শান্তনু বলতে শুরু করে..." অমিত আসাতে আমাদের স্কুলে আমারও একটু হিংসা হয়েছিলো বুঝলি মানে আসলে রাধিকা আমার ক্রাশ ছিলো। ভালো লাগতো ওকে,কিন্তু ও আমাকে পাত্তা দিতোনা।বোধহয় ছেলে বলেও ভাবতোনা কখনো। সেই রাধিকা প্রেমে পড়লো অমিতের, অমিতটা ভীতুর ডিম ছিলো।সোজা রাধিকাকে না করে দিয়েছিলো প্রথমে বড়লোকের মেয়ে বলে।
গরীব বড়লোকের একটা প্রাচীর তুলে গুটিয়ে থাকতো। কিন্তু রাধিকাকে জানিস তো ও সব কিছু গায়ে মাখেনা তাই পুরো শিং দিয়ে গুঁতিয়ে ঢুকে গেলো প্রেম যুদ্ধের ময়দানে আর ভাসিয়ে নিয়ে গেলো অমিতকে।
আর এতো বাজে মেয়ে সব প্রেমের গল্প এসে আমাকে করতো। বললামনা কোনদিন আমার যে একটা ছেলে ছেলে মন আছে ভাবেইনি।
আর কি সবাই প্রেম করছে দেখে আমিও খুব প্রেমিক হয়ে উঠলাম মায়াকেই প্রপোজ করে ফেললাম শেষে।"
অঙ্কিত বাবার গা ঘেঁষে চুপ করে বসে হাসে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বাবা যেন গল্প করতে করতে একদম বাচ্চা ছেলে হয়ে গেছে। মুখে হাসি আর আনন্দের ভাবসাব।
শান্তনু বলে যাচ্ছে তারপর মোটামুটি ইলেভেনেই সব টপাটপ প্রেমে পড়েছি নতুন নতুন। রাধিকা ডানপিটে,মারকুটে আর মায়া ঠিক উল্টো একদম ঘরোয়া শান্ত ছোট থেকেই গিন্নী বান্নী ভাবসাব। রাধিকা অমিতকে বলতো...'আমি বাপু ঐ সব একহাত ঘোমটা টেনে বৌ সাজতে পারবোনা।'
অমিত বলতো..' তাহলে আমার গলায় ঝুললি কেন শুনি জোর করে, বিয়েই যদি করবিনা। '
দাঁড়া আগে বড় হই,শাড়ি সামলাতে পারি তবে বিয়ে করবো। তার আগে ডাক্তার হতে হবে তো।'
আসলে রাধিকার বাবা ভীষণ ঠাকুর বিশ্বাসী উনি নাকি গণনা করে দেখেছেন যে রাধিকার বৈধব্যযোগ আছে। তাই দোষ কাটাতে অনেক ছোটবেলায় কৃষ্ণের সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন রাধিকাকে।"
অবাক হয়ে যায় অঙ্কিত," কৃষ্ণের সাথে বিয়ে হোয়াট!"
" হ্যাঁ কুসংস্কার হয়তো সবটাই, যাক্ সে কথা।"
অঙ্কিত বলে.." রাধিকা মাসি কি উইডো? মানে অমিতকাকু যখন নেই তাহলে তো?"
শান্তনু হেসে ওঠে..." রাধিকা একদম পারফেক্ট সধবা, ও কোনদিন বিধবা হবেইনা। আরে আমাদের কেষ্টঠাকুরও অমর আর রাধিকার সিঁদুরও অক্ষয়। যদিও ও সিঁদুর পরেনা।"
" তাহলে অমিতকাকুর সাথে কবে বিয়ে হলো ?"
" কি আশ্চর্য দেখ অমিতের সাথে রাধিকার বিয়েই হলোনা অথচ অমিত মারা গেলো।"
"মানে?"
অবাক হয়ে যায় অঙ্কিত।
**********************
"আমাদের প্রেমের শুরু প্রায় কাছাকাছি মানে আগে রাধিকা প্রেম শুরু করলো আমি প্রথমটা খুব রাগ করলাম মনে মনে। ওর প্রেম দেখে আর গল্প শুনে আমারও ইচ্ছে হলো তোকে তো বলেছি।
হ্যাঁ রে অঙ্কু আমি যে এভাবে গল্প করছি তোর খারাপ লাগছেনা তো? আর এখন তো বাপ বেটা আমরা বন্ধুর মতই খারাপ লাগবেই বা কেন?"
অঙ্কু কুশনটা কোলে নিয়ে পা ছড়িয়ে আরাম করে বসে। বাবা যেন আজ মনের দরজার তালা খুলে দিয়েছে আর তার থেকে বেরোচ্ছে অতীতের কত ভালোবাসা ভরা গল্পকথা। অঙ্কিত ছবির মত দেখছে সবটা..." তুমি বলো বাবা বেশ ভালো লাগছে। এতদিন বলোনি কেন? মাও মজা পেতো শুনলে।"
" তখন ছোট ছিলি তাই বলিনি তবে এখন না বললে মনটা হাল্কা হচ্ছেনা। তা আমাদের সময় তো ঐ ফোন টোন ছিলোনা।যা কথা হত চিঠিতে,তোর মা তো আবার তোর দাদুর ভয়ে আমার ভালোবাসার চিরকুট পুড়িয়ে ফেলতো।
রাধিকার বাবারও খুব একটা পছন্দ ছিলোনা অমিতকে। চালচুলো নেই মামাবাড়ির আশ্রিত বলে।তবে রাধিকা খুব একরোখা ছিলো। তাই তো ভালোবাসাতে পাগল হলেও নিজের মাটি ছাড়লোনা রাধিকা, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অমিতের চেয়ে বেশি নম্বর পেলো। ডাক্তারিতে সুযোগও পেলো। অমিত ভালো ফল করলেও ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ পেলোনা। রাধিকা খুব কেঁদেছিলো সেদিন এই ভেবে যে আর তো এক স্কুলে থাকা হবেনা, এবার কলেজে যাওয়া অমিতের পড়া শুরু হলো কাছাকাছি কলেজে।যথারীতি আমি আর তোর মাও তাই।
আর রাধিকা যাবে কলকাতাতে পড়তে।
ছুটি খুব একটা থাকতোনা।তবুও ছুটি পেলেই অমিতের কাছে চলে আসতো রাধিকা।
অমিত এমএসসি করতে গেলো তবে রাধিকার সময় লাগলো ডাক্তারি পাশ করতে। তবে এর মধ্যে প্রেমটা টিকে থাকলো কখনো চিঠিতে কখনো বা মুখোমুখি আলাপে। আমি আর মায়াও তখন উড়ে বেড়াচ্ছি। যথারীতি তোর দাদুর উৎপাতে মায়ার আর পড়া হোলনা বিয়ে পাশ করে। আমাদের কাজ ছিলো মায়ার সম্বন্ধ এলেই ভাঙানি দেওয়া। কি না করেছি কম বয়েসে। আবার কত ঝগড়াও করেছি।"
অঙ্কিত অবশ্য বাবা মাকে ঝগড়া করতে শোনেনি তেমন করে তবে মা মাঝেমধ্যে চেঁচামেচি করতো।
" বাবা আজ থাক বরং অন্যদিন শুনবো।"
শান্তনু বলে.." কেন ভালো লাগছেনা শুনতে?
ঘুমোবি এখন?
" না না বলো বাবা,তোমার ক্লান্ত লাগছেনা তো?..."
