#না_বলা_শাড়ির_গল্প#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
ছোটবেলায় আমাদের গ্ৰামের বাড়িতে যেতাম ক্যাঁচ ক্যাঁচ মোষের গাড়ি অথবা গরুর গাড়ি চেপে।গরুর গাড়ি ছিলো হাইস্পীড আর বর্ষার কাদা ভাঙতে আসতো মোষের গাড়ি...তাতেই আমরা উঠে বসতাম বলতে বলতে মোষের গাড়ি চললো আমার গ্ৰামের বাড়ি।
আমি সেই শিবরাম চক্কোত্তির বাড়ির আসেপাশেই এক গ্ৰামের মেয়ে গো। অবশ্য যখন গরুর গাড়ির গল্প করছি তখন আমি একরত্তি এক মেয়ে,মায়ের কোলের কাছে ছইয়ের ভেতর ঢুকেই গুটিশুটি হয়ে শুয়ে একটা বেশ ঘুম দিতাম। বাবা লম্বা মানুষ তার ছই থেকে মাথা বার করে বসতো গাড়োয়ানের পেছনে আর তার সাথে রাজ্যের গল্প করতে করতে যেতো। আমি জেগে থাকলে একবার সামনে আর একবার পেছনে মুখ বার করে দেখতাম।রাস্তার দুপাশে ধানের আর পাটের জমি, মাঝে মাঝে ডোবা তাতে চুপড়ি করে মাছ ধরছে ছোট ছোট ছেলেরা,কারো হাতে বা ছিপ। বাবা জিজ্ঞেস করতো," কি মাছ পেলু রে?"
ওদিক থেকে উত্তর আসতো "শাটি মাছ অথবা ছটো(ছোটো) পুঁটি গে।" আমাদের গ্ৰামের ভাষা এমনি,তবে আমার ঠিক আসেনা কিন্তু শুনতে ভীষণ ভালো লাগে।
চাঁচলে বাস থেকে নামলেই মায়ের মাথায় উঠতো ঘোমটা। কেজানে শ্বশুরবাড়ির কার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়,আমাদের জেঠুরা প্রায়ই আসতেন নানা কাজে সাইকেল নিয়ে চাঁচলে। মায়ের শাড়ি পরা মানে স্কুলে বা বাইরে কোথাও গেলে কুচি দিয়ে শাড়ি পরা আর বাড়িতে আটপৌরে শাড়ি।
আমাদের বাড়ি আসার আগেই সব জায়গার কথা বাবা বলতে বলতে আসতো," ঐ যে হাতিন্দার শিবমন্দির আমার ঠাকুরদার করা প্রণাম করো।" মায়ের মাথায় ঘোমটা হাতদুটো কপালে আমিও প্রণাম করতাম। আজও করি অভ্যেসে চেটেপুটে চোখ প্রাণ ভরে দেখি গ্ৰামের মায়া মাখা পথ,যদিও বাবা মা আর নেই। আরেকটু এগোলেই কয়েকটা গ্ৰামের পর আসে শীতলপুর, বাবা দেখাতো, "আমার হাইস্কুল এটা।"
যত গ্ৰামের কাছাকাছি আসতাম মা সচেতন হত ঘোমটার ব্যাপারে। গ্ৰামে ঢোকার মুখেই আমাদের মিল ছিলো,আমার জ্যাঠামণি সেখানেই বসে থাকতো প্রথম ওয়েলকাম জানাতে।আজও মনে পড়ে হাসিমাখা সেই মুখটা।
তারপরেই ছোটকাকুর প্রাইমারি স্কুল,কাকুকেও দেখা যেতো সেখানে।আমাদের দেখে হাত নাড়তো। বাড়ির সামনে বড় দরজা,সবাই অপেক্ষায় আমাদের আসার। সে এক দিন ছিলো..আলতা পরা পাদুটো মা চটিতে রাখতো গাড়ি থেকে নেমে।আমি কারো কোলে চেপে নামতাম। মায়ের পরনে তাঁত অথবা ছাপা শাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে দুর্গামন্ডপের দিকে হাত তুলে প্রণাম সেরে গেট পেরিয়ে বাড়িতে ঢোকা।প্রথমেই আমাদের গদিঘর,তারপর জেঠিমার ঘর আর ডানদিকে প্রতিষ্ঠিত গোপাল গিরিধারির মন্দির। মা বাবা ঠাকুর মন্দিরে প্রণাম করতো ঠাকুরকে,দেখাদেখি আমিও।
