#ইচ্ছে_মত#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
ইলিশের কচুপাতার পাতুরির ছবিটা খুব ভালো করে গার্নিশ করে স্টেটাসে দেয় উত্তরা যথারীতি খাবারের ছবিতে অনেকগুলো সীন আসে সবারই।কেউ বলে উঃ কি ভীষণ লোভ হচ্ছে আবার কেউ বা লাভ ইমোজি দেয়।
টুয়া প্রায়ই দেখে আজকাল নানান ননভেজ খাবারের ছবি প্রায়ই দিচ্ছে উত্তরা স্ট্যাটাসে।অবাক হয়ে যায় দেখে,উত্তরা কি কুকিং ক্লাশ জয়েন করলো নাকি? এত রকম রান্না করছে আজকাল। আজ ক্র্যাব তো কাল ইলিশ,পরশু চিংড়ি কোনদিন আবার মাটন আফগানী তো ডিমের রেজালা। একটাও তো ভেজ রান্না করেনা।
টুয়ার খুড়তুতো বোন উত্তরা,দুই বাড়িতে তেমন মিলমিশ আর না থাকলেও ওদের কথা হয় মাঝেমাঝেই। যদিও একটু পরশ্রীকাতরতা আছে দুপক্ষেরই মানে টুয়া মাধ্যমিকে যা পেয়েছে তার থেকে উত্তরাকে অন্ততঃ বেশি না হলেও পাঁচ বেশি পেতে হবে নাহলে মান থাকেনা। উত্তরাদের গাড়িটা যদি অল্টো হয় তাহলে পরের কমাসের মধ্যেই একটু বেশি দাম হলেও সুইফট ডিজায়ার কিনে টুয়াকে বলতে হবে," এটাই কিনলো বাবা,আসলে অল্টো বড় ছোট,পা রাখাই যায়না ঠিকমত।"
ওদিক থেকে উত্তরাও কখনো কখনো বলেছে," হ্যাঁ ভালোই করেছিস,অল্টোতে তোর আর জেঠিমণির সত্যিই বসার খুব অসুবিধে হবে।
আসলে আমি ড্রাইভিং শিখছি তো ছোট গাড়িই আমার জন্য ভালো।"
এমন বহু ঠোকাঠুকি হলেও টুয়ার টক্কর বরাবরই উত্তরার সাথে।মানে ওর মা বাবাই মাথায় ঢুকিয়েছে তুমি যা করো না করো ও বাড়ির উত্তরা যেন তোমাকে টপকে যেতে না পারে। তাই অগত্যা ড্রাইভিং শিখতে চললো টুয়াও। কিন্তু পরে দেখলো সত্যিই সুইফট ডিজায়ারটা ওর পক্ষে বড় গাড়ি তাই যখন পার্কিং করতে গিয়ে গাড়িটা আঁচড় টাচড় খেয়ে একটু চেপ্টে গেলো সত্যিই মন খারাপ হলো টুয়ার। বাবা বললো,"ধ্যাৎ দিলি তো নতুন গাড়িটার বারোটা বাজিয়ে। উত্তরা তো
দিব্যি গাড়ি চালাচ্ছে। আসছে যাচ্ছে।"
ওর আত্মবিশ্বাসকে যেন করাত দিয়ে কাটলো বাবা। অবশ্য ও নিজেও হাতুড়ি বার করে বেশ ঠোকাঠুকি করলো বাবার সাথে।" সবসময় ওদের সাথে তোমার কম্পিটিশন, এবার বোঝো। আমার দোষটা কি? অল্টো হলে আমি ঠিক পারতাম।"
******************
উত্তরার স্ট্যাটাসে চোখ রাখলেও প্রশংসা করতে পারেনা টুয়া। মনে মনে ভাবে এ কেমন হলো হঠাৎই আবার মেছো হয়ে উঠলো উত্তরা। একটা সময় ওদের জয়েন্ট ফ্যামেলিতে মাছ নিয়ে মন কষাকষি হতো মায়েদের।সেই গল্প এখনো মাঝেমাঝেই শোনে মায়ের কাছে। " তোর কাকিমা তো কম ছিলোনা,সব সময় মাছের মুড়ো মেয়েকে খাওয়াবে।মেয়ে নাকি খুব ভালোবাসে,আরে আমার মেয়েটা কি জলে ভেসে এসেছে? ব্যাস তোর বাবাকে বললাম আর আনিয়েই ছাড়লাম দুটো করে মাথা। ওর মেয়ে মাথার বুদ্ধি বাড়াবে ঘিলু খেয়ে আর আমার মেয়ে বাড়াবে না?"
