে।"

        " ভালোবাসে? দেন তুমি ওনাকে বিয়ে করে নাও অযথা এমনি এমনি ঘুরে বেড়াবে কেন এদিক ওদিক?"

       " অঙ্কু চুপ কর।
ছিঃ ছিঃ বৃথাই এত পড়াশোনা শিখিয়েছি তোকে।
কত কষ্ট যে এর জন‍্য করেছি!
আচ্ছা তোদের বন্ধু নেই?
বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাসনা তোরা?
নাকি সবার সাথেই তোদের প্রেমের আর বিয়ের সম্পর্ক?
তোদের বন্ধু থাকতে পারে আর আমার থাকতে পারেনা?"

          " না পারেনা মানে এভাবে বান্ধবী নয়।"

    " কেন পারেনা?
আমার বয়েস হয়েছে বলে?
নাকি আমি বিপত্নীক বলে?
তুমি কি আমার সব নিয়ন্ত্রণ করবে?
রাধিকা আমার ভালো বন্ধু ছিলো আর থাকবেও যতদিন আমি বাঁচবো।"

          এর আগে ওর ফোনটা অনেকবার বেজেছে,উত্তেজনা এমন একটা পর্যায়ে তখন যে ফোনটা ধরতে পারেনি অঙ্কিত। বুঝতে পারে অহনা ট্রাই করছে বারবার।

         একটু ছোট্ট অভিমান হয় অহনার অঙ্কিত ফোন ধরছেনা বলে। মনে উঁকি মারে দুশ্চিন্তার মেঘও।সকাল সকাল আবার কি হলো কি জানে? বেশ তো খুশি মনে লুচি খাচ্ছিলো। এখনো কি লুচি খেয়েই যাচ্ছে নাকি?

ওকে তো এখন কলেজে যেতে হবে। ওপিডি আর রাউন্ড দিয়ে ফিরতে একটু দেরি হবে। কুর্তিটা পরে স্কার্ফটা গলায় জড়িয়ে নেয় অহনা চুলগুলো একটু উঁচু করে বাঁধে। এখনই বেরোতে হবে ওকে।

       অঙ্কিত বুঝেছে বাবা ফাইনাল কথা জানিয়ে দিয়েছে হয়ত বাবারও আর ওর ওপর কোন ভরসা নেই ওর থেকে অনেক বেশি ভরসা বান্ধবীর ওপর।

       তবুও থামেনা অঙ্কিত শুরু যখন হয়েছে তখন শেষটা বলে দেওয়াই ভালো ও যা বলতে চায়.." তুমি যতদিন বাঁচবে বন্ধুত্ব যখন রাখবেই তো বিয়েটা করে নাও তাহলে তো আমাকে শুনতে হবেনা উনি মাঝে মাঝেই এখানে আসেন থাকেন।"
              প্রচন্ড রাগে বাবার মুখটা লাল হয়ে যায়.." ছিঃ ছিঃ তুমি আমার চরিত্রে সন্দেহ করো? বিয়ে আমার একবার হয়েছিলো মায়ার সাথে আর হবেনা এই জীবনে।
বাড়িটা আমার উপার্জনের টাকায় করা সুতরাং আমার বন্ধু বা বান্ধবী এখানে আসবে।
আমি যেমন তোমার জীবনের ব‍্যাপারে হস্তক্ষেপ করিনা তেমনি তুমিও কোরনা হস্তক্ষেপ আমার জীবনে।"

               এরপর আর কোনো কথাই চলেনা বোধহয়। অস্থির লাগলো অঙ্কিতের মনে হলো এই কথার পর আর বাড়িতে থাকাই চলেনা।

             তাই বাইরে বেরিয়ে যায়...পেছন থেকে বাবা ডাকে," মাথা গরম করে এভাবে বাইরে বেরোসনা সবটাই ভুল ধারণা তোর। রাধিকা আমার ছোটবেলার বন্ধু তোর বন্ধু অহনার মতো।"

*******************

            ওদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই লেক তাই হাঁটতে হাঁটতে লেকের ধারে এসে বসে। ততক্ষণে বেশ রোদ উঠেছে আকাশে তবে রোদের সেই রাগী ভাবটা নেই। মাথার ভেতরটা কেমন জ্বালা করছে অঙ্কিতের। ফোনটা হাতে নেয়,অনেকগুলো মিসড্ কল অহনার।

মেয়েটা হয়তো কতই না চিন্তা করেছে এতক্ষণ।কেন যেন হঠাৎই মনে হয় অঙ্কিতের ও কেন এলো এখন?
শুধুই অশান্তি করতে?
বাবা এখানে কি করছে তাতে ওর কি এসে যায়? হ‍্যাঁ ওর মামারা বলেছে অনেক কথা।
কিন্তু এখানে আসার পর কেউ তো তেমন করে খোঁজ নেয়নি। ঐ একদিন ও গিয়েছিল ব‍্যাস ওটুকুই। মামারা পরিস্কার বলেছে," যে বাড়িতে বোন নেই সেই বাড়িতে আর ইচ্ছে করেনা যেতে। আর তোর বাবা তো বেশ আছে আজ এখানে যাচ্ছে কাল সেখানে,সঙ্গীও পেয়ে গেছে।"

           পেরেক ফোটানোর মত কথাগুলো ফুটেছিলো মনে অঙ্কিতের।

        শুধু অহনাই বলেছে..সব মানুষের বন্ধু দরকার হয়তো ওদের দুজনের মতো আঙ্কেল আর ম‍্যাম ছোটবেলার বন্ধু। ছোটবেলার বন্ধুত্ব কোনদিন ভোলা যায়না।তার মিঠে স্বাদ মিছরির মত মিষ্টি অথচ শরীর ঠান্ডা রাখে।

           অঙ্কিত বুঝতে পারে ওর মধ‍্যে একটা অন‍্যমন বাসা বেঁধেছে যা ওকে কিছুতেই ভালো থাকতে দিচ্ছেনা। অশান্ত করে তুলছে মনটাকে।

অহনার সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে ওর। অনেকক্ষণ অহনাও ফোন করেনি হয়ত রাগ করেছে।
               একটা টেক্সট করে ওকে..'' ফাঁকা আছিস? মনটা ভালো লাগছেনা কেমন যেন লাগছে।"
              বেশ কিছুক্ষণ বাদে উত্তর পেলো.." একটু বাদে কল করছি,ওয়েট।"

          চারধারে চোখ যায় অঙ্কিতের কত পাখি গাছগুলোতে বসে আছে আনন্দে কিচমিচ করছে ওরা অনেকেই পরিযায়ী পাখি। হয়ত ওর মতোই এসেছে উড়ে অনেক দূর থেকে বাসা বাঁধতে। কতগুলো কমবয়েসী ছেলেমেয়ে হাসিতে ভরপুর।শুধু যেন ওর মনেই কোন আনন্দ নেই।

               আবার বাবার কথা মনে হলো অঙ্কিতের, সত‍্যিই তো বাবাও নিঃসঙ্গ। এবার এসে তো ঐ সেদিন ছাদে ছাড়া ভালো করে কথাও বলেনি মানুষটার সঙ্গে।

হঠাৎই একটা ভয়ে বুকটা কেঁপে ওঠে ওর,কই বাবা তো এতক্ষণ একটাও ফোন করলোনা! অন‍্য সময় বাইরে বেরোলে বাবা একবার হলেও ফোন করে...কখন ফিরবি? খাবি তো?

            বাবা আজ বারবার পেছন থেকে ডাকছিলো..বারণ করছিলো।কিন্তু তারপর এত চুপচাপ কেন?

         ফোনটা বেজে ওঠে অহনা ফোন করে..." তুই এখন কোথায়? সকালে ফোন ধরছিলি না কেন?"
             বাচ্চা ছেলের মত অঙ্কিত বলে," আমি বাবাকে অনেক কথা বলেছি যা মনে এসেছে তাই রাধিকা মাসিকে অপমান করেছি। রাগ করে চলে বাইরে চলে এসেছি?"

         অহনা ভীষণ উৎকন্ঠিত.." অঙ্কু কুল ডাউন,তুই কোথায়? আঙ্কেল কোথায়? আমার ভীষণ রাগ হচ্ছে কিন্তু। দ‍্যাটস আনফেয়ার।এক্ষুনি এক্ষুনি বাড়ি যাবি। আমি আর কিছু শুনতে চাইনা। নাহলে আমি চলে যাবো তোর বাড়ি?"

           ঠিক যেন ওর মায়ের মত বকছে ওকে অহনা।
          " তোকে আসতে হবেনা,আমি যাচ্ছি। সত‍্যিই মনে হচ্ছে আমি বাড়াবাড়ি করেছি।এতটা রিঅ্যাক্ট করাটা ঠিক হয়নি আমার।"

       " তুই এখনই যাবি,আমার খুব ওরিড লাগছে। কেন যে লাইফকে এত কমপ্লিকেটেড করছিস কে জানে? আই মিস ইউ ডিয়ার ট্রায়িং টু ফিল ইউ। তুই যা,পরে কথা বলবো।"

           *****************

তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে পা বাড়ায় অঙ্কিত প্রায় সাড়ে তিনটে বেজে গেছে। দুপুরের খাওয়াটাও যে হয়নি তাও মাথায় নেই। দরজাটা ঠেলতেই খুলে যায় বাবাকে দেখতে পায়না অঙ্কিত,বুকটা অদ্ভুত কাঁপতে থাকে। মায়ের ঘরের দরজাটা অল্প ভেজানো...দরজা খুলতেই একটা কথা শুনতে পায়,মায়া তুমি তো সবটাই জানো। আমি আর পারছিনা।

            পেছন থেকে এসে বাবার ঘাড়ে হাত রাখে অঙ্কিত..সরি বাবা।

বাবা ওকে জড়িয়ে ধরে। অনেকদিন বাদে বাবার চোখে জল দেখলো অঙ্কিত কেন যেন খুব অপরাধী লাগছে নিজেকে। সত‍্যিই তো বাবা তো ওর থেকেও একা,যে চলে গেছে সে তো আর ফিরবেনা।

             ফোনটা বাজে আবার.. বাবা বলে," ফোনটা ধর তোর বন্ধু বোধহয় ফোন করেছে।"

