Skip to main content

জীবন যখন যেমন

#জীবন_যখন_যেমন#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

পুরুলিয়ার লাল মাটির মেঠো সুরে আর পলাশ ফুলের লালিমায় বসন্তে বন্ধুর বাড়িতে দোলে এসে মনে দোলা লাগলো রবীনের। তখন সদ‍্যই স্কুলে চাকরি পেয়েছে মনে আদর্শ,হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ আর চেতনায় বিদ্রোহী কবি নজরুল।

           ছাত্র গড়ার পণ নিয়ে ছাত্ররথের সারথি হওয়া রবীন তখন বাঁকুড়া স্কুলে ছাত্রদের প্রিয় অঙ্ক স‍্যার তবে স‍্যারের গলায় গানের সুর আছে। তাই ছাত্রদের মন জিততে খুব একটা সময় লাগলো না। গানে কবিতায়,রবীন্দ্রজয়ন্তী আর নজরুল জয়ন্তীতে কাছে টেনে নিলো রবীন দুষ্টুমি করা ছাত্রদের শাসনে আর আদরে।

       দোলের ছুটিতে কলিগ কৃষ্ণের আব্দারে ওদের বাড়িতে আসা.." আরে চলো রবীনদা,আমাদের পুরুলিয়ার মাটি আর গাছপালা হাসে দোলের সময়।বসন্তের আগমনে পলাশ গাছে লাগে রঙের ছোঁয়া।রক্তিম গালের হাসি তোমার মনে লেগে থাকবে অনেকদিন।"

        " আচ্ছা গান শুধু আমিই গাইনা, এখন তো দেখছি সাহিত‍্যের মুক্তো মাণিক লুকিয়ে আছে অনেকেরই অন্তরে। দারুণ কথা বলিস তো তুই।
    তাহলে চলো ভোলা উঠাকে ঝোলা।"

      রবীন মাস্টারমশাইয়ের গল্পটাতে ডুব দিতে হলে হাটি হাটি পায়ে গুটি গুটি একটু কয়েক বছর পেছনে যেতে হবে।
      সেই সময় মানুষ গিয়ে মানুষের বাড়ি উঠতো আতিথ‍্য নিতো দ্বিধাহীন ভাবে।মানে মাসিমা চলে এলাম,আর তারপর মিলেমিশে বেশ কয়েকদিন অপরিচিত কারো বাড়ি থেকে তাদের অন্তরের আপনজন করে তোলা। তাই রবীনও ফেলতে পারলোনা কৃষ্ণের কথা। আর দোলে কৃষ্ণ ডাকছে নাইবা হলো ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তবুও না গিয়ে পারা যায় নাকি?

     **********************

   পলাশেরা ঝুড়ি ভরে ফুলের পসরা সাজিয়ে যেন ওদেরই অপেক্ষায়। সঙ্গীতপ্রেমিক রবীন গেয়ে ওঠে ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে। কৃষ্ণ বলে," কি দাদা কেমন দেখছো?
আমাদের পুরুলিয়া কেমন?
মনে রঙ লাগছে?"

      রবীন সাইড ব‍্যাগের থেকে ক‍্যামেরা বের করে ছবি তোলায় ব‍্যস্ত..." আরে আমাদের পুরুলিয়া কি? সবার পুরুলিয়া। ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা।''

            ফাগুয়ার মিঠে হাওয়ার ছোঁয়ায় আর পলাশের রঙে দোলের দিন রঙ মাখিয়েছিলো অনুকে রবীন। খোঁপায় পলাশের মালা জড়ানো অনুও পাল্টা রঙ মাখিয়ে ভূত করেছিলো রবীনকে। আলাপটা অবশ‍্য আগেই হয়ে গিয়েছিলো,অনু কৃষ্ণর খুড়তুতো বোন। ওরা তিন বোন ওদের ভাই নেই একই বাড়িতে থাকে ওরা।

     এক উঠোনেই গোল করে ঘোরানো ঘরে পাশাপাশি বাস।সকাল সন্ধ‍্যা হাতে মুড়ির বাটি আর গরম চা নিয়ে একদম জমাটি আড্ডা।
    খুব সুন্দর একটা হাসিখুশি পরিবার কৃষ্ণদের বাড়িতে অনেক লোক সবাই যেন বহু দিনের চেনা, আর ওর বোন অনু মন ছুঁয়েছিলো রবীনের।
      গল্পে আড্ডায় আর গানে ভাব হয়ে গিয়েছিলো বেশ। যদিও ভালোবাসার কথা অনুচ্চারিতই রয়ে গিয়েছিলো। ভালোলাগা মনে মনে নিয়ে আবার দুচোখে পলাশের গুচ্ছের সৌন্দর্য্য প্রাণভরে নিতে নিতে ফিরে এসেছিলো রবীন।

         স্কুলে ফিরে এসেও তার রেশ রয়ে গিয়েছিলো বেশ কিছুদিন। তারপর কৃষ্ণই একদিন কিন্তু কিন্তু করে বলেছিলো," রবীনদা তুমি মানে বিয়েটিয়ে করবে তো? চার পাঁচবছর তো চাকরি হলো। মানে আমাদের বাড়ির সবার তোমাকে খুব পছন্দ।"

    রবীনের কথাটা বুঝতে অসুবিধা হবে অত বোকা ও নয় তাই বলে.." আমারও তোদের বাড়ির সব মানে সবাইকে খুব পছন্দ।"

     " এই সেরেছে,সবাইকে পছন্দ হলে তো মুশকিল আসলে বিয়ের ব‍্যাপার তো? তাই বলছি অনুকে কেমন লাগে? যদি তুমি বলো তো কথা বলতে পারি।"

            " রবীন একটু হেসে বলে," দাঁড়া বাপু জ্বালায়ে মারিসনি।বাড়িতে বাপটোকে আগে বলি।"

      ওদের হাসির মাঝেই মন বোঝাবুঝির পালাটা হয়ে গিয়েছিলো বাড়িতে চিঠি লিখে দিয়েছিলো কৃষ্ণ। তারপর একদিন দুই পক্ষের বাড়ির লোকের মতেই বিয়ের দিনটা ঠিক হয়ে গিয়েছিলো মানে রবীনের প্রেমের প্রজাপতি সোজা পুরুলিয়াতে বিয়ের বার্তা নিয়ে উড়তে উড়তে।

          বিয়ে ঠিক হওয়ার পর ছমাসের ফাঁকে বেশ কয়েকটা প্রেমে মাখা চিঠিপত্র ডাক পিওন এসে দিয়ে গিয়েছিল দুজনেরই প্রেমের বাক্সে। তারপর আবার সেই মধু বসন্তেই মনে উদাস করা পলাশের লালরঙ মাখিয়ে চারহাত এক করে একদম সাতপাক ঘুরে সিঁদুর পরিয়ে নিয়ে আসা অনুকে গাঁটছড়া বেঁধে স্কুলের কাছে ভাড়া বাড়িতে।

       অনেক কথা হয়নি সেভাবে বলা,অনেক পথ হয়নি একসাথে চলা এই করে বেশ কয়েকটা মাস কেটে গেছে। অনু ভাবে কিছু কাজপাগল মাস্টারমশাই বাপু। বাড়িতে নতুন বৌ সারাদুপুর একলা রয়েছে মনেই থাকেনা। সে রয়েছে আপন খেয়ালে ব‍্যস্ত,অঙ্কের ফর্মূলাতে ডুবে রয়েছে।আবার কখনো ব‍্যস্ত রবীন্দ্রজয়ন্তী নিয়ে। অভিমানের চোরা কাজলে চোখদুটো মাঝে মাঝে আরো বেশি কালো হয় অনুর সেই রঙ মাখে ওর ফর্সা মুখ। রবীন এসেই বোঝে মেঘ ঘনিয়েছে তাই হাল্কা ছেলেমানুষী আর গানে ভোলানোর চেষ্টা অনুকে..রূপসী দোহাই তোমার তোমার ঐ চোখের পাতায় আমাকে কাজললতার কালি কোরো।"
       " স্কুল ছুটির পরেও তোমার বাড়ি আসতে ইচ্ছে করেনা,আর আমি একা একা সারাদিন ঘরে বসে থাকি। আমার একটা চাকরি দেখো আমিও চাকরি করবো।" অভিমান জড়ানো গলায় বলে অনু।
          তখনকার মতো আদরে আর গল্পে অনুর মন ভালো হয়ে গেলেও রবীনের সত‍্যিই মনে হয় অনুরও কিছু একটা করা দরকার। নিজের পায়ে দাঁড়ানোও হবে আর আত্মবিশ্বাসও বাড়বে। অনু অবশ‍্য গ্ৰ‍্যাজুয়েট তবে অনার্স নেই। কথায় কথায় কৃষ্ণকেও সেদিন বললে.." আচ্ছা অনু তো জানিস সারাদিন একা থাকে ও কিছু একটা করতে চাইছে কি করা যায় বলতো?"

       " কৃষ্ণ হেসে বলে,ধু্ৎ মা কাকিমা তো চিরকালই সংসার দেখলো,রান্না করলো আমাদের মানুষ করলো।চাকরি পাবে কোথায় এখন? তাছাড়া সবাই যদি চাকরি করে ঘরটা দেখবে কে শুনি? আচ্ছা আমি অনুর সাথে কথা বলবো।"
              " না না চাকরি যদি পায় করুক না আমার কোন আপত্তি নেই।"

                পরে একদিন রবীনের বাড়িতে কৃষ্ণ আসাতে বেশ একটা জমাটি আসর বসলো।এমনিতেই কৃষ্ণ মাঝে মাঝেই চলে আসে। রবীন আর অনু অবশ‍্য বলছে এবার কৃষ্ণরও একটা বিয়ে করা উচিত।

      " কেন রে? দাদা মাঝেমধ্যে এসে ভালোমন্দ খেয়ে যায় সেটা ভালো লাগছেনা তাই আমাকে পর করতে চাস?" কৃষ্ণ বলে।

     " তুই কি মেয়ে নাকি রে দাদা যে পর হয়ে যাবি? বরং বৌদি আনলে তোর এখানে কেউ একদম আপন হবে।"
      " কেন রে? তোরা আমার আপনজন নোস নাকি?" কৃষ্ণ বলে।
     " একদম শালাবাবু,কিন্তু ভালোবাসার লোকও তো দরকার। এই যেমন আমার ভালোবাসার কেউ এসেছে আমার একলা ঘরের কোণে। মনে সবসময় আজকাল খুশির গুনগুন।মানে ঐ ঘরে ভ্রমর আসার মত আরকি?"

     " ইশ্ কত যে বাড়ি থাকে? রাতটুকু ছাড়া।" অভিমানে বলে অনু।

       " আচ্ছা বোন,রবীনদার এত ছাত্রছাত্রী উনার কাছে অঙ্ক করে ভালো ফল করছে।তোর গর্ব হয়না?"
       দাদাকে আর কি বলবে,মনে মনে ভাবে খুব হিংসা হয় ওর ছাত্রছাত্রীদের,সত‍্যি যদি ওর নতুন বিয়ে হওয়া বরটার সামনে বসে পড়তে পারতো!

         কিন্তু ওর ভাবনা যে এভাবে সত‍্যি হবে ভাবতে পারেনি অনু। স্কুল থেকে ফেরার পথে একগাদা বইপত্র নিয়ে ফেরে রবীন।
    " এত বইপত্র কি হবে গো? বাবা কি মোটামোটা সব বই! উঃ কি ভারী গো।"

      স্বভাবজাত উচ্ছ্বলতায় বকবক করতে থাকে অনু ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে রবীন। অনুর কোমর ছাড়ানো খোলাচুলে তখন ঢেউ লেগেছে বই সামলাতে হিমসিম অবস্থা,খুলে গেছে মাথার এলো খোঁপা। রবীন এসে হাত লাগায়,বই শুদ্ধু জড়িয়ে ধরে অনুকে আদর করে।
         " ইশ্ এত ভারী ভারী বই সামলাতে একদম নাকাল আমার বৌটা! দাও দাও আমায়। ভাবছি আমিও একটু পড়াশোনা করবো তোমার সাথে সাথে। হেডমাস্টার মশাই হবার পরীক্ষায় বসার ইচ্ছে আছে। দুজনেই একসাথে পড়বো।"

        " মানে? দুজনে একসাথে কি পড়বো শুনি?
আমি আবার কি পড়াশোনা করবো?"

" বাহ্ ভুলে গেলে এর মধ‍্যেই? এই তো সেদিন বললে তুমি চাকরি করবে।সারাদিন এভাবে একা একা আর ভালো লাগেনা।"
        বরের মিটিমিটি মাস্টারমশাই মার্কা হাসি একটুও ভালো লাগেনা অনুর। কেন যে মাস্টারমশাইকে বিয়ে করতে গেছিলো? তাও আবার অঙ্কের মাস্টারমশাই।

      " হ‍্যাঁ বলেছিলাম চাকরি করবো কিন্তু এত বই পড়া! আমার মন বসবেনা এখন।"

     " আমি পড়ালে ঠিক মন বসবে,চাকরির চেষ্টা করতে হলে একটু প্রস্তুতি তো লাগবেই। আর ইয়া মোটা বইটা তো আমার ওটা হেডমাস্টার্স ম‍্যানুয়াল।"

           পড়াশোনা করে জেরবার অনু,বরের সামনে ছাত্রী সেজে পড়বে কত শখ ছিলো। বরটা যে এত বেরসিক বুঝতেই পারেনি।মুখের দিকেই তো তাকায়না। ওকে পড়তে বলে নিজে বই নিয়ে বসে। কিছুক্ষণ পড়তে পড়তে রবীনের কাছে শুয়ে পড়ে অনু।নালিশ যায় অবশ‍্য বাপের বাড়ি আর দাদার কাছেও তবে ইশ্ আর ওর ইচ্ছে নেই এত পড়াশোনা করে চাকরি করার।

       ভগবান বোধহয় একদম আড়ি পেতে সবই শুনছেন ওর মনের ইচ্ছেগুলো তাই অনুর শরীর খারাপ করলো। কদিন একদম বিছানা থেকে উঠতে পারলোনা। যথারীতি রবীনেরও ব‍্যস্ততা বাড়লো। বরের কাছে এই সুযোগে অনেক অনেক আদর পেলো অনু। নাহ্ সত‍্যিই ওর বরটা ভালো, কত যত্নে ওর ছোটছোট সুবিধা অসুবিধাগুলো দেখছে অবশ‍্য একদিন বকাও দিলো কারণ অনুই নাকি উর্বশীর মত তার ঋষিতুল‍্য পতির তপস‍্যা ভাঙ্গিয়ে পড়াশোনা ভন্ডুল করার জন‍্য সাত তাড়াতাড়ি মা হতে চলেছে।

         ****************
অনুর বাপের বাড়ি থেকে ওকে নিয়ে যেতে চাইলে রবীনই বারণ করলো আসলে বৌয়ের সাথে থাকা একটা অভ‍্যেস মানে বদভ‍্যাস হয়ে গেছে।না থাকলে সত‍্যিই স্কুল থেকে এসে খুবই ফাঁকা ফাঁকা লাগে। অগত‍্যা বৌয়ের দেখভালের সময়ের জন‍্য মাস্টারমশাইয়ের ছাত্রদের আনাগোনা বাড়িতেই বেশি হলো।মানে একসাথে দুটোই হলো,একাধারে বৌ পাহারা দেওয়া আর অন‍্যদিকে পড়ানো স্কুলের পর।মাঝে মাঝে কৃষ্ণ এসেও ঘুরে যেতো কথা হলো কিছুদিন বাদে অনুর মা এসে দুএক মাস এসে থাকবেন তারপর বাচ্চা হওয়ার পর কিছুদিন বাপের বাড়ি থেকে আসবে অনু।

              বাড়ির বড় মেয়ে মা হতে চলেছে তাই বাবা মা এমন কি বোনেদেরও চিন্তা খুব।
    ওর পরের বোন রাণু ফোন করে বললো," ও দিদি আমি গিয়ে কদিন থেকে আসি তোর কাছে?"
     অনু বলার আগেই রবীন বলে," একদম চলে এসো শাশুড়িমা আসার থেকে শালী এলেই মঙ্গল।"
     বরকে চোখ পাকিয়ে বোনকে বলে অনু," তোর পড়াশোনা আছে না? এখানে এসে বসে থাকলে হবে?"
   " ও দিদি এখন তো ছুটি চলছে।"

     " তা চলুক,ভালো করে পড় তোকে কিন্তু চাকরি করতে হবে। এখানে আমি ঠিক আছি।"
     বৌয়ের কথা শুনে মুচকি হাসে রবীন,নিজেদের সুখী গৃহকোণে রবীনের অতি প্রিয় শ‍্যালিকাকেও অ্যালাউ করতে চায়না অনু। তাই নিঃশ্বাস ফেলে বলে.." আমিই অভাগা,আধি ঘরওয়ালীর আদর থেকে বঞ্চিত হলাম।"

           " ইশ্ শখ কম নয়। তাহলে তোমার দুই শালীকেই ডেকে নিই কি গো?"

            তবে সে সব কিছুই হলোনা যথারীতি ওদের সবার উপস্থিতিতে অনু অনেকটা কষ্ট সহ‍্য করে মা হলো। রবীনের মন খুশিতে ভরে গেলো আরে ও তো মেয়েই চেয়েছিলো অবশ‍্য অনুর ছেলের শখ ছিলো।

         ফর্সা টুকটুকে পুতুলের মত মেয়ে পাশে নিয়ে অনু শুয়ে রবীনের খুব আদর করতে ইচ্ছে করলো দুজনকেই।প্রথম বাবা হওয়ার আনন্দ বোধহয় কোটি টাকার লটারি জেতার থেকেও বেশি পুতুলটার দিকে তাকিয়ে মনে হলো এটা ওদের ভালোবাসার সন্তান খুব আদরে আগলে রাখার জিনিস। কৃষ্ণ হেসে বলে," ইশ্ বাবা মামা কারো মতই হয়নি শ‍্যামলা এতো একদম পলাশের রঙ নিয়ে এসেছে দেখছি।"
  রবীন হেসে বলে," আমরা কালো নাকি? এ আবার কেমন কথা?"
             রাজকন‍্যাকে আদরে আগলে অনুকে নিয়ে বাড়ি ফিরলো রবীন ঠিক হলো মাস খানেক বাদে অনু যাবে বাপের বাড়ি কিছুদিন থেকে আসবে। বিয়ের পর বর ছাড়া থাকেনি অনু তাই বিরহের বাজনা বাজে মনের মাঝে। তবুও যেতেই হলো কারণ মায়ের পক্ষে আর বেশিদিন থাকা সম্ভব হবেনা। এ বাড়িতে শাশুড়ি নেই শ্বশুরমশাই দেওরের সাথে গ্ৰামের বাড়িতে থাকেন তাই বাচ্চার যত্নের কথাও ভাবতে হবে।
           কদিন বাবা হওয়ার খুশিটা মনপ্রাণ দিয়ে উপভোগ করলো রবীন তবে সত‍্যিই একটু ভয় ভয় করছে কোলে নিতে,অনুও ধমকাচ্ছে," এটা তোমার ঐ মোটা ম‍্যানুয়াল নয় যে এভাবে চেপেচুপে ধরলে। ঠিক করে কোলে নাও।"
             তবে অনুর মা মানে শাশুড়িমা একদম সবদিকে খেয়াল রাখছেন।সত্যি উনার খুবই পরিশ্রম হয়ে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে একমাস হয়ে গেলো,মেয়ে বেশ পিটপিটিয়ে তাকায় মুখে হাসির ঝলক দেখতে পায় রবীন। যেন ওকে দেখে খুশি হয়। মেয়ের নাম অনন‍্যা রাখলো ওরা,ডাকনাম মিষ্টি।রবীন স্কুল থেকে এসে মিষ্টি বলে ডাকলেই এদিক ওদিক তাকায় মেয়ে।
           " এই যে মিষ্টি মায়ের সাথে মামাবাড়িতে চলে যাবি আমি কি করে থাকবো একা একা?"
     অনু বলে," তুমিই তো বলেছো যেতে,আবার কেন এখন শুনি?"

