কয়েকটা দিনের মন উচাটনের আর টেনশনের শেষ হলো প্রাপ্তিতে। যে যার মত খুশি হলো নিজের নিজের প্রাপ্তিতে। রবীনকে এই সময় একটু আলো জ্বালিয়ে দেখাতে হয় ভবিষ্যতের পথ অনেককেই।
কেউ বা মশাল দৌড়ের মত ওর মশাল থেকে আলো জ্বালিয়ে ছুটতে থাকে।কারো বা দমকা হাওয়াতে বা অযত্নে নিভে যায় আলো,ঘনিয়ে আসে অন্ধকার জীবনে।কষ্ট পায় তখন রবীন খুব,বুকটা আর্তনাদ করে ওদের অন্ধকারে ডুবে যাওয়ার কষ্টে।
এবার আরেক চিন্তা তার সাথে যোগ হলো,সহজ সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত মিষ্টি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে তো শহুরে আদবকায়দায়? রবীন ছেলেমেয়ের মধ্যে পার্থক্য না করলেও কেন যেন বর্তমানের বিশৃঙ্খলা অবক্ষয় আর মেয়েদের সম্মানহানি সবটাই ভাবালো ওকে।
মিষ্টি সুন্দরী, শান্ত,কম কথা বলে। দুষ্টুর মত লাফিয়ে ঝগড়া করতে পারেনা কাউকে দরকারে মেরেও আসতে পারেনা। দুষ্টু হলে হয়ত এতোটা চিন্তা হতোনা রবীনের। রাণু শুনে জামাইবাবুকে শান্ত করে..." দেখেছেন তো মেয়ের বাবা কোথাও কোথাও হেরে যায় হেডমাস্টারের সাহসের কাছে। এত ভয় কিসের? আমাদের জোজো তো যাবেই ওখানে পড়তে।আলাদা কলেজ হলেও মাঝে মাঝে তো দেখা হবেই। আর দিদিভাইয়ের তো কলকাতাতে একটা ফ্ল্যাটও আছে,মাঝেমাঝেই দিদি আর দাদা ওখানে যায়। শুভও যায় ওখানে অফিসের কাজে এত ভাববেননা জামাইবাবু।
রবীনও ভবিষ্যতের চিন্তা করে। হয়ত ওকেও দরকারে একটা কিছু করতে হবে কলকাতাতে ভবিষ্যতে। জীবন যে কখন কোথায় নিয়ে যায় কে জানে? বাকুড়া,পুরুলিয়া,কালচিনি,শিলিগুড়ি তারপর এবার হয়ত সখ্যতা হবে অন্য কোন শহরের সাথেও। নতুন শহরে গিয়ে পাহাড়ি নদীর মত স্বচ্ছ আর সুন্দর সবুজ মিষ্টি ভালো থাকবে তো?
রাতে শুয়ে শুয়ে অনুর কাছে রবীন একই কথা বলে। অনুও কেঁদে ফেলে," জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়িতে পড়লে হতোনা গো? সেই কতদূরে একলা পড়তে যাবে মেয়েটা।সত্যি খুব চিন্তা হচ্ছে। কোনদিন তো মেয়েদের ছেড়ে থাকিনি। ওদের সাথে বকে চেঁচিয়ে দিন কাটতো আমার। সারাদিন দুটোতে কত কি করতো।"
রাতে শুয়ে ঘুম আসেনা মিষ্টিরও জানলা দিয়ে ফুলের হাল্কা সুবাস আসছে। ওদের জানলার পাশের গাছগুলো মাথা নাড়ছে হাল্কা হাওয়ায়,বুকের ভেতরটা কেমন যেন অস্থির লাগে।মন খারাপও করে কেমন যেন একটা।আবার কবে বাড়ি আসতে পারবে কে জানে? এর থেকে ছোট হওয়াই ভালো ছিলো। দুষ্টু এখন একা একা বেশ মা বাবার আদর খাবে আর ইচ্ছেমত খেলে বেড়াবে চাবাগানের ধারে আবার কখনো সাইকেল নিয়ে ছুটবে ইচ্ছেমত সবুজের কাছে।
কে জানে ইট কাঠ পাথরের শহরটা ওকে আপন করে নেবে কিনা? ভর্তি হতে গিয়ে দেখেছে কত ছেলেমেয়ে সেখানে অনেকেই ঝরঝরে ইংরেজীতে কথা বলছে। মিষ্টির অত ভালো ইংরেজী জিভের ডগায় আসেনা যদি ভুল করে ফেলে তাই অস্বস্তি হয়। নতুন শহর হয়ত শেখাবে অনেক কিছুই আবার ভোলাবেও অনেক স্মৃতি। ওদের চেনাজানা একটা মেয়ে ওখানে ভর্তি হয়েছে,বাবার এক দুজন ছাত্রও পড়ে ওখানে। বাবা ওদের নম্বরগুলো ওকে দিয়ে দিয়েছে।
দুষ্টুর ঘুমটা ভেঙে যায় হঠাৎই, দেখে দিদি জানলায় দাঁড়িয়ে। দিদির জন্য ওরও মনটা ভালো নেই,আস্তে আস্তে গিয়ে দিদির পাশে দাঁড়ায়। শিউলিগাছের ডালগুলো বাবা কেটে দিয়েছে বর্ষায়,টগর আর শিউলির গলাগলিতে মন হারিয়ে যায় ওদের।চা বাগানের ওপাশ থেকে ভেসে আসে রাতজাগা পাখির ডাক হঠাৎই ময়ূরের ডাক তার মধ্যেই নিস্তব্ধতা ভাঙে।
" দিদি আয়,আজ আমরা একসাথে ঘুমোই সেই ছোটবেলার মত।মন খারাপ করিসনা,আমি চলে যাবো কিছুদিন বাদেই কলকাতা,দুজনে একসাথে ওখানেই থাকবো। তবে আমার খুব মনখারাপ করবে কালচিনির জন্য। বাবা মাকে ছেড়ে তো কখনো থাকিনি।"
বোন যে কথা সহজে বলতে পারলো,তা ওর মত বলতে পারেনা মিষ্টি। তাই বলে," আমারও তোদের সবার জন্য মন খারাপ করবে রে বোন।"
তার মাঝেই দুষ্টুরও মন খারাপের রেশ,বলবো বলেও হলোনা যে কথা বলা। ভেবেছে বড় হয়ে বলবে কোনদিন, ও তো এখনো বড়ই হলোনা।আঠেরো আর হলো কই? তাই মনের কথা রইলো মনবন্দি।জোজোদা তো ওকে বড় বলে মনেই করেনা কখনো। সেই চিঠিটাও রয়ে গেলো না পড়া,দুষ্টু জানলোনা সেই চিঠিটায় চোখ রেখেছিলো অন্য কেউ সঙ্গোপনে।
তবুও দিদির মন ফেরাতে বলে..." দিদি তুই একলা কোথায়? জোজোদাও তো যাচ্ছে ওখানেই। মাঝে মাঝে দেখা হবে তোদের।ওখানে তো ওদের ফ্ল্যাটও আছে শুনেছি।"
মিষ্টি বললো," হ্যাঁ জানিতো,যাক তবুও মাঝে মাঝে দেখা হবে।অসুবিধা হলে বলতে পারবো।"
দুষ্টু হেসে ওঠে.. "ফুঃ,ও কত বড় ছেলে রে যে তোর অসুবিধা দূর করবে? শুধু দীপ্তদাই চান্স পেয়েও যেতে পারলোনা।"
" কেন রে? ও তো আমার চেয়ে একবছরের বড়। দীপ্তর মাথায় অনেক বুদ্ধি,ও এখানে থেকেও ভালোই করবে। কি করবে আর?"
মনে মনে ভাবে দুষ্টু,দীপ্তদা যদি জোজোদার মত হত তাহলে কত ভালো কলেজে পড়তে পারতো। সুযোগ পেয়েও ছেড়ে দিতে হতোনা।
ভোরবেলা প্রতিদিনের মত ঘুম ভাঙে রবীনের, বাইরে এসে চোখ রাখে বাগানের দিকে মনটা শীতল হয় চোখের আরামে প্রশান্তি আসে। মেয়েদের ঘরের পরদা সরিয়ে উঁকি দেয় দেখে দুইবোন গুটিশুটি মেরে কাছাকাছি এসে শুয়ে আছে।অনেকদিন বাদে দুটোতে একসাথে শুয়ে আছে।মিষ্টি চলে গেলে দুষ্টুরও খুব খারাপ লাগবে। একদম পিঠোপিঠি দুইবোন ওরা।
********************
দেখতে দেখতে মিষ্টির যাবার দিন চলে এলো,রবীন নিয়ে যাবে মিষ্টিকে একদম হস্টেলে রেখে আসবে।অবশ্য এনজিপি পর্যন্ত যাবে সবাই,একটা দিন রাণুর ওখানে থেকে দুষ্টু আর ওর মা ফিরে আসবে। জোজোও যাচ্ছে মা বাবার সাথে,ওর বাবা এখন এখানেই আছে,একসাথে টিকিট কাটা হয়েছে। দুষ্টুর মন ভেসে যায় ওদের সাথেই নিরুদ্দেশে,মনে পড়ে যায় পুরীতে একসাথে যাবার কথা। মিষ্টি ওর অনেক কিছু বোনকে বুঝিয়ে দিয়ে পা বাড়ায় এক নতুন অধ্যায়ের দিকে।
" তুই এগুলো নিয়ে যা দিদি,আমার লাগবেনা।"
" এগুলো পরার জন্য কত বায়না করতিস,এখন কি হলো?"
দুষ্টুর চোখ ছলছল তবুও হাসে," পড়তে পড়তেই এখন সময় কেটে যাবে এগুলো পরবো কখন?"