       " তুমি টেবিলে যাও আমি আসছি,খুব খিদে পেয়েছে।"বলে অঙ্কিত।

   অহনা ফোনে বলে.." হ‍্যালো, শুনতে পাচ্ছিস? আঙ্কেল ঠিক আছে? এক্ষুনি সরি বল। মা বাবাকে কখনো কষ্ট দিতে নেই। মা বাবার চোখের জল ফেলাতে নেই অমঙ্গল হয়।"

        অঙ্কিতের তখন মনটা অনেকটা ভালো.." এই যে পাকাবুড়ি ঠাকুমা এবার চুপ কর অনেক জ্ঞান দিয়েছিস।কেন যে আমার একটা বোন হলোনা তাহলে বাবাকে আগলে রাখতো। আচ্ছা আমি খাবো এখন ভুখা আছি তো।"

     " হম্ সিওর, একসাথে খা দুজনে তুই সার্ভ করে দে আঙ্কেলকে।"
         
         টেবিলে এসে দেখে বাবা খাবার বাড়ছে।
   " তুমি বোসো আমি দিচ্ছি খাবার। " অঙ্কিত বলে।

  " তুই বোস আমি নিজে না দিলে মন ভরবেনা আমার।"
  অঙ্কিত দেখে বাবা রাধিকা মাসির পাঠানো খাবারগুলো একপাশে সরিয়ে রাখে,ওদের বাড়ির রান্না করা খাবার থালা আর বাটিতে সাজাচ্ছে রান্নাঘর থেকে এনে।

         অঙ্কিত মাইক্রোওভেনে মোচার চপগুলো গরম করে,অবাক হয়ে দেখে শান্তনু।

      " বাবা, পোস্ত আর বিউলির ডালটা দাও। অনেকদিন খাইনি।"
             শান্তনু বলে," থাক ওগুলো, বিকেলে কুন্তী এলে ওকে দিয়ে দেবো। তুই বরং এই দইমাছটা খা। "
         বুঝতে পারে খুব অভিমান হয়েছে বাবার তাই বাবাকে আর কিছু না বলে নিজেই তুলে নেয় পাতে।
            " অনেকদিন বাদে খেলাম,তুমি বলে দিয়ো আমি খেয়েছি।"

      শান্তনুর ইচ্ছে হলো বলতে.. তুইও বলতে পারিস। না থাক কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।

             টুকরো টুকরো কথায় একটু করে সরে যায় মনের মেঘ। রাধিকার জন‍্য খুব খারাপ লাগে শান্তনুর অযথা অপমানিত হলো বেচারা। হয়ত কোন ভোর থেকে উঠে রান্না করে এনেছে।খুবই ব‍্যস্ত থাকে সারাদিন। ওকে একটা মেসেজ করে দিতে হবে অঙ্কু নিজে গরম করে সব খেয়েছে আর ভালো বলেছে।

**********************

     সেদিনটা আর বাইরে বেরোতে ইচ্ছে করেনা,অহনাও তাই বলেছে আরেকটু বেশি সময় বাবাকে দিতে। দেখতে দেখতে একটা সপ্তাহ কেটে গেলো আর তো একটা সপ্তাহ হাতে। অনেকদিন বাদে একসাথে পাশাপাশি বসে টিভি দেখা আর দেখতে দেখতে একটু গল্প আর কফি খাওয়া।
          একটা ঝড়ের পর আজ যেন পরিস্কার আকাশ। বাবা বলে," অহনাকে বলেছিস আসতে একদিন বাড়িতে?"
     " ও ব‍্যস্ত থাকে,আমি বলেছি তবুও। হয়ত আসবে কোনদিন।"

     " মেয়েটা মনে হয় ভালো আসলে কি জানিস সবার একটা ভালো বন্ধু দরকার হয়।
এমন বন্ধু যে তোর পাশে থাকবে তোকে বুঝবে। তোর দুঃখের দিনগুলোতে আগলে রাখবে।
আর ছোটবেলার কিছু বন্ধুত্ব আলমারিতে রাখা গয়নার বাক্সের মতো।
খুললেই মন ভালো হয়ে যায়।"

          " হ‍্যাঁ অহনা খুব ভালো মেয়ে। তবে খুব ঝগড়ুটে আমাকে বকাঝকা করে এখনো সেই ছোটবেলার মত। "
        শান্তনু বুঝতে পারে ঐ ঝগড়ুটে বন্ধুটাই হয়তো তার ক্ষ‍্যাপা ছেলেটাকে আজ বুঝিয়ে বাড়ি ফিরিয়েছে।

     অহনাকে এখন না দেখলেও রাধিকার বর্ণনা আর ছোটবেলার কিছু স্মৃতি মিলিয়ে কল্পনা করে নেয় শান্তনু।

          রাতে আজ আর রাধিকাকে ফোন করেনা আসলে রাধিকার ব‍্যস্ত জীবনে ঐ সময়টা একটু নিজের মত কাটায়। শান্তনুর কাছ থেকে একটা ফোন আশা করেছিলো রাধিকা। সকালের পর ওরও মনটা ভালো ছিলোনা কি হলো কে জানে?

