Skip to main content

স্বপ্নের বেনারসী

#স্বপ্নের_বেনারসী#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

আকাশ জুড়ে নীল মেঘের আল্পনা তার মাঝে সাদা ফটফটে ভেলায় চড়ে লালটুকটুকে বেনারসী পরে জগৎ আলো করে আসছেন মা দুর্গা সাথে লক্ষ্মী সরস্বতী আর কার্তিক গণেশ।
          একচালাতে ঠাকুর হবে দেশের বাড়িতে মনে খুশির ছোঁয়া সবার। গ্ৰামের বাড়ির উঠোনের শিউলিগাছে পড়েছে ফুলের পায়ের ছোঁয়া,আর মাঝে মধ‍্যেই পা পিছলে পড়ছে টুপটাপ মাটিতে ঝরে।
                       দুগ্গাদালানে সিধুজেঠু সিংহের মুখে মাটি লাগাতে ব‍্যস্ত। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই দেখার জন‍্য একছুট, হাতে মাজন নিয়ে বাসি মুখেই। কতটা এগোলো কাজ তা দেখা অবাক চোখে, আর তো কদিনই বাকি। হয়ত শিবঠাকুরের সাথে ঝগড়া করে উমাও মায়ের আদর খাবার জন‍্য ছানাপানা নিয়ে রওনা দিয়েছেন।
                  পুজোর গন্ধে ভরে উঠেছে সবেই মনটা। হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে যায় হায়দ্রাবাদের সাততলার পিজিতে নিজের ছোট্ট বেডে শুয়ে থাকা ময়ূরীর। মনটা খারাপ হয়ে যায় ইশ্ কি সুন্দর ডুবে ছিলো স্বপ্নের ঘোরে। মাত্র কয়েকমাস আগেই চাকরি নিয়ে বাড়ি ছেড়ে আসা মনের প্রতি কুঠুরিতে খুব বাড়ি বাড়ি গন্ধ জানেনা পুজোতে এবার বাড়ি যাওয়া হবে কিনা?
                          মা ফোন করলেই বলে," আসবি তো পুজোতে? কতদিন দেখিনা তোকে।"
                        " হুঁ চেষ্টা করবো মা যাবার। দেখি ছুটি পাই কি না?"
                           হায়দ্রাবাদের আকাশের মেঘ গুলো কেন যেন ঠিকঠাক পুজো আসছের উড়োচিঠি নিয়ে আসেনা। তবুও মাঝে মাঝেই আনমনা হয়ে যায় ময়ূরী," বাবা ঠাকুরের কাঠামো  হলো,কতটা হয়েছে বাবা? সিংহের মুখে মাটি লেগেছে?"

                  বলেই অন্য কথায় চলে যায় ময়ূরী। ও জানে ওদের আর্থিক অবস্থার জন‍্য এখন বাবা পুজোর খরচ তেমন দিতে পারেনা বলে পুজোতে আর তেমন কিছু করতেও দেওয়া হয়না ওদের।

                   কিন্তু মা তো সবার,তাই মাকে আদর করে মনে জড়িয়ে নিতে পারে সবাই।সেখানে উঁচু নিচু কোন ভেদাভেদ নেই। ছোটবেলায় মাঝে মাঝেই ডুব দেয় ময়ূরী, লালপাড়ের শাড়ি আর সিঁদুর পরা মায়ের মুখটা মনে পড়ে যায়। খুব সামান‍্যতেই কত খুশি হত মা। বাবা শাড়ি আনলেই উল্টেপাল্টে দেখেই বলতো," ইশ্ এত খরচ করলে শুধু শুধু কেন? এই টাকায় বরং ময়ূরের জন‍্য দুটো জামা আনলেই হত।"
" বাবা নিঃশ্বাস ফেলে বলতেন,ঐ তো বছরে একটা একটু ভালো শাড়ি আনি,তা আর না কোরনা। ময়ূরের জন‍্য তো এনেছি দুটো জামা।"

      দেখতো রাঙা জেঠি,বড় জেঠিরা কত ভালো ভালো শাড়ি পরে সেজেগুজে আসতো অঞ্জলি দিতে। কিন্তু মা যেন সবার চেয়েই বেশি সুন্দর। অষ্টমীতে মায়ের সামনে অঞ্জলি দিতে দিতে কখন যে দুই মা একসাথে মিলিমিশে যেতো বুঝতেই পারতোনা। মা আরতির শিখা এনে মাথায় ওমটা বুলিয়ে দিতো পরম স্নেহে।
                 বাড়িতে এসে মাকে বলতো," আচ্ছা মা দুগ্গাঠাকুর যেমন শাড়ি পরে তেমন শাড়ি তোমার আছে মা? কি সুন্দর চকচকে লাল শাড়ি সোনালী পাড় দেওয়া। মা বলতো.." ঐ শাড়ি আসে বেনারস থেকে। তোর রাঙাজেঠু আনায় এক বন্ধুকে দিয়ে দুটো বেনারসী একটা দুগ্গামায়ের জন‍্য আর একটা কালীমায়ের জন‍্য।"
       " তোমার কেন অমন শাড়ি নেই মা? রাঙা জেঠিরও তো আছে। দুগ্গামা যেমন পরে?"
           মা হেসে বলতো," ঐ শাড়ি যে মাকেই মানায়।অমন ত্রিনয়ণ দশহাত আর মধু ঝরে পড়া মুখেই তো মানায় ঐ শাড়ি।"

            " তোমাকেও ভালো লাগবে মা,দেখো খুব ভালো লাগবে।"
       মা মুখের বিষণ্ণতাকে হাসিতে ঢেকে দিয়েছিলো একদম। সত‍্যিই সীমা মেয়েকে বলতে পারেনি এখন তাদের তালপুকুরে ঘটি ডোবেনা।খুঁড়িয়ে সংসার চলে। বাক্স খুলে সীমা দেখেছিলো ঘিয়ে রঙের রোলেক্স বেনারসী খানা। ময়ূরীকে দেখাতেই ও রাগ করে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো.." ইশ্ এটা একটা বেনারসী নাকি!
            মায়ের সেদিনের মুখটা এখনো ভুলতে পারেনি ময়ূরী।
                        কথায় বলে মন থেকে যা চাওয়া যায় তা কখনো কখনো সত‍্যিই পাওয়া যায়। হঠাৎই একটা কাজে সুযোগ এলো দুদিনের জন‍্য বেনারস যাওয়ার। আসলে ময়ূরী টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার, যখন সুযোগ পেয়েছিলো পড়ার সমালোচনার ঝড় উঠেছিলো গ্ৰামে। রায় বাড়ির মেয়ে কাপড় বোনার কাজ করবে শেষে? মা গো,আর কিছুতে সুযোগ না পেয়ে শেষে কাপড় বোনা!.....
            সরকারী কলেজে খুব কম খরচে পড়া যাবে, তাই সুযোগটা ছাড়েনি ময়ূরী সবার ঠাট্টাকে এগিয়ে চলায় জেদ হিসেবে কাজে লাগিয়েছিলো।

            বেনারসে নিজের প্রোজেক্টের কাজ শেষ করে আলি হুসেনের কারখানায় যায় ময়ূরী,ল‍্যাপটপ থেকে বের করে দেয় চারবছর আগে করা ডিজাইনটা,যেটা ওদের পাঠিয়েছিলো তবে নিজে আসতে পারবে তা ভাবেনি।ওরা শাড়িটা এনে ওর সামনে রাখে।

      " দেখিয়ে ম‍্যাডাম,সব ঠিক হ‍্যায় তো?"

অবাক হয়ে যায় ময়ূরী,ঠিক যেমন ও বলেছিলো ঠিক সেভাবেই সুতো রঙ আর মিনে দিয়ে নক্সা তুলেছে শাড়িটাতে ওরা। বারবার শাড়িটাতে হাত বুলিয়েও মন ভরেনা ময়ূরীর,ওর নিজের নক্সা করা শাড়ি! কত ডিজাইন তো করেছে কিন্তু এমন আনন্দ কখনো পায়নি।
         সৃষ্টির আনন্দ কি সত‍্যিই এত হয়! এই তো মায়ের বেনারসী শাড়ি,ওর স্বপ্নের শাড়ি। প্রতিটা সুতোর বুনোটে বুনোটে লুকিয়ে আছে হাজার একটা স্বপ্নসুতোর গল্প।