******************
    অনুকে রাখতে রবীনই গেলো,নাহলে রাজকন‍্যাকে আগলে কে নিয়ে যাবে? আরো দু তিনদিন একসাথে থাকা কারণ শালীরাও বায়না করেছে জামাইবাবুকে আসতেই হবে।
        বেশ মজায় কেটে গেলো কয়েকটা দিন,ফেরার আগের রাতে বরের বুকে মাথা রাখে অনু চোখটা একটু ছলছল করে," ভালো ভাবে থাকবে বুঝলে।আর সময়ে খাওয়াদাওয়া কোরো বিন্তির মাকে বলে এসেছি সব তোমার বিকেলের টিফিনও করে যাবে শুধু স্কুল থেকে এসে খেয়ে নিয়ো ঠিকমত।
     " সব ঠিক থাকবে তুমি কিছু ভেবোনা। আমিও একটু পড়াশোনা করবো কদিন। দুটো মাস তো দেখতে দেখতে কেটে যাবে। আর আমি সামনের মাসে তো একবার আসবোই।"

         অনুর দুমাসের বদলে তিনমাসই থেকে যেতে হলো কারণ মাঝে মিষ্টির একটু শরীরটা খারাপ হয়েছিলো তাই বাপের বাড়ির সবাই আপত্তি করলো," এখানে আছিস,সবাই দেখছি ওখানে একা একা সব সামলাবি কি করে?কিছুদিন থেকেই যা।"

         " কিন্তু মা ওর যে ওখানে খুব অসুবিধা হয়।"
  কথাটা বলতে চাইলেও আর লজ্জায় বলতে পারেনা অনু। ইশ্ এই কদিন আগে যে বাড়িটা আর চারপাশের সব ছিলো একদম নিজের জগত হঠাৎই রবীন নামের কেউ জীবনে এসে সব এক দমকায় উড়িয়ে নিয়ে গেলো।

       তবে ফিরে তো আসতেই হবে কারণ বৌ আর মেয়ে ছেড়ে রবীনেরও ভালো লাগছেনা। তাই ছুটে যাওয়া অবকাশ পেয়েই। " চলো জলদি আর ভালো লাগছেনা একা একা।কতদিন যেন মিষ্টিকে কোলে নিইনি।"
         হয়ত অপেক্ষায় ছিলো অনুও রবীনকে কাছে পাবার তাই আদরের ডাকে সাড়া দিতে আর দেরি করলোনা। সবার মন খারাপের মাঝেই আবার ফিরে আসা।
       " ইশ্ কতদিন বাদে আবার কাছে পেলাম মা আর মেয়েকে।" হয়ত অনেক কথা আর অনেকটা বেশিই আদর অনেকদিন বাদে অনুকে আর রবীনকে আনলো আরো কাছাকাছি।

মেয়েকে নিয়ে প্রথমে বেশ একটু অসুবিধা হলেও বিন্তির মায়ের সাহায‍্যে একটু একটু করে বেশ পাকা গিন্নী হয়ে উঠলো অনু।হয়ত একটু বেশিই সংসারী,আজকাল আর রবীনের মিসিং ব‍্যাপারটা তেমন ভাবায়না।কোথা দিয়ে যে সময় কেটে যায় বুঝতেই পারেনা। রবীনেরও মনে হয় জীবন গাড়িটা বেশ হু হু করে ছুটছে আজকাল অনুকে তেমন আলাদা করে পাওয়াই যায়না। অনু এখন ব‍্যস্ত মা।

      *********************

      মাঝে ঘুরে গেছে বছর, মিষ্টি এখন গুটগুট করে হাঁটে। ওকে খাওয়াতে আর স্নান করাতেই মোটামুটি দিনের অনেকটা সময় কেটে যায় অনুর।রবীন যথারীতি ওর স্কুল আর পড়ানো নিয়ে ব‍্যস্ত থাকে।
       এর মধ‍্যে কৃষ্ণরও হঠাৎই বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেলো। বেশ একটা খুশি খুশি ভাব সবার মনে।দাদার বিয়েতে কি পরবে? সাজবে কিভাবে?কত চিন্তা সব বোনেদের।

    অনু আদুরে গলায় বলে, " এই এবার কিন্তু আমি গিয়ে পনেরো দিন থাকবো। অনেকদিন পরে যাচ্ছি।"
     " পনেরো দিন! আমি মেয়ে ছাড়া যে থাকতে পারিনা। আর বৌ ছাড়াও।"

       " ইশ্ সারাদিন বাড়িই থাকেনা। কত ভাবে বৌ আর মেয়ের কথা?"
রবীন কি করে বলবে ঐ বাইরে থাকাটুকু সংসারের প্রয়োজনেই। কিছু কথা শুধুমাত্র হয়ত মনের সাথেই বলা যায়।

      দাদার বিয়েতে গিয়ে প্রায় দিন পনেরো থাকার প্ল‍্যান নিয়ে এসেছে অনু। সত‍্যিই তো বাড়িতে কত লোক আর হৈ চৈ এসব ছেড়ে কি আসা যায়? কদিন বোনেরা মিলে খুব সাজুগুজু আর জমিয়ে মজা।
      বিয়েবাড়ির আনন্দের ফাঁকে আবার সেই কয়েকবছর আগের অনুকে পেলো রবীন,অনুর পিঠ ছাড়ানো এলোচুলের ঢেউ পরনের টুকটুকে লাল বেনারসী আবার নিয়ে গেলো রবীনকে অনুরাগের দিনগুলোতে ফিরিয়ে। মনটা বেশ তখন রোমান্টিকতায় ভরপুর।
         অনুদের বাইরের বাগানের লাল পলাশ গাছটায় আবার সেই মন কেমন করা লালের ছোঁয়া রবীনের মনটাকেও এলোমেলো করে দিলো।
         শালীদের আব্দারে বাসরঘরে গাইতেই হলো রবীনকে," সুরের আসর থেকে মন নিয়ে এসেছি গো ফুলের বাসর ঘরে বন্ধু।"

            রবীনের গানের সেই সুরে রাঙা হলো অনুর গালদুটোও মনে পড়ে গেলো ওদের ফুলশয‍্যার রাতে এই গানটাই গেয়েছিলো রবীন।
        অনুর তখন ওড়নার আড়ালে মনটা ডুব দিয়েছিলো ভালোবাসার ফুলের বাসরে।
        কাছাকাছি এসেছিলো ওরা,সারাটা রাতই কেটেছিলো গানে গল্পে। ক্লান্ত অনুর চোখ যে কখন বুজে এসেছিলো ভোরবেলায়। রবীন ওর চোখের পাতায় ঠোঁট ছুঁইয়ে গেয়েছিলো..' রাই জাগোরে জাগো শ‍্যামের মন মোহিনী বিনোদিনী রাই।'
          একদম ঘুম ভেঙে গেলেও চোখ বুজেছিলো কিছুক্ষণ আদরে অনু।

*****************

অনু প্ল‍্যান মতো কয়েকদিনের জন‍্য বাপের বাড়িতে থেকে গেলেও রবীনের অবশ‍্য অতদিন থাকা হয়নি ফিরে আসতে হয়েছে কাজের জায়গায়।

      আর বাড়িতে ফিরে এসেই চিঠিটা পেলো। সত‍্যিই চিঠিটা পেয়ে খুব আনন্দ হচ্ছে,আবার একটু দুশ্চিন্তাও হচ্ছে। থাক অনুকে এখনই বলবেনা সারপ্রাইজ থাক। তার চেয়ে বরং অনুকে একটা চিঠি লেখা যাক,অনেকদিন উড়োচিঠিতে জমানো খবর ডাকবাক্সে ফেলা হয়না। চিঠিটা লিখে রেজিস্টার্ড পোস্টেই দিলো রবীন। হঠাৎই রবীনের রেজিস্টার্ড চিঠি পেয়ে অবাক লাগে অনুর। বাবার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে ঘরে চলে যায়। কিছুক্ষণ বাদে বাইরে বেরিয়ে আসে।

     " কি রে, কি চিঠি? মানে কি আছে চিঠিতে? সব ঠিক তো?"ওর বাবা বলেন।

    " বাবা ও লিখেছে ওকে একটা কাজে নর্থবেঙ্গল যেতে হবে ফিরতে এক সপ্তাহ হয়ত লাগবে। ফিরে এসে আমাদের নিয়ে যাবে। ততদিন এখানেই থাকতে বলেছে।"

     " তা হঠাৎই নর্থবেঙ্গল কেন? তোকে কিছু বলেছে নাকি চিঠিতে? আর এখানে থাকবি সেতো ভীষণ ভালো কথা। আমাদেরও দিদিভাই কে ছাড়তে ইচ্ছেই করেনা। খুব ভালো হবে,যাক কটা দিন আরো পাওয়া গেলো।"

     সবাই হৈ হৈ করে উঠলেও বরের ওপর খুব অভিমান হয় অনুর। একেই তো সেই কবে চলে গেছে ওকে এখানে রেখে তারপর হঠাৎই চললো নর্থবেঙ্গল, কে জানে কেন? কিছুই লেখেনি চিঠিতে।নিশ্চয় বেড়াতে যাচ্ছে হয়ত,যা নেশা পাহাড় আর জঙ্গল দেখার।

   ইশ্ দাদাটাও তো এখন এখানে খবর পাওয়ার উপায়ও নেই। এবার আসুক,একদম কথা বলবেনা। তখন মোবাইল ফোন ছিলোনা ওদের কারোরই যে টুক করে কথা বলে নেবে।তাই অভিমানের মেঘ মনে জমলেও কিছু করার নেই।
           মনে জমা মেঘ নিয়ে চললো প্রতীক্ষা অনুর। খুব খুব রাগ হচ্ছে মনে মনে।

******************

          স্কুল থেকে ছুটি নিয়েই রবীনকে তাড়াতাড়ি চলে যেতে হয়েছে নর্থবেঙ্গলে। নর্থবেঙ্গল ভাবতেই কেমন যেন মনটা করে ওঠে,চারদিকে সবুজের কানাকানি আর মাঝেমাঝে পাহাড়ের উঁকিঝুঁকি। পাখির ডাক আর প্রজাপতির পাখার রঙ দেখেই কেটে যাবে কতটা সময়। তাও একেবারে কালচিনিতে হয়েছে। রবীনের মনের প্রজাপতি উড়তে উড়তে পৌঁছে যায় কালচিনিতে।

এই স্কুলে অনেকদিন আছে,অনেক স্বপ্নের বীজ বুনেছে এই স্কুলে। রবীন্দ্রজয়ন্তীতে তুলেছে সুরের জলতরঙ্গ। ছাত্রছাত্রীরাও সবাই ভীষণ ভালোবাসে ওকে। রবীন সবার প্রিয় অঙ্ক স‍্যার,
       কিন্তু তবুও রবীন অনেক কাজ করতে চায় একদম নিজের মত করে তাতে কোথায় যেন বাধা আর সমালোচনার আভাস পায়।হয়ত কাজ করার ইচ্ছে আর উচ্চাকাঙ্ক্ষাই নিয়ে চলেছে এই অচেনা পথে রবীনকে।পাহাড়ে পর্বতে ট্রেকিং করা রবীনের বড় প্রিয় নর্থবেঙ্গল এরপর হয়ত ভাগ‍্য নিয়ে যাবে সেই পছন্দের জায়গাতেই ওকে।

          ট্রেনের জানলার ধারে বসে অদেখা অনেক স্বপ্নে চোখ বুজে আসে রবীনের। চারদিকের সবুজ চাদরপাতা চা বাগানের পাশেই স্কুলটা, বেশ সুন্দর আর স্কুলবাড়িও খুব বড় একদম উচ্চমাধ্যমিক স্কুল। স্কুলের সামনে বড় খেলার মাঠ আর লাগোয়া হস্টেল আর তার পাশেই একদম চাবাগানের কোলে ছোট্ট ছিমছাম হেডমাস্টার মশাইয়ের কোয়ার্টার। সব ব‍্যবস্থাই আছে সেখানে।সবার আপ‍্যায়নে মন ভরে গেলো রবীনের। সত‍্যিই হয়ত পদমর্যাদার একটা ব‍্যাপার থাকে আর আজ তা অনুভব করলো রবীন। একদম জয়েন করে তিনদিন স্কুল করে ফিরলো।

         এইসব করতে করতে এক সপ্তাহ কেটে গেলো। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ‍্যে তখন মন খারাপের মেঘকুয়াশার আঁধার." স‍্যার আপনি চলে যাবেন? কেন স‍্যার? আমরা ভালো করে পড়বো স‍্যার।"
       গলাটা বুজে আসে রবীনের," আরে আসবো তো মাঝে মাঝে,আর যেতে এখনো তো দিনকয়েক দেরি আছে।"
            এসেই খোঁজ করে রবীন কোন চিঠি এসেছে কিনা? আর চিঠি না দেখে বুঝলো ওদিকে অনুরানী মানে একমাত্র গিন্নী খুবই রাগ করে বসে আছে।বেচারা সত‍্যিই বর ছাড়া থাকতে পারেনা।এদিকে শালাবাবুও বেপাত্তা তার হানিমুন সেরে এখনো ফেরেনি সে তাই অগত‍্যা গুটিগুটি শ্বশুরবাড়িতে যাওয়া।

***************

     যাওয়া মাত্রই একদম শালীদের সবার কাছে ঘেরাও.." কোথায় যাওয়া হয়েছিলো? দিদি ভীষণ অভিমান করে শরীর খারাপ করেছে।কদিন ভালো করে খাচ্ছেনা একদম বিছানা নিয়েছে।"

       মেয়েকে শালীদের কাছ থেকে নিয়ে কোলে জড়িয়ে রাখে রবীন।সত‍্যিই তো অনু তো একবারও বাইরে এলোনা। তাহলে কি সত‍্যিই খুব রাগ করেছে? যাক সারপ্রাইজটা বলে দিলে নিশ্চয় খুশি হয়ে যাবে।আর রাগ করতে পারবেনা।

            ঘরে গিয়ে দেখে সত‍্যিই অনু বিছানায় শুয়ে,সত‍্যিই তো এই কদিনে বেশ শরীর খারাপ হয়ে গেছে।রবীন বলে ওঠে," কি হয়েছে অনু? অভিমান করে এতদিন ভালো করে খাওয়াদাওয়া করোনি নাকি? সত‍্যিই আমার বৌটা একদম পাগলি।"
       অভিমানী গলায় অনু বলে ওঠে," এতদিন কোথায় ছিলে শুনি?"
        " তোমার জন‍্য একটা দারুণ সারপ্রাইজ আছে। দাঁড়াও বলছি,তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে নাও  এবার তো যেতে হবে।"
          অনু হাসে," তোমার জন‍্যও একটা সারপ্রাইজ আছে। আগে তুমিই বলো তারপর আমি বলছি।"
    বুকটা একটু টিপটিপ করে রবীনের তাই বলে," না না আগে তুমিই বলো।"

               রবীনের বুকে মাথা রাখে অনু," আমার হঠাৎই মাথা ঘুরলো,খেতে ইচ্ছে করছিলোনা। আমাদের মধ‍্যে আবার কেউ আসছে। তবে আমি তো এত তাড়াতাড়ি কিছু চাইনি,মিষ্টি খুব ছোট এখন।মাকে বলেছিলাম সে কথা মা খুব বকলো শুনে।"
         রবীন এক মুহূর্তে অনেক কিছুই ভেবে নেয় চট করে, সত‍্যিই হয়ত আরো একটু সাবধান হওয়া উচিত ছিলো ওদের। কিন্তু যে আসছে সে আসুক হয়ত সেই সব ভালো খবর এনেছে। তাই অনুকে বলে," যে আসছে সে আসুক অনু ও আমাদের অনেক ভালো খবর দেবে দেখো। আমি হেডমাস্টারের অ্যাপয়ন্টেমেন্ট লেটার পেয়েছি জয়েন করতে গেছিলাম নর্থবেঙ্গলে। তোমাকে সামনাসামনি বলবো বলে তখন চিঠিতে লিখিনি..। কিন্তু এই অবস্থায় তুমি যেতে পারবে তো? অচেনা জায়গা,অচেনা পরিবেশ। নাকি কয়েকটা মাস এখানেই.."

       কিছুতেই রাজি হলোনা অনু আর বাপের বাড়ি থাকতে," তুমি আছো তো সাথে ঠিক পারবো আমি।"

    সুতরাং আর ভাবার তেমন কিছু নেই বাড়ির সকলে থাকতে বললেও অনুই বললো," মা আমি না গেলে নতুন জায়গায় সব সামলাবে একা ও কি করে? কিছু ভেবোনা সব ঠিক থাকবে।" বেশ একটা কান্নাকাটি হলো ওদের বোনদের কারণ দিদি এবার অনেক দূরে চলে যাচ্ছে।

     রবীন ওদের বোঝায়," ভালোই তো তোমাদের বেড়ানোর জায়গা হলো। এতদিন পলাশ দেখেছো এবার সবুজ চাবাগান দেখবে।"

**********************

         স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের কাঁদিয়ে আর ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়ে রবীনের যাত্রা শুরু এক নতুন শপথ নিয়ে নতুন পদে যোগদানের জন‍্য। একদিকে বিদায়ের কষ্ট আরেকদিকে নতুনের আনন্দ দুই মিলিয়ে এক মিশ্র অনুভূতি রবীনের মনে। সাথে অনু আর মিষ্টি আর যে আসছে সেও চললো ওদের সাথে হয়ত ওর জন্মের লগ্ন আর জন্মস্থান নির্ধারিত অন‍্য কোথাও।
             অনেকদিন বাদে ট্রেনে চড়লো অনু,মিষ্টির এই প্রথম ট্রেনে ওঠা। বেশ চুপ করে আছে ও। " কি গো তোমার অসুবিধা হচ্ছেনা তো? তাহলে শুয়ে পড়ো,বিছানা পেতে দিই।"রবীন অনুকে বলে।
         " না না আমি ঠিকই আছি,একটু বসি দেখতে দেখতে যাই।"পরম নির্ভরতায় রবীনের কোলে হাত রাখে অনু।হয়ত এটাই মেয়েদের জীবন এই মানুষটার সাথে সব ছেড়ে চললো কত দূরে।

        স্কুলের কোয়ার্টার খুব একটা বড় না হলেও একদম পেছনেই চাবাগান। অনু চোখ ফেরাতে পারলোনা দেখে," এ এক অন‍্যরকম সুন্দর তাই না গো? আমাদের বাপেরবাড়ির মত লাল সবুজে সুন্দর নয় শুধু সবুজে সবুজে গড়ানো কার্পেটে মন হারানো।"
    " তোমার ভালো লেগেছে এই জায়গাটা অনু? থাকতে পারবে তো এখানে?"

      " হ‍্যাঁ মশাই চিনেমাটির কাপেও থাকতে পারি আবার মাটির ভাড়েও থাকতে পারি।"
  " এই রে চাবাগানে এসেই চা হয়ে গেলে নাকি?কিছুদিন আগেই তো ছিলে পলাশফুল।"
           "আমরা মেয়েরা এমনই হই,যেখানে রাখবে সেখানেই মানিয়ে নেবো।"
        সত‍্যিই কদিনের মধ‍্যেই শঙ্কু আর পারুলের সাহায‍্যে সবই গুছিয়ে নিলো অনু। সবুজ কার্পেটের মাঝে পাতলো ওর নতুন সংসার। মিষ্টিও বেশ খেলে বেড়াতে লাগলো পারুলের কোলে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে স্কুলের কাজে মন দিলো রবীন। একদম সব নতুন তাই বুঝতে একটু সময় লাগবে।

          সারাদিন স্কুলের কাজের পর রবীনের কোয়ার্টার থেকে সন্ধ‍্যেবেলাতে গানের সুরের মূর্ছনা ছড়াতো প্রকৃতিতে.." এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়।"
        এই সুরের আলাপটুকুই অঙ্কের ফর্মূলার মাঝেও বাঁচার মিঠে আতরের সৌরভ দিতো রবীনকে। ভালো লাগতো অনুরও,গানের মাঝে মাঝে হঠাৎই কোনদিন কানে আসতো ময়ূরের ডাক।

                      প্রায়ই অন‍্য মাস্টারমশাইদের আনাগোনাও হত, বসতো চায়ের আসর। মাঝে মাঝে অনুও যোগ দিতো অন‍্য বৌদের সাথে গল্পে আর আড্ডায়। মাঝে অনুর মা বাবাও এসে ঘুরে গেলেন মেয়ের কাছ থেকে ওকে দেখে গেলেন।

রবীন ওনাদের নিয়ে ঘুরলো কাছাকাছি বক্সা,জয়ন্তী,রাজাভাত খাওয়া।

একবার কৃষ্ণও নতুন বৌকে নিয়ে এলো।ওরা তো মুগ্ধ রবীনের স্কুল আর থাকার জায়গা দেখে..." রবীনদা দেখোনা,এখানেই একটা চাকরি আমার জন‍্য। সবুজ দেখেই তো থেকে যাওয়া যায়। ওহ্ অপূর্ব জায়গা গো,তুমি সত‍্যিই ভাগ‍্যবান।"
        কৃষ্ণর বৌ সুমায়াও খুব মিশুকে,কদিন দাদা বৌদির সাথে বেশ কাটলো অনুর গল্পে আর গানে। ওদের নিয়েও কাছাকাছি একটু ঘুরে এলো রবীন।অনু একদিনই যেতে পেরেছিলো,ওর শরীরটা বেশ ভারী হয়েছে এখন।

যাবার সময় সুমায়া বলে গেলো," আবার চলে আসবো সবুজ দেখতে ইচ্ছে হলেই তোমাদের এখানে।"

রবীন বললো," মনের টিকিট কেটে রেখো তাহলেই চলে আসতে পারবে যখন খুশি।"
     কৃষ্ণ মজা করে বলে," তুমি বরং থেকে যাও এখানেই।" অনুরাগে মাখা রাগে চোখ বড় করে লজ্জা পায় সুমায়া।

    রবীন বলে," অমন কম্মটি কোরনা শেষে তোমার বোনের মত অসুখে শুয়ে পড়বে হেথায়।"

        রবীনের কোয়ার্টার ফাঁকা করে ওরা চলে গেলো,রবীনেরও মন ছুটলো পুরোনো স্কুলের দিকে আরো একবার।

      ****************

                মিষ্টি ঘুমিয়ে পড়লে অনুর পেটে হাত রাখে রবীন অনুভব করতে চায় অনাগত সন্তানকে।
     " তুমি ঠিকমত খাচ্ছো তো? ও নড়াচড়া করছে তো ঠিকঠাক?"
         রবীনের আদরে ভেজা অনু বলে," সব ঠিক আছে,এখন আমি অনেক কিছু বুঝি।মিষ্টির বেলা প্রথম প্রথম তো তাই কিছুই বুঝতামনা। এবার না আগের থেকে অনেক কিছু আলাদা। এবার মনে হয় ছেলে হবে।"
         অনুর মনে অদ্ভুত একটা অনুভূতি আছে মনে প্রাণে একটা ছেলে চায় ও। হয়ত ওরা তিনবোন ভাই নেই বলেই এমন ভাবনা।
        " আমার তো মেয়েই ভালো লাগে। সুন্দর সুন্দর জামা পরবে,সাজবে আমি এলে জলের গ্লাস ধরবে সামনে।" রবীন বলে।
        " সে তো ছেলেও বাজার করবে,ওষুধ আনবে। একটা ছেলের খুব দরকার।মেয়েরা তো সেই বিয়ে হয়ে চলে যাবে।"
        " আমি যেতেই দেবোনা,একদম রেখে দেবো আমার কাছে জামাইসহ।" রবীন বলে।
হাসে অনু। অবশ‍্য রবীনকে বিশ্বাস নেই সেটা করতেই পারে।
        ছোট ছোট টুকরো কথায় ঘুমিয়ে পড়ে অনু।পেছনের বাগানে মাঝে মাঝেই একটা রাতজাগা পাখির ডাক শোনা যায়।

   *******************

    দেখতে দেখতে সময় এগিয়ে এলো মিষ্টিকে দেখার জন‍্য ওর দিদু আর বড়মাসি দুজনেই এসেছে।
   " বুঝলে অনু আর চিন্তা নেই আমার আধি ঘরওয়ালী এসে গেছে।ওকে এবার এখানেই রেখে দেবো।"
       রাণু হেসেই অস্থির জামাইবাবুর কথা শুনে।

            তবে অনুর ইচ্ছে পূরণ না হলেও রবীনের ইচ্ছে মিটলো আবার মেয়েই হলো। তবে অনুর আচরণে অবাক হয়ে গেলো রবীন.." ইশ্ মেয়ে কোলে নিয়ে কেউ কাঁদে? একটা মিষ্টি পরী এসেছে। আমি ওর নামও ঠিক করে ফেলেছি দুষ্টু,কি সুন্দর দুষ্টুমি ভরা মুখটা। ভালো নাম রাজন‍্যা।"
         অনুর চোখে তখনো জল,মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মনটা মায়াতে ভরে যায় রবীনের। কেমন মা অনু? নিজে মেয়ে হয়েও মেয়ে হয়েছে বলে এত সমস‍্যা?
      চোখ মুছে অনু বলে, " একেই মেয়ে,তারপরে এত কালো হয়েছে।"
  " তাতে কি অনু? ও আমার মত হয়েছে। তুমি সত‍্যিই ছেলেমানুষ এখনো।"
       অবাক হয়ে যায় অনু রবীনের কথা শুনে,এবার সত‍্যিই মনে হয় ওর বরের কোন তুলনা নেই। রবীনের থেকে অনেক কালো হয়েছে মেয়েটা। আর রবীন তো পুরুষমানুষ।

             আর বোনটাও হয়েছে তেমন কি খুশি দেখে দুষ্টুকে। "একদম মিষ্টি পুতুল হয়েছে দিদি,চোখদুটো কি ভাসা ভাসা আর সুন্দর দিদি।"

           অনুর সেই কালো ছোটমেয়েটা যে জন্মেই প্রথমে মায়ের কাছেই কলঙ্কের বোঝা হলো সে হঠাৎই লাকি চ‍্যাম্প হয়ে গেলো স্কুলের সবার কাছে। আরে ও জন্মানোর পরেই সেবার প্রথম স্কুল ফুটবল চ‍্যাম্পিয়ান হয়ে বিশাল শীল্ড জিতে ফিরলো। ওর ভাসা ভাসা সুন্দর চোখের দৃষ্টিতে শুভাশীষ ঝরে পড়লো রবীনের সংসারে আর স্কুলে আর তার কিছুটা ছোঁওয়াও লাগলো রাণুর জীবনেও ওখানকার এক ব‍্যাঙ্ক অফিসারের তার শালার জন‍্য পছন্দ হয়ে গেলো রাণুকে।
                  হঠাৎই এলো সম্বন্ধটা তবে দেখাশোনার জন‍্য আরেকটু সময় চাইলো রবীন। মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরেই এতগুলো ভালো খবর। রবীনের ঘরে লক্ষ্মী এলো রাজন‍্যার হাত ধরে। এতদিন মাকে না দেখে মা আসতেই মায়ের কোলের কাছে শুলো মিষ্টি,জড়িয়ে ধরলো বোনকে।
     রাণু সাবধান করলো," আস্তে আস্তে সোনা,বনু ছোট তো।"
                    রবীন হেসে শালীকে বললো.." এই যে অভ‍্যেস করো তোমারও তো সানাই বাজবে শিগগির মনে হচ্ছে। উত্তরবঙ্গ ভালোবেসে রেখে দেবে এখানেই।"
              বেশ লজ্জা পায় রাণু,সত‍্যিই কিভাবে যে সব হয়ে গেলো! তবে ছেলের দেখা এখনো বাকি,শুনেছে ছবিতেই পছন্দ হয়ে গেছে ওদের কিছুদিন বাদে আসবে ওরা।

         অনেকগুলো খুশির খবর মুঠো করে আনা দুষ্টু দেখতে দেখতে একমাসের হতে চললো।মা আর বোন আর অনুর চব্বিশঘন্টার হেল্পারের জন‍্য দুটোকে সামলাতে খুব একটা কষ্ট হয়না ওর। মিষ্টি এমনিতেই শান্ত তবে ছোটজনের নামের সার্থকতা এখন থেকেই বেশ বোঝা যাচ্ছে। বাবার সঙ্গে আর মাসির সঙ্গে খুব দোস্তি হয়েছে।
             স্কুল থেকে এসে অনুকে দুটোকে কোলে নিয়ে বসে থাকতে দেখে অন্নপূর্ণা মনে হয় রবীনের.." তুমি কিন্তু আরো সুন্দরী হয়েছো মনে হচ্ছে।"
            রবীনের কথা শুনে মুখ টিপে হাসে অনু।
" সব সময় শুধু ফাজলামো। রাণুকে দেখতে আসছে জানো তো?"
       " জানি তো? তোমরা বোনেরা যা সুন্দরী,বুঝতেই পারছি এখানেই হয়ে যাবে ঠিকঠাক।"
              পাত্রপক্ষ আসবে বলে রবীন কোন আয়োজনের ত্রুটি রাখেনি। পাশেই থাকেন বাংলার মাস্টারমশাইয়ের স্ত্রী লাবণ‍্য সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো রাণুকে গাঢ় সবুজ লাল শাড়িতে।
                   " ইশ্ আমারই তো আরেকবার ছাদনাতলা যেতে ইচ্ছে করছে।"
       " জামাইবাবু যে কি বলে..." আদুরে গলায় বলে রাণু।

       রবীনের কথাই ঠিক হলো পাত্রপক্ষের সবারই বেশ পছন্দ হলো রাণুকে। রবীন একটু সুযোগ করে দিলো আলাদা কথা বলে নেবার। পেছনের বারান্দার বেতের চেয়ারে বসে চা খেতে খেতে বন্দি মন পড়ার চেষ্টা দুটো অপরিচিত মানুষের।একসাথে থাকতে হবে তো।
           ছেলের দাদাও খুব ভালো মেরিন ইঞ্জিনিয়ার,বেশিরভাগ বাইরে বাইরে থাকে ।আর জামাইবাবু তো এখানেই থাকে। রবীন নিশ্চিন্ত হলো যাক শিলিগুড়ির বাসিন্দা হচ্ছে তাহলে শালী। কতটুকু আর ইচ্ছে হলে আসতে পারবে। শুধু শাশুড়ির মনটা খারাপ.." দুই মেয়েই উত্তরে ঘর বাঁধলো জানিনা ছোটটা কি করবে?"
     " তাতে কি আপনারাও চলে আসবেন এখানে।"
          সত‍্যিই বড় জামাইয়ের তুলনা হয়না স্বস্তির শ্বাস ফেলেন অনুর মা।

*******************
   কয়েকমাস দুই বাড়ির তোড়জোড় করার সময় নেওয়ার পর রাণুর বিয়ের দিন এগিয়ে এলো। অনেকদিন বাদে অনুর আবার বাপের বাড়ি যাওয়া,মনটা খুবই খুশিতে ভরে রয়েছে। রবীন যদিও বলেছিলো "বিয়েটা এখান থেকেই হয়ে যাক।কাছাকাছি হবে সব এখান থেকে,শুধু আপনারা চলে এলেই হবে।"
       তবে শ্বশুরমশাই, কাকাশ্বশুর,জ‍্যাঠাশ্বশুর সবারই আপত্তি।গ্ৰামের লোকজন কি বলবে। তাই শেষে আবার সবুজের পথ পাড়ি দিয়ে হাত মেলানো পলাশের সাথে। অনেকদিন বাদে মন কাড়লো লাল পলাশ বসন্তে। দুই মেয়ে নিয়ে একদম অস্থির অনু তারমধ‍্যে ছোটটাই বেশি দস‍্যি।সবে বসতে শিখেই একদম মাকে অস্থির করে রেখেছে। তবে বাপের বাড়ি গিয়ে অনেকটা নিশ্চিন্ত,কোলবদল হতে হতে বেশ আছে মামাবাড়ির আদরে। রবীন লেগে পড়েছে একদম কোমরে গামছা পরে বিয়ের যোগাড়যন্ত্রে। বড় জামাই বলে কথা।

        রাণুর মনের কোণে কোণে বসন্তের ভ্রমরের আনাগোণা অবশ‍্য হবু বরের সাথে এর মধ‍্যেই বেশ ভাব হয়ে গেছে।
                          বিয়েটা একদম খুশির ঢেউ খেলিয়ে সুন্দর ভাবে হয়ে গেলো। শিলিগুড়ির বরযাত্রীরা তো মুগ্ধ এখানে এসে। বেশ রথদেখা আর কলাবেচা দুইই হলো। বিয়ে আর বেড়ানো একসাথেই। রাণুর মনে দুঃখের সুরের পাশাপাশি খুশির সানাই, কাছেই আছেই দিদি যখন তখন মন খারাপ হলেই ছুট্টে পালাই এমন ব‍্যাপার কারণ কালচিনিতেই তো ওর ননদও থাকে। কৃষ্ণর সাথেও দেখা হলো,বেশ জমজমাট কাটলো কয়েকটা দিন। তবে অনুর থাকা হলোনা কারণ রাণুর সাথে কনেযাত্রী যাওয়ার ব‍্যাপার আছে,ফুলশয‍্যার তত্ত্ব যাবে তাই ছোটবোন বেবিকে সাথে নিয়ে ওরা ওদের সাথেই ফিরলো।

          রাণুর বর শুভময় বেশ হাসিখুশি আর মিশুকে ব‍্যাঙ্কে চাকরি করে। ওর দাদার ছেলেটা বয়েসে মিষ্টির চেয়ে একটু বড় তাই দুটোতে সারাক্ষণ খেললো ট্রেনে। ভালোই হলো ফেরার সময়ের সফরও। একসাথে মোটামুটি সবাই,তাই হৈ চৈ হাসি ঠাট্টা বেশ জমলো। ট্রেন থামার ফাঁকে ফাঁকে স্টেশনে নেমে চা খাওয়া,খাবার আনা,মালদায় আমসত্ত্ব কেনা বেশ জমে উঠলো।

          শ্বশুরবাড়ির লোকজন বেশ ভালোই রাণুর। তবে ভাসুরের ছেলে এর মধ‍্যেই খুব ন‍্যাওটা হয়ে গেছে ওর। ওকে দেখে বারবার দুষ্টু আর মিষ্টির কথা মনে পড়লো রাণুর। বৌভাতের দিন অবশ‍্য দুটোই এসেছিলো,দুষ্টুটাও পাল্লা দিয়ে দুষ্টুমি করলো। নতুন ঘর,নতুন বর,নতুন শহরের মাঝেও মাঝে মাঝেই মন কেমন করে রাণুর আর তখনই বায়না করে.." আমাকে দুদিনের জন‍্য রেখে আসবে দিদির ওখানে? দুই দিদির বাড়ি হয়েই ফিরবো।"
       " নতুন বৌ ছেড়ে দুদিন আমি থাকতে পারবোনা।পরের উইকএন্ডে সঙ্গে করে নিয়ে যাবো আর নিয়ে আসবো। বাবা জামাইবাবুর কাছে সুন্দরী শালীকে কেউ ছাড়ে।"
      শুভর বুকে মাথা রাখে রাণু.." হিংসুটে কিন্তু ভালো বরটো আমার।"

            শ্বশুরবাড়ির সবার সাথে বেশ মানিয়ে নিয়েছে রাণু ওর জা মধুমিতা চাকরি করে ব‍্যাঙ্কে।দেওর আর বৌদি একসাথেই চলে যায় অফিসে তাই বাড়িতে শ্বশুরমশাই আর শাশুড়িমা আর তার সাথে পুচকে জোজো সারাদিন তার উৎপাত চলছে ওকে নিয়েই সবার সময় কেটে যায়।

      রাণুকে পেয়ে মধুমিতাও অনেকটা নিশ্চিন্ত যে ছেলেটা ঠিক সময়ে খাওয়াদাওয়া করবে।বয়স্ক শ্বশুর আর শাশুড়িমা তো সবসময় পেরে ওঠেনা আর কাজের মেয়ে পুটুকে মোটেই পাত্তা দেয়না ঐ ছেলে।
          দুই বোনের মাঝে মাঝে কথা হয় টেলিফোনে.." দিদি,দাঁড়া একটু ফাঁকা পেয়েই বোধহয় ছুট লাগিয়েছে ছাদে বিচ্ছুটা।"
      ওপার থেকে অনু বলে," কেন পুটু কোথায়? ও দেখছেনা?"
      " পুটু একটু দোকানে গেছে রে।"

  অনু মনে মনে ভাবে ওহ্ কিছু দুষ্টু হয়েছে এই ছেলে মা বাবা দুজনেই চাকরি করে।তারপর বাবা মাসের পর মাস বাড়ি থাকেনা। এই ছেলে একদম ইচ্ছেমত দুষ্টুমি করে বেড়াচ্ছে। এরপর তো বোনেরও হয়ত কোনদিন নিজের কিছু হবে তখন এই ছেলে সামলাতে তো হিমসিম অবস্থা।
        রবীনকে বলতেই রবীন বললো," ওহ্ কবে রাণু মা হবে ততদিনে জোজো বড় হয়ে যাবে। তুমি সামলাচ্ছোনা দুষ্টু আর মিষ্টিকে একসাথে। ও তো তোমারই বোন।তাছাড়া বাড়িতে আরো লোকজন আছে তো নাকি।"
     তবুও অনু একটু গজগজ করে," নিজেদের নতুন বিয়ে হয়েছে একটু কোথায় আনন্দ করবে।"

        "আনন্দ করছে তো,এই তো ঘুরে এলো আন্দামান থেকে। কত সুন্দর সুন্দর ছবি তুলেছে সেখানে। শুভর শখ আছে,তাছাড়া শহরের ছেলে তো। আমার মত গ্ৰামের মাস্টারমশাই তো নয়। বৌয়ের কোন শখ না মিটতেই লক্ষ্মী সরস্বতী এনে দিলাম।"
        রবীন হাসলেও অনু বোঝে রবীন সেদিনের মন কষাকষির সময় অনুর বলা কথাতে কষ্ট পেয়েছে।

           মুখ ভার করে অনু বলে," আমার তো সবেতেই দোষ,যাক যা ভালো বোঝে করুক ওর সংসার।
   দুষ্টু, মিষ্টি মেয়ে,আর মিষ্টি আমার খুব শান্ত যেখানে বলি সেখানেই বসে থাকে একদম লক্ষ্মী মেয়ে। ছোটটাই বড় দুরন্ত সব সময় জ্বালিয়ে মারছে।এই জল ফেলছে তো ঐ বই ছিঁড়ছে আবার কখনো মাটি মাখছে। দৌড়ে বাগানের দিকে চলে যাচ্ছে। উফ্ পারিনা মাঝে মাঝে।"

        ছোট মেয়ের সম্বন্ধে কিছু বললে ভালো লাগেনা রবীনের। অনু যে কেন এমন বলে! সবাই কি সমান হয়?
                   হয়ত অনু মিষ্টিকে বেশি ভালোবাসে বলেই রবীনের একটু বেশিই মায়া ছোট কন‍্যার জন‍্য। মায়েরাও পক্ষপাতিত্ব করে? আশ্চর্য লাগে রবীনের ঐ জন‍্যই ঠাকুমা বলতেন হাতের সব আঙ্গুল সমান হয়না।তেমন বোধহয় স্নেহেরও বিভাজন হয় কখনো সন্তানের বিদ‍্যায়,সৌন্দর্য্য অথবা তার ব‍্যবহারে।

         
***************
একটু একটু করে বড় হতে থাকে দুষ্টু,অনুর মধ‍্যেও একটা যেন অদ্ভুত পক্ষপাতিত্ব দেখে রবীন। মিষ্টিকে একটু বেশিই যেন ভালোবাসে অনু..সব ভালো জিনিস মিষ্টির জন‍্য আর যেটা পড়ে থাকবে তা দুষ্টুর।
     পুজোর বাজার করতে গিয়ে অনু বলে," এত জামা কিনছো কেন দুষ্টুর? দুদিন বাদেই তো ছোট হয়ে যাবে তখন কে পরবে?"