          সারাদিন ফোন করেনি ছেলে আছে বলে। হঠাৎই মেসেজ ঢোকে সাথে কয়েকটা ফাঁকা পাত্রের ছবি..." চেটেপুটে খেয়েছে ছেলে আমিও প্রসাদ পেয়েছি। আর মোচার চপ নিজেই গরম করে খেয়েছে। সন্ধ‍্যেবেলাও খেয়েছে। খুব ভালো হয়েছে তোকে বলতে বলেছে। যদি একটু নিজে বলতো তাহলে আরো ভালো হত।"

       " সত‍্যিই সব কেমন হয়ে যায় বল। অথচ এই অঙ্কুর প্রতিদিন একটা করে ক‍্যাডবেরি আমার কাছ থেকে না নিলেই চলতোনা। মায়া রাগ করতো বলতো দাঁতে পোকা হবে। আমি বলতাম মুখটা ধুইয়ে দে নাহলে জল খাইয়ে দে।"

             ****************

  আজ অহনাকে একটু মেসেজ করেই ঘুমিয়ে পড়ে অঙ্কিত শরীরটা খুব ক্লান্ত হয়ে গেছে মনে হচ্ছে একটা অনেক বড় ঝড় বয়ে গেছে ওর মনের আর শরীরের ওপর দিয়ে। বাবারও হয়ত মনটা ভালো নেই হিসেব করে দেখে আর একটা সপ্তাহ হাতে।

এই একটা সপ্তাহ নো নেগেটিভ ভাইব অনলি পজেটিভিটি বাবাকে সময় দেবে আর অহনাকে নিয়ে চরকিবাজি তার মধ‍্যেই পুরোনো বন্ধুদের সাথে একদিন দুদিন মোলাকাত হবে। দেখা যাক অহনা কি বলে। খোলা জানলা দিয়ে বসন্তের ফুলের হাল্কা সুবাস আসছে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের মধ‍্যেই যেন মনে হয় বাবা সেই ছোটবেলার মত মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আদর করে।
                       সকালে সূর্যের উঁকিঝুঁকির লালচে আলো চোখে লাগতেই ঘুমটা ভেঙে যায়। এদিক ওদিক দেখে বাবাকে দেখতে পায়না।নিশ্চয় ছাদে গেছে বাবা। আস্তে আস্তে ছাদে উঠে আসে,সূর্যের কিরণের নরম আদরে মাখা আদুরে গাছগুলোতে বাবা জল স্প্রে করছে। পাশে এফ এমে গান বাজছে আজি দখিন দুয়ার খোলা এসো হে এসো হে এসো হে আমার বসন্ত এসো।
            " আচ্ছা বাবা এখন তো বসন্ত তাইনা? আচ্ছা দোল কবে?"
          " মনে হয় সামনের সপ্তাহেই আছে রে আমার ওগুলো আজকাল মনে থাকেনা। তোর মা মনে রাখতো।"
     " তুমি রঙ খেলোনা?"

     " আমি আবার কি রঙ খেলবো?
      আমি বাচ্চা নাকি?
     আগে তোর মা ঠাকুরকে দিতো ঐ নিয়মরক্ষা করি আর কি?

    একটু ইতস্ততঃ করে জিজ্ঞেস করে.." রাধিকা মাসির ওখানে যাও না? ওখানে তো দোলে বেশ কৃষ্ণঠাকুরের পুজো ভোগ এইসব হয়। আগে আমরা সবাই গেছি একসময়।"

               "গতবছর যাইনি শরীরটা ভালো ছিলোনা জ্বর হয়েছিলো।
এ বছর দেখি এখনো ভাবিনি তাছাড়া তুই থাকবি তো সেসময়।
নাহ্ যাবোনা রে,তোকে বরং একটু মালপোয়া ভেজে দেবো।
তবে রাধিকা ঠিক প্রসাদ পাঠিয়ে দেবে ওর ড্রাইভার মন্টুকে দিয়ে।"

        " আমি আছি তো কি আছে বাবা? তুমি ঘুরে এসো রাতে একবার।"

    আশ্চর্য লাগে শান্তনুর ছেলের কথা শুনে। রাধিকাকে নিয়ে যার এতো সমস‍্যা সে হঠাৎই রাধিকার বাড়িতে ওকে পাঠানোর জন‍্য জোরাজুরি করছে! কখন যে এদের কি হয় কে জানে? অদ্ভুত খামখেয়ালী আর মেজাজী ছেলে একটা। খুব ভালো একটা মেয়েকে যদি জীবনসঙ্গী হিসেবে পায় তাহলেই ভালো।নাহলে হয়তো ঝগড়া করেই কাটবে ওর জীবন। তবে রাধিকা যখন বলেছে অহনা ভালো মেয়ে তখন এমন একটা মেয়ে যদি ...তবে সত‍্যিই তো ও বাইরে অহনা এখানে। কি সব যে মনে হয় মাঝে মাঝে যাক যা হয় হবে।

            ছাদে কিছুক্ষণ বসে থেকে আনমনা লাগে অঙ্কিতেরও অহনাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে।অদ্ভুত একটা শান্ত নদীর মত মেয়েটা। শান্ত বললে ভুল হবে,মেজাজী অথচ স্থির। ঝগড়ুটে অথচ ভালোবাসতে পারে। কি জানি আজ কখন ওর সময় হবে?