ব্যাগভর্তি তখন কত জিনিস,এক এক করে সবাই একজায়গায় হলে বাবা আর মা বের করতো শাড়ি ধুতি মিষ্টি পুজোর সময়। সেই ছাপা বা তাঁতের শাড়িতেই সবার মুখে আনন্দমাখা হাসির সুবাস। তারপর ঠাকুর ঘরের বারান্দায় বা রান্নাঘরের বারান্দায় বসে সবাই মিলে কত গল্প।
পুজো মানেই শাড়ি একটা দুটো যাই হোক কিন্তু সবার সাথে আনন্দ ভাগ করে নেওয়া। মাকে কখনো খুব ভালো শাড়ি পরে স্কুলে যেতে দেখিনি বলতো," গ্ৰামের স্কুলে পড়াই,সাধারণ মানুষের মাঝে সাধারণ ভাবেই থাকতে ভালো লাগে।"
বাবার পছন্দ করে আনা শাড়িই মায়ের পছন্দের শাড়ি ছিলো আমার খুব মনে পড়ে মা রাজকমলের ছাপা শাড়ি পরতো,পরের দিকে দেখেছি মিনু শাড়ি পরতে। পুজোতে একই রকম শাড়ি আনা হত বাড়ির সব বৌদের আর ননদদের জন্য,তাতেই ছিলো অনাবিল আনন্দ। বেশিরভাগ শাড়িরই জমি হয় সাদা,নাহলে ঘিয়ে অথবা তসর রঙের আর তাতে নক্সা।দেখে অবাক লাগতো আমি বলতাম," তুমি লাল,সবুজ,হলুদ এগুলো পরোনা কেন মা?"
" কালো মানুষকে এগুলো ভালো লাগে নাকি? তবে নীল পরি তো।"
ভেবেছিলাম আমি চাকরি করলে তোমাকে লাল,সবুজ,হলুদের সিল্কে সাজাবো। কিন্তু শাড়ির রঙটাও কেমন যেন মনের রঙের সাথে মিশে যায় তাই মা কিছুতেই নানা রঙে মন মেশাতে পারতোনা।তবে শাড়ির পাড়টা লাল থাকলেই হবে ঐ সব অ্যাবস্ট্রাকট কালার চলবেনা।
যখনই নিজের জন্য নতুন কিছু শাড়ি কিনতাম মায়ের জন্য ঠিক এক শাড়ি শুধু রঙটা মায়ের মনের মত দেখে কিনতাম। মা বলতো," ইশ্ এত ভালো শাড়ি কিনেছিস! কোথায় যাই যে পরবো?"
" কেন স্কুলে পরবে,কোন ফাংশানে পরবে।"
" স্কুলে সবসময় সাধারণ ভাবে গেছি তাই ওটাই অভ্যেস হয়ে গেছে।"
আচ্ছা তাহলে বাইরে বেড়াতে গেলে পরবে।
" ইশ্ এত ভালো ভালো শাড়ি পরে বাইরে বেড়াবো নষ্ট হয়ে যাবে তো।"
ন্যাতানো শাড়িতে তোমার আরাম লাগে,কড়কড়ে শাড়িতে গরম লাগে,এটা আর মানায়না, ওটা থাক পরে পরবো,এই শাড়িটা খুব সুন্দর তুলে তুলে পরি তাই। কত কথা এমন বলতে সারাক্ষণ।
বাবা চলে যাবার পর লালপাড়ের শাড়িগুলোতে হাত বুলিয়ে বলেছিলে," কত শাড়ি আর পরা হলোনা। পরে পরবো বলে মায়া করে রেখে দিয়েছিলাম।"
চোখের জল চেপে বলেছিলাম," লাল রঙটা বাবা এনেছিলো সাথে করে নাকি? যে নিয়ে গেলো ইচ্ছেমতো বাক্সবন্দী করে? যেটা ভালো লাগে পরবে আলমারি খুলে।"
আজ তুমি আর বাবা কেউই নেই। শূন্য ফ্ল্যাটে গিয়ে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে আলমারির তাকে তাকে দেখি আজও দল বেঁধে হাত ধরাধরি করে আছে শাড়িরা ধুতি পাঞ্জাবির পাশে পাশে। আজও ন্যাপথলিনের নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে ভাসে না বলা আর না পরা কত শাড়ির অসমাপ্ত গল্প।
#শাড়ি_কাহিনী#
#আমার_লেখনীতে#
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment