#সুতোর_আল্পনা#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
সেই কবে পুতুলখেলা ছেড়ে দিয়ে আর পুতুল বর বৌকে বোনের হাতে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে শ্বশুরবাড়িতে পা সাবিত্রীর। এক্কা,দোক্কা,চু কিতকিত খেলনাবাটি সব কিছুই এক কথায় আড়ি করে দিয়েছিলো নতুন বৌ সাবিত্রীর সাথে।শাড়ি পরে লাফিয়ে লাফিয়ে ঐসব খেলা যায় নাকি আর?
পড়াশুনা ঐ হয়েছিলো মানে একটা পাশ আরেকটা পরীক্ষায় বসার আগেই বনেদী বাড়ি থেকে সম্বন্ধ এলো বাবা আর হাতছাড়া করলেন না। বিয়ের রাতে বরের কাছে স্ত্রী আচারের পর বাসরে গুটিশুটি হয়ে বসে বলেছিলো.." আমাকে পড়াবেন? সেলাই শেখাবেন?"
মণীন্দ্র হেসে বলেছিলেন," পড়তে তোমার ভালো লাগে? তাহলে বিয়ে করলে কেন? আচ্ছা বেশ তুমি কি পড়তে চাও আর কতদূর পড়তে চাও বোলো আমি দেখবো।
আর সেলাই তো আমার মা ভীষণ ভালো জানেন মায়ের কাছেই শিখে নিয়ো। তবে একটা শর্ত আছে বরকে আপনি আজ্ঞে করা যাবেনা।"
" তাহলে কি বলবো? মা তো বাবাকে আপনি আজ্ঞেই করেন।"
চন্দন মাখা মুখে তখন সরলতার ছোঁয়া। গভীর কালো চোখদুটো নিষ্পাপ সেদিকে তাকিয়ে মন হারায় মণীন্দ্র। মুখে দুষ্টুমি মাখানো হাসি হেসে বলে.." ঐ সব মা ঠাকুমার দিনে এখনো পড়ে থাকবে নাকি? তাহলে আর পড়াশোনা শিখে কি হবে? এখন থেকে আমাকে তুমি বলবে আর সমস্ত আব্দার আমার কাছে করবে কেমন।"
সারাদিনের ক্লান্তিতে ক্লান্ত সাবিত্রী কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো মণীন্দ্রর গা ঘেঁষে পরম নির্ভরতায়।বুঝেছিলো আর চিন্তা নেই এ বাড়িতে যেমন বাবার কাছে আব্দার করতো তেমন আরেকজনের হাত ধরে সাতপাক ঘুরেছে যাকে সব বলা যাবে।
মণীন্দ্রের চব্বিশ বছরের যৌবনে সাবিত্রী আঠেরো বছরের কুসুমলতা। পুতুলের বিয়ে দেওয়া মা থেকে নিজের সংসারে পা রাখা। পায়ে রূপোর ঝমঝমে মল আর টুকটুকে লাল আলতা পরে। সব আদর আহ্লাদের সঙ্গী মণীন্দ্র আর ননদ দেওরেরা। অবশ্য কপালগুণে শাশুড়িমা স্নেহ আর শাসন দুইই করতেন। আদর পেতো বলে কোনদিন তেমনভাবে শাসনটা গায়ে মাখেনি সাবিত্রী।
ইচ্ছেঘড়ির কাঁটাটাও থেমে যায়নি শ্বশুরবাড়িতে। আরেকটা পাশও দিয়েছিলো মণীন্দ্রের কাছে পড়াশোনা করে অবশ্য পড়ানোর পর গুরুদক্ষিণাও দিতো ভালোবেসে। সেলাইটা ভালোবাসা ছিলো সাবিত্রীর তাই নিজের উদ্যোগে অনেকটাই শিখেছিলো দুই ছেলে এক মেয়েকে বড় করার ফাঁকে ফাঁকে। নিজেই মেশিনে ফটফটিয়ে বানাতো ওদের ছোটছোট জামা,নিজের জামা,মণীন্দ্রর পাজামা কখনো ঘরের বালিশের ওয়াড় আর সেই সাদা কুঁচি দেওয়া বালিশে তুলতো যত্নে নক্সা। রাতে সেই বালিশে পাশাপাশি শুয়ে সূঁচ সুতোর মালায় ভালোবাসার নক্সা বুনতে বুনতে মণীন্দ্রের বুকের কাছে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তো সাবিত্রী। ছেলেমেয়েরা একটু বড় হলেই ঠাকুমার কাছেই শুতো।
