রবীন দেখতে পায় সকাল থেকেই রাণুর ছোটাছুটি শুরু,সবার হাতে হাতে চা জলখাবার দেওয়া তারপর রান্নার তদারকি। রবীনই বকা দেয়," তোমার না শরীর খারাপ এত ছোটাছুটি করার কি আছে? টেবিলে সব রেখে সবাইকে ডাক দেবে। এত দৌড়াদৌড়ি করোনা।"
রবীন একটু অবাকই হয় দেখে ওর জাকে,বেশ সুন্দর সেজেগুজে ঘর থেকে বেড়িয়ে একদম চায়ের টেবিলে বসলো। তাহলে কি উনি চাকরি করেন আর রাণু গৃহবধূ বলে কোন বিভাজন আছে? নাকি রাণুই আগ বাড়িয়ে পারে বলে সবই করে। তবে সবটা ওর মাথায় ঢোকেনা অনু থাকলে বুঝতে পারতো। শুধু এটাই চাওয়া মনে মনে মেয়েটা ভালো থাক। বড় সরল,হাসিমাখা শালীটা ওর কোন কষ্ট যেন না পায়।
তারমধ্যেই জোজোকে খাওয়ানো,দুষ্টুকে খাওয়ানো রাণু যেন ডানায় ভর দিয়ে উড়ছে। রবীনের মনে হলো, রাণুর একটু বিশ্রামেরও দরকার। তাই শুভকে বলে গেলো," কয়েকদিনের জন্য ওকে রেখে আসতে কালচিনিতে।"
এর মধ্যে বেশ কয়েকবার জোজোর সাথে দুষ্টুর হাতাহাতি হয়ে গেছে অবশ্য সবটাই সামলেছে রাণু। নাহ্ দুষ্টুকে বা মিষ্টিকে এখানে না আনাই ভালো।একরাত্রি থেকে সেটাই মনে হলো রবীনের,সত্যি ছেলেটা বাবা মায়ের অনুপস্থিতির সুযোগে আর সবার আদরে একদম বাঁদর হয়ে গেছে। সন্তান মানুষের সময় প্রশ্রয়ের সাথে সাথে শাসনটাও জরুরী।তবুও অবাক হয়ে দেখে রাণুও অদ্ভুত প্রশ্রয় দিচ্ছে ঐ ছেলেকে।যখন খুশি কোলে ঝাপিয়ে পড়ছে অথবা কোলে উঠে পড়ছে। একটু বিরক্তই লাগে রবীনের, আসলে মিষ্টি দুষ্টু কেউই এমন নয় তবে দুষ্টু একটু মারকুটে আছে। ওকে কেউ কিছু করলে ছেড়ে দেয়না। রাণুর জা জোজোর হাত দিয়েই অনেকগুলো চকোলেট দেওয়ালো দুষ্টুকে। দুষ্টু বাবার দিকে তাকালো,ও জানে বাবা কারো কাছ থেকে দামি উপহার নেওয়া পছন্দ করেনা।
তবে রবীন সৌজন্যের খাতিরে খুব একটা কিছু বলতে পারেনা শুধু বলে," এতগুলো কেন?অভ্যেস খারাপ হয়ে যাবে।"
ওর জা বলে," কিছু হবেনা। ও নিলে আমাদের ভালো লাগবে।”
মণিমার বাড়ি থেকে ফিরে গল্পের ঝুড়ি খুলে বসে দুষ্টু।মিষ্টি চকলেট দেখে খুব খুশি হয়," ও মা এত চকলেট! আমি খাবো দে আমাকে।"
দিদিকে কয়েকটা দিয়ে হাতের মুঠোতে ভরে রাখে দুষ্টু সেই চকলেটটা যেটা ওর খুব ভালো লেগেছে খেতে। জোজোদা দিয়েছিলো ওকে।
মিষ্টি বলে," আমি এগুলো নেবোনা,তোর হাতে যেটা আছে সেটা দে আমাকে।"
" এটা আমি খাবো,তোকে তো অনেকগুলো দিলাম। তুই ওগুলো খা,সব সময় আমার জিনিস নিস কেন তুই?"
" আমি তোর জিনিস নিই? তুই তো আমার জিনিস নিস। আমার সব জামা তো তুই পরিস ছোট হয়ে গেলেই।"
অনু এসে বকে দেয় কিছু না বুঝেই দুষ্টুকে," এই জন্যই বারণ করেছিলাম যাসনা ওখানে। দিদিকে দে বলছি নাহলে খুব মারবো।"
" দিদিকে তো সব দিলাম, এটা আমার ভালো লেগেছে খেতে,আমি খাবো।"
মিষ্টি বলে ওঠে," মা দেখোনা।"
"উঃ আর পারিনা"..বিরক্ত হয়ে অনু দুষ্টুর হাত থেকে চকলেট প্রায় কেড়ে নিয়ে বলে," ভালো জিনিস ভাগ করে খেতে হয় দে ওকে। দাঁড়া আমি দিচ্ছি।"
রাতে অনু রবীনের কাছে অভিযোগ করে," এইজন্য রাণুর শ্বশুরবাড়িতে আমার ভালো লাগেনা ওদের ভীষণ বড়লোক ব্যাপার স্যাপার। আজ দুই মেয়ের কি ঝামেলা ঐ চকলেট নিয়ে।শেষে ভাগ করে দিয়ে ঝামেলা মেটালাম।"
" হ্যাঁ আমিও কিছুটা দেখলাম,রাণুকে একটু বেশিই পরিশ্রম করতে হয় সারাটা দিন। ছেলেটাও খুব দুষ্টু,সারাদিন ধকল নিচ্ছে মেয়েটা।বললাম এত কাজ না করতে। মেয়েটা বেশ রোগাও হয়ে গেছে দেখলাম। তবে দুষ্টুর পছন্দের সব জিনিসই মিষ্টিকে নিতে হবে এটাও ঠিক নয়। একটু একটু করে বড় হচ্ছে তো ওরা। এবার বোঝাও।"
" তাইতো ভাগ করে দিলাম,আর দুষ্টুকে তো তাই বলি বড় দিদি একটু বেশি নিলে ক্ষতি কি? তাতে কি বললো জানো? বললো ও নাকি আগে এসে সবই বেশি নিয়ে নিয়েছে। আর চিৎকার করে বললো..আমি কেন ওকে আগে পেট থেকে বের করিনি। তাহলে তো ছোট হয়ে ওকে থাকতে হতো না?"
রবীন হাসে," ঠিকই তো বলেছে দুষ্টু।অনু দেখো তোমার কাছে যেন ওরা বড় ছোট বলে অসম ভাগের অঙ্কে এসে না পড়ে তাহলে অনেকগুলো সংখ্যা বসবে দশমিকের পরে। ভাগটা সমানই কোরো।"
রবীন যে মাঝে মধ্যে অঙ্কের ভাষায় কি বলে বুঝতে পারেনা অনু। সারাদিনের সংসারের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে অনু রবীন ভাবে আরেকটু বেশি সময় দেওয়া দরকার মেয়েদের এবার। জালে ঘেরা বারান্দায় এসে দাঁড়ায় রবীন পেছনের চাবাগানটা সাদা চাঁদের আলোয় ধুয়ে যাচ্ছে। চিতাবাঘ মাঝেমধ্যে এসে পড়ে তাই মোটামুটি ব্যবস্থা করা আছে। মেয়েদের ঘরে একবার উঁকি দেয় দুটোই ঘুমোচ্ছে,দুষ্টুর হাতে জড়ানো গল্পের বই ভীষণ শখ মেয়েটার বই পড়ার। ওর হাত থেকে বইটা নিয়ে রেখে দেয়।
বেতের চেয়ারে বসে খুব গাইতে ইচ্ছে করে আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে। স্কুলের দায়দায়িত্ব আর সংসারের চিন্তায় আজকাল অনেক শখেই পলি পড়ছে সেই পলিমাটিতে আবার চাষ হচ্ছে নতুন কোন ইচ্ছের।নিজের জীবনের বেশ কিছুটা পথ পেড়িয়ে এখন চোখ রাখা উত্তরপুরুষের দিকে।
মাঝে মাঝেই মনে হয় ঠিকমত মানুষ করতে পারবে তো মেয়েদুটোকে। ওদের মনগুলোকে বড় করতে পারবে তো শিক্ষার আলো দেখিয়ে। একটু বেশিই ভাবতে হবে ওদের কথা দেখতে দেখতে দুষ্টুর ফোর আর মিষ্টির সিক্স হলো। দূরে কোথাও একটা ময়ূরের ডাক কানে আসে রবীনের গুনগুন করে গান গায় আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে।
*******************
মাঝে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা মাস,উত্তরবঙ্গের দুর্গাপুজোর আগে বর্ষার রিমঝিম বৃষ্টির ঝর্ণাকে একপাশে সরিয়ে আকাশে ভাসছে নীল নীল মেঘেরা দল বেঁধে। স্কুল থেকে এগিয়ে একটু দূরে গেলেই হাওয়াতে দোলা দেয় কাশফুলের বন।একদিন বিকেলে দুই মেয়েকে নিয়ে সাইকেলে করে রবীন গিয়ে দাঁড়ায় সেখানে.."
