Skip to main content

একটুকরো ছেঁড়া পাতা

#একটুকরো_ছেঁড়া_পাতা#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

হিন্দ সিনেমার কাছে নেমে হাঁটতে হাঁটতে যাওয়া কলেজস্ট্রীটের দিকে। এই রাস্তাটুকু কিছুদিন ধরে এভাবেই প্রতিদিন যাই আমরা হঠাৎ হওয়া কয়েক বন্ধু মিলে। ঐটুকু সময়ই বন্ধুত্বের এলোমেলো তাসের পাতা গুছিয়ে নিয়ে পথচলা আর টুকরো টুকরো কথা বলা কখনো বলি টুকরো কবিতাও। তারপর মতিউর আর সুমনা ঢুকে যায় মেডিক্যাল কলেজে আমি আর শঙ্খ ক‍্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে। আজ অবশ‍্য শুধু আমি আর মতিউর পা মিলিয়েছি, ওরা ঘরে বসে আলসে সকালে বোধহয় গরম কফিতে চুমুক দিয়ে জানলা দিয়ে আসা বৃষ্টির ছাটে কবিতা সাজাচ্ছে।

       মতিউর মেডিক্যাল কলেজে ঢোকার আগেই বললো," আজ একটু দাঁড়াবে ছুটির পর,বিশেষ দরকার তোমাকে। কয়েকটা বই কিনবো বুঝলে বিশেষ একজনের জন‍্য । তোমার পছন্দ ভালো তুমি পছন্দ করে দিয়ো।"
      অবাক হয়ে বললাম," আমি!সুমনা পছন্দ করলে ভালো হতনা? ও তো বেশ ভালো লেখালেখি করে।"
    " আসলে আজই বইটা লাগবে আমার। আর সুমনা বোধহয় দুএকদিন আসবেনা ওর মায়ের শরীরটা ভালো নেই। তুমিও ভালো লেখো,আমিও লিখি টুকটাক তাই ঠিক ম‍্যানেজ হয়ে যাবে।"

                   ছুটির পর বেরিয়ে মতিউরকে একটা ফোন করি,ফেসবুকের একটা লেখালেখি গ্ৰুপে আমাদের বন্ধুত্ব,তা প্রায় বছরখানেক ছুঁই ছুঁই হবে।এক রাস্তায় কাজ বলে এখন যাওয়া আসার পথে আড্ডা দিতে দিতে বন্ধুত্বের ঝালমুড়ি মেখে খাওয়া। আমার ফোন পেয়ে ও চলে আসে গলায় তখনো স্টেথো ঝুলছে.." বৃষ্টির মধ‍্যে তোমাকে আর আটকালাম না ফোন পেয়েই ছুটে চলে এলাম।"
             ভেজা ভেজা ট্রামলাইন ধরে একটু হেঁটেই মতিউরের পছন্দের বইয়ের দোকান।
 বেশ অনেকগুলো বই দেখার পর এটা নয় সেটা করে শেষে প্রায় হাফডজন বই কিনে ফেললো মতিউর।আর একটা পরিতৃপ্তির হাসি হেসে বললো," আহ্ ভীষণ পছন্দ হয়েছে বইগুলো, আমার বড়িবেগমের নিশ্চয় খুব পছন্দ হবে।"
            ওর মুখের দিকে তাকিয়ে একটু খাবি খেলাম আমি। এই যাহ্! আমি কে তা তো বলাই হয়নি,আমি তিস্তা। মনে মনে ভাবলাম বাবা ডাক্তারবাবুর তো গুণের শেষ নেই এর মধ‍্যেই দুই বেগম! বড়ি বেগমের কথা শুনলাম,নিশ্চয় ছোটি বেগমও আছে।
         আমার খাবি খাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে মতিউর ওর ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি সাজানো মুখটাতে একটা রহস্যময় হাসি মাখিয়ে বললো," কি হলো?"
        " মানে তোমার দুই বেগম নাকি? আগে তো বলোনি। তবে খুব বিদূষী মনে হচ্ছে তোমার বড় বেগম। তা ছোটজন কেমন?"

            " ছোটজন এখনো আব্বুর বাড়িতেই,বড়জনের মত আগে তৈরি হোক তবে আসবে বাড়িতে।"
                      ততক্ষণে মতিউর বলছে," একটু গিফ্ট প‍্যাক করে দিতে হবে।আমি পেপার এনেছি অলরেডি।"
       ওরা আপত্তি করেনা খুব একটা, মতিউর পকেট থেকে সোনালী ফাউন্টেন পেন বের করে লিখতে থাকে "আদরের বড়িবেগম বিজয়া জুলেখাকে.... বাদশা।"
          আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি,কিছু বলতে পারিনা,বইগুলো আরো সুন্দর হলো মতিউরের আদর মাখা মুক্তাক্ষর বুকে নিয়ে। 'ডাক্তারদের হাতের লেখা খারাপ', কথাটা যে কতটা ভুল তার প্রমাণ বোধহয় মতিউরের লেখা।

          দোকান থেকে বাইরে এসেও ছাড়া পাইনা পিঠের ব‍্যাগে টপাটপ ছখানা বই ভরে আমাকে নিয়ে সোজা উঠে এলো কফি হাউসে। এই বৃষ্টিতে এমন খোঁজাখুঁজি করে বই কেনার পর নাকি একদম সোজাসুজি কফি হাউসেই চলে আসতে হয়।
          যথারীতি কফি আর চিকেন স‍্যান্ডউইচে কামড় বসানোর ফাঁকে আমি নারীসুলভ কৌতূহল আর দমন না করতে পেরে বলেই ফেললাম," তোমার বড়িবেগম কি হিন্দু? কই কখনো ছবি দেখিনি তো ফেসবুকে?"
       মতিউর কফির ধোঁয়া ঠোঁটে জড়িয়ে বলে," সব কিছু কি ফেসবুক বলে? একদিন টুক করে চলে এসো আমাদের বাড়িতে। বড়ি বেগমের কথা তার মুখেই শুনবে,খুব সুন্দর কথা বলতে পারে বেগম, তোমার ভালো লাগবে মানে প্রেমেও পড়ে যেতে পারো। আসলে আজ বড়িবেগমের জন্মদিন তাই বইগুলো কিনলাম।"
         " ইশ্ আগে বলবে তো,আমিও তাহলে কিছু কিনতাম... আচ্ছা দাঁড়াও।"
        আমি আমার কাঁধের ব‍্যাগটা হাতড়ে গতবারের বইমেলায় বেরোনো আমার কবিতার বইখানা বের করি। নিজের মত কয়েকটা ছত্র তাতে লিখে মতিউরের হাতে ধরিয়ে দিই.." আমার হয়ে তুমি দিয়ে দিয়ো আর বোলো একদিন আসবো আলাপ করতে।"

        পরের দিনও যথারীতি শঙ্খ আর সুমনা অনুপস্থিত। নিম্নচাপের বৃষ্টি অঝোরধারায়  সেদিনও পড়ছে আমি আর হাঁটার রিস্ক নিইনি তাড়াতাড়ি ট্রাম থেকে নেমে দৌড়ে ইউনিভার্সিটি ঢুকি। দুপুরের দিকে মতিউর ফোন করে," আজ এসেছো?
    " হ‍্যাঁ এসেছি তো? আজ আর রিস্ক নিইনি একদম ট্রাম পেয়েই উঠে গেলাম।"

         " যাবার সময়ে অপেক্ষা কোরো আমি আজকে গাড়ি নিয়ে এসেছি তোমাকে লিফ্ট দিয়ে দেবো।"
           মতিউরের গাড়িতে উঠে বসলাম কিন্তু ও যে হঠাৎই এমন একটা প্রস্তাব দিয়ে ফেলবে বুঝতেই পারিনি।
     " বুঝলে বড়িবেগম তোমাকে দাওয়াত দিয়েছে আজই,বলেছে তোমাকে পেলে আজই ধরে আনতে।তোমার লেখা কবিতার বই পড়ে নাকি সে কাল রাতে ঘুমোতে পারেনি। কি করে লেখো এমন!"
          এত প্রশংসা পাবার পর আর না বলা চলেনা,যাক ভালোই হলো মতিউরের পর্দানসীন বড় বেগমকে দেখাও হয়ে যাবে।

****************
       গাড়ি এসে থামে চাঁদনীচকের একটা পুরোনো বাড়ির সামনে। বেশ বড় বাড়িটা,দেওয়ালে সুন্দর কারুকার্য করা। সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসি মতিউরের দেখানো পথে,বাড়িতে অনেক লোকজন। মতিউর আগেই বলেছে ওর বাবারা অনেকগুলো ভাইবোন আসলে তখন লোকে এত ফ‍্যামেলি প্ল‍্যানিংয়ের ধার ধারতোনা।
        মতিউর ওর আম্মার সাথে আলাপ করিয়ে দেয় তারপরে বলে,"চলো বড়িবেগমের ঘরে যাই।"
       আমি বুঝতে পারি সুন্দরী বৌকে দেখানোর তর সইছেনা মতিউরের।
      আমাকে বাইরে দাঁড় করিয়েই বলে," একমিনিট,দেখি বড়িবেগম সাজগোজ করেছে কিনা? নাহলে রেগে যাবে আবার।"

আমি মনে মনে হাসি,বেগমের ইমেজ নিয়ে খুবই কনশাস ডাক্তারবাবু। এত সুন্দরী বৌ যখন আবার দ্বিতীয় বিয়ে এই বয়েসেই?
           ততক্ষণে আমার ডাক পড়েছে ভেতরে। ঘরে ঢুকে আমি কেমন যেন মন্ত্রমুগ্ধের মত দাঁড়িয়ে রইলাম কয়েক মুহূর্ত, মতিউর বলছে "এই যে আমার বড়িবেগম আর বেগম এই হচ্ছে তিস্তা।"
                    আমি ঐ মুহূর্তে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলামনা।আর বুঝলাম ডাক্তারবাবুর সেন্স অফ হিউমার অত‍্যন্ত বেশি আসলে উনি ওর ঠাকুমা।

     বড়িবেগম অসাধারণ রূপসী,এখনো চোখ ফেরানো যায়না ওনার থেকে।বুঝতে বাকি রইলোনা ডাক্তারবাবুটি এখনো অবিবাহিত তবে ছোটিবেগমের চেয়ে বড়িবেগমের প্রেমেই এখনো মশগুল।
       " তুমি তিস্তা?আমিই বাদশাকে বলেছিলাম তোমাকে আনতে।কাল তোমার কবিতা পড়ে আমি সারারাত ঘুমোতে পারিনি জানো। তোমার ঐ দেশভাগের কবিতা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলো আমার ফেলে আসা মেয়েবেলায়। কাল চোখ দিয়ে অনেকটা জল পড়ে মনটা হাল্কা হয়েছে অনেকদিন বাদে।"
          আমি ছোটখাটো কবি,শখে লিখি এতোটা প্রশংসা পেয়ে কেমন যেন আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম। তবে ঐ স্বাধীন কবিতাটা আমারও খুব প্রিয়।
           তারপর ডুবে গিয়েছিলাম কথায় আর গল্পে বেশ অনেকক্ষণ। শুধু মাকে একটা ফোন করে বলে দিয়েছিলাম ফিরতে একটু রাত্রি হবে। বাবার কাছে শুনেছি আমাদের দেশের বাড়ি ওপার বাংলায়,নিজেকে পূর্ববাংলার মানুষ বলতে বেশ ভালো লাগে কিন্তু আমার। যদিও আমার যাওয়া হয়নি কখনো ঐ দেশে। তাই বড়িবেগমকে বললাম," বলোনা বেগম তোমাদের দেশের গল্প খুব শুনতে ইচ্ছে করে।"
   " সে তো অনেক কথা তিস্তাভাই,জানিনা সবটুকু হয়ত বলতেও পারবোনা। তবুও শুনবে তুমি?"
        " আমি শুনবো,তুমি বলো।"
     বড়ি বেগম বলতে শুরু করেন,ঢাকার বর্ণনা নিতাইগঞ্জ,নারায়ণগঞ্জ সব যেন চোখের সামনে ফুটে উঠছিলো আমার।

