Skip to main content

জীবন যখন যেমন(৮)

এই প্রথম নিখোঁজের ঠিকানায় নাম লেখানো দীপ্তদাকে মুঠোফোনে ধরলো দুষ্টু সত‍্যিই কেন যেন মনটা ভালো লাগলো। মুঠোফোনে ধরা নিরুদ্দেশের দেশ থেকে ফেরা দীপ্তদার মেসেজটা বারবার পড়ে দুষ্টু। ছোট কয়েকটা শব্দে অনেক কথাই বোধহয় এইভাবে বলা যায় নিঃশব্দে। দুষ্টুর ইচ্ছে হলো কিছু লিখতে..কিন্তু কি লিখবে? সাবধানে যেয়ো,পৌঁছে জানিয়ো। না না এ যেন কেমন খুব চেনা চেনা কথা,সবাই বলে এমন কথা। মা তো কতবারই বলে ওকে..সাবধানে যাবি,পৌঁছেই ফোন করিস।
     একবার ভাবলো থাক,কি আর উত্তর দেবে এই মেসেজের। কাল বরং জেনে নেবে একবার ঠিক মত পৌঁছলো কিনা? কিন্তু ফোন করবে? দীপ্তদা তো এতদিন ওকে নম্বর দেয়নি মানে হয়ত ইচ্ছে করেই দেয়নি।
     হ‍্যাঁ আর না মনের মাঝে কিছুক্ষণ দ্বন্দ্ব করে দুষ্টুর মনে।আজকাল কোথাও যেন একটু বেশি অভিজ্ঞ দুষ্টু, ওর সেই ছেলেমানুষী কান্নাগুলো কবেই ধুয়ে মুছে গেছে বর্ষার জলে। আর যেটুকু ছিলো সেটুকু কে অনেকদিন চাপা দিয়েছে মনের অন্তরালে সঙ্গোপনে।
         কানের হেডফোনটা আবার বাধ‍্য করে মনটাকে গান শুনতে..

দেখেছি রূপ সাগরে মনের মানুষ

কাঁচা সোনা,

তারে ধরি ধরি, মনে করি,

ধরতে গেলে আর মেলে না।

      " কি করছিস এত মন দিয়ে দুষ্টু?

      কখন থেকে ডাকছি সাড়া নেই। খেতে হবেনা নাকি?"

    মিষ্টি এসে ছোটবেলার মত ওর ঘাড়টা ধরে একটু ঝাঁকিয়ে দেয়।

      আদুরে গলায় দুষ্টু বলে," ভাবছিলাম দিদি। ওহ্ একটু ভাবতেও দিবিনা।"

     " কার কথা ভাবছিস শুনি? কেউ হয়েছে নাকি তোর? বলনা বলনা। আমি কাউকেই বলবোনা।"

      " কেউ নেই বিশ্বাস কর দিদি কেউ নেই।"

দুষ্টুর গলা আজ অনেকদিন পর সুরের বাঁধনে আবার বাঁধলো মিষ্টি ওর কাঁধে মাথা রাখলো মন ডুবে গেলো সুরে।

আমার একলা আকাশ 
থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে, 
শুধু তোমায় ভালবেসে। 
আমার দিনগুলো সব 
রঙ চিনেছে তোমার কাছে এসে, 
শুধু তোমায় ভালবেসে। 
তুমি চোখ মেললেই 
ফুল ফুটেছে আমার ছাদে এসে, 
ভোরের শিশির ঠোট ছুঁয়ে যায় 
তোমার ভালবেসে। 
আমার একলা আকাশ 
থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে, 
শুধু তোমায় ভালবেসে। 

আমার ক্লান্ত মন 
ঘর খুঁজেছে যখন, 
আমি চাইতাম পেতে চাইতাম 
শুধু তোমার টেলিফোন। 
ঘর ভরা দুপুর 
আমার একলা থাকার সুর, 
রোদ গাইতো আমি ভাবতাম 
তুমি কোথায় কতদুর। 
আমার বেসুর গিটার 
সুর বেঁধেছে তোমার কাছে এসে, 
শুধু তোমায় ভালবেসে। 
      দুজনেই কিছুক্ষণ কোন কথা বলতে পারলোনা হয়ত এমন মনের কথা ওদের দুজনেরই।হয়ত বা সবারই,একলা মন ভালোবাসার খোঁজে হয়ত এভাবেই ফেরে আর ঘুরে বেড়ায়।
     " কি ভালো গান গাস এখনো তুই বোন।আজকাল আর করিসনা কেন? বাবা বলে আজকাল শুধু পড়াশোনা আর শরীরচর্চা নিয়েই থাকিস। মডলিং বা বিউটি কনটেস্টে যাবি নাকি?"
      দিদির কথা শুনে কিছুক্ষণ গুবরে পোকার মত গড়িয়ে নেয় বিছানাতেই দুষ্টু।হাসি আর ওর থামেনা।
      ধাক্কা মারে মিষ্টি,"এত হাসির কি আছে শুনি?ইশ্ আমাকে নিয়ে মজা খারাপ কি বললাম শুনি?"
     " না আরেকজন বললো আজই তাই হাসি পেলো।"
     " আজকেই কে বললো শুনি জোজো? বলনা আমাকে?"
         "আরে কলেজস্ট্রীটে এক বন্ধুর সাথে দেখা হলো সে বলছিলো।"
    " বুঝলাম, তাই ফিরতে দেরি হলো। যাক আমি আর কিছু বলতে চাইনা। চল খেতে চল।"
           হঠাৎই দুষ্টুর মনে হলো মেসেজের রিপ্লাই দেওয়া হয়নি তাই বলে," তুই সার্ভ কর আমি আসছি,জোজোদাকে আসতে বলিসনি?"
    " ওকে আসতে বলবো কেন আমাদের দুইবোনের মাঝে? তুই চলে আয়।"

         ******************
দুষ্টুর মন একটা চাপা অতীতে চুপ করে ডুব দেয় যে কবেই তো দুইবোনের মধ‍্যেই জোজোদা এসে পড়েছিলো আর হয়ত থেকেই গেলো।
        দুষ্টু খেতে যাওয়ার ফাঁকে একটা ছোট্ট মেসেজে লিখে যায় দীপ্তকে..." তুমি নিশ্চয় উত্তরের দিকে আরো কাছাকাছি, আমিও আসছি তবে আপাততঃ দুটো দিন আছি।"
          চেটেপুটে থালা শেষ করে দিদিকে আদর করে একদম বিছানায় চলে আসে দুইবোন। সেই কালচিনির মত মাঝরাত হয়ে যায় গল্পে।
        জানতে ইচ্ছে করলো দুষ্টুর দিদির কথা।কেমন আছে দিদি? যাকে আইডিয়াল করে ওর বড় হয়ে ওঠা এতদিন। এখনো দিদি ওর কাছে সেরা সুন্দরী,ও যখন মাঠে দৌড়য় দিদি তখন অনেকের মনে দোলা দেয় ওর নাচের ছন্দে।

           " দিদি তোর কি প্ল‍্যান? মানে তোর শখগুলো কি সেই চিলিচিকেন আর ফ্রায়েডরাইস বানাতেই চাপা পড়ে গেলো?"
    দুষ্টুর গায়ে হাত রাখে মিষ্টি.." কেন চিলিচিকেন বানানোতে কি আনন্দ নেই? যা করতে আমার ভালোলাগে সেটাই আমি করি।"
   " আর তোর অভিনয়,অ্যাড সেগুলো?"
  একটু চুপ করে যায় মিষ্টি,"ওটা একটা ঝোঁক ছিলো। ঠিক আছে চাকরি করছি এখন যদি জীবনে সঠিক ভাবে কোন সুযোগ আসে করবো।"
     " দিদি তুই খুশি আছিস তো? তোর মনটা ভালো আছে তো?" দুষ্টু বলে।
      একটু ভাবে মিষ্টি,মনের হদিস বোধহয় কোনসময় নিজেরও অজানা থাকে। তবুও বলে," খুশি থাকবোনা কেন? আর কত চাই জীবনে?"
          " আমি চাই জীবনে অনেক কিছু,নিজের ভালোবাসা গুলো না পেলেও ভালোলাগা গুলোকে নিয়ে বাঁচতে চাই।"
   " দুষ্টু ভালোবাসা! না পাওয়া? ছিলো নাকি কোন ক্রাশ? বলনা আমাকে প্লিজ।"
      " দিদি আমার ঘুম পাচ্ছে,আর ক্রাশ বলে কিছু ছিলোনা।তুইও তো ছোটবেলা অমন কত ক্রাশ খেয়েছিস বলবো?"

        ঘুমোনোর কথা বলতে গিয়েও দুষ্টু জিজ্ঞেস করলো.." আচ্ছা দিদি জোজোদা তোকে প্রপোজ করেছে?"
          মিষ্টির চোখে রাতের অন্ধকারে অনেকগুলো স্বপ্ন খেলা করে।কেন যেন জোজোকে বন্ধু ভাবতেই ওর বেশি ভালো লাগে। এখনো ঠিক ঐ প্রেমের ভাবটা ঠিক আসেনা।

" জানিস তো ওকে না বন্ধু বলে ভাবতেই আমার ভালো লাগে। এখনো প্রেমের ভাবটা ঠিক জমেনি রে।"
  "মাকে বলেছিস?"
 " কি বলবো? না না কিছুই তো তেমন জমেনি শুধু বন্ধুত্ব ছাড়া তবে আর কি বলবো।তারপর সেই নিয়ে অশান্তি হবে। বাবাকে অনেক চাপ দিয়েছি।"
    মনটা উদাস হয়ে যায় দুষ্টুর, বন্ধু বা প্রেমিকা যাই হোকনা কেন জোজোদার সবটা জুড়ে বোধহয় তুইই আছিস দিদি। আমার সাথে শুধুই মারামারি করেছে,হয়ত আমার মনটাকে দেখেইনি কোনদিন।

