সবুজ কচিকচি পাতাগুলো চাবাগানে দোলা দিচ্ছে,শহরজুড়ে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। দুষ্টুর পড়াশোনার চাপ বেড়েছে,কয়েকমাস বাদেই টেস্ট তারপর ফাইনাল।নিজেকে আরেকবার প্রতিযোগিতার মাঠে রেখে প্রমাণ করা। মাঝেমাঝেই মনে হয় এই পরীক্ষাগুলো যদি সত্যিই না থাকতো সত্যিই কি পড়াশোনার জন্য পরীক্ষা না পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা? চোখের চশমাটা কপালে তুলে কলমটা গালে রেখে ভাবে দুষ্টু। কেজানে ভবিষ্যত কি ছবি এঁকে রেখেছে ক্যানভাসে ওর জন্য?
ভবিষ্যতের চিন্তায় অস্থির দীপ্ত আর পারেনা স্যারের কাছে না এসে। স্কুলবাড়ি, ওদের হস্টেল আর চা বাগান কানে কানে বলে যায় ফেলে আসা ছাত্রবেলার কথা।মনে হয় স্কুলই বোধহয় সবচেয়ে সেরা সময় ছাত্রজীবনের যেখানে নিয়ম শেকলে বাঁধা জীবন শেখায় অনেক কিছু।বেনিয়ম আর বেখেয়ালে চলা স্বাধীন জীবনে হয়ত ভুল হয়ে যায় অজান্তেই।
অনেকদিন বাদে স্যারের বাড়িতে পা রাখছে,পেয়ারা গাছের তলায় এসে মনে হয় দুষ্টুর সেই পেয়ারা ছোঁড়ার কথা। কেমন আছে দুষ্টু? ওকে তো স্যার বলেছিলেন মাঝে মাঝে সময় পেলে দুষ্টুকে একটু গাইড করতে।সত্যিই কিছু পারলোনা ও,কিচ্ছুই হয়ত হবেনা।
সিঁড়িতে পা রেখে তারের জালে ঘেরা দরজার বাইরে পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ায়। আজ কেন যেন মনে কোন আনন্দ নেই বরং একটা ভয় আছে মনে। অদ্ভুত একটা ভয় দীপ্তর জীবন জুড়ে।হস্টেলে শিশিরদা আর অন্য ছাত্রদের ভয়,ওরা ওকে শাসিয়ে পোস্টার লেখায়।নতুন ছেলেদের কাছ থেকে কখনো টাকা আদায় করায়। আজকাল দীপ্ত না করাতে ওরা ভাবে দীপ্ত বোধহয় অন্য পার্টিতে নাম লিখিয়েছে।
শযুক্ত শব্দে গালমন্দ করে কখনো ভয় দেখায়। এ কেমন লড়াই কেজানে? স্বাধীনতা পরাধীনতার মত শেকলে বেঁধে রেখেছে ওকে।
দরজায় শব্দ করতেই অনু বাইরে বেরোয়,দীপ্তকে দেখে অবাক হয়ে যায় অনু। সেই লম্বা টানটান ছেলেটা কেমন যেন একটা ভয়ে কুঁঁকড়ে আছে চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ।
" ও তুমি,এসো এসো ভেতরে।স্যার একটু বস্তীতে গেছেন ছেলেদের পড়াতে।এসে যাবেন একটু বাদেই।"
পরিচিত ঘরটায় অনেকদিন বাদে ঢুকেছে দীপ্ত হঠাৎই একটা ঝোড়ো হাওয়ার মত একঝলক ঠান্ডা বাতাস নিয়ে আসে দুষ্টু। কলেজে দেখা মেয়েদের সাথে দুষ্টুকে মেলাতে পারেনা দীপ্ত।নমাস আগে দেখা দুষ্টু আজ অনেক পরিণত। আগের বারও দুষ্টুকে অন্যরকম দেখেছিলো দীপ্ত,ওর সাথে খুব ভালো করে কথাও বলেনি।
আজ দীপ্ত এসেছে শুনে নিজে থেকেই বাইরে এসেছে দুষ্টু কেন যেন পুরোনো আয়নায় আবার পরিচিত মুখটা দেখতে ইচ্ছে করলো। তার সাথে জানতে ইচ্ছে করলো রাজনীতি,নেতৃত্ব এইসব নিয়ে লড়াকু দীপ্তদা আছে কেমন?
দুষ্টুই কথা শুরু করলো.." কই তুমি তো আর পড়াতে এলেনা আমাকে? তোমার কলেজ কেমন চলছে? এখন তোমার শরীর ঠিক আছে তো? মাথায় আর কোন ব্যথা নেই তো?"
স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বকবক করে দুষ্টু,আজ অনেকগুলো প্রশ্ন করেছে।
" পড়াতে আসা হয়নি,যদি কিছু থাকে আজ দে চেষ্টা করে দেখবো।
কলেজের থেকে স্কুলই ভালো ছিলোরে।
শরীরটা ঠিকই আছেরে,শুধু মনটা ভালো নেই।মাথা ব্যথাটা সারলেও অন্য মাথা ব্যথা বেড়েছে। রাজনীতি সবার জন্য নয়।কেন যে নিজেকে জড়ালাম? আমি সব কিছু ছাড়তে চাই আবার ভালো করে পড়তে চাই।পরীক্ষা এসে যাচ্ছে।আমার খুব একটা চাকরির দরকার। ভেবেছিলাম দল করলে সাহায্য পাবো অনেক।কিন্তু আমাকে বোকা আর ভালোমানুষ পেয়ে ওরা যে ব্যবহার করবে তা কখনো ভাবিনি।"
শেষের দিকে গলাটা কাঁপে দীপ্তর।মুখটা ঢাকে,দুষ্টু অবাক হয়ে যায় দীপ্তদাকে দেখে।এই দীপ্তদা ওর কাছে একদম অচেনা। সবসময় শান্তশিষ্ট লাজুক আর হাসিমুখের একটা ছেলেকে দেখেছে বাবার কাছে পড়তে আসতে।
ওদের কথার মাঝে কখন যে রবীন এসে পড়েছে কেউই বুঝতে পারেনি। দীপ্তর সব কথা আর শেষের গলা কেঁপে যাওয়াতে রবীনের বুকের ভেতরটা কাঁপে। বুঝতে পারে একটু নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে হয়ত নিজের সাথে অনেক লড়াই করেও এসেছে ছেলেটা ওর কাছে।
অনেক অভিমান জমা থাকলেও রাগ করতে পারেনা রবীন।ওর মা ছোট থেকে শিখিয়েছেন বাড়িতে বয়ে এসে কেউ সাহায্য চাইলে তাকে সাহায্য করতে হয়,আর এতো সন্তানতুল্য ছাত্র।
দীপ্তকে আর বেশি কিছু বলতে হয়না স্যারকে।রবীন ঠিক বুঝতে পারে ছাত্রর না বলা কথা।ঘরের দরজা ভিজিয়ে ভেতরে চলে যায় দুষ্টু।ও জানে বাবা এখন অনেক কথা বলবে,ও থাকলে কেউ ফ্রী হতে পারবেনা।
বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর কেঁদে ফেলে দীপ্ত।স্যার আমি বাইরে চলে আসতে চাই,আমি বেরোতে চাই।আমি ভুল করেছি। রবীন ভাবতে থাকে কি করা যায়।
দীপ্তর মত ছেলেদের মাথায় পা রেখে সিঁড়ি বাইছে কত সুযোগসন্ধানী এভাবেই। তুই কিছুদিন কলেজ হস্টেল থেকে বাড়িতে এসে থাক।"স্যার আমার ক্লাসগুলো? আমার টিউশন?
মানে আমি তো অনেকগুলো টিউশন করি।"
"আচ্ছা দেখছি আমি,তোকে যদি হস্টেলের থেকে বাইরে এনে রাখা যায়।তাহলে হয়ত চাপ অনেকটা কমবে।"
স্যারের কথা শুনে কিছুটা শান্ত হয় দীপ্ত। তবে আজ অনু ওকে খাইয়ে বাড়ি পাঠায়।
**********************
মাঝে কেটে গেছে বেশ কিছুদিন দেখতে দেখতে থার্ডইয়ারে মিষ্টি।সামনের বছরই ক্যাম্পাসিং হয়ত ভালোই একটা চাকরি হয়ে যাবে।
অনেক চেষ্টা করে দীপ্তকে রাজনীতির জাল ছিঁড়ে বের করেছে রবীন। তবুও যে কি হলো বুঝতে পারেনি রবীন..হঠাৎই একদিন স্কুলের ফোনে হুমকি পেয়েছিলো অচেনা গলায়,কালচিনিতে আছেন ওখানেই হেডমাস্টারি করুননা কেন। আপনার বড় মেয়ে তো কলকাতা থাকে,আর ছোট মেয়ে এখানে। কলেজের ব্যাপারে নাক গলাতে আসছেন? দীপ্তকে আমরা তুলেছিলাম,আমরাই টেনে নামাবো।"
ফোনে বারবার আপনি কে? তুমি কে? জানতে চাইলেও কোন উত্তর পায়নি রবীন।এক নিঃশ্বাসে কথা বলে ফোনটা ছেড়ে দিয়েছিলো।
স্কুল থেকে এসে অদ্ভুত শরীর খারাপ লেগেছিলো কেন যেন মেয়েদুটোর কথা মনে হয়েছিলো। অনু জানতে চেয়ে যখন সবটা শুনেছিলো ভয় পেয়ে বলেছিলো," আর না,দীপ্ত সামলাক এবার নিজেকে।অনেক করেছো,এবার মেয়ে দুটোর কথা ভাবো।এমনিতেই স্কুলে অনেক ঝামেলা।"
শুধু দুষ্টু বলেছিলো," বাবা আমাকে কেউ কিছু করতে পারবেনা, দেখে নেবো।"
দুষ্টু পরীক্ষার রেজাল্ট খুব ভালো করলেও জয়েন্টের র্যাঙ্ক তেমন ভালো হলোনা দুষ্টুর তবুও বাবার ইচ্ছে অনার্স নয় জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেই ভর্তি হতে হলো দুষ্টুকে। দাপুটে দুষ্টু প্রতিবাদ করেছিলো," আচ্ছা বাবা সবাইকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে কেন? আমি যদি জোজোদার মত অনার্স নিয়ে পড়ি কলকাতায়?"
এই একবছরে কেমন যেন মানসিক ভাবে অনেকটা দূর্বল হয়ে গেছে রবীন। মানসিক চাপ নেওয়ার ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমছে। ছোট মেয়েকে আর দূরে পাঠাতে ইচ্ছে করেনা,জলপাইগুড়ি কাছে ইচ্ছে হলেই চলে যেতে পারবে দুষ্টুও চলে আসতে পারবে একা। কিন্তু বাবা.." ভালো ক্যাম্পাসিং হবে তো?
আমি কিছু করতে পারবো তো? আমি ইচ্ছেমত বড় হতে পারবো তো?"
মেয়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে কেমন যেন হাঁফ ধরে রবীনের।কে জানে কি স্বপ্ন দেখেছে মেয়েটা? কখনো ওরা স্বপ্ন ভাঙে,কখনো বাবা মা ভাঙে আবার কখনো ভেঙে যায়।
****************
দুষ্টুর অভিমান হলেও মনকে বোঝালো বাবা হয়ত ঠিকই বলেছে।কলকাতার থেকে এখানে থাকলে হয়ত বাবা একটু শান্তি পাবে। কেজানে কেন যেন বাবাকে আজকাল খুব ক্লান্ত মনে হয়। জীবন খাতার হিসেব নিকেশে বসে রবীন নিজেও মেলাতে পারেনা আজকাল।
পাল্টাচ্ছে চারপাশ, পাল্টাচ্ছে মানুষ যাচ্ছে মান নেই কোন হুঁশ।ছাত্রদের মান নামছে,এখন পড়াশোনা মানে বলে দিন পরীক্ষায় পাশ করার জন্য কি কি লাগবে। জানার ইচ্ছে অনেক কমেছে।
পুরোনো কৃতী ছাত্ররা এলে মনে হয় তেমন ছাত্র এখন আর কই?
কই প্রশ্নটার মধ্যে রবীন খোঁজে দীপ্তকেও,কোথায় গেলো?কেমন আছে ছেলেটা? পায়ে পায়ে আসছে ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা কেমন নিজেকে তৈরি করলো কে জানে?
অদ্ভুতভাবে হুমকি ফোনটা আসার পর দীপ্ত আর যোগাযোগ করেনি। তবে কি ওকে ভয় দেখিয়েছে ওরা? রবীনের খুব জানতে ইচ্ছে করে তবে ভরসা পায়না।দূর শহরে মিষ্টিটা থাকে, দুষ্টুও এখন কলেজের চৌকাঠে পা দিয়েছে।
অনু বারবার সাবধান করেছে,রাগও করেছে,"শোনো তুমি আর কোন ঝামেলায় থেকোনা,একবার মেয়েদের কথা ভাবো। ওদের দলের লোক নিশ্চয় কলকাতাতেও আছে। কারো ভাগ্য খন্ডাবে কেমন করে?"
*****************
একটা ছেঁড়াপাতার মত হারিয়ে গেলো দীপ্ত।রবীন খুব আশা করেছিলো রেজাল্ট আউটের পর একবার আসবে ছেলেটা। একবার স্কুলের পুরোনো রেজিস্টার হাতড়ে দেখে ওর ঠিকানা,ভাবে খোঁজ নেবে। ছেলেটা ঠিক আছে তো?
তারপর অভিমান হয়,হয়ত ঠিকই আছে। পড়বে এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে কি দরকার খোঁজ নেবার।
দীপ্ত হারিয়ে যায় বাধ্য হয়েই,একদম ছিঁড়তে পারলোনা রাজনীতির সুতোটা হুমকি পেলো স্যারের ক্ষতি করার। তাই মুখ বন্ধ করে কিছুটা মানিয়ে নিলো,পরীক্ষাটা যে ওকে দিতেই হবে। শিশিরদা বললো," বেশি উড়িসনা,যা বলছি শোন নাহলে স্যারকে তো ফাঁসাবো আর তার সাথে তোকেও বলবো রূপসীর শ্লীলতাহানি করেছিস।"
রূপসী লাল রঙের ঠোঁটে সিগারেট চেপে হাসে। কেমন যেন দম আটকে যায় দীপ্তর।
পরীক্ষাটা দিলেও মন মত রেজাল্ট হলোনা।কেজানে এটাও চক্রান্ত কিনা? দীপ্তর মনে হলো ওরা সব পারে। কলেজ থেকে বেরিয়ে ভিড়ে মিশে গেলো দীপ্ত,একটা কিছু ওকে করতেই হবে। এই মুখ নিয়ে ও স্যারের কাছে কিছুতেই যেতে পারবেনা। যেদিন নিজেকে দীপ্ত বলে প্রমাণ করতে পারবে সেদিনই যাবে আবার স্কুলে।
স্কুলের পঁচাত্তর বছরের পূর্তি অনুষ্ঠানের মহড়া বেশ কিছু দিন ধরে চলছে। অনেকটা বড় অনুষ্ঠান,নতুন ছাত্রদের সাথে পুরোনো ছাত্ররাও থাকবে।তাই মোটামুটি খবর যায় সবার কাছেই।
রবীনের এই কদিন বেশ ব্যস্ততায় কাটছে,এতবড় একটা অনুষ্ঠানের আয়োজনের চিন্তা মাথায়।যদিও পাশে অনেকেই আছেন,তাছাড়া এমন অনুষ্ঠান করতে ভালো লাগে রবীনের।
উত্তীয় মানে জোজোও কলকাতা থেকে আসবে,যদিও মিষ্টির আসা হবেনা।তবুও জোজো কিছুতেই মিস্ করতে চায়না অনুষ্ঠানটা।উফ্ কতদিন বাদে আবার বন্ধুদের দেখবে,অনেক মজা আর গল্পের মাঝে আবার দৃঢ় হবে বন্ধুত্বের আল্গা হওয়া সুতোটা। যদিও অনেকের সাথেই কথা হয়,তবে জোজোর এখানে আসতে চাওয়া একজনকে খুঁজতে। এরমধ্যে তো ওরও ফাইনাল ইয়ার শেষ হয়েছে,বেশ ভালো রেজাল্ট হয়েছে। জোজো ভর্তিও হয়েছে ওর ইচ্ছে সাংবাদিকতায় এম এ করার। ইংরেজিটা ভালো জানার জন্য ওর ইচ্ছে সাংবাদিকতায় যাওয়ার।
দীপ্তও নিশ্চয় খুব ভালো রেজাল্ট করে এমএসসি পড়ছে। মাঝে মিষ্টির সাথে দেখা আর কথাও হয়েছে। জোজো কালচিনিতে যাবে শুনে একটু অভিযোগ করলো," ইশ্ আমাকে ছেড়েই চললি। পরীক্ষা না থাকলে আমিও যেতাম। দেখনা আমি সেই এখানে একাই রয়ে গেলাম,বোন তো ওদিকেই থাকলো।"
জোজো হাসে," তুই আর একা কোথায়? কত বন্ধু এখন তোর। কালচিনির অনন্যা এখন অনেকেরই ড্রিমগার্ল।"
রঙিন চুলের থোকা হাওয়ায় নাচে মিষ্টির,একগোছা চুল চোখমুখে আদর বোলায়। খিলখিল করে একটা আত্মতৃপ্তির হাসি হাসে মিষ্টি।সত্যিই এই শহরটা শেখালো অনেক কিছুই। অথচ একটা সময় ও বাবাকে বলেছে এখানকার মেয়েরা খুব স্মার্ট। ও সেই তুলনায় অনেক পিছিয়ে।আজ কলেজের যে কোন প্রোগ্ৰামে নাচের জন্য ওকেই লাগে। রুম্পা তো সেই কবে থেকেই সিরিয়ালের জন্য বলছে। এতদিন না ভাবলেও এবার ফাইনালের পর ভাববে।চাকরি করবে কদিন বাদে, এবার একটু নিজের মত পথ চলা।
" কলকাতায় এসে চোখমুখ খুব খুলেছে দেখছি। কজন মেয়ে বন্ধু হয়েছে শুনি? মণিমাকে তো খবরটা দিতে হবে। কি রে?"মিষ্টি বলে।
" তা খুব ছোট নয় লিষ্টি তবে প্রথমেই আছে মিষ্টি।"
" বাপরে বেশ তো কবিতা করতে শিখেছিস! আমি তো তোর গার্জেন।একদম চোখ দিয়ে বসে আছি,এদিক ওদিক করেছো কি দেবো একদম।"
" দেখা যাক কে কার গার্জেন। তবে দুষ্টুটা এখানে এলে ভালো হত তাইনা রে? দুষ্টুর মধ্যে একটা আলাদা ব্যাপার আছে।"
চোখ গোল করে জোজোর দিকে তাকায় মিষ্টি," ব্যাপারটা কি রে? দুষ্টুকে দেখে ক্রাশ খেয়েছিস নাকি? তারপর আবার যাচ্ছিস ব্যাপারটা ভালো বুঝছিনা আমি।"
" রক্ষা করো মা,দুষ্টু যা ঢ্যাঙা আর মেজাজী দরকারে আমার মাথায় গাট্টা মারবে। তবে বেশ দেখতে হয়েছে কিন্তু এখন।আরে আমি না পাড়ার বন্ধুরা বলছিলো।"
দুজনেই একচোট হেসে কুটিপাটি হলো..মিষ্টি বললো," বলবো নাকি বোনকে?"
" ধ্যাৎ, তুই যে কি বলিস? কোনদিন তোদের তেমন করে আর দেখলাম কই?"
" আহা রে একদম ভালো মানুষ ছেলেটা।"
বাড়ির পথে পা রাখতে রাখতে ভাবে জোজো সময়ের সাথে সাথে সম্পর্কে বন্ধুত্বের রঙটা বেশ গাঢ় হয়ে যায়। যেই মিষ্টি একটা সময় মুখ তুলতোনা বই থেকে আজ কত মজা করলো। মনটা বেশ ফুরফুরে জোজোর সামনের সপ্তাহে বাড়ি যাচ্ছে তারপর মা আর কাম্মাকে নিয়ে যাবে কালচিনিতে।স্কুলের কথা মনে হতেই মনটা কেমন যেন ফুরফুরে হয়ে গেলো।
******************
আয়োজনের কোন ত্রুটি রাখেনি রবীন,মাননীয় অতিথির আসনে আছেন প্রাক্তন হেডমাস্টারমশাই,ডিআই এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব। আজকাল কোন অনুষ্ঠানে ওনাদের ছাড়া ভাবাটাই একটা অপরাধ কারণ স্কুলের অনেক ব্যাপারে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত রবীনকে দ্বারস্থ হতে হয়।
ছাত্ররা খেয়াল খুশির পাখনা মেলেছে হচ্ছে বিজ্ঞানের প্রদর্শনী,সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও।অনেক পুরোনো ছাত্র ডোনেশন দিয়েছে। জমজমাট অনুষ্ঠানের মধ্যে রবীনের বাড়িও জমজমাট শিলিগুড়ি থেকে জোজো ওর মা,রাণু আর জয় এসেছে। আসার পথে দুষ্টুকে ওরা সাথে করে নিয়ে এসেছে। ড্রাইভারের সিটে বসা জোজোদাকে দেখে আবার পুরোনো প্রেমটা পাখনা মেলে প্রজাপতির মত গালে মুখে চুমু দেয় দুষ্টুর। ইশ্ একদম জোজোদার পাশে সামনে ওকে বসতে হবে?
তাই মিনমিন করে বলেছিলো," আমি সামনে বসবো? জয় এখানে বসুক।"
রাণু আর মধুমিতা বললো.." বোসনা, কি হবে? জয় ভীষণ ছটফট করে। একটু বাদেই দুই ভাই ঝগড়া করবে।"
বাড়িতে এসেও অনেকক্ষণ আবেশে ভাসে দুষ্টু। জোজোদা স্কুলে চলে গেছে আসার কিছুক্ষণ বাদেই।বাড়িতে খুশি খুশি ভাব।ওরাও যাবে স্কুলে,ছোট থেকে তো এই স্কুলকে কেন্দ্র করেই ওরা বড় হয়েছে। এর মাঝেই মিষ্টি ফোন করে.." সবাই এসে গেছে? ইশ্ তোমরা কত মজা করছো? আমার যাওয়া হলোনা।বাবা খুব ব্যস্ত তাইনা মা? বাবাকে একটা ভালো ড্রেস পরিয়ে পাঠিয়েছো তো?"
অনু বলে.." সে কি আর সাজগোজ করার লোক? হ্যাঁ রে পরে গেছে সব ঠিকঠাক। দাঁড়া দুষ্টুকে দিচ্ছি।"
দুইবোনের কলকলানির মাঝে মিষ্টি জিজ্ঞেস করে," হ্যাঁ রে আসেনি?"
" কে?"
" আরে বাবার বাধ্য ছাত্র দীপ্ত।"
"বলতে পারবোনা দিদি,হয়ত স্কুলে এসেছে।"
পাশ থেকে মধুমিতা বলে," ওর জন্যই তো জোজো এলো বেশি করে। বললো কতদিন দেখা হয়না,যোগাযোগ নেই।এই সুযোগে ফোননম্বরটা নিয়ে নেবে।"
অনুষ্ঠান খুব ভালো হলেও দীপ্ত এলোনা।জোজো আর রবীনের দুইচোখ দীপ্তকে খুঁজলেও তাকে পাওয়া গেলোনা। রবীন ওদের সাথে পড়া দুএকজনকে জিজ্ঞেস করলো দীপ্তর কথা। কেউ ঠিক বলতে পারলোনা তবে সোমেন বললো," স্যার দীপ্তর রেজাল্ট খুব একটা ভালো হয়নি শুনেছি। ভীষণ মানসিক ভাবে অত্যাচারিত হয়েছে।শুনেছি পার্টির ছেলেরা ওকে হস্টেলে মেরেওছিলো।"
অনেক কাজের মাঝেও দীর্ঘশ্বাস পড়ে রবীনের মনে মনে ভাবলো ওদের গ্ৰামের বাড়িতে একদিন যাবে। তার আগেই সোমেন বললো," আমি গেছিলাম স্যার ওদের গ্ৰামের বাড়িতে।শুনলাম বাড়ি বন্ধক দিয়ে মাকে নিয়ে কোথাও একটা চলে গেছে কাজ করতে।"
কুয়াশার অন্ধকারে কতগুলো কালো মেঘ এসে ঢেকে দিলো একটা উজ্জ্বল নাম দীপ্তময়। রবীন জোজো কেউই আর কোন খোঁজ পেলোনা দীপ্তর। ওর জন্য স্যারের কোন ক্ষতি হোক,দুষ্টু মিষ্টির পড়াশোনার কোন ক্ষতি হোক তা কখনো চায়নি দীপ্ত।শুধু পড়াশোনা কেন? যদি অন্য কোন ক্ষতি হয়? আর কি রেজাল্ট নিয়ে যাবে স্যারের কাছে? মনে মনে সেদিন ভেবেছিলো সত্যিই যদি কোনদিন অন্ধকারে আলোর দীপ্তি ছড়াতে পারে তাহলে ঠিক ফিরবে স্যারের কাছে।তখন ক্ষমা চেয়ে নেবে।
******************
কালচিনিতে একটা দিন ভীষণ ভালো কাটলো ওদের সবার। দুষ্টুই বোঝালো জোজোকে আর বাবাকে.." পৃথিবীটা গোল ঠিক একদিন দেখা হবে তোমাদের সবার সাথে সবার।"
দুষ্টুর ডাইরি লিখলো আরো অনেক মিঠে মিঠে কল্পনার প্রেমের গল্প। জোজোর সাথে একসাথে গাড়িতে আসা,পেয়ারা গাছে হেলান দিয়ে স্মৃতিরোমন্থন। জোজোর চোখের মুগ্ধতা,দুষ্টুকে সুন্দর হয়েছিস দেখতে বলা। খোঁজ নেওয়া ওর কোন স্পেশাল বন্ধু হয়েছে কিনা।
দুষ্টু ঠোঁটে হাসি মাখিয়ে বলেছিলো," আগে বড় হই,পড়াশোনা করি তারপর।"
জোজো হেসে বলেছিলো.." এখনো বড় হসনি,আর কবে হবি?"
কেন যেন দুষ্টুর মনে হয়েছিলো জোজোদার চোখে কোন প্রেমই নেই।আচ্ছা জোজোদা কি বুঝতে পারেনা ওর মনের কথা?
দিদি নেই,ওরা দুজন কত গল্প করছে বারান্দায় বসে। আকাশে বড় থালার মত পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে, দূরে ময়ূর ডাকছে।রান্নাঘরে ভালোমন্দ রান্না হচ্ছে,মণিমা আর মা রান্নাতে ব্যস্ত,জেম্মা বাইরে টুল পেতে বসে গল্প করছে।সামনের ঘরে বাবা হিসেব মেলাচ্ছে।মাঝে মধ্যে দুষ্টুর মনে হয় বাবা সারাজীবনই হিসেব করে গেলো।জয় মেতেছে নিজের মত খেলায়।
কিন্তু তার মধ্যেও বলতে পারলো কই দুষ্টু ওর মনের কথা? মাঝের মাঝ জোজো ওকে স্পোকেন ইংলিশ বলিয়ে নাকাল করলো।
" দেখি তোর ইংরেজী কেমন হয়েছে এখন? আগে তো ইংরেজী কাজ আমাকে দিয়ে কত করিয়েছিস। চল দুজনে ইংরেজী বলতে বলতে গল্প করি।"
জোজো প্রথমটা ভেবেছিলো দুষ্টুকে নাকাল করবে কিন্তু দুষ্টুর ঝর্ণামাখা ইংরেজী শুনে কাত হলো জোজো..." আরে বাবা এতো ঝরঝরে ইংরেজী বলছিস। আরে এত ইমপ্রুভ করলি কি করে?"
নিঃশ্বাস ফেলে দুষ্টু হয়ত জীবনে অনেক স্বপ্ন দেখেছে,জানেনা আদৌ সেই স্বপ্ন পূরণ হবে কিনা? তবুও একটু একটু করে সিঁড়িতে পা দিয়ে ওঠার চেষ্টা। তাই হেসে বলে.." একটু শিখেছি পরীক্ষার পর,এখনো শিখছি।"
বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ে জোজো, "শেখ শেখ যত শিখবি তত এগিয়ে যাবি।"
************
কালচিনিতে ফেলে আসা দিনগুলো মাঝে মাঝেই মিঠে স্মৃতির প্রজাপতির মত ফুলের রেণু মাখিয়ে দিয়ে যায় জোজোর মনে।
একটা সময়ের পর সবারই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া এদিক ওদিক। আজকাল ওরও পড়াশোনার চাপ অনেক বেড়েছে। এখন আপাততঃ ফ্ল্যাটেই আছে আসলে মাঝে মাঝেই নানান কাজে ফিরতে দেরি হয় তাই আর নিজেকে বেঁধে রাখতে চায়না নিয়মের বেড়াজালে।
যদিও মা বারবার বলে দিয়েছে একদম যেন কোন রকম বাজে ব্যাপারে নিজেকে না জড়ায়।
" একা থাকছিস তবে এমন কিছু করিসনা যাতে আমাকে আবার মাথা নিচু করতে হয়। অবশ্য তুই এখন বড় হয়েছিস,নিজের ভালো মন্দ নিশ্চয় বুঝবি।" মায়ের কথার ইঙ্গিত বুঝতে কোন অসুবিধা হয়না জোজোর।সত্যিই সেই দিনগুলো কি ও নিজেও ভুলতে পেরেছে? একরাশ অপমান আজও চোখ বুজলে দেখতে পায়।
এখানে বন্ধু অনেক হয়েছে,বান্ধবীও কম নয়।জোজো বুঝতে পারে ওকে নয়না পছন্দ করে। কয়েকদিন ওদের বাড়িতে গেছে।তবে কেন যেন গায়ে পড়া মেয়েদের পছন্দ হয়না জোজোর। আজকাল সময় পেলেই নতুন বন্ধু ক্যামেরার সাথে বাইরে চলে যায় সময় কাটাতে। সামনেই আইটি আসছে তাই এরমধ্যে হাতটা পাকানো জরুরী।
তাই অবসরে বন্ধুর সাথে জোজো চলে যায় কখনো বাবুঘাটে,কখনো দ্বিতীয় হুগলীব্রীজে, আবার কখনো পা ডোবায় সবুজ ঘাসে। পড়াশোনা বা পেশার পাশাপাশি ভালোবাসাটা বাঁচিয়ে রাখাটাও জরুরী। ভালোবাসা মাখা ফটোগুলো মাকে পাঠিয়ে দেয় জোজো।নিশ্চিন্ত লাগে মধুমিতার যে শখের ভালোবাসা নিয়ে ভালো আছে ছেলেটা।
মাঝে মাঝে একটু প্ল্যান করে দেখা করে মিষ্টির সাথে। যদিও মিষ্টি কখনোই ওর ফাঁকা ফ্ল্যাটে আসেনা।জোজোও আসতে বলেনা কারণ মা অনেকদিন আগে একটা কথা বলেছিলো মিষ্টিকে.." যখন আমি থাকবো চলে আসিস।দুএকদিন থেকে যাবি।" তাই কখনো বাইরেই একটু আড্ডা মেরে স্মৃতির রোমন্থন হয়। মনটা তখন কিছুক্ষণের জন্য চলে যায় কালচিনিতে।তবে সময়ের সাথে সাথে হয়ত পাল্টায় সবাই।
তাই খুব অবাক হয়েছিলো হঠাৎই একদিন মিষ্টিকে দেখে।প্রথমে সত্যি চিনতে পারেনি মিষ্টিকে চোখে স্টাইলিশ চশমা খুব অন্যরকম পোশাকে মিষ্টি উঠছে একটা দামি গাড়িতে। দূর থেকে দেখে অবাক হয়ে যায় জোজো। এটা কি সত্যিই মিষ্টি?এইরকম পোশাকে! কিন্তু কোথায় যাচ্ছে ও? গাড়িতে কে আছে? তবে মিষ্টি কি কোন ছেলের সাথে?
চিন্তায় মনটা এলোমেলো হয়ে গেলো জোজোর,গাড়িটা তখন চোখের নাগালে তবুও গাড়ির নম্বরটা মনে রয়ে গেলো জোজোর।
গাড়ি ততক্ষণে বাইপাস ধরে ছুটছে,রুম্পা অনেকদিন ধরেই বলছিলো ওর দাদার কথা। সায়মের সাথে আলাপ করিয়ে দিয়েছে রুম্পা।সায়ম একটা প্রোডাকশনে কাজ করে,মিষ্টির নাচ আর ছবি দেখে অনেকদিনই বলেছিলো অভিনয়ের কথা।
প্রথমটা মিষ্টি অতটা পাত্তা না দিলেও
একটা সময় এগিয়ে যায় বন্ধুত্বের টানে।রুম্পার জন্মদিনে গিয়ে একদম ভিআইপি ট্রিটমেন্ট পেয়েছিলো সায়মের কাছ থেকে। নিজেকে বেশ একটা কুইন কুইন লাগছিলো। তবে জোজোকে এসব কিছুই বলেনি। আর বাড়িতে বলার তো প্রশ্নই নেই। বাবা মা ভীষণ কনজারভেটিভ ও জানে, তাই বাবা শুনলে খুব রাগ করবে। তবুও জীবনটা তো ওর,কখনো তো ইচ্ছে করে নিজের মত চলছে। অলরেডি ও সিলেকটেড হয়েছে জবে। এরপর চাকরি করবে,তখন পুরোপুরি স্বাধীন,এবার নিশ্চয় সেটাই করতে পারবে ও যেটা চায়।
আজকাল সায়ম মাঝে মাঝেই চলে আসে।ওর দামি গাড়ি,সুন্দর চেহারা আর স্মার্টনেস টানে মিষ্টিকে। যদিও এখনো মিষ্টি বুঝতে দেয়নি ওর মনের খোঁজ সায়মকে তবুও সায়মের সাথে আজকাল প্রায়ই দেখা যায় মিষ্টিকে।
জোজো আজকাল মিষ্টিকে অনলাইনে দেখে অনেক রাত অবধি। নিঃশ্বাস ফেলে জোজো,মাঝেমাঝেই নিজেকে প্রশ্ন করে.." কেন ও দেখে মিষ্টিকে? মিষ্টি অনলাইনে থাকলে ওর কি? মিষ্টির বদলে যাওয়া ওকে ভাবায় কেন?
মিষ্টি ওর কাম্মার কেউ তাই? নাকি যিনি ওকে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছেন সেই স্যারের মেয়ে মিষ্টি?"
সব প্রশ্নের মাঝে মন থেকে একটা ছোট্ট কথা গুনগুন করে বেরিয়ে আসে মিষ্টিকে ওর ভালো লাগে। মিষ্টির নাচ,মিষ্টির হাসি,মিষ্টির ঝগড়া আর ওর গাট্টা সবটাই ওর প্রিয়।তাই তো মাসে একবার হলেও ছুটে যায়। গল্প আর আড্ডায় ভরে থাকে কিছুক্ষণ,মিষ্টির প্রত্যেকটা খুশির মুহূর্ত ওকে ছুঁয়ে থাকে ভালো রাখে।
ছবি তুলতে আর ভালো লাগেনা সেদিন জোজোর। বাড়িতে ফিরে এসেও গাড়িটা আর গাড়ির নম্বরটা চোখের ওপর ভাসতে থাকে। গাড়িটা দেখে মনে দামি আর নতুন। কালচিনিতে দেখা প্রথম দিনের মিষ্টি আর দুষ্টু যেন দুই পাহাড়ি ঝর্ণার মত উচ্ছ্বল তার মধ্যে মিষ্টি অনেক বেশি শান্ত,সুন্দর আর পরিণত।দুষ্টু মারকুটে, দাপুটে আর ঝগড়ুটে।ঐ চারটে বছরের কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এখনো মনে। সদ্য কৈশোরে পা রেখেই চিনেছিলো মিষ্টিকে প্রিয় বন্ধু হিসেবে। আজ সেই প্রিয় বন্ধুকে ওর ভালো লাগে,ওকে মিস্ করে ওকে মনে মনে পাহারায় রাখে।তবে ভালোবাসার কথা বলতে কখনো সাহস পায়নি।
বারবারই মনে হয়েছে স্যারের কথা আর মা বাবার কথা। স্যার কি ভাববেন? এমন একটা অকৃতজ্ঞতার কাজ ও করলো? তাছাড়া মা বাবাও হয়ত কাম্মাকেই দোষ দেবে। আর মিষ্টি? ও তো সব সময় ওর সাথে ঝগড়া করে আর পেছনে লাগে। প্রেমের ছিটেফোঁটা কখনো দেখেনি ওর দুইচোখে। তারপর আজকাল আধুনিকতা,শিক্ষা আর সৌন্দর্যের মোড়কে মুড়িয়ে নিয়েছে মিষ্টি নিজেকে। জোজো কেন যেন আর ছুঁতে পারেনা সেই সৌন্দর্যকে। সেই তুলনায় দুষ্টু এখন অনেক শান্ত আর পরিণত,আধুনিকতার ছোঁয়া তেমনভাবে ছুঁতে পারেনি ওর সরল মুখটাকে।
ব্যালকনিতে বসে কেমন যেন লাগে জোজোর।কে জানে কোথায় গেলো? কার সাথে গেলো? সত্যিই কি মিষ্টি অভিনয় করবে?
*****************
জলপাইগুড়ির কলেজে নিজেকে বেশ মানিয়ে নিয়েছে দুষ্টু,আজকাল মনে হয় বাবা ঠিকই করেছে ওকে কাছাকাছি রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে।কি সুন্দর ইচ্ছে হলেই ছুট্টে বাড়ি চলে আসে আবার কখনো মণিমার বাড়িতে চলে যায় ইচ্ছে হলেই। জলপাইগুড়ি শহর,নদী,গাছপালা এর মধ্যেই ওর খুব চেনা হয়ে গেছে। এমনিতেই উত্তরের গাছপালা,চা বাগান ওর বন্ধু সেই ছোট্টবেলা থেকে।তাই কলকাতা যাওয়ার একটু ইচ্ছে থাকলেও মানে ইচ্ছে হয়েছিলো ও বেশ দিদি আর জোজোদার মত ঘুরে বেড়াবে আড্ডা দেবে। কিন্তু নাহ্ সেসব আর হলো কই? যাক যা হয়েছে ভালোই হয়েছে,একদিন তো বড় হলে ও যাবেই অনেক দূরে চাকরিতে।অবশ্য মা বাবাকে সঙ্গে নিয়েই যাবে। একটু গালে হাত দিয়ে ভাবে দুষ্টু কিন্তু চা বাগান? চা বাগানটাকে নেবে কি করে?
এলোমেলো কত কথা ডাইরিতে লেখে দুষ্টু।ডাইরির মলাটে হাত বোলায় দুষ্টু। ওহ্ বলাই হয়নি তো সবাইকে যে এই ডাইরিটা জোজোদা ওকে দিয়েছে।খুব সুন্দর ইন্সপায়ারিং সমস্ত ইংরেজী কোট লেখা পাতায় পাতায়।ওর আগের ডাইরিটা একদম ভর্তি হয়ে গিয়েছিলো,ভালোই হয়েছে। ডাইরিটা একটা লুকোনো জায়গায় রেখে দিয়েছে বইপত্রর মাঝে। ডাইরিটার হাত ধরে প্রতিদিনই জোজোদা সামনে এসে দাঁড়ায় মনে পড়ে যায় সেদিনের রাতে বলা কথাগুলো.." তোর ইংরেজীটা এখন কিন্তু একদম ঝরঝরে। এগিয়ে যা এভাবেই।ভালো কিছু করতে হলে সবসময় কলকাতা যেতে হবে কেন? এখানে বসেই যদি ভালো করিস শুধু কলকাতা কেন তোকে প্যারিস খুঁজে নেবে।"
জোজোদার কথা শুনে হেসে কুটোপাটি হয়েছিলো দুষ্টু। সত্যিই পারেও কথা বলতে পারে জোজোদা। ডাইরিতে আঁচড় কাটতে কাটতে কত কি যে ভাবলো দুষ্টু।
নন্দিনী এসে দাঁড়াতেই ডাইরি বন্ধ করে দুষ্টু।নন্দিনী ওর প্রিয় বন্ধু এছাড়া দার্জিলিংয়ের প্রেমা, মুন্না ওরা তো আছেই। সবাই মিলে বেশ মজা করে কেটে যাচ্ছে তবে ছেলেরা অনেকে ক্রাশ খেলেও খুব একটা ঘাটায়না দুষ্টুকে কারণ ও যখন লাফিয়ে বাস্কেটবল খেলে বা দৌড়ের মাঠে ছোটে তখন অনেক ছেলেই ভাবে দম আছে মেয়েটার।
নিজের শেখাগুলোতে ধুলো পড়তে দেয়নি দুষ্টু সুযোগ পেলেই ঘষামাজা করে নেয়।
*******************
রবীন আজকাল কিছুটা নিশ্চিন্ত দুই মেয়েই দেখতে দেখতে বড় হয়ে উঠেছে।মিষ্টির চাকরিও হয়ে যাবে কিছুদিনের মধ্যেই। মিষ্টি এখন অনেকটাই পরিণত,তবুও বাবার মন নিশ্চিন্ত হতে পারেনা। এই চারবছরে অনেকটাই নিজেকে পাল্টে ফেলেছে মিষ্টি। তবে আজকাল মিষ্টিকে দেখতে অনেক সুন্দর হয়ে গেছে সেটাও ঠিক।দুই মেয়ে বাড়ি থাকলে ঘরে যেন আলো জ্বলে ওঠে রবীনের।সত্যিই বোধহয় মেয়েরা ঘরের লক্ষ্মী।
অনুকে জিজ্ঞেস করে রবীন," হ্যাঁ গো,মেয়েদের খবর তুমি কিছু জানো?"
" কি আবার জানবো?"
" মানে মিষ্টি তো বাইরে থাকে কোন বন্ধু হয়েছে কিনা?"
অনু হাসে," কি জানি,আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম বললো..' দাঁড়াও আগে চিনি,দেখি বুঝি তবে তো। এ কি তোমার মত নাকি? বাবা দোলে গেলো আর তোমাকে পছন্দ করে এলো।' কোন কিছুই মুখে আটকায়না এখন খুব কথা হয়েছে মিষ্টিরও। বড় হয়েছে মেয়েরা তাই ওরাই ঠিক করুক।তুমি তো দেখলে এতদিন।"
অনু যত সহজে কথাগুলো বলে গেলো অতটা নিশ্চিন্ত হতে পারেনা রবীন মনে মনে একটু চিন্তাও হয়।
দুদিন হস্টেলে গিয়ে মিষ্টিকে পায়নি জোজো,ভেবেছিলো একদম গিয়ে সারপ্রাইজ দেবে। ওর রুমমেট সুদীপাকে চেনে জোজো। একটু হেসে বলেছিলো," তুইও আছিস নাকি লাইনে? সত্যিই লাকি মিষ্টি। আরে ওকে পাওয়া এখন মুশকিল কিছুদিন বাদেই টিভিতে বা সিনেমার পর্দাতে দেখবি। আমারই কিছু হলোনা।
ফ্রী আছিস নাকি? তাহলে চল বরং একটা মুভি দেখে আসি।"
জোজোর মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে যায় সত্যিই কেমন যেন একা লাগে নিজেকে। একটা সময় এক ট্রেনে করে ওরা পা রেখেছিলো কলকাতার বুকে স্বপ্ন সাজাতে নিজের নিজের মত। বেশ মজাতে কেটেছিলো প্রথম কয়েকটা দিন।এখনো মাঝে মাঝে মিষ্টিকে দেখলেই মনে হয় আছে কেউ ওর আপনজন এই শহরের এক কোণে।
কাজের অজুহাতে ওখান থেকে চলে আসে জোজো। রাস্তাতে দেখা হয়ে যায় সৌগতর সাথে ও জোর করাতেই চলে আসে পার্কস্ট্রীটের একটা রেস্তোরাঁয়।
" একটা বিয়ার আর ক্রিস্পি চিকেন দিই কি বল?"
জোজো মাথা ঝাঁকায়," আমি আজকাল আর খাইনা বুঝলি।মানে ভালো লাগেনা।"
" আরে বিয়ারটা কি মদ্যপানের মধ্যে পড়ে নাকি? জাস্ট একটু রিফ্রেশমেন্ট। আমারও বোর লাগছিলো।অনেকদিন বাদে তোর সাথে দেখা হলো।"
সৌগত এক নাগাড়ে বলে যায় হাসে জোজো। ওর মন তখন অন্য চিন্তা করছে মিষ্টির সাথে একবার দেখা হলে ভালো হত।
***************
চিয়ার্স বলে সৌগত শুরু করতেই হঠাৎই কোণের টেবিল থেকে দরজার দিকে চোখ চলে যায় জোজোর একটা কাপল ঢুকছে।মেয়েটা জিন্সের জ্যাকেট আর টাইটস পরা থোকা থোকা চুল আড়াল করেছে মুখটা সাইড থেকে খুব একটা ভালো বুঝতে পারেনা তবুও যেন সব মিলিয়ে খুব চেনা লাগে জোজোর। ইশ্ একবার যদি মেয়েটা এদিকে মুখ ফেরাতো। সঙ্গী ছেলেটা ওর কোমরে হাত রেখেছে। অনেকটা দূরের একটা টেবিলে বসেছে ওরা। খাওয়াতে মন দিতে পারেনা জোজো,কেমন যেন অস্থির লাগে।ওর খুব মনে হচ্ছে ওটা মিষ্টি। মানে একদম সাইড থেকে বা পেছন থেকে মিষ্টির মত অথচ দেখতে পারছেনা।
সৌগত ওকে লক্ষ্য করে," আরে কোন প্রবলেম নাকি? তোকে কেমন যেন লাগছে? চেনা কেউ? এমন করে আগে তো কখনো মেয়ে দেখতে দেখিনি। তবে ফিগারটা দারুণ আমিও দেখেছি ঢোকার সময়।"
মাথাটা একটু গরম হলেও কিছু বলেনা জোজো...তবে মনে মনে ভাবে এটা নিশ্চয় মিষ্টি। আর সেই মুহূর্তে মুখটা পেছনে ফেরায় মেয়েটা। অবাক হয়ে যায়না একটুও জোজো শুধু নিজেকে সাবাশ বলতে ইচ্ছে করে মিষ্টিকে এত ভালো করে চেনার জন্য। সত্যিই বোধহয় মিষ্টির ছায়াটাও ও চেনে তাই ভুল হয়নি একটুও।
তবে ইচ্ছে করেই সামনে যায়না শুধু দূর থেকেই খেয়াল করে।ওরা নিভৃতে একটা টেবিলে বসে গল্প করছে।মাঝে মাঝে ছেলেটা আদরে মিষ্টির এলোমেলো অবাধ্য চুলের গোছা সরিয়ে দিচ্ছে। খুব অসহ্য লাগলেও ছেলেটাকে ভালো করে দেখে জোজো। ছেলেটা কে ওকে জানতেই হবে।
বেশ কয়েকদিন বাদেই জানতে পারলো মিষ্টির কাছ থেকেই। ওদের রেস্তোরাঁয় দেখার পর কেন যেন আর মিষ্টিকে ফোন করতে ইচ্ছে করেনি জোজোর। নিজের সাথে নিজের লড়াই করেই দিনগুলো কাটছিলো। আরো বেশি নিজেকে ব্যস্ত করে নিয়েছে ও,আজকাল আর মেয়েদের ছায়া মারাতেও ওর ভালো লাগেনা কেন যেন। গতবার বাড়ি গিয়ে দুষ্টুর ফোননংটা নিয়ে এসেছিলো জোজো। এসে একবার ফোন করেছিলো তবে আর করা হয়নি।তাহলে কি একবার দুষ্টুকেই ফোন করে সব বলবে? মানে স্যারের কলকাতা এলে ভালো হয়।
ফোনটা হাতে নিয়ে দুষ্টুর নম্বরটা সার্চ করতে যেতেই স্ক্রীন জুড়ে মিষ্টির ছবিটা ভাসে।গতবছরের পুজোর সময় ছবিটা তুলেছিলো জোজো।
ক্লান্ত মনে সাড়া দেয় জোজো.." হুঁ বলছি। কোথায় থাকিস আজকাল? দুদিন গেছিলাম দেখা হয়নি।"
ওদিক থেকে মিষ্টি খিলখিলিয়ে হাসে," কেন রে ফোন করে আসতে পারিসনা? তাহলেই তো সব বলতাম আমি।"
" কি সব বলতিস? কি বলবি বল,আমার শরীরটা ভালো লাগছেনা।"
শরীর খারাপের খবরে একটু উদ্বিগ্ন হয় মিষ্টি,"জেম্মাকে বলেছিস? কি হয়েছে? মানে আমি যাবো?"
খুব ইচ্ছে করছিলো মিষ্টির সাথে একবার দেখা করতে আর কথা বলতে তবুও বললো," থাক।"
থাক বললেও মিষ্টি উচ্ছ্বাসে অনেক কথা বলে গেলো সায়মের কথা। ও ওকে সিরিয়ালে চান্স করিয়ে দেবে মানে আপাততঃ প্রোডিউসার বাইরে উনি এলেই সব ফাইনাল হবে এমন কত কথা। ভীষণ ভালো হ্যান্ডসাম আরও অনেক কিছু সায়ম। মিষ্টির উচ্ছ্বাসে একটু করে হারিয়ে গেলো জোজো।
শুধু বললো," দুষ্টুকে বা স্যারকে কিছু বলেছিস তুই সিরিয়াল করবি?"
" বলবো,দাঁড়া আগে সব ফাইনাল হোক তারপর।জানি বাবা রাগ করবে,তবে আমাকে অভিনয় করতে যখন দেখবে তখন নিশ্চয় মেনে নেবে।"
মনটা সায়মের প্রেমে নেচে উঠলেও একটা সময় নিজেই মেনে নিতে পারলোনা মিষ্টি। হয়ত বা বেঁচে গেলো খাদে তলিয়ে যেতে যেতে।ভাগ্যিস জোজোকে বলে গিয়েছিলো ও প্রোডিউসারের সঙ্গে মিট করতে হোটেল সাজমহলে যাবে সায়মের সাথে।
মধুমিতা প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা কখনোই ছেলের হাতে দেয়না তবুও বলা আছে দরকার হলে তুলিস টাকা। অ্যাকাউন্ট থেকে কিছু টাকা তোলে জোজো।
জোজো আজ কেন যেন মিষ্টিকে অনুসরণ না করে পারেনা তবে হোটেলে ঢুকে মিষ্টিকে বা সায়মকে কোথাও দেখতে পায়না। একটা স্টার্টার অর্ডার দেয় আর ওর চোখ এদিক ওদিক খোঁজে তবে কি ওরা কোন ঘরে? হঠাৎই কেমন যেন মাথাটা গুলিয়ে ওঠে ওর।যদি মিষ্টির কোন বিপদ হয়?
তারপর নিজেকেই প্রশ্ন করে মিষ্টি কি ওকে আসতে বলেছে এখানে? ও তো ওকে না জানিয়েই এসেছে। তাহলে এখন কি করবে?
টয়লেটের দিকটায় একবার যায়। হোটেলটা অনেক বড়,ও কি করে বুঝবে ওরা কোথায়? স্টার্টার ভালো করে খেতে ইচ্ছেও করেনা।কোন রকমে একটু নাড়াচাড়া করে,বিলটা পে করে লিফ্টের কাছে এসে দাঁড়ায়। ও জানে বেশিক্ষণ এখানে দাঁড়ানো যাবেনা এরপর হয়ত ওকে রাস্তাতেই অপেক্ষা করতে হবে। তাছাড়া আরো তো লিফ্ট থাকতেই পারে,ইশ্ কোথায় যে ওরা চলে গেলো বুঝতেই পারলোনা।
বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ও বুঝলো অনেকেই ওকে দেখছে তাই নিচে নামার জন্য ভেবেও লিফ্ট আসতেই ওপরের দিকে রওনা দিলো।হোটেলটা কয় তলা কে জানে? তবুও একটু উঠেই দেখা যাক। একজন হোটেলের স্টাফ ওর কাছে জানতে চাইলো ও কোথায় যেতে চায়? আন্দাজেই জোজো বললো ব্যাঙ্কোয়েট হলে। ছেলেটা আশ্চর্য হয়ে বললো কিন্তু ওখানে তো কোন পার্টি হচ্ছেনা আজ। নিজেকে বাঁচাতে একটু ভেবে জোজো বললো যে ওকে এখানেই আসতে বলেছিলো তবে কি ও ডেটে ভুল করেছে? ছেলেটা অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকায় আর পরিস্কার ইংরেজীতে বলে," ও কোথায় যেতে চায় বললে ওকে সাহায্য করতে পারে। নাহলে বেরোনোর রাস্তা দিয়ে বাইরে যেতে হবে।"
জোজো বুঝতে পারে ও নির্ঘাত একটা ঝামেলায় পড়বে এবার তাই ব্যাক টু প্যাভেলিয়ন ছাড়া কোন উপায় নেই।তবুও শেষ চেষ্টা করে যে এখানে বোধহয় ওকে থাকতে হবে কারণ পার্টিটা মনেহয় কাল আছে তাই আজ ওয়েট করা ছাড়া উপায় নেই।ছেলেটা ওকে রিসেপসনের ফ্লোর বলে দেয়।
অনেকটা উঁচুতে উঠে গেছে জোজো,কেজানে মিষ্টি কোথায়? কোন বিপদ হলো কিনা ওর।সায়ম ছেলেটা যদি ওকে কোনভাবে কাজে লাগায় বা কারো হাতে তুলে দেয়? সত্যিই তো এত বড় হোটেলে কেন আনলো ওকে?
তবুও মিষ্টি ওকে বলেছে তাই ও এতোটা জানতে পেরেছে।কেন যে তখন মিষ্টিকে বারণ করলো না? স্যার ওকে অনেকটা পথ হাত ধরে এনেছেন,নতুনভাবে বাঁচতে শিখিয়েছেন।ওর হাতে লাগানো গাছগুলো ডালপালা মেলেছে ফুলে ফলে সেজেছে দেখে এসেছে এবার। মিষ্টিকে কিছুতেই ডুবতে দেওয়া যাবেনা,দরকারে স্যারকে বলবে এবার।
লিফ্টের ভেতরে একা জোজো অনেকটা ওপরে উঠে গেছিলো ও। এক একটা ফ্লোরে থামছে লিফ্টটা। হঠাৎই একটা ফ্লোরে দরজা বন্ধ হওয়ার আগের মুহূর্তে দৌড়ে ঢোকে মেয়েটা, আরেকটু হলে পড়েই যেতো।
মিষ্টি! জোজো অবাক হয়ে দেখে। কতক্ষণ ধরে খুঁজছে ওকে। মিষ্টির চুল এলোমেলো, হাঁফাচ্ছে ভীষণ যেন ভয় পেয়েছে, জোজোকে খেয়ালই করেনি।
"মিষ্টি"
ততক্ষণে লিফ্ট গ্ৰাউন্ড ফ্লোরে এসে গেছে। জোজোর হাতটা চেপে ধরেছে মিষ্টি দুজনে পা বাড়ায় রাস্তার দিকে।মিষ্টি বলে," চল তাড়াতাড়ি,এক্ষুণি এখান থেকে চল। তুই কোথা থেকে এলি এখানে? কি করছিস এখানে?"
"ভাগ্যিস এসেছিলাম।"
ততক্ষণে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে মিষ্টিকে নিয়ে উঠে পড়ে তাড়াতাড়ি।
কিন্তু কোথায় যাবে এখন ওরা? মিষ্টির দুচোখে আজ অনেক স্বপ্নের বদলে ভর্তি জল আর তার সাথে ভয়ের ছাপ চোখেমুখে।
" আমি এখন এভাবে কিছুতেই হস্টেলে যেতে পারবোনা। তুই আমাকে বরং ট্রেনে বা বাসে তুলে দে আমি বাড়ি যাবো।"
জোজোকে কথাগুলো বলেই নিজেকে সামলায় মিষ্টি,কিন্তু বাবা? সবাই তাহলে জিজ্ঞেস করবে ও হঠাৎই এভাবে কেন এসেছে?
জোজো ধমকায় মিষ্টিকে," কি হয়েছে আমাকে বল,আমি বাবার বন্ধু পরিতোষকাকুকে ফোন করে সব বলবো।তোর সায়মকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাবে।"
জোজোর হাতট চেপে ধরে মিষ্টি ভয়ে," না না তুই কাউকে বলিসনা,কিছু।আমি ঠিক আছি এই দেখ আমার কিছু হয়নি ক্ষতি মানে ওরা আমার কোনো ক্ষতি করতে পারেনি।"
******************
ট্যাক্সিটা এসে ওদের বাড়ির সামনে দাঁড়ায়,মিষ্টিকে আগে শান্ত করতে হবে ওর কথা শুনতে হবে তারপর যা হয় হবে।
বাথরুমে শাওয়ারের তলায় গিয়ে ভালো করে স্নান করে মিষ্টি।ঝরনার জলের সাথে অনেকটা চোখের জল বেরিয়ে এসে আর বাঁধ মানতে চায়না,আজ আবার ছোটবেলায় ফিরতে ইচ্ছে করছে।বাবা বোধহয় ঠিকই বলেছিলো সব কিছু সবার জন্য নয় তবে শিক্ষা সবার জন্য তাই আমাদের দেশের সবাই প্রথমে শিক্ষার আলো পাবার চেষ্টা করে।
সায়মের কথা মনে হতেই একদলা ঘেন্না মুখ থেকে ঝরে পড়ে দালাল একটা ছিঃ। দেহ দিয়ে একরাত হোটেলে থেকে ভালো নায়িকা হতে ও চায়না।কেজানে হয়ত সবটাই ভুঁয়ো,আদৌ হয়ত ওর কোথাও চান্স পাওয়া হতোনা তার বদলে হয়ত ব্ল্যাকমেইলড হত প্রতিটা পদক্ষেপে।ওর চাকরিটাও আর করা হতনা।কালচিনির মিষ্টি মুখে কালি মেখে হারিয়ে যেত কোথায় কোন অজানা অন্ধকার খাতে।
মিষ্টির কাছে সবটা শুনে রাগে মনটা ফুটতে থাকে কিন্তু মিষ্টি ওকে প্রমিস করালো এই কথা যেন ও কাউকে না বলে। আজ এই মুহূর্তে সায়ম আর ওর রূপোলী জগতের স্বপ্ন চিরতরে মুছে ফেলতে চায় মন থেকে। কালচিনির মিষ্টি ফিরতে চায় চাবাগানের সবুজে অথবা টিয়াপাখির ডাক শুনতে শুনতে হারিয়ে যেতে কালজানি নদীর ধারে।
" কিন্তু তুই তো সায়মের সাথে অনেক ঘুরেছিস ও যদি তোকে ব্ল্যাকমেইল করে? ওর মাসতুতো বোনের সাথে কথা বলা দরকার। ওরা যদি কলেজে কিছু বলে?"
অনেকগুলো চিন্তা নিয়ে কেঁদে ফেলে মিষ্টি।
ওর হাতে হাত রাখে জোজো.." এতো ভাবিসনা আছি তো আমরা।"
মাকে কিছু গোপন করেনা জোজো। চিন্তায় পড়ে মধুমিতা তবুও কিছু বলতে পারেনা কাউকে ছেলে বারবার প্রমিস করিয়েছে।
মিষ্টি কয়েকদিনের জন্য থেকে যায় ওদের বাড়িতেই।তিনটে ঘর সুতরাং খুব একটা অসুবিধা হয়না। কিন্তু খুব মনকেমন করে মিষ্টির,অন্যায় করতে করতে বোধহয় মিথ্যের জালও শক্ত হয়ে যায় চট করে ছেঁড়া যায়না।তাই ভেবে পেলোনা বাবাকে কি বলবে যে ও এখানে কেন আছে? নাকি কিছুই বলবেনা?
******************
আকাশে বাতাসে আবার পুজোর সুবাস,তবুও মিষ্টির মনে খুশি নেই।সারাক্ষণ একটা ভয় আর বিশ্বাস হারানোর যন্ত্রণা ওকে ছুঁয়ে রেখেছে। কিছুতেই যেন মুক্ত করতে পারেছেনা নিজেকে একটা ভয় সবসময় ঘিরে রেখেছে কড়া পাহারায়।আর তার সাথে বাড়িতে সবটা না বলতে পারার যন্ত্রণা।
দুদিন হলো এখানে এসেছে মিষ্টি,মোটামুটি নিজেকে ঘরের মধ্যেই বন্দি রাখে। তেমন কিছু খেতেও চায়না। জোজোও ওকে চাপ দেয়নি কিছু বলার জন্য।শুধু বুঝতে পারে মিষ্টি এখানে থাকার ব্যাপারে একটু সঙ্কুচিত। তাই যখন ও চলে যেতে চাইলো জোজো নিজেই বললো," মা তো জানে তুই এখানে আছিস,দুদিন যখন থেকেছিস সাতদিন থাকলে কোন অসুবিধা হবেনা।পুজোর ছুটির তো আর বেশি দিন নেই।থাকলি নাহয় কয়েকটা দিন এখানে।তারপর একসাথে বাড়ি যাবো দুজনে।"
" কিন্তু এখানে এভাবে থাকাটা কি ঠিক হবে?" কাচুমাচু মুখে মিষ্টি বলে।মিষ্টিকে দেখতে এখন একটা বাচ্চা মেয়ের মত লাগছে। মেকআপ করা মুখের ভেতর থেকে বাইরে উঁকিঝুঁকি মারছে সরল সাধাসিধে একটা মুখ। শরতের সোনা রোদের মাখামাখি সেই সোনা মুখটাতে। প্রেমে পড়ে যায় জোজো।
মিষ্টির মুখের হাসিটা খুব মিস করে,এত কাছে আছে মিষ্টি বেশ কয়েকটা বছর পরে অথচ মুখে হাসি নেই। না না কিছুতেই মিষ্টি হারবেনা,ও দেবেনা হারতে মিষ্টিকে।
পাহাড়ের ঘোরানো পথ দিয়ে ঘুরে ঘুরে ওপরে উঠছে বাসটা। সবাই খুশিতে আনন্দ করছে নিজের মত।পুজোর আর বেশি দেরী নেই দুষ্টুদের কলেজ থেকে সবাই মানে ওদের ইয়ারের ছেলেমেয়েরা যাচ্ছে দার্জিলিং। মেঘকুয়াশার ঘোমটা সরিয়ে মাঝে মাঝেই শরতের আলো পড়ছে চোখেমুখে। সত্যিই দার্জিলিং অনন্যা এক পাহাড়ের রানী। দার্জিলিং নিজের মত সুন্দরী।বাস রাস্তার পাশ দিয়েই টয়ট্রেনের লাইন মনকে নিয়ে যাচ্ছে ছায়াছবির জগতে। আনন্দে সবাই মেতেছে,অনেকদিন বাদে বাইরে যাওয়া।যদিও ওখানে গিয়ে চারদিন থাকবে শুনে অনু আপত্তি করছিলো খুবই তবুও রবীনই বলে.." এবার একটু ছাড়তে হবে অনু মেয়েদের।ভালো মন্দ সবটাই যে ওদের নিজেদের জেনে বুঝে নিতে হবে। আমরা আর কতদিন মাথার ওপর পাহারা দিয়ে পথ দেখাবো?"
অভিমান করে অনু," তুমিই তো বলো ওদের সামলে রাখতে দিনকাল ভালোনা। এই নিয়ে তো মিষ্টির সাথেও তোমার মন কষাকষি, রাগ করেছিলে অ্যাড করতে চেয়েছিলো তাই।"
রবীন জানে অনুরও ইচ্ছে ছিলো মিষ্টি অ্যাড করুক তাই কথাটা বললো।
" আচ্ছা অনু অ্যাড করা,অভিনয় করা আর কলেজের এডুকেশনাল ট্যুরে যাওয়া কি এক হলো? অনেকদিন কোথাও যায়না মেয়েটা,ঐ জলপাইগুড়ি আর বাড়ি। যাক ঘুরে আসুক।আর কাছেই তো,মাত্র তো কয়েকঘন্টার পথ।"
"চিরকালই তুমি দুষ্টুকে প্রশ্রয় দাও।"
" হ্যাঁ দিই তো,আর তুমি মিষ্টিকে। আজ মিষ্টিকে ফোন করলে আমাকে একটু দিয়ো তো।দুদিন ভালো করে কথা হয়না মেয়েটার সাথে।"
অনুও দেখেছে অল্প দুএকটা কথা বলে ফোনটা রেখেছে মিষ্টি,বলছিলো মাথা ধরেছে। গতকাল বললো ঘুম পেয়েছে।দেখা যাক আজ কি বলে।রান্নাঘরে গজগজ করতে করতে ঢোকে অনু যত জ্বালা হয়েছে ওর।
ফোনটা বাজে, রবীন ধরতেই দুষ্টু ফোনে কলকলিয়ে ওঠে," বাবা তোমাদের খুব মিস্ করছি।দিদি এলে সবাই মিলে আসবো এখানে আবার। কি সুন্দর চারিদিকে শুধু সাজানো গোছানো পাহাড়,বাড়িঘর আর গাছপালা।"
হাসে রবীন," তোর মাথাটা গেছে একদম! পাহাড় আবার কেউ গুছিয়ে দেয় নাকি?"
" সত্যিই বাবা খুব সুন্দর, বিশ্বাস করো।আমাদের হোটেলটা ম্যালের কাছে জানলায় দাঁড়িয়ে পাহাড় দেখা যাচ্ছে। উঃ কি ঠান্ডা! কিন্তু খুব ভালো লাগছে।"
মেয়ের উচ্ছ্বাস দেখে খুব ভালো লাগে রবীনের। পাহাড়ের প্রেমে রবীনও মুগ্ধ কিন্তু অনু পাহাড়ে উঠলেই বমি করে তাই আর যাওয়া হয়নি এত কাছে হলেও।
সংসারের জন্য অনেক সময়ই ছাড়তে হয় অনেক কিছু ছেলে বা মেয়ে সবাইকে।
*******************
মিষ্টির ঘরের পরদাটা টানা,এরমধ্যে সায়ম কয়েকবার ফোন করেছে প্রত্যেকবারই শাসিয়েছে কারণ ওদেরকে পুলিশের ভয় দেখিয়ে মিষ্টি চলে এসেছে হঠাৎই ছিটকে,তাড়াহুড়োতে কিভাবে যে দরজা খোলা পেলো কেজানে? মিষ্টি বলেছিলো ও এখানে এসেছে সেটা পুলিশ জানে কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে যাবে পুলিশ ওর ফোনে ট্র্যাকার লাগানো আছে। তখন কি করে যে এতটা বুদ্ধি হয়েছিলো কে জানে?
মিঃ ঝুনঝুনওয়ালা সায়মকে অপমান করতে ছাড়েনি,প্রচন্ড শাসিয়েছে ওকে এমন একটা মেয়েকে জোগাড় করার জন্য।শুধু শুধু হয়ত পুলিশের ঝামেলায় পড়তে হবে।
সায়মের ফোনটা রেখে বিষাদে ডুবে যায় মিষ্টি তবে কথা বলতে ও ছাড়েনা..জোজোর পরিতোষকাকুর রেফারেন্স দিয়ে বলে বেশি বাড়াবাড়ি করলে একদম ওর ফ্ল্যাট থেকে তুলে নিয়ে যাবে। দরকার হলে ওর বোনকেও ধরবে।একটু দমে যায় সায়ম ফোনটা রেখে দেয়।
জোজোই ওকে বলেছিলো," একদম ভয় পাবিনা ও যদি তোকে শাসায় তাহলে এইভাবে উত্তর দিবি তার পরেরটা আমি দেখছি।পুলিশ মিডিয়ার লোক আমারও কিছু আছে।"
মিডিয়া আর পুলিশ শুনে মিষ্টি চমকে ওঠে," সে তো অনেক লোক জানাজানি।বাবা তাহলে কি করবে?"
মুখ ঢাকে মিষ্টি। ওর মাথায় হাত রাখে জোজো "তাই বলে তুই ছেড়ে দিবি ওদের? তোর মত আরও অন্য কত মেয়ের সর্বনাশ হয় এভাবে জানিস?"
কান্নায় ভাসে মিষ্টি," সত্যিই আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। আমি আর বাঁচতে চাইনা।"
জোজো মিষ্টিকে বোঝায়," পালিয়ে যাবি? তাহলে কি স্যার মুখ দেখাতে পারবে?"
ইউটিউবটা অনেক আগেই অন করা ছিলো... গানটা বাজতে থাকে ওদের কথার মাঝেই
যদি কেড়ে নিতে চাও
কবিতা ঠাসা খাতা
জেনো কেড়ে নিতে দেবোনা।
...........
আজ আমি জানি জানি
চোরাবালি কতখানি
হারানো স্বপ্নের খোঁজ।
মিষ্টির মনে গিয়ে ধাক্কা দেয় গানের কথাগুলো। জোজো বলে," তোর কিছু এভাবে কাউকে কেড়ে নিতে দেবোনা। আছি তো সাথে আমরা সবাই এত ভয় কি?"
মিষ্টি চোখের জলে ভেসে মুখ ডোবায় নরম বালিশে। জোজো রান্নাঘর থেকে স্যান্ডউইচ নিয়ে এসে বলে," আমি জেম্মার মত লুচি পারিনা,ম্যাগি,স্যান্ডউইচ, খিচুড়ি পারি।তোর জন্য বানিয়েছি খেয়ে নে। সামনের সপ্তাহে মা আসছে,আজ ফোনে বললো।"
একটু চমকে ওঠে মিষ্টি জেম্মা আসছে শুনে।তার আগেই ওকে চলে যেতে হবে এখান থেকে।
জোজো ওর চোখের ভাষা পড়তে পারে," মা বলেছে যে মা না আসা পর্যন্ত এখান থেকে না নড়তে।"
*********************
ভোরের কুয়াশা মুখে মাখে দুষ্টু,বন্ধুরা তখন অনেকেই ঘুমিয়ে।কিছুক্ষণ বাইরে চোখ রেখে ডাইরিতে কলম ছোঁয়ায় দুষ্টু। বাইরের প্রকৃতি তখন একটু একটু করে রোদের আদর মাখছে। দিদিটার কথা বারবার মনে হচ্ছে।দিদিকে খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে বলতে চেয়েছিলো সবটা,দিদিটা যেন পাত্তাই দিলোনা।বললো ওর শরীরটা ভালো নেই,পরে কথা বলবে।অবশ্য বললো খুব মজা করতে আর ছবি তুলতে।
ডাইরি লিখতে আর প্রকৃতির সদ্য ঘুমভাঙা রূপে ডুবে যায় দুষ্টু,বেশ শীত লাগছে তাই স্কার্ফটা মাথায় জড়ায়।আজ সকালে ওরা বেরোবে কিন্তু ব্রেকফাস্ট করে দশটায়।বাইরেটা দেখে খুব হাঁটতে যেতে ইচ্ছে করে দুষ্টুর। কাঠের সিঁড়িতে পা রাখবে ভাবে এমন সময় হঠাৎই পিঠে একটা আলতো ছোঁয়া পায়,ঘুরে তাকাতেই দেখে মুন্না। মুন্না নেপালি,আগে দার্জিলিঙে থাকতো এখন কালিম্পঙে থাকে।
কাটা কাটা বাংলায় বলে.." হাঁটতে যাবি? চল আমার সাথে। আমাদের বাড়ি কোথায় ছিলো তোকে দেখিয়ে আনি।"
ব্যাস আর কথা নয় একদম রেডি টু ওয়াক। হাঁটতে হাঁটতে ওরা অনেকটা নিচে নেমে এসেছে।এখান থেকেও ওদের হোটেলটা দেখা যায় তবে ঠিক একটা দেশলাইয়ের বাক্স লাগছে। অনেকটা হাঁটার পর ফেরার সময় রাস্তার পাশে রাখা চেয়ারে কিছুক্ষণ বসে ওরা।মুন্না ওকে ওর স্কুলের গল্প বলে,চার্চ লাগোয়া ছবির মত স্কুল ওদের। তখন কিছু ছেলেমেয়ে ইউনিফর্ম পরে ব্যাগ কাঁধে স্কুলে আসছে।ওদের ভাষায় কয়েকজনের সাথে মিষ্টি করে কথা বলে মুন্না। ততক্ষণে ওরা বেশ কিছুটা ওপরে উঠে এসেছে।রাস্তা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে দুএকটা জিপ।পাহাড়ি ফুলেরা যেখানে সেখানে ফুটেছে আপন খেয়ালে।
হঠাৎই উল্টোদিক থেকে আসা একজনকে দেখে চমকে যায় দুষ্টু...অবাক হলেও চিনতে একটুও ভুল হয়না,দীপ্তদা!
তাহলে কি পৃথিবীটা সত্যিই গোল?
*****************
মেঘ কুয়াশার বাষ্প সরিয়ে সদ্য আলোর লুকোচুরির মধ্যেই যেন হারিয়ে যাওয়া একটুকরো আলোর ঝলক দেখতে পেলো দুষ্টু।সেই ঋজু চেহারা প্রায় ছয় ফিট তিন ইঞ্চি লম্বা যাকে দেখে দুষ্টুর মাঝেমধ্যে খুবই রাগ হত তাই বাবাকে বলে বারান্দায় দুটো ঝোলার রিঙ লাগিয়েছিলো।অবশ্য তাতে ঝুলে,স্কিপিং দড়ি লাফিয়ে দুষ্টু মাত্র পাঁচ ফিট সাড়ে সাত ইঞ্চি। অবশ্য সেই হাইট দেখেই মায়ের মোটামুটি অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা.." এই মেয়েকে কোন পাত্রর সাথে বিয়ে দেবে? এমন সিরিঙ্গী লম্বা?"
আজ দূর থেকে সেই সিরিঙ্গী লম্বা ছেলেটাকে লক্ষ্য করলেও যখন পাহাড়ি রাস্তার ঢাল বেয়ে গড়গড়িয়ে নেমে এলো প্রায় ওর কাছেই তখন দুষ্টু লাফিয়ে গিয়ে পথ আটকালো.." দীপ্তদা! আই থিঙ্ক আই অ্যাম রাইট।"
গায়ে কোট গলায় টাই পায়ে কালো পলিশ করা জুতোতে এ যেন এক অন্য দীপ্তদা। বেশ অন্যরকম, গালেও ঠান্ডায় বেশ লালচে আভা।
দুষ্টু যেন কেমন বোকা বোকা হয়ে যায়,একি কিছু বলছেনা কেন? অথচ দাঁড়িয়ে পড়েছে লোকটা মানে ছেলেটা। অবশ্য যাবেই বা কি করে ও তো দুদিকে দুহাত দিয়ে পথ আটকে রয়েছে। মুন্না ওর হাত ধরে টানে,নেপালী ভাষায় কিছু বলে ছেলেটাকে। হঠাৎই দুষ্টুর খেয়াল হয় ওকে চিনতে পেরেছে তো দীপ্তদা? জিন্সের প্যান্ট, গায়ে জ্যাকেট,কপাল মাথা ঢাকা আর চোখে চশমা। না চেনাটাই স্বাভাবিক।
তাই মাথার স্কার্ফ আর চশমাটা খুলতে খুলতে বলে.." আমি দুষ্টু,চিনতে পারছোনা?"
অনেকদিন বাদে দীপ্তদার সেই পুরোনো হাসিটা দেখলো দুষ্টু।আকাশও যেঘদের বকুনি দিয়ে দূরে সরিয়ে খিলখিল করে হাসলো।
" দুষ্টু! তুই এখানে? সরি রে আমি সত্যিই প্রথমে চিনতে পারিনি।অবাক হয়ে গেছিলাম,চোখদুটো কালো চশমায় ঢেকেছিস কেন? এভাবে ইংরেজী তে বললি আমি তো ভাবলাম আমার কলেজের কোন জুনিয়র। তাই চুপ করে গেছিলাম।"
পাহাড়ি ঝর্ণার সামনে থেকে পাথর সরিয়ে নিলে যেমন কলকল করে জল বইতে থাকে অমনি কলকল করে উঠলো দুষ্টু.." চোখে ঠান্ডা লেগেছে গো।আমি প্রথমে অবাক হলেও পরে বুঝেছি তুমি আমাকে চিনতে পারোনি। তুমি এখানে কেন? চাকরি করছো? বাবাকে ভুলে গেলে এভাবে? বাবা খুব কষ্ট পেয়েছে।"
ঘড়ির দিকে তাকায় দীপ্ত।দুষ্টু বোঝে দীপ্তর তাড়া আছে তাই বলে," তোমার তাড়া আছে? কোথাও যাচ্ছো? আচ্ছা তোমার ফোননম্বরটা অন্ততঃ দাও পরে কথা বলে নেবো।'
দীপ্ত কয়েক পা সামনে এগোতে এগোতে বলে," তোর নম্বরটা বল,সামনে আমার স্কুল আরো কিছুটা নামতে হবে। তোর নম্বরটা বল,আমি ফোন করবো। কোথায় উঠেছিস নামটা বল।"
দুষ্টু নম্বরটা বলে...যেতে যেতে দীপ্ত বলে," আমি বিকেলে ফোন করবো,এখন আসি।"
দুষ্টু অবাক হয়ে কথাগুলো ছড়িয়ে দেয় দীপ্তর নামার পথে," নম্বরটা নোট করলে.....না? মনে থাকবে?"
পাথরে ধাক্বা খেয়ে উত্তরটা ফিরে আসে," মনে নোট করে নিলাম।"
অবাক হয়ে যায় দুষ্টু দীপ্ত তখন অদৃশ্য হয়ে গেছে পাথরের বাঁঁকে।
মনে একটা জিজ্ঞাসা চিহ্ন এত্তো বড় হয়ে দেখা দিলো ইশ্ সত্যিই কি দীপ্তদা ধরা দেবে? নাকি ধরা দেবেনা বলেই ফোননম্বরটা সেভ করলোনা পর্যন্ত! তবে দুষ্টুর ভীষণ ভালো লাগলো এইভাবে হঠাৎই দীপ্তদাকে পেয়ে।একটা সময় খুব যে একটা খুশী লাগতো ওকে দেখে তা নয় বরং বাবা বেশি প্রশংসা করতো বলে দিদির মত অতটা মুখ ভার না হলেও খুব একটা ভালো লাগতোনা। কারণ মা অনেক সময়ই বলতো," বাইরের ছেলেদের মানুষ করতে যতটা সময় নষ্ট করে ততটা সময় যদি মেয়েদুটোকে দিতো।"
অবশ্য বাবা একদিন শুনে নিয়ে মাকে বলেছিলো," বাইরের কোথায় অনু? ঘর গড়ার সাথে সাথে যে সমাজও গড়তে হয়।শুধু মেয়েদুটোকে শেখালে হবে লোকশিক্ষাও করতে হয়। ভালো কাজ হলো আয়নার মতই কখনো না কখনো তোমার কাছে ফিরবেই।"
অনুকে বলা রবীনের কথাটা যে কতটা সত্যি আর তা প্রমাণিত সেটা রবীন না জানতে পারলেও মিষ্টি বুঝলো। একদিন বাবা জোজোকে বকে,ভালো কথায় কখনো বা শাস্তি দিয়ে ভালো করেছিলো বলে হয়ত তারই প্রতিফলন,বা সুফল আজ ওর জীবনে। সত্যিই তো এই খারাপ সময়ে যখন ও একদম একা তখন তো বাবার শিক্ষায় শিক্ষিত ছাত্রই ওকে আগলে রেখেছে।এই আগলে রাখা শুধুই আত্মীয়তা নয়, ছাত্রের স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞতাও বটে।
মিষ্টি বাবাকে কিছু বলতে না চাইলেও মাকে বললো মানে জোজোই বলতে বললো।
" ভয় কি বাবা মাকে তোর? হয়ত বকবে রাগ করবে কিন্তু ক্ষমাও করে দেবে। তিনদিন ধরে এখানে আছিস এবার বল জেম্মাকে।"
অনু শুনে কেমন যেন আঁতকে উঠলো সব কথা।অতবড় হোটেলে যদি ওরা মিষ্টিকে আটকে রেখে শারীরিক অত্যাচার করতো? মেরেও ফেলতে পারতো? কি হত তাহলে? সেইজন্য ওর বাবা কিছুতেই চায়নি যে মেয়ে অন্য পথে যাক।
ধরা গলায় অনু বলে," সেই কবে তোর বাবার হাত ধরে পুরুলিয়া থেকে এসেছিলাম। তারপর থেকে শুধু সংসারই করে গেছি।তোদের মত তো অনেক কিছুই বুঝিনা তবুও গর্ব করি যে আমার মেয়ে দুটো ভালো মানুষ হয়েছে। এতো কিছু হলো আমাকে একবারও জানালি না?"
কাঁদে মিষ্টি,আজ ওর চোখের জল বাঁধনহারা," ভয়ে মা, আমি বাবাকে ভয় পেয়েছি আসলে বাবার অমতেই তো পা রেখেছিলাম নিজের ইচ্ছেতেই তাই। তুমি বাবাকে বোলোনা মা কিছু। দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে।"
অনেক না বলা কথা জানলো অনু কষ্ট পেলো বুঝতে পারলো মেয়েদেরও গোপনীয়তার জগত হয়েছে সেই ছোট্টবেলার মত আর মায়ের কাছে এসে দমবন্ধ করে একনাগাড়ে মিষ্টি বলে ফেলেনা পেটে জমে থাকা সব কথা। মিষ্টিরও মনের মধ্যে তাহলে গোপন লকার হলো? আর দুষ্টু তো সেই কবে থেকেই লুকিয়ে লুকিয়ে ডাইরি লেখে।কেজানে তারমধ্যে কি লেখে মেয়েটা?
রবীন স্কুল নিয়ে নানা অশান্তিতে থাকে তারমধ্যে এত বড় ঘটনা ঘটেছে। মানুষটা না অসুস্থ হয়ে পড়ে এর মধ্যেই প্রেসার সুগার এসে গেছে। বাইরের বারান্দায় চুপ করে বসে অনু আজকাল শূন্যতা ওকেও গ্ৰাস করে মাঝে মাঝে।এই সপ্তাহে দুষ্টুটাও আসেনি বেড়াতে গেছে।খুব খুশি মেয়েটা বাইরে যেতে পেরে। ও নিশ্চয় জানেনা মানে মিষ্টি ওকে কিছু বলেনি।নানা চিন্তায় কেমন যেন হারিয়ে যায় অনু।বাইরের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে এক ঝাঁক পাখির গান।
হঠাৎই ফোনটা আবার বাজে,ইচ্ছ করেনা ধরতে অনুর তবে আবার বাজতে উঠে যায়।ফোনের ওপারে রাণু,অনু বুঝতে পারলো রাণু জানে সবটাই। মানে ওর জায়ের কাছে শুনেছে।নিজেকে কেমন যেন বোনের শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়ের কাছে ছোট মনে হলো অনুর।
রাণু অনুকে বোঝায়," দিদি তুই এত ভাবছিস কেন? ওরা ছোট থেকেই ভাইবোনের মত বড় হয়েছে। এই সময় জোজো মিষ্টির সাথে আছে সেটাই তো ভালো।"
" তোর জা কি ভাবছে কে জানে? আর তৈর ভাসুরও তো একটু রাগী মানুষ।"
" দিদি তুই ভাবিসনা,কেউ কিছু ভাবছেনা।আচ্ছা জোজো খারাপ হয়ে যায়নি একটা সময়?ঠিক আছে একটা ভুল করেছে ঠিক হয়ে যাবে সব। আমি একদিন যাবো,অনেকদিন যাইনা।"
রাতে রবীনকে একটু একটু করে সব খুলে বলে অনু। রবীনের মুখটার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন ভয় করে ওর। রবীনের মুখের রেখার দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে।আজ যেন ভেতরের ছবিটা শুধুই মুখে স্পষ্ট রবীনের, মুখের সব কথাই জমলো মনে। সব শোনার পর অনুকে বললো," আজ থাক অনেক রাত হয়েছে। কাল মিষ্টিকে আর জোজোকে ফোন করবো আমি।"
অনু কান্নাভেজা গলায় বলে," মেয়েটা একদম ভেঙে পড়েছে।তুমি খুব বোকোনা মানে রাগ কোরোনা বেশি।"
রবীন অনুর হাতে হাত রাখে," চলো পাল্টাই এই শ্লোগানটা আমি অনেক আগেই শুনেছিলাম কালচিনিতে বসেই। ঠিক আছে নিজেই তো বুঝতে পেরেছে ও অনেক কিছু। ওকে বোলো আমি এমনি গল্প করবো ওর সাথে।"
দীর্ঘশ্বাস পড়ে রবীনের।অনু বলে," ভাগ্যিস জোজোটা ছিলো।"
রবীন বলে," ঘরের খেয়ে এতদিন মনে হয় শুধুই বনের মোষ তাড়াইনি। আমার ছাত্ররা আছে আমার কাছে।"
" সবাই আছে তোমার কাছে,তোমার মেয়েরাও আছে।"
ফোনটা বেজে ওঠে আপন ছন্দে আবার।ওদের নিস্তব্ধতাও ভঙ্গ হয় ফোনের শব্দে।রবীন উঠে দাঁড়ায় ফোন ধরতে,নিশ্চয়ই দুষ্টু ফোন করেছে। সারাদিন বাদে এই সময় ফোন করে মেয়েটা তারপর মনের খাতার পাতা খুলে দেয় আর অক্ষরের পর অক্ষর সাজিয়ে শব্দের ঝর্ণা বইতে থাকে অঝোরে।
" বাবা আজ তোমাকে একটা অনেক অনেক ভালো খবর দেবো তোমার মন একদম খুশিতে ডানা মেলে উড়ে যাবে চাবাগান ছাড়িয়ে,রেললাইন পেরিয়ে ঐ দূরের পাহাড়ে। অথবা আমার কাছে এই দার্জিলিংয়েও উড়ে আসতে পারে। বলতো কি?"
কেন যেন রবীনের মনে হয় অদ্ভুত একটা ঝোড়ো বাতাসের ছোঁয়া আছে দুষ্টুর কথায় যাতে উড়ে যায় মনের সব দুঃখ আর অবসাদ। অনুকে এটা বুঝিয়ে বলতে পারেনা রবীন যে দুষ্টু পাহাড়ি ঝর্ণার মতই মনকে ঠান্ডা করে।
রবীনের গলাটা আজ একটু নিভু নিভু সেই গমগমে আওয়াজটা পায়না দুষ্টু। তাই আবার বলে.." ভালো করে বলো,কি হয়েছে রে? কি আবার হলো?"
নিজেকে সামলায় রবীন.." এতো খুশি কেন? খুব মজা করছিস তাইতো? সব লিখে রাখবি আমাকে শোনাতে হবে কিন্তু। এবার বল কি হয়েছে?
বাবা আজ দীপ্তদাকে দেখেছি হঠাৎই, মানে দেখা হয়ে গেলো।ভাগ্যিস সকালে হাঁটতে গেছিলাম। খুব স্মার্ট লাগছিলো বাবা।ভীষণ ভালো,একটু অল্প কথা হয়েছে। এখানে একটা মিশনারী স্কুলে পড়ায়। আর বেশি কিছু কথা হয়নি। তবে আমাকে ফোন করেছিলো বাবা কাল আসবে বলেছে।"
দুষ্টুর কথার মাঝে রবীন ডুবে যায় এক নিরুদ্দেশীকে খুঁজে পাওয়ার আনন্দে। ছেলেটা আছে তাহলে। একদম হারিয়ে যায়নি নিরুদ্দেশের ঠিকানায়।
দুষ্টুর কলকলানির মধ্যে বলে," ধরে আনতে পারবি ছেলেটাকে?কানদুটো ভালো করে মলে দিতাম।"
দুষ্টু বলে," ঠিক ধরে আনবো বাবা খোঁজ যখন পেয়েছি।আসবে তো আমার সাথে দেখা করতে।"
দুষ্টুর ফোননম্বরটা মনে নোট সত্যিই করে নিয়েছিলো দীপ্ত তা বোঝে দুষ্টু ওকে বিকেলে ফোন করতে..." আজ আর যেতে পারলামনা রে,আমাদের চার্চের একটা কাজে কালিম্পঙ যাচ্ছি। কাল আসবো ঠিক।"
দুষ্টু ওপাশ থেকে বলতেই থাকে...." কাল আসবে ঠিক। আর না এলে আমি স্কুলে চলে যাবো।মুন্না পড়তো ঐ স্কুলে।"
দুষ্টুর এক নাগাড়ে কথার মাঝেও রবীনের মনে হয় সত্যিই আসবে তো ছেলেটা নাকি হারিয়ে যাবে আবছা কুয়াশার অন্ধকারে আবার?
*******************
পুজোর গন্ধ লেগেছে কলকাতার আকাশে বাতাসে,মেঘেরা নিয়ে এসেছে শারদীয়ার চিঠি।জোজোর ক্যামেরাও একটু আনচান করছে স্মৃতি আর খুশিকে ঝাঁপিবন্দি করতে কিন্তু মিষ্টিকে রেখে বেরোতে পারেনা।
কদিন মিষ্টি বিছানাকেই বন্ধু করে নিজেকে বদ্ধ ঘরে আটকে রেখেছে।ওর ঢেউ ওঠা চুল কদিনেই অযত্নে অগোছালো। চোখের পাতা আর নাচেনা নরম হাসিতে।ব্যালকনিতে বসে মনটা উদাস হয় জোজোর,এই নিয়ে আরেকটা দিন চলে গেলো,মিষ্টি কত কাছে অথচ ভালো করে কথা বলাই হয়না। শরতের আনাগোনার খুশির ছোঁয়া যদি একটু লাগতো মিষ্টির মুখে। দুবছর আগের স্মৃতির আলপনা আলগোছে ছুঁয়ে যায় জোজোর মন।
যদিও সায়মের ফোন করা বন্ধ হয়েছে অবশ্য এর মধ্যে রুম্পারও হদিস করেছে জোজো। জানতে পেরেছে সায়ম ওর দূর সম্পর্কের দাদা।ও আলাপ করিয়ে দিয়েছিলো ঠিকই মিষ্টির সাথে কিন্তু তারপরে আর কিছু জানেনা।
জোজো একটু কড়া হয়," জানোনা ঠিক আছে,তবে নিশ্চয় জানো ও কি করতো? এখনও মিষ্টিকে বিরক্ত করছে। পুলিশ ঢুকলে কিন্তু তোমাকেও ছাড়বেনা।"
পুলিশের কথায় একটু ঘাবড়ায় রুম্পাও যদিও রেগে যায় হঠাৎই.." মিষ্টির লোভ ছিলো সিরিয়াল করার আমি সব বলবো পুলিশকে।"
" আচ্ছা দেখা যাক কি বলবে? আমার তো মনে হয় তুমিই বন্ধু সেজে মিষ্টির সর্বনাশ করেছিলে। এরপর দরকার হলে সব বের হবে।"
তখনকার মত কিছুটা শান্ত হয়েছিলো পরিস্থিতি।জোজো বুঝেছিলো সায়ম একটু নতুন বোধহয় এই ব্যাপারে তাই খুব একটা এগোতে পারেনি আর তবে তবুও সাবধানে থাকতে হবে মিষ্টিকে।
মিষ্টির বন্ধ মনের ভয়ের আর সঙ্কোচের ধাক্কায় বন্ধ করা জানলা একটু খুলতে চায় জোজো। ফিরে আসার পথে মিষ্টির সেই প্রিয় চকোলেট আর একটু খাবার নিয়ে ফেরে।ভেবেই আসে আজকে বাড়িতে এসে দুকাপ কফি আর স্ন্যাকস চকোলেট খেয়ে মিষ্টির মনটাকে একটু স্বস্তির বাতাস লাগতে দেবে। ওর মুখের সেই মনে দোলা দেওয়া হাসিটা খুব মিস্ করে জোজো। এর মাঝে দুষ্টু ফোন করেছিলো,ইশ্ একদম ঝড় বইয়ে দিলো।
মিষ্টির নিস্তব্ধতার মধ্যে দুষ্টুর আনা উত্তুরে ঠান্ডা বাতাস বেশ লাগলো জোজোর আর তার মধ্যে যখন খবর পেলো দীপ্তকে মেঘকুয়াশার আলো আঁধারিতে খুঁজে পেয়েছে দুষ্টু তখন সত্যিই মন ছুটে গেলো। কলকাতার ফ্ল্যাটে বসে জোজোর অবাধ্য দুষ্টু মনটা নিমেষে উড়ে গেলো মিষ্টিকে সাথে নিয়ে কুঝিকঝিক টয়ট্রেনে করে দার্জিলিং।উঃ সেই কবে ছোটবেলায় গিয়েছিলো! ক্যাভেন্টার্সে আর গ্লেনারীজে খাওয়া পাহাড়ের ভালোবাসা গায়ে মাখতে মাখতে।
উফ্ কল্পনাকে সঙ্গী করেই কিছুক্ষণ জোজো ভাঙলো পাহাড়ের ঘোরানো পথ বেয়ে চড়াই আর উতরাই। এমন যদি হত সেই আবার আগের মত দীপ্তর সাথে গলা জড়াজড়ি করে পা মেলাতে মেলাতে দুষ্টুর গান শোনা অথবা মিষ্টির নাচ দেখা আমার রাত পোহালো শারদপ্রাতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সাথে।
কত কি ভাবনা ভাবতে ভাবতে দরজার লকটা চাবি দিয়ে খুলতে যায় জোজো।হয়ত মিষ্টিটা এখনো ঘুমোচ্ছে,বা শুয়ে আছে নিজের খেয়ালে।আজ ইউনিভার্সিটিতে যেতেই হয়েছিলো ওকে।
চাবি ঘোরানোর আগেই দরজাটা খুলে যায়।অবাক হয়ে যায় জোজো মিষ্টিকে দেখে। মিষ্টি যেন কিছুক্ষণ সময় একা থেকে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়েছে নিজের মত করে। মিষ্টির মুখে একটা আলতো হাসির ছোঁয়া। জোজো এবার সত্যিই মন হারায় আবার দার্জিলিংয়ে যেখানে ওরা চারজন কাঁধে হাত রেখে সবুজে ডুব দিতে দিতে গাইবে.. একদিন দলবেঁধে কজনে মিলে যাই ছুটে খুশিতে হারাতে। বাবার মুড ভালো থাকলে গাইতো গানটা শুনতে বেশ লাগতো।
******************
" তুই উঠেছিস? ফিলিং বেটার না? আমার খুব ভালো লাগছে তোকে দেখতে।"
মিষ্টি হাসে.." বাবা ফোন করেছিলো,তোকেও চাইছিলো বাবার সাথে কথা বলে অনেকখানি মনটা হাল্কা লাগছে। কতভাবে বোঝালো বাবা। আচ্ছা ভালো মাস্টারমশাইরা কি সত্যিই দার্শনিক হয়?"
ঘাড় নাচায় জোজো হেসে বলে," তা ঠিক বলতে পারবোনা তবে আমাদের মা বাবাদের আমাদের চেয়ে জীবন দর্শন অনেক বেশি। আরে অভিজ্ঞতার একটা দাম আছে তো? স্যার আবার বাবা যোগ মাস্টারমশাই তাই একদম গ্ৰেট দার্শনিক। যাক বাবা।"
" কি যাক বাবা?"
মিষ্টির ঘর থেকে শোনা যায় আমাকে আমার মত থাকতে দাও গানটার শেষ লাইনগুলো... সব পেলে নষ্ট জীবন।
গানের কথাতেই জোজো বলে.." সব পেলে নষ্ট জীবন শুনছিস তো? তাই জীবনে কিছু না পাওয়া থাকা ভালো। অভাববোধ থাকা জরুরী তবেই তো তোর বাঁচতে ইচ্ছে করবে জাস্ট টু গেট অর ডিজার্ভ। আমার কিন্তু এখন একটু কফি খেতে ইচ্ছে করছে। এই রে আমার সাধের স্ন্যাকস প্রায় দেহ রাখছে।"
জোজোকে না যেতে দিয়ে আজ রান্নাঘরে ঢোকে মিষ্টি একটু সময় নিয়ে ভালো করে দুকাপ কফি নিয়ে আসে।
জোজো বলে," এখানে বসেই দার্জিলিংয়ে আছি মনে করি।দুষ্টুটা কিন্তু দারুণ এনজয় করছে ওখানে।"
কফি খেতে খেতে টুকরো কথায় একটু করে মন বদল হয় মিষ্টির আলতো হাসির ছোঁয়ায় আবার নাচে ওর চোখদুটো।
জোজো ভাবে যাক দুর্গাঠাকুরের আসার আগেই যেন মিষ্টিটা কালো সরিয়ে শরতের আলো মুঠোভরে মাখতে পারে চোখেমুখে।
********************
সারাদিন ওদের গ্ৰুপের বন্ধুদের সাথে চক্বর দিয়েছে দার্জিলিংয়ে দুষ্টু। হেঁটে হেঁটেই দেখেছে জু,টিগার্ডেন,অর্কিড হাউস আর চোখেমুখে মেখেছে পাহাড়ের কুয়াশা।কখনো বা হাঁ করে দৌড়ে খেতে গেছে মেঘকে।
আজ তো দীপ্তদার আসার কথা তাই মনটাও বেশ খুশি লাগছে।গতকাল অনেক দিন বাদে জোজোদার সঙ্গে অনেক কথা হলো। ওরা এখানে এসেছে সেই গল্প খুব মন দিয়ে শুনলো।দিদিটার যেন কোন উৎসাহ নেই।জোজোদা বললো," ইস্ দুষ্টু আমি যদি যেতে পারতাম তোদের সাথে কি মজাই না হত? খুব মিস্ করছি আমি।তবে এখানে বসেই মনে মনে ছুঁয়ে নিচ্ছি তোদের দার্জিলিং মানে এখন তো ওটা তোরই।"
দুষ্টুও মনে মনে ছুঁয়ে নিলো জোজোদাকে।ম্যালের ঐ একলা বেঞ্চটাতে বসে দুপুরে কত গল্প করলো জোজোদার সাথে মনে মনে।
হাতঘড়িতে সময় দেখে দুষ্টু চারটে ছুঁই ছুঁই।জমজমাট ম্যাল,কতরকম রঙিন জিনিসের পসরা নিয়ে বসেছে দোকানগুলো আর পেছনে পাহাড় আর গাছের সারি। ঘোড়াতে চেপে অনেকেই ঘুরছে সাথে কুচোকাচারা আছে। দুষ্টু একমনে তাকিয়ে দেখে চারদিকে।দীপ্তদার আসার কথা কিছুক্ষণ বাদেই। কিছুক্ষণের জন্য একটু অন্যমনস্ক হয় দুষ্টু।আজ ও একাই এসেছে এখানে,অবশ্য ওদের হোটেল কাছেই খুব একটা দূরে নয়।
" দুষ্টু সরি রে একটু দেরি হয়ে গেলো।"
মুখ ফেরায় দুষ্টু...দীপ্তদা। তাহলে দীপ্তদা সত্যিই এলো,যদিও বাবার একটু সন্দেহ ছিলো।কিন্তু দুষ্টুর কেন যেন মনে হয়েছিলো দীপ্তদাকে আর হারাতে দেবেনা ও ঠিক ধরবেই।"
"চল,একটু হাঁটি তারপরে বসবো কোথাও।"
দীপ্তদাকে দেখে অবাক হয়ে যায় দুষ্টু,আগের দিন তো তেমন কোন কথাই হয়নি তবে অনেক পরিণত দীপ্তদা। এই কয়েক বছরে যেন অনেকটা বড় হয়ে গেছে। লাল সাদা সোয়েটারের আদরে ভালোই লাগছে বেশ।এখন দীপ্তদার মধ্যে একটা বেশ পাহাড়ের চাকচিক্য।
বোকা বোকা ভাবে দুষ্টু বলে," কোথায় যাবো? তুমি তো এখানে বসতেই বলেছিলে।"
" তুই তো কিছু খাসনি,চল একটু কিছু খেতে খেতে গল্প করবো।"
ফ্রক পরা দুষ্টুকে প্যান্ট আর জ্যাকেটে দেখে তো সেদিন চিনতেই পারেনি রাস্তায়। দীপ্তর হাসি পায় মনে মনে সেই গেছো বাচ্চা মেয়েটা বেশ বড় হয়ে গেছে। এতদিনে তো কলেজে পড়ার কথা ওর। কি পড়ছে কে জানে?
ম্যাল থেকে রাস্তার ঢাল বেয়ে নামতে নামতে চোখ আটকে যায় দুষ্টুর সুন্দরী দার্জিলিংয়ের রঙবেরঙের দোকানগুলোতে। দীপ্তদা ছুটে চলেছে নিজের ছন্দে,ওর পায়ের তালে পা মেলায় দুষ্টু।
ক্যাভেন্টার্সে দোতলায় এসে বসে দীপ্ত দুষ্টুর মুখোমুখি। সামনে কফির কাপ আর চিকেন স্যান্ডউইচ।
" এতো কিছু অর্ডার দিয়েছো কেন?"
" খাবো তাই,এমনি কথা কি করে বলবো? আমারও খিদে পেয়েছে।"
কয়েক মিনিটের জন্য মনটা চলে যায় কালচিনিতে দীপ্তর।এমনভাবে কতদিন স্যার ওকে খাইয়েছেন।গম্ভীর গলায় ডাক দিয়েছেন," অনু খাবারটা একটু বেশি দিয়ো দীপ্ত এসেছে।"
আজ দুষ্টুর সামনে বসে একটা অদ্ভুত ফিলিংস হচ্ছে মনটা বারবারই হারিয়ে যাচ্ছে।অতীতে আর পা রাখেনি হেরে যাবার পর,স্যারের জ্বালিয়ে দেওয়া মশালটা যে নিভে গিয়েছিলো ওটা যদি কোনদিন জ্বালাতে পারে তবে স্যারের কাছে যাবে।
দুষ্টু মাথা নাড়ে," সব বুঝেছি কিন্তু বাবা তোমাকে খুব মিস্ করে।মানে তোমাকে খোঁজে প্রতিনিয়ত।কিছু ছাত্রকে বোধহয় ভোলা যায়না কখনোই।"
" কিন্তু আমি যে পারিনি কিছু করতে জীবনে। ভাগ্যিস আমার কাকার জন্য এই মিশনারী স্কুলের চাকরিটা পেয়েছিলাম। নাহলে ওরা হয়ত আমাকে বাঁচতে দিতোনা। দীপ্ত নামের একটা ছেলে উড়তে চেয়েছিলো ডানা মেলে আকাশে।মুখ থুবড়ে পড়ে ডানা ভেঙেছে তার,জানেনা সে আর উড়তে পারবে কি না?"
" আমরা তো সবাই রোদ ধরতে চাই দীপ্তদা,সবাই কি পারি? তবুও তো জীবন থেমে থাকেনা। তোমার স্যার আমার বাবা,তুমিও তো আমাদের একজন। বাবা বোধহয় তোমার স্বপ্নগুলো সাজিয়ে দিতে পারতো।"
দুষ্টুকে কি করে বোঝাবে যে ও স্যারকে বলে এসেছিলো এবার নিজেকে নিজেই সামলে তুলে ধরতে পারবে। লুজার হয়ে ফিরবে স্যারের কাছে?
অনেক কথা মনের মধ্যে অব্যক্ত হয়ে দীর্ঘশ্বাসের মত ঘোরাঘুরি করে সবটা বলতে পারেনা দুষ্টুকে.....দুজনেই কফিতে চুমুক দেয় বাইরে তখন হাল্কা অন্ধকার নেমেছে তারমধ্যেই আলোতে সেজেছে পথঘাট।
******************
মিষ্টির মুখের হাসিতে কফির স্বাদটা যেন অনেক বেশি বেড়ে গেছে জোজোর।মুচমুচে স্ন্যাকসটা নেতিয়ে পড়লেও মনে হলো এত ভালো স্ন্যাকস কখনো খায়নি জীবনে।
শরতের মন ভালো করা বাতাস উঁকিঝুঁকি মারে জোজোদের ফ্ল্যাটে।অনেকদিন বাদে জোজোর সাথে অনেকগুলো কথা বলে মনের
মরা সোঁতাটা আবার যেন বিদায়ী বর্ষার জলে ভরপুর হলো।
Comments
Post a Comment