#মিঠে_স্মৃতি#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
'লাজে রাঙা হলো কনে বৌ গো মালাবদল হবে এই রাতে আজ মালা বদল হবে এই রাতে। '
গানের সুরে বিয়েবাড়িতে বেশ বিয়ে বিয়ে আমেজ আর ব্যস্ততা।
বিয়ের সন্ধ্যেয় মনে মিষ্টি আবেশ বোধহয় থাকে যে কোন মেয়ের। ঠিক তেমনি হাতে গাছকৌটো ধরে আর গা ভর্তি গয়না পরে চন্দনের লালিমায় ললিতা লালিত্যে ভরপুর হয়ে বসে অপেক্ষায় মালাবদলের। বাড়িভর্তি লোকজন আর সানাইয়ের মিঠে সুরে নতুন কিছুর গন্ধ বাড়িজুড়ে। সবার আদরের ললিতার আজ মেয়ে থেকে বৌ হবার দিন।
ইতিমধ্যেই দুধসাদা গাড়ি থেকে যত্নে নামিয়ে বরণ করে আনা হয়েছে ওর বরটিকে সে খবর ওর বোনেরা এনেছে অন্দরমহলে। আরেকটু কল্পনার জাল বোনাতে ব্যস্ত হয়ে যায় ললিতা।প্রায় ছমাস আগে বরকে দেখেছে এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যেতে,কথায় কথায় বেশ কিছুটা সময় কেটে গেলেও সেভাবে মুখের দিকে তাকিয়ে আদেখলা পনা করতে পারেনি বছর বাইশের ললিতা।
এখনো বরের জিজ্ঞেস করা দুটো প্রশ্ন বেশ মনে পড়ে..বেশ হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করেছিলো.." আপনি বিদেশী রান্না জানেন?"
ললিতা বেশ ঘাবড়ে গেছিলো ওদের বাড়িতে দেশী রান্নারই চল বেশি।বাবা,কাকা, ঠাকুরদা সবাই ভোজনরসিক কিন্তু খাওয়ার ব্যাপারে খাস বাঙালিয়ানা.. ফুলকো লুচি,ছোলার ডাল,আলুরদম নিদেনপক্ষে কুমড়োর ছক্কা,হালুয়া,পায়েশ,মালপোয়া, ক্ষীর,মাছের কালিয়া,চচ্চড়ি,ইলিশভাপা,চেতল মুইঠ্যা,পাতুরি,মালাইকারি এইসব রান্নার গন্ধেই তো চিরকাল বাড়ি ম ম করেছে। এর মধ্যে আবার বিদেশী রান্না কোথা থেকে এলো?
হোটেল রেস্টুরেন্টে খাওয়া বাবার না পসন্দ সব সময় এক কথা..." মায়ের রান্নার কাছে আর কিছু লাগেনা। শরীর মন দুইই ভালো থাকে।"
বন্ধুদের সাথে পকেটমানি বাঁচিয়ে বড়জোর
চাউমিন,রোল,মোগলাই,ডেভিল বা কাটলেটে কামড় বসিয়েছে। ওদের ছোট শহরে তখন এইটুকুই।
তবুও ওপাশের ছেলেটা প্রশ্ন করে যখন একটা মিটিমিটি হাসি দিচ্ছে ভাবটা এমন বেশ জব্দ করেছি।তখন ললিতা একদম স্মার্টলি উত্তর দিয়েছিলো..." খেতে ভালোবাসি, বাবাও খুব খাওয়াতে ভালোবাসেন। বিদেশী রান্না তেমন কিছু জানিনা শিখে নেবো।"
ওদিক থেকে উত্তর এসেছিলো.." শেখার ইচ্ছেটাই আসল।"
ললিতা বলেছিলো," কিন্তু কার কাছে শিখবো? আপনি জানেন তো? তাহলে একটু হেল্প করবেন প্লিজ। আমি আবার হাতে কলমে ছাড়া ঠিক পারিনা।"
হাসির রোল উঠেছিলো ছেলের দুই বন্ধুদের মাঝে মানে বোঝ ঠ্যালা এবার যেমন প্রশ্ন তেমন উত্তর। ললিতার হয়ে ওরাই বলে দিয়েছিলো.." একটা কন্টিনেন্টাল কুকিং ক্লাস জয়েন করে নে।"
ললিতা কলার তুলেছিলো খুব একটা বোকা নয় ও যাক প্রথম প্রশ্নবাণ ভালোই ভেদ করেছে।
দ্বিতীয় প্রশ্নটা বড় বোকা বোকা অবশ্য.." বেড়াতে গিয়ে বাসে উঠলে বমি হয় কিনা? মানে আমি তো খুব ঘুরতে ভালোবাসি।"
ললিতা হেসে বলেছিলো.." এখনো হয়নি কোনদিন তবে বিয়ের পর নতুন নতুন রোগ হয় শুনিছি। আপনার হয়না তো বমি? আমিও কিন্তু খুব ঘুরতে ভালোবাসি।"