     ******************

      ভোরের সেই ঘুমভাঙা স্বপ্নটা আজ সত‍্যি। অনেকটা ট্রেনের পথ পেরিয়ে বাসের ধুলো উড়িয়ে ছোটবেলার গাছপালাগুলো দেখতে দেখতে আবার অনেকদিন বাদে গ্ৰামের পথে ময়ূরী। আকাশে নীলমেঘের ফিসফিস,বাতাসে শিউলির গন্ধ আর রাস্তার পাশে কাশফুলের আনন্দ।
           ওদের পুরোনো ভাঙাচোরা বাড়ির সামনে মা বাবার মুখগুলো হাসছে ওর প্রতীক্ষায়। মন্ডপে মা এসেছেন দশদিক আলো করে,বাজছে ঢাকের বাদ‍্যি। ধুনোর গন্ধে মনটা পবিত্র পবিত্র। মন্ডপে নতুন জামা গায়ে কুচোদের ভিড়। মাকে জড়িয়ে ধরে ময়ূরী।

          আগামীকাল অষ্টমী,মায়ের হাতে শাড়িটা দেয় ময়ূরী। মায়ের চোখটা টলটল করে ওঠে আনন্দে,সন্তানের হাত থেকে তার নিজের কল্পনায় বোনা সুতোর নক্সা আদরে গায়ে মুখে ছোঁয়ায় সীমা। তারপর মাথায় ঠেকায়।
        "দুুগ্গগা মায়ের জন‍্য একখানা বুনিস ময়ূর, তোর দেওয়া শাড়ি নিজের হাতে দেবো মাকে।"
        হাসে ময়ূরী," নিজের কথা আর কবে ভাববে মা?"
        " তুই তো আছিস আমার কথা ভাবার জন‍্য।"

       আজ আনন্দের শিশিরবিন্দুর দুএক ফোঁটা ময়ূরীর চোখেও,কাল মা ওর দেওয়া শাড়ি পরে অঞ্জলি দেবে।
                   রাতে আনন্দে ঘুম আসেনা সীমারও,ভোরে উঠে স্নান সেরে বড় করে কপালে সিঁদুরের আল্পনা এঁকে গায়ে জড়ায় মেয়ের কল্পনার শাড়িটা।
        " ময়ূর দেখ তাকিয়ে তোর বানানো শাড়ি।"

       অষ্টমীর সকালে হাতে সাজিভরা ফুল নিয়ে আটপৌরে সাজে বেনারসী খানা গায়ে জড়িয়েছে সীমা। ময়ূরীর মনে হলো ওদের ভাঙা বাড়ির নোনাধরা দেওয়াল আর পালিশ ওঠা মেঝেতে আজ ওর স্বপ্নের বেনারসী পরে পা রেখেছে চিন্ময়ী মা নয় মৃন্ময়ী মা উমা।
            চোখটা কচলে বিছানায় উঠে বসে বলে,"কি সুন্দর লাগছে তোমায় মা! একবার সাজি হাতে উঠোনের শিউলি গাছটার তলায় একবার দাঁড়াও না তোমার একটা ছবি তুলি।"
         দূরে শাঁখ ঘন্টার আওয়াজ পাওয়া যায়,অষ্টমীর পুজো শুরু হবে আরেকটু বাদেই। ব‍্যস্ত হয় মা।ময়ূরী বুঝতে পারে মায়ের মন দুগ্গাদালানে,এবার পুজোতে অষ্টমীর সব খরচই দিয়েছে বাবা। তাই মা আবার সবার সাথে হাত মেলাবে পুজোর জোগাড়ে।

                  মা চলে যাবার কিছুক্ষণ বাদে অঞ্জলি শুরু হওয়ার মুখে বাবাকে সাথে নিয়ে যায় ময়ূরী। আজ ওর কল্পনার সুতোর আল্পনার জয় সবার মুখেই। মা যে আলো করে বসে আছে জগজ্জননী মায়ের সামনে আর কেউ জিজ্ঞেস করলেই বলছে," আমার ময়ূরের হাতে আঁকা শাড়ি গো,সুতোয় আর নক্সায় যে জড়িয়ে আমার ছোট্ট ময়ূরের স্বপ্ন।"
       
সমাপ্ত:-
        

             
          
           
       
             
            

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...