ছোটছোট ইট দিয়ে গাঁথা বাড়িটার সামনে রিক্সাটা থামতেই বলে মহিম," আরে এখানে কেন দাঁড়ালে?
আমি তো বলেছি পূবপাড়াতে জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি যাবো "
রিক্সাওয়ালার মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায় মহিম,মিটমিটে একটা হাসি ওর মুখে।একটু ভয় করে মহিমের কে জানে লোকটা আবার খারাপ নয় তো?
প্রায় দশবছর বাদে পা রেখেছে নিশিকান্তপুরে।দেশে ফেরার পর কে যেন টেনে নিয়ে এলো এখানে।
মাধুরীর নিশ্চয় এতদিনে বিয়ে হয়ে গেছে,দশবছর তো কম সময় নয়।
একদিন মাধুরীকে ভালোবাসার স্বপ্ন দেখিয়ে সুযোগ পেয়ে নিজেই ভালোবাসার দেশে চলে গিয়েছিলো। হঠাৎই চমক ভাঙে মহিমের রিক্সাওয়ালার খোনা গলায়,"বাবু ভাড়াটা দেন দিকি,পথ এখানেই শেষ আর এটাই জটিলেশ্বর বাবুদের বাড়ি। হঠাৎই আগুনে পুইরে এমন হয়েছে।"
এক অদৃশ্য টানে মহিম বাড়ির ভেতরে পা রাখে। চারদিকে আগাছা হয়েছে,আর ঢুকতে সাহস পায়না মনে হয় কেউ থাকেনা এখানে। চোখ চলে যায় দোতলার ঘরটার দিকে এই ঘরেই তো মাধুরীকে কাছে টেনে নিয়েছিলো। ডুব দিয়েছিলো ওর নরম শরীরে। কথা দিয়েছিলো আসবে তাড়াতাড়ি।
হঠাৎই কানে আসে," মহিমদা এলে নাকি? কতদিন তোমার অপেক্ষায় বসে আছি।"
মহিম অবাক হয়ে তাকায়,ওপরের সেই ঘরটা থেকে ওকে হাত নেড়ে ডাকছে মাধুরী।
" মাধুরী তুমি এখানে আছো কি ভাবে?"
হঠাৎই ওপর থেকে নিচে লাফ দেয় মাধুরী।
চোখ বোজে মহিম। ওর কানের কাছে শুনতে পায় ফিসফিস করে কে যেন বলছে," ছিলাম তো,কিন্তু থাকতে দিলো কই?বাচ্চাটাকে রাখতে পারলাম না।তার আগেই বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিলো ওরা।"
নাকে পোড়া গন্ধ আর অপরাধের জ্বালায় অজ্ঞান হয়ে পড়লো মহিম তার আগে কানে এলো মৌমিতার বুকফাটা কান্না," এত দেরি করলে কেন তুমি।"
#আয়না#
কলমে:রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী
অনেকদিন বাদে হাওড়া স্টেশনের বড় ঘড়িটার নিচে এসে দাঁড়িয়েছে পূর্বা। একটা সময় এটাই অপেক্ষার লক্ষ্মণরেখা ছিলো।
মা জোর করে সাথে নিয়ে এলো প্রায় এক বছর গৃহবন্দি থাকার পর। মাসির বাড়ি যেতেই হবে মেসোকে দেখতে,তাই কোন আপত্তিই টিকলোনা।
লোকাল ট্রেনের লেডিসে দিব্যি পাওয়া গেলো দুটো সিট জানলার পাশেই। মাকে পাশে বসিয়ে জানলায় চোখ রাখে পূর্বা গাছপালা গুলো দৌড়ে যাচ্ছে।কলকাতার বাইরেও এখন কত বাড়িঘর।অনেকদিন বাদে কোন্নগর যাচ্ছে মায়ের সাথে।
স্টেশনে নেমে রিক্সাতে ওঠার মুখেই পাশ থেকে কে যেন বলে ওঠে.." পূর্বা না?ঠিক চিনতে পেরেছি এতদিন বাদেও।"
অবাক হয়ে যায় পূর্বা আজকাল ওর অনুভূতিগুলোও কেমন যেন ভোঁতা হয়ে গেছে ওর মতই। মনে করার চেষ্টা করে ঠিক মনে হয়না।
রিক্সাওয়ালাও তাকিয়ে আছে বোধহয় দেরি হয়ে যাচ্ছে।
"আরে আমি লাভলি,একসাথে কলেজে পড়তাম তোর মনে নেই? একবার তো নাটকও করলাম একসাথে।"
স্মৃতির পাতা উল্টোতে একটু সময় লাগে পূর্বার। মনে পড়লো ওর বন্ধু মাঠে সহপাঠী ছিলো মেয়েটা একসময়।
পূর্বার শীতলতা গলানোর জন্য লাভলির উষ্ণতাই যথেষ্ট।ঐটুকুর মধ্যেই ঝপাঝপ ওরা কোথায় যাচ্ছে শুনে নিলো।
"আরে কাছাকাছিই তো আমার বাড়ি,আমি আসবো তোকে নিতে একটু গল্প করবো।"
অনিচ্ছাকৃত ভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে পূর্বা বলে," তুই এখান থেকে কলেজ করতিস?"
" না রে এখন থাকি এখানে,মানে চলে এসেছি।"
মাসির বাড়িতে অনেকদিন বাদে এলো বুঝতে পারলো মা আর মাসির চোখে চোখে কিছু ইশারা হলো।মা বোঝাতে চাইলো ও এখন ভালো আছে।মাসি শান্তির শ্বাস ফেললো জেনে।
মেসো অনেকটা ভালো আছে। মায়েরা গল্পে ব্যস্ত। তার মধ্যেই লাভলি এসে হাজির পূর্বাকে যেতেই হলো। মা বললো," যা ঘুরে আয়। আজ রাতটা তো আছি,একটু গল্প করে আয়।"
অনিচ্ছায় মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে একটু মনকে আলাদা বাতাস দেবার জন্য পা বাড়ায় পূর্বা লাভলির সাথে।
ওদের বাড়িতে অনেক লোকজন সবার সাথে ওকে আলাপ করিয়ে ওপরের ঘরে নিয়ে যায় লাভলি।
ওর সামনে তখন একপ্লেট মিষ্টি সাজানো।পূর্বা আপত্তি করে," এতো খাবোনা রে।" লাভলি যেন ওর কথা শুনতেই পায়না," এই শোননা আমার না বিয়ে সামনের মাসে।তোকে আসতে হবে কিন্তু।দাঁড়া তোকে ছবি দেখাই। এই দেখ কি সুন্দর না আয়নার সামনে দাঁড়ানো আমাদের ছবিটা! আমার তো খুব পছন্দ হয়েছে এই আয়নাটা।"
পূর্বারও খুব ভালো লেগেছিলো ঐ শ্বেতপাথরের কাজ করা আয়নাটা। প্রবীরের সাথে বিয়ের পর প্রথম ছবিটা ঐ আয়নার সামনেই দাঁড়িয়েই তুলেছিলো লাল বেনারসি পরে। আজ আয়নায় হঠাৎই নিজের রক্তাক্ত মুখটা আবার দেখলো পূর্বা।
মনে মনে বললো তুই ভালো থাকিস লাভলি,তোর বিয়েতে আমার আর আসা হবেনা।
ফিরে এসে মাকে বললো," আচ্ছা মা সন্ধ্যেতে ফেরার কোন ট্রেন নেই? বাড়ি যাবো।"
শ্যাওলা
রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী
দাম্পত্যের ভরা টলটলে দীঘি মাঝেমাঝেই আজকাল মরা সোঁতার মত মনে হয় উত্তরার। কোথাও যেন একটা শ্যাওলার গন্ধ পায়। বুঝতে পারে ভালোবাসার মসৃণ সিঁড়িতে শেওলা জমেছে যেখানে আজকাল আর অবলীলায় উঠতে পারেনা উত্তরা মাঝে মাঝেই পা পিছলে যায়।
অভির অফিসিয়াল জন্মদিনের দিন ও ফিরলো,মুখে লাজুক হাসির ছোঁয়া হাতে ফুলের বোকে আর মিস্টির বাক্স।অবাক হয়ে গেলো উত্তরা"কে দিলো এগুলো?আগে তো কোনদিন আনোনি?" "আমি তো জানতামই না কিছু,ওরাই কেক,ফুল,মিস্টি সব এনেছে।" বুঝতে পারলো নতুনভাবে নতুন নতুন দিনের আনন্দের জানলাগুলো খুলে গেছে অভির জীবনে।
অদ্ভুতভাবে সেবার ওদের বিবাহবার্ষিকীর দিনে অভির অভ্যেসেও বদল এলো,খালি হাতে ফিরলো অভি। উত্তরার পছন্দের রজনীগন্ধা সেদিন আর গন্ধ ছড়ালোনা ওদের ভালোবাসার জন্মদিনের আনন্দ বাড়াতে।
টিভিতে খবর চলছে কখনো সারা বিশ্বের মৃত্যুর পরিসংখ্যান আবার কখনো সুস্থতার হারের বাড়া কমার বাজার দর। তার মধ্যেই পর্দা সরিয়ে ঠাম্মার ঘরে ঢোকে বুকু।তাড়াতাড়ি মুখে মাস্কটা পরে নেন অমলা," ও দাদুভাই তুমি আবার এখানে এলে কেন?বলেছিনা আমার কাশি হয়েছে এখানে আসতে নেই।"
ছোট্ট বুকু বলে," তুমিও তো আমার কাশির সময়ে আমার ঘরে এলে,আমার বুকে তেল মাখালে মধু খাওয়ালে।আমি তো শুধু তোমাকে দেখতে এসেছি।"
বৌমাকে ডাক দেন অমলা,বুঝিয়ে নিয়ে যাক ছেলেকে নাহলেই হয়ত ছোট অন্যায়ে বড় শাস্তি পাবে ছেলেটা।
স্যানিটাইজার হাতে ছুটে আসে অমলার বৌমা " আচ্ছা মা আপনাকে তো বলেছি,আপনার কাশি হয়েছে ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকুন।খাবার দেবার সময় আমি নক করলে খুলে দেবেন। কত দিকে দেখবো বলুন তো?"
চাপা শাসনের আওয়াজটা চাপা দিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজাটা বন্ধ করেন অমলা। সন্দেহের অসুখে আজ ভুগছে সমাজ,সবার চোখেই আজ চোরা চাউনি ছোঁয়াটুকু বাঁচিয়ে চলা।
অনুভূতি
রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী
ছাদ বাগানের সবুজের রঙ মিলান্তি খেলায় মনের ক্লান্তি দূর করে দূর্বা। কতদিন পা রাখেনি বৃষ্টি ভেজা ঘাসে,কতদিন ছাতা মাথায় হাঁটেনি ফুটপাথ ধরে। ভোরের আলো মাখতে মাখতে ওদের শ্যামবাজারের বাড়ির নোনাধরা চার ভাগ হওয়া ছাদের একটা কোণে পলিথিনে পলিথিনে ওর গাছের সংসার। শাশুড়িমা যদিও প্রথমে খুবই আপত্তি করেছিলেন," এই ভাগের বাড়িতে নিজেদেরই থাকার জায়গা নেই তারপর আবার ছাদের একটা কোণ দখল করলো গাছেরা।"
" থাকনা মা, একটু সবুজের ছোঁয়া ঐ কালো ছোপধরা ছাদের বুকে।"আজ সেই ছোট্ট গাছগুলোতে দোল দেয় নয়নতারা,টগর,বেল আর জবা। প্লাস্টিকের ঝুড়ি ভরে ছাদের বাগানের ফুলে। শাশুড়িমা বলেন," ফুলগুলো এই সময় পুজোর কাজে বেশ লেগে গেলো।"
কদিন পূবের জানলা আর খোলা হয়নি দূর্বার।বড় তরফের মানে ওর জেঠাশ্বশুরের বাড়িতে সবাই পজেটিভ।শাশুড়িমা বললেন,"বৌমা, তুমি ছাদেও উঠোনা,ও বাড়ির হাওয়াও নাকে আসা খারাপ।"
" আমার গাছগুলো যে আছে ওখানে মা,আমাকে একবার তো যেতেই হবে।" "তা নাকমুখ বেঁধে যেয়ো বাপু।"
একদম ভোর ভোর ছাদের গাছে জল দিতে দিতে প্রাচীরের ওপার থেকে একটা মিহি আওয়াজ আসে,"দিদিভাই আমি এপাশে এসেছি গো।"
প্লাস্টিকের ব্যাগে ডিম,দুধের প্যাকেট,সোয়াবিন আর সব্জি ভরে এপাশে রেখে দড়িটা ওপাশে ঝুলিয়ে দেয় দূর্বা সাথে ওর গাছের ফুলও। দড়ির টানে ব্যাগটা ওপারে চলে যায় বুঝতে পারে ইন্দু মানে ওর জা নিলো হয়ত দেওরও আছে সাথে।
"সুখের দিনে নাইবা হলাম মুখোমুখি, অসুখের দিনে তাই বলে কি দূরে থাকি?" বরকে বুঝিয়েছিলো দূর্বা।ওর বর হেসে বলেছিলো,"বুঝলাম,ইধার কা মাল উধার করা তো?এ আর নতুন কি?যতই মাঝে প্রাচীর থাক,তার মধ্যে দিয়েই যে বাটি চালাচালি হয় তা কি আর আমি জানিনা।বৌ যে আবার দুব্বা নয় দুগ্গা।"
"চুপ,গোপন কথাটি থাক গোপনে।"বলে হাতের আদরে বরের ঠোঁটটা বন্ধ করে দূর্বা।
Comments
Post a Comment