শান্তনু আবার শুরু করে...রাধিকার পড়াশোনা শেষ প্রায় তখন অমিত পিএইচডি করছে। চাকরি পায়নি চাকরির চেষ্টা চলছে। এমন সময় বাইরে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেলো রাধিকা।
অমিত যেন খুশি হতে পারেনি ওর বাইরে যাওয়ার কথা শুনে, বেশ মান অভিমান হয়েছিলো ওদের মধ্যে। রাধিকা আমার কাছে একদিন কেঁদেওছিলো..আসলে ওর তখন এমনিতেই মন খারাপ বাইরে চলে যাবে আবার না গিয়েও পারবেনা স্যারেরা সবাই বলছেন এই সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত নয়। খুব ভালো ছাত্রী ছিলো রাধিকা।
আমি তখন সবেই ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়েছি, আমি পেছনে থাকা ছাত্র হলেও বেড়ালের ভাগ্যেই শিকে ছিঁড়ে পড়লো। মানে প্রথম আমিই চাকরি পেলাম।
অমিত আর রাধিকা দুজনেই একদিন এসেছিলো আমার কাছে বুঝেছিলাম ওদের মান অভিমানের পালা চলছে। অমিত বারবারই বলছে..' এত কোয়ালিফিকেশন বাড়িয়ে কি হবে।অনেক তো পড়াশোনা করলি?' এখানেই চাকরি নিয়ে নে।'
আর রাধিকা বারবারই বলছে..'' মা তো বলেছে আমাকে পড়তে যেতে। মায়ের ইচ্ছে বিয়ে করে এখনই আমি যেন পড়াশোনা না ছাড়ি।আরো এগিয়ে যাই।''
অমিত একটু অসন্তুষ্ট হয়ে বলে," আমার মায়ের কথা ছাড় তো মা পড়াশোনার অত কি বোঝে? তোকে ভালোবাসে তাই যা মনে হচ্ছে বলে যাচ্ছে।"
আমি মনে মনে ভাবলাম এদিকে মায়া তো বিয়ের জন্য ক্ষেপেছে। বেশি দেরি করলে ওর বাড়ি থেকে বিয়ে দিয়ে দেবে শুনছি তাই আমাকে হয়ত এবার তাড়াতাড়ি ছাদনাতলায় যেতে হবে।
অমিতের মা রাধিকাকে খুব ভালোবাসতেন আর উনি নিজের জীবন দিয়ে জানেন মেয়েদের আর্থিক স্বাধীনতা খুব দরকার। তাই হয়ত উৎসাহ দিয়েছেন পড়াশোনার ব্যাপারে।
একটু মনে মেঘ জমলেও অমিতের প্রেমের সাথে নিজের স্বপ্নের বোঝাপড়া করলোনা রাধিকা.. লন্ডনে পড়তে যাবার সময় বলে গেলো..."মাত্র তো কটা বছর,দেখতে দেখতেই কেটে যাবে তারপর দুজনে মিলে চুটিয়ে সংসার করবো। ভালোবাসায় ভরা বাসা বাঁধবো একদম।
ভীষণ মন খারাপ করছে তোদের সবার জন্য তবুও আমি যাবো আসলে আমি যদি ভালো কিছু শিখে দেশে ফিরি কত লোকের উপকার হবে।"
আমাকেও বলে গেছিলো রাধিকা...." এই যে আমি আসি তারপর বিয়ে করবি নাহলে আমার নেমন্তন্নটাই খাওয়া হবেনা। এত কিসের তাড়া তোর? এখন কিছুদিন আগে মনটা বুঝে নে মায়ার ভালো করে তারপর মনের মানুষের জন্য দরজা খুলে দিস।"
******************
"রাধিকা চলে গিয়েছিল অনেক অনেক দূরে আমাদের সবাইকে ছেড়ে দিয়ে ওর স্বপ্নকে মুঠোবন্দি করতে। অমিত আবার ব্যস্ত হয়েছিল নিজের কাজকর্ম নিয়ে আর আমি চাকরি নিয়ে।
তবে আমি ঘাড় নাড়লেও কথা রাখিনি পরের বছরই আমাকে বিয়ে করতে হয়েছিল। তোর মাকে ঘরে এনেছিলাম জীবনসঙ্গী করে। রাধিকার পড়তে যাওয়া নিয়ে গ্ৰামেও কথা উঠেছিলো অনেকেই বলেছিলো...' আইবুড়ো মেয়েকে কেউ পাঠায় অতদূরে? এ একদম লালমুখো সাহেব বে করে জাতধর্ম খুইয়ে আসবে।' ওর বাবা হেসে বলেছিলো 'ও আবার আইবুড়ো কোথায়?কবেই তো বিয়ে হয়েছে ওর।'
তখন তো এত ফোনটোন ছিলোনা সবার হাতে হাতে আর ঘরে ঘরে। রাধিকা চিঠি লিখতো,ওখানকার খামে আসতো সেই চিঠি।নিজেকে বেশ একটু অন্যরকম মনে হত মানে বন্ধু ফরেনে থাকে। তবে এক দুদিন ফোনও করেছে আমার অফিসে। তবে ওর শেষ ফোনের প্রশ্নে আমি ঠিক সঠিক উত্তর দিতে পারিনি।
রাধিকা খুব ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো অমিতকে অনেক চিঠি দিয়েছে উত্তর পায়নি। ওর ইউনিভার্সিটিতে ফোন করেছে ওরা বলেছে থাকেনা এখানে। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো কি হয়েছে? ওরা সবাই ভালো আছে তো?
আমি কোনরকমে কাটিয়ে দিয়ে বললাম..আমি তো অনেকদিন বাড়ি যাইনি তাই কিছু জানিনা। তবে শুনেছি ও মণিপুরে বোধহয় চলে গেছে চাকরি নিয়ে আসলে ওখানের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো নয় তাই যোগাযোগ করতে পারছেনা। লাইনটা কেটে গিয়েছিলো। তারপর আর রাধিকা আমাকে ফোন করেনি। হয়ত খবরটা পেয়ে গিয়েছিল।"
বাবার গল্প শুনতে শুনতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলো অঙ্কিত মনে হচ্ছিলো ও যেন পাখনায় ভর করে উড়ে গেছে রাধিকা মাসির প্রথম যৌবনের প্রেমের উল্টানো বইয়ের পাতায়।
তাই জিজ্ঞেস করে...." কোন খবর পেয়েছিলো? অমিতকাকুর মারা যাবার?"
*********************
শান্তনু কিছুক্ষণ একটু চুপ করে থাকে মনটা যেন কেমন থমকে যায়...." না রে অমিতের মৃত্যুর খবর নয়,রাধিকার প্রেমের মৃত্যুদন্ডের খবর।"
বাবা কেমন যেন ঘুরিয়ে কথা বলছে তাই অঙ্কিত বলে..." মানে ওদের কি ব্রেকআপ হয়ে গিয়েছিলো?"
শান্তনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে.." অমিত মামাবাড়িতে মানুষ তুই জানিস। ওর মামাতো বোনের ননদের বিয়েতে ওরা সবাই গিয়েছিলো। অমিত তখন মণিপুরে চাকরি করে। কিন্তু আশ্চর্য আত্মীয়ের বিয়েতে সদলবলে গিয়ে শেষে নিজেই বিয়ে করে ফিরলো অমিত।"
বাবার কথার মাথামুন্ডু কিছুই বোঝেনা অঙ্কিত।
" হোয়াট! বিয়ে করে ফিরলো? কাকে? মানে দেন রাধিকা মাসির কি হলো? জাস্ট ভাবতে পারছিনা। এবার কেমন যেন লাগছে।"
শান্তনু বলতে শুরু করে,"অমিত সব সময় মামাদের বাধ্য কারণ ওখানেই বড় হয়েছে। ওর মামাতো বোনের ননদের বিয়েতে বর আসার সময় হঠাৎই অ্যাক্সিডেন্ট হয় তাতে বর আর বরযাত্রী সমেত বেশ কয়েকজন মারা যায়। খবর যখন আসে বিয়েবাড়িতে তখন চারিদিকে কান্নাকাটি গ্ৰামের ব্যাপার বুঝতেই পারছিস।মেয়ের বাবা ওর মামার কাছে কেঁদে পড়ে মেয়ে তখন অজ্ঞান হয়ে আছে অবশেষে অমিতের কোন আপত্তি টেকেনা ওকেই বিয়েটা করতে হয়।
যথারীতি রাধিকা কিছুই জানতে পারেনা মানে ওকে জানানোর কোন সুযোগই পায়নি অমিত। বিয়ে করে বৌ নিয়ে কাজের জায়গায় চলে গেলো অমিত। রাধিকার পাঠানো চিঠি ওর কাছে এলোনা দেশের বাড়িতেই পড়ে রইলো। রাধিকা হারিয়ে গেলো অমিতের জীবন থেকে।
অমিত রাধিকাকে ওর বিবাহিত জীবনের মধ্যে টেনে আর বিপর্যয় বাড়াতে চাইলোনা। সব ঘটনা জানিয়ে একটা চিঠি পাঠালো রাধিকাকে।
জানিনা বিদেশে একা সেই চিঠি পড়ে নিজেকে কি করে সামলেছিলো রাধিকা!
তবে রাধিকা বলেই হয়ত সামলাতে পেরেছিলো ওর আত্মনির্ভরতা,আত্মবিশ্বাস, সেবামূলক মনোভাব সবটুকুই হয়ত ওকে বাঁচিয়ে রেখেছিলো ডুবতে দেয়নি অবসাদে।
রাধিকার মা ছিলোনা,বাবা আর ঠাকুমাই ওকে মানুষ করেছিলো। অমিতের মায়ের কাছে মাতৃত্বের স্বাদটুকু পেতো রাধিকা। হয়ত সেটাও হারালো।
অমিত ওর ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টারে মা আর বৌকে নিয়ে ঘর পাতলো। প্রথম প্রথম হয়ত একটু অস্বস্তি হয়েছে কিন্তু স্ত্রীকে কাছে টেনে নিয়েছিলো তারপর স্বাভাবিক ভাবেই।
আমার খুব খারাপ লেগেছিলো, আসলে রাধিকা আমার একদম ছোটবেলার বন্ধু তো তাই অমিতের সাথে আর তেমন যোগাযোগ ছিলোনা আমার। তাছাড়া ওরা থাকতোও অনেক দূরে। আমিও তখন নতুন সংসার নিয়ে ব্যস্ত। তোর মায়েরও তখন শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা পরীক্ষা করে জানা গেলো ছোট থেকেই একটা রেয়ার হার্ট ডিজিজ আছে ওর। এই করে আর কোন যোগাযোগ হয়নি। রাধিকাকে একটা চিঠি দিয়েছিলাম কিছুদিন বাদে কিন্তু কোন উত্তর পাইনি। এক সময় ছিটকে গেলাম এক একজন এক এক দিকে রাধিকা,অমিত,আমি সবাই। শুধু মাঝে মাঝেই মনে হত আমাদের ফেলে আসা সেই সব মজার দিনগুলোর কথা।
**************
মুঠোফোনে হাত রাখে অঙ্কিত,অহনা অনেকবার টেক্সট করেছে ও ছোট্ট করে রিপ্লাই দিয়েছে দুএকটা প্রথমে,তারপর আর দেওয়া হয়নি গল্প শোনার নেশায়। কোথায় যে মন হারিয়ে গিয়েছিলো এতক্ষণ বুঝতেই পারেনি। নাহ্ এবার কল করতে হবে ওকে তাই বাবাকে বলে.." কাল শুনবো বাবা বাকিটা,চলো আজ শুয়ে পড়ি।"
" হ্যাঁ তাই ভালো, কাল বাদবাকিটা বলবো। শুয়ে পড় এখন।"
বিছানায় শুয়ে রাত জাগে দুজনেই,শান্তনুর মনেও অস্থিরতা আর অঙ্কিত যেন ডুবে আছে এক রূপকথায়। আজ অঙ্কিতের খুব ইচ্ছে করে অহনার সাথে একটু শেয়ার করতে তারপর ভাবে আগে পুরো গল্পটা শুনে নিয়ে তারপর ভাববে। বেশ কিছুটা সময় কথায় গল্পে কাটলো অঙ্কিতের। অহনা বললো, "ঘুমো এবার।"
"একটা গান শোনাবি ঘুম আসছেনা"
অহনা খিলখিল করে হাসে..ঘুমপাড়ানি গান শোনাবো?"
" তাই শোনা"
অহনা গাইতে থাকে....'আমার রাতজাগা তারা,তোমার অন্য পাড়ায় বাড়ি।'
আস্তে আস্তে ঘুম নামে অঙ্কিতের দুই চোখে।
শনিবার এমনিতেই সকাল থেকে ব্যস্ততা থাকে সারা সপ্তাহের কাজ বাজার মোটামুটি সামলে নেয় সেদিন অঙ্কিত। শান্তনু অবাক হয়ে যায় ছেলেকে দেখে এত কাজ কোথা থেকে শিখলো ছেলেটা কে জানে?
সারাদিন সব সামলে বাবার কাছে এসে বসে অঙ্কিত," বাবা মনে আছে তো..তোমার অসমাপ্ত উপন্যাসের বাদবাকি পাতাগুলো খুলবে তো আজ? আমি কিন্তু অপেক্ষায় আছি।"
শান্তনুও আজ সারাদিন গুছিয়েছে মনে মনে কি করে পাতাগুলো মেলে ধরবে ছেলের সামনে। এতবছর ধরে লুকোনো উপন্যাস শেষ পর্যন্ত খুলতেই হলো রহস্যের চাবিটা ছেলের হাতে চলে আসাতে। তবে এখন শান্তনুও চায় হাল্কা হতে,সেদিন মরে গেলে তো আর বলাই হতনা।
অঙ্কিত বাবার কাছে এসে বসে..শান্তনু আদরে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
"গল্পের শেষে একটা প্রশ্ন থাকবে দেখি তুই উত্তরটা খুঁজে পাস কিনা? নাহলে আমাকেই বলতে হবে।"
" তুমি বলো বাবা আমি চেষ্টা করবো।"
" তবে গল্পের অনেক চরিত্রই নেই এখন হয়ত আমি আর রাধিকাও থাকবোনা কিছু বছর পরে। তুই এটাকে একটা গল্প ভেবেই মনে রাখিস। কষ্ট পাসনা বাবু।"
অঙ্কিতের মনটা যেন কেমন করে ওঠে অমিতকাকুর সাথে নিজের মিলটাকে কাকতালীয় বলে এতদিন যে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছে তার মধ্যেই কি কোন রহস্য লুকিয়ে আছে? বাবা কি সেইজন্যই অস্থির হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো? তবে কি বাবাকে বারণ করবে বলতে?
" বাবা তুমি যদি কষ্ট পাও তাহলে আর বোলোনা। আমি শুনতে চাইনা সেই গল্প।"
শান্তনু হাসে..." কোন কষ্ট নেই রে আমার। আর যে কিছুই পাবার বা হারাবার নেই।"
" তাহলে বলো শুনি" অঙ্কিত বলে।
********************
বাইরে তখন হাল্কা কুয়াশার চাদর,শান্তনু বলতে থাকে.." রাধিকার সাথে আর তেমন যোগাযোগ ছিলোনা।শুধু শুনেছিলাম রাধিকা দেশে ফিরেছে তবে এখানে নয় চেন্নাইয়ে আছে। মনে মনে ভাবলাম যাক দূরে থেকেই ভালো আছে। কিই বা আছে এখানে ওর? আসলে আমরাও একটা সময়ের পর কেমন যেন হয়ে যাই বুঝলি দরকার ছাড়া আর তেমন করে মানুষের খোঁজ নিইনা।
ওর ফোননম্বর বা ঠিকানাও ছিলোনা আমার কাছে তাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলাম আমরা।
হঠাৎই একটা খবর বেরোলো খবরের কাগজে আর রেডিওতে। মণিপুরে মৃত বাঙালী অধ্যাপক স্ত্রী সহ। অদ্ভুত মৃত্যু কোয়ার্টারের ছাদ ভেঙে পড়ে রাতের বেলাতে। সত্যিই শোনা যায়না এভাবে স্বামী স্ত্রীর একসাথে মৃত্যু। নামটা শুনে আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারিনি...অমিত আর ওর স্ত্রী একসাথে মারা গেলো! রাধিকার না হয় বৈধব্যযোগ ছিলো,কিন্তু ওর সাথেই তো বিয়ে হয়নি তবুও অমিত বাঁচলোনা। সত্যিই ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস!
সেদিন আমি আর মায়া কেউই কিছু খেতে পারিনি। যোগাযোগ থাক আর না থাক তবুও এই একই আকাশের তলায় কোথাও আমরা ছিলাম।আজ আর অমিত বলে কেউ থাকলোনা হারিয়ে গেলো কোন এক অনন্তলোকে। খুব মন খারাপ হলো মাসিমার জন্য,ঐ তো এক শিবরাত্রির সলতে তার।কোন অল্প বয়েসে বিধবা হয়ে বাপের বাড়িতে ভাই বৌদের অবহেলা সয়ে ঐ ছেলেকে মানুষ করেছেন। আর কিছুই ভাবতে পারলাম না।
দুঃসংবাদ যেন হাওয়ায় উড়ে আসে,যে ছেলেটার সঙ্গে প্রায় দুবছর যোগাযোগ নেই সাতসকালে পেপারের এককোণ থেকে তার মৃত্যুসংবাদ ঠিক পেয়ে গেছিলাম।
মাঝে কেটে গেছে আরো একটা বছর আমি তখন সংসার নিয়ে খুব ব্যস্ত আমার বাবা মানে তোর দাদু চলে গেলো। আমারও আর তেমন কেউ রইলোনা মায়া ছাড়া। তার মধ্যে মায়ার দুবার মিস ক্যারেজ হয়ে গেছে। মায়া খুব অসুস্থ তখন শারীরিক আর মানসিক দুদিকেই। আসলে মায়া চিরকালই খুব বেশি ঘরোয়া। ঘর সংসার স্বামী সন্তান এটাই বোধহয় মায়ার স্বপ্ন ছিলো।
আসলে স্বপ্নেরও নানা রঙ হয়,কারো স্বপ্ন থাকে আকাশ ছোঁওয়ার আবার কেউবা মাটি ছুঁয়েই তাতে আল্পনা এঁকেই খুশি থাকে। কলকাতাতে দু একজন ডাক্তার দেখালাম তেমন কিছু লাভ হলোনা। আমার সাথে একজন চাকরি করতো সে বললো মায়াকে চেন্নাইয়ে নিয়ে যেতে।
হঠাৎই মনে হলো চেন্নাইয়ে তো রাধিকা থাকে। ওর সঙ্গে একবার যোগাযোগ করলে হত। দেখেছিস তো এই আমরা মানুষ, যখন দরকার তখন বন্ধুকে মনে পড়লো। তবে কিছুতেই ওর নম্বর পেলাম না। যাক অগত্যা মায়াকে নিয়ে রওনা দিলাম মাদ্রাজে,তখন তো এই নামই ছিলো।
অঙ্কিত বাবাকে একটু জল আর ওষুধটা এনে দেয়.." একটু জল খাও। তোমার কষ্ট হচ্ছেনা তো? হলে পরে বোলো।"
শান্তনু বলে..."আর পরে নয় বাবু,আজই সবটাই বলবো। জানিস তো মন দিয়ে কিছু খুঁজলে তা বোধহয় পাওয়া যায় ঠিক। ওখানে হসপিটালে তোর মায়ের নাম রেজিস্টার করে বসে আছি। যখন দেখাতে গেলাম কি বলবো এখনো ভাবলে আমার গায়ে কাঁটা দেয়। যদিও চোখে চশমা,পিঠ অবধি ঝাঁকড়া চুল ঘাড় অবধি কাটা। গলায় স্টেথো ঝুলছে তবুও চিনতে কোন অসুবিধা হয়না এক দেখাতেই।
রাধিকা আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসলো ইশারায় বললো পরে কথা হবে।
*******************
মায়ার সব টেস্ট,ডাক্তার দেখানো কাউন্সেলিং এইসব মিটতে বেশ কয়েকটা দিন লাগবে। মায়ার এক অদ্ভুত পরিবর্তন হয়েছে ওর মুখে হাসি নেই একটা হতাশা যেন ওকে ঘিরে ধরেছে।
রাধিকার স্বভাবসুলভ দুষ্টুমি এখনও আছে খুব ভালো লাগলো দেখে যে এত কিছুর পরেও মেয়েটা ভেঙে পড়েনি। তবে আমি ওকে কিছুই বলতে পারিনা। ও নিজেই বলে," মায়া তোর সেই হাসি আর ঢলঢলে মুখটা কোথায় গেলো? আমি বলতামনা খুব লক্ষ্মীমন্ত বৌ হবে মায়া। আমার মত বাউন্ডুলে নয়। আর শোন তোদের তো বেশ কয়েকদিন থাকতে হবে ঐ সব হোটেল মোটেল ছাড় বাপু চলে আয় আমার ওখানে।কদিন বেশ সেই আগের মত আড্ডা দেওয়া যাবে। রোগ আর রুগী নিয়ে জীবনটাই কেমন যেন রোগা হয়ে গেছে।"
আমি একটু কিন্তু করছিলাম সত্যিই সঙ্কোচ হচ্ছিলো এতদিন বন্ধুর কোন খবর নিইনি হঠাৎই প্রয়োজনে বন্ধুকে কাজে লাগাবো?নিজেকে সুযোগসন্ধানী বলে মনে হয়েছিলো। তবে মায়া খুবই উদগ্ৰীব হয়ে উঠেছিলো রাধিকার প্রস্তাব শুনে ওর ওখানে থাকার জন্য।
অগত্যা আমি রাজি গিন্নী আর বান্ধবী দুজনকে খুশি করতে। রাধিকাই আমাদের হোটেল থেকে গাড়ি করে ওর ওখানে নিয়ে যায়। বাড়িতে এসে বেল বাজায় রাধিকা,দরজা খোলেন একজন মহিলা আর তার পেছনে টলমল করে হেঁটে আসে একটা ফর্সা টুকটুকে মিষ্টি গুবলু বাচ্চা এসেই রাধিকাকে জড়িয়ে ধরে। রাধিকা ওকে কোলে তুলে নেয়।
যথারীতি আমি আর মায়া একদম অবাক হয়ে যাই।মায়ার চোখে ঝরে পরে এক অনাবিল মাতৃত্বের অতৃপ্ত আস্বাদ ওর চোখমুখ ভরে ওঠে আনন্দে।দুহাত বাড়িয়ে দেয় বাচ্চাটাকে কোলে নিতে...রাধিকা ওকে মায়ার কোলে দেয়। আর কোন আপত্তি ছাড়াই ও মায়ার কোলে চলে এসে মুঠোতে ওর আঁচলটা ধরে।
রাধিকা আওয়াজ দেয়.." চলে আয় চলে আয়।দেখ কত বড় বাড়ি।একদম হাত পা ছড়িয়ে থাকতে পারবি কোন অসুবিধা হবেনা। মায়া আয়,ওকে নিয়ে থাকলে তোর সারাদিন কেটে যাবে।"
মায়া ততক্ষণে ওর সাথে বাচ্চাদের ভাষায় কথা বলে যাচ্ছে আর ও খিলখিল করে হাসছে।
মায়া আর নিজেকে সামলাতে পারলোনা,আমিও ভেবেছি কথাটা কিন্তু জিজ্ঞেস করতে পারিনি।মায়া বলেই ফেললো..." তোর ছেলে? বিয়ে করেছিস বলিসনি তো? কি মিষ্টি ছেলে তোর! বর কোথায় তোর? দেখছিনা তো?"