    বড়িবেগম বলে যাচ্ছে," বুঝলে তিস্তা গ্ৰামে বড় পুকুরওয়ালা বাড়িটা ছিলো আমাদের। গোলা ভর্তি ধান,গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা মাছ।কত বৌ ঝি আসতো স্নান করতে সেই পুকুরে, আমাদের ইঁদারা থেকে জল তুলে নিয়ে যেতো কত লোক। আমাদের দুর্গাদালানে দুর্গাপুজোতে সারা গ্ৰামের হিন্দু আর মুসলমানদের সে কি আনন্দ। আজো চোখ বুজলে সব দেখতে পাই।
             আমার মনে জমা প্রশ্নটা এবার আবার উস্কে উঠলো দুর্গাপুজোর কথা শুনে।ইতস্ততঃ করে জিজ্ঞেস করলাম," তোমাদের বাড়ি মানে ওখানেই তো দুর্গাপুজো হত? মানে তুমি কি হিন্দু?"
            " আমি মানুষ দিদি,আগেও তাই ছিলাম এখনো আছি। তবে আগে ধর্মে হিন্দু ছিলাম রে, আমার নাম ছিলো বিজয়া। দুর্গাপুজোতে বিজয়ার দিন হয়েছিলাম,মানে মা দুগ্গা জলে গেলো আর আমি এলাম তাই বাবা আদর করে নাম রেখেছিলেন বিজয়া। বড় আদরের মেয়ে ছিলাম রে বাবার। পনেরো বছর বয়েসে মাকে হারাই তারপর বিধবা পিসিমা আর বাবার আদরেই মানুষ। দেখতে দেখতে আঠেরোয় পা দিলাম।
      তখন তার আগেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেতো শুধু বাবাই পারেননি আমার পড়াশোনা ছাড়িয়ে বিয়ে দিতে। তবে বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিলো বাবার বন্ধুর ছেলে পাশের গ্ৰামের হরনাথকাকার ছেলে নৃপেন্দ্রের সাথে,সে বেশ কিছুটা বড় আমার থেকে। একবার সপরিবারে আমাদের বাড়ি এসেছিলো দুর্গাপুজোতে আর তখনইৎআমাকে পছন্দ হয় ওদের।"

      " তোমার পছন্দ হয়নি নৃপেন্দ্রকে? কেমন ছিলো সে? কথা বলোনি?"

           বড়িবেগমের ফর্সাগালে তখন রঙের ছোঁয়া চোখদুটো যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে.." কথা বলেছি তো,ভালো লেগেছিল তাকে।আমিই তো তাকে আমাদের বাড়ির চারপাশ ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলাম।" বড়িবেগমের চোখ জুড়ে স্বপ্নের ছোঁয়া আর আমার চোখ আর মন যেন সবটুকুই দেখছে। মন ছুটে চলে গেছে সুদূর ঢাকার গ্ৰামে দেখছে দুর্গাপুজোতে হিন্দু মুসলমানের মিলন। বিজয়ার সাথে নৃপেন্দ্রের না বলা চোরা চাউনির ছবি। আবিষ্টের মত বলি.." তারপর কি হলো?"

          তখন দেশ জুড়ে অশান্তি শুরু হয়েছে তার মধ‍্যেই আমাদের আশীর্বাদ হয়ে গেলো খুব ধুমধাম করে। আমার হবু শাশুড়িমা আমাকে চুনি,পান্না বসানো একজোড়া মোটা বালা দিয়ে আশীর্বাদ করলেন।ঠিক হলো আমাদের দুমাস বাদেই বিয়ে হয়ে গেলে সবাই এদেশে চলে আসবো। কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনায় বাবা বুঝতে পারলেন আর এখানে থাকা যাবেনা। মতিউরের ঠাকুর্দার বাবা আমাদের বাড়ির কাছেই থাকতেন আমি বলতাম রফিক চাচা আর রফিক চাচার ছেলে আজিজুল তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ছে।
                তারপর এলো সেই ভয়ঙ্ক‍র রাত,তার আগের দিন থেকেই অশান্তি শুরু হয়েছে আমাদের এলাকায় বাবাকে সবাই মানলেও বাবাও বিপদের আঁচ পেলেন। হঠাৎই এলেন রফিক চাচা জানালেন যে আমাদের আর ঠিক হবেনা ওখানে থাকা,কাল পরশুই যেন আমরা চলে যাই এখান থেকে।রফিক চাচা বাবাকে বললেন," চিন্তা করসনা আমি সব ব‍্যবস্থা কইর‍্যা দিমু। তোরা চইল‍্যা যা।"
     বাবা বললেন," কিন্তু বিজয়ার বিয়া তো সামনেই।"
       " আমি খবর পাইছি ওরা কালই চইল‍্যা গেছে কলকাতায়। তোরাও যা ওহানেই যা হওয়ার হইবো ওখানে গিয়া।"রফিক চাচা বললেন।
             সেই রাতে পিসিমা আমার হাতে সেই বালাজোড়া আরো কিছু গয়না পরালেন সারা গায়ে। বাবা শুধু টাকা আর গয়না গুছিয়ে নিলেন কিন্তু শেষ রক্ষা হলোনা। সেদিন আমাদের বাড়িতে আক্রমণ হলো,ওরা বাবাকে মেরে ফেললো সব ছিনতাই করলো,পিসিকেও ছাড়লোনা..উঃ কি নিষ্ঠুর! শুধু তার আগে আমাদের পেছনের দরজা দিয়ে বোরখা পরিয়ে পিসি আমাকে বের করে দিয়েছিলো। ভয়ে আতঙ্কে রফিক চাচাদের গোয়ালে এসে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। রফিক চাচা আর দেরি করেননি বোরখা আর কাঁচের চুড়ি পরিয়ে রাতারাতি আমাকে আজিজুলদা আর ওর চাচার সাথে রওনা করিয়ে দেন। আমি মুসলমানের বৌ এই পরিচয়ে অনেক চোখের নজর বাঁচিয়ে অনেক কষ্টে এ পাড়ে চলে আসি।"

           মতিউর অনেকক্ষণ ঘরে ছিলোনা,আম্মার সাথে এসে ঢোকে হাতে ড্রাইফুটস আর সরবত।বড়িবেগমের হাতেও দেয় এক গ্লাস।সরবতে চুমুক দিয়ে একটু শ্বাস নেয় বড়িবেগম।

        আমি বলি," তারপর কি হলো?"
    একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে বুক বেয়ে বলেন," তারপর বোরখার তলায় কতদিন কাটালাম আজিজুলদার বৌয়ের পরিচয়ে শরীরে আর মনে আধমরা হয়ে। মাঝে মাঝে হাহাকার করে কাঁদি।

       ভেতরে ভেতরে খোঁজ চললো আমার হবু বর আর শ্বশুরবাড়ির। চাচা আর আজিজুলদা বলতেন.." তোকে শ্বশুরবাড়িতে দিয়ে আসতে পারলে আমরা নিশ্চিন্ত।খুব খোঁজ করছি দেখি।" আমি যেন কেমন বোবা হয়ে গেছি সব হারিয়ে, মাঝে মাঝেই মনে হয় এই বড় দুনিয়ায় আমার কেউ নাই। বাবা আর পিসির কথা খুব মনে পড়তো।চোখের জল আর শুকাতোনা। আজিজুলদা এনে দিতে শুরু করলো বই একটু একটু করে বইরেই বন্ধু করলাম। পড়াটা হয়ে গেলো নেশা,দুঃখ ভোলার ঔষধ।"

          আমি আবার বলে উঠলাম," তোমার যার সাথে বিয়ে হবার ছিলো সে? তাকে পেলে?"

        " ছমাস বাদে তাদের খবর পেলাম দিদি,আজিজুলদা অনেক খোঁজ করে বার করেছিলো তাদের। একদিন আমাকে নতুন শাড়ি পরিয়ে গয়নায় সাজিয়ে আর হাতে বালাদুটো পরিয়ে নিয়ে গেলো ওদের বাড়িতে। আমার চোখে তখন কত স্বপ্ন আর আশা আমার হবু বরকে দেখবো ওরা আমাকে আপন করে নেবে। কিন্তু না.."
     " কি না?"
   "ওরা আমাকে দরজার বাইরেই রেখে দিলো আমার হবু বরকে দেখলাম এক ঝলক,কিন্তু ওরা তাকে বেরোতেই দিলোনা বাইরে।কড়া ভাবে বলে দিলো ওরা আমাকে কিছুতেই গ্ৰহণ করবেনা কারণ এতদিন মুসলমানদের বাড়ি থেকে আমার জাতধর্ম সব গেছে। আমি এখন মুসলমানের বৌ।
     আজিজুলদা চেঁচিয়ে বললো," যত্তসব বাজে কথা বলতেছেন। আপনেগো বাড়ির হবু বৌ বিজয়া যা ভালো বোঝেন তা করেন। এই আমি রাইখ‍্যা গেলাম।"
     ওরা দরজা বন্ধ করে দিলো মুখের ওপর,আজিজুলদা তখন একটু এগিয়ে গেছে আমি বালাজোড়া দরজার সামনে খুলে রেখে পাগলের মত রাস্তায় বেরিয়ে খুঁজতে থাকি আজিজুলদাকে। দেখতে পাইনা,মনে হলো আমার পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে গেলো।কোথায় যাবো আমি? কি করবো? হঠাৎই আজিজুলদা এসে হাতটা ধরে বলে," বিজয়া চল,যাবিতো আমার সাথে?আমি তো আছি ভয় কি?"
                  " তারপরই কি তোমার বিয়ে হয়ে গেলো ওনার সাথে?"
                বড়িবেগমের মাথা থেকে ওড়না খুলে পড়েছে কাঁচাপাকা চুলের কোঁকড়া গোছা মুখের চারপাশে মাধবীলতার মত ছড়িয়ে। মুগ্ধ হয়ে যাই আমি।
    বড়িবেগম বলে," বিয়ে কি এত সোজা কথা দিদি। আগে মন বুঝতে হয়,ছোটছোট অনুভূতিগুলোকে শ্রদ্ধা করতে হয়। আজিজুলদাকে যখন বাড়ির লোক আমাকে বিয়ে করতে বললো তখন ও বললো," জোর করে নয় বিজয়া যেদিন ভালোবেসে আমাকে বিয়ে করতে চাইবে সেদিনই হবে বিয়ে।"
        " তুমি ভালোবেসেছিলে?"
  " হ‍্যাঁ রে প্রথমে ওর এনে দেওয়া বই তারপর মানুষটাকে ভালোবেসেই তো এতোবছর কাটালাম। আজও তাকে শ্রদ্ধা করি।"
       দেওয়ালে টাঙানো ছবিটার দিকে চোখ যায় আমারও।
      " শুধু আমিই এক হতভাগা বছরের পর বছর বই দিলাম কিন্তু ভালোবাসা পেলামনা।" ঠাম্মার একদম কোলের কাছে এসে বসে মতিউর। আদর করে ওর মাথায় হাত বোলান বড়িবেগম।

     " সব নাতিনাতনির ছোট তো। খুব নেওটা আমার বাদশা।ছোট থেকেই বলতো আমাকেই বিয়ে করবে।"

       *****************
একটা ঘোরের মধ‍্যে রাস্তায় পা রাখি,মতিউর কিছুতেই ছাড়লোনা একদম গাড়িতে করে বাড়িতে পৌঁছে দিলোই। নামার আগে বললো," তিস্তা আমি সব জানি তুমি নৃপেন্দ্রকিশোর চৌধুরীর বাড়ির মেয়ে। ফেসবুকেই দেখেছি,তাই বড়িবেগমের অনুরোধে তোমাকে নিয়ে গেছিলাম আমাদের বাড়ি। আজ আর দুই পরিবারের মধ‍্যে কোন শত্রুতা নেই, হয়ত কিছু সম্পর্ক ওপর থেকেই তৈরী হয়ে আসে। আমাদের বন্ধুত্ব টুকু যেন বজায় থাকে আলুকাবলির ঠোঙার মত ফেলে দিয়োনা।"
        মতিউরের মুখে একটা মিষ্টি হাসি আমার মনে তখনও ইতিহাসে ডুব দেওয়ার ঘোর।ঠাকুরদার পুরোনো গল্পের ছেঁড়া পাতার সাথে বড়িবেগমের গল্পটা জুড়ে নিলাম। শুধু বলতে পারলামনা সেদিন আমার ঠাকুরদাকে ঘরে আটকে রাখা হয়েছিলো,সাতদিন তাকে বেরোতে দেওয়া হয়নি। আর সাতদিনের মধ‍্যেই সাত তাড়াতাড়ি মেয়ে দেখে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। তোমার ফেরত দিয়ে আসা ঐ চুনির পান্নার বালা ঠাকুরদা আমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন।চুপ করে কানে কানে বলেছিলেন," মায়ের কাছ থেকে ঐ বালাটা আমি আমার কাছে রেখে দিয়েছিলাম। তোকে দেখতে অনেকটা বিজয়ার মত তাই তোকে দিলাম। যত্নে রাখিস এটা।"
   আমি বলেছিলাম," তুমি বিজয়াকে ভালোবাসতে দাদু? তবে কেন দরজা ভাঙলেনা?"
      " বিজয়াকে যে বন্ধু করেছিলাম আর ভালোবেসেছিলাম। বন্ধুকে কখনো ছোট করতে নেই।জোর করে এই বাড়িতে আনলে সে অসম্মানিতই হত। আসলে তোর দাদু একটা ভীতু রে।"
             দাদুর সেই দীর্ঘশ্বাসের গল্প আজ আর বলা হলোনা বড়িবেগমকে। কিছু গল্প থাক না বলাই ছেঁড়াপাতার মুছে যাওয়া অক্ষরের মত।
সমাপ্ত:-
          
       
         

             

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...