অনেকদিন বাদে হাতে ক্যামেরা নিয়েছে রবীন,একগোছা কাশফুল হাতে নিয়েছে দুষ্টু আপনমনে হাসছে মিষ্টি,"ও বাবা দেখো আচ্ছা কাশফুল শুধু এখনি ফোটে কেন গো?"
" সব বলছি আগে দুজনে একটু দাঁড়া তো একটা ছবি তুলি। মিষ্টি একটু হাস দেখি,দুষ্টু দিদির গলা জড়িয়ে গজদাঁত বার করে।"
রবীন দেখে মিষ্টির সাথে বেশ মাথায় মাথায় দুষ্টু,কে বলবে যে দুবছরের ছোটবড় দুজনে। বেশ কয়েকটা ছবি আজ তুললো রবীন অনেকদিন বাদে ক্যামেরায় উঠে এলো হাসিমাখা মুখে ছোট্ট দুগ্গাদের শরত মুঠোয় ধরার ছবি।
পুজোর আগেই নতুন জামাকাপড়ের নতুন গন্ধের সাথে এলো সুখবরের মিষ্টি গন্ধ। রাণু মা হতে চলেছে,অনু কপালে হাত ঠেকায়" মা তুমি বোনটাকে দেখো,যেন ও সুস্থ থাকে।"
ওপাশ থেকে উচ্ছ্বসিত হয়ে রাণু বলে," দুষ্টু কইরে? ও আমার কাছে আসার কিছুদিন পরই তো সুখবর এলো। তিনমাস শাশুড়িমা মুখ খুলতে দেয়নি তবে আর কতদিন বলতো? কি অদ্ভুত নিয়ম শ্বশুরবাড়িতে যা বলবে তাই মানতে হবে।"
" শোন ভালোই করেছিস,তবে খুব সাবধান তোর ঐ আদরের ছেলে যেন ঝাঁপিয়ে কোলে উঠতে না যায়।আমাদের মিষ্টির বয়েসী তো প্রায় তবুও তোরা বড় আদিখ্যেতা করিস ওকে নিয়ে। তোর ভাসুর আসছে বলছিস তো। এবার কিছুদিন সামলাতে দে ওদের ছেলেকে ওদের। তুই শরীরের যত্ন নিবি।"
" হ্যাঁ পুজোর আগেই তো দাদাভাইয়ের আসার কথা। দেখি কবে আসে। চিন্তা করিসনা আমি ঠিক আছি।"
অনু বাড়িতে ফোন করে রাণুর দায়িত্ব অনেকটাই ওর কারণ বাবার শরীরটা খুব ভালো যাচ্ছেনা।
পুজোর জামায় আর জুতোতে একদম সমান ভাগ করে রবীন। " মিষ্টি বোনের আর তোর এক রঙের জামা কিনি?"
অনু পাশ থেকে বলে," সে কি এক জামা কিনবে কেন? আলাদা হলে তো পাল্টে পরতেও পারবে?"
রবীন জানে বাড়িতে এসেই মিষ্টি বলবে কিছুক্ষণ বাদে বোনের জামাটাই ভালো ওরটা ভালো নয় তাই আগে থেকেই বললো। পিঠোপিঠি হওয়ার যে কি জ্বালা! ভাব আর ঝগড়া দুইই আছে বেশ।
*********************
পুজোর আগেই রাণুর ভাসুর এসেছে শুনেছে অনু। তবে রাণুর কেমন যেন মনে হয় দিদিভাই আর দাদাভাইয়ের মধ্যে একটা চাপা অশান্তি। বাথরুমে ওঠার সময় কখনো কখনো চাপা গলায় কথা শুনতে পায় একদিন দিদিভাইয়ের কান্নার আওয়াজ পেলো। শুভকে বলতে ও খুব একটা পাত্তা দিলোনা," রাণু,তুমি রাতে জেগে থাকো কেন? শরীরের কথাটা মাথায় রেখো। হয়ত কোন কারণে কিছু হয়েছে সব ঠিক হয়ে যাবে।
রাণু সকালে চা দিতে গিয়ে বুঝতে পারে আজকাল বোধহয় দাদাভাই একটু বেশিই ড্রিঙ্ক করে,দিদিভাইয়ের মুখের হাসিটা মিস করে। অফিসের বাইরে দিদিভাই অনেক বেশি চুপচাপ জোজোকে তেমনভাবে ওরা কেউই সময় দেয়না।
শাশুড়িমার শরীরটা তেমন ভালো নেই শ্বশুরমশাই কানে কম শোনেন ওরা একতলায় থাকেন ছেলে বৌদের ব্যাপারে মাথা ঘামাননা।
জোজোর দুষ্টুমি খুবই বেড়েছে ওকে সামলানো খুব মুস্কিল। রাণু আর পুটু হিমসিম খায়।রাণুকে ডঃ রেস্টে থাকতে বলেছেন। তাই বাধ্য হয়েই একদিন শুভই বৌদিকে বলে," জোজোকে তোমরা একটু দেখো বৌদি। দাদাকে বলতে পারিনা তেমন করে। অনেক দিন বাদে আসে কিই বা বলবে ছেলেকে ওর বোধহয় শাসন নয় একটু আদরের দরকার।"
কথায় কথা বাড়লো ওর জায়ের সব রাগ রাণুর ওপরেই পড়লো,নিজের ভেতরে জমে থাকা সব অভিমান অভিযোগ আছড়ে পড়লো," বুঝতে পেরেছি এখন রাণু কনসিভ করেছে তাই জোজোকে তোমাদের ঝামেলা মনে হচ্ছে। অথচ একটা সময় জোজোই ছিলো রাণুর অবলম্বন। ওকে তো ও নিজেই সামলাতো,আমি তো বলিনি।"
জোজোকে খুব মারে সেদিন ওর মা আর তারপরে লাগে স্বামী স্ত্রীর অশান্তি। দরজা বন্ধ করে বসে থাকে রাণু খুব কান্না পায়। জোজোর জন্য খুব খারাপ লাগে মনে হলো ওর জন্যই বেচারা মার খেলো। বৌদির আচরণে অবাক হয়ে গেলো শুভ। এত রাগ হঠাৎ করলো কেন বৌদি? রাণুর বাচ্চা হবে বলে? নাকি অন্য কোন কারনে?
পরেরদিন থেকে রাণুর সাথে ভালো করে কথা বলেনা ওর জা। জোজোকে ওদের ঘরে আসতে দেয়না একটা অদ্ভুত থমথমে পরিবেশ বাড়িতে। পুজোতে মা দুর্গা ফিরে যাবার সাথে সাথেই বিষণ্ণতায় ভরে ওঠে রাণুর মন।
বাড়ির এই দমবন্ধ পরিস্থিতিতে হাঁফিয়ে ওঠে রাণু মনে হয় বাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে গেলে ভালো। শুভকে বলতে শুভ রেগে যায়," নিজের বাড়ি থেকে ভয়ে চলে যাবে? কেন?"
তবে একটা সময় শুভ বুঝতে পারে রাণুকে আর এখানে রাখা ঠিক হবেনা।তবে পুরুলিয়া পাঠানোও ঠিক হবেনা। সবসময় যেন একটা ভয়ের মধ্যে থাকে রাণু এর প্রভাব ওদের সন্তানের ওপরেও পড়বে বুঝতে পারে।
দাদা বৌদির মধ্যে যে কোন তৃতীয় কেউ ঢুকে পড়েছে বুঝতে পারে শুভ।হয়ত দাদারই দোষ, কোন প্রলোভনে পা দিয়েছে।তবে ছেলেটা যে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ওরা কেউ ভাবছেনা!
***************
রবীনের সাথে কথা বলে শুভ," দাদা রাণু যদি কিছুদিন ওখানে থাকে,তাহলে কি খুব অসুবিধা হবে?"
রবীন বুঝতে পারে কিছু সমস্যা হয়েছে।অবশ্য একটু অনুর কাছে শুনেছে,যদিও রাণু খুব চাপা মেয়ে।
" আরে অসুবিধার কি আছে? আমরা সবাই চাই রাণু আসুক এখানে।"
দুষ্টু মিষ্টিও শুনে খুব লাফালো," কি মজা মণিমা আসছে।"
অনু ধমকায় দুটোকে," শোন মাসির ভাই হবে একটুও জ্বালাবিনা মাসিকে। তাহলে মাসি চলে যাবে কিন্তু।"
ওরা দুজনেই মাথা নাড়ে। দুষ্টু বলে ওঠে," মা ভাই কেন? বোন হলেই তো ভালো।"
অনু চোখ পাকায়।রবীন হাসে," ঠিকই তো বলেছে দুষ্টু বোন হলেই বা ক্ষতি কি? মানে ওদের দলটা ভারী হবে।"
অনুর মুখে কথাটা এলেও বলতে পারেনা তবুও বলে অন্য ভাবে," ওদের ভাইফোঁটা দেবার জন্য এবার কেউ আসুক।"
কয়েকদিন বাদে রাণু আসে,এত ভালো একটা খবর কিন্তু রাণু কেমন যেন মনমরা। ও নাকি আসতেই চাইছিলোনা এখানে, শুনে রবীন আশ্চর্য হলো। পাহাড়ি ঝর্ণার মত ছটফটে শালীটা যেন একেবারে মরা সোঁতার মত প্রাণহীন হয়ে গেছে।একেই রোগাপাতলা ছিলো এখন একদম চোখমুখ কোটরে ঢুকে গেছে মুখের হাসিটা উধাও। অনুকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মাথা রাখলো রাণু, দুইবোনই না বলা অনেকটা কষ্টে ভিজলো কিছুক্ষণের জন্য।
রাণুর শরীরে এখন টের পাওয়া যায় প্রাণের উপস্থিতি।দুষ্টু মাঝে মাঝেই মণিমার পেটে কান দিয়ে শোনে সেই শব্দ আর জিজ্ঞেস করে ভাই না বোন কি আছে।একটা ক্লান্ত হাসি হেসে রাণু বলে, "তোর কি চাই বল তাই আছে।"
অনুর শেখানো কথাই বলে দুষ্টু," আমি ভাই চাই,ভাইফোঁটা দেবো।"
রাণুর বুকটা কেঁপে ওঠে ঘরে বন্ধ করে জোজোকে মারধোর করার কথাটা মনে হয়। জোজোকে আজকাল দিদিভাই ওর কাছে আসতে দেয়না। জোজো একদিন বাইরে থেকে বললো.." মা এই ঘরে ঢুকতে বারণ করেছে। তুমি ভাই আনছো তাই আর আমাকে ভালোবাসো না।"
রাণু ছুটে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরতে যেতেই জোজো রাণুকে জোরে ধাক্কা দেয় ভাগ্যিস শুভ ছিলো তাই বেঁচে গেছিলো রাণু নাহলে কি যে হত ভাবলেই গা টা শিউড়ে ওঠে। তারপর থেকে আর তেমন ঘর থেকে বেরোয়নি রাণু জোজোও আর ওর কাছে আসেনি।কখনো অপরাধী মুখ করে দূর থেকে দেখে চলে গেছে। জোজো আজকাল আর সময় পায়না। ওর বাবা মা সারাদিন ওকে ব্যস্ত করে রেখেছে নানা কাজে। তবুও রাণু রাতে চাপা গলায় ঝগড়ার আওয়াজ পায়। দাদাভাই আর দিদিভাইয়ের অস্থিরতা,জোজোর পরিবর্তন কেমন যেন ভালো থাকতে দেয়না রাণুকে। কি যে হলো বাড়িতে! শুভর ওপর খুব রাগ হয়।ও কেন বলতে গেলো এইসব কথা?
*****************
রাণু একটু চাপা হলেও রবীন আর অনু কিছুটা জানতে পেরেছে।রবীন বলে," তুমি ভেবোনা রাণু সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমাকে ভালো থাকতে হবে যে আসছে তার জন্য। এরপর থেকে আমরা সন্ধ্যেবেলা একটু গান নিয়ে বসবো তোমার মন ভালো থাকবে। ওদের সন্তানের ভাবনা ওদের ভাবতে দাও।"
কি করে জামাইবাবুকে বোঝাবে এতদিন হাতে করে যে ও ছেলেটাকে মানুষ করেছে এখন হঠাৎই সেই ছেলে ওর কাছে আসনা। না জানি ছেলেটা কত কষ্ট পাচ্ছে। মনটা যেন ভালোই লাগেনা।
*******************
রাণুর যত্নের কোন ত্রুটি ওরা না করলেও রাণুর শ্বশুরবাড়িতে ডাক পড়লো তাই চলে যেতে হলো কারণ সাধ দেবে ওরা। অনুকেও যেতে হলো মেয়েদের নিয়ে।রাণু এখানে বেশ কিছুদিন থেকে অনেকটা স্বাভাবিক আর হাসিখুশি হয়েছে।অবশ্য দুষ্টু আর মিষ্টি দুজনেই সব সময় মণিমার কাছে ছিলো পড়া হয়ে গেলেই।
শ্বশুরবাড়িতে ঢুকেই রাণু কাউকে যেন খোঁজে। তবে ওর অবাক হওয়ার জন্য আরো কিছু বাকি ছিলো শাশুড়িমা বললেন জোজোকে নিয়ে দিদিভাই ওদের ফ্ল্যাটে চলে গেছে কিছুদিন আগেই।
শুভর দিকে তাকিয়ে অভিমান করে রাণু," আমাকে একবারও বললেনা কেন?"
" কি হত বললে? আমরা সবাই বলেছি ওরা শোনেনি। ওদের মধ্যে কিছু একটা সমস্যা আছে রাণু ওদেরটা ওদেরকে বুঝতে দাও। এত অশান্তি আর ভালো লাগছেনা।"
অনুরও খুব অস্বস্তি হয় এসে,অদ্ভুত একটা পরিস্থিতি। রাণুকে শুভ আর ও দুজনেই বোঝায়। দুষ্টুর মন খারাপ হয় জোজোর জন্য আগেরবার কত খেলেছে। অবশ্য জোজো দাদা খুব দুষ্টু বকে আর মারে তবুও ওকে অনেক চকলেট দিয়েছিলো। মিষ্টি আর দুষ্টুকে নিয়ে দুটো দিন কাটিয়ে বাড়ি ফেরে অনু। রাণুর জা সাধের দিনও এলোনা শুধু ভাসুর এসে রাণুকে একটা শাড়ি,আর মিস্টির বাক্স দিয়ে কিছু না খেয়েই চলে গেলো। অদ্ভুত হয়ে গেছে বাড়ির পরিবেশটা ওদের।
********************
মাঝে কেটে গেছে দুটো মাস শুভ ফোন করতে রবীনই চলে যায় শিলিগুড়ি কারণ মেয়েদের রেখে অনুর পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। একটু আগেই ডাক্তার ভর্তি করিয়ে নিয়েছে রাণুকে।
শেষ পর্যন্ত অনুর ইচ্ছেই পূরণ হলো রাণুর ছেলেই হলো। সবার মনেই খুশি,রাণুও হয়তো ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে অনেক কিছু ভোলার চেষ্টা করলো।তবুও মনে হলো বার বার জোজোটা থাকলে কত খুশি হত। তবে হঠাৎই মনে হলো সেদিনের সেই ধাক্কাটার কথা। থাক ওরা দূরেই থাক বাচ্চাটা খুব ছোট হয়েছে তবুও হাতদুটো মুঠো করে ওর দিকেই তাকিয়ে তাই ওকে এবার যত্ন করে বড় করতে হবে। জোজো নিশ্চয় ভালো আছে ওর বাবা মায়ের কাছে। দাদাভাই তো নিশ্চয় চলে গেছে এতদিনে।
*******************
মাঝে কেটে গেছে বেশ কিছুদিন রাণু এখন সত্যিই ব্যস্ত মা। ছেলে নিয়ে সারাদিন বকবকানি আর ব্যস্ততা।
জোজো বিহীন জীবনের ক্ষতটা মাঝে মাঝে খোঁচা মারলেও জয় কিছুটা ভুলিয়ে দিয়েছে সেই কষ্ট। অবশ্য এর মধ্যে দুএকবার জোজোকে নিয়ে দিদিভাই এসেছে প্রয়োজনে।জোজো আর তেমনভাবে যায়না রাণুর কাছে। রাণু কাছে ডাকলে বলে," এখুনি আমরা চলে যাবো খেলতে যাওয়া আছে আমার।"
" ভাইকে দেখবিনা? দ্যাখ তোকে দেখে কেমন হাত পা নাড়ছে।"
ওর জা অবশ্য কর্তব্যের ঘাটতি করেনি অনেক জামাকাপড় আর খেলনা দিয়ে গেছে। তবে কোথায় যেন সম্পর্কের মিস্টতা উবে গিয়ে একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে। রাণু জোজোর হাতে নাড়ুর কৌটোটা দেয়। জোজো ওর মায়ের দিকে তাকায় তারপর বলে," আমি খাইনা নাড়ু,ভালো লাগেনা।"
অবাক লাগে রাণুর একটা সময় নাড়ু খাওয়ার জন্য জোজো পাগল হয়ে যেতো। বুঝতে পারে রাণু জোজোও পাল্টাচ্ছে একটু একটু করে।শুভ আজকাল একটু বেশি বিরক্ত দাদা বৌদির ব্যবহারে তাই রাণুকে বলে," ভগবান যা করেছেন ভালোর জন্যই রাণু। এখানে থেকে জোজো খারাপ হলে তোমার ওপরেই দোষ পড়তো।তাছাড়া দাদার স্টেটাস এখন অন্যরকম এই পুরোনো বাড়িতেও হয়ত ওদের পোষাচ্ছিলো না।"
রাণু সহজ সরল মেয়ে সম্পর্কগুলো বাঁধতে চায় ভালোবাসার রঙে তাই ওর খারাপ লাগলো তবুও মেনে নিলো এই ভেবে যে যেখানে থাক ভালো থাক।
*****************
এদিকে দুষ্টু আর মিষ্টিও একটু একটু করে বড় হচ্ছে ওদের খুনশুটি রাগ আর ঝগড়া মাখা একদম খাট্টামিঠে জীবনের স্বাদ নিয়ে। অনুর মাঝে মাঝেই রাগ হয়ে গিয়ে আজকাল যেন একটু বেশিই চেঁচামেচি করে মনে হয় রবীনের।
স্কুলে যাবার আগে পাশের ঘরে অনুর চিৎকার শোনে রবীন," দুষ্টু খুব মার খাবি কিন্তু আজকাল খুব মুখে মুখে তর্ক করছিস কিন্তু।"
ওদিকে দুষ্টুর গলা শোনা যায়," আমি ছোট বলে সবাই আমাকে বকবে তাইনা? আমার মোজা দিদি পরেছে কেন? আমি দেখেছি এটা ওর মোজা,আমি পরবোনা এটা।"
" আচ্ছা দুটোই সাদা মোজা ও হয়ত ভুল করে পরেছে। আর তুই বা কি করে বুঝলি শুনি? আমার ভালো লাগেনা আর।"
অনু মিষ্টিকে ডাকতে গিয়ে দেখে সে মুখে দুষ্টু হাসি নিয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে।
রবীন এসে দাঁড়াতেই অভিযোগ করে দুষ্টু," বাবা ওর মোজার ইলাস্টিক ঢিলে তাই আমারটা পরেছে।আমি এটা পরবোনা।সবসময় ও আমার জিনিস নিয়ে নেবে কেন? আর ওর পুরোনো জিনিসই আমি নেবো কেন সবসময়?"
মেয়েকে বুঝিয়ে মোজা পরিয়ে স্কুলে রওনা করে নিজে বেরোয়। খারাপ লাগে যে ঘরে কোন বাড়তি মোজা নেই,থাকলে মেয়েটাকে দিয়ে দিতে পারতো। ফেরার সময় দুজোড়া মোজা হাতে করেই ফিরতে হবে ভেবেই নেয়।
হয়ত কাজের তাগিদে সংসারের প্রয়োজনের দিকে সবসময় মন দিতে পারেনা।আর অনু নিজেদের ছেলেবেলার মত এক জিনিসেই মেয়েদের বড় করতে চেয়ে হয়ত ব্যায়সঙ্কোচ করে ফেলে আর তাতেই হয় মনান্তর।
হয়ত আরেকটু বেশি নজর দিতে হবে এবার মেয়েদের ব্যাপারে এটাই তো অ্যাডোলেসেন্স পিরিয়ড তেমন করে হয়ত গুছিয়ে বলতে পারবেনা কিছুই রাগ আর অভিমানের পারদটা বাড়বে। অনুর হয়ত আরেকটু বন্ধুর মত মেশা উচিত মেয়েদের সাথে।কিন্তু সারাদিন পরিশ্রম করে ক্লান্ত অনু একটু বেশিই কঠিন হয়ে যায় কখনো সন্তানদের প্রতি আচরণে।কখনো দুএক ঘাও পড়ে যায় পিঠে। মিষ্টি বুদ্ধিমতী কম কথা বলে তর্ক করেনা,মায়ের ইচ্ছে অনিচ্ছা মেনে চলে। দুষ্টু অবাধ্য পাহাড়ি ঝর্ণার মত মাঝেমাঝেই অঝোরে ঝরতে থাকে আপন খেয়ালে। কখনো ঝগড়াতে কুটোকুটি হয় আবার কখনো বা ভাবে লুটোপুটি দুটোতে।
******************
মাঝে বেশ কয়েকবার পলাশের দেশে আনাগোনা হয়েছে ওদের দলবেঁধে। ওখানে গেলে মেয়েদের ভীষণ আনন্দ হয় কারণ ছোটমাসিরও বিয়ে হয়ে গেছে,মণিমা ওদের সাথেই আসে তার সাথে জয়। দাদু,দিদা,মামা,মামী আর ভাই। সবাই মিলে জোছনা রাতে অনেক গল্প আর আড্ডা। ওখান থেকে ফেরার সময় পলাশফুল নিয়ে আসে দুষ্টু বন্ধুদের জন্য আর কালচিনি থেকে যাবার সময় চা পাতা। সবুজের দেশের বন্ধুদের দেয় লালের ছোঁয়া আর লালমাটির দেশে পৌঁছে দেয় সবুজ পাতার বাহার।
কৃষ্ণর বৌ সুমায়া একদিন রবীনের সামনেই অনুকে বললো," তোমার দুটো মেয়ে কি সুন্দর হয়েছে গো দিদি। দুজনের একজন নাচে আরেকজন গান গায়। দেখতেও ভালো হয়েছে।"
অনু হেসে বলে," দুষ্টু ওর বাবার মত আর মিষ্টি..."
কোথা থেকে রাণুর ছেলে জয় দৌড়ে আসে," আমি কার মত?
সুমায়া বলে," তুমি তো রসগোল্লার মত মিঠা। আমাদের সবকটা ছেলেমেয়ে একদম মিত্তি।"
অনু আর রাণু দূরে থাকায় বেবি মানে ওদের ছোটবোন মা বাবার দেখাশোনা করে। তাছাড়া ওদের যৌথ পরিবার তাই কোন অসুবিধা হয়না। এছাড়া কৃষ্ণ তো আছেই,ও কাছাকাছি একটা স্কুলে চলে এসেছে। তাই এখানে এলে রবীনের সাথে চুটিয়ে আড্ডা চলে কয়েকদিন।
আর মাতোয়ারা হয় বোনেরাও সবাই সবাইকে
কাছে পেয়ে। বাড়ি তখন একেবারে চাঁদের হাট।
*****************
দুষ্টু মিষ্টির পরীক্ষা তাই ওরা তাড়াতাড়ি ফিরে এলো বেশিদিন থাকা হলোনা যথারীতি রাণুও চলে এলো ওদের সাথেই।
মিষ্টির ক্লাশ নাইন হবে আর দুষ্টুর সেভেন।রবীন এখন একটু নজর দেবার চেষ্টা করে দুজনের দিকেই কারণ ওদের সঠিক পথে পরিচালনা করাটা জরুরী। রেজাল্টে দেখা গেলো মিষ্টি সেকেন্ড হয়েছে দুষ্টু থার্ড। মায়ের কাছে এসে দাঁড়ায় দুষ্টু," মা আমি থার্ড হয়েছি এবার।"
ক্লাশ সেভেনে উঠতে থার্ড হলি,উঁচু ক্লাশে ওঠার সময় কি করবি?"
" কেন তখন ফার্স্ট হবো তুমি দেখো। আচ্ছা যদি ফার্স্ট হই তুমি আমাকে খুব ভালোবাসবে তো?"
" অনেক ভালোবাসবো। কেন এখন ভালোবাসিনা?"
" তাহলে এত বকো কেন?"
" তুই যদি ভালো করে পড়তি তাহলে ফার্স্ট হতে পারতি। দিদি উঁচু ক্লাশে উঠতে সেকেন্ড হলো।"
"সবসময় দিদি আর দিদি,ও শান্ত আমি দুষ্টু ও ফরসা আমি কালো।ও সেকেন্ড হয়েছে আমি থার্ড। ভালো লাগেনা একদম।ও ওর মত আমি আমার মত।"
দিদির মুখের সেই জিতে যাওয়ার হাসিটা দেখে আরো রাগ হয় দুষ্টুর। অনুরও রাগ হয় ওর তর্ক করা শুনে।বাইরে আওয়াজে বোঝে রবীন ফিরছে বাড়িতে তাই একটু সাবধান হয় অনু।
" কই দেখি আমার অনন্যা আর রাজন্যা কোথায়? আরে ছানার জিলিপি এনেছি তো।"
দুজনেই খুশি হয়ে বাইরে আসে। আর অনু যায় রান্নাঘরে।মনে মনে ভাবে আচ্ছা যে ভালো তাকে ভালো বলা কি ঠিক নয়? ছোটবেলায় তো ওকেও সবাই একটু বেশি আদর দিতো বাড়ির বড় মেয়ে বলে। অবশ্য রবীন এটা একদম পছন্দ করেনা তবুও অনু জানে রবীনের বেশি আদরের ছোটমেয়ে এমনকি রাণুরও।
নতুন বছরে মায়ের কথা শুনে একটু শান্ত হয়েছে দুষ্টু পড়াশোনাতে মন দিয়েছে বাবাও বুঝিয়েছে ওকে সকালে দৌড়তে নিয়ে যাবে কিন্তু তাই বলে সারাদিন দৌড়ে বেড়ালে চলবেনা। রবীনেরও আজকাল মনে হয় মেয়েরা বড় হচ্ছে তাই ইচ্ছেমত এদিক ওদিক না ঘোরাই ভালো।
নতুন বছরে ওদের ক্লাশ শুরু হয়ে গিয়েছে প্রায় চারমাস হঠাৎই একদিন শুভময় ফোন করে রবীনকে অনেকক্ষণ কথা হয় দুজনের। অনুরও অবাক লাগে,একটু চিন্তাও হয় এমন কি ঘটলো যে এতক্ষণ কথা বলছে ওরা! রাণুর বা ওর ছেলের কোন বিপদ হয়নি তো?
ফোন ছাড়ার পর অনু রবীনকে জিজ্ঞেস করে," রাণুর শরীর খারাপ হয়নি তো? বাড়িতে কিছু হয়েছে? কি গো?"
রবীন বলে," তেমন কিছুনা,তোমাকে পরে বলবো।"
অনু বুঝতে পারে কথাটা দুষ্টু আর মিষ্টির সামনে বলতে চায়না রবীন তাই আর কিছু বলেনা।
রাতে রবীনের কাছে শুনে অবাক হয়ে যায় অনু।জানলা দিয়ে হালকা চাঁদের আলো ঢুকেছে ঘরে কিন্তু অনুর মনটা কেমন যেন অন্ধকার হয়ে যায়। জানতে পারে শুভর দাদার ছেলে জোজো ভীষণ দুষ্টু মানে বাজে হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। বাবা মায়ের মধ্যের অশান্তিটা আর বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়াটা হয়ত ওর খারাপ হওয়ার পেছনে কাজ করেছে। এই বাড়িতে থাকতে রাণু আর পুটু সবসময় নজর রাখতো ওর ওপর।ঠাকুমাও নজর রাখতো। ঐ বাড়িতে গিয়ে মায়ের অনেকক্ষণ বাড়িতে না থাকা আর বাবার অনুপস্থিতিতে জোজো একটু একটু করে বিগড়েছে এই বয়েসে সিগারেট মদ সবই ধরেছে। স্কুলের পিকনিকে বাবার আনা দামি মদের বোতল নিয়ে যাওয়াতে ব্যাপারটা যে কোনভাবে জানাজানি হয়ে যায় এবং গার্জেন কল করে ওরা টি সি দিয়ে দিয়েছে জোজোকে।
"ঠিকই হয়েছে আমার বোনকে কষ্ট দিয়েছে কত ওরা।তারপর কি হয়েছে?" বলে অনু।
"অমন করে বলেনা অনু। এই নিয়ে শুভর দাদা বৌদির মধ্যে নাকি খুব অশান্তি।ওর দাদা নাকি বৌদির ওপরেই দোষ দিচ্ছে রাগ করে শ্বশুরবাড়ি ছাড়ার পরিণাম নাকি জোজোর এই অধঃপতন। ওর বৌদি এসে খুব কান্নাকাটি করেছে রাণুর আর শুভর কাছে।"
" আর কি রাণু আর শুভ নিশ্চয় গলে গেছে?"
" ছেলেটার কথা ভাবো অনু,একটা ভালো স্কুলে পড়তো এখন শিলিগুড়ির কোন স্কুলে ওকে ভর্তি নিতে চাইছেনা। বেশ কয়েকটা মাস হয়ে গেছে এখন ছেলেটার ভবিষ্যতের কি হবে?"রবীন বলে।
অনু এত বোকা নয়,এবার বুঝতে পেরেছে শুভ কেন ফোন করেছিলো..." ও তার মানে জোজোকে এখানে ভর্তি করতে চাইছে ওরা তাই তো? আর সেটাই শুভ বলছিলো তোমাকে?যেমন তুমি আর তেমন হয়েছে আমার বোকা বোন আর ওর ভালো বরটা। আমার ব্যাপারটা একদম ভালো লাগছেনা। সত্যিই তো ওর জা একটা সামান্য ব্যাপারকে এত বড় করে কত কান্ড করলো।ছেলের খারাপ হওয়ার জন্য ওরা দায়ী এখন শোধরানোর দায়িত্ব আমাদের?"
" অনু একটু ভাবো,কোথায় যাবে ছেলেটা এই পরিস্থিতিতে? ও তো মিষ্টির সাথেই পড়ে মানে নাইন এবার।"
" তুমি পারবে ঐ বখে যাওয়া ছেলেকে শোধরাতে? বাবা মদ খায় বাড়িতে বসে ছেলে আর কি করবে? ছেলেকে ভালোবাসা না দিয়ে পয়সা দিয়েছে। তারপর ঐ ছেলে এখানে এসে কি করবে কে জানে? তখন কিন্তু তোমার বদনাম হবে। সেটা ভেবে এগিয়ো।"
রবীন হাসে," এই এত বছরে তো কম ছেলে এই রবীন মাস্টারের মগজ ধোলাই যন্তরে পার হলোনা? দেখি যদি ছেলেটাকে একটু বদলে দেওয়া যায় ছুমন্তরে।"
অনু বুঝতে পারে রবীন ঠিক করে নিয়েছে কি করবে।এতদিন সংসার করে এটুকু বোঝে মানুষটা ভালো হলেও খুব জেদী অনেকটা দুষ্টুর মতই তাই আর তাকে বোঝানো যাবেনা।তাই নিজের মনটাকে বোঝায় অনু যাক তবুও রাণুর জা একটা শিক্ষা পেলো।মাঝের মাঝ ভুগলো ছেলেটা।
********************
প্রায় দিন পনেরো বাদে জোজোকে নিয়ে শুভ আর ওর বৌদি এলো ওদের বাড়িতে।অনেকদিন বাদে জোজোকে দেখলো অনু বেশ অনেকটা লম্বা হয়ে গেছে মাথায় দেখতেও বেশ ভালো হয়েছে।একটা ছেলেমানুষী মাখা মুখ অবাক হলো অনু এই ছেলে নাকি নেশা করে!
প্রথমে রাণুর জায়ের একটু জড়তা থাকলেও স্বাভাবিক হলো ধীরে ধীরে রবীনের সাথে কথা বলতে বলতে কান্নায় ভিজে গেলো ওর গলাটা," অনেকটা ভরসা করে এখানে আনলাম।মানে আমার উপায় ছিলোনা কোনো।শুভই বললো আপনার কথা।"
রবীন বললো," জানিনা ও মানিয়ে নিতে পারবে কিনা এখানে।তবুও খুব চেষ্টা করবো।তবে আপনার এখানে বেশি আসা হবেনা।আমি ফোন করলে আসবেন।"
*******************
উত্তীয় রায় মানে জোজোর জীবনের আরেক অধ্যায় লেখা হয়ে গেলো রবীনের কোয়ার্টারে বসে। রবীন অনুকে ডাকলো," তুমি একটু ওদের নিয়ে যাও গল্প করো চা দাও আমি জোজোর সাথে একটু গল্প করি। এই সময়টা দুষ্টু মিষ্টি বাড়িতে থাকেনা রবিবার ওরা নাচ আর গানের ক্লাশে যায় তাই রবীনের পক্ষে নিরালায় বসে কথা বলার সুবিধে হয় জোজোর সঙ্গে।
জোজোর মুখটা দেখে রবীনের মনে হয় ছেলেটা কেমন যেন একটু ভয় ভয় পেয়েছে। হয়ত ভাবছে ওর কাজকর্ম সব জেনে ফেলে রবীন হয়ত কিছু বলবে ওকে। জোজো মাথা নিচু করে বসে।
রবীন উঠে দাঁড়িয়ে ওর কাছে উঠে আসে," মা যা বলে বলুক,তুই থাকতে পারবি তো এখানে?
আমি জানতে চাই সেটা।
হ্যাঁ বলে হেরে গিয়ে ফিরে যাবিনা তো?
এখানে এসি নেই।
হস্টেলের ঘরে একসাথে চারজন করে থাকে।খাওয়ার পর থালা মাজতে হবে,নিজের জামাকাপড় কাচতে হবে।
ভোরবেলা উঠে প্রথমে প্রার্থনা তারপর ব্যায়াম তারপরে পড়তে বসা।
দুপুরে স্কুল, বিকেলে খেলাধুলা তারপর আবার প্রার্থনা তারপর পড়তে বসা।
অনেক সময় কারেন্ট থাকেনা তখন হ্যারিকেনের আলোতে পড়তে হবে কোন জেনারেটর নেই। সাথে বেশি টাকাপয়সা রাখা যাবেনা। বাড়ি থেকে ভালোমন্দ কিছু আনা যাবেনা,আনলেও ভাগ করে খেতে হবে।
পারবি তো থাকতে এখানে?ভেবে বল।"
কথাগুলো শুনে কেমন যেন ভেতরটা ফাঁকা আর গুলিয়ে ওঠে জোজোর।মন খারাপ আর রাগ দুটোই হয় নিজের ওপর আর মায়ের ওপরও। এত বিধিনিষেধ মেনে কে জানে কি করে থাকবে এখানে ও? পরমুহূর্তেই মনে হয় তাহলে কি করতো?
ভেবেই মনটা আবার খারাপ হয়,সত্যিই তো মা চেষ্টা করেছে অনেকগুলো স্কুলে। কি করে যেন সবাই জেনে গেছে ব্যাপারটা,কেউই ওকে নিতে চায়নি।
তাই একটু চুপ করে যায়।
হঠাৎই দরজার কাছে শুনতে পায়," জোজোদা তুই কত বড় হয়ে গেছিস,দেখ দিদি জোজোদাকে চিনতে পারছিস?"
জোজো ঠিক বুঝতে না পারলেও এটুকু বুঝতে পারে এরাই দুষ্টু আর মিষ্টি। দুষ্টু ওকে ছোটবেলায় দু এক ঘা লাগিয়েছেও মনে পড়ে জোজোর। তবে এখন আর চিনতে পারছেনা কে কোনটা। তাই মুখটা একটু বোকা বোকা করে তাকায় ওদের দিকে তবে একটু হাসি খেলে যায় ওদের দেখে।
কাম্মার জামাইবাবু মনে হচ্ছে খুব রাগী, তবে ওরা তো বেশ হাসিখুশি আছে অথচ এই বাড়িতেই থাকে বাবার কাছে। তাহলে ওর এত ভয় কেন, এই বছরে কোথাও না ভর্তি হলে পিছিয়ে পড়বে তাই বলে ফেলে," আমি পারবো মানিয়ে নিতে।মানে চেষ্টা করবো।"
রবীন ওর মাথায় হাত রাখে," এই যে চেষ্টা করবি বললি এটাই বড় কথা।চেষ্টাটাই তো আসল,চেষ্টার দ্বারাই সব সম্ভব হয়।"
দুষ্টু মিষ্টির সাথে আলাপ হয়ে যায় জোজোর অবাক হয়ে যায় শুনে জোজো ঐ লম্বুটাই নাকি ছোট ওর নামই দুষ্টু আর ফর্সা একটু গোলগোল পুতুল পুতুল দেখতে মিষ্টি। ওরে বাবা এ তো মেয়ে নয় পুরো গেছো হনুমান.. "এই জোজোদা তুই পেয়ারা খাবি? ঐ দ্যাখ আমাদের গাছে কত পেয়ারা।"
জোজো কি বলবে ভেবে মুখ খুলতে পারেনা।ও ঠিক সহজ হতে পারেনা ওদের সাথে কে জানে ওর সম্বন্ধে ওরা কি শুনেছে?
তার মধ্যেই অবাক হয়ে দেখে তরতরিয়ে গাছে উঠে পড়েছে দুষ্টু আর গাছের ওপর থেকে পেয়ারা পেড়ে ছুঁড়ে ফেলছে নিচে বলছে," দিদি ধর দেখি কেমন ক্যাচ ধরতে পারিস।"
রাণুর জা বাইরে এসে অবাক হয়ে গেছে ওদের দেখে।দুষ্টুকে গাছের ডালে ঝুলতে দেখে অবাক," ও ওখানে কি করছে দিদি?পড়ে যাবে তো?"
অনু ধমকায় দুষ্টুকে। রবীন মেয়ের কান্ড দেখে বলে," ওকে থাকতে দাও।বন্যেরা বনে সুন্দর আর দুষ্টু সুন্দর পেয়ারা গাছে।"
মিষ্টির সাথে জোজোর হাতেও পেয়ারা দেখে ওর মা অবাক হয়ে যায়। তুই খাবি পেয়ারা? বাড়িতে তো খাসনা?"
জোজো হাসে একটু লজ্জাও পায়। রবীন বলে," বাজার থেকে কিনে আনা পেয়ারা আর গাছ থেকে পেড়ে খাওয়াতে অনেক তফাত। দুদিন বাদে ও উঠবে এই গাছে। হস্টেল থেকে কত বাঁদর আসে এই গাছে ,বাঁদরীও।"
দুষ্টু ওখান থেকে "বাবা আমি বাঁদরী না"... বলে ডাক দেয়। শুভর জোজোকে দেখে একটু ভালো লাগে,এই কদিন তো ছেলে ঘর থেকে বেরোয়নি,কারো সাথে কথাও বলেনি। বৌদি ভয়েই অস্থির, দাদাও নেই।থেকেই বা কি হত?আরো অশান্তি হত,হয়ত জোজো আরো মারধোর খেতো।
সমস্ত কিছু বুঝে নিয়ে দুটো দিন সময় নিয়ে ওরা জোজোকে নিয়ে গেলো সাথে করে।কথা দিয়ে গেলো একটু সব গুছিয়ে দিয়ে আর যা যা লাগবে সব কিনে দিয়েই পাঠাবে।
ওদের যাবার সময় দুষ্টু আর মিষ্টি বললো," চলে আসিস কিন্তু দুদিন পরেই।এখানে কত কি আছে তোকে দেখাবো।"
ওরা যাওয়াতে অনু সব গুছিয়ে মেয়েদের তাড়া দেয় পড়তে বসতে। তারপর রবীনের কাছে এসে বসে বলে," হ্যাঁ গো আসবে ছেলেটা দুদিন বাদে? তোমার মনে হয়? কেমন যেন গোজ হয়ে বসেছিলো।কথাও তো বললোনা তেমন। রাণুরর জাকে দেখে খারাপ লাগলো কি সুন্দর দেখেছিলাম গো। কেমন যেন হয়ে গেছে।"
রবীন হেসে বলে," সুখের সংসারে যখন অসুখ বাসা বাঁধে তখন মোমের পুতুলও পোড়া কাঠ হয়ে যায়। আমাদের হয়ত তেমন টাকা নেই,বাড়িতে এসি নেই তবুও তো সারাদিন বাদে একটু ভালোবাসা বাসি আছে আবার মন কষাকষিও হয়। মেয়েদুটো আমাদের অল্প কিছুর মধ্যে আদরে শাসনে বাড়ছে। আসলে কি জানো জীবনে একটু অভাব থাকা ভালো তাহলে মানুষ পূর্ণতা খোঁজে। আর সম্পূর্ণতার পরেই আসে শূন্যতা।"
মাঝে মাঝে রবীনের কথা মাথায় ঢোকেনা অনুর তবুও আজ যেন পুরোটাই বুঝলো হয়ত একটু কম জানে আর কম বোঝে বলে ভালোও আছে।
" তুমি বললেনা তো ও কি আবার আসবে এখানে পড়তে? শুনলাম এখানে আসবেনা বলে জেদ করেছিলো খুব। বাড়িতে অশান্তি করেছে। শুভ বললো আমাকে। তারপর অনেক বুঝিয়ে এনেছে শুভ।"
রবীন হাসে," তোমার কি মনে হয়?"
"আমার তো মনে হয় আসবেনা। গিয়ে আবার ঝামেলা করবে।"
রবীন বললো," আমি বলছি ও আসবে। ও আমাকে কথা দিয়েছে।"
অনু ঠোঁট উল্টে বলে," ওর আবার কথার দাম? হয়ত এরপর ওর মা নিজেই ছাড়বেনা।"
রবীন বলে," ওদের হাতে আর কোন বল নেই। তাই মনে হয় আসবে। যদি আসে তাহলে সেদিন পোলাও আর কষামাংস হবে।হাট থেকে আনবো।"
অনু হাসে," উঃ সবটাতেই শুধু খাওয়া আর খাওয়া।"
" আরে আমার জন্য নাকি? ওদের জন্য করবে আমিও খাবো মানে সবাই খাবো।"
অবাক হয়ে যায় অনু আর রবীন ভেবেছিলো রাণু নিশ্চয় একটা ফোন করবে ওরা যাবার পর কি হলো বা কি করবে ওরা সেইসব জানিয়ে। কিন্তু রাণু কোনো ফোন করেনা।
" তুমি মাংস আনবো করে লাফিয়োনা বুঝলে। রাণুও যখন কোন ফোন করলোনা তখন নিশ্চয় ঐ ছেলের আর ওর মায়ের এখানকার স্কুল পছন্দ হয়নি।তাই লজ্জায় কিছু বলতে পারছেনা।"
রবীনের শালীর এই রকম আচরণে অবাক হলেও বলে," থাক ওরা ফোন না করলে তুমিও ফোন করতে যেয়োনা। নিশ্চয় যেদিন আসার কথা সেদিন কিছু জানাবে।"
তবে হাট থেকে রবীনের বেশ অনেকটা মাংস আনা দেখে একটু অবাক আর তার সাথে রাগও হলো অনুর।যদিও দুষ্টু আর মিষ্টি খুব লাফালো.." বাবা তুমি কত মাংস এনেছো! মা আমরা বেছে ধুয়ে দেবো।"
অনু বকুনি লাগায়," এই হয়েছে দুই গিন্নী আমার।মাছ মাংস ঘাটতে যে কি ভালোবাসে! কাল ওরা আসবে কিনা তার ঠিক নেই আয়োজন শুরু হয়ে গেছে আজ থেকেই।"
" শোনো বললেই তো সবসময় পাওয়া যাবেনা,আজ ভালো করে কষে রাখো। আজ অল্প খাই,কাল হবে। ওরা কাজ করে দিতে চাইছে তাতে রাগ করছো কেন? কাজ মানুষকে ভালো রাখে বন্ধন বাড়ায়,তাছাড়া উপকারও হয়। মায়ের কষ্ট বুঝতে শিখেছে এখন থেকেই এটাই তো ভালো।"
অনু বলে " ইশ্ কাজ না অকাজ করবে দেখো?"
" অকাজ করতে করতেই কাজ শিখবে।"
অনু আর কিছু বলতে পারেনা কারণ রবীন সুযোগ পেলেই রান্নাঘর দখল করে অনুকে বাইরে পাঠিয়ে।বলে ছেলেদের আর মেয়েদের কাজ আবার কি? সব কাজই সবার শেখা উচিত, পারার মধ্যেও একটা আলাদা আনন্দ আছে।
******************
রবীনের আব্দার তাই অনুকে প্রস্তুতি নিতেই হয়েছে।যদিও খুব চেয়েছিলো রাণুকে একটা ফোন করতে ওরা আসছে কিনা? রবীন দেয়নি বলেছে এলে আসবে না এলে আসবেনা।দরকার ওদের তাই ওদেরই জানানো দরকার তুমি ফোন করবেনা। রান্নাঘর থেকে পোলাওয়ের চাল ভাজার গন্ধ ভাসছে দুষ্টু আর মিষ্টিরও মনটা উড়ু উড়ু হঠাৎই ওদের কোয়ার্টারের সামনে গাড়ির আওয়াজ শোনা যায়। দুষ্টু মিষ্টি বাইরে ছুটে আসে,অনুও আসে।
গাড়ি থেকে রাণু,শুভ আর জয়কে নামতে দেখে ওরা অবাক হয়ে যায়। অনু বলে ওঠে..." একি তোরা? তোর জা আর জোজো কই? ওদেরই তো আজ আসার কথা।"
" দিদি আমি আসাতে খুশি হয়নি,দেখুন জামাইবাবু। খোঁজ করছে কাদের?"
" আমি কিন্তু খুব খুশি তাইতো মাংস বেশি করে এনেছি।"
অনু তবুও জিজ্ঞেস করলো," ওরা এলোনা? এখানে পড়বেনা তাইতো? আমি আগেই বলেছি আসবেনা।"
" ওরা আসবে অনু,তুমি ভেবোনা। তাই তো জোজোর যশোদা মা এসেছে।"
চোখে জলের লুকোচুরির সাথে সাথে আনন্দের হাসিও দেখা যায় রাণুর মুখে.." আপনি কি করে জানলেন?"
"হেডমাস্টারের বুদ্ধি দিয়ে,নিজের হেড আর মাস্টারের হেড দুটোকে একসাথে যোগ করলাম বুদ্ধি বেড়ে গেলো।"
রবীনের কথা শুনে সবাই হেসে ওঠে।
রবীন গেয়ে ওঠে," বলি ও ননদী আর দুমুঠো চাল ফেলে দে হাড়িতে। অনু চালটা আরো বাড়িয়ে দাও।"
******************
জোজোর বায়নাতেই আজ মা ছেলে ওদের গাড়িতে এলো রাণু আর শুভ এলো আলাদা। শুভ আর রাণু বুঝতে পারে ওরা মা আর ছেলে হয়ত কিছুক্ষণ একান্তে থাকতে চায়। এতদিন কখনো এভাবে ছেলে ছেড়ে থাকেনি মধুমিতা। স্বামীর বাইরে থাকাটা খুব একটা বুঝতে পারেনি প্রথমে শ্বশুরবাড়িতে থাকার জন্য আর পরে ছেলে আসাতে। সবার সঙ্গে হাসি মজাতে আর নিজের কাজ নিয়ে কতটা সময় যে কেটে যেতো বুঝতেই পারেনি।
যদিও শিলিগুড়ি থেকে এখানকার পথ বেশি নয় তবুও অনেকটা চোখের জল বয়ে গেছে হঠাৎই বাঁধভাঙা বৃষ্টির মত। জোজোকে শিকড়ছেঁড়া করে ইগো বজায় রাখতে অন্য বাড়িতে নিয়ে না গেলে এই দিন তাকে দেখতে হতনা। ভেবেছিলো ওর মনমত ভালো করে মানুষ করবে ছেলেকে। দেখিয়ে দেবে ও কি পারে? আসলে চ্যালেঞ্জের ঘুটি হিসেবে জোজোকে অবলম্বন করেছিলো, তাই ক্রিকেট কোচিং, গিটার,আঁকা,পড়াশোনা সব কিছু শেখার সময় ভাগ করে দিয়েছিলো।বুঝতেই পারেনি ঐ ভাগগুলো ঠিক হয়নি অত ভাগ করতে গিয়ে ঝালাইটা ঠিকঠাক হয়নি অতিরিক্ত জোড়া দিয়ে নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিলো। রাণু আর ওর শাশুড়িমা যেভাবে জোজোকে দেখতো মাইনে করা লোকেরা তা করেনি। আর দাম্পত্যের ফাঁকগুলোতে তালি মারতে নিজে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো যে তার ফাঁকেই বিগড়ে গেছিলো জোজো।
গতকাল রাতে অনেকদিন বাদে জোজো শুতে চেয়েছিলো ওর কাছে," মা আমি তোমার কাছে শোবো?"
অবাক হয়ে গিয়েছিলো শুনে মধুমিতা.. বেশ অনেকদিন জোজো ওর কাছে শোয়না।
" বেশ তো আয় আজ তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিই।"
ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সেই ছোট দুরন্ত জোজোর কথা বারবার মনে হলো।সত্যিই দিন যে কোথা দিয়ে চলে যায়।সেই জোজোই এখন মাকে ছাড়িয়েছে লম্বাতে। কোথাও কোথাও ছেড়ে আর ছাড়িয়ে দুটোই গেছে।
" ওখানে ভালোভাবে থাকিস। আমি কাকু কাম্মা সবাই যাবো তো।"
"মা বাবা আসবে তো?"
মনটা হারিয়ে যায়," আসবে বাবা,কালই তো বললো তোকে ভালো করে পড়তে।"
জোজো ঘুমিয়ে পড়লেও মায়ের চোখ থেকে ঘুম কেড়ে নিলো রাতের নিস্তব্ধতা। বারবার মনে হলো খুব একা হয়ে গেলো তবুও মানুষ হোক ছেলেটা।
অনেকটা সময় গাড়িতে মায়ের পাশে বসে পথঘাট চিনতে চিনতে এলো জোজো।মাঝে নেমে একটু দাঁড়িয়ে মন আর চোখকে তাজা করে নিলো সবুজের ছোঁওয়ায়।
বারবার আদর করে মা ছেলেকে কাছে টেনে নিয়ে ভালো হয়ে থাকার কথাই বললো। জোজো কেন যেন শুধু বলতে পারলোনা," তোমাকে ছেড়ে থাকতে খুব মন খারাপ হবে মা।"
ও জানে মা কষ্ট পাবে এটা শুনলে মাকে আর কষ্ট দিতে চায়না ও। সত্যিই ভাবেনি ওর জন্য মাথা নিচু করে মাকে স্কুলে দাঁড়াতে হবে বাবার কাছে হেনস্থা হতে হবে। কেন যেন সবসময় মনে হত ওকে কেউ ভালোবাসেনা। এই কদিন মা,কাকু,কাম্মা সবাই ওকে জড়িয়ে আছে।
*******************
গাড়ি এসে দাঁড়াতেই জোজো দেখে ততক্ষণে পেয়ারা গাছের তলায় বেশ কয়েকজনের ভিড়। এরাই বোধহয় সেই বাঁদর বাঁদরীরা তারমধ্যে জয়ও আছে। ওর হাতে ধরা পেয়ারা। হঠাৎই গাছের ওপর থেকে ধুপ করে একটা পেয়ারা ওর পিঠে এসে পড়ে চমকে ওঠে জোজো ওর কান্ড দেখে অনেকদিন বাদে মাকে হা হা করে হাসতে দেখলো জোজো। মাকে হাসলে ভীষণ ভালো লাগে।কতদিন বাদে মাকে এমন খুশি দেখলো।
" ঐ দ্যাখ গাছের ওপর কে বসে। তোকে ওয়েলকাম জানালো বোধহয়।"
জোজো ওপরে তাকিয়ে দেখে ওপরের ডালে বসে পা দোলাচ্ছে দুষ্টু।
একদল ছেলেমেয়ের কিচিরমিচিরের মধ্যে জোজোর পা রাখা এক নতুন শিক্ষাআশ্রমে। ততক্ষণে ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে কাম্মা আর কাকু।তবে জোজোর চোখদুটো খোঁজে হেডমাস্টারমশাইকে,ও ওর কথা রেখেছে তাই এসেছে এখানে। চেষ্টা করবে ভালো ছেলে হওয়ার।