       " শোনো মিষ্টির জন‍্য  কিনছি তাই ওর জন‍্যও কিনলাম। যা আনবো সমান সমান,আমার তো দুই রাজকন‍্যা।"

     অনু মুখটা একটু ভার করে বলে," মিষ্টিরটা ছোট হলে দুষ্টু পরতে পারবে। আর ওরটা ছোট হলে তো সেই নষ্ট।"
        " নষ্ট কেন অনু? সেইদিনই ফুলমতিয়া এসেছিলো বলছিলো বাচ্চাদের জামাকাপড় থাকলে দিতে ওর নাতনিদের জন‍্য। ফুলমতিয়া আমাদের মালীর বৌ তুমি চেনো তো। আচ্ছা অনু ওরা পিঠোপিঠি বলে অসুবিধা সুবিধা দুই আমাদের হয়েছে মিষ্টির দোলনা,সাইকেল,জামা,সোয়েটার এমন কি কাঁথাগুলোও তো কাজে লেগে গেছে দুষ্টুর জন‍্য। আর খেলনা তো একটা নিয়েই দুজনে খেলছে। দুষ্টুর জন‍্য তেমন করে খরচ করলাম কই? তাই ভালোবাসাতে আর কিপ্টেমি করবোনা।"

*****************

                ওদের দুই কন‍্যা একজন ফুটফুটে ফর্সা আরেকজন শ‍্যামলা, একজন বাবার একটু বেশি আদরের আরেকজন মায়ের।একজন উত্তরা আরেকজন দখিনা। দুজনের স্বভাবে মিলমিশ না থাকলেও ভাব ভালোবাসা বেশ ভালোই আছে। তাই মা বড়জনকে কিছু হাতে দিলেই সঙ্গে সঙ্গে চেয়ে নেয়.." ও মা,দুষ্টুরটা দাও। শুধু আমাকে দিলে কেন?"
         অনু বলে," ও এসে দুবার খেয়ে গেছে কড়াই থেকেই এটা তুই খা। ওকে আটকানো কি সহজ কথা?কালচিনির প্রতিটা নুড়িপাথর বোধহয় ওর চেনা। সারাদিন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে চা বাগানে,কোনদিন চিতা এসে থাবা বসাবে। ওহ্ মেয়েমানুষ অথচ একদম দস‍্যিপনা চালাচ্ছে হাতে পায়ে।"
         " মা বোন যে এখানেই হয়েছে তাই এখানকার সব চেনা ওর। আমি তো বাকুড়াতে হয়েছি। ওর সঙ্গে চিতাদেরও ভাব হয়ে গেছে। সেবার যখন চিতা এসেছে সবাই বললো মনে আছে ও হাতে লন্ঠন নিয়ে দৌড়লো দেখতে। বাবা কি সাহস!"

       " পাকাবুড়ি ঠাকুমা একটা!
তুই আর তোর বাবা সব সময় ওকে আগলাস।তাই সারাদিন পড়াশোনা না করে পাড়া বেড়াচ্ছে আর দস‍্যিপনা করে বেড়াচ্ছে।"

       কোথা থেকে ছুটে আসে দুষ্টু,দুদিকের চুল খুলে ঝুলছে। কোঁকড়া চুল ঢেকেছে মুখের আর্ধেক," মা আমি শুধুই দুষ্টুমি করি? পড়াশোনা করিনা? বাবা তো বলেছে আমি দিদির চেয়েও ভালো অঙ্ক পারি।"
            অনুর একটু রাগ হয়,বাবা হয়ে মাথাটা খাচ্ছে,এসব আহ্লাদের কথা না? কেউ বলে তুই দিদির চেয়ে ভালো অঙ্ক পারিস?
       " শুধু অঙ্ক পারলে হবে? অন‍্য সাবজেক্ট ও ভালো পারতে হবে নাকি?"
          " করি তো মা,তুমি শুধু আমার দুষ্টুমিটাই দেখো।আমার নাম কেন রেখেছিলে দুষ্টু শুনি?"

         দিদির কাছে গিয়ে গলাটা ধরে ঝুলে পড়ে দুষ্টু।মিষ্টি এতক্ষণ বোনের বকবক শুনছিলো ওর সাথে কথায় পারবে নাকি মা। শেষে গরম খুন্তি নিয়ে তাড়া করবে। তার থেকে সামনের দেবদারু গাছের তলায় গিয়ে খেলা করাই ভালো।এতক্ষণে নিশ্চয় পুকু,কুট্টি আর রাহুলও এসে গেছে।

            "মা আমরা খেলতে যাচ্ছি",বলেই দৌড়লো দুই বোনে। অনু গজগজ করতে করতে হাঁক মারে," তাড়াতাড়ি ফিরবি কিন্তু স্নান করতে হবে এবার। হয়েছে এক হেডমাস্টার বর,যার ধ‍্যানজ্ঞান হয়েছে স্কুল।কোথায় গাছ লাগানো হবে? হস্টেলে কি হচ্ছে? ফুটবল খেলা,ফাংশান এইসব নিয়েই মেতে আছে।
     আর সময় পেলেই বসে মেয়েদের আহ্লাদ দেওয়া।"

               তবুও এই গজগজের মাঝেই ওরাই অনুর একটুকরো খোলা আকাশ আর সবুজের মিঠে বাতাস। সবেই মেয়েরা একটু একটু করে বড় হচ্ছে তারমধ‍্যেই তাদের জন‍্য অনেকবারই গর্বিত হয়েছে অনু। মিষ্টি ভীষণ ভালো নাচে শিখছেও তবে দুষ্টুর সেসব দিকে কোন উৎসাহ নেই ও দৌড়তে পারে হরিণের মত আর দিদিকে বলে," তুই তা থৈ তা থৈ করে নাচার আগেই একদম আমি এক দৌড়ে পৌঁছে যাবো। তালে তালে হাঁটা আমার ভালো লাগেনা।"
        তবে রবীনের সাথে কখনো হারমোনিয়ামে বসে গলা মেলায়," হারে রে রে রে রে আমায় ছেড়ে দেরে দেরে যেমন ছাড়া বনের পাখি মনের আনন্দেরে।"
       ব‍্যাস একটা লাইন গেয়েই লাফাতে লাফাতে ছোটে বারান্দার পাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া টিয়াপাখির ঝাঁক দেখে।
            " এই মেয়ে যা চঞ্চল,ওকে তুমি শেখাবে গান? ওর কিচ্ছু হবেনা। দিব‍্যি দিদিকে দেখে দেখে নাচতে পারতো।আমাদের বোনেরা তো এইভাবেই শিখেছি ছোটবেলায়।"

        রবীন আবার ছোটমেয়েকে বাঁচানোর জন‍্য আদরমাখা পিতৃত্বের অদৃশ‍্য ঢালটা বের করে," ছবি আঁকছে,কবিতা বলছে,পড়ছে,একটু আধটু গাইছেও। আর কত কি করবে বলতো এইটুকু মেয়ে? অনু আর কোনদিন ওর কিচ্ছু হবেনা যেন না শুনি।"
         অনুর খুব অভিমান হয় চোখটাও ছলছল করে," হ‍্যাঁ সবাই তো বলে তোমার ছোটমেয়ে বড় মেয়ের মত নয়। ও কত শান্ত আর লক্ষী,ছোটটা একদম দুরন্ত।"
                    অলক্ষ্মী কথাটা দুষ্টুকে মাঝে এক দুবার বললেও আর সাহস পেলোনা বলতে অনু।

             রবীন একটু গম্ভীর হয়ে বললো," সামনের সপ্তাহে একটা কাজে শিলিগুড়ি যেতে হবে।"
           " তাহলে রাণুকেও দেখে এসো একবার। অনেকদিন আসেনা। বেশ কয়েকবছর হয়ে গেলো মেয়েটার এখনো কোন খবর নেই। ঐ হয়েছে এক ভাসুরের ছেলে তাকে নিয়েই রয়েছে। ওর জা বেশ মানুষ করে নিলো ছেলেকে এই সুযোগে।"
          রবীনের আজকাল কেন যেন মনে হয় স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে ভীষণ অনু। অদ্ভুত সব কথা বলে। নিজেও সারাদিন সংসারে মেয়েদের ওপর খবরদারি করছে আর বোনের ওপরেও করছে।
           তবে ছোট শালী এরমধ‍্যেই চাকরি পেয়েছে এবং মা বাবার কাছে থাকবে বলেই কাছাকাছির
     কাউকেই মনের মানুষ হিসাবে পছন্দ করেছে, তার সাফ কথা.." সবাই উত্তরের সবুজের প্রেমে পলায়ে গেলে মা বাবাকে কে দেখবে?"

     রবীন হেসে বলেছে," ঠিক ঠিক,তুই থাক এখানে সবার প্রতিনিধি হয়ে।আমার আদরের সেই ছোট্ট শালীটাও বড় হয়ে গেলো।

    *******************
রাণুকে ফোন করে অনু বলতেই রাণু আহ্লাদে লাফিয়ে উঠলো," ও দিদি তোরা সবাই চলে আয়না,একদিন থেকে যাবি এখানে। কতদিন আসিসনা। আমারও যাওয়া হয়না শরীরের জন‍্য।"
       অনু জানে রাণুর একবার মিসক‍্যারেজ হয়ে গেছে। মেয়েটা একটু কাহিল হয়ে পড়েছে অথচ সবচেয়ে ছটফটে ছিলো রাণুই।মনটাও ভীষণ ভালো।
        " না রে সবাই মিলে যাওয়া হবেনা এখন। তোর জামাইবাবু একটা কাজে যাচ্ছে।"
            রাণুর ওখানে গিয়ে একটু অস্বস্তিই হয় অনুর অনেক লোকজন বাড়িতে।তারপর ওর বড় ভাসুর থাকলে সেই রবীনকে ডাকবে রাতে ওদের ঘরে সবাই মিলে গল্প আর তার সাথে ঐসব বিদেশী বোতলও অফার করে। যখন ফেরে তখন প্রচুর জিনিস নিয়ে ফেরে শুনেছে রাণুর কাছেই। আর ছেলেটা ঐসব পেয়ে পেয়েই দিন দিন বিগড়াচ্ছে। বাচ্চাদের চাই মা বাবার আদর আর শাসন তা নয় বাবার অভাব মেটাচ্ছে জিনিসে।
        ওপাশ থেকে রাণু বলে," ও দিদি তাহলে দুষ্টু মিষ্টিকে পাঠাস।"
        " নারে মিষ্টি তো মোটেই আমাকে ছাড়া থাকেনা তবে দেখি দুষ্টুকে। এই রে নাম নিতেই হাজির হয়েছে। কি রে মাসিমণি কি বলছে,যাবি?"
         " আমাকে দাও,আমি কথা বলবো। হ‍্যাঁ মণিমা আমি যাবো তো তোমার কাছে।"
            "ব‍্যাস আর কি,আমার আগেই কথা দিয়ে দিলো। দেখি তোর জামাইবাবু কি বলে? মনে হয় রাগ করবে।"
                     আসলে দুষ্টুকে ছোটবেলায় অনেকদিন বুকে নিয়ে ঘুমিয়েছে রাণু তাই ওর প্রতি একটু বেশি টান ওর।তাই আবার বললো," আমি জামাইবাবুকে বলবো তুই ওকে পাঠিয়ে দিস জামাইবাবুর সাথে। অনেকদিন দেখিনি।"

          দুষ্টুর মণিমার কথা ফেলতে পারেনি রবীন সত‍্যি বলতে সে নিজেও একটু বেশিই দূর্বল এই শালীর প্রতি। মেয়েটা ভীষণ ভালো আর সরল।ওর বিয়ের সবটুকুই ওর হাতে করা।তাছাড়া মেয়ে বিদায়ের সময় শ্বশুরমশাই বলে দিয়েছেন বার বার," তোমার কথাতেই অত দূরে দিলাম বাবা,একটু খোঁজ রেখো ছোটবোনের।"
        কথাটা খুবই মন ছুঁয়েছিলো রবীনের এখন যেন আরো বেশি মনে পড়ে কথাটা মেয়েদের বাবা হয়েছে তাই সে নিজেও বোঝে সমাজের নিয়ম মেনে হাতে করে যত্নে মানুষ করা কন‍্যাসন্তানকে অন‍্যের হাতে তুলে দেওয়া যে কি কষ্টের! কেন যে এমন নিয়ম সমাজে?

              তাই দুষ্টুকে নিয়েই যাওয়া,কথা হলো প্রথমে শালীর ওখানে দুষ্টুর শিরোমণি দুষ্টুকে রেখে দিয়ে তারপর কাজ সেরে ওখানে এসে রাতে থেকে পরের দিন ফিরে আসবে। ঐ দিনটা শঙ্কু আর পারুলের দায়িত্বে থাকবে মা আর মেয়ে তাছাড়া পাশেই তো অন‍্য মাস্টারমশাইরাও আছেন।
          বাবার সাথে এই প্রথম একলা যাওয়া দুষ্টুর,অনু তো ওকে বুঝিয়ে পাখিপড়া করলো," শোন যাচ্ছিস ভালো মণিমার বাড়িতে কিন্তু ওখানে গিয়ে কোন দুষ্টুমি করবিনা তাহলে সবাই কিন্তু বাজে বলবে। একদম ভালো ভাবে থাকবি।"
        বাধ‍্য মেয়ের মত মাথা নাড়ে দুষ্টু," ওমা দিভাই ও চলুক না আমার সাথে।"
       মায়ের আঁচলের কাছে এসে মুখ ঢাকে আঁচলে মিষ্টি," মা গেলে যেতাম, আমার রাত্রে কান্না পাবে।"
      মেয়েকে আদরে কাছে জড়িয়ে ধরে অনু দেখে দুষ্টুও গিয়ে মায়ের আদর খেতে মাকে জড়ায়।

           সারা রাস্তা বাবার সাথে কথা বলতে বলতে গেলো দুষ্টু। সবুজের সাথে ছোট্ট থেকেই বন্ধুত্ব ওর,আজ আরো কত কি দুচোখ মেলে দেখতে দেখতে গেলো আর বকবক করলো," আচ্ছা বাবা ঐ কুচকানো পাতাগুলো কি গো,ওপরটা স্প্রিং মত?"
       "ওগুলো ঢেকিশাক,পারুল এনেছিলো মনে নেই? আচ্ছা চল আমরা মুখে মুখে একটা ছড়া বানাই তুই একটা লাইন বল আর আমি একটা বলি।"
         কখনো ছড়ার খেলা আর অঙ্কের খেলা খেলতে খেলতে শিলিগুড়ি এসে গেলো।দুষ্টুর কাছে অনেক বড় শহর তাই অবাক হয়ে চারদিকে দেখে। রাণু তো দুষ্টুকে দেখেই জড়িয়ে ধরে," ওমা কতটা লম্বা হয়ে গেছিস তো? ইশ্ তোর চুলগুলো এমন করে কাটলো কে?"
       নালিশ জানায় দুষ্টু," মা কেটে দিয়েছে,চুল বাঁধিনা তাই।"
        শুভময়ও খুশি হলো রবীনকে দেখে," দাদা অনেকদিন বাদে এলেন।খুব ভালো হয়েছে।রাণুরও মনটা ভালো ছিলোনা অনেকদিন যায়না দিদির ওখানে।"
        ওদের কথার মাঝেই জোজো ছুটে আসে,জোজো মিষ্টির বয়েসী। এসেই দুষ্টুকে হাত ধরে নিয়ে যায়।রাণু সাবধান করে," সেবারের মত যেন মারামারি না হয়। তাহলে কিন্তু ও আর আসবেনা।"
      জোজো কিছু বলার আগেই দুষ্টু বলে," ও মারলে আমিও মারবো ওকে।"
               " নাও এবার সামলাও দুজনকে,আমাকে কিন্তু একটু বেরোতে হবে।"

    জোজো আর দুষ্টুকে সামলাতে রাণু জেরবার মাঝেমাঝেই ঝগড়া হচ্ছে দুটোর কেউ কম নয়। শাশুড়িমাও বলছেন," বৌমা এ দুটো তো একদম বুনো ওল আর বাঘা তেঁতুল।"
         জোজোর খেলনা দেখে অবাক হয়ে যায় দুষ্টু সারা ঘর ভর্তি কত খেলনা হাতে রিমোট নিমে বসে থাকলেই এরোপ্লেন ট্রেন বাস সব চলছে তড়তড়িয়ে। "এতো খেলনা,তুই কোথায় পেয়েছিস রে জোজো দাদা?"
  " সব বাবা এনে দিয়েছে বাইরে থেকে।বাবা যখন আসে তখন একদম বাক্সভর্তি খেলনা নিয়ে আসে। তুই নিবি একটা?"

     " না না এগুলো ছেলেদের খেলনা,আমি নেবোনা বাবা বকবে। আমাদের পুতুলের ঘর আছে সেখানে আমরা খেলি। মণিমা আর ছোটমিমি এলে তো ওরাও খেলে।"
      জোজো সাথে সাথে দৌড়ে গেলো," ও কাম্মা তুমি কি পুতুল খেলো গো? দুষ্টু বলছে।"

      রাণু হেসে বলে," আগে খেলতাম তখন ছোট ছিলাম তো,এখন আর খেলিনা।"
                      সারাটা দিন বেশ কেটে গেলো রাণুর ওদের দুজনকে নিয়ে সন্ধ‍্যের আগেই রবীন,শুভ আর জোজোর মা ফিরলো। বেশ জমজমাট বাড়ি,আর খাওয়াদাওয়া হলো জোরদার। রাণুর শাশুড়িমা নিজে রান্না করে অনেক কিছু খাওয়ালেন শুধু রাণুর হাসিটা একটু নিভু নিভু লাগলো রবীনের মনে মনে ভাবলো এবার একটা কিছু হোক মেয়েটার খুব বাচ্চা ভালোবাসে। রাতে দুটোই এসে রাণুর দুদিকে শুলো।শুভময় অনেক রাত অবধি রবীনের সাথে গল্প করে কাটালো।
       " তুমি বরং রাণুকে কিছুদিন আমাদের ওখানে রেখে আসতে পারো। ভালোবাসে তো আমাদের ওখানে থাকতে। একটু বিশ্রামও হবে।"
... রবীন বলে।
  " না মানে দাদা জোজো তো খুব দুষ্টু দেখছেন তো।বৌদি বাড়িতে থাকেনা,দাদাও ছমাস থাকেনা তাই ও চলে গেলে খুব অসুবিধা হয়ে যায় মা একলা হয়ে যায় একদম। দেখি দাদা যখন এখানে থাকবে তখন নাহয় কয়েকদিন গিয়ে থেকে আসবে।"
        রবীন হেসে বলে," নিজের অসুবিধাটাও বলো ভাই।"
    শুভময় হাসে,কিছু বলতে পারেনা।

     ****************
সকালে উঠেই রাণুর ছুটোছুটি শুরু," রবীনই বকা দেয়," এতো ঘরে ঘরে সব দিয়ে আসার কি আছে
          
    
       
             
             
      

                  
         

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...