দুষ্টুর মেলানো কথার ছন্দে হাসে মিষ্টি।
স্টেশনে সবাই একজায়গায় হয় ওরা,এই কদিনেই যেন জোজোদা অনেক বড় হয়ে গেছে। দিদিকেও খুব অন্যরকম লাগছে। ওদের কাঁধে বড় ব্যাগ,সবাই মিলেমিশে বেশ গল্প হচ্ছে স্টেশনে।
দুষ্টু শুধু ভাবলো জোজোদা অনেক দূরে চলে গেলো।আর মণিমার বাড়িতে এলেই দেখা হবেনা।
" কি রে এত চুপচাপ কেন আজ? মনখারাপ?
দুবছর বাদে তো তুইও আসবি এখানে।" জোজোদার চোখেমুখে আনন্দের হাসি। হয়ত এটাই চেয়েছিলো ওরা।
দুষ্টু অভিমান করে বলে," আমি বাবাকে ছেড়ে যাবোনা এখানেই পড়বো।"
মিষ্টি আর জোজো হাসে...জোজো বলে," দেখা যাবে সময় আসুক।"
হঠাৎই ওরা অবাক হয়ে যায় দীপ্তকে দেখে..
ছুটতে ছুটতে আসছে ও..জোজোর কাছে এসে বলে," এসে গেছি,একটু দেরি হয়ে গেলো।"
রবীনের মনটা খারাপ হয়ে যায় ছেলেটার জন্য আজ এই ট্রেন যাত্রাতে ওর থাকার কথা তো ছিলো কিন্তু হলোনা।
" তুই আবার এলি,এতোটা? কি করে?"
" দিদির বাড়িতে এসেছিলাম স্যার,তাই চলে এলাম। এক সাথে কত কি শিখেছি।"
ওদের ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে এসেছে,অনু জড়িয়ে ধরে মেয়েকে,দুষ্টুও আদর করে দিদিকে।
দীপ্ত আর জোজো দুজনকে জড়িয়ে ধরে,মিষ্টির সাথে হাত মেলায় দীপ্ত।
রবীন বলে.." সাবধানে থাকিস,আমি কদিন বাদেই আসবো।রাণু ওদের গাড়িতে তুলে দিয়ো।"
মধুমিতা হেসে বলে," দুটোদিন থেকে যেয়ো।"
জোজো দুষ্টুর দিকে হাত বাড়ায়,দুষ্টু জোজোদার হাতটা ধরে হ্যান্ডশেক করে বলে.." ভালো থাকিস,দিদির খবর নিস।"
ঘাড় নাড়ে জোজো,হাসে মিষ্টি।দুজনেই বলে..." তুই ভালো থাকিস,মন দিয়ে পড়িস।"
ট্রেনের জানলার বাইরে ওরা,দীপ্তর মনটা যেন কেমন করে ওঠে। এই গাড়িটা আর ওর ধরা হলোনা,ওকে রয়ে যেতে হলো স্টেশনেই, ওর যে টিকিট কাটার ক্ষমতা নেই। দুষ্টুর হাতে লেগে জোজোর হাতের ছোঁয়া। সবাই হাত নাড়ে। দীপ্ত হাত নাড়তে নাড়তে মনে মনে বলে..." আজ না হলেও একদিন গাড়িটা ঠিক ধরে ফেলবো আমি।"
*******************
নতুন শহরে নতুন শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পা রাখে মিষ্টি।এর আগে দুএকবার কলকাতা এসেছে,মাঝেও আসতে হয়েছে।তবে এবার একদম কিছুদিনের স্থায়ী ঠিকানা এই শহর।বাবা বাড়ি ফিরে যাবে ওকে থেকে যেতে হবে এখানেই,ভেবে মিষ্টির মনটা খারাপ হলো।তবে প্রথম কয়েকটা দিন বাবা যখন ছিলো তখন বেশ কেটেছে দিনগুলো।
মধুমিতা জোর করেই রবীনকে রেখে দিয়েছিলো ওদের ফ্ল্যাটে,হোটেলে থাকা হয়নি রবীনের। মিষ্টিও দুটো দিন বাড়ি বাড়ি গন্ধ পেয়েছে সবার মাঝে থেকে। জোজো,জেঠু,জেম্মা বাবা সবাইকে একসাথে পেয়েছে। একসাথে বাজারে গিয়ে কিছু জিনিসপত্রও কেনা হলো মিষ্টির জন্য।
মধুমিতা পছন্দ করে কিছু ড্রেস কিনে দিলো মিষ্টিকে।যদিও রবীনের একটু আপত্তি ছিলো,তবুও মধুমিতা শুনলোনা কিছুতেই.." আচ্ছা দাদা মিষ্টি তো আমাদেরও মেয়ে।আমি তো দুষ্টুর জন্যও কিনেছি আপনাকে নিয়ে যেতে হবে।"
রবীন বুঝতে পারে কৃতজ্ঞতার কিছুটা ভার হয়ত এভাবে হাল্কা করতে চায় মধুমিতা। একসাথে একটু ঘোরাও হলো কয়েকটা জায়গা।
দিদিকে ছাড়া মনকেমনের মেঘকুয়াশাটা একটু হাল্কা হলো দুষ্টু আর অনুর রাণুদের বাড়িতে থেকে। জয়ের সাথে খুনশুটি করে বেশ কাটলো দুটোদিন।রাণু কিছুতেই পরদিন আসতে দিলোনা,বারবার বললো," দিদি কতদিন বাদে এলি,এখন তো দিদিভাই আর দাদাও নেই এখানে।থেকে যা না কয়েকটা দিন।"
দুষ্টু ঐ বাড়িতে জোজোর গন্ধ পেলো,ওদের ঘরের কত কিছুতেই আছে জোজোর ছোঁয়া।জোজোর ব্যাটবল এখন জয়ের সম্পত্তি। মিষ্টির মত অনেক কিছু জয়কে দিয়ে গেছে জোজো।
দেওয়া নেওয়া আর ছাড়া ধরার মধ্যে এভাবেই চলতে থাকে জীবন।আজ যা তোমার কাল হয়ত ছেড়ে দিতে হয় অন্য কাউকে।মেনে নিতে পারলে বোধহয় ভালো,না মানতে পারলেই কষ্ট।
বাড়ি ফিরে এসে দুষ্টুও কষ্ট পেলো,একটা সময় ঘর আলাদা করার জন্য কত বায়না করেছে। দিদির খবরদারি একদম অসহ্য লাগতো,রাগ হত। এখন দিদির সব কিছু পড়ে থাকলো অবহেলাতে আজ আর রাত জেগে ডাইরি লিখতে ওকে কেউ দেখে ফেলবেনা। দিদি ওখান থেকে ফোন করেছিলো ভালো আছে ও।ওরা এর মধ্যে কলকাতার অনেক জায়গা ঘুরেছে,জোজোদার সাথেও কথা হলো।
" তোরা খুব মজা করছিস ওখানে! ইশ্ আমার যাওয়া হলোনারে।"
মিষ্টি বলে," ধুস্ কি মজা আর এখানে,আমার তো কালচিনির কথাই মনে হচ্ছে খুব। তবে এই কদিন ভালো লাগছে বাবা আছে তো। বাবা চলে গেলে তখন মন খারাপ করবে।"
" দিদি তোর কলেজের সবাই কেমন? ভালো তো? তোদের র্যাগিং হচ্ছে নাকি?"
" আমি তো এই দুদিন বাড়ি মানে জেম্মাদের ফ্ল্যাট থেকেই গেলাম তাই বুঝতে পারিনি কিছু রে। তবে হস্টেলে যাবো কাল জানিনা কি হবে? একটু ভয় লাগছে রে।"
জোজো ওদিক থেকে কি যেন বলে। এদিক থেকে দুষ্টু বলে," ভয় কিসের? তোকে কিছু বললে তুইও দেখিয়ে দিবি মজা। তবে এখন আর ওসব হয়না,বাবা বলছিলো আগেই নাকি বন্ড লিখে ভর্তি হতে হয়। তবে শুনেছি তার মধ্যেও অনেক কিছুই হয়।"
কি হবে কি হবেনা এই সব অনেক চিন্তা নিয়েই মিষ্টির হস্টেলে যাওয়া। রবীনও একটা দিন বেশিই থেকে গেলো।তবে মেয়ে ঠিকঠাক আছে জেনে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো কারণ ওদিকে অনেক কিছু অপেক্ষা করছে ওর জন্য। স্কুলের অনেক কাজ জমে আছে তাই বাড়ি ফেরাটা খুব জরুরী। মধুমিতা অভয় দেয় রবীনকে.." দাদা আমি আরো একটা সপ্তাহ আছি আপনি নিশ্চিন্তে যান।"
******************
এই কদিন কিছু মনে না হলেও আজ রবীনের মন খারাপ হলো। বুঝতে পারলো বাবা হওয়ার কিছু যন্ত্রণা যা হয়ত আর কাউকে বলা যায়না।আত্মজার সাথে বিচ্ছেদ কখনো শিক্ষার জন্য অথবা কখনো তাকে সংসারী করার জন্য। এখন ভরসা শুধুই ফোন আর রবীনের দেওয়া শিক্ষা।
বাবাকে বেশ কয়েকদিন বাদে আবার পেলো দুষ্টু।বাইরের টেবিলে বসে সবুজে চোখ রাখে রবীন,দুষ্টু আর অনু গালে হাত দিয়ে বসে ওখানকার গল্প শুনতে।
" বাবা দিদি একা থাকতে পারবে তো? ওখান থেকে জেম্মাদের বাড়ি কতটা? জোজোদা কোথায় থাকবে? বাড়িতে না হস্টেলে?"