      বাবা একমনে গান শুনতে শুনতে গাছের আদর যত্নে ব‍্যস্ত। হঠাৎই বলে..." আজ ভবেনের দোকানের ডালপুরী খাবি? আনবো? সাথে গরম জিলিপি?"
      সত‍্যিই একটা সময় কত বায়না ছিলো ওটা খাবারের জন‍্য।
    " বাবা একদম না,আমিও খাবো না তুমিও না।"

       দুজনেই হেসে ফেলে এবার।অনেকদিন বাদে এমন করে হেসে বাবার সাথে কথা বলছে অঙ্কিত।
    
ওর ফোনে টুং করে শব্দ হয়,বাবার চোখদুটোতে একটা হাসি দেখে।

        " আজ কোথাও যাবিনা?"

" কেন আমাকে বিদায় করতে পারলে তোমার ভালো লাগে?
চলো আজ বরং দুজনে একটু ঘুরে আসি সকালে। তোমার সাথে বাজারে যাই,কি কি লাগবে তোমার কিনে দিই।"

           বাবার চোখদুটো অদ্ভুত হেসে ওঠে আনন্দে.." তাহলে অহনাকেও ডেকে নে।"

       " তুমিও তাহলে রাধিকা মাসিকে ডেকে নাও। ভালোই হবে চারজনে ঘুরে আসি।"

       ছেলের কথাটা ঠিক বুঝতে পারেনা শান্তনু একটু অবাক হয়।তাই একটু থেমে বলে.." ওর সময় হয়না সারাদিন। রাত্রিবেলা একটু ফ্রী থাকে এগারোটার পর।"

                মজা করেই কথাটা বলেছিলো ও জানে অহনাও যেতে পারবেনা এখন। ঠিক তাই হলো,অহনা বললো বিকেল হবে ফ্রী হতে। তাই অনেকদিন বাদে বাবাকে নিয়ে বেরোলো। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে একেবারে ফেরা বাড়িতে অবশ‍্যই ডালপুরীও খাওয়া হলো। বাবার মনে হচ্ছে ওকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পেরে আকাশের চাঁদ পাওয়া হয়ে গেছে ।কতজনের সাথে পথে কথা বললো ওকে দেখালো । মনটা খুব ভালো দুজনেরই।

********************

     অঙ্কিতের ফেরার দিন এসে যাচ্ছে অহনাকে বলেছে এই কয়েকটা দিন একসাথে সময় কাটাবে ওর সুবিধা মত।

                হাল্কা আকাশী টিশার্ট আর সাদা জিন্সে অহনা এসে দাঁড়ায় সামনে, হাতে একটা ঢাউস ব‍্যাগ। একদম তোর তাড়াতে হস্টেলে বন্ধুর রুম থেকে চেঞ্জ করে চলে আসছি।
              অনেকদিন বাদে আজ নিজের অত‍্যন্ত প্রিয় বাইকটা নিয়ে অহনাকে নিতে একদম ওর কলেজের গেটে এসেছে।
        " ওরে একদম তো হিরো হিরো লাগছে রে।"

      " হতেই হলো জিরো থেকে হিরো তোর জন‍্য।বাড়ির গাড়িটা না চালিয়ে গেছে ব‍্যাটারীটা।"

             অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয় অহনার অঙ্কিতের পিঠে হাত রেখে বসে মন ছুটে যায় তেপান্তরের পথে। একদম বাঁধনহারা মন ছুটেছে আজ,অঙ্কিতের হাসিমুখেই আজ যেন মুক্তি অহনার। খুব হাল্কা লাগছে অঙ্কিতকে যেন একটা ভার নেমে গেছে ওর মন থেকে। তাই শুধু মিষ্টি কথার রেশটুকুই ছুঁয়ে আছে দুজনকে।

          অহনার সঙ্গে এই প্রথম এইভাবে  নিজের পুরোনো বাহনে বসে মুক্তির আশ্বাস পায় অঙ্কিত।

        অহনা প্ল‍্যান করেই রেখেছিলো গঙ্গাতে ক্রুজে বসে কিছুক্ষণ বসে বিকেলের পাখিদের ঘরে ফেরা আর সূর্যাস্ত দেখবে।
   গঙ্গার বুকে ভেসে ভেসে ওদের ক্রুজ এগিয়ে চলে সামনাসামনি টেবিলে বসে অহনা বলে.." একদম কুল হয়ে শুধু মনকে ভাসিয়ে দে আজ গঙ্গার ঢেউয়ের সাথে।
দেখবি খুব ভালো লাগবে।"

গঙ্গার ঠান্ডা হাওয়া আর সূর্যাস্ত মনকে ভরিয়ে দেয় অঙ্কিতের। অহনা ওর খুব কাছে দাঁড়িয়ে,ওর কাঁধে হাত রাখে অঙ্কিত। একটা ভালো লাগার স্পর্শ ছুঁয়ে থাকে অহনাকে। এমন ভালোলাগার স্বাদ হয়ত এর আগে পায়নি। আসলে ভালোলাগা আর ভালোবাসা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