********************

  মনটাকে না দেখলেও জোজো যে অনেক কিছুই দেখে বা নজর রাখে তা বুঝলো দুষ্টু।হয়ত জোজোদা কোথাও একটা আগলে রাখে ওদের দুজনকেই তা আবার একবার বুঝলো দুষ্টু।
        দিদির ওপর রাগ হলো দুষ্টুর, কাল ছুটি নেবে বলে আজ ওকে রেখে কাজ আছে বলে লাফিয়ে চলে গেলো।
     বইয়ের পাতাতে চোখ রাখে দুষ্টু, একটু অন‍্যরকম ভাবে পড়াশোনা করতে হবে।বাবা ঠিকই বলেছিলো রাগ করে শুধু ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেলি কেন? জানেনা দুষ্টু এই চারবছরে যা শিখেছে তা এখানে কোন কাজে লাগবে কিনা? তবে দুষ্টু নিজে বিশ্বাস করে কোন শিক্ষাই হয়ত বিফলে যায়না।
                  ব‍্যালকনিতে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চোখ আর গলা বাড়িয়ে আকাশের নীল মেঘ দেখার চেষ্টা করে। তারপর একটা সময় চড়ুই পাখির কিচমিচ শুনতে শুনতে বারান্দার লাল নীল ফুলে আদুরে হাত বুলিয়ে ঘরে চলে আসে। মা বাবা যথারীতি ফোন করে খোঁজ খবর নিয়ে সাবধান করলো,কাউকে যেন দরজা না খোলে। আচ্ছা ও কি বাচ্চা!
        " মা যদি এমন করো তাহলে আমি আবার আজও চলে যাবো ঘুরে বেড়াবো কলকাতার রাস্তায়।"ধমকায় অনু। ফোন রেখে দেয় দুষ্টু।তারপর ছড়ানো বইদের সাথে চলে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা।
        হঠাৎই কলিংবেলটা বাজে,বিড়বিড় করে দুষ্টু উহ্ সেই কে আবার এলো! যত্তসব।
         আইহোলে চোখ রাখে দুষ্টু, জোজোদা। ও এখন কেন এলো?
  দরজা খুলেই আক্রমণ করে দুষ্টু, "যা বলবি বলে চলে যা।আমি পড়ছি আর দিদি বাড়ি নেই এখন।"
         " তুই যে এতটা অসভ‍্য হয়েছিস জানতামনা। আরে আমি তোর হবু জামাইবাবু। আচ্ছা ঠিক আছে দাদা তো বটে ঢুকতে দে।"
                  দুষ্টুর দূর্বল জায়গাটা এখন অনেক শক্ত,জোজোকে দেখলে আর আগের অনুভূতি না হলেও ভালো লাগে। কিন্তু আজ অবাক হয়ে গেলো দুষ্টু যখন জোজো ওকে বললো..." আমি জানি এখন মিষ্টি নেই তাই তো এলাম এখন।মানে মিষ্টিই বললো একটু বকবক করে তোর মাথাটা খেয়ে যেতে। তুই নাকি একা থাকতে রাগ করছিলি।"
       অবাক হয়ে যায় দুষ্টু, দিদির একবার মনে হলোনা যে...নিজেকে বকুনি দেয় দুষ্টু।
    ততক্ষণে জোজো ওর বইপত্র ঘাটাঘাটি শুরু করেছে।তারপর বললো," আরেব্বাস আমাদের দুষ্টু আইএএস হবে,আর আমি মিডিয়ায় নিউজ কাভার করবো!
      এগিয়ে যা একদম ছুটে যা তোর হবে।"
  স্বপ্নের উড়ানে পাড়ি দেয় দুষ্টু, সত‍্যিই কি তাই হবে কোনদিন?
        " এই যাবি আমার সাথে,চল তোকে কলকাতা ঘুরিয়ে আনি। যাবি?"
     এবার না হেসে পারেনা দুষ্টু.." এই দুপুরে কলকাতা ঘুরতে যাবো! দিদির পারমিশন নিয়েছিস?"
       "পারমিশনের কি আছে আবার,তোকে নিয়ে ঘুরতে যাবার জন‍্য পারমিশন? ফুঃ। আচ্ছা এবার বলতো,কাল কার হাত ধরে ট্রামলাইন পার হচ্ছিলি?"
      অবাক হয়ে যায় দুষ্টু..." কার হাত ধরে আবার? তুই যে কি বলিস!"
          " হঠাৎই গলিতে ঢুকে গেলি তাই ধরতে পারলাম না।"
        ইশ্ সেরেছে,এতো মহা বিচ্ছু ছেলে।আর বোধহয় সিক্রেটটা রাখা গেলোনা।তবুও বলে," আমি আবার কোথায়?"
  " হ‍্যাঁ তুই,সাথে একটা লম্বু ঢ‍্যাঙা।ইশ্ মুখটাই দেখা হলোনা। যাক খবর আমি নেবো ঠিক মিডিয়ার লোক বলে কথা। শুধু মিষ্টিকে না দুষ্টুকেও নজরে রাখি দেখেছিস তো।"
       জোজো বুঝতে পারে দুষ্টু ধরা দিতে চায়না তাই আর জোর করেনা। কিন্তু ওর জোরাজুরিতে দিদিকে ফোন করে অবশেষে বেড়িয়ে পড়তে হলো ঘোরাঘুরিতে।
       কখনো হয়ত সম্পর্কের অদলবদল গুলোকে
মেনে নিয়ে মিষ্টতায় ভরে দেওয়াই ভালো।সত‍্যিই তো জোজোদার কোন দোষ নেই,দিদিরও নেই।তাই বাঁচুক এই সুন্দর বন্ধুত্ব আর খুনশুটি অভিমানের মেঘ সরিয়ে।

*********************
উত্তরের খোলা হাওয়া আর আকাশ মন খারাপ করায় বেশিদিন ছেড়ে থাকলেই।এরমধ‍্যে দুষ্টুর পড়াশোনার সব খোঁজ খবর নেওয়া হয়ে গেছে।
       এখন শুধু রক ক্লাইম্বিয়ের মত নিজেকে মজবুত করে তৈরী করে নেওয়া।যদিও জানেনা কতটা সময় যাবে পৌঁছতে। তবুও এই দৌড়টা দৌড়ে চড়াইটা ভাঙতেই হবে ওকে।
             মিষ্টির মনটা একটু খারাপ হলো কদিন বেশ ছিলো দুজনে,আবার সেই বন্ধ দরজা খুলে ঢোকা আর মুঠোফোনে সম্পর্ক গুলো চেনা। সত‍্যিই মাঝে মাঝে আর ভালো লাগেনা।বোনকে বলতেই ও বললো," তুই বরং এবার বিয়েটা করে নে খুব ভালো হবে।বেশ জমিয়ে আনন্দ করা যাবে।তোরও আর একা একা লাগবেনা।"
       মিষ্টি হাসে," তুই বরং করে নে বিয়েটা।এখন তো দেখলে সবাই তোকেই বড় বলে।এই তো পাশের ফ্ল্যাটের স্বপ্না কাকিমা বলছিলো তোমার দিদি কিন্তু খুব সুন্দর আর স্মার্ট।আমি তো দেখে অবাক,বাইক চালিয়ে জোজোকে নিয়ে এলো।"
     " দিদি ওরা জোজোদাকে চেনে? "
  "চেনে তো। মধুমিতা কাকিমার পরিচিত ওরা তাইতো এই ফ্ল্যাটটা পেয়েছি চট করে। তুই কি ভাবছিস চোখের পাহারা শুধু গ্ৰামেই আছে? শহরের মানুষও প্রতিবেশীর ওপর নজর রাখে কখনো বন্ধ দরজার আইহোল থেকে আবার কখনো ব‍্যালকনি থেকে।"
    " তাহলে তো খুব মুশকিল, মানে জোজোদা তো এখানে আসে মাঝে মাঝে। ওরা কিছু ভাবেনা?"
     " জানিনা,হয়ত ভাবে।বা মধুমিতা কাকিমা ওদের কিছু বলেছে।"

           কদিন ঘোরাঘুরি, আর রেস্টুরেন্টে খাওয়ার মাঝে জোজোদা যে এত ভালো শেফ হয়েছে তার প্রমাণটাও ওরা পেয়ে গেছে তাই একদিন ওদের ফ্ল্যাটেই হলো বেশ জমাটি আড্ডা। দুষ্টুর যেন কেমন মনে হয় দিদির মধ্যে এখনো সেই পুরোনো বন্ধুত্বের ঝলকটাই বেশি।কি সুন্দর হাসিখুশি আছে ওরা দরকারে তেড়েও আসছে দিদি সেই পিকনিকের মত। ওদের পাশাপাশি দেখে মনে হচ্ছে জোজোদার সাথে দিদিকেই মানায়।
     নিজেকে আবার বকা দেয় দুষ্টু কি সব যে ভাবে মাঝেমাঝে।জীবন যেমন তেমনি তাকে উপভোগ করা উচিত প্রতিমুহূর্তে।কে জানে আজকের অবহেলায় তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে পায়ে ফেলা ছোট ছোট সেকেন্ড মিনিটগুলো আর কখনোই টুকরো খুশির ঝলক নিয়ে ফিরবেনা।
     তাই খুশি যেমন মনকে ভালো করে,দুঃখ তেমন শেখায় আর বিপদ সাহসী করে।কখনো অভাব শেখায় সঞ্চয়ী হতে। সব কিছু শিখতে বোধহয় স্কুল যেতে হয়না,এই পৃথিবী আর জীবনই কখনো হয় সেরা শিক্ষক। শুধু দেখার নজরটা পাল্টে ফেললে অনেক সময়ই জীবনের ছক উল্টে পাল্টে যায়।

*****************

            দুষ্টুর সাথে হঠাৎই কেন যে বারবার দেখা হয়ে যায় ভাবে দীপ্ত,কেন যেন দুষ্টুর সেই চিঠির প্রতিটা কথা আজও ওর মনে ভাসে।কলেজে রূপসী ওকে নিয়ে ভাসতে চেয়েছিলো জোয়ারে। জীবনে পাল্টানোর প্রতিটা প্রলোভন বোধহয় কেন যেন আঠেরো বছরের পর কখনো বা আগে প্রতি ছেলেমেয়ের জীবনেই আসে। হঠাৎই বড় হচ্ছি এই ভাবটা বেশি করে চেপে বসে জীবনে।আর এই স্বাধীনতার চাপটা অনেকেই সামলাতে পারেনা,কেউ ডুবে যায় হঠাৎই আসা কোন হড়কা বানে আবার কাউকে ভাসিয়ে রাখে রবীনের মত কোন শিক্ষক অথবা কড়া অভিভাবক। তাই একটা সময়ে বাবা মায়ের শাসন কড়া মনে হলেও ভবিষ‍্যতে তার মিঠে ফল মনকে দেয় অনেকটা নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা ভাগ‍্যিস ঐ সময় শাসনটা ছিলো। তাই একটা সময় বোধহয় যে বাবা মায়ের বা শিক্ষকদের শাসন অসহ‍্য লাগতো তারাই উদাহরণ হয়ে যান জীবনে।

       পাল্টে যাওয়া অনেকটা দাপুটে,আত্মবিশ্বাসী আর স্বাধীনচেতা দুষ্টু হঠাৎই ঝোড়ো হাওয়ার মত দীপ্তকে উড়িয়ে নিয়ে গেলো হয়ত বা ওর মতো আরেক জনকে পেলো যে জীবনে অন‍্য কিছু করতে চায়।
     দীপ্তর মনে হলো দুষ্টুর সাহস আর ওর বুদ্ধি হয়ত এগিয়ে নিয়ে যাবে দুজনকেই অনেকটা।