"ছাত্র হওয়ার আগে একটা দিন আত্মীয়তার আদর দিলাম তোকে। এরপর কিন্তু আমি মাস্টারমশাই আর তুই ছাত্র।"
খাওয়ার সময় জোজোর কাঁধে হাত রাখে রবীন।
" কত কি রান্না করেছো গো! খুব ভালো হয়েছে খেতে।" রাণুর জায়ের কথার মাঝে অনু হেসে প্রশংসাটুকু মুঠোভরে নিলেও বললো," একটু যদি ফোন করতে তাহলে আরো একটু ভালো করে করতে পারতাম।"
" আমি তো দাদাকে বলেই গেছিলাম গো ঠিক আসবো দুদিন বাদেই।"
একটা দিন খুব ভালো করে কেটে গেলো। ওরা সেদিনের রাতটা থেকে পরেরদিন জোজোকে হস্টেলে রেখে ফিরবে শুধু রাণু থেকে গেলো ছেলে নিয়ে।
" আমি দুএকদিন থেকে যাবো,এত তাড়াতাড়ি যাবোনা।কতদিন বাদে এলাম।"
শুভ হাসে," এই এক মুশকিল একবার জামাইবাবুর বাড়ি এলে আর যেতে চায়না।"
ওরা যা বলেই হাসাহাসি করুক রবীনের বুঝতে বাকি থাকেনা ছোট বেলায় যেমন সন্তানকে স্কুলে দিয়ে মায়েরা বসে থাকে বাচ্চারা যদি কান্নাকাটি করে সেই ভয়ে। তাই হয়ত ওর জায়ের এখানে থাকতে সঙ্কোচ হবে এটা বুঝেই রাণু রয়ে গেলো এখানে জোজো হস্টেলে কেমন থাকবে দেখতে। অনেকদিন পরে সন্তান হওয়াতে প্রথম অপত্যসুখ জোজোর কাছ থেকেই পেয়েছিলো রাণু। তাই হয়ত সেই সুখটা আজও ভুলতে পারেনা রাণু।
*******************
যাবার সময় ছেলেকে বুকে জড়িয়ে মনকে শক্ত বাঁধনে বেঁধে গাড়িতে পা রাখে ওর মা। হয়ত এই শুরু ছেলে ছেড়ে থাকা অভ্যেসের। হস্টেলের দিকে পা বাড়ায় জোজো। একা একা বন্ধুদের সাথে থাকতে শেখা মিলেমিশে সবটাই ওর কাছে নতুন এক মন ফাঁকা করা অভ্যেসের শুরু। তাই হয়ত এক সময় একটু বেশি সাহসী হয়ে ওঠা জোজোরও আজ বুকটা দুরু দুরু করে। শুধু একটু ভালোলাগা মনের কোণে উঁকি মারে কাম্মাকে এখন দুতিনদিন দেখতে পারবে।
বছরের প্রায় চারমাস ক্লাশ শুরু হয়ে গেছে তাই অনেককিছু এগিয়ে গেছে। এতদিন জোজো তেমন কিছু শেখেনি মানে ওর অধঃপতন ওকে হয়ত শিখতে দেয়নি। তাই হস্টেলের ভালো ছেলে দীপ্তময়ের সাথেই ওকে রাখে রবীন।
দীপ্তকে দেখে অবাক হয়ে যায় জোজো..ছেলেটা কেমন যেন বোকা বোকা দেখতে ওর কাছে ওকে শিখতে হবে?
দীপ্তও একটু নার্ভাস হয়ে যায় জোজোকে দেখে এই ছেলেটার সাথে আমাকে থাকতে হবে। ওর নিজের অবস্থার সাথে ঠিক মেলাতে পারেনা ওকে। তবুও এগিয়ে এসে জোজোর হাত ধরে একটা পরম অবলম্বনে এগিয়ে আসে।
রবীন জোজোকে সবটা বুঝিয়ে ওকে ওখানে রেখে ফিরে আসে কোয়ার্টারে।রবীনের অনেক দায়িত্বের মধ্যে রাণু আর শুভর পরিবারকে একটু আলোর খোঁজ দেখাতে আরো একটা দায়িত্ব নিলো নিজের কাঁধে রবীন।
হয়ত একটু চাপ বাড়লো,তা বাড়ুক যদি সাফল্য আসে তার শেষে গুছিয়ে দিতে পারে একটা জীবন ক্ষতি কি?
****************
জোজোর প্রথম দিনের স্কুলের শেষে রাণু আর পারেনি ছুটে চলে গিয়েছিলো," কি রে কেমন লাগলো তোর নতুন স্কুলে?"
জোজো চুপ করে থাকে রাণু জানে জোজো কম কথা বলে। মাথা নাড়ে জোজো।
মাঝে কেটে গেছে কয়েকদিন তিনদিন থেকে রাণুও চলে গেছে বুঝতে পেরেছে জোজো মানিয়ে নিয়েছে মানে মেনে আর মানিয়ে নিয়েই হয়ত চলবে এখন থেকে।
তবে মাসখানেক বাদে রবীন একদিন জানতে পারলো লুকিয়ে এখানেও সিগারেট খাচ্ছে জোজো। দীপ্তকে জিজ্ঞেস করতে ও চুপ করে থাকে। বাড়িতে কিছু জানিয়ে ওর মাকে বিব্রত করেনা রবীন কারণ রবীন বোঝে ছেলের সমস্যার পেছনে সবসময় মা বাবা থাকেনা কিছু অভ্যেস ওরা নিজেরাই সঙ্গী করে নেয় বদভ্যাসের মত।
রবীন ডাকতে একটু ভয় পায় জোজো।
" একমাস আমি দেখবো,যদি আবার জানতে পারি এবার বাড়ি চলে যাবে। এবছরটা আর পড়তে হবেনা।"
অদ্ভুত এক শাস্তি হয় জোজোর,দশটা গাছ ওকে লাগাতে হবে প্রতিদিন যত্ন করতে হবে সকাল বিকেল গাছে জল দিতে হবে। গাছগুলোকে বাঁচিয়ে রেখে বড় করতে হবে।
একমাস পরে রবীন দেখবে গাছগুলো বেঁচে আছে কিনা অথবা কত বড় হলো। প্রাণপন গাছগুলোকে যত্ন করে জোজো কিন্তু বাঁচাতে পারেনা সব গাছগুলোকে চারটে শুকিয়ে যায়। অদ্ভুত এক মনখারাপ হয় ওর।কি জানি মাস্টারমশাই কি বলবেন।
" এ কি চারটে গাছ বাঁচেনি কেন? এগুলো মরলো কেন? নিশ্চয় যত্ন করোনি?"
" আমি যত্ন করেছি খুব তবুও বাঁচলোনা।এত খারাপ লাগছে! কেন যে বাঁচলোনা?"
রবীন ওর কাঁধে হাত রেখে বলে," তুই যেমন ঐ গাছগুলোকে যত্ন করে বাঁচাতে পারলিনা তোর কষ্ট হলো আমাদের মাস্টারমশাইদের আর মা বাবাদেরও তেমন কষ্ট হয় যখন ছাত্র বা সন্তান খারাপ হয়ে যায়। তুই ভাবিসনা আরো চারটে গাছ দিয়ে পাঠাবো এবার নিশ্চয় বেঁচে যাবে।"
দীপ্তকে যতটা বোকা ভেবেছিলো জোজো ওর সাথে কথা বলে ওর ভালো লাগে ওকে বন্ধু বলে মনে হয় বুঝতে পারে অনেক নাকে হ্যাঁ করে দিতে পারে এই ছেলেটা। তাই বছরের শেষে যখন গাছে ফুল ফুটলো হাতে মার্কশীট আর মুঠোতে কিছুটা সাদাফুল নিয়ে দাঁড়ায় জোজো। রবীন যদিও আগেই রেজাল্ট জেনেছে তবুও ওর হাতের ফুলটা আজ যত্নে কাঁচের বাটিতে সাজিয়ে বলে," এই তো গাছে ফুল ফুটেছে। আঃ কি মিস্টি গন্ধ!
তোকে দেখেও আমার তাই মনে হচ্ছে।"
অনুর সাথে দুষ্টু মিষ্টিও এসে দাঁড়ায়।
" অনু ছানার জিলিপি আর রসগোল্লাটা নিয়ে এসো। ওদেরকে খেতে দাও।"
জোজোর হাত থেকে বিজ্ঞের মত মার্কশীটটা নেয় দুষ্টু ," বেশ ভালো করেছো তবে অঙ্কে আরেকটু ভালো করতে হবে।"
মিষ্টি হাসে," ওর কথায় কিছু মনে করিসনা, নিজে অঙ্কে একশো পায় তো তাই সবার ওপর খবরদারি করে।"
জোজোর মনে খুশির ছোঁয়া অনেকদিন বাদে বাড়ি যাবে। বাবাও আসবে কদিন বাদে।
Comments
Post a Comment