রবীন হাসে," একটু দূরেই রে খুব কাছে নয়।মিষ্টিকে চিনিয়ে দিয়েছি।মেট্রো করেই আসতে পারবে। জোজো আপাততঃ ফ্ল্যাটে থাকবে,হোম ডেলিভারি খাবে।তারপর হস্টেলে যাবে এখনো সিট পায়নি।
কত কথা আর গল্পে কেটে যায় সময়।আজকের সব গল্পই মিষ্টিকে নিয়ে।দূরে গিয়েও আজ মিষ্টি আদর মাখলো সবার মনের মাঝে।
দুষ্টুর ডাইরি ভরলো মিষ্টি আর জোজোর কথায়।এই কয়েকদিন দুষ্টু মায়ের কাছেই শুয়েছিলো।আজ বাবা বললেও শুনলোনা।আবার ফিরে এলো অনেকদিন বাদে ওদের দুজনের ঘরে যা এখন শুধু দুষ্টুর। একা একা থাকা,ক্যালেন্ডারে চোখ রাখা আর ডাইরির পাতায় লেখা। তার মাঝেও আছে দৌড় যা শুধু বড় হওয়ার।দীপ্তদার থেকেও ভালো রেজাল্ট করতে হবে ওকে। এই কদিন কলেজস্ট্রীটে দুএকবার গেছে রবীন কিছুটা স্কুলের জন্য আর কিছুটা ভালো কিছু বই জোগাড় করা দুষ্টুর জন্য।
বাবার আনা বইগুলোতে চোখ রাখে দুষ্টু,ওকে এগোতে হবে অনেক এগোতে হবে। মনটা ডুব মারে বইয়ের পাতার মাঝে।
******************
কালচিনির স্কুল থেকে এসে প্রথম কদিন একটু হাবুডুবু খায় মিষ্টি।ওখানে ওকে সবাই ভালো মেয়ে বলে চিনতো,তার ওপর বাবার একটা নামডাক ছিলো। এত বড় কলেজে কে কাকে চেনে? বন্ধুত্ব হলো কয়েকজনের সাথে।হস্টেলে ওর রুমমেট সুদীপা জলপাইগুড়ির মেয়ে তাই খুশী হলো মিষ্টি যাক দুজনে একটু একরকম কথা বলে বাঁচবে কিন্তু তবুও মাঝে মাঝে সুদীপার সাথেও তাল মেলাতে পারেনা মিষ্টি, সুদীপা ওর চেয়ে অনেক বেশি স্মার্ট বেশ ভালো ইংরেজী বলে অনেক বন্ধু করে ফেলেছে এরমধ্যে ওর বাবা বেশ বড়লোক কোন একটা টি এস্টেটের ম্যানেজার।
বাবাকে কথাটা বলেছিলো মিষ্টি," বাবা ওর সাথে আমার ঠিক মেলেনা।ওরা অনেক বড়লোক কত জামাকাপড় আর জিনিস ওর।"
রবীন বুঝতে পেরেছিলো কিছুটা মেয়ের সমস্যা,হয়ত এখান থেকেই আছে নেই সমস্যার শুরু।তাই বলেছিলো," জামাকাপড়ে কি এসে যায় মিষ্টি।তুই তোর ভেতরের প্রতিভার আগুন জ্বালিয়ে দে দেখবি সবাই তোকে দেখবে।"
ওদের ফ্রেসার্স ওয়েলকামে মিষ্টিকে শাড়ি পরতে দেখে সুদীপা অবাক হয়ে ভেবেছিলো.." ইশ্ যতসব ব্যাকডেটেড কনসেপ্ট।" কোথায় ও শপিংমল থেকে একটা নতুন ড্রেসই কিনে ফেললো ফ্রেসার্স অ্যাটেন্ড করবে বলে সেখানে শাড়ি পরে যাচ্ছে।
" তোর অন্য কিছু ড্রেস নেই পরার মত? অবশ্য আমার একটা কিছু পরতে পারিস তো।"
হাসে মিষ্টি.." শাড়ি পরতে ইচ্ছে করলো রে তাই পরলাম। আমার খুব ভালো লাগে পরতে শাড়ি।বোনকে তো আমিই পরিয়ে দিতাম।"
নিজের মনে বকবক করতে থাকে মিষ্টি,ঠোঁট ওল্টায় সুদীপা।
বড় হলে সুন্দর করে সাজিয়েছে দাদা দিদিরা ওদেরকে ওয়েলকাম জানানোর জন্য।যদিও ভয়ে ভয়ে আছে ওরা কে জানে কি করবে এবার ওদের?
কে কি জানে বলতে অনেকে অনেক কিছুই করলো তবে সুদীপা বুঝতে পারলো মিষ্টি কেন আজ শাড়ি পরে এসেছে। ওকে কিছু করতে বলাতেই মিষ্টি ব্যাগ থেকে ওড়না বের করে কোমরে বেঁধে নাচতে থাকে ওর পরিচিত ছন্দে...সবাই তখন মুগ্ধ ওর নাচের মূর্ছনায়.. প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ।
কালচিনির মিষ্টি একদিনেই সবার কাছে পরিচিত হয়ে গেলো ওর নাচে। হাততালি দিতে দিতে ফিদা হয়ে গেলো অনেকেই,আলাপ হয়ে গেলো অনেক সিনিয়ারদের সাথেও সবাই প্রশংসা করলো ওর।
বাবার কথা আজ খুব মনে হলো মিষ্টির,প্রতিভার আগুন জ্বালিয়ে দিলে সেই আগুনের আলো সবার চোখেই পড়ে,ড্রেসে কি এসে যায়। ভাগ্যিস মা দুটো শাড়ি দিয়ে দিয়েছিলো সাথে,বলেছিলো.." যদি কখনো নাচিস ওখানে লাগবে তো।কোথায় পাবি?"
ও তখন বলেছিলো," মা আমি পড়তে যাচ্ছি ওখানে নাচবো কখন?"
সত্যিই কখন যে কি কাজে লেগে যায়....যে কোন শিক্ষাই বিফলে যায়না সময়ে সবই কাজে লাগে।
******************
নতুন শহর,নতুন কলেজ প্রথম বাড়ির বাইরে আসা সব মিলিয়ে মনে ছিলো একটু ভয় ভয় মিষ্টির।বাবাকে বললেই বাবা বলতো কুয়োর ব্যাঙ হয়ে থাকলে কি চলবে চিরকাল? বলতেই হবে থাকবোনা কো বদ্ধ ঘরে দেখবো এবার জগতটাকে। তাই বাবার কথা মেনেই জানতে শেখা আর চিনতে শেখা। চলে যাওয়ার আগেথ শেষ দিনে বাবা বলে গিয়েছিলো," এবার তোর জীবন আর লড়াইগুলো তোর তাই চলতে হবে একাই তোকে।লড়তেও হবে ঢাল তলোয়ার হাতে নিয়ে একাই।তবে খুব বড় যুদ্ধ লাগলে আমাকে তো আসতেই হবে।"
সত্যিই বাবা ছোটছোট কথাগুলো কি সুন্দর সাজিয়ে বলে।প্রতিটা কথার কত যে গভীর অর্থ থাকে ভেবেই অবাক লাগে মিষ্টির।
তাই টুকটাক ঝামেলা লাগলো,একটু করে সামলাতে শিখলো অবশ্য সামলাতে গিয়ে বারবারই মা বাবার মুখটা মনে পড়লো কখনো বা মিস্ করলো বোনকেও। বন্ধুদের কথাও মনে হলো খুব।এখানে এখনো তেমন কারও সাথে ভালো বন্ধুত্ব হয়নি।অবশ্য মিষ্টিই একটু দূরের থেকে সবটা দেখছে।দুষ্টু হলে এতক্ষণে বকবক করে মিশে যেতো সবার সাথে মিষ্টি অতটা পারেনা একটু ভয় পায় মনকে ধাক্কা দিতে।কি জানি ভালো বন্ধু যদি না হয় যাকে ভরসা করবে সে,আসলে ও যাকে ভালোবাসে মন থেকেই ভালোবাসে তাই হয়ত সেই কষ্টটা নিতে পারেনা।
তবুও পাখা মেললো মিষ্টি একটু একটু করে বন্ধুত্ব হলো অনেকের সাথেই। অনন্যা এখন অনেকেরই হার্টথ্রব। একটু শহুরে আধুনিকতার ছোঁয়াও লাগলো মিষ্টির চোখেমুখে। অনেকদিন বাদে জোজোর সাথে দেখা হয়েছিলো মেট্রোতে,অবশ্য সেদিন মিষ্টিই বলেছিলো ও নিউমার্কেট যাবে।
" তুই একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছিস এখানে? স্যার জানে? ওখানে তো ঘর থেকেই বেরোতিসনা।"
ফোনে খিলখিল করে হাসে মিষ্টি," এর আগেও একদিন গেছিলাম,সেদিন একটু ভয় করছিলো অবশ্য সেদিন একজন ছিলো সাথে ও চিনিয়ে দিয়েছে। তবে এখন আর করেনা,মাঝে মাঝে যাই তো।"
" একা এতো ঘুরিসনা,আমাকে তো বলতে পারিস আমিই যেতে পারি তোর সাথে।" জোজো বলে।
" কেন রে তোকে আমার লোকাল গার্জেন করে এখানে পাঠিয়েছে নাকি বাবা?"
জোজো ওদিক থেকে হুম বলে একটা হাসি দেয়।
মিষ্টিকে দেখে অবাক হলো জোজো,ভালোও লাগলো তবে মেলাতে পারলোনা কালচিনিতে দেখা সাদামাটা দুই বিনুনী বাঁধা ফর্সা চুপচাপ মেয়েটার সাথে। শহরের আধুনিকতার ছোঁয়ায় অনেকটা শহুরে সুন্দরী মিষ্টি। তাই হেসে বললো..." ওয়া এই কদিনেই তো খুব অন্যরকম হয়ে গেছিস।"
মিষ্টি হাসে," ওয়াটা আবার কি শুনি? ইংরেজী কলেজে শেখা নাকি?"
" ওয়া মানে আমি তো চিনতেই পারছিনা,দুষ্টু দেখলেই কামড়ে দেবে বা পেয়ারা ছুঁড়বে।"
হাসি মজাতে সেদিনের বিকেলটা খুব ভালো কাটলো দুজনেরই। মিষ্টি বললো ও বাড়ি যাবার জন্য দিন গুনছে।কবে যে পুজোর ছুটি আসবে এখন সেই অপেক্ষায় দিন গোনা।
ক্যালেন্ডারে লাল পেন্সিল দিয়ে দাগ দেয় দুষ্টু আর একমাসও নেই পুজো আসতে দিদি আসবে পুজোতে কত আনন্দ হবে। জানলার বাইরের শিউলি ফুলের গাছটায় কত ফুল ধরছে,মাটি মাখছে ফুলের ছোঁয়া আনন্দে।হাতের মুঠোয় ভরে ফুল এনে ছড়িয়ে দেয় দুষ্টু ওদের সামনের ঘরে রাখা দুর্গাঠাকুরের ফটোর সামনে। মনটা ভরে যায় ফুলের গন্ধে।দুষ্টুর কল্পনার রঙ আর মন ঘুরে বেড়ায় পড়ার ফাঁকে দিদি আর জোজোদার সাথে। দিদির কাছে মাঝেমাঝেই কত গল্প শোনে ওদের কলেজের আর হস্টেলের।
" বাবা দিদি এসে কদিন থাকবে তো এখানে? আমরা একদিন মণিমার বাড়িতে যাবো তো?"
রবীনের মনেও অপেক্ষা মিষ্টির জন্য সত্যিই মেয়েটা অনেকদিন বাইরে আছে।দেখতে দেখতে দুমাস হয়ে গেলো।যদিও প্রতিনিয়ত যোগাযোগের ব্যবস্থা মোটামুটি হয়ে গেছে,বাড়িতে ল্যান্ডফোন অনেকদিন ছিলো এখন প্রয়োজনের তাগিদে মিষ্টিকে মুঠোফোন দিতে হয়েছে রবীনকে। তবে দুষ্টুর ভরসা শুধুই কম্পিউটার তাতে পড়াশোনার কাজ অনেকটাই হয়।আর মাঝেমাঝে দিদির সাথে মেলে যোগাযোগ, কখনো জোজোদাকেও মেইল করে টুকটাক কথা জিজ্ঞেস করে তবে সেই প্রথম চিঠিতে প্রথম ভালোবাসার আমন্ত্রণ সত্যিই আজ ইতিহাস। জানেনা কোনদিন তা পূরণ হবে কিনা? আচ্ছা সত্যিই কি মন দিয়ে কিছু চাইলে পাওয়া যায়? নাকি যা ঘটার তাই ঘটে? একদিন মায়ের কাছে জানতে চাইলো দুষ্টু।
অনু আশ্চর্য হয়ে গেলো মেয়ের প্রশ্নে...কি উত্তর দেবে ভেবে পেলোনা।তবুও বললো," মনের আশাটাকে না একদম অনেক উঁচুতে রাখবি।বড় বড় স্বপ্ন দেখবি।"
দুষ্টু মায়ের কোলে মাথা রেখে বলে," আশা বড় রাখবো? আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখবো? ধ্যাৎ তা কি কোনদিন পূরণ হবে নাকি?"
অনু হেসে বলে," আমার ঠাকুমা বলতেন আশা নাকি বেশি করতে হয়,স্বপ্ন দেখতে হয় অনেক বড় তাহলে তার সিকিভাগ হলেও পূরণ হয়। বড় স্বপ্নের সিকিভাগ বড়,ছোট স্বপ্নের সিকিভাগ তো এইটুকু। এই দেখনা আমি এত ছোট স্বপ্ন দেখেছি যে পূরণ হলো আর কই?"
দুষ্টু যেন একটা কষ্টের ছোঁয়া পায় মায়ের মুখে..কেজানে সুখ পাখিটা বোধহয় মাকে সব সুখের খোঁজ দেয়নি।সত্যিই কি মানুষ সবসময় একদম একশোভাগ খুশি হয়?
দার্শনিকের মত মাকে বলে.." আমরা তোমাকে অনেক অনেক সুখ আর সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেবো।"
রবীন অবেলায় দুষ্টুকে গড়াগড়ি করতে দেখে বলে,"মন দিয়ে পড়াশোনা কর,এতদিন বলিনি কিন্তু এবার বলছি।এই দুটো বছর একটু কষ্ট করলে সারাজীবন ভালো থাকতে পারবি।"
মেয়েকে কথাটা বলে রবীন নিজেই ভাবে,কথাটা কি সত্যি? আসলে লড়াইটা সারাজীবনই চলে,কখনো স্বাধীনতা পাবার জন্য লড়াই আবার কখনো স্বাধীনতা রক্ষার লড়াই। কখনো ভালো থাকার লড়াই কখনো ভালো রাখার লড়াই।
অনু আজকাল রবীনের আচরণে অবাক হয়,রবীন এখন হঠাৎই আগের থেকে একটু কড়া আর মেজাজী হয়েছে।কখনো সেই রাগ মেয়েদের মনেও দাগ কাটে।এই সেদিনই দুষ্টুকে বললো," আমার একার রোজগার, অনেক কষ্ট করেছি জীবনে। সুতরাং এমনভাবে তৈরি হও যাতে নিজের যোগ্যতায় ভালো জায়গায় যেতে পারো।"
বাবার কথা মনে বেঁধে দুষ্টুর,অনুরও খারাপ লাগে শুনে।মেয়ের আড়ালে রবীনকে বলে," অমন করে বললে কেন?"
" জীবনে কষ্ট করে মানুষ হতে দাও অনু,ওদেরও আমাদের কষ্টটা বুঝতে দাও। দীপ্তর মত কত ছেলে আছে যাদের টাকার অভাবে পছন্দ অপছন্দ সবই চলে যায় একসময়।"
অনু বুঝতে পারে রবীন হয়ত নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায় দীপ্তর মাঝে। তাই মনে লাগে ছেলেটার না পাওয়াটা।
******************
দেখতে দেখতে পুজো এলো,রবীন মিষ্টিকে আনতে যাবো বললেও মিষ্টিই বারণ করলো।বারণ করলো রাণুও.." জামাইবাবু, দিদিভাই যাচ্ছে কলকাতা ওদের একদিন ঠাকুর দেখিয়ে সপ্তমীতে এখানে আসবে। আপনারাও চলে আসবেন এখানে।একটা দিন সবাই আনন্দ করবো তারপর নবমীতে যাবেন।"
রবীনের আর কিছু বলা হয়না শালীর আব্দারে। দুষ্টু বাবার মুখের দিকে তাকায়, আজকাল বাবা মাঝে মাঝে একটু অস্থির হয়ে যায় প্রেসার বেড়েছে। দুষ্টু বোঝে বাবা একটু বেশিই চিন্তা করে আজকাল,মাঝে মাঝে টের পায় স্কুলের অশান্তির কথাও। তাই বাবাকে কিছু বলেনা।
রবীন হাসে," নে এবার তৈরী হয়ে নে যেতে হবে মাসির বাড়ি।দিদি ওদের সাথেই আসবে।"
মনটা আনন্দে নেচে ওঠে দুষ্টুর মণিমাদের বারান্দা থেকেই দেখা যায় পুজো।সারারাত কত লোক দেখে ঠাকুর।ওরা বারান্দায় বসে জমিয়ে গল্প করে আর খাবার কিনে খায়।
কল্পনার সুতোগুলো আল্পনা দেয় দুষ্টুর আনমনা মনে।তবুও খাতা বই টেনে নিয়ে বসে মোটাসোটা বইগুলোতে মন দিতে।
********************
পুজোর বাদ্যি বেজেছে,কাশফুলেরা আদরে মাখামাখি করে বলছে শরত এলো।আকাশে ছেঁড়া মেঘেরা নিয়ে এলো আনন্দের চিঠি মণিমার বাড়িতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দুষ্টু। বাবা আর পারেনি অপেক্ষা করতে একটু এগিয়ে গেছে। রাস্তায় চোখ রাখে দুষ্টু ঐ তো দিদি আসছে,ওরা সবাই আসছে।জোজোদাও আসছে।
মিষ্টি এসে জড়িয়ে ধরে দুষ্টুকে,দুষ্টু অনেকদিন বাদে দিদির ছোঁয়া আর গন্ধ পায়।কিন্তু এই গন্ধটা কেমন যেন অচেনা,এই কয়েকমাসে দিদি বেশ অন্যরকম হয়ে গেছে।দিদির লম্বা চুল স্টেপস কাটে কাটা,হাতের নখ মুখ সবই বেশ অন্যরকম লাগছে। দুষ্টু বুঝতে পারে কলেজ আর স্কুলের মধ্যে কোথাও হয়ত একটা ফারাক হয়। স্কুলটা নিয়মে বাঁধে,কলেজ নিয়মে বাধ সাধে।
রবীনও অবাক হয়েছে মিষ্টিকে দেখে তবুও বাড়ির সবাই বলে উঠলো..." ওমা মিষ্টি এই কদিনেই তো একদম পাল্টে গেছিস!"
আদুরে গলায় মিষ্টি বলে," কেন গো? সত্যিই বদলে গেছি মা? আমাকে ভালো লাগছেনা? আরে চুল এতো উঠছিলো ছোট করে ফেলেছি।"
দুষ্টু বলে ওঠে," খুব স্টাইলিশ লাগছে রে।"
জোজো পাশ থেকে বলে," আর আমাকে বদলানো লাগছেনা?"
" তুই একই আছিস,শুধু একটু মোটু হয়েছিস।"
রবীন পাশ থেকে বলে," এক থাকাই ভালো।" বাবার কথাটা কেমন যেন লাগে মিষ্টির।
তবুও সব কিছুর মাঝে শুধুই আনন্দে ভরলো বাড়ি।অনেকদিন বাদে বাড়ির ছেলেমেয়ে বাড়িতে ফিরলো।
******************
পুজোর গন্ধে মেতেছিলো শহর আর প্রকৃতি,বছরভর সবাই অপেক্ষা করে এই চারটে দিনের জন্য। তার মধ্যেই রাণুদের বাড়িতে খুশির ঝুড়ি নিয়ে এলো বাইরে থাকা দুটো ছেলেমেয়ে। বাড়িতে সব মিলিয়ে চারটে ছেলেমেয়ে রবীন অনু আর ওরা তাই একটা দিন শুধুই খাওয়াদাওয়া আর হৈ হুল্লোড়। জোজোর সাথে দুষ্টু মিষ্টি পাড়ার ঠাকুর দেখতে গেলো।এই বয়সে পুজোর সাজে মন আর চোখ সবই তখন বাধনহারা, দুষ্টু মিষ্টিকেও অনেকেই দেখলো। মিষ্টি আজকাল অন্যের চোখের মুগ্ধতার ভাষা বোঝে তাই প্রজাপতির মত পাখনা মেলে ভাসিয়ে নিতে শিখেছে নিজেকে।
জোজোরও বেশ নিজেকে অন্যরকম লাগে কারণ ওর দুদিকে দুষ্টু আর মিষ্টি।পুজোর দিনে পাশে সুন্দর কাউকে নিয়ে হাঁটার আনন্দই আলাদা।
ওখানে কয়েকটা বন্ধুর সাথেও দেখা হয় ওরাও দুষ্টু মিষ্টিকে দেখে।জোজোকে একটু আড়ালে নিয়ে ক্ষ্যাপায়..." ইশ্ কলকাতাতে থেকে তো দারুণ ব্যাপার হয়েছে তোর! সকালবেলাতেই সাথে সুন্দরীদের নিয়ে একদম প্যান্ডেলে? আলাপ করিয়ে দে না? আমাদের দিকে তো ফিরেও তাকালোনা। তোর বান্ধবী মানে ঐ গার্লফ্রেন্ড কোনটা? ঐ ভাসা চোখের মডেল নাকি? দারুণ লম্বা কিন্তু।"
দুষ্টু মিষ্টি জোজোকে খোঁজে।জয় বলে," ঐ তো দাদা ওদিকে আড্ডা দিচ্ছে।"
দুষ্টু বলে," অমন বলতে নেই,বল দাদা গল্প করছে।"
জোজো বুঝতে পারে ওরা দুষ্টুর কথা বলছে, তাই বলে," ও লম্বা মডেলকে পছন্দ? যা না গিয়ে প্রপোজ কর একদম ঠেঙিয়ে বৃন্দাবনে পাঠিয়ে দেবে। আগে ও ঠ্যাঙাবে তারপর আমি। আরে ওরা আমার বোন হয় কাম্মার দিদির মেয়ে।"
খুনশুটি আর হাসাহাসিতে কিছুটা সময় কাটিয়ে জোজো ফিরে আসে।ভালো করে এবার দেখে দুষ্টুকে, ও ভাবতেই পারেনি মিষ্টির পাশে দুষ্টুকে দেখে কেউ ফিদা হতে পারে।
কাছে এসে দুষ্টুর দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে জোজো। হঠাৎই জোজোকে অমন করে দেখতে দেখে একটু লজ্জা পেলেও অবাক হয় দুষ্টু। মনে হয় সত্যিই কি ও বড় হয়েছে তাই জোজোদা ওকে অবাক হয়ে দেখছে? নাকি ওকে দেখতে বিচ্ছিরি লাগছে? দিদিটা এমন বিদঘুটে সাজিয়ে দিলো! তারপর জোর করে একটা স্কার্ট আর টপ পরিয়ে দিলো।কিছু করার নেই উনি এনেছেন সুতরাং পরতেই হবে। কে জানে কেমন লাগছে? ঐ ছেলেগুলোও তো ওকে দেখছিলো। মনে হয় দিদির আনা ঐ হিল তোলা জুতো আর স্কার্টে ওকে বিচ্ছিরি লাগছে। তাই জিজ্ঞেস করেই ফেলে..." এই কি দেখছিস শুনি? আমি কি চিড়িয়াখানার বাঘ?"
জোজো হেসে বলে," না বাঘিনী,তবে সবাই বলছে সুন্দরী বাঘিনী। একদম র্যাম্পে হাঁটা মডেলের মত।"
খুব রাগ হয় দুষ্টুর বলে," আমি বাড়ি যাবো এবার,আর থাকবোনা।"
মিষ্টিও যোগ দেয় ওদের আলোচনায় আর এক ঝলক হাসি মজায় জমে ওঠে পুজোর সকাল।
মিষ্টি বলে," ইশ্ আমাকে কেউ দেখছেনা,সবাই তোকেই দেখছে।"
ঠোঁট বেকায় দুষ্টু, যতসব উল্টোপাল্টা ছেলের সাথে জোজোদার বন্ধুত্ব।আমি কি ওদের দেখতে বলেছি?
বাড়িতে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায় দুষ্টু,একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিজেকে। মিষ্টি এসে পাশে দাঁড়িয়ে বলে," বোন তুই সত্যিই বড় হচ্ছিস এবার। এই কয়মাসে বেশ অনেকটা বড় হয়ে গেছিস। মায়ের আর বাবার পুরো আদরটা খাচ্ছিস তাই বোধহয় তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেলি।"
ওদের কথার মাঝে রাণু আসে.." কি হয়েছে রে? জোজো বললো,কারা যেন দুষ্টুকে দেখে ফিদা হয়ে গেছে?আমি তো তখনই বলছিলাম খুব ভালো লাগছে তোদের।দুষ্টু সত্যিই অনেকটা বড় হয়ে গেছে।"
রাগের মাঝেও দুষ্টুর ভালো লাগে,ও তো বড় হতেই চায়। অনেক বড়। যখন আর কোন ভয় থাকবেনা একদম খুলে মনের কথা বলতে পারবে।
বাবা মা আর এই বাড়ির সবার সাথে সন্ধ্যেটা বেশ ভালো কাটলো ঠাকুর দেখে আর খাবার দাবার মানে ফুচকা,রোল,কোল্ডড্রিঙ্কস খেয়ে।মেসোর কাছে বায়না করা মাত্রই সব এসে যাচ্ছে সবার জন্য। পুজো মানেই অনেক মজা,আড্ডা,খাওয়া দাওয়া। পুজো মানেই হঠাৎই প্রেমে পড়ে যাওয়া। দুষ্টুর মনের মাঝে লুকোনো প্রেমটা আবার ডানা ঝাপটালো।
রাতে অনেকক্ষণ ঘুম এলোনা, মনে উড়ু উড়ু শরতের হিমেল হাওয়া। কালই তো ওদের চলে যাওয়া তাই আবার কবে দেখা হবে কে জানে।
পরদিন ভোরবেলাতে উঠেই চলে আসা ওদের, ঘুম চোখে উঠে জোজো হাত নাড়ে.." ভালো করে পড়িস,আর তোরও তো সময় চলে আসছে বাইরে যাবার।"
মনের কিছু কথা মনের গহীনে বন্দি করে ফিরে আসা নিজেদের সবুজে ঘেরা বাড়িতে। রবীনও নিশ্চিন্ত হলো দুই মেয়েকে কাছে পেয়ে ওরাও মাতলো সেই আগের মত খুনশুটিতে...অনু রান্নাঘর থেকে চিৎকার শুনলো," মা দেখো দিদি কি করছে।"
আরেকদিকে মিষ্টির কথা শোনা যায়," মা আমি তো চলে যাবো কদিন বাদে তবুও কেমন করছে দেখো।"
রবীন ইশারা করে অনুকে "যেয়োনা,ওদের এটাই টাইমপাস।একটু বাদেই দেখবে দুটোতে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে।"
বিজয়া দশমীর মিস্টি,লক্ষ্মীপুজোর নাড়ুমোয়া খেয়ে আবার মিষ্টি চড়লো ঝিকঝিক গাড়ি মানে ট্রেনে, মনে জমলো মন খারাপের মেঘ কুয়াশা। দুষ্টুরও চোখের পাতা ভিজলো ইশ্ কি তাড়াতাড়ি চলে গেলো দিনগুলো!
*******************
মিষ্টি চলে যাওয়ার পর অনেকগুলো দিন কেটে গেছে আবার ছন্দে ফিরেছে ওরা সবাই। সকালে রবীন বাইরে হাঁটতে গিয়ে ফিরে এলো একটু হৈ হৈ করে অনু আসতেই ওর হাতে নকুলের দোকানের মিস্টি আর বাজারের থলেটা দিলো।
অনু অবাক হলো দেখে.." কি ব্যাপার গো? সকালে মিস্টি কেন? কেউ আসবে?"
রবীন বলে," এই একটু বাদেই আসবে।রাস্তায় দেখা হলো তাই একেবারে খেতে বলে দিলাম। অনেকদিন বাদে আসছে ছেলেটা।"
অনুর আর বুঝতে বাকি রইলোনা দীপ্ত আসবে। অনু খুব একটা খুশি হয়না,কেন যেন ওর মনে হয় রবীন গোপনে সাহায্য করে ঐ ছেলেটাকে। রবীনের হয়ত সত্যিই ভেতরে ভেতরে ছেলের শখ ছিলো।এমন সব চিন্তা কেমন যেন ভাবায় ওকে। মিষ্টিও খুব একটা পছন্দ করেনা দীপ্তকে,বরাবরই ওর সাথে মিষ্টির একটা প্রতিযোগিতা ছিলো।
রবীনের এই একটা অভ্যেস দুঃস্থ ছাত্র আর দুঃস্থ মানুষ দেখলে ঠিক থাকতে পারেনা।কতদিন রবীনের আব্দারে এমন কতজনকে খাওয়াতে হয়েছে অনুকে।
দীপ্ত আসাতে রবীনের ভালো লাগে, এই ভালোবাসাটুকু পেতেই হয়ত ওর আসা এখানে। তবে দুষ্টুর একটু সঙ্কোচ হয় দীপ্তদার সাথে আগের মত কথা বলতে পারেনা।
" তুই মাঝে মাঝে এসে দুষ্টুকে একটু গাইড করিস বুঝলি আমার এখন এত চাপ বেড়েছে সময়ই হয়না।"
অবাক হয়ে যায় দীপ্ত," আমি! আমি তো সবই শিখেছি আপনার কাছে। আর দুষ্টু নিজেই ভালো পড়াশোনাতে।"
ঘরের ভেতরে একটু গজগজ করে দুষ্টুও,বাবা যে কি? দুষ্টু বেরোয়না দীপ্তর সামনে।আজ এই বাড়িতে এসে কেমন যেন বোকা বোকা লাগে দীপ্তর,একটু খারাপও লাগে। মনে পড়ে যায় ওদের একসাথে পড়ার কথা। দুষ্টু একবারও এলোনা,তবে কি খুব পড়ছে?
স্যারের অনুরোধে খেতেই হলো,খাবার টেবিলে দুষ্টুকে দেখলো দীপ্ত। দুষ্টু যেন অনেকটা বড় হয়ে গেছে এই কয়েকমাসে।
টুকরো কথা বলে দীপ্ত," মিষ্টি আর জোজো কেমন আছে?"
" দিদি ভালো আছে,ফোন করে তো।জোজোদার কথা জানিনা। কেন তোমার কাছে ফোন নম্বর নেই?"
" আমার কোন ফোন নেই তবুও নম্বর দিস যদি পারি কথা বলবো। তোর পড়াশোনা ঠিক চলছে তো?" দীপ্ত বলে।
" হ্যাঁ ঠিকই আছে। তুমি মন দিয়ে পড়ো।"
দীপ্ত বুঝতে পারে দুষ্টুর কথার ইঙ্গিত যে ওকে পড়াতে আসাটা দুষ্টুর পছন্দ নয়।
*******************
এক ঘরে থাকতে থাকতে সুদীপার সাথে ভালোবাসা বন্ধুত্ব হয়ে গেছে মিষ্টির। ওকে এখন কলেজের অনেকেই চেনে এমনকি স্যারেরাও। মেয়ের কাছে ওর কলেজের কথা শুনে অনেকটা নিশ্চিন্ত হয় রবীন।দেখতে দেখতে একটা বছর কেটে গেছে। দুষ্টুরও ক্লাশ টুয়েলভে পা দেওয়া হলো আর মিষ্টির একবছরের অভিজ্ঞতাবৃদ্ধি। আজকাল মিষ্টিকে অনেকটা পরিণত লাগে রবীনের।
স্কুলের নানা ঝামেলার মধ্যে ঐ টুকুই শান্তি। রাজনৈতিক আবহাওয়ার পরিবর্তন দেশজুড়ে অনেক সময়ই উঠছে অশান্তির ঝড়।সেই অশান্তির আঁচ ওদের স্কুল থেকে একটু দূরে আরেকটা স্কুলে লাগলো।খবর পেলো রবীন কারা যেন চরম হেনস্থা করেছে সেখানকার হেডমাস্টার মশাইকে।
অনু শুনে আরো সাবধান হতে বলে রবীনকে.." শোন মেয়েরা এখনো ছোট,দুষ্টু স্কুলে যায়।তুমি কোন ঝামেলায় যাবেনা। খবরের কাগজে পড়ছো নাকি পড়ছোনা?"
খবরের কাগজ প্রতিদিন পড়ে রবীন তবে সেদিনের খবরে চমকে ওঠে... ছাত্রনেতার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে কিছু দুষ্কৃতী, গুরুতর জখম অবস্থায় হসপিটালে ভর্তি।নামটা দেখে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনা রবীন...দীপ্ত!
*************
দীপ্ত নামটা দেখে আর পারেনা নিজেকে ঠিক রাখতে রবীন।তাড়াতাড়ি গিয়ে টিভিটা খোলে,টিভি দেখে অবাক হয়ে যায় রবীন,আজ টিভিতে শুধুই উত্তরের অশান্তির খবর। দীপ্ত তাহলে নিজেকে খবর বানিয়েই ছাড়লো! একবারও মনে পড়লোনা ওর স্যারের কথা? স্যারকে একবার তো জিজ্ঞেস করতে পারতো?
রবীনের মনে পড়ে গেলো ওদের সাথে পড়া মৃগাঙ্কের কথা,অদ্ভুত উজ্জ্বল চোখ ছিলো মৃগাঙ্কের। কাঁধে কাপড়ের ঝোলা,ঢিলে প্যান্ট আর খাদির জামা পরা মৃগাঙ্কের একটা পরম সম্পদ ছিলো ওর চোখ আর বুদ্ধি। কতদিন ঠোঙা থেকে মুড়ি চিবোতে দেখেছে মৃগাঙ্ককে ওর গমগমে গলার বক্তৃতায় কাঁপন ধরতো সবার বুকে।
রবীনের তেমন ভাবে সক্রিয় রাজনীতি কখনোই ভালো লাগতোনা। তবুও মৃগাঙ্ককে অনেক সময়ই সাহায্য করেছে কিন্তু অনেকদিন বাদে একটা সময় ছেঁড়া প্যান্ট আর ময়লা জামার মৃগাঙ্ককে দেখে চমকে উঠেছিলো রবীন বইমেলার বাইরে তখনো রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করছে। এ এক নেশা যে নেশা রক্তে ছড়িয়ে পড়ে।সবাই সুযোগের জন্য রাজনীতি করেনা অনেকে আদর্শকে ভালোবেসে আসে রাজনীতিতে কিন্তু একটা সময় হারিয়ে যায়।
মৃগাঙ্ক চোখদুটোতে জ্যোতি জ্বালিয়ে বলেছিলো," ভালো আছিস? ওর গমগমে গলাটা তখনো একরকম।"
" তুই এখানে?এখনো দলে আছিস?"
" ছাড়তে পারলাম আর কই?"
অনেকটা নচিকেতার গানের স্টাইলে বলেছিলো..আমার তো এখানেই থাকার কথা ছিলো বন্ধু। কিছু বলতে পারেনি আর রবীন।
আজ অনেক দিন বাদে মৃগাঙ্ককে খুব মনে পড়লো রবীনের। গলাটা আটকে এলো কে জানে দীপ্তও কি তেমন হবে? মৃগাঙ্কের মত? দীপ্তর শিক্ষার আগুন কি জ্বলবেনা?
মনটা বিষাদে ভরে গেলো,হঠাৎই মনে হলো দীপ্ত তো ওর কেউ নয় শুধুই ছাত্র। পরক্ষণেই অন্তরাত্মা বিদ্রোহ করে সহস্র স্বরে বলে উঠলো...দীপ্ত আমার ছাত্র,খুব প্রিয় ছাত্র।দ্রোণাচার্যের যেমন অর্জুন। নিজের হাতে গড়ে পিটে সেই আগুন জ্বালিয়েছিলাম। আচ্ছা দীপ্ত বাঁচবে তো?
অনু আর দুষ্টু যে কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারেনি। দুষ্টু বাবার ঘাড়ে হাতটা রাখে। অনু বলে," ভালো হয়ে যাবে ভেবোনা,আমি ঠাকুরকে বলেছি।"
অবাক হয়ে যায় রবীন যে অনু পছন্দ করতোনা রবীন সাহায্য করুক দীপ্তকে সে? তাই বলে.." তুমি ঠাকুরকে বলেছো?"
" আমিও তো মা নাকি? ওর মা যে কি করছে? গরীব ঘরের মেধাবী ছেলে।ভালো থাক ছেলেটা মায়ের কোলজুড়ে।"
অনুর মধ্যে আজ মাতৃত্বের ছোঁয়া পায় রবীন। ফোনটা বাজে মিষ্টি ফোন করেছে.." বাবা শুনেছো? দীপ্ত রাজনীতি করছে তুমি জানতে?"
রবীন গম্ভীর হয়ে বলে," তোমরা সব বড় হয়েছো,কে কি করছো সব কি আমাকে বলে করো? আর ও আমার কে? কত ছাত্রই তো এমন আসে যায় প্রতিবছর।"
মিষ্টি বুঝতে পারে বাবা ওর ওপরেও অসন্তুষ্ট, কয়েকদিন আগে একটা অ্যাড এজেন্সিতে মডেলিং করার অফার এসেছে বলে বাবাকে জানিয়েছিলো ও ওটা করবে। রবীন বাধা দেওয়াতে মনক্ষুণ্ণ হয়েছে মিষ্টি।অনুকে বলেছে বাবা কি চিরকাল সেই পুরোনো আদর্শ নিয়ে থাকবে?
অনু বলেছিলো," বাবা চায়না এখন পড়াশোনা ছাড়া অন্য কিছু তুই কর তাই হয়ত বলেছে। তারপর কেমন লোকজন হবে,তোর কোন বিপদও হতে পারে।"
রবীনের কানে সবটাই এসেছিলো,খারাপ লেগেছিলো বুঝতে পেরেছিলো একেই বোধহয় পরিবর্তন বলে।মানতে পারলে ভালো, না মানতে পারলেই কষ্ট।
মিষ্টি অনেকক্ষণ মা আর বোনের সাথে কথা বলে ফোন রেখেছে। জোজো ওকে ফোন করেছে.." শুনেছিস?"
" হ্যাঁ, শুনেছি,দেখেছি।"
" আমি তো ভাবতেই পারছিনা দীপ্ত। সেই দীপ্ত,যার সাথে চারটে কথা বললে একটা উত্তর দিতো।"
" না রে ভালো কথা বলতো,যেটা বলতো সেটা খুব গুছিয়ে। হয়ত এভাবেই নিজেকে সেলেব করে নিলো সবাই তো ওর নামটা জেনে নিলো।"বললো মিষ্টি।
অবাক হলো জোজো কেমন যেন কথা বলে আজকাল মিষ্টি।ও কি দীপ্তকে অপছন্দ করে? তবে জোজোর খুব খারাপ লাগলো।
*****************
মনকে বুঝিয়েও বোঝাতে পারলোনা রবীন,বেশ একটা দিন কেটে গেছে উচিত অনুচিতের প্রশ্নে তবে যাবে কি একবার দেখতে?
খবরে শুনেছে,মাথার আঘাত গভীর হলেও অবস্থা স্থিতিশীল হসপিটালে ভর্তি। বারান্দায় পায়চারি করে রবীন।
দুষ্টু বলে," আমি জানি বাবা তোমার মন কেন ভালো নেই। তুমি দীপ্তদার কথা ভাবছো তাই না?
বাবা একবার যাবে দেখতে দীপ্তদাকে।"
অভিমানে মনটা ভিজে যায় রবীনের, কই ওকে তো জানায়নি কখনো এখন কি করছে।সেই যে পুজোতে এসেছিলো আর পাত্তা নেই।ছাত্র এখন বড় নেতা,চারপাশে মিডিয়া, কত লোকজন।কি করবে সেখানে গিয়ে?
ফোনটা বেজে ওঠে কড়কড়ে আওয়াজে,হাত বাড়ায় অনু।রবীন বুঝতে পারে রাণু ফোন করেছে।
ওদের কথার মাঝে অনু ইশারায় রবীনকে ডাকে। মধুমিতা কথা বলছে তখন..." দাদা বলছিলাম কি আমি ভাবছিলাম একটু দীপ্তকে দেখতে যাবো।এখানেই তো ভর্তি।আসলে জোজো খুব ব্যস্ত হয়েছে।সত্যিই একটা সময় অনেক সাহায্য করেছে জোজোকে, একদম আগলে রেখেছিলো।"
রবীনের ইচ্ছে করে যেতে, শাসন করতে ছেলেটাকে ঠিক যেমন করতো স্কুলে তবুও ইগোতে লাগে। বলতে পারেনা। মধুমিতাই বলে," আপনি একবার গেলে ভালো হত,ও একটু সাহস পেতো।"
ইচ্ছেটাকে আর দমন করতে পারেনা রবীন, সত্যিই একবার দেখতে ইচ্ছে করছে ছেলেটাকে। অনু মাথা নাড়ে,দুষ্টু বাবার দিকে তাকায়।রবীন বলে.." আমি যাবো কাল।"
মধুমিতা খুশি হয়," তাহলে একসাথে যাওয়া যাবে।"
********************
মাথায় মোটা ব্যান্ডেজ বাঁধা অনেকগুলো স্টীচ তবুও আজ একটু ভালো লাগছে দীপ্তর। মা এই দুদিন হসপিটালের বাইরেই রয়ে গেছে। আজ একটু চোখ মেলে তাকানোতে দিদি এসে জোর করে নিয়ে গেছে। তবুও চোখ বুজে আসে ঘোরে,কতবার যে এই অবস্থায় এক কথা বারবার বলতে হয়েছে।শিশিরদা শিখিয়ে দিয়েছে কি বলতে হবে.. বলেছে তার বাইরে একটা কথাও বলবিনা।
রাজনীতিও গতে বাধা,স্বাধীন কেউ নয়।কখনো বেড়ি পড়ে পায়ে আবার কখনো বা মুখে বাঁধা থাকে নিষেধের চাদর।
আধো ঘুমে স্বপ্ন দেখে দীপ্ত সেই পেয়ারা গাছটার।গাছের নিচে চেয়ারে বসে থাকা শ্যামলা লম্বা তেজস্বী একটা মানুষ...ওকে যেন বলছে আগুনটা নিভতে দিসনা। ঘুমের মধ্যেই আধা নেভা মশালটা থেকে কেরোসিনের গন্ধ পায় দীপ্ত। স্কুলের স্পোর্টস যখন হত প্রথমে মশালটা দৌড়ে গিয়ে জ্বালিয়ে নিয়ে সবার আগে থাকতো ও।
হঠাৎই কপালে সেই চওড়া একটা হাতের ছোঁয়া পায়....অনেক দূর থেকে কে যেন ডাকছে..দীপ্ত,নিভতে দিসনা আগুনটা।
চোখটা খোলে দীপ্ত...ক্লান্ত গলায় বলে," স্যার আপনি সত্যি এসেছেন?"
" না এসে পারলাম কই।"
******************
স্যারের মুখের দিকে ভালো করে তাকাতে পারেনা দীপ্ত,চোখদুটো ফুলে আর চোখের জলে কেমন যেন একটা ভারী হয়ে গেছে।যে কষ্টের জল লুকোনো ছিলো তা আজ চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
রবীন হয়ত ওর না বলা কথার অনেকটাই বুঝে যায় তাই বলে..." তোরা অনেক বড় হয়ে গেছিস এখন,নিজের সিদ্ধান্তে চলতে শিখেছিস। জানিনা কোন পথের দিশা তুই পেয়েছিস যার ঠিকানা আমাকে জানাসনি। তবুও বলবো যদি ফিরতে পারিস ফিরে আয় তোর জীবনের তোকে বড় প্রয়োজন।"
স্যারের শেষের দিকের কথাগুলো কেমন যেন ধাঁধার মত লাগে দীপ্তর কানে। জীবনের ওকে বড় প্রয়োজন, তাহলে কি ওর জীবনের সাথে যারা জড়িয়ে তাদের ওকে প্রয়োজন?
মধুমিতা কিছু ফল আর কমপ্ল্যান রাখে ওর পাশের টেবিলে বলে," জোজো খুব ব্যস্ত হয়েছে ওখানে তোমার কথা শুনে।আমাদের সবার মন খুব খারাপ। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো আবার তোমাদের দুজনকে গলা জড়িয়ে ধরতে দেখতে চাই।"
দীপ্ত মনে মনে ভাবে একটা সময়ের গভীর বন্ধুত্বের মাঝে দূরত্ব এসে গেলেও বন্ধুত্বটা বোধহয় এখনো আছে তাই উত্তীয় ওখানে থেকেও ব্যস্ত হয়েছে ওর জন্য।
ওদের কথার মাঝে অনেকগুলো ছেলে মেয়ে এসে ঢোকে। তারমধ্যে একটা ছেলে রবীনকে বলে," আপনারা কে? বাড়ির কেউ? এখন একটু বাইরে যেতে হবে মিডিয়া আসছে। এর বদলা আমরা নিয়েই ছাড়বো মারের বদলে মার খেতে হবে।"
রবীনের রক্তে দোলা লাগেনা বরং বুকটা একটু কাঁপে আতঙ্কে। মারের বদলে মার দিতে গিয়ে আবার কি এই নিরীহ ছেলেটাকে এগিয়ে দেবে এরা?
দীপ্ত বলে," শিশিরদা,এই আমার স্যার। সবসময় আমার পাশে থেকেছেন কালচিনি থেকে ছুটে এসেছেন আমার জন্য।"
শিশির সেইসব মাথায় ঢোকায়না,ও চায় শুধু পপুলারিটি।কতটা খাবে লোক এই ঝামেলাটা? মোটামুটি এই করে ওদের পার্টি আর কলেজ একদম লাইমলাইটে এসে গেছে।এক ডাকে সবাই চেনে ওকেও,টিভিতে কতবার দেখাচ্ছে ওকে।সবাই শুনছে ওর কথা।
একটা দায়সারা নমস্কার কপালে ঠেকিয়ে বলে," স্যার এখন আসুন,আসলে খুব ব্যস্ত আমরা এখন।আগুন জ্বলছে পুরো কলেজে।"
দীপ্তর মুখে একটা আশার আলো দেখেছিলো রবীন কথা বলার সময়,ওর চোখদুটো অসহায় লাগে.." এখনি চলে যাবেন স্যার।"
রবীনের অপমানিত লাগে চিন্তাও হয় কলেজের আগুনে এই ছেলেটাকে পুড়িয়ে ওরা ফায়দা নেবেনা তো? তাই বলে," আমি সবসময় আছি। দরকার মনে করলে যাস।"
স্যারের কথায় অভিমানের ছোঁয়া পায় দীপ্ত।এই কিছুদিন আগেও তো স্যার জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন।কত কি খাওয়ালেন।
দীপ্তর সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় রবীন ও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পারেনা। ততক্ষণে সামনে অনেকগুলো ক্যামেরা,শিশিরদা কথা বলছে ওকে দেখিয়ে। দীপ্তর মাথায় কিছু ঢোকেনা ওর মনে পড়ে যায় সেই প্রথম স্কুলে আসার দিনটার কথা।
পরপর ওর করা অঙ্ক দেখে স্যার বলেছিলেন আরে এ তো অঙ্কের জাদুকর। আগুন আছে তোর মধ্যে জিতবি বেটা। রবীনের সেই টেনে টেনে কথা বলা আজ বড় বেশি টানে দীপ্তকে।
*****************
হসপিটাল থেকে বাইরে এসে একটু খোলা হাওয়ায় শ্বাস নেয় রবীন,আজকাল নিজের জীবনের অনেকগুলো দিন পেরিয়ে বড় ভাবায় এই নবীন প্রজন্মের কথা ওকে। এরা কি করতে চায়? কোথায় যেতে চায়? যন্ত্র আর যান্ত্রিকতা কি এদের আত্মকেন্দ্রিক বানিয়ে ছাড়লো শেষ পর্যন্ত। শুধুই নিজেদের কথা ভাবে? পাবলিশিটি ফ্যান ফলোয়ার্সের যুগে রবীন ওর নিজের হাতে গড়া ছাত্রদের কথা মনে করে।ওরা কি ওর ফলোয়ার্স?