          ফোনটা বেজে ওঠে দীপ্তর,কখনো সুরে আবার হঠাৎই মেসেজে বা মেলে দুষ্টুর নানা প্রশ্ন থাকে দীপ্তর কাছে।দুষ্টুর মুঠোতে আসে ফেরত দীপ্তর দেওয়া উত্তরগুলো। আবার কখনো দুষ্টু কিছু কোশ্চেন বা নোটস পাঠিয়ে দেয় দীপ্তকে।
      রবীন দুষ্টুর ইচ্ছে জানতে পেরে ওকে যতটা পারে এগিয়ে দিতে চেয়েছে তাই কোচিংয়ের ব‍্যবস্থাও করেছে। কিন্তু সব জয় কি সহজেই হাতের মুঠোতে আসে? তবে শুধু বোধহয় জেতার ইচ্ছেটাকে ধরে রাখতে হয় প্রাণপনে হাতের মুঠোয়। পারবোনা বা হবেনা ভাবলেই মনেহয় অনেকটা পরাজয় এমনিতেই চলে আসে।

**********************
মাঝে কেটে গেছে প্রশ্নের আদান প্রদানে দুটোবছর,তবে দুষ্টুর ভাগ‍্যে শিকে ছিঁড়ে পড়েনি। একটু অস্থির হয় আজকাল অনু। পাশে থাকা দুজন মাস্টারমশাইয়ের ছেলে মেয়ে দুষ্টুর চেয়ে ছোট দিব‍্যি চাকরি করছে তারা একজন হায়দ্রাবাদে আর একজন ব‍্যাঙ্গালোরে।অথচ এই মেয়ে এতদিন কোন চাকরির চেষ্টা না করে ঐ এক জেদ নিয়ে বসে আছে।
      মায়ের কথায় একটু হলেও মনোবলে ধাক্কা লাগে দুষ্টুর, সত‍্যিই তো দীপ্তদার আর ওর কারো তো হলোনা। তারমধ‍্যে ওর চেয়ে বেশি বোধহয় দীপ্তদা ভেঙে পড়েছে। মা ভীষণ অসুস্থ, চিকিৎসা করতে অনেক খরচ। আজকাল দুষ্টুর মনে হয় ওর নাহয় পরেই হোক তবে দীপ্তদার তো অন্ততঃ হোক।সত‍্যিই ওর একটা ভালো চাকরির খুব দরকার। জীবনে হতাশার সাথে বন্ধুত্ব করতে করতে খুব ক্লান্ত দীপ্তদা।
                রবীন অনুকে বকুনি দেয়.." কি দরকার মেয়ের মনোবলে ধাক্কা দেওয়ার।মাঝে মাঝেই মেয়েটা কলকাতা যাচ্ছে।কোচিং নিচ্ছে আর কি চাও তুমি? একটু ধৈর্য্য ধরো সব ঠিক হবে। পজেটিভ ভাবো অনু।"
     " আচ্ছা সারাজীবন কি মেয়েদের চিন্তাই করে যাবো? ভাবলাম এবার ওরা বড় হলো,চাকরি করবে আমরা নিশ্চিন্ত।আর কি ভালো বিয়ে দেবো।"
        " আগের দিনের মা বাবার মত কথা বলোনা অনু।বিয়েটাই সব নয়,বিয়ের পর যদি অ্যাডজাস্ট না করতে পেরে ফিরে আসে তাহলে কি হবে ভেবেছো? আগে তো ওদের পায়ের তলার মাটিটা শক্ত করতে দাও।"
    অভিমানে গলা আটকায় অনুর." যা পারো করো।দুষ্টুটা কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে দেখেছো,ভালো করে কথাও বলেনা।সারাদিন ল‍্যাপটপে নাহলে বইয়ে।"
     "ভালো তো অনু,কোন খারাপ আড্ডা নেই।নিজের পড়াশোনা নিয়ে আছে। আমি তো বলছিলাম এবার কলকাতা বা দিল্লী কোথাও একটা গিয়ে একটু ভালো কোচিং নিতে।"
         রাত ঘন হয়,দুষ্টুর মনে অস্থিরতা আবার সামনের বছরের অপেক্ষা জানেনা কি হবে?
     দূরের চাবাগানে আঁধারের চুমু,ঝিঁঝি পোকা সুরের ঝঙ্কারে মাতিয়েছে বৃষ্টিমাখা রাত।
        হঠাৎই আবার মুঠোফোনে নীল আলো জ্বলে,গাইড...." ঘুমোলি? একটা কথা ছিলো।"
           " এতদিন কোথায় ছিলে? অনেকদিন তোমার কোন ফোন,মেসেজ পাইনি।তুমি ব‍্যস্ত ছিলে হয়ত তাই আমিও কিছু বলিনি।মাসিমা এখন কেমন?"
      " ওষুধের ওপর আছে।আচ্ছা মা আমার ভালোটা দেখে যেতে পারবে তো?"
        নিজের স্বপ্নবোনা মনের অল্প স্বপ্ন ছড়িয়ে দেয় দীপ্তর হাতে দুষ্টু। ধরতে চেষ্টা করে দীপ্ত স্বপ্নগুলো নানান কঠিন পরিস্থিতির মধ‍্যেও।
দুষ্টু বলে," আচ্ছা শোনো আমি মনে করি তোমার মন খারাপের ওষুধ তোমার কাছেই আছে।আগে ভাবতে হবে তোমার মন খারাপ কেন? সেটা কি দূর করা যায় না যায়না? যদি দূর করা যায় তো লেগে পড়ো।আর যদি কারণটা না মোছা যায় তো অন‍্য ভালোলাগা গুলো দিয়ে ঐ খারাপ লাগাটা মুছে দাও মানে ঠেলে সরিয়ে দাও।শুধু ভালোলাগা খুঁজে নিতে হবে সেটা নদীর ঢেউ থেকে কাছের কেউ যে কেউই হতে পারে।"
         দীপ্ত মনের মধ‍্যে খুঁজতে চেষ্টা করে ভালোলাগাটা রাতের আঁধারে। কোথায় যেন দুষ্টু আর স‍্যার মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
      তারপর মনের টুকরো পাওয়াটা শেয়ার করে দুষ্টুর সাথে,যেটা নিয়ে মনটা একটু উচাটন ও সুযোগটা নেবে কি নেবেনা? হয়ত বড় স্বপ্নেরা অধরাই রয়ে যাবে তবুও হয়ত এই চাকরিটাই ওকে নিতে হবে।
        " আমি বিসিএস পরীক্ষাটাতে কোয়ালিফাই করেছি। খুব একটা ভালো র‍্যাঙ্ক নয় জানিনা চাকরিটা কেমন পাবো? বুঝতে পারছিনা কি করবো? তবে এভাবে আর কতদিন? সত‍্যিই কি আমার স্বপ্ন সত‍্যি হবে না মুঠোতে আর কোনদিনই আসবেনা?"
      কেন যেন ভালো খবরেও মনটা ভালো লাগেনা দুষ্টুর শুধু বলে..." তুমি চাকরিটা নেবে দীপ্তদা?"


******************
 মাঝরাতে দুষ্টুর গুছোনো কয়েকটা শব্দ বলে যায় অনেক কিছুই। দুষ্টুর মনটা খারাপ হয়ে যায়,আরেকজন হাল ছাড়লো,এভাবেই হয়ত হাল ছেড়ে দেয় জীবন যুদ্ধের কত লড়াকু।কেউ হারে কেউ বা হাল ছাড়ে। দুষ্টু বুঝতে পারলো একবার সরকারী চাকরি পেলে দীপ্তদার উড়ান মহাকাশের বদলে হয়ত গতি বদলে অন‍্য কোথাও গিয়ে থেমে যাবে।
      তবুও ও কি করে বারণ করবে দীপ্তদাকে? ওর নিজেরই তো কোন ঠিক ঠিকানা নেই।মানে বারবার আর কত ধৈর্য্য থাকবে।এরপর হয়ত ওকেই একটা চাকরি নিতে হবে। কিন্তু সত্যিই কি আর ভালো চাকরি পাবে?

      দীপ্ত অপেক্ষা করে দুষ্টুর মেসেজের জন‍্য।কিছু লেখা লিখতে আঙুলটা বিদ্রোহ করে ওঠে। কিছু বলতেও সাহস পায়না,তবুও লেখে আস্তে আস্তে "জানি চাকরিটা তোমার খুব দরকার,এবার তো তোমাকে স্বপ্নের সাথে বাস্তবের সমঝোতা করে চলতে হবে। তবে থেমে যেয়োনা এগিয়ে যাও মাথা ঠান্ডা করে।"
          সত‍্যিই তো জীবন থেমে যায়না তাই হয়ত জোজো মিষ্টির মনটাকে আগে যত্ন করতে চাইলো কেন যেন ওর বারবার মনে হলো মিষ্টি বন্ধুত্বটা কিছুতেই পার হতে পারছেনা।হয়ত বা ভয় পাচ্ছে বন্ধুত্বের গন্ডী পার হতে,ভালোবাসার মিলমিশে যদি বন্ধুত্বটাই নষ্ট হয়ে যায়।
              " আমি তোর পাশে আছি সবসময়,মনের কাছাকাছি যেদিন আছি মনে করবি সেদিন ডাকিস। তোর ভয় নেই আর যাতে ভেঙে না যাস সেটা দেখবো আমি।"
            মিষ্টিও স্বপ্ন সাজিয়েছিলো নিজের মত,আসলে সবার স্বপ্নের রঙ তো এক হয়না তাই অনেকসময় সেগুলো ঝলমলে না হয়ে কখন যে ফিকে হয়ে মিলিয়ে যায় বুঝতেই পারেনা। তবুও জোজো একটু একটু করে মিষ্টির মনের ছোট ছোট ইচ্ছেগুলো যেগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছিলো সেগুলো সাজাতে চেষ্টা করে।
           প্রেমে আর সম্পর্কে বোধহয় মনটা বোঝাই সবচেয়ে জরুরী। মনের ছোটছোট ভালোলাগা গুলোকে একটু যত্ন করলেই বোধহয় জিতে নেওয়া যায় ভালোবাসা।
        মধুমিতার প্রথমে মিষ্টিকে নিয়ে একটু অমত থাকলেও আজকাল মিষ্টিকে খারাপ লাগেনা।নিজের জীবন দিয়ে বুঝতে পারে হয়ত মিষ্টিরও কোথাও একটা সেল্ফ রেস্পেক্ট আছে,আর ভালোলাগা ভালোবাসা বোধহয় জোজোর দিক থেকেই প্রথম। ছোট থেকে একমাত্র ছেলের ভালোলাগা গুলো একটু বেশিই দেখেছে ওরা তবে ভুলও করেছে ছেলেটা কিছু ঠকেছে। আর পুড়তে পুড়তে বোধহয় একটু একটু করে হয়ে উঠেছে খাঁটি সোনা।
        মাঝে একবার কলকাতা এসেছে মধুমিতা.. কদিন মায়ের আদর খায় জোজো।মধুমিতা বলে," হ‍্যাঁ রে মিষ্টি আসেনা? দেখা হয় তো ওর সাথে?"
    " ও খুব ব‍্যস্ত থাকে মা,চাকরির বেশ চাপ। আমিও ব‍্যস্ত থাকি তাছাড়া। তবে দেখা হয় মাঝে মাঝে।কখনো আমি চলে যাই।"
            " ওকে কিছু বলেছিস? মানে ও রাজি হয়েছে? বেশ অনেকদিন তো হলো।"
          " মা ও বোধহয় বন্ধুত্বটা নষ্ট করতে চায়না আসলে জানো তো একটা ট্রমা থেকে উঠেছে। তাই আমরা ভালো বন্ধু।তবে এছাড়াও...." কথা বলতে বলতে একটু থেমে যায় জোজো।
      অবাক হয়ে যায় মধুমিতা.." এছাড়াও কি? বললি না কেন? কোন সমস‍্যা?"
            " মানে আমাদের দুই পরিবারের মধ‍্যে কোন ভুল বোঝাবুঝি হোক আমাদের সম্পর্ক নিয়ে সেটাও ও চায়না মা। হয়ত ওর মণিমা আর বাবার কথাও ভাবছে। আমাকে একদিন বলছিলো জেম্মা ভাববে বাবা তোকে ভালো করার দায়িত্ব নিয়ে একটা সুযোগ নিলো।"
       চুপ করে যায় মধুমিতা, তারমানে ওদের মধ‍্যে অনেক কথাই হয়ত হয়েছে এ ব‍্যাপারে। তবুও যে ভুল বোঝাবুঝি হয়নি এটাই হয়ত অনেক। আজ কেন যেন মিষ্টিকে নতুন করে ভালো লাগলো মধুমিতার হয়ত বা ওর বুদ্ধির ওপরেও এলো এক আস্থা। এর থেকে আর কিছু চাওয়া হয়ত মা বাবার থাকতে পারেনা।তাই ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে," আমি কথা বলবো?"
       অবাক হয়ে তাকায় জোজো," কার সাথে? মিষ্টির সাথে?"
     " এই বুদ্ধি তোর মাথায়! আমি রবীনদার সাথেই কথা বলবো যদি তুই বলিস।"
         " আরেকটু সময় দাও মা,এখন থাক আগে মিষ্টিকে ভালো করে বুঝে নিই।ওর ভালোলাগা গুলোকে ছুঁতে চাই আগে।"
    অবাক হয়ে যায় মধুমিতা... ছেলেট কার মত হয়েছে কে জানে? ওর বাবা তো তেমনভাবে কখনোই মধুমিতার ছোটছোট ভালোলাগা গুলোকে যত্ন করেনি।সবসময় বড় বড় জিনিসে সাজিয়েছে ওকে।