       চুপটি করে ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে অহনা একমনে অনুভব করে ভালোলাগার মুহূর্তগুলো। সূর্য আস্তে আস্তে তার লালচে রঙ গুলে দিলো গঙ্গার জলে। অঙ্কিত মোবাইলে বন্দি করতে চায় দৃশ‍্যটাকে অহনা ওর হাতটাকে ছুঁয়ে বলে সব কিছু ছবিতে রাখতে নেই মুহূর্তগুলোকে যত্নে সাজিয়ে নে মনে। ওখানে যখন চলে যাবি,আমি থাকবো অনেক দূরে তখন কোন এক অলস বিকেলে মনে পড়বে আজকের এই বিকেলটার কথা।

কথায় কথায় ঠিক সন্ধ‍্যের মুখে ক্রুজ এসে পৌঁছলো বেলুড়মঠে। অঙ্কিতকে নিজের মধ‍্যে কিছুক্ষণ ডুবে যেতে দেয় অহনা।
           ক্রুজ থেকে নামে অন‍্যদের সাথে ওরাও।অঙ্কিত অহনার হাতটা ধরেছে ওর হাতের মুঠোয়।
   একটু বাদেই আরতি হবে..একটা শান্ত জায়গা দেখে বসে পড়ে ওরা। অহনা চোখ বন্ধ করেছে অপূর্ব সুন্দর লাগছে ওর এই প্রশান্ত সুন্দর মুখটা,কিছুক্ষণ চোখ বুজতে পারেনা অঙ্কিত তারপর আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ করে। এক অদ্ভুত প্রশান্তি নেমে আসে ওর মন জুড়ে, মনে হয় শরীর মন এক পবিত্রতায় ভরে আছে।

         আরতি শুরু হয় ওরা উঠে দাঁড়ায়।এর আগে কোনদিন এভাবে বেলুড়মঠের আরতি দেখেনি অঙ্কিত। সত‍্যিই এত সুন্দর শান্ত একটা সন্ধ্যা ওকে আজ দেখালো অহনা ওর পরিচিত শহরকে চেনালো নতুন করে।
                 স্বামী বিবেকানন্দের একটা বই আর একটা বড় প‍্যাকেট ধূপ ওর হাতে দেয় অহনা।
    " এটা সাথে রাখিস সব সময় আর ধূপটা আঙ্কলকে দিস ঠাকুরের সামনে দেবে।"

        অহনাকে নামিয়ে দিয়ে বাড়ি আসে অঙ্কিত একটা অদ্ভুত মন ভালো করা অনুভূতি ছুঁয়ে আছে ওকে। বাবা টিভি দেখছিলো, বাবার হাতে ধূপটা দেয়। শান্তনুর অবাক লাগে..
   " কি দেখছো?"

    " মানে তুই এগুলো নিয়ে এলি কোথা থেকে?"

   বেলুড় মঠে গিয়েছিলাম অহনা দিয়েছে তোমার জন‍্য।"
           বাবার অবাক হয়ে তাকায়.." বেলুড় মঠে গিয়েছিলি? খুব ভালো, আগে জানলে আমিও যেতাম।"
         অঙ্কিত উচ্ছ্বসিত হয়ে বলতে থাকে ক্রুজের অভিজ্ঞতার কথা। ছেলের মুখের হাসিটা ছুঁয়ে যায় শান্তনুকে। অঙ্কিত বলে," তোমাকে নিয়ে যাবো।"
      " আচ্ছা যাবো,এর পরের বার আয় তখন। এবার নিজের মত এই কয়েকটা দিন আনন্দ কর।"
              " সবাই মিলে আমরা যাবো তখন,রাধিকা মাসি আর অহনার বাবা মাকেও নেবো সাথে।"
         ছেলেটাকে আনন্দে থাকতে দেখে ভীষণ ভালো লাগছে শান্তনুর। বাড়ির গুমোট আবহাওয়া কেটে গিয়ে বসন্তের মিষ্টি বাতাস ঢুকেছে জানলা দিয়ে।
      
******************
      বাড়ি এসে আজ মনটা ভীষণ খুশি লাগে অহনার বাতাসে শুধুই প্রেম প্রেম মিষ্টি গন্ধ। তবে সময় ঘড়ির কাঁটা চলেছে এগিয়ে হাতে আর মাত্র কয়েকদিন তারপর এই একলা শহরে তুই থাকবি আমার মন জুড়ে।হাসি পায় অহনার প্রেমে পড়লে বোধহয় কবিতা আসতে থাকে মনের সিঁড়ি বেয়ে।

         অঙ্কিত ফোন করেছে...." বল,ঠিক আছিস তো? আঙ্কেল ঠিক আছে?"
            " হুঁ বাবা খুব খুশি হয়েছে রে ধূপ পেয়ে। এরপর যখন আসবো তখন সবাইকে নিয়ে যাবো বেলুড়ে।"
    অহনা হাসে.." সবাই কে?"
  " বাবা, রাধিকা মাসি, আঙ্কেল আন্টি আর তুই আমি তো কমন। কোথায় যাচ্ছি আমরা আবার কাল? মানে কাল দেখা হবে তো?"
      " হোপ সো দেখছি। তুই বল কোথায় যাবি?"
    ' যেখানে তুই নিয়ে যাবি? একদম চোখ বন্ধ করে চলে যাবো।"..বলে অঙ্কিত।