একটু ঝালঝাল মিঠে মিঠে ললিতাকে ভালো লেগে গিয়েছিলো রায়ানের। আর তারপরই প্রজাপতি একদম হলুদ সিঁদুর মেখে উড়ে এসেছিলো শুভ পরিণয়ের বার্তা নিয়ে।
সিঁদুরের ছোঁয়ায় রাঙা হয়ে শ্বশুরবাড়িতে দুধে আলতায় পা ডুবিয়ে লক্ষ্মী লক্ষ্মী পা ফেলে গুটি গুটি গিয়েই বুঝেছিলো শ্বশুরবাড়ি খুব একটা সহজ জায়গা নয় বাপু,এখানে পদে পদে যাচাই করা আছে।প্রথমে রূপ দিয়ে শুরু তবে শেষটা সেই গুণে মানে বেশিরভাগই উনুনে গিয়ে ঠেকে।
তাই পড়াশোনাতে বেশি মন আর খুন্তি নাড়াতে ঠনঠন ললিতাও দেখলো সে মোটামুটি পিছিয়ে পড়া শ্বশুরবাড়িতে। রূপসী তেমন সে নয় তবে লালিত্য হয়ত আছে আর সেই সুবাদেই ড্যাং ড্যাঙা ড্যাং টু ছাদনাতলা কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে কম্পিটিশন আর ডেইলি টেস্টে তো ডাহা ফেলটু আর সেই সুযোগ নিয়ে সবাই ঘা মারে সেন্টুতে।
ননদ রান্নাতে সৈরেন্ধ্রী,অমুকে ভালো রাঁধে তমুকে চুলবাঁধে আর রাঁধেও তুমি একটা যাচ্ছেতাই ঐ ঝালঝাল কথা ছাড়া আর কিছু নেই।
বরের আদরের ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝেই মনটা হু হু করে ললিতার।তখন তো ছাই ঐসব তুমিনল ইস্ মানে ইউটিউবও ছিলোনা।
বরের করা দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব দিব্যি দিয়েছে,হানিমুনে পাহাড়ে গিয়েছে গাড়িতে গড়িয়ে গড়িয়ে, বমিটমি হয়নি। বরও খুশি ললিতাও খুশি, ভাবে যাক বরের কাছে তো পাশ যতই শ্বশুর বাড়ির লোকজন বলুক ধপাস। তবে প্রথম প্রশ্নের উত্তরের কি হবে? বরকে চাউমিন,ফ্রায়েড রাইস চিলিচিকেন ছাড়া মানে চীনকে কুপোকাত করা ছাড়া আর কিছুই পারেনি।
রায়ান রাতের আদরে ফিসফিস করে বলে.." প্রথম প্রশ্নের জবাব কই?"
ললিতা বলে," তুমি শিখেছো? তোমার কাছেই তো শিখবো।"
বর কিছু না বললেও আত্মসম্মান বলে তো একটা জিনিস আছে বাপু আর অগ্নিপরীক্ষা যখন সীতাকেই দিতে হয়েছে তখন আর সামান্য রান্নার পরীক্ষায় ভয় পাবেনা।
রায়ান অফিসে চলে যাবার পর শ্বশুরবাড়িতে সব কিছু গুছিয়ে দুপুরের দিকে বেরোয় ললিতা সপ্তাহে দুদিন শাশুড়িমায়ের দিবানিদ্রার ফাঁকে কাজের মেয়েকে বলে।
একদিন শাশুড়িমা খপ করে ধরলেন.." মাঝে মাঝেই কোথায় যাও শুনি? সেদিন তো বললে সুতো কিনতে। আরেকদিন কাগজ কিনতে।কি এত সেলাই করো আর আঁকো শুনি।"
" মা ঐ টুকুই তো ভালোবাসা,একটু আঁকি মাঝেমধ্যে সেলাই করি। চাকরিও তো পেলামনা এখনো।"
" ঐ সব ভূত নামাও মাথা থেকে সংসারটা করো ঠিক করে।"
দেখতে দেখতে বিয়ের প্রথম বছরের বিয়ের জন্মদিন আসছে ললিতার।মনটা বেশ খুশি খুশি হলেও ললিতার বায়না সেদিনটা ওরা নিজেদের মত করে কাটাবে। অনুষ্ঠান করতে হলে সপ্তাহের শেষে ছুটির দিনে।
****************
অফিস থেকে ফেরার পথে ফুলের গোছা নিয়ে ফেরে রায়ান, এই একবছরে ভালোই জেনেছে ফুল ভীষণ পছন্দের ললিতার। বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠার মুখেই খাবারের গন্ধে মন ভরে যায় রায়ানের। কই ললিতা তো আগে তেমন কিছু বলেনি, কি হচ্ছে বাড়িতে?
বেল বাজাতেই দরজা খোলে ললিতা। লাল সরু জরির পাড়ের কাঞ্চিপুরমে আর সোনার ঝুমকোতে খুব সুন্দর লাগছে ললিতাকে।ওর হাতে ফুলের বোকেটা দেয় রায়ান..." মেনি মেনি হ্যাপি রিটার্নস অফ দ্য ডে।"
ওদের ডাইনিং হলে ঢুকে অবাক লাগে রায়ানের এত সুন্দর করে সাজালো কে?
ললিতার মুখে তখন দুষ্টুমি ভরা হাসি।রায়ান বোঝে এই জন্যই ওকে ঠেলেঠুলে অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছে। ঘর থেকে তার মধ্যেই শ্বশুরমশাই আর শাশুড়িমাকে নিয়ে এসেছে ললিতা।টেবিলের ওপর একটা ছোট্ট খুব সুন্দর অ্যানিভার্সারি কেক,তার ওপর বসানো একটা মিষ্টি কাপল।
" কি কান্ড করেছে দেখ,এই মেয়ে যে এত কিছু জানে আমি তো জানতামই না। আমাকে রান্নাঘর থেকে বিদায় করে মিনতিকে নিয়ে সারাদিন ধরে এইসব করেছে।"
শাশুড়িমায়ের প্রশংসা আর রায়ানের মুগ্ধ দৃষ্টি এক ভালোলাগায় ভরে দেয় ললিতাকে। টেবিলে তখন সুন্দর করে সাজানো স্টার্টার,মেন কোর্স আর ডেজার্ট।
সবই খুব অল্প অল্প করেছে তবে সাজানো গোছানো আর স্বাদে গন্ধে পরিপাটি।
ললিতার গালে ভালোবেসে একটু ক্রীম লাগিয়ে রায়ান বলে," এত কিছু শিখলে কখন? আমি তো ভাবতেই পারছিনা?"
ললিতা বলে," একটা কুকিং ক্লাশ করেছিলাম কিছুদিনের জন্য। বলেছিলাম না শিখে নেবো।"
শাশুড়িমা বলেন.." আমাকে ফাঁকি দিয়ে পালাতো দুপুরে বুঝলি।"
রায়ান হেসে বলে," বুঝলাম তবে বৃহত্তর কাজের জন্যই করেছে বুঝলে মা। তাই একটা গিফ্ট একদম দিতেই হবে। নিচের তলায় একটা ওর পছন্দমত কিচেন করে দিই কি বলো? দরকারে কুকিং ক্লাশও নিতে পারবে।"
ললিতার মুখে তখন এক মিঠে হাসি আজ যে ওর চ্যালেঞ্জ জেতার দিনও। আসলে নিজের ঘরদোর ছেড়ে বরের হাত ধরে গাছকৌটো হাতে নিয়ে মেয়েরা শ্বশুরবাড়িতে পা দেবার সাথে সাথে কখন যে বড় হয়ে যায় বোঝেইনা। লটারির টিকিটে কখনো আসে প্রথম পুরস্কার আবার কারো বা টিকিট কেটেই জীবন যায় পুরস্কারের বদলে তিরস্কারেই জীবন কেটে যায়। তবুও সব মেয়েই চায় ললিতার মত সব চ্যালেঞ্জ জিততে।
ললিতার বিয়ের প্রথম জন্মদিনটা মনের ডায়েরীতে খুশির দিন হিসেবে লেখা আছে এখনো মাঝে মাঝে কোন উদাস করা বিকেলে পাতা উল্টে দেখে আর অনাবিল আনন্দে মন ভরে যায়।
ছোট থেকে বড়,বড় থেকে বুড়ো হওয়ার জার্নিতে সবারই হয়ত এমন দুএকটা খুশির দিন আছে যার পাতা উল্টেই মাঝে মাঝে যাদু কি ঝাপ্পি নিয়ে খুশি থাকা।©রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী
সমাপ্ত:
Comments
Post a Comment