***************
মাঝে কেটে গেছে বেশ কিছু দিন,হঠাৎই একদিন মিষ্টি ফোন করে," বাবা আজকে সন্ধ‍্যের খবরটা দেখো। মানে দেখো কিন্তু।"
    " কেন রে? তুই কি কিছু করেছিস? মানে তোকে দেখাবে টিভিতে?"
     " সারপ্রাইজ, এখন বলবোনা। আমি বলতামনা,তবুও তোমরা রাগ করবে তাই বললাম।"
          দুষ্টু আজকাল সত‍্যিই নিজের জগতে থাকে,ওর শরীরচর্চা আর পড়াশোনা নিয়েই সময় কেটে যায়।অনুর কথাটা ঠিকই বোঝে রবীন তবুও ওর জগতে অযথা ঢুকে দরকার না হলে বিরক্ত করেনা।তবুও বইয়ের পাতায় মুখ ডুবোনো দুষ্টুকে রবীন টেনে আনলো সন্ধ‍্যেবেলাতে। অনুও ভাবছে কেজানে কি হবে আজকে,রাণু আর মধুমিতা বসেছে টিভির সামনে।
         খবর শুরু হলো দূরদর্শনের সেই পরিচিত মিউজিকের পর মিষ্টিকে যে এভাবে খবর পড়তে দেখবে ভাবেনি রবীন। সত‍্যিই যতক্ষণ খবর চলে ততক্ষণ অপলক মেয়েকে দেখে রবীন। মিষ্টি শাড়ি পরেছে,চোখে চশমা সুন্দর পরিশীলিত সাজে মিষ্টিকে খুব সুন্দর লাগছে। তার সাথে একদম প্রথম মিষ্টিকে দেখা তাই টিভির এপারে বসে দুষ্টু, অনু আর রবীনের চোখ আর মন ভাগ করে নিলো সেই আনন্দ। অবাক হলো মধুমিতা আর রাণুও। সত‍্যিই দুটো বোন হয়ত অন‍্য অনেকের থেকেই আলাদা।
        বাড়ির সবার খুশি ছুঁয়ে যায় মিষ্টিকে আর মিষ্টির খুশি ছুঁয়ে যায় জোজোকে।
     " বাবা,মা,বোন সবাই খুব খুব খুশি হয়েছে আর সবটাই তোর জন‍্য। তুই না থাকলে তো এই নিউজ রিডারের...." বাকি কথাটা বলতে গিয়ে আনন্দে আটকে যায় মিষ্টির।
      " আসলে তোর স্বপ্ন ছিলো তুই টিভিতে নিজেকে দেখতে চাস।আমি তো আর সিরিয়ালে সুযোগ করে দিতে পারবোনা।তবে এটা চেষ্টা করলাম, কিন্তু সবটাই তোর মেরিটে হয়েছে মাইন্ড দ‍্যাট,আমি শুধু খবরগুলো তোকে এনে দিয়েছি।"
        জোজো বুঝতে পারে সিরিয়ালের কথা শুনে মিষ্টির মুখটা নিভে যায় হঠাৎই।তাই জোজো বলে.." এতো ফোন,এত আনন্দ তার মধ‍্যে মুখটা নিভে যাওয়া কেন? অনন‍্যাকে এবার সবাই চিনবে।তোর নাচটা নিয়েও ভাবতে হবে এবার। ইশ্ তুই হবি সেলিব্রেটি আর আমি যাবো ইন্টারভিউ নিতে! ব‍্যাপারটা ভাব।"
       মিষ্টির মুখটা আবার খুশিতে ভরে ওঠে,জোজো বুঝতে পারে মিষ্টির মনের ভালোলাগার ঠিকানার কাছাকাছি পৌঁছতে পেরেছে একটু হলেও তাই বলে..." চল আজ একটু সেলিব্রেট করি।"
            হঠাৎই মিষ্টির রিঙটোন বেজে ওঠে...

বাতাসে বহিছে প্রেম

নয়নে লাগিল নেশা

কারা যে ডাকিল পিছে

বসন্ত এসে গেছে।

    অন‍্য সময় হলে আবার পেছনে লাগতো জোজো তবে আজ মনে হলো সত‍্যিই বোধহয় কলকাতার আকাশ বাতাসও কখনো বলে কানে কানে অথবা মুঠোফোনে... বসন্ত এসে গেছে।

        ***********************

  কখনো কখনো কারো সঙ্গে পরপর কিছু না কিছু হতে থাকে।দুষ্টুর মনের কথাটা বোঝার মত অনুভূতি হয়ত দীপ্তর ছিলো তবুও অভাবে কখনো অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যায়।তাই দীপ্তও এগোলো চাকরির জন‍্য,দুষ্টু জানতে পারলো এবার আর যখন তখন দীপ্তদার কাছে প্রশ্নের উত্তর হয়ত খোঁজা যাবেনা।

        দীপ্তর পোস্টিং অনেকটা প্রত‍্যন্ত অঞ্চলে হলো,সবসময় সেখানে নেটের কানেকশান থাকেনা, কখনো বা ফোনের টাওয়ারও থাকেনা। তাই চাকরির পাশে তখনও সঙ্গী হয়ে রইলো স্বপ্নপূরণের বইগুলো। মাঝে মাঝেই এই নিরিবিলি প্রত‍্যন্ত অঞ্চলে কাজের ফাঁকে চেষ্টা চললো স্বপ্নকে মনে রাখার। তবে আর্থিক সমস‍্যা মিটলো কিছুটা।

          দুষ্টুকে মন দিতে হলো স্বপ্নপূরণে,আর বোধহয় ওর সামনে কোন অপশন নেই। আজকাল মাঝে মাঝে একটু অবসাদ হয় দুষ্টুর।সত‍্যিই কি ওর স্বপ্নপূরণ হবে না অধরাই থেকে যাবে? মাঝে মাঝে এটাও মনে হয় দিদি তো ওর ছোটছোট স্বপ্নগুলো নিয়ে ভালোই আছে। জোজোদা ওর ইচ্ছেগুলো বোঝে,এর থেকে আর হয়ত কিছুই চাওয়া থাকতে পারেনা।

       " দুষ্টু তুই কলকাতা চলে আয় পুরোপুরি, একবার দেখনা এসে। হয়ত এবার ঠিক হয়ে যাবে।"

      মাঝেমাঝেই কলকাতা যেতে হয় আজকাল দুষ্টুকে কিন্তু একদম থেকে যাবে কিনা ভাবতেই অদ্ভুতভাবে মনে হলো যদি কিছুদিন একদম একা কোথাও থেকে পড়াশোনা করে তাহলে কি হয়? দিদির সাথে থেকে ওভাবে হবেনা? তাহলে একা থাকা? বাবা রাজি হবেনা। ও যে আলাদা থাকবে তার একটা খরচ আছে সেটা কি হবে? সব ভেবে কেমন যেন লাগে দুষ্টুর। আজকাল মাঝে মাঝেই মনটা খুব অভিমানী হয়ে যায় দুষ্টুর। নিজেকে না পাওয়ার দলে মনে হয়,সাহসটাও যেন ধরে রাখতে পারেনা সবসময়।

     দীপ্তদা ভালো করেছে চাকরি নিয়েছে,বাবা শুনে খুশি হয়েছিলো খুব।বলেছিলো," যাক,ছেলেটা শেষে ফিরে দাঁড়িয়েছে। যাক ভালো থাক। হয়ত আরো কিছু করতে পারতো।তবে এক জীবনে কি সব হয়?"

       দীপ্তদা যদিও বাবার সাথে দেখা করতে আসেনি তবুও বাবার একটা কথা দুষ্টুর আজকাল খুব মনে হয়...এক জীবনে কি সব হয়?

       একটা বছরের শেষে আবার আরেকটা বছরের পরীক্ষা আসছে। রবীন কেন যেন বুঝতে পেরেছিলো দুষ্টুর মনের ইচ্ছে,দুষ্টুকে খুব বেশি বুঝিয়ে বলতে হয়নি। দুষ্টুর জন‍্য মাস আটেক হলো একদম আলাদা থাকার ব‍্যবস্থাই করেছে কলকাতাতে। মিষ্টি যদিও খুব আপত্তি করেছিলো তবুও রবীন বোঝানোতে বুঝেছিলো.." মেয়েটা কেমন যেন পাল্টে গেছে,থাক কিছুদিন নিজের মত।ওকে চেষ্টা করতে দে।তুই তোর মত থাক।"

         প্রয়োজন ছাড়া বাইরে খুব একটা বেরোয়না দুষ্টু তবে জোজো বা মিষ্টি মাঝে মাঝেই এসে খোঁজ নিয়ে যায়। ওদের সবার হাসিমুখগুলো ওকে ছুঁয়ে যায়। আর ভাবে দিদি যেদিন টিভিতে খবর পড়েছিলো প্রথম বাবার মুখের সেই হাসিটা আবার হয়ত দেখতে পাবে কোনদিন খুব কাছ থেকে যেদিন ওর সাফল‍্য আসবে।

     দীপ্তদার জগতের থেকে দুষ্টু এখন অনেক দূরে কিসব প্রত‍্যন্ত অঞ্চলে কাজ করে দীপ্তদা। অনেকদিন আগে মেসেজ করেছিলো একবার... ভীষণ কাজের চাপ,তার সাথে কিছু অন‍্য চাপও আছে। জিজ্ঞেস করেছিলো দুষ্টু উত্তর পায়নি।

        এই বাড়িতে বইপত্র,ল‍্যাপটপ আর টুকটাক জিনিস ছাড়া তেমন কিছু নেই। নিজের জগতে ডুব দিয়েছে দুষ্টু,পরীক্ষার আর খুব একটা বেশি বাকি নেই।

            হঠাৎই মেঘভাঙা বৃষ্টির মত জোজোদা খবরটা দেয় ফোনে.." খবরট শুনেছিস,আক্রান্ত অফিসার নামটা ভীষণ চেনা,ছবি দেখাচ্ছে...যদিও অনেক বছর পর দেখছি তবুও চেনা যায় আমাদের দীপ্ত।"

      কেমন যেন বুকটা কাঁপে দুষ্টুর, ঐ তো অসুস্থ মায়ের একমাত্র সন্তান যার কাঁধে কত দায়িত্ব।রুজি রোজগারের জন‍্য স্বপ্ন ছেড়ে জীবিকার সন্ধান গেছে তাকে কি কেউ এগোতে দেবেনা?

          " কোথায় দিয়েছে খবরটা? কাগজে আছে? তুই কোথায়?"

           হঠাৎই জোজো একটা হাল্কা অথচ গভীর প্রশ্ন করে দুষ্টুকে..." দীপ্ত হারিয়ে গেছে অনেকদিন কিন্তু ওর বন্ধুত্ব আজও জড়িয়ে আছে আমাকে। হয়ত ওর আর স‍্যারের জন‍্যই পাল্টে গেলো জীবনটা। কিন্তু তোর সাথে কি যোগাযোগ ছিলো ওর?"

       গলাটা শুকনো লাগে দুষ্টুর..." কেন? হ‍্যাঁ মাঝে দেখা হয়েছিলো। তুই এখন কোথায়?"

      আমি রাস্তায়," নিউজটা কাভার করবো ডিটেলসে ইচ্ছে করেই কাজটা নিলাম। খুব ইচ্ছে করছে দেখতে দীপ্তকে জানিনা কেমন আছে?"


       খবরের কাগজের একটা পৃষ্ঠাতে আজ আটকে দীপ্তদা। তবে রাজনৈতিক গন্ধ বোধহয় মানুষের পেছন ছাড়েনা তাই এক্ষেত্রে তাই হলো,সব কিছু ছাপিয়ে পেপারে আর নিউজ চ‍্যানেলে গবেষণা চললো যে দীপ্তদা কোন দলের লোক ছিলো,আর যারা হামলা করেছে তারাই বা কোন দলের ছিলো?

         যার সাথে কত খবর আর খাবার একসময় ভাগ করে নিয়েছে জোজো আজ হঠাৎই তার উদ্দেশ্য প্রশ্নের ঝুড়ি নিয়ে রওনা দেয়া।জানেনা সব প্রশ্নের উত্তর পাবে কিনা।তবে বন্ধুত্বকে খুব ইচ্ছে করে ছুঁয়ে দেখতে। যে বন্ধু আনন্দ দেয়,মন ভালো করে তোমার উপকার করেছে কখনো তাকে বোধহয় ভোলা কখনোই উচিত নয়।কিন্তু আমরা সকলে হয়ত কখনো না কখনো সেটাই করি।

          খবরে চোখ রেখেছে রবীনও,ছেলেটা আবার আক্রান্ত তবে রবীনের বিশ্বাস সেই গানের কথাগুলো.. একদিন ঝড় থেমে যাবে,পৃথিবী আবার শান্ত হবে। সবসময় নিজের দুর্ভাগ্য নিয়ে খবরের শিরোনামে আসবেনা ছেলেটা।

     স্কুলের স্টাফরুমে আলোচনা আর সমালোচনার ঝড় উঠলো।কেউ দীপ্তর পক্ষে গেলো,কেউ বা বিপক্ষে।কেউ দুঃখ প্রকাশ করলো আবার কেউ বললো.." আজকাল খবরের শিরোনামে আসতে চায় সবাই।"

       রবীন কান দিতে পারলোনা সব কথাতে।এই পোস্টে থাকতে হলে মেন্টাল ব‍্যালেন্স আপডেট করতে হয় প্রতিনিয়ত।তাই আজকাল চেষ্টা করে বিতর্ক এড়াতে। প্রতিদিনের মত খবর পড়তে এলো মিষ্টি দুষ্টু দেখলো অদ্ভুতভাবে ওরা তিন বন্ধু আজ খবরে...একজন খবর পড়ে শোনাচ্ছে সবাইকে,আরেকজন ইন্টারভিউ নিয়েছে অর্থাৎ নেপথ‍্যে আরেকজন স্বয়ং খবর। আজ দুষ্টু শুধুই শ্রোতা।

             হসপিটালে দেখলো জোজো দীপ্তকে,অনেকটা পাল্টেছে দীপ্ত। সেই রোগা লম্বা দীপ্ত আজ অনেকটা পরিণত,মুখে সেই হাসিটা নেই অনেকটা চিন্তার ভিড়।

      প্রথমে নিজের কাজটা সারতে থাকে জোজো কারণ সাথে টিম আছে। তারপর অনুমতি নেয় বন্ধুত্ব ছোঁয়ার, দীপ্তর হাতটা নিজের হাতে রাখে জোজো,"একদম হারিয়ে গেলি কখন যে..তোকে সেই আগের মতাই জড়িয়ে রাখতে ইচ্ছে করে মাঝে মাঝেই। হঠাৎই কি হলো এমন?"

        "হঠাৎই বোধহয় কোন ভালো মানুষের জীবনে সূর্যাস্ত হয় মানে মেঘ এসে ঢেকে দেয় উজ্জ্বল রোদটুকু।কোনদিন খারাপ হতে চাইনি,তবুও কেন যে লোকে ভালো থাকতে দেয়না কে জানে?"

        কি বলবে বুঝতে পারেনা জোজো..সত্যিই কি সব খবর সোজাসুজি বলার স্বাধীনতা ওদেরও আছে? নিয়ন্ত্রণ রেখা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত বোধহয় আমরা সবাই। সহজে কাঁটাতারের বেড়া পেরোনো যায়না। মেনে নিয়ে মানিয়ে চলার নামই হয়ত জীবন।

         " তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে নে,এবার তোকে পেয়ে গেছি।একসাথে একদিন দেখা করবো। মিষ্টিও আসবে।"

       দীপ্তর মুখের সেই চেনা হাসিটা দেখে জোজো,হয়ত এই হাসিটা দূর করতে পারে অনেক কালো মেঘ।ও বলে," দুষ্টু কোথায় আছে রে?"

      অবাক হয়ে যায় দীপ্ত দুষ্টুর খোঁজ হঠাৎ ওকে করতে শুনে.." তোর সাথে ওর যোগাযোগ নেই? মানে যোগাযোগ নাকি ছিলো?"

     " অনেকদিন যোগাযোগ নেই সত‍্যিই, মাঝে একবার দেখা হয়েছিলো।"

         দীপ্তকে নেটওয়ার্ক ফর ফ্রেন্ডজ্ অন রাখতে বলে জোজো ফিরে আসে। প্রথমে দুষ্টুর ওখানে গিয়ে বাড়ি ফিরবে ঠিক করে। তারপর হঠাৎই মনে হয় থাক বরং একটা কল করে নেবে।

           ফোন জোজোকে করতে হয়নি দুষ্টুই করেছিলো,সত‍্যিই যেন অনেক কিছু জানতে ইচ্ছে করছিলো দীপ্তদার সম্বন্ধে।মানে কি হয়েছে,কেন হলো এখন কেমন আছে?

      দীপ্তদার মনের কোণে হয়ত জমে আছে অনেক স্বপ্ন ওর মতই তবে সত্যিই তো সবাই কি ওর মত বাবা পায়? স্বপ্ন সুতোর জালগুলো যেন না ছিঁড়ে যায় এভাবে সেটাই জোজোদার কথা শুনে মনে হলো।একটু নিশ্চিন্ত লাগলো অপরাধীরা ধরা পড়েছে দীপ্তদাকে ওরা ফাঁসাতে পারেনি ওদের সাথে ঘুষ নেওয়ার জালে। প্রাণটা বেঁচে গেছে,নিশ্চয় সেরে উঠবে অল্পদিনেই তবে মনটা ধাক্কা খায়নি এটাই হয়ত অনেক। মনের ক্ষত শরীরের ক্ষতের চেয়ে অনেকটা গভীর।

       অনেকদিন ফোন করে নট রিচেবল পেয়ে দুষ্টুও ফোন করা ছেড়েছিলো। মনে হলো আবার এবার ফোন করবে একদিন, কিন্তু অনেকদিনের জড়তায় কেমন যেন অস্বস্তি হলো। আসলে সম্পর্কগুলো হয়ত সেই কলকারখানার মতই তেল না দিলে জং ধরে আর একটা সময় বিগড়ে যায়। সত‍্যিই কত সময় কে আগে ফোন করবে এই ভেবে ফোন করাই হয়ে ওঠেনা।

          তবুও দুষ্টুর ফোন এবার নেটওয়ার্ক পেয়ে দীপ্তর যন্ত্রণায় প্রলেপ লাগালো। কেন যেন দুষ্টুকে ওর সহযোদ্ধা বলে মনে হয় দীপ্তর।

    " তুমি পারলে বেরিয়ে এসো,চেষ্টা করোনা আবার এখনো তো সময় আছে। আমি জানি তুমি পারবে।"

     অবাক লাগে দীপ্তর একজন রক ক্লাইম্বার আরেকজনকে সাহস দিচ্ছে যদিও সে নিজেই এখনো শিখরে পৌঁছাতে পারেনি,তবে নিশ্চয় পারবে।

    দীপ্তর জবাবের জন‍্য অপেক্ষা করে দুষ্টু।দীপ্ত একটু চুপ করে থাকে তারপর বলে..আচ্ছা,ভাববো।

     হঠাৎই শুনতে পায় অনেকদিন বাদে একটা গুরুগম্ভীর আওয়াজ যে আওয়াজে একসময় ওরা চুপ করে যেতো,কখনো আবার বুক কাঁপতো.." কিচ্ছু ভাবিসনা,আমরা আছি তো সবাই।দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।"

     দুষ্টু যে কখন স‍্যারকে অ্যাড করে নিয়েছে ফোনে বুঝতেই পারেনি। সব ঠিক হয়ে যাবে কথাটার মধ‍্যে একটা অদ্ভুত ভরসা পাওয়া যায়। কিন্তু কবে?

     অনেকদিন বাদে অনেকটা সময় স‍্যারের সাথে কথা বলে মনটা ভালো হয়ে যায় দীপ্তর।কতদিন ভেবেছে ফোন করবে কিন্তু সেই ঘটনাটা তো মনে দাগ কেটে ছিলো। তাই পারেনি সহজ হতে অথচ আজ রবীনের ফোনে যেন অনেক কিছুই সহজ হয়ে গেলো। ভালোবাসার মানুষের পাশে থেকে ভরসা দেওয়াটা বোধহয় খুব সহজেই পৌঁছে দেয় সব পেয়েছির দেশে।

*******************

দেখতে দেখতে দুষ্টুর পরীক্ষা এসে যাচ্ছে এবার রবীন ছুটি নিয়েই এসেছে,ইচ্ছে আছে কদিন মেয়েদের সঙ্গে কাটিয়ে যাবে,অনুও এসেছে সাথে। অনুকে আপাততঃ দুষ্টুর সাথে দেখা করিয়ে মিষ্টি সঙ্গে নিয়ে গেছে.." মা তুমি আমার কাছে কয়েকটা দিন থাকো,এখনো তো পরীক্ষার দেরি আছে বোনের।"

  " কিন্তু ওদের খাওয়াদাওয়া, সে হবে তোমাকে আর এখানে এসে রান্না করতে হবেনা।আমি যা খাই তাই খাবি।আর দুষ্টু যা খেতো বাবা তাই খাবে।"

       "সত‍্যিই বোধহয় এবার মেয়েদের যুগের শুরু অনু, আমাদের রিটায়ার করার সময় আসছে এবার।"

         সবাই হেসে ফেলে এই কথা শুনে। 

অনেকদিন স্কুলের দায়িত্ব আর অফিসের কাজের মাঝে কয়েকদিনের অবসরে রবীন দুষ্টুর পাশে থেকে ভরসা দিতে চায়।

        " ভালো করে সব দেখে নে একবার, আজ আর পড়তে হবেনা।একটু বিশ্রাম নে এবার।"

     বাবার ঘাড়ে মাথা রাখে দুষ্টু," আমার হবে তো বাবা?"

    " নিশ্চয় হবে,তোর পড়া হলে বলবি আজ একটা গান শুনবো তোর।অবশ‍্য আমিও গাইবো,তুই চলে আসার পর অনেকদিন গান শোনা হয়না।মানে আমারও ইচ্ছে হয়না হারমোনিয়াম নিয়ে বসতে।"

        দুষ্টু এক মনে প্রশ্নগুলো আবার দেখছিলো টাইম ক‍্যালকুলেশন করে।হঠাৎই বেলটা বেজে ওঠে।

       রবীন দরজা খুলতেই অনুকে নিয়ে মিষ্টি আর জোজো আসে।

  " তোরা এখন? আবার কি হলো?"

  " আর বোলোনা,মায়ের মন অস্থির তাই নিয়ে এলাম। আর জোজো আসতে চাইলো বোনকে উইশ করতে।"

     অবাক হয়ে হাসে দুষ্টু.." কিসের উইশ্?"

 " তোর সাকশেশ মানে সাফল‍্যের উইশ।এই নে চাবি,খুলে যাক তোর ভাগ‍্যের তালা।"

  যথারীতি সেই চকোলেট আর সাথে ঠিক চাবির মত দেখতে একটা কার্ড। সত্যিই মনটা ভালো হয়ে যায় দুষ্টুর.." কত কি পাওয়া যায়! সত‍্যিই খুব সুন্দর রে।"

      রবীন বলে," তোরা এখন এলি ভাবলাম আমরা বাপ বেটিতে একটু গানটান করবো।"

    অনু বলে," তোর বাবাকে দেখেছিস তো কেমন করে বলছে যেন আমরা এসে খুব মুশকিলে ফেললাম।"

     " কিছু মুশকিল নেই মা,হয়ে যাক গান।সত‍্যিই বাবা কতদিন গান শুনিনা তোমার।"

        হাসি ফোটে সবার মুখে তবে দুষ্টু শর্ত রাখে দিদি তুই তৈরি হয়ে নে নাচটাও হবে।

    জোজো তাড়াতাড়ি, সব সরিয়ে ডাইনিং স্পেশকে রেডি করে ফেলে।

  মিষ্টি কোমরে ওড়না জড়িয়ে নেয়..রবীন আর দুষ্টু একসাথে গলা মেলায়..

ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো।

একলা রাতের অন্ধকারে   আমি চাই   পথের আলো ॥

     দুন্দুভিতে হল রে কার আঘাত শুরু,

     বুকের মধ্যে উঠল বেজে গুরুগুরু--

পালায় ছুটে সুপ্তিরাতের স্বপ্নে-দেখা মন্দ ভালো ॥

     নিরুদ্দেশের পথিক আমায় ডাক দিলে কি--

     দেখতে তোমায় না যদি পাই নাই-বা দেখি।

     ভিতর থেকে ঘুচিয়ে দিলে চাওয়া পাওয়া,

ভাব্‌নাতে মোর লাগিয়ে দিলে ঝড়ের হাওয়া

বজ্রশিখায় এক পলকে মিলিয়ে দিলে সাদা কালো ॥

    সত‍্যিই বোধহয় ওদের তিনজনের মিলিত গানে আর নাচে কিছুক্ষণের জন‍্য হারিয়ে গিয়েছিলো ওরা সবাই। জোজোও ডুবে গিয়েছিলো সুরের মূর্ছনায়। 

মনের জোর ফিরে পেয়েছিলো দুষ্টু অনেকটা,কি শক্তি আর শান্তি যে আছে রবীন্দ্রনাথের গানে। ওরা দুইবোন ভালোবেসে জড়িয়ে ধরেছিলো বাবাকে।অনেকদিন বাদে অনুর মনটা ভালো হয়ে যায় দুই মেয়েকে কাছে পেয়ে।মনে মনে ভাবে সব যেন ভালো হয় এবার।

        আজ স‍্যার না থাকলে জোজো দুষ্টুর সাথে খুনশুটিতে মাততো যদিও জানে দুষ্টু হয়তো মারতে আসতো মিষ্টিকে তাড়া করতো তবুও বলতো..." নিজেকে সৌভাগ্যের অধিকারী মনে হচ্ছে এই ভেবে যে আমার হবু শালী আর ঘরওয়ালী এতো গুণী।"

    বাড়িতে এসে ভিডিওটা দেখে জোজো আজকের বিকেলটা অনেকদিন বাদে কালচিনির গন্ধ নিয়ে এলো। কালচিনিতে ওদের হস্টেলের সামনের মাঠের রবীন্দ্রজয়ন্তীতে ওরা দুই বন্ধু কত বসে দুষ্টু মিষ্টির গান নাচ দেখেছে। হঠাৎই মনে হলো দীপ্তকে পাঠাবে ভিডিওটা। 

       সন্ধ‍্যে থেকেই লোডশেডিং বাইরে দলছুট পাখিদের ডাক এখনো শোনা যাচ্ছে।কোয়ার্টারের সামনের মাঠ পেরোলেই জঙ্গল। অন্ধকারে আলো জ্বালিয়ে বইয়ের পাতায় চোখ রাখে দীপ্ত। মুহূর্তের দাম হয়ত এভাবেই দেয় সুযোগ পেলেই। কাজের মেয়েটা পাশের গ্ৰামে থাকে অনেক আগে রুটি করে চলে গেছে।মা এখন অনেকটা ভালো।

     ওর চিন্তার জাল ছিঁড়ে হঠাৎই আলো জ্বলে ওঠে মুঠোফোনে। উত্তীয় মেসেজ করেছে,আজকাল মাঝে মাঝেই ওকে নাড়া দেয়।ওর কাছেই পায় সবার খবর। হাত বাড়িয়ে মেসেজে চোখ রাখে দীপ্ত,একটা ভিডিও। চেষ্টা করে ডাউনলোড করতে পারেনা।

     মুঠোতে মুঠোফোন ধরে বাইরে এসে দাঁড়ায়।পূর্ণিমার রূপোলী আলো মাঠটা ধুয়ে দিচ্ছে।দূরের জঙ্গলে টিমটিম করছে জোনাকিরা দল বেঁধে। বাইরে এসে অনেক চেষ্টা করে ডাউনলোড হলো ভিডিওটা.....অনেকদিন বাদে হঠাৎই যেন একটা কালচিনির সন্ধ‍্যা ফিরে এসে মনটাকে ভালো করে দিলো।

  উত্তীয়র পাঠানো ভিডিওতে আর ওদের নাচে গানে এই অন্ধকারেও মনে জমে থাকা সব আবর্জনা পুড়ে আগুন জ্বলে উঠলো দীপ্তর মনে।

কতদিন বাদে সবাইকে এক জায়গায় দেখলো।মিষ্টিকে আজকাল মাঝে মাঝে টিভিতে দেখে তবে ওদের নাচে গানে ভরে উঠলো হঠাৎই ওর আঁধার রাত আলোতে।

       কি বলবে উত্তীয়কে? অনেকটা ভালোবাসা জানানো বোধহয় দরকার এই ভাবে ভালোলাগাটাকে হঠাৎই বাঁচিয়ে দেওয়ার জন‍্য।

******************

     পরীক্ষা দিয়ে দুষ্টুর মনে এলো একটুকরো আশার আলো,হয়ত এবার কোন একটা সুখবর আসতে পারে। রবীন প্রতিবারের মত কেমন হয়েছে তা আর জিজ্ঞেস করেনা শুধু বলে এবার মনে হচ্ছে ভালো কিছু হবে।

      "তোমার মনে হচ্ছে বাবা?" ছোটবেলার মত বাবার কাছে এসে বসে দুষ্টু।

   " তোর মন কি বলছে চুপি চুপি? সে কি একদম চুপচাপ? না বার্তা দিচ্ছে কিছু?"

       মনটা সত্যি বোধহয় একটু ভরসা দিচ্ছে এবার তাই বলে,"দেখা যাক।"

"আচ্ছা বেশ দেখা যাক?"

  " কি?"