তবে যৌবন বড়ই চঞ্চল, হয়তো ক্ষণস্থায়ীও।সুখের দিনগুলো যে কোথা দিয়ে চলে যায় কেজানে। একটা সময় ছেলেমেয়ে সংসার সামলে নিঃশ্বাস ফেলতে পারতোনা সাবিত্রী। এক এক সময় মনে হত এই যুদ্ধ যে কবে শেষ হবে?কবে যে একটু অবসরের দখিনা মিঠে বাতাস লাগবে প্রাণে।
অবশেষে অবসরের বাতাস লাগলো প্রাণে কিন্তু এ বাতাস দখিনা মিঠে বাতাস নয়।এই বাতাস উত্তুরে হাওয়ার মত কনকনে ঠান্ডা। ভীষণ রুক্ষ্ম আর শীতশীতে অনুভূতি মনে। সেদিনের সেই চঞ্চল অষ্টাদশী সাবিত্রী যখন সত্তরের কোঠায় তখনই একদিন মণীন্দ্র চলে গেলেন একদম একলা করে। ছেলে মেয়েরা তো কবেই বিয়ে করে যার যার সংসার আগলাচ্ছে কিন্তু নিজের পুরোনো সংসারে তখন ছন্দপতন। ছেলেমেয়েরা চলে গেলেও মণীন্দ্রের যত্নেই কেটে যেত অনেকটা সময় কিন্তু এখন সবই ফাঁকা।
সাবিত্রীর জানলা দিয়ে ঢুকছে উত্তুরে হাওয়া মনে একলা থাকা উদাসী বাউল গাইছে ঘুম ভাঙানো গান। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে যায়,কখনো বা ভোরে উঠে বসে হাত বোলায় মণীন্দ্রের লাগানো স্থলপদ্ম গাছটার গায়ে।
ছেলেরা মেয়ে সবাই নিয়ে যেতে চাইলেও কারো সাথেই যেতে মন চায়নি সাবিত্রীর এ বাড়িতে যে তার প্রথম বিয়েবেলার অনেক স্মৃতি এখানেই খুঁজে পায় মণীন্দ্রকে সারাদিনের টুকটাক কাজের ফাঁকে।
তবুও ছোটছেলে যখন নিতে এলো বৌমার বাচ্চা হবে বলে আর না করতে পারলোনা সাবিত্রী। সত্যিই তো দিদিভাইকে দেখার জন্যও তো যাওয়া দরকার। পাশে থাকা ছোট দেওর আর জাকে সবটা বুঝিয়ে রওনা দেওয়া।
সাবিত্রী বুঝতে পারে ছেলে বৌমা কিছু একটা বলতে চায় কিন্তু হয়ত বলতে পারছেনা। নিজেই অভয় দিয়ে বলে," বল কি বলবি? মায়ের কাছে আবার লজ্জা কি? এখন তো আমিই মা বাবা সবই।"
" মা বলছিলাম কি মান্তুকে ড্রাইভার নিয়ে যায় তবে ঐটুকু মেয়েকে বুঝতেই পারো ড্রাইভারের সাথে একা ছেড়ে দেওয়া...আসলে আগে তো মলিই নিয়ে যেতো এখন এই অবস্থায়।"
" কিছু ভাবিসনা ছোটু,আমি চলে যাবো দিদিভাইয়ের সাথে। তবে আমি বারবার তো আসতে যেতে পারবোনা আমি ওখানে বসে থাকবো দিদিভাইকে নিয়ে একদম ফিরবো।"