       " তাহলে চোখ বন্ধ করে চলে আসিস ঠিক দুটোতে। কাল একটু তাড়াতাড়ি বেরোবো। কাল একসাথে খাবো বুঝলি।"

         কথার খুনশুটিতে রাত হয়ে যায়। সকালে বাবাকে বলে.." আজ দুপুরে খাবোনা বাবা,তুমি অপেক্ষা কোরোনা খেয়ে নিয়ো ঠিক সময়ে আমি সন্ধ‍্যের পর চলে আসবো।"
          শান্তনুর অবাক লাগে অঙ্কিতকে দেখে,অনেকদিন বাদে আবার চেনা সুরে কথা বলছে ছেলেটা।
                      অহনাকে আজ আর বলতে হয়নি একদম দুহাতে অঙ্কিতকে ধরেছে,বেঁধেছে ভালোবাসার শক্ত বাঁধনে। বাইপাস ধরে চলেছে অঙ্কিত ওখানে একটা হোটেলে দুপুরের খাওয়া সেরে নেয় ওরা।
      " উফ্ বুফেতে এত খাবার আজকাল আর খেতে পারিনা।"অঙ্কিত বলে।

        অহনা হেসে বলে..." ভুখা ভুখা অঙ্কু আস্তে আস্তে খাও ধীরে ধীরে বাচ্চা।"

******************

        এই কদিন অহনা ট্রামলাইন ধরে কখনো ময়দানের পথে হেঁটেছে অঙ্কিতের হাত ধরে। কখনো গাছের তলায় চুপ করে বসে নির্জনতার চুপকথা শুনেছে আবার কখনো ওর মিঠে গলায় গেয়েছে....' চল রাস্তায় সাজি ট্রামলাইন আর কবিতায় শুয়ে কাপ্লেট।
আহা উত্তাপ কত সুন্দর তুই থার্মোমিটারে মাপলে।
হিয়া টুপটাপ জিয়া নস্টাল মিঠে কুয়াশায় ভেজা আস্তিন।
আমি ভুলে যাই কাকে চাইতাম আর তুই কাকে ভালোবাসতিস।'

      "কাকে আবার ভালোবাসবো...তোর চোখ দিয়ে দেখা এই উত্তাপ মাখা শহরটাকে আর অবশ‍্যই সেই চোখ দুটোকে যারা চেনালো ভালোবাসতে,দুঃখ ভুলে যেতে আর ভালো থাকতে।"

       " কি সুন্দর কথা বললি রে অঙ্কু। একদিন এক টুকরো কাগজে লিখে দিস আমার ডাইরির ভাজে রেখে দেবো। তুই যখন থাকবিনা তখন দেখবো।"

        বলতে বলতে গলাটা একটু ধরে যায় অহনার। অঙ্কিতের ঘাড়ে মাথা রাখে ও।

       " কি ভালো গান গাস রে তুই? কই এর আগে তো শোনাসনি?"

     " বাবা কদিন যা রাগী রাগী মুখে আসতিস! গান আসে নাকি তখন? গান আসে মন যখন ভালোবাসায় ভেসে যায়। আচ্ছা তোকে এরপর মাঝে মাঝে ফোনে শুনিয়ে দেবো।"

      অহনা যখন ট্রামলাইনে হাঁটতে হাঁটতে গানের ভেলায় ভাসছিলো তখন সবুজ ভেলভেট ঘাসে পা দিয়ে অঙ্কিত গানটা রেকর্ড করে নিয়েছিলো মুহূর্তটাকে বন্দি করতে।

অহনার স্বপ্নিল চোখ অঙ্কিতের হাত ধরে কখনো ডুবেছে ভিক্টোরিয়ার সবুজে,কখনো প্রিন্সেপঘাটে পাশাপাশি বসে চুপ করে দেখেছে সূর্যোদয় একদম ভোরবেলা উঠে। তারপর পাঞ্জাবী ধাবায় গরম গরম চা খেয়ে ভোরের বাতাস গায়ে মাখতে মাখতে অহনাকে নিয়ে উড়ে যাওয়া বসন্তের রঙ ছড়ানো পথ দিয়ে।
           ছেলের কান্ড কারখানা দেখে শান্তনু বুঝতে পারে কিছু কিছু,মানে ছেলেটা প্রেমে পড়েছে। আর সেদিন যখন রিংটোন বাজলো...চল রাস্তায় সাজি ট্রামলাইন আর কবিতায় শুয়ে কাপ্লেট বার বার করে আর স্ক্রীনে ঘাসের ওপর স্কার্ট পরা একটা মেয়ের হাসিমুখ ভেসে উঠলো শান্তনুর মুখে একটা হাসি ফুটে উঠলো।
রাধিকাকেই বলতে হবে একদিন অহনাকে দেখতে চায়। এই পাজি ছেলেটা তো আনলোই না বাড়িতে। অঙ্কিতকে যে এতোটা পাল্টালো সেই ইয়ঙ্গ লেডি ডাক্তারকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে শান্তনুর।

     অঙ্কিত বাথরুম থেকে বেরোতেই বলে," তোর ফোন বাজছিলো।কি মিষ্টি একটা গান করেছিস রে রিংটোন!"
      " বাবা এটা অহনা গাইছিলো কাল আমি রেকর্ড করে নিয়েছি বললো একটা সিনেমার গান।"
          " খুব ভালো গান গায় তো মেয়েটা!"

" হ‍্যাঁ খুব ভালো গান গায় আর অনেক কিছুই ভালো করে। আমার মত এমন বখাটে নয়।"

        অঙ্কিতের মাথায় হাত রাখে শান্তনু.." কি যে বলিস! এবার খুব মন খারাপ হবে আমার।আবার তাড়াতাড়ি আসিস এই ফাঁকা বাড়িটাতে মন টেকেনা। রাধিকা বলেছিলো কোন ওল্ডএজ হোম দেখতে। ওকে বকে দিয়েছি আসলে মায়ার মমতা মাখা বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাবো?"

      বাবার কথা শুনে মনটা খারাপ হয় অঙ্কিতেরও সত‍্যিই বোধহয় বার্ধক‍্য একটা অভিশাপ আর তারসাথে যদি একাকীত্ব মিলে যায়।
          " আমার সাথে যাবে ওখানে? দুজনে থাকবো একসাথে।"

     " সেই তো বাড়িটা পড়ে থাকবে অযত্নে।যতদিন আছি আগলাই।"
       বাবাকে এবার বকে অঙ্কিত "কি বয়েস হয়েছে তোমার যে এসব বলছো? সবেই তো রিটায়ার করলে। পরশু দোল মনে আছে তো তারপরের পরের দিন আমার চলে যাওয়া। আর দোলের দিন তুমি রাধিকা মাসির বাড়ি যাবে।"

          শান্তনুর ফোনটা বেজে ওঠে..." তুই অনেকদিন বাঁচবি। এক্ষুণি তোর কথা হচ্ছিলো।"

       " অঙ্কু আছে? আগে ওকে ফোনটা দাও।ওর সাথে কথা বলে তারপর তোমার সাথে কথা বলবো। "
        শান্তনু ফোনটা এগিয়ে দেয়..খুব ভদ্রভাবেই না করলো অঙ্কিত আসলে কদিন আগেই যাকে অপমান করেছে তার বাড়িতে পুজো দেখতে যাওয়া! মেলাতে পারেনা অঙ্কিত। তবে বললো.." আমার একটু বন্ধুদের সাথে গেটটুগেদার আছে। বাবা যাবে অবশ‍্যই। আমি যাবার আগে এসো দেখা হবে।"
              অঙ্কিত জানে ও না বললেও রাধিকা মাসি আসবে ঠিক আর সাথে কিছু উপহার থো থাকবেই।

        ফোনটা ছাড়তে শান্তনু রাগ করে.." তুই কেন বললি বাবা যাবে। আমার ইচ্ছে করছেনা তোকে রেখে যেতে।"
        " যাও প্লিজ, আমি যাবো প্রমিস অন‍্য সময়।"

       ******************

       আগামীকাল দোল,অঙ্কিত চলে যাবে বলে অহনা দুদিন ডিউটি চেঞ্জ করেছে ওর ইচ্ছে যতটা থাকা যায় একসাথে।

           অহনা আজ গাড়ি নিয়ে এসেছে থ্রী কোয়ার্টার জিন্স আর একটু ঢিলে টপে আজ ড্রাইভারের সীটে সত‍্যিই ভীষণ সুন্দর লাগছে অহনাকে। অঙ্কিত বলে.." তোকে আজ সমুদ্র সুন্দরী লাগছে।"

       অহনা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে.." এখন সাড়ে ছটা সমুদ্দুরে যাবি?"
        " মানে! সেতো অনেকটা!"
    অহনা মাথা ঝাঁকায় ওর কোঁকড়া চুলগুলো দস‍্যি হয়ে চোখে মুখে পড়ে।

        " মাকে বলা আছে। আঙ্কেলকে প্লিজ বলে দে সন্ধ‍্যের আগেই ফিরবো। খুব দেরি হবেনা।"

     অঙ্কিত ফোন করাতে শান্তনু একটু চিন্তাতেই পড়ে.." সে কি অতদূরে যাবি হঠাৎ।এই তো বললি কাছাকাছি কোথাও থেকে ঘুরে আসবি।"

       " আর কি বাবা পাগলীর বায়না যাই দেখি কতটা যাওয়া যায়।"
           অহনাকে সরিয়ে ড্রাইভিং সীটে বসেছে অঙ্কিত ঠিক হয়েছে দুজনে কিছুটা কিছুটা করে চালাবে। গাছের সারি ছাড়িয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে হাইওয়ে ধরে মন্দারমণির দিকে।
                 জানলা দিয়ে আসা ঠান্ডা বাতাস মুখে মাখে অহনা...মিউজিক অন করে দেয় বাজতে থাকে ওর পছন্দের গান...
       
       

            
               
  
    
                 

        

             
                
    

     

        
       
      
       
               

                  

     

   

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...