    " একটু ঘোরাঘুরি করে দেখা যাক। কতদিন বোধহয় কোথাও যাসনি। চল একটু কাছাকাছি সবাই মিলে ঘুরে আসি। খুব দক্ষিণেশ্বরে যেতে ইচ্ছে করছে বুঝলি। সেই কবে গেছিলাম।"

          " আমারও খুব ইচ্ছে করছে বাবা,সবাই মিলেই যাই চলো।"

     দুষ্টুর পরীক্ষার পর মিষ্টি আর শুনলোনা।ওদেরকে একদম নিয়ে এলো নিজের আস্তানায়। রবীনও বুঝলো এবার হয়ত কলকাতাতেই একটা ফ্ল্যাট কেনা দরকার।তবুও মেয়েরা এখন বড় হয়েছে তাই হয়ত সবার মত এক মত করেই এগোতে হবে। কিন্তু সামনে অনেকটা দায়িত্ব, দুই মেয়েকে তো বিয়ে দিতে হবে।

       কথাটা তুললো রবীন," ভাবছিলাম কলকাতাতে একটা ফ্ল্যাট দেখবো নাকি। মিষ্টি তো আপাততঃ এখানেই আছিস।দুষ্টু কোথায় যাবে ঠিক জানিনা। তবে তোদের তো বিয়ে দিতে হবে সেটাও ভাবনা।"

        বাবার কথা শুনে হাসে মিষ্টি একটু লজ্জাও পায় তবুও বলে," বাবা আমাদের তুমি ভালো করে পড়াশোনা শিখিয়েছো।আর বেশি চিন্তা কোরনা।"

     " বিয়ে দিতে হবে কি? দেখবে সময় হলেই বাড়ি বয়ে এসে নিয়ে যাবে দিদিকে।আর আমি ওসবের মধ‍্যে নেই,আমি তো বাবা তোমার কাছে থাকবো।" মিষ্টি চোখ পাকায় বোনকে আর দুষ্টু এসে বাবার কাছ ঘেঁষে বসে।

    " কিন্তু আমরা কি থাকবো চিরদিন, তখন কে দেখবে তোকে?"

      " কেন আমি আমাকে দেখবো। এই তো মা চাকরি করেনা তবুও মা তো আমাদের আর তোমাকে দেখে। আমরা কতটা দেখি মাকে।"

      অনু বলে," চাকরি করলে হয়ত পুরোটাই দেখতে পারতাম।"

  রবীন বুঝতে পারে অনুর মনের কথা তাই বলে,"তবুও সবার একটা সঙ্গীর দরকার জীবনে,যার সাথে সুখ দুঃখ ভাগ করে নেওয়া যায়।"

      দুষ্টু হঠাৎই বলে ওঠে," আচ্ছা বাবা সত‍্যিই কি দুঃখ ভাগ করে নেওয়া যায়? দুঃখের অনুভূতি গুলো বোধহয় খুব আপন।একদম নিজের।"

      অন‍্যমনস্ক হয়ে যায় রবীন কোথা থেকে যে মেয়েটা এত গভীর কথা বলা শিখেছে? মনের একদম মাঝ দরিয়ায় গিয়ে ঘা মারে।

         কলিংবেল বেজে ওঠে...দরজা খুলতেই মিষ্টি শুনতে পায়।"আর চিন্তা নেই এসে গেছি,চল এবার সবাই রেডি তো?"

      জোজোর নিজের উপার্জনে কেনা গাড়ি আর তাতে স‍্যার বসবেনা তা হয়? সুতরাং রবীনের কোন কথাই আর টিকলোনা দক্ষিণেশ্বর,বেলুড় মঠ সবই ঘুরতে হলো ওর গাড়িতেই। অবাক হলো রবীন একদিন কাচুমাচু মুখে এই ছেলেটা মাথা নিচু করে এসে দাঁড়িয়েছিলো মায়ের সাথে অসহায় ভাবে। কত আর বয়েস তখন..হয়ত চোদ্দ।তার মধ‍্যেই পচন ধরেছিলো সঙ্গ দোষে।রবীন কখনো স্নেহে আর কখনো শাসনে ফিরিয়ে দিয়েছিলো সেই আত্মবিশ্বাস, সব পারবোর দেশে নিয়ে গিয়েছিলো হাত ধরে যত্নে। আজ সেই ছেলে তার রথের সারথী।পথ দেখিয়ে যত্নে নিয়ে চলেছে ওদের পরিবারকে।

               সারাটা দিন ভীষণ ভালো কাটলো অনেকদিন বাদে। সবার মনগুলো হাল্কা হয়ে পাখনা মেললো হাওয়ায়। গঙ্গার ঢেউয়ের দোলা লাগলো বদ্ধ মনগুলোতে। খোলা হাওয়া আর মাতৃ দর্শনে তৃপ্ত সবাই। 

       রবীন আজ অনেকটা সময় এইভাবে পুরো পরিবারের সঙ্গে কাটালো। জোজোকে কোনদিনই বাইরের কেউ বলে মনে হয়না কারণ রাণুর অনেক আদরের জোজো সেটা ওরা সবাই জানে। তবুও আজ যেন এতক্ষণ থেকে রবীনের মনে হলো মিষ্টি একটু বেশিই সচেতন জোজোর ব‍্যাপারে,কখনো ধমকাচ্ছে,কখনো হাসছে আবার কখনো হুকুম করছে।

     ফিরে এসে অনুকে রাতে বললো," আমার মেয়েগুলোকে তো কেউ ঘরে নেবেনা বোধহয়। মিষ্টিকে ভাবতাম শান্ত।ও বাবা এও তো কম যায়না,সারাক্ষণ দুই বোনে মিলে ছেলেটাকে বকলো,ঝকলো হুকুম খাটালো। এত ভালো করে নিয়ে গেলো তবুও কেমন বকাঝকা করছিলো দেখেছো?"

      " তোমার মেয়েদের কি তোমার নিজের ইচ্ছেমত বিয়ে দিতে পারবে নাকি? নিজেরাই হয়ত খুঁজে নেবে নিজেদের পছন্দমতো কাউকে। তবে জোজো ছেলেটা বেশ ভালো, ওদের দুইবোনের সাথে খুব মিল। একদম পিঠোপিঠি ভাইবোনের মতই তো মানুষ হয়েছে ওরা। তবে সবাই এখন বড় হয়েছে দেখতে দেখতে।"

          রবীন একটু অবাক হয় অনুর কথাতে,মনে হলো কিছু বলতে চাইছে অনু। রবীনের অভিজ্ঞ দৃষ্টিও হয়ত এই কদিনের অভিজ্ঞতাতে কিছুটা বুঝেছে,কিন্তু কার জন‍্য জোজো মাঝে মাঝেই ছুটে আসে মিষ্টি না দুষ্টু? অবশ‍্য মিষ্টি বেশ কিছুদিন আগে জোজোদের ফ্ল্যাটে বেশ কয়েকদিন ছিলো। রবীন কিছুই ভাবতে পারেনি তখন,মানে ভাবার আগেই সব ঘটে গেছিলো। তাহলে সত‍্যিই কি কোন ভালোলাগা বা ভালোবাসা তৈরী হয়েছে ওদের মধ‍্যে? অনুও ঠিক জানেনা রবীন বুঝলো,তবে কি দুষ্টুকে জিজ্ঞেস করবে একবার।

রবীন অভিভাবক হিসেবে তেমন কড়া হয়ত নয় কিন্তু একদম আত্মীয়দের মধ‍্যে। সব চিন্তাগুলো জট পাকিয়ে গেলো মাথার মধ‍্যে হঠাৎই। সত‍্যিই তো এতট ভাবেনি কখনোই।

         তবে ভাবনার বাইরে কিছু ঘটে যায় যা হয়ত অবাক করে আর বাক‍্যরোধ করে। দুষ্টুকে নিয়েই কালচিনিতে ফিরে আসে রবীন।মিষ্টিকে তেমন কিছু না বলতে পারলেও রবীন বলে," তুই কি মানে তোর বিয়ের জন‍্য ভাববো?"

           মাথা নিচু করে মিষ্টি," আরেকটু গুছিয়ে নিই বাবা,কিছুদিন যাক তারপর তোমাকে বলবো।দুষ্টুর কিছু একটা হয়ে যাক।"

      তোমাকে বলবো এই কথাটার মধ‍্যেই অনেক কথা রয়ে যায় যা বুঝতে পারে রবীন। তার মানে হয়ত ওর মনে আছে এমন কোন কথা যা বলতে চায়। এরমধ্যে আসলে রবীনকে এক বন্ধু তার ছেলের জন‍্য বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো।

              অলস ভাবে মনে অনেক কিছুই উঁকি দেয়,দুষ্টুটা অধীর আগ্ৰহে অপেক্ষা করছে পরীক্ষার রেজাল্টের। আজকাল মাঝে মাঝে দীপ্তদার সাথে কথা হয় দুষ্টুর, দীপ্তর মনের মধ‍্যে আবার আগুনটা জ্বলে ওঠে দুষ্টুর সাথে কথা বলে।হয়ত দুষ্টুর রেজাল্টের দিকে চোখ রেখেছে দীপ্তও। ওর না পারাটা কি পারবে পুরো করতে দুষ্টু মনের মধ‍্যে স্বপ্নের ওঠানামার দোলাচল।

          *******************

হঠাৎই মধুমিতা আর রাণু একদিন এলো,রবীন তখন স্কুলে। দুষ্টু দরজা খুলেই অবাক হলো," মণিমা, জেম্মা তোমরা! ফোন করলেনা তো? জয় কোথায়?"

    " দেখেছো দিদিভাই আমাদের ঢুকতে না দিয়ে কেমন জেরা করে চলেছে। তোর বাবা মানে আমার জামাইবাবু কোথায়?"

        "বাবা তো স্কুলে।"

  " বাবাকে ফোন কর,বল একদম মাংস কিনে নিয়ে আসতে।"

    ততক্ষণে অনু এসে গেছে,মধুমিতা দুষ্টুর হাতে বরাবরের মত একগাদা বাক্স ধরিয়ে দেয়।

     তারপর গুছিয়ে বসে পড়ে। 

    অনু রাণুকে বলে," একটা ফোন করবি তো?"

  " কেমন সারপ্রাইজ দিলাম বল। আরে রাতে তো আছি আমরা,খেয়ে দেয়ে অনেক গল্প করবো তারপর কাল যাবো।"

     রবীনকে এরমধ্যে ফোন করে দিয়েছে দুষ্টু, যথারীতি স্কুলের পর তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে মাংসের কথা বলে মিস্টি নিয়ে বাড়িতে চলে আসে। কারণ এখানকার মিস্টি রাণুদের সবার খুব পছন্দ।

         তবে সারপ্রাইজটা যে মধুমিতা এভাবে দিতে পারে তা ভাবেনি ওরা কেউ। রবীন কথাটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।

      " কি হলো দাদা,আপনার কোন আপত্তি আছে? আমরা মিষ্টিকে জোজোর জন‍্য চাইতেই আজ এসেছি। জোজোর বাবা তো এখন নেই তবে আমি প্রথমে আপনার মতের জন‍্যই এসেছি। আপনি না বললে অবশ‍্য কিছুই হবেনা।"

       অবাক হয়ে যায় রবীন...এই যুগে এখনো বাবা মায়ের মতের কি এত দরকার? তবুও বলে," মিষ্টির সাথে একবার কথা বলতে হবে। আমি এর আগে যখন এসেছি তখন বলেছিলো আরেকটু সময় নেবে গুছোতে।"

       রাণু হাসে," মিষ্টির সাথে আমরা কথা বলেছি জামাইবাবু, ও বলেছে আপনি যা বলবেন তাই হবে।"

        দুষ্টু হয়ত প্রথম সম্পর্ক ভাঙা আর গড়ার আঁচটা পেয়েছিলো,তবে দুইবোনের মধ‍্যে ঘটে যাওয়া কোন কথাই বাবাকে বলতে পারেনি।কেন যেন মনে হয়েছিলো দিদি যদি কোনদিন বাবাকে বলে তো বলবে।

         রবীন স্বভাব সুলভ গাম্ভীর্যেই বলে," অনু তুমি কি জানতে কিছু? আমি তো সত্যিই কখনো ভাবিনি। দেখেছি দুষ্টু মিষ্টিকে ছেলেটার ওপর জোর খাটাতে কিন্তু ভাবতে পারিনি এমন একটা সম্পর্ক হতে পারে।"

      মধুমিতা অবাক হয়ে যায়," কি সম্পর্ক? মানে জোজোকে কি আপনার পছন্দ নয়?"

