Skip to main content

স্বাধীনতা নিয়ে যান

#স্বাধীনতা_নিয়ে_যান#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

বজবজ স্টেশন থেকে নেমে হেঁটে সুদীপ্তর বাড়ি যাবার পথে থমকে দাঁড়ায় প্রতীম,অনেক দিন এই পথে আসা হয়নি অথচ একটা সময় প্রতিদিন ট্রেন থেকে নেমে দৌড়তে দৌড়তে যেতে হত স্কুলে,যদিও চাকরিটা পার্মানেন্ট ছিলোনা তবুও ছাত্রদের সাথে মনের আর হাতের মিল হয়ে গিয়েছিলো গত দুবছর। সবার প্রিয় হয়ে উঠেছিলো আঁকার স‍্যার প্রতীম।ওর শেখানোর গুণে কত ছেলের সাদা খাতায় আঁকা হত স্বপ্নের নীল আকাশে রঙবেরঙের তুলির আঁচড়। অনেকের অবাধ‍্য আঙুলগুলোকে বাধ‍্য করেছিলো শিল্পী হতে।
            তবুও স্কুলের চাকরিটা ছাড়তে হয়েছিলো প্রতীমকে সত‍্যিই অত কম টাকায় আর পারছিলোনা চালাতে।তারপর এতটা যাতায়াতের খরচ আর ক্লান্তি। স্কুল থেকে ফিরে আর ভালো লাগতোনা। তাই যখন বাড়ির কাছের একটা স্কুলে কম্পিউটার ছাড়াও আঁকা শেখানোর চাকরিটা পেয়ে গেলো আর ছাড়লোনা। এখানে মাইনেটাও অনেক বেশি তার পাশাপাশি বাড়িতে আঁকার টিউশন গুলোও করতে পারবে।
       প্রতীমের আঁকা ছবি কথা বলে যদিও ওদের বাড়ির অবস্থা খুব একটা ভালোনা তাই অনেক চেষ্টা করে এরমধ‍্যে একটা মাত্রই এক্জিবিশন করতে পেরেছে। বাবার হঠাৎই কোম্পানির চাকরিটা চলে যাওয়া তারপর অসুস্থতা ছোট ভাইবোনের পড়াশোনা সব সামলাতে গিয়ে কেমন যেন তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গিয়েছিল প্রতীম।
       তবে চাকরি ছেড়ে আসার দিনটাতে খুব মনটা খারাপ হয়েছিলো ওর কতগুলো কচিমুখের অসহায় চোখের চাওয়া অনেকদিন ভুলতে পারেনি," স‍্যার আপনি আর আঁকা শিখাবেন না? আমাদের তো অত পয়সা নাই যে বাইরে শিখবো।"
        ওদের কাছে গিয়ে ঘাড়ে হাত দিয়ে বলেছিলো,"নিশ্চয় অন‍্য কোন স‍্যার আসবে তোদের শেখাতে। তখন শিখতে পারবি ঠিক।"
        মন খারাপ হলেও কিছু করার ছিলোনা,সত‍্যিই আর পোষাচ্ছেনা ওর এত দূরে যাতায়াত এত কম টাকায়।
     হেডস‍্যারও বললেন," আমাদের ফান্ড পারমিট করছেনা,নাহলে হয়ত চেষ্টা করতাম।আসলে এরা সবাই খুব দুঃস্থ ভর্তির টাকা কোনরকমে দেয় তারপর তো সবই ফ্রী। তাতেও আর্ধেকদিন স্কুলে আসেনা।"
         প্রতীম জানে সেটা তবে ওর আঁকার ক্লাশ যেদিন থাকতো সেদিন ওরা সবাই আসতো ভালোবেসেই নতুন কিছু শিখতে।
     " আজ যেমন এসেছিস তেমন অন‍্যদিন আসিসনা কেন?মানে অন‍্য ক্লাসে?"

তাতে যা শুনেছিলো অবাক হয়ে গিয়েছিলো মনে হয়েছিলো নিজের ফেলে আসা একটা সময়ের কথা যখন ও খবরের কাগজ আর দুধের প‍্যাকেট বিলি করতো।মা সবার নজর বাঁচিয়ে ঠোঙা বানাতো,ব্লাউজের হুক লাগাতো।
      " স‍্যার অনেক ভোরে উঠে পেপার আনতে যাই তো তারপর বিলি করতে করতে অনেকদিন দেরি হয়ে যায়।" বলেছিলো সুমন।

সুমনের আঁকার কথা আজও ভুলতে পারেনা প্রতীম।ওর চলে আসার দিন কোথা থেকে দৌড়ে এসেছিলো হাতে একটা ছবি নিয়ে। সূর্যোদয়ের ছবি যে এত সুন্দর হয় ঐটুকু একটা ছেলের হাতের ছোঁয়ায় তা দেখে মনটা ভরে গিয়েছিলো।

       ওকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো," কি সুন্দর এঁকেছিস রে? আঁকাটা ছাড়িসনা কিন্তু কোনদিন।"

*********************
আজ স্বাধীনতা দিবসের ছুটির দিন তাই সুদীপ্তর বাড়ি আসছে প্রতীম ব‍্যাগে যথারীতি আঁকার সরঞ্জাম।সুদীপ্তর কয়েকটা ড্রয়িং করে দিতে হবে। অনেকদিন বাদে পুরোনো পথে পা রাখা।
               আর তার মধ‍্যেই থমকে দাঁড়ানো কিছুক্ষণের জন‍্য মনটা হারিয়ে গেছিলো হঠাৎই। পাশে রিক্সার হর্ণে চমক ভাঙে।বুকভরা একরাশ ব‍্যথা নিয়ে এগিয়ে যায় সামনের দিকে...ছেলেটা চিৎকার করছে," স্বাধীনতা নিয়ে যান....পতাকা,পতাকা,খবরের কাগজ।"
     কাছে গিয়ে প্রতীমের চিনতে একটুও ভুল হয়না সেই স্বপ্নদেখা চোখদুটো,ঠিক বুঝেছে এই তো সুমন। সুমনের দেওয়া সেই সূর্যোদয়ের ছবি আজও উজ্জ্বল ওর শোবার ঘরে কিন্তু সুমনের জীবনে এভাবে সূর্যাস্তের অন্ধকার নেমে আসবে ভাবতেই পারেনি। কনুই থেকে কাটা দুটো হাত নিয়ে ঘরে ঘরে স্বাধীনতাকে পৌঁছে দিতে চায় আজ সুমন। আবার কানে আসে সুমনের গলাটা..."স্বাধীনতা কিনবেন?"
     প্রতীম এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,"একদম বড় স্বাধীনতাটা কিনতে চাই,দাম কত?"

        প্রতীমের মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায় সুমন..." স‍্যার আপনি?"
            সুমনের ক্লান্ত চোখদুটোতে তখন একটার পর একটা ভেসে চলেছে ক‍্যানভাসের লাল,নীল,সবুজের স্বপ্ন। কিন্তু ঐ স্বপ্ন যে খবর বিক্রির তাড়াতে কবেই ট্রেনে কাটা পড়ে হারিয়ে গেছে।শুধু প্রাণটা বেঁচে গেছে কোনরকমে।

         সুমনের বাবার কাছ থেকে কিছুক্ষণের জন‍্য ওকে চেয়ে নিয়ে রিক্সায় ওঠে প্রতীম। সোজা চলে যায় সুদীপ্তদের বাড়িতে।
    সুদীপ্তকে বলে, " ভাগ‍্যিস আজ এসেছিলাম এখানে নাহলে তো দেখাই হতনা সুমনের স্বাধীনতা বিসর্জনের দৃশ‍্য। একটা মাদুর পেতে দে না ওকে।"

          প্রতীম সুমনের সামনে রঙ পেন্সিল আর কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলে," আজ স্বাধীনতা বেচার দিন নয় স্বাধীন হবার দিন। আঁকতো দেখি স্বাধীনতাকে মনের মত করে।"
         নিজের কাটা হাতদুটোর দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলে সুমন," আমি পারবোনা,স‍্যার।আমার  তো হাতই নেই।"
           "পা তো আছে? তাই দিয়েই কর,থামিসনা। তোকে করতেই হবে।"
      " পেন্সিলে পা দেবো স‍্যার?"

     " হ‍্যাঁ দিবি।হাত নেই তাই পেন্সিলে পা দিবি তবুও রঙ ছড়াবি জীবনে।"

            সুমনকে আড়ালে রেখে সুদীপ্তর আঁকাগুলোতে হাত দেয় প্রতীম,একটা একটা করে রঙ তুলির আঁচড়ে জীবন্ত করে ওগুলোকে।

        স‍্যারকে সামনে না দেখে সুমন কিছুক্ষণ হা করে বসে থাকে তারপর পায়ের আঙুলে শক্ত করে পেন্সিল ধরার চেষ্টা করে। প্রথমে পিছলে যায় পারেনা।চোখ দিয়ে জল গড়ায় তারপর আবার চেষ্টা...প্রতীম ঘড়িতে চোখ রাখে প্রায় একঘন্টা কেটে গেছে ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ায় সুমনের সামনে মাথা নিচু করে পা দিয়েই কাগজে ফুটিয়ে তুলেছে জাতীয় পতাকার ছবি অসামান‍্য রঙের বিন‍্যাসে।

           " সুদীপ্ত আমাকে কয়েকটা টিউশন দিতে পারিস ড্রয়িংয়ের? আমার অবস্থা তো জানিস, তাহলে সপ্তাহে একদিন করে আসবো সুমনকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাতে।"

      " আরে আমার বোনঝি আর ভাইঝি তো আছেই এছাড়াও আরো কয়েকজন ঠিক হয়ে যাবে।"
           কথাটা শুনে সুমনের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে," আমি আবার আঁকবো স‍্যার? আমি পারবো?"
       " নিশ্চয় পারবি,স্বাধীনতা যে বড় দামি তাই তাকে আগলাতে হয়। একদিন তোর আঁকা ছবি সারা পৃথিবী দেখবে।"

     সমাপ্ত:-

                
             
                    

        

         

       
                 

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...