Skip to main content

ননীর পুতুল

#ননীর_পুতুল#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

ফেসবুক হোয়াটস অ্যাপ করার অভ‍্যেস কোনদিনই লীলার ধাতে ছিলোনা,আর একটা সময় তো ফোনই ছিলোনা।হাতে চিঠি লিখে আদানপ্রদান হতো ঐ ডাকবাক্সে তারপর পিয়ন এসে বাড়িতে দিয়ে যেতো। তারপর এলো বাড়িতে রিসিভার ওয়ালা হ‍্যালো ফোন।কালো হাতল ধরে মনের দেওয়ালের ফোকর দিয়ে এপারের কথা ওপারে বলা আর সেটাই বেশ। চেয়ারে বসে কানে ধরে কথা বলো যতখুশি।লীলার কর্তাটি অবশ‍্য ব‍্যস্ত মানুষ হলেও শৌখিন ভীষণ আর বৌ অন্ত প্রাণ ছিলেন। তাই কিছুদিন বাদেই ঐ কালো মোটা হাতল বাদ দিয়ে সরু সুন্দরী সোনালী হাতলের ফোন আনলেন।
       লীলার স্বামী সমীরণ যাকে চিরকাল হ‍্যাঁ গো ওগো শুনছোই সে করে এসেছে সেই দাপুটে পুলিশের বড় কর্তার কাছে আদরের বৌটি চিরকালই একটা নরম তুলতুলে খরগোশের মত।আজকালকার মেয়েদের হয়ত ভালো লাগবেনা কিন্তু লীলা চিরকালই মোমের বাবা বললো এই শাড়িটা পরো,এই গয়নার ডিজাইনটা মোমের বাবার পছন্দ করে বানানো,মোমের বাবা এই তসরটা ভাগলপুর থেকে এনেছে এমনই গল্প করতে ভালোবেসেছেন।
      যদিও তারই মেয়ে মোম মানে মৌমিতা বরকে নাম ধরে ডাকে মাঝে মাঝে তুই তোকারি করে আবার কখনো মারামারিও করে মানে মোমই বলেছে মাকে। লীলা তো শুনে জিভ বার করে ফেলেছেন," সেকি মারামারিও করিস!ও তোর পতিদেবতা না?"
    " ও আমার বন্ধু মা ঐসব স্বামী ইস্তিরির সম্পর্ক আমাদের নয়,আর দেবতা তো নয়ই।আমি আর ইমন সেম এজ মা,মানে আমিই ছমাসের বড়।তোমার মত তো নয়,বাবা তোমার থেকে বারো বছরের বড়। আর তোমাকে কি নামে ডাকে খুকু, ইশ্ একেবারে খুকুমণি।"
           কথাটা শুনে এখনো লজ্জায় গালটা বেশ রাঙা হলো লীলার,ফুলশয‍্যার রাতেই কাছে টেনে নিতে নিতে মুচকি হেসে সমীরণ বলেছিলো,"শোনো লীলাখেলা আমি বেশ করতে পারি ,তবে লীলা নয় আমি তোমাকে বাড়ির নাম খুকুই ডাকবো। অযথা তুমি তোমার বাড়ির নামটা হারাবে কেন?"
       সেই থেকেই শুধু নামেই নয় একদম খুকুর মতোই আগলে রাখা শাসনে সোহাগে।একবার তো যাচ্ছেতাই কান্ড,মা মেয়ে দুজনেই বসে আছেন ডাক্তারের চেম্বারে। সমীরণ একটু দূর থেকে ডাকেন,"খুকু এদিকে এসো।"ওরা শুনতে পায়না। এক ভদ্রলোক কাছে এসে মোমকে বলে,"এই যে খুকু তোমার বাবা ডাকছেন।"

       শুনে একটু লাজুক লাজুক মুখ করে উঠে যায় লীলা।ভদ্রলোক তো হাঁ।
                সমীরণের আদর আর আগলে রাখায় তেমন করে বোধহয় ব‍্যক্তিত্ব আর হ‍্যাঁ না বলে স্বাধীন মাথা নাড়ার ক্ষমতাও চলে গিয়েছিলো লীলার। একটা বিয়েবাড়ি পড়লে আলমারি খুলে খাবি খেতো লীলা।কোন শাড়িটা পরবে?তার সাথে গয়নাই বা কি হবে?
    " হ‍্যাঁ গো,আমার শাড়িটা তুমি একটু বলে দাওনা,আর গয়না।"
         হয়ত খুকুর এই নির্ভরতা একটু বেশিই আনন্দ দিতো সমীরণকে। খুব বেশি স্বাবলম্বী আর সব পারি মহিলার চেয়ে একটু নির্ভরশীল বৌ বোধহয় অনেকেই ভালোবাসে সমীরণের মতই।
     তবে মেয়ে মুখ ঝামটা দিতো বড় হবার পর মাঝেমাঝেই,"আচ্ছা মা, বাবা অফিস থেকে আসবে,তোমার শাড়ি গুছিয়ে বার করে দেবে, তারপর তুমি পরবে? কি আদুরী গো মা তুমি এখনো!সত‍্যিই ভাগ‍্য করে বর পেয়েছিলে বটে।"
             " আচ্ছা বেশ তোর বাবাকে আর জ্বালাবোনা এখন থেকে তুই বার করে দিবি আমার শাড়ি গয়না।দিবি তো?"
        "একদম নয় অত আদর আমি দিতে পারবোনা বাপু,আমিও নিজের জামা বার করেছি ছোট থেকে তুমিও শেখো।নাহলে যাও বরের কাছে তোমাকে যে চির খুকি করে রেখেছে আদর দিয়ে।"
              " ইশ্ খুব মুখ হয়েছে না..আসুক তোর বাবা আমি বলছি।"
    " বলো গিয়ে আমি একটুও ভয় পাইনা।বাবা অফিসে যতটা কড়া বাড়িতে ততই নরম।কিছুই বলবেনা আমাকে।"

******************
         দেখতে দেখতে কতগুলো বছর পার হয়ে গেছে মোমও এখন গিন্নী আর খুকু মানে লীলা এখন শাশুড়িমা, মোম আর ইমন বিয়ের পরই বাইরে চলে গেছে। বাড়িতে এখন শুধুই সমীরণ আর লীলা। সমীরণের অবসরের ফোকরে প্রাণে লেগেছে অবকাশের বাতাস তাই মাঝে মাঝেই দুজনেই চলে যান একটু তাজা নিঃশ্বাসের খোঁজে বাইরে বেড়াতে।আবার কখনো বাড়িতেও জমে আড্ডা বেয়াইয়ের আগমনে।
     ইমনের মা নেই ওরা এক ভাই এক বোন, দুজনেই বাইরে থাকে।তাই সারাদিনে কাজ ভাগ করে নিয়েছেন নিজের মত করে সুপ্রতীমবাবু,তার মধ‍্যে একদিন বেয়াই বাড়িতে এসে নির্ভেজাল আড্ডা আর বেয়ানের হাতের লুচি আলুরদম খাওয়াও থাকে।
         দরাজ গলায় বলেন.." ও থাকতে সপ্তাহে একটা দিন বেশ করে খেতাম লুচি আলুরদম।যাক এতদিনে আবার পুরোনো অভ‍্যেসটা ঝালাই হচ্ছে। বেয়াইবন্ধুর বাড়ি থেকে রোববার লুচি খেয়ে যাওয়া।"
           সমীরণ হাসতে হাসতে বলেন," সত‍্যিই এমন বন্ধু কজন পায়? আমাদের দুই বেয়াইয়ের গলায় গলায় ভাব।বেঁচে থাক আমাদের বন্ধুত্ব।"

         তবে সত‍্যিই কি সব চিরস্থায়ী হয়?কিছু ভালোবাসা আর বন্ডিং ক্ষণস্থায়ীও হয় তাই একদিন খুকুর শাড়ি গয়না খুঁজে দেওয়ার দায় ছেড়ে হঠাৎই চলে গেলেন সমীরণ বিনা নোটিশেই তারাদের দেশে। আলমারিতে রইলো থরে থরে সাজানো শাড়ি আর গয়না, শুধু আদর করে খুঁজে দেওয়ার লোক চলে গেলো।
               মোম আর ইমনের আসতে আসতে প্রায় শ্রাদ্ধের দিন এসে গেলো ততদিন লীলার পাশে থাকলেন বেয়াই মশাই সুপ্রতীমবাবু আর তার প্রাতঃভ্রমণের গ্ৰুপের বন্ধুরা। আসলে বাইরের কাজে অনভ‍্যস্ত লীলা তো কিছুই তেমন পারেনা। সমীরণ মাঝে মাঝেই বলতেন," খুকু কিচ্ছু চিন্তা কোরনা আমি কিছুতেই তোমার আগে যাবোনা। আমি চলে গেলে তোমাকে আগলাবে কে?তবুও বলে  রাখলাম এই ফাইলে সব গুছোনো আছে আর ডাইরিতে লেখা আছে সবকিছু।"
                   একা বাড়িতে সব যেন তালগোল পাকিয়ে গেলো লীলার।আলমারিটাও তো অচেনা, কখনোই চেষ্টা করেননি সেভাবে সব তাকগুলোর সাথে বন্ধুত্ব করার। মেয়ের আসতেও তো আরো কদিন। শোকে তাপে আর আদরের অভাবে কেমন যেন জড়ভরত হয়ে গেলেন লীলা।

         এক অন‍্য লীলাকে আবিষ্কার করলেন সুপ্রতীমবাবু,এতদিন এসেছেন লুচি খেয়ে গেছেন পরিপাটি করে চা জলখাবার সাজিয়ে দিয়েছেন বেয়ান,পরনে সুন্দর সুন্দর শাড়ি পরিপাটি করে জড়ানো।কপালে বড় টিপ আর হাতে সোনার গয়না।
        আজ নিষ্প্রভ এক,বিষাদমাখা প্রতিমা লীলা বৈধব‍্যের মোড়কে মোড়ানো। কি জানি বড় অসহ‍্য লাগে এখন এই বাড়িতে আসতে। তবুও আসতেই হয় কর্তব‍্যের খাতিরে। যাক মেয়ে জামাই এসে অনেকটাই সামলালো লীলাও কদিনে একটু সেরে উঠলেন বাড়িটা একটু জেগে উঠলো। মেয়ে এসে বোঝালো," আচ্ছা মা তোমার তো একটা জীবন ছিলো বিয়ের আগে নাকি? ভাবো সেই জীবনেই আবার ফিরে গেছো। বাবা তো সব রেখে গেছে টাকা পয়সা বাড়ি গাড়ি তোমার জন‍্য একদম গুছিয়ে।"
         সমীরণ জীবনে আসার আগে জীবনটা কেমন ছিলো মনেই পড়েনা আজ তেমন করে লীলার হয়ত সমীরণের মত এত তোলা তোলা করে কেউই রাখেনি তাকে।

            একটা সময় ইমন আর মোম চলে গেলো। একা বাড়িতে আর সময় কাটেনা লীলার।কতদিন আলমারিটাও খুলে দেখেননি। একদিন হঠাৎই মনে হলো আলমারিটা খুলে দেখি তবে বেশিক্ষণ ভালো লাগলোনা আসলে আলমারিটা বোধহয় আরো উস্কে দিলো সমীরণের স্মৃতি।প্রতিটা শাড়ির বুকে লেখা এক একটা গল্প,কোনটা ছোট গল্প কোনটা বড় গল্প। জড়িতে বোনা কখনো বেনারস কখনো বা মাদুরাই। অ্যালবাম খুলে বসে থাকেন ঘন্টার পর ঘন্টা। আজকাল বিয়াইমশাই মানে ও বাড়ির দাদাও কম আসেন,হয়ত লীলা বেশি কথা বলেননা তাই আর লুচিও তো ভাজা হয়না। মাঝে মাঝে ফোন করেন শুধু কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করেন।

       একদিন সুপ্রতীমবাবুই হঠাৎই এসে আবিষ্কার করলেন প্রচন্ড মানসিক অবসাদে ভুগছে লীলা। উনি প্রায় আধঘণ্টা বসে থাকলেন তারমধ‍্যে লীলা অন‍্যমনস্ক হয়ে হয়ত চারটে কথা বললেন। ছেলেকে আর বৌমাকে ফোন করে বললেন পুরোটা,আরও বললেন পারলে কিছুদিন ওখানে নিয়ে গিয়ে রাখতে। মোম বললো," বাবা আপনি একটু দেখুন কাউন্সেলিং করানো যায় কিনা?এখন তো যেতে পারবোনা বলতে বলতেই। মাকে অনেকবার বলেছি একটু স্বাবলম্বী হতে। আসলে বাবারই দোষ চিরকাল মাকে আদর দিয়ে এসেছে আর একদম পুতুলের মত সাজিয়ে রেখেছে গায়ে আঁচ লাগতে দেয়নি। আমাকে তো সব করতে হয় এমনকি ইমনের কাজও করে দিতে হয়।"
           সুপ্রতীমবাবুর কোথায় যেন মনে হয় মেয়েও মায়ের দায়িত্ব এড়াতে চায় আর লীলার ঐ নির্ভরশীলতা একদম না পসন্দ মেয়ের। তবে সত‍্যিই তো লীলাকে তো বাইতেই হবে জীবনের দাঁড় যে করেই হোক।শেষে নিজেই লেগে পড়লেন লীলাকে সুস্থ করতে।
                  প্রতি শনিবার করে গাড়ি নিয়ে এসে লীলাকে প্রায় জোর করেই নিয়ে গেছেন কাউন্সেলিং করাতে।প্রথম প্রথম কোনরকম একটা শাড়ি পরে এলোমেলো হয়ে বেড়িয়ে আসতো লীলা।একদিন রাগ করেই বললেন," শুনুন আমার বন্ধুবেয়াই অনেক শাড়ি কিনে দিয়েছেন আপনাকে উনি কিন্তু খুব কষ্ট পাচ্ছেন তার আদরের খুকু এমনভাবে বাইরে বেরোচ্ছে।"
       চোখের জল সামলাতে পারেননা লীলা তাতে আরো কড়া হন সুপ্রতীমবাবু বকুনি দেন।
          বেশ কিছুদিন যাবার পর লীলাকে আর বলতে হয়না..লীলার চুল এখন পরিপাটি বাঁধা থাকে,পরনে কখনো হাল্কা সিল্কের শাড়ি কখনো বা বাটিকের শাড়ি আবার কখনো কটকি শাড়ি।
         আসেপাশের বাড়ির অনেকেই যারা সমীরণবাবু চলে যাবার পর তেমন করে খোঁজ নেয়নি তারাও এখন লীলা যখন পাটভাঙা শাড়ি পরে সুপ্রতীমবাবুর পাশে বসে গাড়িতে, দরজা বা জানলা ফাঁক করে দেখে অথবা এসে দাঁড়ায় বারান্দায়। কেউ বা বলে," ভাই কপাল থাকা চাই,এই বয়েসেও দেখো কেমন আদরে আছে।বর গেলো তো বয়েই গেলো,বেয়াইয়ের পাশে বসে দিব‍্যি লঙ ড্রাইভে যাচ্ছে সেজেগুজে প্রতি সপ্তাহে।"

****************
স্মার্টফোনটা মোমই কিনে দিয়েছিলো ব‍্যবহার তেমন জানতেননা লীলা। হ‍্যালো ফোনেই তার অভ‍্যেস তবে সুপ্রতীমবাবুও বকুনি দিয়ে অনেকটাই শিখিয়েছেন.." আচ্ছা তুমি তো বাজারে যাও,কখনো ওষুধ কিনতে ফোনটা সাথে রাখলে তো ভালো হবে।"
        আজকাল সুপ্রতীমবাবু লীলাকে তুমি করেই বলেন। প্রথমে একটু কানে লাগলেও অভ‍্যেস হয়ে গেছে এখন বেশ অভিভাবক বলেই মনে হয় বেয়াইকে।
      সেবার পুজোর সময় এলো মোম মাকে দেখে একটু অবাকই হয়ে গেলো মাকে এখন আর শাড়ি বের করে দিতে হয়না। নিজেই শাড়ি বের করে পরে পছন্দমত সাথে ম‍্যাচিং ব্লাউজ। সকালে উঠে অনেকটা সময় যোগা আর প্রাণায়াম করে,খাওয়াদাওয়ার দিকেও যত্ন নেয়।মনে হলো মা আগের থেকে অনেক সুন্দর হয়েছে।

      ওর কাছে বসে গল্প করতে করতে হেসে বলেন লীলা," এবার নিশ্চিন্ত হয়ে যাবি ওদেশে। আমি অনেক সামলে নিয়েছি।কত কাজ শিখেছি,লকারে যাই,ব‍্যাঙ্কে যাই,বাজারে যাই,দর্জির দোকানে গিয়ে ব্লাউজ বানাই। তোর জন‍্যও কয়েকটা ব্লাউজ বানিয়েছি ডিজাইনার, দেখ তো কেমন হয়েছে? তবে সবটাই ডাক্তারবাবু আর সুপ্রতীমদার ক্রেডিট। নাহলে হয়ত এতদিনে পাগলই হয়ে যেতাম।আসলে হঠাৎই তো আমার মাথা থেকে ছাদ আর পায়ের তলার মাটি সরে গেলো। তোর বাবা যে বড় আগলাতো আমায়।"

        নাহ্ অনেকটা নিশ্চিন্ত লাগে মোমের মানসিক রোগী হয়ে থাকার চেয়ে ভালো থাক মা এভাবেই। কদিন ছেলে বৌ আসাতে সুপ্রতীমবাবু তেমন করে আসেননি এ বাড়িতে। সেদিন এলেন কদিন বাদে তবে শ্বশুরমশাই হঠাৎই মাকে তুমি বলে ডাকছেন দেখে অবাক হয়ে গেলো মোম। একথা সত‍্যি মা ওনার থেকে বেশ কিছুটা ছোট তবে আগে তো বলতে শোনেনি কখনো। হয়ত একটু কেমন যেন লাগলোও। পুজোর রেশ কাটতে কাটতেই ওদের ফেরার সময় চলে এলো। মনটা ভারী হলো লীলারও বেশ কাটলো কয়েকটা দিন,আবার সেই একলা জীবন। যদিও মেয়ে বলছিলো আগেই এবার ওদের সাথে যেতে..আসলে বাড়ি ছেড়ে কোথাও ভালো লাগেনা লীলার।কত স্মৃতির আল্পনা এই বাড়ি জুড়ে আনাচে কানাচে আলমারির তাকে ড্রেসিংটেবিলের কাঁচে সমীরণের ছোঁয়া। তারপর ওদের নতুন বিয়ে হয়েছে,কিই বা করবেন ওখানে গিয়ে।
             
       ****************
মাঝে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা মাস।এখন ভিডিও কলও করতে পারেন লীলা। মেয়েকে জামাইকে দেখতে পান চোখের সামনে ভালো লাগে।আর মোম দেখে মাকে ভালো লাগে ওরও তবে যদি বাবা থাকতেই মা এতোটা স্বনির্ভর হতো বাবারও হয়ত ভালো লাগতো।
    তবে ওর শ্বশুরমশাইয়ের জবাব নেই মাকে বেশ ঠিকঠাক করে দিয়েছে একদম দায়িত্ব নিয়ে। শুধু মনে একটা খটকা রয়ে গেলো মানে ভদ্রলোক ওর মায়ের প্রেমে পড়ে যায়নি তো? যেটা ঠিক শেয়ারও করতে পারলোনা ইমনের সাথে।

             তবে দুমাস বাদে অবাক হওয়ার সাথে সাথে একটু রাগও হলো মোমের কি করবে এই ছবিটা? হাইড করে রাখবে? মা তো একবারও বলেনি যে মা মন্দারমণি যাচ্ছে। হ‍্যাঁ এটা তো মন্দারমণির সী বীচই মনে হচ্ছে। বেশ কয়েকটা ছবি শ্বশুরমশাই ফেসবুকে দিয়েছেন খোলা হাওয়ায় মায়ের আঁচল উড়ছে,অনেকদিন বাদে সেই চেনা হাসিটা মায়ের মুখে। শ্বশুরমশাই আর মা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ঢেউয়ে পা ভেজাচ্ছেন। আরেকটা ছবিতে পাশাপাশি বসে দুজনে। কে তুললো এই ছবিগুলো? মা একদম সোজা মন্দারমণি চলে গেলো? একবারও বললো না!
         ঘড়ি দেখে মোম এখন অনেকটা রাত্রি,ইচ্ছে করছিলো মাকে এখনি ফোন করে বলতে থাক কাল সকালেই বলবে। শ্বশুরমশাইয়ের হোয়াটস অ্যাপ স্ট‍্যাটাসেও এক ছবি। ইমনকে দেখায় ছবিগুলো," দেখেছিস,বাবা আর মা বেড়াতে গেছে।"

      " বাহ্ বাবাকে বেশ লাগছে তো। আর মামণিকেও। ভালো তো,আগে মা থাকতে কত এদিক ওদিক যেতো বাবা গাড়ি চালিয়ে এখন তো কোথায় যায়না। ভালোই করেছে।"
         " ভালোই করেছে! তোর অন‍্য কিছু মনে হচ্ছেনা?"
     " কি আবার মনে হবে? দুটো একলা মানুষ একসাথে একদিন বেড়াতে গেছে।"
   " তোর আর কোনদিন বুদ্ধি হবেনা।কেন যে বয়েসে ছোট বরকে বিয়ে করেছি! ফেসবুকে মাসিমণি,কাকিমণি সবাই আছে।ওরা কি ভাববে?ইমন আমার বাবা মারা যাওয়া সবে একবছর পার হয়েছে। এরমধ‍্যেই মা.."
         " কেন বেড়াতে যেতে পারেনা? তুইই তো বলেছিস মামণিকে ব‍্যাচেলার লাইফে ফিরে যেতে। আর আমার বাবার কোন গিল্ট নেই বলেই ছবিটা সোশ‍্যাল মিডিয়ায় দিয়েছে। মোম একটা কথা মনে রাখিস মামণি কিন্তু খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো।মামণির ভালো থাকাটা দরকার,তাহলে আমরাও ভালো থাকবো। কি সুন্দর হাসছে দেখ আবার।"

*******************
   ইমন যতই বলুক মায়ের জন‍্য ওর শ্বশুরবাড়িতে ওর প্রেস্টিজে কালি লাগুক তা হবেনা কিছুতেই।
     পরদিন ও ফোন করার আগেই মা ফোন করলো মায়ের কথায় উচ্ছ্বাস," হ‍্যালো মোম, কাল মন্দারমণি গেছিলাম জানিস। দাদাই জোর করে নিয়ে গেলো,কাল নাকি ফ্রেন্ডশিপ ডে ছিলো আরো কয়েকজন মিলে গেছিলাম আমরা ঐ যাদের সাথে দাদা মর্ণিং ওয়াক করে।"
       একটু নিভে যাওয়া গলায় মোম বলে," বললেনা তো কিছু আগের দিন যে বেড়াতে যাচ্ছো।"
     " আরে আমি জানি কি ছাই,সকালে গাড়ি নিয়ে হাজির আমাকে জোর করে নিয়ে গেলো। তোর শ্বশুরমশাই পারেন বটে। তোকে ছবি পাঠাবো দেখিস।"
         " হ‍্যাঁ মা পুরুষ মানুষেরা অনেক কিছুই পারেন। কয়েকটা ছবি আমি দেখেছি মা। আসলে বাবার যাওয়ার তো বেশিদিন হয়নি এভাবে ছবিগুলো না তুললেই পারতে।আমার শ্বশুর বাড়ির অনেকেই ফেসবুকে আছে।"
           ফোনটা কেটে দেয় লীলা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে ছবিগুলো। বুঝতে পারেনা এর মধ‍্যে কি খারাপ আছে।তবে মেয়ের কথাগুলো কাঁটার মত বুকে বাজে। ছুটে যান সমীরণের ফটোর কাছে দুহাতে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন.." তোমরা সবাই চলো নিজের খেয়ালে বলেছিলে আমায় আগলাবে সারাজীবন।কথা না রেখে পালালে। মোম বললো ভালো থাকতে।ডাক্তার,দাদা সবাই বললো ভালো থাকতে। কিন্তু ভালো থাকতে দিলে কই? আমি কি অন‍্যায় করেছি? হয়ত বিধবা হয়েও একটা ভালো শাড়ি পরে সেজেছি,দাদার পাশে দাঁড়িয়ে একটা দুটো ছবি তুলেছি। একটা দিন খুশি থেকেছি।কি এসে গেছে তাতে?"

            ক‍্যালেন্ডারের দিকে চোখ চলে যায় লীলার।পরের দিন সুপ্রতীমকে ফোন করে," কাল কিন্তু মনে করে একবার আসবেন সকালে। একটু দরকার আছে।"
     ওপাশ থেকে হাসে সুপ্রতীম," কাল লুচি আর আলুরদম হচ্ছে তো?"

          পরেরদিন সকালে গাড়ি নিয়ে চলে আসেন সুপ্রতীমবাবু। পাটভাঙা আসমানী নীলের জড়িপাড় শাড়ি আর জড়ির ব্লাউজ পড়েছে লীলা। আজ লীলাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।
   " কোথাও যাবে নাকি? চলো তাহলে পৌঁছে দিই।"
    " আগে আসুন তো ভেতরে তারপর দেখা যাবে।"
        বসার ঘরের সোফায় গা এলান সুপ্রতীম,একটা সময় কত আড্ডা হয়েছে বন্ধুবেয়াইয়ের সাথে এই ঘরে। পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢোকেন লীলা হাতের ট্রেতে মিষ্টির প্লেট আর লুচি আলুর দম। টেবিলে রাখে লীলা অবাক হয়ে যায় সুপ্রতীম একটা ছোট প্রদীপও জ্বলছে আর পাশে একটা রাখী।

          সুপ্রতীমের কপালে প্রদীপের শিখা দিয়ে হাতে রাখী বেঁধে দেন লীলা,আর তার সাথে মুখে একটা মিস্টি। লীলার মুখে যেন একটা স্বস্তির হাসি। মুখে মিস্টি থাকায় কথা বলতে পারেননা সুপ্রতীম। কিছুক্ষণ বাদে বললেন," বন্ধুত্বটা রাখতেও ভয় পেলে লীলা তাই বাঁধলে সম্পর্কের বন্ধনে? আচ্ছা দাদা,ভাই এসব না হয়ে শুধু বন্ধু হওয়া যেতোনা?
    তোমাদের মেয়েদের এইজন‍্য আর কিছু হলোনা প্রথমে বাবা তারপর স্বামী আর শেষে সন্তানের ভয়েই মরলে।"

           ফোনটা দেখতে গিয়ে হঠাৎই চোখে পড়ে মোমের।মা স্ট‍্যাটাস দিয়েছে,অবাক হয়ে যায় মা এসবও পারছে এখন? নিশ্চয় শ্বশুরমশাইয়ের শেখানো। ছবিটা দেখার কৌতূহল আর রাখতে পারেনা,একটাই ছবি মা ওর শ্বশুরমশাইয়ের হাতে রাখী বাঁধছেন। ফোনটা বন্ধ করে মোম। দুদিন ও মাকে ফোন করেনি,মাও ফোন করেনি সেদিনের পর।
            নিজের ফোনটা খুলে স্ট‍্যাটাসটা দেখেন লীলা,চোখ বোলানোর লিস্টে মেয়ের নামটা দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে ফোনটা রেখে দেন বালিশের পাশে।কলঙ্কের আঁচ বড় ছোঁয়াচে শরীর পুড়ে ছাই না হওয়া অবধি নারীকে ছাড়েনা।@রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী
সমাপ্ত:-

               

     

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...