    একটু ভাবে রবীন,মধুমিতাকে কি করে বোঝাবে সে কথা? কিন্তু একটা কথা কেন যেন মনের আনাচে কানাচে ঘোরে রবীনের যাকে ছাত্র ভেবে শাসনে গড়তে চেয়েছে এক সময় আজ তাকেই কন‍্যাদান করা? কোন সুযোগ নেওয়া হবেনা তো? মানে যদি কথা ওঠে? না মিষ্টির সাথে কথা বলতেই হবে।

     " কি ভাবছেন এতো জামাইবাবু?আমার তো খুব ভালো লাগছে আমাদের ঘরের মেয়ে ঘরেই থাকলো। আমাদের মেয়েরা যা গুণী তাই ঠিকঠাক ঘরে না গেলে ওদের গুণের কদরই হয়ত কেউ করবেনা। জোজো মিষ্টিকে ভালোবাসে জামাইবাবু,আপনাকে সম্মান করে।মিষ্টির সব ছোট ছোট ভালোলাগা গুলোকে যত্ন করে।"

     মধুমিতা বলে," হ‍্যাঁ এটা ঠিক হয়ত খুঁজে দেখলে মিষ্টির জন‍্য আরো ভালো কেউ আপনি পাবেন তবে হয়ত জোজোকে আপনি গড়েপিটে মানুষ করেছেন তাই একটু হলেও ভরসা করতে পারেন। মিষ্টি ভালো থাকবে মানে ওর মত করে ভালো থাকবে।"

            বড়দের কথার থেকে বাইরে এসে বারান্দায় বসে দুষ্টু। সত‍্যিই হয়ত আজ একটা ভালো দিন,তাই মধুমিতা জেম্মা নিজে এসেছে বাবার সাথে কথা বলতে। আজ আর দিদির ব‍্যাপারটা নিয়ে খারাপ লাগেনা দুষ্টুর, হয়ত কিছু সম্পর্ক ওপর থেকেই ঠিক হয়ে আসে। ওর চোখ এখন শুধু এবারের পরীক্ষার রেজাল্টের দিকে। অনেকদিন আগে একবার মা বলেছিলো ভালো আর খারাপ খবরেরা নাকি দলবেঁধে আসে কখনো।মানে ভালোর পর ভালো আবার ভালো তেমন খারাপের পর শুধুই খারাপ।

     আচ্ছা তেমন কি আরও কোন খবর অপেক্ষা করে আছে ওর জন‍্যও?

    *************************

রান্নাঘরে রাণু মেতেছে দিদির সাথে,এখানে আসা মানেই ওর প্রিয় পাঁঠার মাংসের জোগাড় রবীনকে করতেই হয়। আদরের শালী বলে কথা,মধুমিতা রান্নাঘরের সামনে বসে যোগ দিয়েছে গল্পে। যদিও রবীন আজ একটু চুপচাপ, তাই অল্প হলেও দ্বিধা রয়েছে মধুমিতার মনেও।

         মিষ্টির অপেক্ষায় আছে রবীন,ও অফিস থেকে ফিরলে ওর সাথে একটু কথা বলবে।যদিও মিষ্টি অনেকদিন বাড়িছাড়া তবুও মেয়ের বিয়ের কথায় কেমন যেন মন খারাপ হয় রবীনের।অদ্ভুত একটা চাপা কষ্ট হচ্ছে যেট ঠিক বোঝাতে পারছেনা। দুষ্টু এসে বাবার কাছে বসে.." বাবা তোমার কি হয়েছে? আজ এত চুপচাপ কেন? মা ,মাসি,জেম্মা কত গল্প করছে।"

      দুষ্টুকে হঠাৎ একটা প্রশ্ন করে রবীন," তুই তো অনেকদিন কলকাতা ছিলি,মিষ্টিকে জোজো বুঝবে তো? মানে মিষ্টির উচ্চাকাঙ্ক্ষা ওর স্টাইল আর ভালো থাকতে চাওয়া সব কিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে তো জোজো?"

     দুষ্টুর অবাক লাগে বাবার কথা শুনে, সবসময় শুনেছে মেয়েদের সব জায়গায় মানিয়ে আর মেনে নিতে হয়।আজ বাবা অদ্ভুতভাবে জোজোদাকে মানিয়ে নেবার কথা বললো। জানেনা এই কথাটা জেম্মার শুনলে কেমন লাগবে? হয়ত ভালো লাগবেনা। 

তাই বললো," বাবা দিদি তো মেয়ে,মা তো চিরকালই বলেছে মেয়েরা জলের মত যেখানে থাকে তার মাপেই টলটল করে। আচ্ছা তুমি মানিয়ে নিয়েছিলে,না মা মানিয়ে নিয়েছিলো?"

      রবীন বুঝতে পারে দুষ্টু এখন অনেক পরিণত আর বাস্তববাদী।আগের মত ঝগড়ুটে আর মারকুটে নয়।তবুও বলে.." আমি তো তোদের কোনদিন মেয়ে বলে ভাবিনি।তোর মা ছেলে ছেলে করেছে।আমি খুশি আর গর্বিত হয়েছি আমার দুই রাজকন‍্যা নিয়ে।"

    " তাহলে আর চিন্তা কি তোমার ছেলে বিয়ে করে বৌমা আনছে। জোজোদা খুব ভালো হাসিখুশি আর অ্যাডজাস্ট করতে পারে।ওরা ভালো বন্ধু বাবা ঠিক ভালো থাকবে। আর যদি দুস্টুমি করে তুমি আবার গাছ লাগাতে বলবে দেখবে ঠিক সোজা হয়ে যাবে। তাইতো জেম্মা চিরজীবনের মত জোজোদাকে তোমার হাতে দিয়ে গেলো।"

      দুষ্টুর কথার বাঁধনে অবাক হয়ে যায় রবীন,কিছু কথা বলতে পারে এই মেয়ে।তার সাথে সাথে মনের ভারটা আরো হাল্কা হয়ে যায় মিষ্টির সাথে কথা বলে। একটু লজ্জা পেলেও মিষ্টির মনের কথাগুলো আজ স্পষ্ট করেই বাবাকে বললো.." কেন যেন যখনই বিপদে পড়েছি ও সবসময় আমার পাশে থেকেছে বাবা। প্রথমে বন্ধু ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারিনি, তবে এই কয়েক বছরে বুঝতে পেরেছি ওর সাথে নিশ্চিন্তে থাকা যায়।"

********************

  খাবার টেবিলে আবার হাসিখুশি রবীনকে দেখলো ওরা সবাই। মনের ভারটা নেমে গেলো মধুমিতার, হয়ত এটুকু ভাবনা চিন্তার সময় রবীনদাকে দেওয়া দরকার ছিলো।তাই জোজোর বাবাকে ছাড়া একা এসে ভালো করেছে।

         মিষ্টির সাথে নিশ্চয় কথা হয়েছে তাই অনেকটা হাল্কা রবীনদা।

     রাণু বলে," জামাইবাবু মাংসটা আজ আমাকেই করতৈ হলো।দিদি তো খুব টেনশনে উল্টোপাল্টা কাজকর্ম করছে।"

      " টেনশন কেন আবার? একদিনের জন‍্য এসেও তোমাকে লাগতে হলো রান্নাতে?"

         " আর কি,আসলে আরেকটা নতুন অধ‍্যায় আসছে তো জীবনে তাই সবারই দুশ্চিন্তা।মেয়েদের জীবনের এক একটা পর্যায়..প্রথমে মেয়ে,তারপর বৌ,তারপর মা,আবার শাশুড়িমা অবশেষে ঠাম্মা,বম্মা কত কি?"

    দুষ্টু হাসে," কি সুন্দর কথা বলছো তুমি মণিমা।"

      " তোর কাছ থেকেই তো শিখেছি বলতে পাকাবুড়ি। ভালো খবরের ঝুলি খুলেছে,এরপর আরো আসবে ভালো খবর।"

    অনু বলে," তাই যেন হয় এবার দুষ্টুর একটা ভালো খবর আসুক। রেজাল্ট টা যেন ভালো হয়।"

    মধুমিতা বলে.." আপাততঃ আজকের ভালো খবরটার জন‍্য সবাই একটু মিঠেমুখ করি তাই তো।"

*****************

            মিষ্টির খুশির খবর নিয়ে প্রজাপতিরা পাখনা মেললেও অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম আসেনা দুষ্টুর। যদি এবার পরীক্ষার ফল ভালো না হয় তাহলে কি করবে ও?

      ফোনের নীল আলোটা জ্বলে ওঠে ফোনের দিকে তাকায় দুষ্টু দীপ্তদা মেসেজ করছে..স্ক্রিনে কয়েকটা প্রশ্ন ভেসে ওঠে,উত্তরগুলো জানতে চাইছে।

   দীপ্তদা কি করতে চাইছে বুঝতে পারেনা দুষ্টু, তবে কিছু একটা করতে চায় সেটা বোঝে। একদিন বলেছিলো.." তুমি তো আমার গাইড ছিলে, এখন আমাকে প্রশ্ন পাঠাও কেন?"

   " তুই এক্সপিরিয়েন্সড সিনিয়র তাই পাঠাই। আমি পারছিনা।দেখ একবার।"

        " আমি সিনিয়র! তোমার ছোট আমি।"

    মনে মনে দীপ্ত ভাবে তবুও তোর সব কথা আর কাজই বোধহয় দামী।

       দুষ্টু বই বের করে ল‍্যাপটপ খুলে বসে। রবীনের ঘুম ভেঙে যায় মাঝরাতে।আসলে মনটা খুব চঞ্চল তাই হঠাৎই ঘুম ভাঙে।

      দুষ্টুর ঘরে নীল আলোটা তখনো জ্বলছে,ল‍্যাপটপ খোলা দুষ্টুর সামনে একটা বইও।কারো সাথে আস্তে আস্তে কথা বলছে দুষ্টু। অবাক লাগে রবীনের, আজকাল তেমন ভাবে ওর ঘরে রাতে আসেনা রবীন। তবে এত রাতে দুষ্টু কার সাথে কথা বলছে? ঘড়ির দিকে চোখ যায় প্রায় দুটো।পাশের ঘরে অনু রাণু মধুমিতা সবাই ঘুমোচ্ছে অঘোরে।

              


          

      

      









Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...