এখন ওরা আলাদা তবুও একসাথে থাকার কিছু ছোটখাটো ঘটনার দাগ মায়ের মনে এখনো স্পষ্ট। আর হয়ত সেখান থেকেই রেষারেষির সূত্রপাত। তবে এই উত্তরা যখন ব্যাঙ্গালোরে চাকরি করতে গেলো তখন খুব বুকে বেজেছিলো ওদের সবার। টুয়ারও মনে হয়েছিলো,ছোট হওয়াই ভালো ছিলো তাহলে দেখতো উত্তরা কি করছে সেটা বুঝে ও করতো। ও অনার্স নিয়ে পড়লো, মানে এখনো পড়েই যাচ্ছে। আর উত্তরা একটু ছোট হয়েও টুক করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে চললো ড্যাং ড্যাং করে চাকরি করতে। আর ওরাও তেমন চাপা একদম উত্তরা চলে যাবার আগের দিন এতবড় বাক্সে একবাক্স মিস্টি এনে বলেছিলো.." হঠাৎই চাকরির চিঠি এসেছে কাল ভোরেই ফ্লাইট তাই বললাম শিগগির চল মিস্টি নিয়ে জেম্মার সাথে দেখা করে আসি।"
সেদিন কেন যেন ঐ মিস্টি ওদের কারো গলা দিয়ে নামেনি।বাবা খেয়ে ফেলাতে বকুনি খেয়েছিলো খুব।মা বলেছিলো," তোমার ভাই বৌ কিছু পারে আর তেমন চালাক মেয়েটা একদম কিছু বলেনি চুপ করেছিলো এতদিন! হুঁ পেয়েছে তো কুড়িহাজারের চাকরি তার আবার কত বড় বড় কথা।"
কুড়িহাজার না পঁচিশ তা নিয়ে একটা বেশ জমজমাট পিএনপিসির আসর বসিয়ে ওরা মুড ফিরিয়েছিলো সেদিন। তারপর কিছুদিন সব ধামাচাপা মোটামুটি। তবে যেদিন টুয়ার মা শুনে এলো উত্তরার বিয়ে তাও আবার খোদ সাউথ ইন্ডিয়ান ছেলের সাথে সেদিন একদম বাড়িতে লেগেছে লেগেছে আগুন নাচের মেজাজ।
" ইশ্ ছ্যা ছ্যা শেষে আবার সেই সাউথ ইন্ডিয়ান ছেলে! হায় ভগবান কি আড্ডু,মাড্ডু বলবে কিছুই তো বুঝবেনা তোর কাকি। আর ইংরেজিও বলতে পারবেনা। বেশ হয়েছে, নিশ্চয় একটা কেলে ভূতের মত জামাই হবে।"
টুয়া জানে ওর পছন্দ করা রিতমকে মায়ের প্রথমে একটু খুঁতখুঁতে লাগলেও এখন মেনে নিয়েছে।তবে রিতমের গায়ের রঙটা দারুণ, শুধু সমস্যা একটাই ওর হবু শাশুড়িমা বলেই দিয়েছেন," আমরা মাছ খাইনা,তুমি বাইরে খেতে পারো তবে বাড়িতে উঠবেনা কিন্তু। আর রিতমও তো খায়না।"
টুয়া প্রথমে একটু আপত্তি আর রাগ করলেও রিতম বলেছিলো," আমাকে দোষ দিবিনা,তুই জানিস আমি মাছ খাইনা। তবুও প্রেমে পড়েছিস ছলাৎ করে একদম। আরে বাবা দুটো স্টপেজ পড়েই তো বাপের বাড়ি গিয়ে খেয়ে আসবি। কি দরকার বাড়িতে অযথা গোলাবারুদ নিয়ে বিদ্রোহ করার। শুধু চুমু খাওয়ার আগে একটু ব্রাশ করে নিস।"
শুনে একটা কিল মেরেছিলো রিতমকে.." চুমু খেতে হবেনা যা।"
কিন্তু এবার আর গুগলি খেলে চলবেনা উত্তরার বিয়ের প্রায় ছমাস বাকি আছে তাই এরমধ্যে আগেই টুয়ার বিয়েটা সেরে ফেললো ওর মা বাবা। হাজার হোক একবছরের বড় টুয়া উত্তরার চেয়ে তাই যখন পাত্র ঠিকই আছে তখন অসুবিধা কোথায়? যদিও ওর বিয়েতে উত্তরা আসেনি মানে আসতে পারেনি তবে ফেসবুক আর হোয়াটস অ্যাপে ছবি দেখেছিলো। বেশ ভালো লাগছে টুয়াকে যদিও ওর মা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলেছিলো," আর কি দুজনেই স্কুল মাস্টার ভালোই হলো।তবে এখন অবশ্য মাস্টারদের মাইনে ভালোই। একটাই দুঃখ রয়ে গেলো তুই অনেক দূরে চলে গেলি ও বেশ আসবে যাবে।"
উত্তরা হেসে মাকে বলেছিলো," বাপের বাড়ির বেশি কাছে শ্বশুরবাড়ি না হওয়াই ভালো। তারপর তোমাকেই জ্বালিয়ে মারতাম কথায় কথায়।"
*********************
ছমাস বাদে উত্তরার বিয়েতে গিয়েছিলো টুয়া বরকে নিয়েই।দেখুক সবাই ওর সুন্দর বরকে।উত্তরা আলাপ করিয়ে দিয়েছিলো ওর বরের সাথে,বেশ লাজুক মুখে বাংলায় কথা বলেছিলো নতুন সাউথ ইন্ডিয়ান বর।অবাক হয়ে গিয়েছিল টুয়া। বরের গায়ের রঙ চাপা হলেও অনেকটা বাহুবলীর নায়কের মতই দেখতে। তাহলে কি একটু কালো হলেও উত্তরার বরটাই জিতে গেলো? কিন্তু বাংলাটা শিখলো কি করে? যাক পরে জানা যাবে। হয়ত প্রেম করতে করতেই শিখেছে।
একদিন ওদের বাড়িতে তো মা খেতে বলবেই মানে যদি ওরা আসে তাহলে গল্পে গল্পেই সব জানা যাবে।
যথারীতি টুয়াদের বাড়ি থেকে নেমন্তন্ন আসে উত্তরার উইথ নতুন বর। তবে টুয়ার একটা মিল পেয়ে বেশ ভালো লাগলো যে যাক তাহলে উত্তরার অবস্থাও ওর মতই মানে সেই মেছো ভূত হয়েও পড়েছে গিয়ে নিরামিষের খপ্পরে।তবুও তো ওর শাশুড়িমা ধোকা,পনীর,এঁচোড়,পটলের দোলমা কত কি বানান।তবে উত্তরার আর মাছের মুড়ো চেবানো হবেনা অথবা মুরগির ঠ্যাঙ। ভেবে বেশ ভালো লাগলো টুয়ার, তারপর বাপের বাড়িও দূরে ইচ্ছে হলেই চলে আসতে পারবেনা। সুতরাং সম্বল হচ্ছে ইডলি,ধোসা সম্বর।
সেই উত্তরাই কিছুদিন ধরে খোদ শ্বশুরবাড়িতে বসে নিত্য নতুন আমিষ পদের ছবি তুলে পোস্ট করছে ফেসবুক আর হোয়াটস অ্যাপে? বেশ অনেক ফলোয়ার্সও জুটেছে মানে আজকাল ব্লগ লিখছে উত্তরা। কিন্তু কি ভাবে?