হাসে রাধিকা..." বাপরে এতো প্রশ্ন! তোদের সাথে কতদিন বাদে দেখা হলো বলতো? পাঁচবছর? না ছয় বছর? আর তোরাও তো আমাকে না জানিয়েই সব বিয়ে করলি।"
রাধিকার কথায় অভিমানের ছোঁয়া পাই আমি। তাই কি আর বলবো..একটু বোকা বোকা হাসি হেসে বললাম ঐ করতেই হলো। কিন্তু তোর বিয়েটা কবে হলো?
রাধিকা বলে.." আমার বিয়ে তো সেই কবেই হয়ে গেছে কৃষ্ণের সঙ্গে। মেয়েদের আবার কতবার বিয়ে হয়?"
আমি আর মায়া নিজেদের মধ্যে ইশারা করছি তখন। আমার মনে জাগছে একটাই কথা তাহলে ও কি?
রাধিকা হাসে," বাচ্চাটাকে কৃষ্ণই দিয়েছেন আমাকে বুঝলি। স্ত্রী,মা সবটাই প্রাপ্তি তার কল্যাণে''।
পুচকেটা ততক্ষণে এসে রাধিকার আঁচল জড়িয়ে ধরেছে মাম মাম করছে সমানে। রাধিকা ওকে কোলে নিয়ে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে। আমি দেখি মায়ার চোখটা কেমন যেন চকচক করে ওঠে।
রাধিকা আবার বলতে শুরু করে," অমিত আর নেই জানিস তো। খবরটা শুনে আমি থাকতে পারিনি।বিয়েটা আমাদের নাইবা হলো,আমি তো ওকে ভালোবাসতাম।সবচেয়ে আগে আমার বন্ধু ছিলি তোরা,খুউব ভালো বন্ধু। তাই সঙ্গে সঙ্গে ফ্লাইটে করে চলে গেলাম। হয়ত ডাক্তার বলেই সহ্য করে নিয়েছিলাম পুরোটাই।সে দৃশ্য চোখে দেখা যায়না। চোখের জল মুছে সামলালাম মাকে.. মা তখন আধা পাগল।আমাকে অসহায়ের মত জড়িয়ে ধরলো। কি আশ্চর্য জানিস অমিত আর ওর বৌ মারা গেলো একসাথে অথচ বাচ্চাটা বেঁচে গেলো।
আত্মীয়স্বজন কেউ তেমন ঘাড় পাতলোনা।আর মা আমাকে ছাড়বেনা...বারবার বলতে লাগলো," তোর সাথে বিয়ে হলে আমার ছেলেটা মরতোনা।"
কি আশ্চর্য দেখ অগ্নিসাক্ষী করে বিয়েটা হলো না আমাদের কিন্তু অমিতেকে আমি কথা দিয়ে এলাম আগলে রাখবো তোদের ভালোবাসাকে। কোনদিন জানবেনা ও অনাথ।"
রাধিকাকে কোনদিন তেমন করে কাঁদতে দেখিনি বুঝলি ভীষণ শক্ত মেয়ে সেদিন দেখলাম ওর চোখে জল। হয়ত আমাদেরকে দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারলোনা। হঠাৎই দেখলাম কান্নায় ভেঙে পড়লো রাধিকা ছেলেকে বুকের মধ্যে ধরে। অঝোর ধারায় ঝড়ে পড়লো বাঁধভাঙা জল যা হয়ত এতদিন আটকে রেখেছিলো ওর স্বভাবের কঠোর সংযমে।"
শান্তনুর দুচোখ ভরা জল গাল দিয়ে গড়িয়ে পড়ে। কাঁদছে অঙ্কিত বাবাকে জড়িয়ে..এও এক বাঁধভাঙা কান্না....জড়ানো গলায় বলে অঙ্কিত.." বাবা তোমার উপন্যাস শেষ হবার আগেই আমি উত্তর পেয়ে গেছি। রাধিকা মাসির কোলে তুলে নেওয়া সেই পুচকেটাই আমি। তাইতো? বলো বাবা? সত্যিই তো?"
*****************
শান্তনু আর নিজেকে সামলাতে পারেনা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে..." মায়া আমি তোমার কথা রাখতে পারলাম না। ও যে অমিতের ছেলে তা ওকে বলে দিলাম বুঝলে,ওকে বলে দিলাম। আমি জানি ও আমাদের ভুল বুঝবেনা। আমি তোর সত্যি বাবা নই অঙ্কু,বাবার মতো। তবুও আমি মানে আমরা তোকে সবটা দিয়ে ভালোবেসেছি বাবা।"
অঙ্কিতের ফর্সা গালদুটো আরো লাল চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে তখনো দুই চোখ। এই পরবাসে ওরা শুধু দুজন দুজনকে আকড়ে ধরে আছে এক অনন্ত স্নেহের বন্ধনে যেখানে শুধু অপত্য সুখটুকু পাওয়া ছাড়া আর কোন স্বার্থ নেই।
" বাবা তুমি আর কেঁদোনা এবার চুপ করো। তোমাদের প্রতি হয়ত আরো শতগুণ শ্রদ্ধা আমার বেড়ে গেলো। তোমরা না থাকলে আমাকে হয়ত কোন অনাথআশ্রমে বড় হতে হত। কোথায় যে হারিয়ে যেতাম কে জানে!"
অঙ্কিত কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ে..." আচ্ছা বাবা,আমার বাবাকে কি একদম আমার মত দেখতে ছিলো? বলোনা গো..তুমি তো বাবাকে দেখেছো আমার মত বয়েসে।"
চোখের জল সামলে শান্তনু বলে..." একদম অবিকল তোর মত দেখতে বাবু। তাইতো রাধিকা তোর হাজার অপমান সত্ত্বেও ঘুরে ফিরে আসে আমাদের বাড়িতে তোকে দেখতে। তোর মাঝে খুঁজতে চায় ওর হারানো অতীতকে। এখানে এসেও দেখে গেছে ওর ভালোবাসার কোলছেঁড়া সন্তান কেমন আছে। জানিস রাধিকাই অমিতের আর তোর মায়ের মুখাগ্নি করেছিলো। আমি আর তোর মা শুনে চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি।রাধিকার চোখ তখন শুকনো খটখটে বলছিলো আগুনকে সাক্ষী করে যাকে সাতপাকে বাঁধার কথা তার মুখাগ্নি করতে হলো আমাকে। বারবারই বলছিলো তোর মা অঙ্কনার কথা,ওর সৌভাগ্যের কথা।"
এই এতক্ষণে ওর গর্ভধারিণী মায়ের নামটা শুনলো অঙ্কিত। অমিত আর অঙ্কনা দুজনের সন্তান বলেই হয়ত ওদের নাম মিলিয়ে ওর নাম অঙ্কিত দেওয়া হয়েছিলো।
নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগে অঙ্কিতের,রাধিকা মাসির নাম শুনলেও একটা সময় ওর অসহ্য লাগতো। ছিঃ কত কষ্ট দিয়েছে মানুষটাকে। এমন মানুষও হয়! যারা শুধুই কর্ম করে যায় ফলের আশা না করে।
শান্তনু চুপ করে থাকে...অপ্রকাশিত উপন্যাসের আর কয়েকটা পাতা তখনো বাকি। অঙ্কিতও চুপ করে তাকিয়ে আছে মায়ার ছবিটার দিকে। শান্তনু প্রস্তুত হচ্ছে পরবর্তী অধ্যায় শোনানোর জন্য,ও জানে অঙ্কিত এবার কি জানতে চাইবে।
একটু বাদেই অঙ্কিত বলে..." আমি তো রাধিকা মাসির কাছে ছিলাম,আমার ঠাম্মু কোথায় গেলো? আমি তোমাদের ছেলে হলাম কি করে?
শান্তনু অঙ্কিতের দিকে তাকায়.." ঘুমোবিনা? অহনাকে ফোন করতে হবে তো?"
"আমি ওকে বলে দিয়েছি বাবা,আজ আমি তোমার পাশে শুয়ে গল্প শুনছি। ওকে কাল ফোন করবো।"
শান্তনু শুরু করে বলতে..." তোর ঠাম্মু মানে আমাদের মাসিমা,অমিত যাওয়ার পরই মোটামুটি খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। রাধিকার কাছে তোকে দিয়ে অমিতের মৃত্যুর ছমাসের মধ্যেই উনি মারা যান। পুত্র শোকটা সহ্য করতে পারেননি কিছুতেই। আর তারপর থেকে রাধিকাই তোর একমাত্র অবলম্বন হলো। সবটাই রাধিকার মুখে শোনা আমাদের।
মায়ার চিকিৎসার জন্য বেশ কিছুদিন ওখানে থাকতে হলো আমাদের। রাধিকা থাকাতে কোন অসুবিধা হলোনা। আমার পক্ষে অতদিন ওখানে টানা থাকা সম্ভব হলোনা তাই অফিসে জয়েন করতে চলে এলাম। রাধিকা অনেকটা সময় বাড়ি থাকতোনা,সেই সময়টা তুই মায়ার ন্যাওটা হয়ে গেলি। তোকে স্নান করানো,খাওয়ানো ঘুম পাড়ানো অনেক কিছুই মায়া করতো। মায়া মাঝে যে হাসতে ভুলে গেছিলো তোকে পেয়ে ওর শুকনো বাগানে আবার ফুল ফুটলো।
এমনও অনেকদিন হয়েছে রাধিকার নাইট ডিউটি তুই মায়ার বুকের সাথে লেপ্টে ঘুমোতিস। আর মায়া পরম স্নেহে তোকে জড়িয়ে রাখতো।
রাধিকা ভোরবেলা ডিউটি থেকে এসেই তোকেই আগে দেখতে চাইতো। মায়া ওষুধ খেতো তাই একটু বেলা হত উঠতে...আমাকে রাধিকা বলতো 'দেখেছিস, কৃষ্ণ কেমন যশোদাকে জড়িয়ে ঘুমোচ্ছে।' আমি হেসে বলতাম মায়া এখানে খুব ভালো আছে রে। তবে ও যেভাবে বাবুকে আকড়ে ধরে আছে তাতে আমরা ফিরে যাবার পর কি হবে কেজানে? আসলে আমি আর রাধিকা দুজনেই জানতাম আবার মা হতে গেলে মায়ার জীবন সংশয় হতে পারে।
সেবার প্রায় একমাস ওখানে থাকলো মায়া। ফেরার কথা বলতেই মায়া বায়না ধরে বসলো..' আর কটা দিন থাকিনা এখানে। বাবুকে ফেলে আমার একটুও যেতে ইচ্ছে করছেনা। দিনে রাতে সব সময় আমার সাথে থাকে,কি সুন্দর আধো আধো কথা বলে। রাধিকা তো ওকে সময়ই দিতে পারেনা। এই কদিনে কেমন কথা বলছে...আমাকে মা বলছে দেখো।'
আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন কেঁপে উঠলো মায়া এ সমস্ত কি স্বপ্ন দেখছে? এখন তো দেখছি ওকে এখানে আনাটাই ভুল হয়েছে।
আমি বলে উঠি মায়া ও রাধিকার ছেলে,ওকেই মাম মাম বলে এত বড় ভুল তুমি কোরনা। রাধিকার কথা ভাবো ও ছাড়া কেউ নেই ওর। মায়া কেমন যেন রেগে যায়..' ও আমাকে মা বলে রাধিকার তো সময়ই নেই ওকে সামলানোর। আর ও রাধিকার ছেলে নয় ও অমিতের ছেলে। আর রাধিকা বিয়েই বা করছেনা কেন?একটা বিয়ে করতেই তো পারে।'
আমি মায়ার মুখে চাপা দিই,খুব খারাপ লাগে রাধিকার জন্য।কেন যে আমাদের হোটেল থেকে ওর বাড়িতে এনেছিলো! ও শুনলে কি ভাববে? ভাগ্যিস তখন রাধিকা ছিলোনা।
****************
তবে যা ভেবেছিলাম তাই হলো,আমাদের চলে আসার আগের রাতে মায়া কিছুতেই তোকে রাধিকার কাছে শুতে দেবেনা ..বার বারই বলতে লাগলো,' ও আমার কাছে খুব ভালো থাকে একদম বুকের কাছে এসে শোয়। আজ রাতটা আমার কাছে শুতে দে।"
রাধিকা হাসে.." ও ঘুমিয়ে গেছে দেখ আমার আঁচল ধরে।সারাদিন তেমনভাবে ছেলেটাকে পাইনা। তাই বাড়িতে যতটুকু থাকি ওকে কাছে রাখি।"
এরপরেই বাজ ফেললো মায়া.." তাই তো বলছি,এখানে প্রায় একমাস আছি দেখছি তো তুই একদম সময় পাসনা। আর ঐ কাজের লোকের কাছে রেখে কি বাচ্চা মানুষ হয়? মায়ের যত্ন বলে একটা কথা আছে নাকি?"
দেখলাম মায়ার কথা শুনে রাধিকার মুখটা কেমন চুপশে গেলো। ওর গলাটা খুব ভারী লাগলো.." আসলে মায়ের আদর তো আমিও তেমন পাইনি ছোটবেলায়। তবে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যদি কোনদিন মা হতে পারি তাহলে ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে রাখবো।"
" কিন্তু তোর সময় কোথায়? ছেলেটা একলা থাকে কাজের লোকের কাছে। আমি বলি কি তুই বাবুকে আমাকে দিয়ে দে। তোরা দুই বন্ধু যতই বলিস আমি জানি আমার আর সন্তান হবার নয়।যদি থাকতোই তাহলে দুবার দুবার...."
বলেই কেঁদে ফেলে মায়া। রাধিকা ওর মাথায় হাত রাখে,"নিয়মে থাক,খাওয়াদাওয়া ঠিকমত কর সব ঠিক হয়ে যাবে।"
কেঁদে ওঠে মায়া আবার খুব জোরে..." কিচ্ছু ঠিক হবেনা আমি জানি আর সন্তান হলে আমি বাঁচবোনা। তোর নিজের ছেলে হলে আমি চাইতুম না রে। ওকে তো তুই গর্ভে ধরিসনি। তুই একটা ভালো বিয়ে কর তোর নিজেরই সন্তান হবে।"
ওদের কথার মাঝে আমি পুরো বোকা হয়ে গেছি কারণ দুজনের কষ্টটাই আমার জানা।
আমি মায়াকে এবার বকলাম ভেতরে গিয়ে শোওয়ার জন্য।
রাধিকা বললো.." ও যে আমার অমিতের শেষ স্মৃতি,ভালোবাসার জিনিস। জানিস শেষ সময় বাচ্চাটার ওপর উল্টে ওকে বাঁচিয়েছিলো। নিজে আঘাত নিয়েছিলো যদি ও বাঁচে। মা আমার হাতে ওকে দিয়েছেন যাতে ওর কোন কষ্ট না হয়।"
মায়া এবার ওর কাছে গিয়ে ওকে ভোলাতে থাকে..." তুই বিয়ে করলে ওর কি হবে ভেবেছিস? আর বিয়ে করবিইনা কেন? এত বড় জীবনটা এখনও পার করতে হবে। আমি আর শান্তনু ওকে আগলে রাখবো দেখিস।"
মায়া যেন এক স্বপ্নের রাজত্ব গড়ে ফেলেছিলো তোকে নিয়ে। কখন যে এইসব ভেবেছে আমি জানতেও পারিনি। আমার কাছে কিছু বলেনি এতদিন। রাধিকাও বুঝতে পারে মায়া ঘোরের মধ্যে আছে তাই বলে.." আমাকে ভাবতে সময় দে কিছুদিন।"
*****************
সেবার মায়াকে খুবই কষ্ট করে আনতে হলো মৃতসন্তানের জন্ম দেওয়া জননীর সন্তান সাধ যে এত প্রবল তা মায়াকে না দেখলে বুঝতামনা। আসার সময় তোকে আঁকড়ে ধরে চুমু দিয়ে আর ছাড়তেই চায়না কান্নাকাটি করছে। আর তুইও জড়িয়ে রেখেছিস মুঠোতে মায়ার আঁচল সেই প্রথম আমি আর রাধিকা দুজনেই শুনলাম তুই পরিস্কার মা বলে ডাকলি মায়াকে।
সারাটা ট্রেন মায়াকে তেমন কিছু খাওয়াতে পারলাম না।বারবারই বললো এই বাবুর ঘুমোনোর সময়,কে জানে খেলো কিনা?আজ তো রাধিকার নাইট ডিউটি কি করবে রাতে কে জানে?
কলকাতাতে ফিরেও শুধু বাবু আর বাবু...তখন তো এইসব ভিডিও কল ছিলোনা যে দেখাবো। শেষে মায়ার অসুখ করলো,খায়না,ঘুমোয়না। আমি রাধিকাকে ফোন করলাম অফিস থেকে। দু তিনদিন পর রাধিকা একদিন হঠাৎই ভোরবেলা এলো কিচ্ছু না জানিয়ে। আমি দরজা খুলে অবাক,ওর কোলে বাবু। আমাকে ইশারায় চুপ করতে বললো।
মায়া তখনো ঘুমোচ্ছে.. আস্তে আস্তে বাবুকে নিয়ে ওর পাশে শুইয়ে দিলো। বাবু মানে তুইই অদ্ভুতভাবে মায়াকে মা বলে ডেকে তুললি।
অঙ্কিত এতক্ষণ একদম চুপ করে ছিলো এবার বলে ওঠে...." তারপর কি হলো? মা কি সুস্থ হলো?"
হ্যাঁ রে যে মায়া হয়ত মানসিক অবসাদে পাগলই হয়ে যেতো সে সুস্থ হয়ে উঠলো তোকে দেখেই দুধ কই বাবু খাবে,আপেল আনো সেদ্ধ করবো। আমি যাই রান্নাঘরে এইসব শুরু করলো। তোকে আর ছাড়তে চায়না আর তুইও গুটগুট করে সারা বাড়ি ওর পায়ে পায়ে ঘুরতে শুরু করলি। তোর মানে আমাদের সন্তানের পায়ের ছাপ পড়লো আমাদের বাড়ির মাটিতে।
রাধিকা অনেকক্ষণ চুপ করে বসেছিলো...মায়া ওর গলাটা জড়িয়ে ধরে বলে "বাবুকে আমাকে এবার দিয়ে যাবি তো বল।"
" হ্যাঁ রে আমি আর মায়ার বাঁধনে নিজেকে জড়াবোনা তুই ঠিকই বলেছিস। ভেবে দেখলাম তোর কাছে থাকলেই ও মা বাবা দুজনের ভালোবাসা পেয়ে বড় হবে। তবে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রে মায়া অনেকগুলো দিন আমাকে জড়িয়ে শুতো তো। আমাকে মাঝে মাঝে দেখতে আসতে দিবি তো মায়া?"
রাধিকা যেন মায়ার কাছে ভিখারিনীর মত তোকে দেখার জন্য অনুমতি চাইলো।মায়া ওকে জড়িয়ে ধরে বললো," তোর যখন খুশি আসবি। তবে এবার একটা বিয়ে কর এমন কাউকে যে তোকে আর তোর কাজকে বুঝবে।"
রাধিকা ওর স্বভাবজাত ভঙ্গিমায় এত কিছুর মধ্যেই মজা করে বললো অতি বড় ডাক্তার না পায় বর। সবাই হাসলাম আমরা।ঠিক হলো একদম নিয়ম মেনেই আমরা তোকে একদম আমাদের করে নেবো। তবে বরাবরই অমিতের প্রাপ্য টাকার অনেকটা আর রাধিকার আদর তোকে ঘিরে রেখেছিলো নাহলে হয়ত এত খরচ করে তোকে আমরা মানুষ করতে পারতামনা। একার সাধারণ চাকরি আর মায়ার অসুস্থতা সবটাই সামলেছি।
অঙ্কিত দেখে বাবা থেমেছে,অনেকটা হাল্কা লাগছে বাবাকে যেন অদ্ভুত একটা প্রশান্তি বাবার চোখমুখ ঘিরে। টেবিলে রাখা মায়ের ছবিটার সামনে দাঁড়ায় বাবা...." মায়া ওকে সব বলে দিলাম, যদিও একটা সময় পরে তুমি ভয় পেতে রাধিকাকেও ভাবতে ও বোধহয় সব কেড়ে নেবে আবার তোমার কাছ থেকে। আজ আর আমাদের হারানোর কিছুই নেই।বড় শান্তি আজ,বড় হাল্কা লাগছে। জানিস আজো মনে পড়ে রাধিকাকে এয়ারপোর্টে ছাড়ার দিনটা। রাধিকা চলে যাচ্ছে তোকে মায়ার কাছে দিয়ে চশমার ভেতরে ওর চোখদুটো খুব ঝাপসা তবুও মুখে হাসি। ভাঙনের শব্দটা আড়াল করেই ট্রলিটা টেনে এগোয়...আর তুই হঠাৎই মামা মামা বলে কেঁদে উঠিস তবুও রাধিকা আর পেছনে তাকায়না এগিয়ে যায়।
আমার চোখটা কেন যেন ভীষণ ঝাপসা হয়ে গিয়েছিলো সেদিন।আজও ভুলতে পারিনা সেই মনভাঙার দৃশ্যটা।
এরপর আর প্রায় চারবছর রাধিকা আসেনি,তবে চিঠি আর ফোনে যোগাযোগ করতো। আমি পাঠিয়ে দিতাম তোর ছবি। প্রায় পাঁচবছরের মাথায় রাধিকা এখানে এলো।তখন থেকে এখানেই আছে। তারপর তো তুই অনেকটাই জানিস।
আচ্ছা বাবু আমরা ছোটবেলায় বিক্রম বেতাল দেখতাম।বেতাল বিক্রমাদিত্যকে একটা গল্প শোনাতো প্রতি রাতে যতক্ষণ না রাজা উত্তর দিতো ততক্ষণ রাজার ঘাড়ে চেপে থাকতো। আজ আমিও তোকে একটা প্রশ্ন করতে চাই উত্তর দিতে পারবি তো?"
অঙ্কিত বলে," চেষ্টা করবো বাবা,তবে আমার একটা শর্ত আছে।"
অবাক হয়ে যায় শান্তনু," শর্ত! কি শুনি?"
" আমি একটা প্রশ্ন করবো তার উত্তর মানে একদম ঠিকঠাক উত্তর তুমি দেবে। আচ্ছা তোমার প্রশ্ন বলো এবার।"
শান্তনু হাসে বলে," আচ্ছা আমি উত্তর দেবো।
আমি যে গল্প বললাম তাতে তোর জীবনে মাতৃত্বের স্নেহের ঝাঁপি নিয়ে এসেছে বিভিন্ন সময়ে তিনজন মহিলা। তারমধ্যে কার অবদান সবচেয়ে বেশি তোর জীবনে? তোর গর্ভধারিণী মা অঙ্কনার? মায়ার না রাধিকার? ভালো করে ভেবে বলবি।"
"আমাকে ভাবতে হবেনা বাবা,রাধিকা মাসিই তার অদৃশ্য মাতৃত্ব দিয়ে আমাকে আগলে না রাখলে হয়ত কোন অনাথআশ্রমে আমার ঠাঁই হত। আচ্ছা বাবা আমার জন্মদাত্রী মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে আমায় দেখাবে বাবা। কোন একটা ছবি কি পাওয়া যাবে কোথাও? আমি ঠিক উত্তর দিয়েছি তো বাবা?"
শান্তনু ছেলের মাথায় হাত রাখে..." ঠিক বলেছিস বাবু। অঙ্কনার ছবির হদিস হয়ত রাধিকাই তোকে দিতে পারবে। একটু শুধু অপেক্ষা, এইটুকু আমরা করবো তাইনা?"
মাথা নাড়ে অঙ্কিত।
শান্তনু বলে," এবার তোর প্রশ্নটা বল, দেখি আমি উত্তর দিতে পারি কিনা?"
******************
অঙ্কিতের চোখের সামনে তখন অতীত বর্তমানের নানা রঙের মিশেল। কল্পনার ছবিতে ওর তিন স্নেহময়ী মা যার মধ্যে দুজনেই এখন অতীত। ওর গর্ভধারিণী মায়ের মুখটা দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। খুব জানতে ইচ্ছে করছে কেমন ছিলো মা? হাসিখুশি না চুপচাপ? ওর মত মুডি? রাগী না শান্ত?
" আচ্ছা বাবা রাধিকামাসি এতো ভালো একটা মানুষ,তোমার ভালো বন্ধু তুমি মজা করে বলেছো যে একটা সময় তোমার ভালো লাগতো খুব, সেই মানুষটা কি সারা জীবন কিছু পাবেনা?
ঘর সংসার, ভালোবাসা সন্তান কিছুই তো পায়নি কোনদিন রাধিকা মাসি।অথচ সবটাই তার হতে পারতো।
বাবা তুমি কি এখনো রাধিকা মাসিকে ভালোবাসো?"
শান্তনু বুঝতে পারে অঙ্কিত তার মনের গভীরে ডুব দিতে চায়। শান্তনু বলে.." রাধিকাকে ভালো না বেসে কি থাকা যায়? তবে তুই যা ভাবছিস তা নয় এ ভালোবাসায় মেশানো শুধুই শ্রদ্ধা আসলে রাধিকা এত উঁচুতলায় মন বেঁধেছে যেখানে কিছুতেই পৌঁছানো যায়না দূর থেকে প্রণাম করা যায়। আর সবাই কি পাবার জন্য আসে নাকি? রাধিকা বলে..." দেওয়াতে যে কি সুখ তা তুই বুঝবিনা,অমিতকে ভালোবাসতাম খুব একরকম জোর করেই ওর প্রেমে পড়েছিলাম। যেদিন শুনলাম অমিতের বিয়ে হয়ে গেছে আর কোন অনুযোগ করিনি,কখনো একটা চিঠিও লিখিনি ফোনও করিনি। অমিত চলে গেলো অদ্ভুতভাবে বাবুকে কোলে পেলাম তাকেও নিলো মায়া আমি স্বেচ্ছায় দিয়ে দিলাম শুধু চাইলাম মায়াটা বাঁচুক তোর সংসারটা সুখের হোক।বাবুটা মা বাবা পাক যারা ওকে বুক দিয়ে আগলে রাখবে। আমি তো সত্যিই ওকে সময় দিতে পারিনা, অনেকদিনই লোকের কাছে শুয়ে থাকে রাতে ছেলেটা।"
আমি একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম," তোর ভাগের সবটুকুই যে এ ও নিয়ে গেলো। তো তোর রইলো কি?"
রাধিকা হেসে বললো," আমার তো সবটুকুই তাই তো হাসতে হাসতে দিতে পারলাম। শুধু অঙ্কুকে একটু মাঝে মাঝে দেখতে দিস। আমি জানি মায়া ভয় পায় আমি অঙ্কুকে নিয়ে নেবো।তবুও পারিনা মাঝে মাঝে চলে আসি ও যে একদম অমিতের মত।"
এখনকার প্রেম আর ব্রেকআপের যুগে রাধিকার মত একজন উচ্চশিক্ষিত মেয়ের এই ধারণাগুলোর সত্যিই কোন মানে নেই।তবুও হয়ত এটুকু নিয়েই ভালো আছে।
আসলে কি জানিস রাধিকার প্রতি বন্ধুত্ব, ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা সব মিলেমিশে গিয়ে ফ্রেন্ডশিপ অ্যান্ড মোর হয়ে গেছে মানে বন্ধুত্ব যোগ অনেক কিছু। আর এখন তো দুই বন্ধু দুজনের অভিভাবক হয়ে বেশ আছি বুঝলি। রাধিকার শাসন,অহনার শাসন তোদের সবার ভালোবাসা সব মিলে বেশ আছি।"
অহনার সাথে থেকে অঙ্কিত এটুকু বোঝে সব মানুষের একটা মন আছে যা নিজের ইচ্ছেয় চলে তাই সন্তানদের কখনোই উচিত নয় মা বাবার অসহায়তার সুযোগে তার ওপর খবরদারি করার।
তাই বাবার বিয়ে তাও আবার মাম মামের সাথে সেটা আর নাইবা ভাবলো। মাম মাম নামটা কেমন যেন ছুঁয়ে গেলো মনটাকে অঙ্কিতের। এই নামেই নাকি এয়ারপোর্টে ডেকে কেঁদে উঠেছিলো।
******************
বাবা ঘুমিয়ে পড়েছে। আজ অঙ্কিতেরও অশান্ত মনটা অনেক শান্ত। তবুও অহনাকে বলতে হবে কিছু কথা একান্ত অবকাশে।
অঙ্কিতকে ভয়েস মেসেজ করে অহনা ঘুমিয়ে পড়েছে ওকে সকাল হলেই আবার হসপিটালে যেতে হবে। আজকাল আর ম্যামের ঘরে গিয়ে বুকটা কাঁপেনা অহনার খুব কাছের কেউ বলে মনে হয় ম্যামকে। খুব ইচ্ছে করেছে একদিন ম্যামকে বলবে ওদের বাড়িতে যেতে। ওর মা বলে দিয়েছে বারবার," একদিন বলিস নিশ্চয় আসবেন। তোকে তো খুব ভালোবাসেন।"
রাতে শুয়ে অঙ্কিতের ঘুম আসেনা শুধু ভাবে অহনাকে কি করে বলবে সব কথা?অথচ অহনাকে বলতেই হবে...তারপরের টুকু অহনা ঠিক করবে। হঠাৎই টেবিলের দিকে চোখ যায় অঙ্কিতের, অহনার দেওয়া নোটবুকটা ঐরকমই আছে..এখনও হাত দেওয়া হয়নি। নোটবুকটা খোলে অঙ্কিত পরতে পরতে অহনার ভালোবাসার ছোঁয়া,কি সুন্দর ছোটছোট কোটেশন আর ইমোজি এঁকেছে পাতার কোণে কোণে।সত্যিই অহনা বোধহয় শিল্পী একদম মনে মনে।
নোটবুকের পাশে রাখা কলমটা টেনে নেয় অঙ্কিত আজ নাহয় চিঠিতেই ডুববে বাকি রাতটুকু।একটা রাত জাগলে ক্ষতি কি? টেবিল ল্যাম্পের আলোতে অঙ্কিত লিখতে শুরু করে অহনাকে লেখা ওর প্রথম চিঠি। একটু একটু করে কাগজের ভাজে ভাজে খুলে দিতে থাকে ওর শব্দবন্দি জিজ্ঞাসু মনটাকে। কে জানে সব জানতে পারার পর ওর মত একটা অনাথ ছেলেকে অহনা গ্ৰহণ করতে পারবে কিনা?
অনাথ কথাটা মনে হতেই নিজের ওপর খুব রাগ হয়।ছিঃ ছিঃ সত্যিই ও অকৃতজ্ঞ! ওর মা বাবা যারা ওকে এতো যত্ন করে মানুষ করেছে এমন ভাবনা মনে এলে তাদের তো অপমান করা হয়।
মনের কাছের বন্ধু অহনাকে মনের আনাচে কানাচে জমে থাকা সব কথাগুলো একটু একটু করে নিঃশব্দে শব্দবন্দি করলো। একবার তলিয়ে দেখলো মনে আর কিছু জমে নেই তো? মনের আনাচে কানাচে উঁকি দিয়ে দেখলো কাগজে কলমে নিজেকে নিঃশেষে উজাড় করে দিয়েছে। হয়ত এই দিনটার জন্যই অহনা না জেনেই ওকে দিয়েছিলো এটা। আজ কি সুন্দর কাজে লেগে গেলো।
সত্যিই এত কথা বলতে পারতোনা কখনই ফোনে বা সামনাসামনি। প্রথম চিঠিতে এক অজানা খবর দিলো অহনাকে। বাইরে তখন একটু হাল্কা আলো ফুটছে অঙ্কিতের খুব কফি খেতে ইচ্ছে করছে। সারারাত না ঘুমোনোর ক্লান্তি কেটে যেত। কিচেনে যাবার আগেই টেবিলে ফ্লাক্সটা নজর পড়ে,খুলেই গরম কফি।বাবারা কি এভাবেই অলক্ষ্যে নজর রাখে সবসময় অথচ কখনো মন খুলতে পারেনা হয়ত সেভাবে।
কফিটা হাতে নিয়ে জানলার পর্দাটা সরায় অঙ্কিত। অনেকদিন বাদে আবার একটা সুন্দর ভোর দেখলো অঙ্কিত একদম কুয়াশাবিহীন সুন্দর একটা ভোর।
*********************
রাধিকা মাঝে মাঝেই ফোন করে,শান্তনুর খবর নেয়। অঙ্কিত খুব চেয়েছিলো ফোনে রাধিকাকে কিছু বলতে,ক্ষমা চাইতে। ফোনেই মনে জমে থাকা কিছু কথা বলতে। শান্তনুই বারণ করেছে,বলেছে..." সব কথা ফোনে হয়না। অনেক মমতা অভিমান ভালোবাসা জড়িয়ে আছে সম্পর্কের পরতে পরতে ফোনে একটা সরি বলে তাকে খুলতে যাসনা কেমন যেন মেকি হয়ে যাবে ব্যাপারটা।"
অঙ্কিত বাবার দিকে তাকিয়ে বলে.." তাহলে? কিভাবে?"
হাসে শান্তনু,"আমি বলে দেবো সময় হলেই। আমরা যাবো তো,মানে আমাকে তো যেতেই হবে। আর তুইও যাবি কথাই আছে। তখনই নাহয় হবে।
সারাজীবন ও শুধু সারপ্রাইজ দেবে সবাইকে আর মহান সাজবে?"
"আর আমার মায়ের ফটো? সেটার কথা বলবোনা? যদি থাকে?"
"পঁচিশ বছর যখন অপেক্ষা করেছিস..আরো কয়েকটা দিন নাহয় অপেক্ষা করলি বাবু।"
অঙ্কিত অহনাকেও কিছু বলেনা ফোনে প্রেমের ফিসফিসানি আর কানাকানি তো প্রতিদিনই হয় তবুও খামবন্দি মনটা নিজেই খুলবে অহনা ওর কাছে পৌঁছলে।
খুব তাড়াতাড়ি জবাব দিলো অহনা একদম নিশ্চুপে ভালোবাসা ভরা এক রঙিন খামে। আঁকাবাঁকা অক্ষরে সেখানে লেখা কত ভালোবাসার কথা আর লেখা...."বন্ধুত্ব প্লাশ মোর মানে অনেক অনেক লুকোনো ভালোবাসা যা ডালপালা মেলে হোক আরো বড়,ফুল ফুটুক মনে। তোর অতীত গল্প হয়েই থাক তোর মনে আমি শুধু তোর ভালোবাসাটাই নিলাম সঙ্গোপনে।"
চিঠি কি এতই মিঠে হয়! এ যে এক রঙিন খাম ভালোবাসা ভরা শব্দের ঠাসাঠাসি। এই প্রথম বোধহয় কোন ভালোবাসার চিঠি পেলো অঙ্কিত।
অহনার মনে জমা প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছে অঙ্কিতের চিঠি থেকেই।তাহলে ওর কথাই সত্যি হলো।ম্যাম সত্যিই সেরার সেরা, হয়ত বা খাঁটি হীরা। অঙ্কিত খুব মাকে দেখতে চায়,অহনা ওর শ্যাম রাইকে বলে একটা ছবি যেন থাকে অন্ততঃ ওর মায়ের। আর থাকলে তা ম্যামের কাছেই থাকবে।
*********************
মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন।ছেলের ভালোবাসায় আর এদেশের আবহাওয়ায় শান্তনু এখন অনেক ভালো।শরীর মন দুই অনেক সুস্থ। রাধিকা নিজের বাড়িতে জন্মাষ্টমীর পুজো করলেও অহনার অনুরোধে ওদের বাড়িতে যেতেই হয়। শান্তনুকে বলে রাধিকা..." আমার ভাগ্যকে আবার হিংসা করিসনা,তুই বেয়াই বাড়ি যাবার আগেই আমি ওখানে গিয়ে এতো এতো আদর পেয়ে এলাম। খুব ভালো মানুষ ওরা,আরে আমার ছাত্রী বলে কথা!"
হাসিতে গল্পে কেটে যায় অনেকটা সময়।
অহনার মনে একটা ইচ্ছে অনেকদিন ছিলো রাধিকার পা ছুঁয়ে প্রণাম করার তা মিটিয়ে নিয়েছে জন্মাষ্টমীর দিন। রাধিকা বলে উঠেছিলো.." যখন তখন মাথা নিচু কোরনা।"
" আপনার কাছে বোধহয় সবসময় মাথা নিচু করা যায় ম্যাম।"
রাধিকা হাসে..." কেন বলতো?"
অহনা বলে..." মনে হলো।"
******************
বিদেশে একটু করে আসছে শীত শীত ভাব আর কলকাতার বাতাসে তখন শিউলি কাশের ছোঁয়ায় শরৎ রাণীর পায়ের শব্দ। কাউন্ট ডাউন শুরু হয়েছে মায়ের আগমণীর। রাধিকা পরিচিত বুটিকের বাইরে গাড়ি রাখে। ওরা হাসিমুখে এগিয়ে আসে..." অনেক নতুন ডিজাইনের পাঞ্জাবি এসেছে। আর আপনার শাড়িও।"
সে হবে.." এবার দু সেট পাঞ্জাবি আর শাড়ি চাই মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ করে। খুব ভালো কিছু দেখাবেন।"
" ম্যাম ছেলের বিয়ে নাকি?"
অঙ্কিতের পাঞ্জাবি বরাবর এখান থেকেই কেনে রাধিকা তাই ওরা জানে..."না এখনি নয় তবে পুজো তো তাই ইচ্ছে হলো।"
মনে মনে ভাবে রাধিকা অমিতকে নিয়ে তো কত স্বপ্নই দেখেছিলো। ঘর সাজাবে,পর্দা টাঙাবে,বুককেসে থাকবে গীতাঞ্জলি। এক রঙের শাড়ি পাঞ্জাবি পরবে দুজনে আর ছুটিতে চলে যাবে কোন হিল স্টেশনে। মুখোমুখি বসে গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে ডুবে যাবে প্রেমের কুয়াশায় আবছা আলোতে ধরবে হাত মুঠো করে। কত স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়।তারপর তো কতজনই হাত বাড়িয়েছে কিন্তু কেন যেন ছেঁড়া স্বপ্নের জাল কেটে ধরা হয়নি কোন হাতই মানে ভরসাই পায়নি।
অহনাও মায়ের সাথে টুকটুক করে কেনাকাটা করছে পুজোর আমেজ নিতে নিতে।আকাশে শরতের ভেসে বেড়ানো নীল নীল ছেঁড়া মেঘের সাথে ওর মনেও প্রেমের আল্পনা মা তখন শাড়িটা গায়ে ফেলে দেখাচ্ছে দেখতো এটা তোর ম্যামকে ভালো লাগবেনা?
***************
শান্তনু ছেলের সাথে একদিন বায়না করেই বেরোলো.." ওমা,কিছু নেবোনা বিদেশী জিনিস এখান থেকে?"
অঙ্কিত হাসে..." তোমার বন্ধুর জন্য?"
" আমার বন্ধু আর তোর বন্ধু দুজনের জন্য। তুই আমাকে ছেড়ে দিয়ে যা,পরে এসে নিয়ে যাবি।তোর সামনে কেনাকাটা করতে পারবোনা।"
বাবার কান্ড দেখে হেসে বাঁচেনা অঙ্কিত.." মনে হয় পুরো ডিপার্টমেন্টই কিনে নেবে?"
তবে অঙ্কিত দেখলো বাবার সেন্স ওর থেকে অনেক ভালো.. খুব সুন্দর দুটো ব্যাগ,দুটো জ্যাকেট। অহনার জন্য আর ওর জন্য টিশার্ট আর রাধিকা মাসির জন্য একটা পারফিউম কিনলো।
অবশ্য অঙ্কিতও কিনেছে অহনার জন্য একটা পারফিউম। ভালোবাসার গন্ধকে আরো গভীর করতে ফুল আর সুগন্ধের কোন বিকল্প নেই।
অঙ্কিত এর আগে কখনোই এতবার একবছরে আসতে পারেনি তবে এবছর সবই যেন ছকভাঙা খেলায় উল্টোপাল্টা। তাই আবার প্রস্তুতি চলছে বাবাকে রেখে আসার সাথে সাথে ওর অতীতের কিছূ স্মৃতি দেখে আসা কারণ এখানের শীতে বাবাকে এখানে রাখাটা ঠিক হবেনা তাছাড়া বাবাও খুব ব্যস্ত বাড়ি যাবার জন্য। ওখানে ছাদের একটুকরো সবুজ রুমালে যে বাবার মনটা বাঁধা। যদিও কুন্তিদি আর মন্টুকে বলা হয়েছে দেখতে তবুও বাবার মন উচাটন।
******************
দেখতে দেখতে উড়ানের ডানায় ভর করে আবার উড়ে যাওয়া বাড়ির দিকে পুজোর টানে।
আগে রাধিকামাসি এয়ারপোর্টে এলেও এখন আর আসেনা। অহনাকে বারণ করেছে অঙ্কিত। তাই বাবা আর ছেলে আবার পা রাখলো নিজেদের বাড়িতে।
অনেকদিন বাদে বাড়ির সেই পরিচিত সুবাসে শান্তনুর মন ভরলো।
পরের দিনই মহালয়ার ভোর,অনেকদিন বাদে বাবার পাশে বসে মহালয়া শুনলো অঙ্কিত আজ খুব মনে হচ্ছে মায়ের কথা। মহালয়া শেষ হওয়ার পরই বাড়ির সামনে গাড়ির আওয়াজ শান্তনু বারান্দায় বেরিয়ে আসে..নিচ থেকে হাত নাড়ে অহনা। শান্তনু ইশারায় ডাকে ওকে ওপরে..হাত দেখায় অহনা। ততক্ষণে অঙ্কিত এসে গেছে,বাবাকে বলে.." বাবা আমি একটু আসছি,কিছুক্ষণ বাদেই ফিরবো। তখন অহনাকে আনবো ওপরে।"
হাসে শান্তনু...সত্যিই তো অনেকদিন বাদে দেখা তাই একটু খোলা হাওয়া লাগুক ওদের প্রাণে...রেডিওটাও হঠাৎই সুরে বেজে উঠলো..' তোমার খোলা হাওয়া,লাগিয়ে পালে।'
অহনা অঙ্কিতের দিকে তাকিয়ে হাসে...দুধসাদা পাঞ্জাবিতে অঙ্কিতকে খুব সুন্দর মানিয়েছে বেশ একটা পবিত্রতার ছোঁয়া ওর চোখে মুখে। অহনার খুব কাছে এসে বসে অঙ্কিত..অহনা ওর হাতে প্যাকেটটা দেয়। গাড়ি তখন শরতের ভোরের স্নিগ্ধতা কেটে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। গাড়িটা এসে দাঁড়ায় অঙ্কিতের খুব পরিচিত একটা বাড়ির সামনে।বাবার দেওয়া চাবি দিয়ে দরজা খুলে চুপিচুপি দরজা খুলে ঢোকে অঙ্কিত... কৃষ্ণের মূর্তির সামনে পুজোতে বসেছে রাধিকা। কাঁচা পাকা খোলা চুলের রাশি ছড়িয়ে আছে পিঠজুড়ে।
পেছন থেকে এসে শাড়ির আঁচলটা ধরে অঙ্কিত মুখ দিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বলে ফেলে আলতো স্বরে মাম্মা।
চমকে উঠে ততক্ষণে পেছন ফিরেছে রাধিকা অনেকদিন পরে রাধিকার কোলে মুখ ডুবিয়েছে অঙ্কিত ওর হাতে ধরা লাল পাড়ের গরদের শাড়িটা রাধিকার কোলে.." না জেনে অনেক কষ্ট দিয়েছি তোমাকে মাম্মা আমাকে ক্ষমা করে দাও।"
রাধিকার বাধ্য চোখদুটো আজ বড়ই অবাধ্য...ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে," কবে বড় হবি শুনি? এবার তোকে বিয়ে দিয়ে বৌ আনতেই হবে। আমরা আর পারছিনা সামলাতে।"
অনেকদিন বাদে মাতৃত্বের অমৃতধারার স্বাদ প্রাণভরে নিতে চায় অঙ্কিত। অহনা তখনো বাইরে অপেক্ষা করছে,এই সময়টুকু শুধুই ওদের তাই সুখটুকু ভাগ করে নিক ওরা।
রাধিকা আদরের স্বরে বলে.." ওঠ এবার। এই প্ল্যান কার শুনি? নিশ্চয় ঐ পাজি শান্তনুটার? কিচ্ছু বলেনি আমাকে আগে থেকে। কতদিন বাদে ঐ মাম্মা ডাকটা শুনলাম!"
অঙ্কিতকে নিয়ে ওদের দুজনের ছবির সামনে এসে দাঁড়ায় রাধিকা ও বুঝতে পারে ও যে ছবিটা দেখেছে সেই একই দিনে এই ছবিটা তোলা হয়েছে। অঙ্কিত বলে.." আচ্ছা মাম্মা আমার মায়ের কোন ছবি নেই? খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।"
রাধিকা তাড়াতাড়ি পাশের ঘরে যায় অঙ্কিতের হাতের মুঠোয় একটা হার দেয় তাতে একটা লকেট।
" তোর মায়ের গলায় এটা ছিলো...খুলে দেখ।"
অঙ্কিত খুলে দেখে কমবয়েসী সরল সাধাসিধে গোল একটা মুখ কপাল সিঁদুরের টিপ,পাশে বাবার ছবি। লকেটটা হাতের মুঠোয় চেপে ধরে অঙ্কিত।রাধিকা বুঝতে পারে মাকে অনুভব করার চেষ্টা করছে ছেলেটা। ওর মাথায় হাত রাখে রাধিকা..
অঙ্কিতের ছোঁয়ায় আজ রাধিকার হলো মাতৃত্বের দেবী বরণ। অনেক না পাওয়ার মাঝে হয়ত এটাই সেরা পাওনা। ভেজা গলায় রাধিকা বলে..." তোর রথের সারথীকে এবার ডাক।আমি জানি সে এসেছে ঠিক। আর পালের গোদাটাকে আমি একহাত দেখে নেবো দাঁড়া এইভাবে চুপিচুপি আমার বাড়ির চাবি দিয়ে ছেলেকে পাঠানো।"
হেসে ফেলে অঙ্কিত ততক্ষণে ম্যামের ডাকে অহনা এসে দাঁড়িয়েছে।
" ছোটবেলায় তুমি খুব দুষ্টু ছিলে তাইনা মাম্মা? ছেলেরা বোধহয় তোমাকে ভয় পেতো।"
রাধিকা হেসে বলে," ছিলাম তো,আর এখনই বা কম কিসে। কি রে অহনা? তাইনা?"
মাথা নাড়ে অহনা..." ইউ আর দ্য বেস্ট ম্যাম।"
" এই যে এবার থেকে ম্যাম না বলে মম্ বলার অভ্যেস করো।"
মহালয়ার ভোর উদ্ভাসিত হলো এক নতুন ভালোবাসার রঙে...প্রেম,মাতৃত্ব শ্রদ্ধা সব মিলে মিশে একাকার হয়ে গেলো।©রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী।
শেষ করার জন্য আরকটা দিন নিলাম আশা করি সবাইকে সাথে পাবো।
Comments
Post a Comment