কে জানে একটা সময়ের পর হয়ত সন্তানই পিতাকে আর ছাত্র গুরুকে পথ দেখায়। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে রবীনের, হসপিটালে ওর ভালো লাগেনা কখনোই তবুও এক আত্মিক টানে ছুটে আসা।অবশ্য মধুমিতা বৌদি না বললে এভাবে আসা হোতনা,তাছাড়া কেন যেন অনুও সায় দিয়েছিলো।আসলে ছেলেটাকে অনেকদিন নিজের হাতে খাইয়েছে অনু।
রাস্তার দুধারের গাছগুলোতে বৈশাখের আমন্ত্রণের ছোঁয়া,নতুন পাতা সাজিয়ে অপেক্ষায় আছে নতুন বছরের আহ্বানে। রবীনের মনে হলো পঁচিশে বৈশাখে দীপ্ত গাইতো...এসো হে বৈশাখ এসো এসো। সত্যিই কি সব জরা,গ্লানি মুছে গিয়ে আবার শুচি হবে ধরা। মধুমিতার গাড়ি গেটের কাছে দাঁড়িয়ে।হাঁটা পথটুকু আনমনা হয়েই এগিয়ে আসে রবীন।
" দাদা,একটু জল খান।ভীষণ গরম পড়েছে।বাড়ি গিয়ে খাওয়াদাওয়া করে একটু বিশ্রাম নেবেন চলুন। সত্যিই দীপ্তকে দেখে খুব খারাপ লাগলো।তবে সেরে উঠছে এটাই শান্তি। প্রথমদিনে শুনে তো আমি কেঁপে উঠেছি খেতে পারিনি। আসলে আমিও তো মা। কে জানে আমাদের দুটো কলকাতাতে কি করছে?"
রবীনের মন ছুঁয়ে যায় মধুমিতার কথাগুলো, ও তো নিজেও বাবা তাই হয়ত মনে এতটা খারাপ লাগা।কিছুটা আঘাতের, কিছুটা বিশ্বাস ভাঙার। সত্যি তো মিষ্টি আর উত্তীয় কি করছে ওখানে কে জানে? মাঝে মাঝে মেয়েটাকে অচেনা লাগে।আগে নাচতো গাইতো এখন বেশি গান শোনে। কান সবসময় বন্ধ,সেখানে রবীনের সব কথা হয়ত পৌঁছতেই পারেনা।
****************
রাণু খুব খুশি হলো অনেকদিন বাদে জামাইবাবুকে পেয়ে," ইশ্ দিদি আর দুষ্টুকে আনলেই পারতেন খুব মজা হত।কতদিন দেখিনি ওদের।"
শালীর সাথে কথা বলে মনটা হাল্কা করলো রবীন," তুমি বরং চলো আমার সাথে ঘুরে আসবে কদিন কালচিনি থেকে।"
হাল্কা কথায় কেটে যায় মনের মেঘ রবীনের।নিশ্চয় সব ভালো হয়ে যাবে।দীপ্ত নিশ্চয় দেখবে নতুন আলোর দিশা। ওর সঙ্গী ছেলেটাকে কেন যেন ভালো লাগেনি রবীনের।ওর অভিজ্ঞতা বলছে ছেলেটা দীপ্তর মগজধোলাই করে একদম হাতের মুঠোতে ভরে ফেলেছে।আর ওর ধারালো মগজটাকে কাজে লাগাচ্ছে নিজেদের প্রয়োজনে।
সময় ঘড়িকে সবটা ঠিক করে দিতে বলে আবার ফেরা চাবাগানের কোলে রবীনের। অনু আর দুষ্টুও অনেকক্ষণ বসে শুনলো সব কিছু। রবীন দুষ্টুর দিকে তাকিয়ে বলে," আজকাল যেন মনে হয় এতদিন ভস্মে ঘি ঢাললাম।"
দুষ্টুর মনে দাগ কাটে বাবার কথাটা তাই নিজের মত করে গুছিয়ে বলে," ঐ ছাইয়ের মধ্যে থেকেই দেখবে একদিন ভস্মমেখে শিব উঠবে।"
রবীন অবাক হয়ে যায় মেয়ের কথা শুনে তারপর হোহো করে হেসে ওঠে জোরে।অনেকদিন বাদে বাবার প্রাণখোলা হাসিতে মন ভরে যায় দুষ্টুর নিজেই নিজের পিঠটা চাপড়ে নেয় খুশিতে যাক বাবাকে হাসাতে পেরেছে ও। রবীন মেয়ের মাথায় ওর চওড়া হাত রাখে.." দুষ্টু তুই কি এখন সাহিত্য করছিস নাকি? মানে লেখালেখি? দারুণ বললি তো! সাবাশ বেটা।"
অনেকদিন বাদে বেটা ডাকটা শুনলো বাবার কাছে দুষ্টু। মনটা ভালো হয়ে গেলো হঠাৎই। মিষ্টির সাথেও অনেক কথা বললো আজ রবীন।মিষ্টি বুঝলো বাবার মনটা আজ ভালো আছে। বাবা হয়ত ওদেরকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন তো দুষ্টুও দেখে কলেজের ফেস্টে ওর নাচ দেখে রুম্পার দাদা তো ওকে সিরিয়ালে কাজ করার অফার দিয়ে ফেলেছে। মিষ্টি পড়াশোনা বজায় রেখে যদি অভিনয় করে বাবার কেন যে আপত্তি বুঝতে পারেনা। অবশ্য সাহস করে সেই কথা বলতেই পারেনি বাবাকে। অ্যাড করার কথা শুনেই বাবা যা রেগে গিয়েছিল, বোনের কাছে শুনেছে মিষ্টি তারপর থেকে বেশ কয়েকমাস আসেনি কলকাতাতে। শেষে পরীক্ষার পর ও চলে গিয়েছিলো। রুম্পা তো মাঝে মাঝেই বলছে," ইশ্ এই সুযোগ কেউ ছাড়ে? এত সুন্দর ফিগার তোর!"
কে জানে বাবা,একদিন জোজোর সাথে দেখা হয়েছিলো ওকে দেখেই আওয়াজ দিলো প্রথমেই.." ইশ্ এত সেজেছিস কেন? তোকে তো সিম্পলই ভালো লাগে।"
মিষ্টি ক্ষেপে উঠেছিল," ইশ্ তোদের কলেজের মেয়েরা সাজেনা বুঝি?"
রাস্তায় তাই কিছু বললাম না,নাহলে গাট্টা মারতাম একদম।
জোজো হাসে," এই তো সেই চেনা গন্ধটা পাচ্ছি।"
চেনা অচেনা নানা রঙে জীবন চলতে থাকে নিজের আপন ছন্দে আর সময় ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে চলতে থাকে নিজের আনন্দে।
*******************
দীপ্ত সুস্থ হয়ে উঠেছে,রবীনকে একদিন ফোন করেছিলো। যদিও রবীন খবর পেয়েছে আগেই,তবুও ফোনটা পেয়ে ভালো লাগলো। মনে হলো সম্পর্কের সুতোটা আকাশে উড়ে হাতের নাগালের বাইরে চলে গেলেও একদম ছিঁড়ে যায়নি।
শুধু বললো," ভালো থাকিস,এগিয়ে যা নিজের লক্ষ্যে।"
এগিয়ে যাওয়াটা বোধহয় এত সহজ নয়,তাই শিশিরের কথা না শুনতেই সংঘাত বাঁধলো।" ওহ্ খবরে নাম তুলেই তোর শখ মিটে গেলো? ছাড়বো বলে চলে গেলেই হবে। তাহলে এসেছিলি কেন পার্টি করতে? সামনে ইলেকশন আসছে আমরা এবার জিতবোই তোকে সামনে রেখে।ছেলে মেয়েদের ভীষণ ইনফ্লুয়েন্স করেছে ব্যাপারটা।"
" কিন্তু শিশিরদা আমার সামনে পরীক্ষা,পড়ালেখা তেমন কিছু হচ্ছেনা একে শরীরের জন্য এতদিন হয়নি। আমরা খুব গরীব, ভালো জায়গায় সুযোগ পেয়েও যাওয়া হয়নি তুমি তো জানো।তাই পড়াশোনাটা আমার খুব ভালো করে দরকার।"
" সব ম্যানেজ হয়ে যাবে ঠিক ফার্স্ট ক্লাশ পেয়ে যাবি।অবাক হয়ে যায় শিশিরদার কথা শুনে দীপ্ত।"
শিশিরদা দামী সিগারেট খায়,ট্যাক্সি চড়ে কখনো আরো অনেক কিছু করে যা বলতে ইচ্ছে করেনা দীপ্তর।একটু একটু করে সব বুঝেছে দীপ্ত। আজকাল মনে হয় যদি কিছুদিন কোথাও চলে যেতে পারতো। কিন্তু কি করে যাবে? সারাদিন অনেকটা সময় কেটে যায় পার্টির কাজ করে,কখনো ক্লাশেও যাওয়া হয়না। এভাবে কি করে ভালো ফল করবে? কিন্তু কি করবে এখন? হঠাৎই মনে পড়ে স্যারের কথা। কিন্তু স্যার তো খুব রাগ করেছেন ওর ওপর।স্যার কি ওকে পথ দেখাবেন?
Comments
Post a Comment