" কিন্তু মা ওখানে অতক্ষণ আপনি থাকবেন কি করে? আমরা যদিও একটা ঘরেই বসি,মানে সবাই মিলে ভাড়া নিয়েছি তবে সবই কমবয়েসী মায়ের দল। ওদের মধ্যে আপনি কিভাবে এতক্ষণ.." বৌমার কথায় চিন্তার ছোঁয়াটুকু মনে লাগে সাবিত্রীর। হয়ত তার শারীরিক আর মানসিক দুয়ের কথাই ভাবাচ্ছে ওদের। মনটা তো সত্যিই ভালো নেই সাবিত্রীর তবুও যতক্ষণ জীবন আছে ততক্ষণ তো চলতেই হবে। তার মধ্যে যদি ওদের একটু সাহায্য হয়।
ছেলে বৌমাকে অভয় দিয়ে সাবিত্রী রওনা দেন গুটিগুটি নাতনির সাথে স্কুলের পথে। প্রথম দিন ছেলে সাথে এসে কোথা দিয়ে নাতনি ঢোকে,কোন গেট দিয়ে বেরোয় সব দেখিয়ে গেছে। দু একজন মায়ের সাথে আলাপও করিয়ে দিয়ে গেছে। প্রথমদিন বুকের ভেতরটা বেশ কেঁপেছে সাবিত্রীর তার ঐ গ্ৰামের বাড়ির গন্ডী থেকে এই এত বড় স্কুলের গেট। কত বাচ্চা! আর সবাই তো একই রকম দেখতে ভয়ে ভয়ে নাতনিকে বললেন..." ও দিদিভাই, আমি যদি তোকে না চিনি তুই আমাকে চিনে নিবি তো?"
ছোট্ট নাতনি হাত নেড়ে বলে.." আমি ছুটি হলেই ছুটে আসবো তোমার কাছে ঠাম্মা।"
এক এক করে তিন,প্রথম তিনদিন সকালে উঠেই কেমন বাথরুম পেয়েছে ঘন ঘন সাবিত্রীর কে জানে সব ঠিক হবে তো? দিদিভাই হারিয়ে যাবেনা তো অত বাচ্চার ভিড়ে?
তারপর থেকে অভ্যেস হয়ে গেলো বেশ। সাবিত্রীর মনখারাপের মনে লাগলো পূবের ঘরের বাতাস। প্রথম কদিন চুপ করে এক কোণে বসে থাকতেন,কিছু কমবয়েসী বৌ শাশুড়ি বা ননদের নিন্দায় ব্যস্ত।কেউ বা পড়া তুলছে খাতায়। মাঝে মাঝে পরিচিত মেয়েদুটো খোঁজ নিয়ে যায়.." ও মাসিমা ঠিক আছেন তো? পাশে বাথরুম আছে। জল এনেছেন তো?"
সাবিত্রী হাসিমাখা মুখে মাথা নাড়েন।
সেদিন স্কুল ছুটি সাবিত্রী একটু ইতস্ততঃ করে ছেলেকে বললেন," ছোটু আমাকে একটু বাজারে নিয়ে যাবি? ঘুরে আসতাম।"
" তোমার কিছু লাগবে মা? আমাকে বলো আমি এনে দেবো।"
" টুকটাক কয়েকটা জিনিস,তুই পারবিনা আমি দেখে নিয়ে আসতাম।"
বৌমা বলে.." ঘুরে আসুক মা দেখো কি লাগবে মায়ের। মা কি কিনবেন? আসলে ও তো বাজারে খুব একটা যায়না আমিই যেতাম।"
" কিছুনা ঐ একটু সেলাইয়ের জিনিস কিনতাম।আসলে দিদিভাইকে নিয়ে স্কুলে গিয়ে তো অনেকক্ষণ বসে থাকি তাই সময়টা কাটতো।"
আর বেশি কিছু বলতে হয়না সাবিত্রীকে মলি পুরোটা বুঝে যায়। সাবিত্রী তো বাজারে গিয়ে থ এত সেলাইয়ের জিনিস,কত রকমের সুতো আর কাপড়। নিজের পছন্দ মত বেশ কিছু জিনিস কিনলেন। দিদিভাইকে নিয়ে স্কুলে যাবার সময় হাত ব্যাগে গুছিয়ে নিয়ে যান নিজের স্বপ্নের বাক্সটুকু যত্নে। আর তাই দিয়ে এককোণে বসে ডুবে যান সেলাইয়ের কাজে। কতদিন বাদে আবার কাপড়ের কোলে সুতোর আলপনা। মন সব চিন্তা ভুলে যায়। পূবের ঘরের এককোণে বসে নিমগ্ন হয়ে যান সাবিত্রী। এভাবেই কেটে গেছে বেশ কয়েকদিন সুতোর আলপনা এঁকে।
তবে সাবিত্রীর চারধারে এখন ভিড় জমেছে সবাই আড্ডা ফেলে কাপড় আর সূঁচ সুতো নিয়ে ব্যস্ত মাসিমার কাছে সেলাই শিখতে। সময় যে কোথা দিয়ে কেটে যায় বুঝতেই পারেননা সাবিত্রী। ইশ্ কবে মণীন্দ্রর কাছে বায়না করে সেলাই শেখা,কিছুটা শাশুড়ি মায়ের কাছে কিছুটা বাইরে।আজ আবার মনখারাপের একলাবেলায় সঙ্গী হলো ভালোবাসার কাজ। মনের শোকে ভুলেই গেছিলেন এই ভালোলাগাটুকু।
কোথা দিয়ে যে ছটা মাস কাটিয়ে বাড়ি ফিরছেন বুঝতেই পারেননি সাবিত্রী। ওদের সাথে তাঁরও মনকেমন দিদিভাই আর ছোট্ট দাদুভাইয়ের জন্য।
দিদিভাইয়ের বন্ধুর মায়েরা তো রীতিমতো তাদের প্রিয় সেলাই মাসিমাকে ফেয়ার ওয়েল দিয়েই ছাড়লো। সবাই টুকটাক সেলাইয়ের জিনিস হাতে দিয়ে বললো.." আবার কবে আসবেন মাসিমা? আমরা কিন্তু অপেক্ষায় থাকবো।"
" আবার আসবো গো সামনে পুজো তো তাই যেতেই হবে বাড়িতে। তোমরা সবাই ভালো থেকো আর এভাবেই সময়কে কাজে লাগিয়ো।"
নিজের বানানো পদ্মফুলের নক্সী কাঁথায় দাদুভাইকে শুয়ে থাকতে দেখে মনে হয়েছে হয়ত এই ভালোলাগা টুকু নিয়েই কাটবে মণীন্দ্র বিহীন জীবনের বাকি সময়টুকু।
******************
বাড়ি ফিরে এসে স্থলপদ্মের গাছটায় হাত রাখেন সাবিত্রী। হাল্কা গোলাপি রঙের থোকা থোকা ফুলে সেজেছে গাছটা শরতের আনন্দে। নিজের শূন্য মনেও এই বার্ধক্যেও নক্সিকাঁথার হাজার নক্সার আলপনা। মনে মনে ভাবেন সাবিত্রী আর বৃথায় যেতে দেবেননা জীবন খাতায় পড়ে থাকা বাকি দিনগুলো। ভালোবাসার সেলাইয়ের ফোঁড় টেনে ভরাট করবেন শূন্য মনের কোণগুলো।
বিকেলে ছোট জা আর দেওরকে ডাকেন সাবিত্রী.." ঠাকুরপো,আমার একটা কাজ করে দেবে? আমার নীচতলাতে একটা সেলাইয়ের ক্লাশ করবো ভাবছি গ্ৰামের গরীব মেয়েগুলোকে সেলাই শেখাবো।তুমি যদি একটু ব্যবস্থা করে দাও।"
অনেকদিন বাদে বৌদিকে হাসিখুশি দেখে মন ভরলো দেওর সুরেন্দ্ররও..." তুমি কিছু ভেবোনা বৌদি সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।"
" আমি ভাবছি মহালয়ার দিনই শুরু করবো মা দুর্গার নাম করে।"
সাবিত্রীর বৃদ্ধ হয়ে যাওয়া মনটা আবার আজ তরতাজা এক নতুন স্বপ্ন দেখার আনন্দে। শরীর তো নিজের নিয়মেই ভাঙে,তবুও স্বপ্নরা থাক জীবন্ত জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
Comments
Post a Comment