তাহলে নিশ্চয় শ্বশুরবাড়ির পাট চুকিয়েছে উত্তরা। হয়ত বা বরকেও ছেড়েছে।
থাকতে না পেরে একদিন জিজ্ঞেস করেই বসে মেসেজে.....
"তুই কি বাড়ি পাল্টেছিস? মানে শ্বশুরবাড়িতে থাকিসনা?"
টুয়ার কথা শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে উত্তরা "এ কথা বলছিস কেন?শ্বশুরবাড়িতে থাকি আবার কোথায় থাকবো?"😊😊
"মানে এত রান্না করিস তোর শাশুড়ি মা কিছু বলে না?
"ওমা শাশুড়ি মা কিছু বলবে কেন? ওরা ওদের পছন্দের খাবার খায় আমি আমার পছন্দের খাবার খাই।☺️"
অবাক হয়ে টুয়া জিজ্ঞেস করে," বাড়িতে ঢোকায় আমিষ?"
হাসে উত্তরা,"ব্যাগে করে এসে ঢুকে পড়ে।আমি আর কি ঢোকাবো। আমি আগেই বলেছিলাম আমি আমিষ না খেয়ে থাকতে পারিনা আমাকে যদি তোমাদের বাড়িতে নিয়ে যাও তাহলে আমার জন্য আলাদা মাছ রান্নার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।"
" ওরা রাজী হয়েছিলো?
কিছু বলেনি?"
" নাহলে বিয়ে করতাম না। আরে খাবার স্বাধীনতাটুকু বিসর্জন দিতে হবে নাকি বিয়ে করতে গিয়ে? সব কি আমরাই ছাড়বো নাকি? বাড়িঘর,মা,বাবা ইভেন খাওয়ার স্বাধীনতাও! তোমরা বাপু তোমাদের আপ রুচিতে খাও আমিও তাই খাবো।"
অবাক হয়ে যায় টুয়া উত্তরার কথা শুনে ওরও পছন্দ করেই বিয়ে কিন্তু রিতমকে কোনদিন বলতে পারেনি এমন কথা বরং মেনে নিয়েছিলো ওদের সবটাই। নিজের খাওয়ার স্বাধীনতার পায়ে বেড়ি পরিয়েছিলো নিজের হাতেই।
একটু মিনমিন করে জিজ্ঞেস করে," একই রান্নাঘরে রান্না করিস?"
"নারে ছাদে একটা দারুণ মডুলার কিচেন করে নিয়েছি আমরা। মানে ওটাই আমার সুহাগরাতের গিফ্ট ছিলো। এত সুন্দর রান্নাঘরে আমি একা রাঁধুনী আর খাউনিও আমি, শেখানোর টিচার ইউটিউব মাসি আর মা। তাই যা রাঁধি তারই ছবি আর রেসিপি দিই অন্যদের প্রশংসা পাবার জন্য। ধুৎ রাঁধবো আর কেউ ভালো বলবেনা তা কি হয়? তাই একখানা ব্লগ খুলে ফেলেছি।"
মনে মনে টুয়া বলে তা আর দেখিনি আমি তাই তো জিজ্ঞেস করলাম। সত্যিই পারিস বটে তুই। যতই টক্কর দিই তবুও হয়ত সেভাবে তোর মত কোনদিনই স্বাধীন হতে পারলাম না। তবুও একটু আমতা আমতা করে বললো, "মানে ইয়ে তুই মাছ খেলে অ্যাভি চুমু খায় তো?"
হেসে গড়িয়ে পড়ে উত্তরা," শুধু চুমু? দুএকটা ফ্রাইও খেয়ে যায় মাঝে মাঝে। সঙ্গদোষ বলে একটা কথা আছে তো আফটার অল।"©রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment