রাতের অন্ধকারে নীলচে আলোতে আরো উজ্জ্বল দুষ্টুর মুখটা,ল্যাপটপ দেখে দেখে ফোনে কিছু বলছে কাউকে।
সত্যিই যুগ পাল্টাচ্ছে,একটা সময় রবীনদের গ্ৰামের বাড়িতে বাবা বলতেন সকাল সকাল শুয়ে পড়ো কাল ভোরে উঠবে।উঠে পড়তে বসবে,ভোরের পড়া মনে থাকে। মানুষদের রাতে ঘুমোনোর সময় পশুরা রাতে জাগে। একটা সময় দুষ্টু মিষ্টিকেও এভাবেই মানুষ করেছে রবীন।তবে এখন যুগ পাল্টাচ্ছে,রাতেই ছেলেমেয়েরা বেশি পড়াশোনা করে দিনে বেলায় ওঠে। প্রথমটা একটু খারাপ লাগলেও আজকাল অভ্যেস হয়ে গেছে।
অনুই বুঝিয়েছে মেয়েরা বড় হচ্ছে,পড়ার চাপ বাড়ছে ওদের মত করে সময় ভাগ করে নিতে দাও। তবে রবীন কিছুতেই বোঝাতে পারেনি অনুকে যে দিনটা তো সেই চব্বিশ ঘন্টাতেই ঘুরছে তাই তার বাইরে তো আর যেতে পারবেনা।
শুধু দুষ্টু বলেছিলো," বাবা রাতে সব নিঃশব্দ থাকে তো পড়া ভালো হয়। আমি তো উঠেই পড়ি সাতটার মধ্যে।"
রবীন গানে গানে বলেছিলো কবিগুরুর কথা..
অবাক হয়েছিলো দুষ্টু সত্যিই বোধহয় কবি শুধু কবিই ছিলেননা এমন জীবন দর্শন ছিলো বলেই হয়ত তিনি বিশ্বকবি।
পুরোনো কথার সাগরে ডুব দিয়ে রবীন ফেরে বিছানার নিভৃত কোণে।হয়ত এই জায়গাটুকু আরামে বিশ্রামে কখনো শ্রান্তি আর ক্লান্তিতে বড় প্রিয়।
আর হয়তো ঘন্টা তিনেকের মধ্যেই ভোর হবে।মনের মধ্যে আজ বারবারই বাজে মেয়ের বাবা হওয়ার এক অস্থিরতা, একি আনন্দ না ব্যথা বুঝতে পারেনা রবীন। যদিও দুষ্টু ঠিক বলেছে ছাত্র হবে পুত্রসম তার কাছে যাবে তার আদরিণী আত্মজা তবুও সেই ছোট দুষ্টু মিষ্টি আজ কত বড় হয়ে গেলো ভাবতেই কেমন যেন মনটাকে আর নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনা।
দীপ্তদার কোশ্চেনগুলো একটু একটু করে সল্ভ করে ফেলে দুষ্টু। দীপ্তর চাকরির জায়গা ভীষণ প্রত্যন্ত অঞ্চল তাই সবসময় নেটওয়ার্ক থাকেনা,তাই ফোনে ফোনেই জেনে নিতে হয় দুষ্টুর কাছে অসুবিধা হলেই।
প্রথমে একটু লজ্জা পেলেও সত্যিই দুষ্টুর অভিজ্ঞতা সাহায্য করে দীপ্তদাকে ওর অজানা জিনিসগুলো জানিয়ে দিতে।
দুষ্টুকে কেন যেন একদম স্যারের মত লাগে দীপ্তর। নিঃশব্দে নীরবে ভালো কাজ করে যায়। আজকাল উত্তীয়র সাথে নিয়মিত যোগাযোগ হয়,ছেলেটা অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে রাখতে চায়। নিজেকে কোনসময় অপরাধী মনে হয় দীপ্তর,নিজের হীনমন্যতায় ও হারিয়ে গিয়েছিলো এমন বন্ধুদের সাথে যারা কোনদিন বন্ধুই ছিলোনা।
সত্যিই বোধহয় ভালো বন্ধু পাওয়া সহজ নয় তবুও আমরা ভালো বন্ধুত্বকে অনেকসময় না বুঝেই নষ্ট করে ফেলি।
রবীনও কথায় কম যায়না," পুরোনো সম্পর্কটাও মিঠে ছিলো এটাও খুব মিঠে সম্পর্ক। পুরোনো সম্পর্কের বইটাতে আবার নতুন করে মলাট লাগানো এই আর কি?"
মধুমিতা বললো," বোঝো তোমরা শালী আর জামাইবাবু কি করবে? আমার দাদা তো দাদাই থাকবে ঠিক আগের মতই। যাকে ভরসা করা যায়।"
ওরা চলে যাবার পর রবীন অনুকে বলে," এই ভরসাটা যেন রাখতে পারি আমরা,সম্পর্কটা যেন ভালো থাকে চিরকাল এটা মিষ্টিকেও বলতে হবে।নাহলে আমার শালীটা কষ্ট পাবে।"
অনু বলে," অত ভেবোনা,তোমার মেয়েরা কখনো এমন কিছু করবেনা যাতে তোমার অসম্মান হয়।"
তবে ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজাপতি উড়ে আসে রঙিন আলো গায়ে মেখে চাবাগানের ওপার থেকে। রবীনের মনেও ভিড় করে অনেক স্বপ্ন...প্রথম মেয়ের বিয়ে আসছে যদিও দিন ঠিক হয়নি তবুও একটু একটু করে গুছোতে হবে অনেক কিছু।
এলোমেলো ভাবনায় ডুবে যায় দুষ্টু, সত্যিই আজকাল আর অপেক্ষা ছাড়া তেমন কিছু করার নেই। নিজেকে প্রমাণ করার লড়াইয়ে কখনো জিতেছে আবার কখনো হেরেছে। জানেনা এবারের পরীক্ষাটা কি খবর নিয়ে আসবে?
আর কিছু মাস বাদেই হয়ত দিদির বিয়ে যেখানে কত লোকজন আসবে তার মাঝে ওর কি পরিচয়? এমনিতেই অনেকে ওকে ক্ষেপি বলে..আড়ালে লোকে বলে,চাঁদ ধরা কি এত সহজ? পাশের বাড়ির দুটো ছেলেমেয়ে চাকরি করছে ওর জুনিয়র। যখন বাড়িতে আসে তখন হাত ভর্তি উপহার আনে সবার জন্য আর ওকে এখনো বাবার কাছে হাত খরচ নিতে হয়।অথচ এমন একটা চাকরি ও পেতেই পারতো,বাবা মা নিশ্চিন্ত হতো।
হঠাৎই খারাপ চিন্তাগুলো দূরে সরে গিয়ে মন বলে ওঠে ঠিক পারবে।নিশ্চয় এবার সৌভাগ্যের তালা খুলবে।
অনেকদিন বাদে জোজোদার সাথে কথা হলো..
ফোন ধরতেই হৈ হৈ করে উঠলো.." এবার জিজুদা বলাটা অভ্যেস কর। জিজু প্লাশ দাদা মানে জিজুদা। আজকাল ফোন করিসনা কেন রে? টেক্সট করলে চারদিন বাদে উত্তর দিস।কি হলো তোর?"
" কি আবার হবে? তুই আনন্দ কর,সাকশেশফুল এডিটার, ভালো রাইটার,গুড ড্রাইভার।এরপর আবার ভালো হাবি হবি। সমস্ত গুড তো তোর ঝুলিতে এখন।"
দুষ্টুকে এমন ডিপ্রেসড মুডে দেখেনি জোজো,বুঝতে পারে ওর কষ্টটা তাই বলে.." তুই কম কি ইঞ্জিনিয়ার, স্মার্ট, মডেল লুক,ভালো বাইকার।দরকারে লাদাকে চলে যেতে পারিস বাইক নিয়ে আর কি চাই?"
" বেকার ইঞ্জিনিয়ার, আজ পর্যন্ত একটা বয়ফ্রেন্ড জুটলোনা,নেট ব্যালেন্স বাবা ভরে দেয় তারপর কথা বলি।লাদাক স্বপ্ন এখনো যেতে পারিনি তবে বাইকার এটা ঠিক আছে।বাবাকে নিয়ে বাজারে দোকানে যাই মানে রবীনবাবুর ছোটছেলে।"
" আরে এই তো সুন্দর কথা বলছিস,আমাকে মিষ্টি বললো তোর নাকি মুড অফ। আরে হবে হবে খুলে যাবে সিমসিম। আর যদি সত্যি এবার পারিস আমি একটা সারপ্রাইজ গিফ্ট দেবো।"
এবার খিলখিল করে হাসে দুষ্টু.." ইশ্ আগে বলবি তো গিফ্ট দেবো।তাহলে পরীক্ষাটা আরো ভালো করে দিতাম।"
ফোনটা রাখার পরও কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে দুষ্টু, দিদি ওকে নিয়ে এতোট ভাবে। এই ভালো সম্পর্কগুলো যেন এমনি ভালো থাকে চিরকাল।
" কত কাজ পড়ে আছে ওদিকে আচ্ছা বসছি। তুই চল আমার সাথে।বলেছিনা কাজের মধ্যে থাকবি মন ভালো থাকবে।"
মেয়ের মন ভালো করতে অনু বলে," আজ তোর বাবাকে বলি কোথাও গাড়ি করে ঘুরে আসবো বরং।"
বাইরে যাওয়ার কথা শুনে লাফিয়ে ওঠে দুষ্টু," মা তাহলে গাড়িটা আমি চালাবো কিন্তু।"
রবীনের প্রশ্রয়ে শেষে পাকাপাকি ভাবে ড্রাইভারের সীটে বসলো দুষ্টু। অনু সাবধান করলো বারে বারে," সামনে মিষ্টির বিয়ে।"
নিয়ন্ত্রিত কিন্তু সুন্দর গতিতে দুষ্টু গাড়ি চালিয়ে জলপাইগুড়ির রাস্তায় আসে।রবীন জিজ্ঞেস করে," এদিকটায় এলি হঠাৎ?"
"পুরোনো ক্যাম্পাসটা একবার দেখতে ইচ্ছে করলো বাবা। অনেকদিন আসিনা এদিকে। চলো আজ তোমাদের এক জায়গায় নিয়ে যাবো।"
রাস্তার পাশে সাইড করে গাড়ি রেখে মা বাবাকে নিয়ে যায় দুষ্টু একটু গাছপালার পথ ধরে এগিয়ে।
রবীন নাম শুনেছে তবে আসা হয়নি আগে..দেবী চৌধুরাণীর কালী মন্দির।ভেতরের কালী প্রতিমা মনকে ডুবিয়ে নিয়ে গেলো ফেলে আসা ইতিহাসে হয়ত কখনো এই মন্দিরেই পুজো দিয়ে দেবী চৌধুরাণী যেতেন ডাকাতি করতে। গাছপালা ঘেরা মন্দিরটা সত্যিই মনকে টানে।
বাড়িতে ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেলো ওদের। তবুও আজকের টুকরো খোলা হাওয়া মাখার খবরটা দুষ্টুর মনের অন্দরে রয়ে যাবে অনেকদিন।
রেজাল্ট বেরোনোর সময় যত এগিয়ে আসছে দুষ্টুর মনে উদ্ভট চিন্তারা বাসা বাঁধছে।মনে একটা ভয় কি হয় কি হয়। অবশ্য চিন্তা নেই আগে তো সিলেকটেড হোক তারপর ভাবা যাবে বাকিটা। কারণ হার্ডল রেসের মত অনেকগুলো ধাপ পেরোতে হবে তারপর লক্ষ্যে পৌঁছোনো।
সকাল থেকেই এদিক ওদিক করে রবীন,মনটা অস্থির কি হয় কি হয়? তবুও ভালো মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার মত এই রেজাল্ট সর্বজনবিদিত নয় তাহলে আজকে অনেক আত্মীয় খুঁজে পেতো যারা হিতাকাঙ্খী হয়ে বারবার ফোন করতো।
দুষ্টুর মনটা অস্থির সকাল থেকে নেটটা প্রবলেম করছে।কে জানে ঠিকঠাক দেখতে পারবে কিনা? আজ আর খাওয়া দাওয়াতে মন নেই ওর।
ফোনটা আবার বেজে ওঠে তাই অনু আর পারেনা উঠে যায় ফোনটা আনতে। স্ক্রীনে চোখ রাখে অনু জোজো ফোন করেছে,দুষ্টুর হাতে ফোনটা দেয় অনু।
দুষ্টু ফোনটা ধরতেই ওপার থেকে উচ্ছ্বাস ভেসে আসে গুডনিউজ,গুডনিউজ আমিই দিলাম আগে। একটা ধাপ পেরিয়ে গেছিস। আমি ওত পেতে ছিলাম, জানবো বলে। তুই নিশ্চয় এখনো জানিসনা।"
আনন্দে চোখটা ভিজে ওঠে দুষ্টুর, জোজোদার কাছ থেকেই শেষে এলো গুডনিউজ টা। হয়ত জোজোদা আর দিদিও ওর হিতাকাঙ্খী তাই সকাল থেকেই ওদেরও মন পড়ে আছে দুষ্টুর জন্য।
বেশি কথা বলতে পারেনা দুষ্টু শুধু বলে," বাবাকে আগে বলি তারপর আবার ফোন করছি।এখন ছাড়।"
দুষ্টু জানে কাল থেকে বাবারও মনটা অস্থির তাই বাবাকে খবরটা দেওয়া দরকার আগে।
রবীন শুধু বলে," আমি জানতাম এবার তোর হবেই।শুধু তোর অস্থিরতা দেখে মনটা অদ্ভুতভাবে অশান্ত হয়ে গেছিলো কিছুতেই শান্ত হচ্ছিলোনা।"
রবীনের পক্ষে আর বেশিক্ষণ স্কুলে থাকা সম্ভব হয়না জয়ী মেয়েটাকে কাছে টেনে মাথায় হাত রাখতে ইচ্ছে করছে খুব। সত্যিই মেয়েটা খুব কষ্ট করেছে,সফল হোক ওর স্বপ্নগুলো এভাবেই।
খুশির ছোঁয়াতে ধুয়ে মুছে যায় এতদিনের অবসাদ আর ক্লান্তি,যদিও আরো ধাপ আছে তবুও দুষ্টুর আত্মবিশ্বাস এখন বলছে সব পারবে। কারণ ভালো খবরগুলো বোধহয় এবার ভিড় করে আসছে কালচিনিতে। আজ সবার সাথে একসাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে দুষ্টুর।দিদি জোজোদা,মণিমা আর দীপ্তদাকে খবরটা দিলেও ভালো হত। কিন্তু নাহ্ দীপ্তদাকে পরে বলবে।এভাবে হঠাৎ অ্যাড করলে হয়ত খারাপ লাগতে পারে। একটা সময় দীপ্তদা চেষ্টা করেছিলো অবশ্য কিছুটা সফল হয়েছে কিন্তু স্বপ্ন সফল হয়নি পুরোপুরি।
কিছুক্ষণের জন্য দুষ্টুর মনে হলো ওরা সবাই এখন কালচিনিতে এসে গেছে। খুশির ঝোড়ো হাওয়াতে এতদিনের জমে থাকা সব না পাওয়া মুছে গেছে।
" আরে এবার তো একটা সারপ্রাইজ গিফ্ট আছে তোর জন্য সেটা নিবিনা? আমি কিন্তু প্রমিস করেছিলাম দেবো।"
ওদের হাসি মজা ভালো লাগে রবীনের, যাক দমবন্ধ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে একটু আনন্দ করুক ওরা। বাইরের ঠান্ডা হাওয়ায় এসে চেয়ারে বসে রবীন,খুব হাল্কা লাগে মনটা।হয়ত এরপরের টুকু নিশ্চয় ভালো হবে।
ওদের হাসির মাঝে জোজো বলে..." তোর লাদাক যাওয়াটা আমি স্পন্সর করবো এই খুশিতে। তোর অনেকদিনের শখ ছিলো আমি জানি।"
" আমার সামনে অনেক কঠিন কিছু আছে,এত খুশি হওয়ার কিছু নেই সবটা সামলে তারপর যাবো লাদাক।"
খুব বেশি ক্লান্তি,খুশি আর দুঃখে কখনো কখনো চোখে ঘুম আসেনা। দীপ্তদাকে সারাদিন ফোন করা হয়নি।কেমন যেন একটা দোটানায় পড়েছে দুষ্টু, তবুও এবার নিজেই নিজেকে শাসন করে আর কোন ভাবনা নয় এখনি একটা ফোন করা দরকার।
ফোনটা কিছুক্ষণ বাজে নিজের ছন্দে ওপাশে ফোন ধরে দীপ্ত।দুষ্টু বলে,"আমি পেরেছি দীপ্তদা।"
তবে দুষ্টুর উচ্ছ্বলতা সবটাই ধুয়ে মুছে দিলো। দীপ্তও সাহস দিলো দুষ্টুকে, নিশ্চয় একদিন দুষ্টু পৌঁছে যাবে সব পেয়েছির দেশে।
জোজোদা সত্যি পারে সবাইকে ঢোল পিটিয়ে বেড়িয়েছে।ওহ্ মনে হচ্ছে পরীক্ষাটা ও নিজেই পাশ করেছে। হয়ত সত্যিই ভালো মনের মানুষ হলেই এতোটা মন থেকে খুশি হওয়া যায়।
মাঝে কেটে গেছে বেশ অনেকগুলো মাস। সব বাধা পেরিয়ে দুষ্টু লক্ষ্যে পৌঁছনোর মুখে। খুশির বাতাসে সুগন্ধের ছোঁয়া এরমধ্যে অনেকবার দুষ্টুকে নিয়ে রবীন কলকাতা আসা যাওয়া করেছে।
রবীনের স্কুলের কমনরুমে শুধু দুষ্টুর আলোচনা অনেকেই বললো..." আসলে লেগে থাকতে হয় বুঝলে,মাটি কামড়ে থাকলে জয় আসবেই।ছেড়ে দেওয়া মানেই হেরে যাওয়া।"
অবাক হয়ে যায় রবীন আজ যাদের মুখে এত ছেড়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে কথা একটা সময় এরাই কানাকানি করেছে...আর হয়ত হবেনা,এত সহজ নয় এই পরীক্ষা ক্র্যাক করা।সুতরাং হাল ছেড়ে দেওয়াই ভালো।
মিষ্টির বিয়ের তারিখ নিয়ে একটু দোটানায় ছিলো রবীন কারণ বেশ কিছুদিন দুষ্টুকে নিয়ে ছোটাছুটি চলেছে তাই একটু সময় নিয়েছে।অবশ্য মিষ্টিও বলেছে সেই কথা," আগে দুষ্টুর ব্যাপারটা হয়ে যাক বাবা,তাহলে ও একটু ভালো করে আনন্দ করতে পারবে।"
রবীন যদিও চেয়েছিলো দুষ্টুর আশীর্বাদ বিয়ের দিনই হোক তবুও মানেনি মধুমিতা আর রাণু ...." দাদা একটাই ছেলে আমার, আমরা একটু আনন্দ করবো বেশ কিছুদিন ধরে।জোজোর বাবারও তেমন ইচ্ছে।"
সবার এত সম্মিলিত ইচ্ছেতে আর বাধা দিতে পারেনা রবীন তাই আশীর্বাদের জন্য একটা দিন ঠিক হয়। মধুমিতা খুব ব্যস্ত কেনাকাটা নিয়ে,মাকে দেখে অবাক লাগে জোজোর মা যে এত ছেলেমানুষ এখনো আগে বুঝতে পারেনি। হয়ত বা আনন্দে ছেলেমানুষী আরো বেড়েছে।
জোজোর কাছে সব শুনে মিষ্টি রাতে একলা ফ্ল্যাটে শুয়ে অনেক মধুকরের গুনগুনের মধ্যে ভাবে বিয়েটা একদম খুব কাছাকাছি সম্পর্কের মধ্যে হচ্ছে। ও পারবে তো সবার এই আনন্দকে ধরে রাখতে এমন করেই?
কালচিনিতে দুষ্টুর এখন দিন গোণা হাতে খুব বেশি সময় নেই আর এরপর আলস্য কাটিয়ে নতুন জীবনে পা রাখা।যেখানে হয়ত দীপ্তদার মত ঠোক্কর খাবে পায়ে পায়ে তবুও হার না মেনে এগিয়ে চলার নামই জীবন। হয়ত স্বপ্নপূরণের পথে আসবে বাধা তবুও হার মারবেনা,এগিয়ে ওকে যেতেই হবে।
বাবার ঘর থেকে গান ভেসে আসে...
ভরা থাক্ স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি।
মিলনের উৎসবে তায় ফিরায়ে দিয়ো আনি॥
বিষাদের অশ্রুজলে নীরবের মর্মতলে
গোপনে উঠুক ফলে হৃদয়ের নূতন বাণী॥
যে পথে যেতে হবে সে পথে তুমি একা--
নয়নে আঁধার রবে, ধেয়ানে আলোকরেখা।
সারা দিন সঙ্গোপনে সুধারস ঢালবে মনে
পরানের পদ্মবনে বিরহের বীণাপাণি॥
এক অদ্ভুত ভালোলাগায় ডুবে দুষ্টুর মন রাতের আঁধারে।
*****************
অফিসের কাজের ফাঁকে বারবার আনমনা হয়ে যাচ্ছে দীপ্ত বেশ কিছুদিন। রায়বাবু বলেন," আপনার কি শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা স্যার?"
অনেক বারই রায়বাবুকে বলেছে স্যার না বলতে তবুও উনি শুনবেননা।
" না না ঠিক আছে,আর কি কি সই করতে হবে বলুন আমি সেরে নিয়ে একদম যাবো।"
" হ্যাঁ স্যার দিচ্ছি,মাসিমা তো এখন ভালোই আছেন তবুও বাড়ি গিয়ে সেই একলা একলা এবার একটা বিয়ে করুন।"
রায়বাবু মানুষটা ভালো তাই কিছু বলতে পারেনা দীপ্ত শুধু বলে," এখনো কিছু ভাবিনি,আসলে পড়াশোনা চলছে এখনো।"
" সে তো চলবেই,কথায় বলে বইয়ের চেয়ে ভালো বন্ধু আর আছে কোথায়? আপনার একলা থাকার সুযোগে বইয়ের দল একদম গলা জড়িয়ে ভালোবেসে রেখেছে আপনাকে। তা এতো আর প্রেমিকা নয়,তাই বিয়ে করতে আপত্তি কোথায়?"
বেশ রাগ হয় দীপ্তর এবার," ভদ্রলোক ভালো কিন্তু খুব বাড়তি কথা বলেন তো। প্রেমিকা টেমিকা এসব কি বলছেন।"
হঠাৎই দীপ্তর ফাইলের মাঝে উঁকিঝুঁকি দেয় একটা মুখ...এক যে ছিলো কন্যা তার শ্যামলা বরণ,না না শ্যামলা নয় অদ্ভুত রোদেলা বরণ,লম্বা গরন,মাথার চুল ছোট,চোখে নাচে তিস্তার ঢেউ।ওর খুব পরিচিত কেউ। যার সাথে দুদন্ড কথা বললে মনে আসে ভরসা আশা,শুধু তাকেই বলা যায় সব কথা আর হয়ত যায় ভালোবাসা।
হঠাৎই চিন্তার সোনালী জড়ি কেটে যায় রায়বাবুর কথায়.." একদম চুপ করে গেলেন যে? অবশ্য হতেই পারে বয়েসটাই তো এই। আপনি যদি বলেন তাহলে আমার বড় শালীর মেয়ে আছে,সুন্দরী ইংরেজী অনার্স কথা বলতে পারি। আরে আমার কাছেই তো ছবি আছে। কই গেলো, আচ্ছা আমি বাড়ি গিয়ে খুঁজে আপনাকে পাঠাবো।"
দীপ্ত একটু গম্ভীর হয়ে বলে.." আপনার কাজগুলো সেরে রাখবেন।আমি এখন একটু ব্যস্ত আছি পরে আপনার সাথে কথা বলবো।"
দীপ্তর মেজাজ বুঝে রায়বাবু কিছু বললেননা মনে মনে ভাবলেন হয়ত প্রেমে পড়ে বসে আছে। তার কথা ভাবতে গিয়েই স্যার আনমনা তবুও মনে মনে বললেন আমিও হাল ছাড়বোনা,বৌ বারবার বলেছে যদি একবার বিয়েটা লাগিয়ে দেওয়া যায় তাহলে পোয়াবারো। কম বয়েস,দেখতে ভালো, ভালো চাকরি করে আর কি চাই? সবচেয়ে বড় কথা একদম সাধারণ ঘরের ছেলে ফাট ফুটুনি নেই।
অফিস থেকে বেরিয়ে কোয়ার্টারের পথটুকু হেঁটেই আসে দীপ্ত, ভালো লাগে গাছ গাছালির সবুজে মন ডুবিয়ে আসতে এখানে। দুষ্টুর খুব পছন্দ জায়গাটা শুনেই বলেছিলো," ওমা পুরুলিয়াতে তোমার পোস্টিং ও তো আমার দাদুর বাড়ির দেশ গো।"
দীপ্ত হেসে বলেছিলো," পুরো পুরুলিয়াতে কি তোর দাদুরবাড়ি নাকি? কত গ্ৰাম আছে তোর জানা আছে?"
একটু থমকে গেলেও হার মানার মেয়ে নয় দুষ্টু তাই বলেছিলো.." লাল মাটি আর পলাশ তো জানি,আর কি জানবো।সব জানি আমি,তুমি নামটা বলো দাদু সব চেনে।"
রায়বাবু তখন অমন করে বলাতে বারবারই আজ দুষ্টুর কথা মনে হচ্ছে।তাহলে কি একটা ফোন করবে দুষ্টুকে? ফোনটা হাতে নিয়েও আবার পকেটে রাখে দীপ্ত। দুষ্টু নিশ্চয় আইএএস অফিসার হবে মানে সবটাই তো ক্লিয়ার হবার পথে আর ও যেমনি হোক দুষ্টুর কাছাকাছি এখনো পৌঁছাতে পারেনি তাই কি করে বলবে। হঠাৎই স্যারের কথা মনে হতেই দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে দীপ্ত... স্যার ওকে নিজের সন্তানের মতই গড়েপিটে মানুষ করেছেন। তবুও উনি নিশ্চয় দুষ্টুর জন্য ভালো কাউকে চাইবেন।
অবশ্য উত্তীয়ও তো ওনার ছাত্রই ছিলো,মিষ্টিকে যদি উনি ওর হাতে দিতে পারেন তাহলে?
হঠাৎই অনেকগুলো না না না কোথা থেকে এসে গলা চেপে ধরে। উত্তীয়রা বড়লোক,স্যারের আত্মীয় তাছাড়া মিষ্টি ওকে ভালোবাসে।
কিন্তু দুষ্টু কি ওকে? অনেকগুলো প্রশ্ন এসে ভিড় করে মনে হয়ত নিজের যোগ্যতার মাপকাঠি নিজেই বিচার করে নিজের মত।
পড়ন্ত বেলার সূর্য আলো মাখামাখি করে পাহাড়ের কোলে সবুজ পাহাড় রাঙা হয় সূর্যের আলোতে। লেকের জলে ছড়িয়ে পড়ে সূর্যের রঙ।
হাঁটাপথ ধরে পা বাড়ায় দীপ্ত বাড়ির দিকে।
******************
রবীনের অনেক দায়িত্বের মধ্যে আরেকটা আছে পুরুলিয়াতে সব জানানো মানে নেমন্তন্ন করা।যদিও ওরা সবটা শুনেছে ফোনে।তবে একবার যাওয়া উচিত সেখানে ভাবে রবীন অথচ এত চারিদিকে কাজের চাপ যে কিছু ভাবতে পারেনা হঠাৎই।
এদিকে মিষ্টি যেতে বলছে কলকাতাতে..." বাবা তুমি আর বোন এসো,নাহলে বোনকে পাঠাও।আমি এত কিছু একা করতে পারছিনা।"
দুষ্টুকে বলতেই ও রাজি এক পায়ে," বাবা চলো ঘুরে আসি আমরা দুজনে। দিদির কি কি দরকার সব গুছিয়ে দিই।আমি তো এখন ফ্রী আছি এত চিন্তার কি আছে?"
দুষ্টু বললেও রবীন সুবিধা করতে পারলোনা শেষে অনুকেই দুষ্টুকে নিয়ে যেতে হলো। মিষ্টিকে কেনাকাটা করতে সাহায্য করা মানে ওসব মেয়েলি ব্যাপার ওরাই ভালো পারবে।কারণ স্কুলটাও তো দেখতে হবে।
রবীন এতদিন ওর সবটা দিয়ে স্কুলকে দেখে এসেছে,অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে ঐ অঞ্চলের সেরা স্কুল ওদের স্কুল তাই চেতনায় মননে আর স্বপ্নে জড়িয়ে স্কুলটা।সবসময় মনের মধ্যে ঘোরে কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে স্কুলকে আরো।
মা আর মেয়েকে মিষ্টিকে সাহায্য করার পাশাপাশি আরেকটা দায়িত্ব দিয়ে পাঠালো রবীন.." শোনো তোমাদের আসতে কয়েকটা দিন দেরি হয় হোক এই কাজটা করেই এসো বুঝলে।যদিও আমারই কাজটা তবুও আমার হয়ে তোমরাই.."
বাবার কথা শুনে হৈ হৈ করে ওঠে দুষ্টু।
অনেকদিন বাদে আবার অনুর বাইরে বেরোনো,খাঁচাবন্দি জীবন থেকে মুক্তির কিছুটা আনন্দ তবুও ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভাঙে তাই অনুও মিষ্টির ওখানে গিয়ে হাল ধরলো...সত্যি মেয়েটার খুব খাটনি সারাদিন অফিস করা তারপর এসে রান্না একটু বিশ্রাম পাক মেয়েটা।মায়ের আদর চেটেপুটে নিলো মিষ্টি।দুষ্টু বললো..." ছেড়ে দিলাম, যতখুশি আদর খেয়ে নে এরপর মা শুধু আমার।"
মিষ্টি হাত নাড়ায়," কচু,কোথায় যাবি চাকরি নিয়ে ঠিক নেই।মাকে কোথায় পাবি তখন?"
" কেন সাথে করে নিয়ে যাবো।"
অনেক দিন বাদে দুইমেয়ের খুনশুটিতে মনটা ভরে ওঠে অনুর। তারমধ্যেই চলে কেটাকাটা,জোজোর পছন্দমত কিছু জিনিসও কেনা হয় ওকে নিয়ে..অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে থাকে জোজো। " আমি কিছু জানিনা,তোরা দুইবোন যা পারিস কর।"
দোকানের ভদ্রলোকও একটু ঘাবড়ে যায়,সব তুই তোকারি করছে কেজানে কোনটা বৌ? নাকি কোনটাই নয়,এরা বোধহয় বোন।
বাড়িতে এসে এই নিয়ে একচোট হাসাহাসি হয়।
মিষ্টি বলে.." উফ্ দোকানের ভদ্রলোকের অবস্থা দেখে খুব খারাপ লাগছিলো, একবার তোকে দেখছে বোন একবার আমাকে।ভাবতে পারছেনা মানে একদম কনফিউসড।"
অনেক কনফিউসন,হাসাহাসি আর হৈ চৈ করে কলকাতার কাজ সারা হলো প্রায়।
জোজো দুষ্টুকে বলে," কি বাইকার লাদাক যাওয়া হবে কবে? তোর একটা গিফ্ট কিন্তু রয়ে গেছে আমার কাছে।মানে তুই বললেই হবে।"
" তোমার কাছে রাখো বৎস বর খানা,সময়ে চাহিয়া লইবো। এত অধৈর্য্য হইয়োনা।"
নিজের সাফল্য আর সময়ের জাদুকাঠির ছোঁয়ায় দুষ্টুর মনের অনেক ক্ষতই আজ প্রলেপ পেয়ে ভরাট আর শান্ত।তাই সম্পর্কে কোন জটিলতা নেই।হয়ত দুষ্টুর মত মেয়েরা সব পারে।
**************
দুষ্টু যে সব পারে তা একদম বুঝলো দীপ্ত। অফিসের কাজে তখন বেশ ব্যস্ত,বাইরে বেশ রোদ উঠেছে। বেলা প্রায় বারোটা ডিঙ্গিয়ে একটার দিকে হঠাৎই কানাই এসে বলে," স্যার আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে। মানে আপনার নাম বলছে।"
" এখন আমি খুব ব্যস্ত,একটু অপেক্ষা করতে বলো।পরে দেখা করছি,এভাবে অফিসে কারা আসে যখন তখন..."
দীপ্ত কথা শেষ করার আগেই রায়বাবু এসে বলেন," স্যার আমি দেখেছি কানাই ঠিকমত বলতে পারছেনা। একটা মেয়ে মনে হলো,বেশ লম্বা আর মাথায় ছোট চুল। একদম বাইক চালিয়ে এসেছে।"
নিজের অবাধ্য পা দুটো আর চেয়ারে বসে থাকতে চায়না তাই উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে হঠাৎই.. তারপর মনে হয় কাজটা ঠিক হবেনা তাই কানাইকে বলে," ওনাকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও। রায়বাবু আপনি এখন আসুন দরকার হলে আমি ডেকে নেবো।"
ইচ্ছে না থাকলেও পা বাড়ান রায়বাবু, কিছু করার নেই।
নিজেকে একটু গুছিয়ে নিতে চায় দীপ্ত কিন্তু তার আগেই দুষ্টু ঢুকে পড়ে সাথে একটা ছেলে,একটু ছেলেমানুষ মনে হচ্ছে ভাই।
"বলেছিলাম না পুরুলিয়া আমার সব চেনা। আরে দুষ্টু সব পারে,দাদুর কাছ থেকে জেনে নিলাম সবটা তারপর গুগল অন করে চলে এলাম ভাইকে নিয়ে মামার বাইক নিয়ে। অবশ্য গুগল মাঝে মধ্যেই ভুলভাল রাস্তা দেখিয়েছে।"
একনাগাড়ে কথা বলে চুপ করলো দুষ্টু, দীপ্ত অবাক হয়ে যায় ওকে দেখে। দুষ্টুর সাথে চোখাচোখি হতেই চোখটা নামিয়ে ফেলে। ওর স্বভাবজাত লাজুক হাসিটা হেসে বলে..." আমি জানি তো দুষ্টু সব পারে। কনগ্ৰ্যাচুলেশন উড বি আইএএস। আমি হার মানলাম।"
দীপ্তর কথায় একটু লজ্জা পায় দুষ্টু, এতক্ষণ রোদে বাইক চালিয়ে এসে ওর গালে রাঙা বসন্তের ছোঁয়া,বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে কপালে।
দীপ্তর অবাধ্য চোখদুটো আবার আটকে যায় দুষ্টুর লাজুক মুখে।সেই সেবার কলকাতার দেখা দুষ্টু আজ অনেক পরিণত আর উন্নত।
মাঝে কানাই এসে চা দিয়ে গেছে রায়বাবু আরেকবার এলেন কাজের অজুহাতে।এবার ইচ্ছে করেই আলাপ করিয়ে দেয় দীপ্ত.." আমার স্যারের মেয়ে,ভবিষ্যতের আইএএস অফিসার।"
দীপ্তর কথা শুনে রায়বাবু অবাক হয়ে যান..দীপ্ত যেতে বললেও বারবার চোখ আটকে যায় দুষ্টুর দিকে মনে মনে ভাবেন বাপরে এতো আরেক রত্ন মানে রতনে রতন চিনেছে।
দুষ্টু পিঠের ব্যাগটা খুলে বেশ কিছু সাজেশন আর নোট দীপ্তকে দেয়।অবাক হয়ে যায় দীপ্ত.." এগুলো কেন?"
" তোমার জন্য,আমি এনেছি কলেজস্ট্রীটে ঘুরে ঘুরে।আর কিছু বলবে? আমি জানি তুমি পড়াশোনা করছো এগুলো তোমার কাজে লাগবে।"
অনেক কথা দীপ্তর বলতে ইচ্ছে করছিলো কিন্তূ কোথায় গিয়ে যেন সব আটকে গেলো।শুধু বললো," আমার কি হবে?"
" নিশ্চয় হবে,শুধু ভরসা রেখো আত্মবিশ্বাস হারিয়োনা। বইগুলো ভালো তোমার কাজে লাগবে।"
" আমার কোয়ার্টারে যাবিনা?"
" অফিস ফেলে এভাবে যেয়োনা,ঠিক হবেনা।আসলে মামাবাড়ি থেকে বেরোতেই পারছিনা।কেউ ছাড়ছেনা।আজ প্রায় ভাইকে নিয়ে পালিয়ে এসেছি। ওহ্ তোমাকে তো বলাই হয়নি যদিও তুমি জানো।"
" কি জানি?"
" আরে দিদির বিয়ে তো,অবশ্য ওরা তোমাকে ইনভাইট করবে। তোমার বন্ধুর বিয়ে,তুমি আসবে তো কালচিনিতে?"
" দেখি যদি ছুটি পাই নিশ্চয় চেষ্টা করবো।"
দুষ্টুর গলায় দাবীর সুর বেজে ওঠে.." চেষ্টা নয় তুমি আসবে। আর তুমি কিন্তু কনেপক্ষ,আমাদের বাড়ির দিকের লোক মনে থাকে যেন।যদিও জোজোদা তোমাকে দলে টানবে তবে যদি ওদের দলে যাও ভালো হবেনা।"
কি সাবলীল ভাবে বিয়ের কথাগুলো বলে যাচ্ছে দুষ্টু অথচ এই মেয়েটাই একদিন জোজোকে চিঠি দিয়েছিলো প্রথম কিশোরীবেলার প্রেম জানিয়ে।মাঝে মাঝে নিজেকে অপরাধী লাগে মনের আয়নায় দেখে। ও যদি সেদিন চিঠিটা জোজোকে দিতো তাহলে হয়ত দুষ্টুর ইচ্ছে পূরণ হত। কেন যে দিতে পারেনি তার জবাব খুঁজে পায়না এখনো।
যেমন এসেছিলো তেমনি ঝড়ের মতই রাস্তার লালমাটি আর দীপ্তর মনকে এলোমেলো করে চলে গেলো দুষ্টু। শুধু টেবিলে পড়ে রইলো ওর আনা বইগুলো।
রাত অনেকটা হয়েছে,বইগুলোতে চোখ রাখতে রাখতে বারবারই দীপ্তর সামনে ভেসে ওঠে একটা মুখ যাকে দার্জিলিংয়ে দেখে চিনতে পারেনি প্রথমে তারপর সে নিজেই চিনিয়ে দিয়েছে কারণে অকারণে প্রকাশ্যে নির্জনে। দুষ্টুকে নিয়ে ঘুরে দেখতে ইচ্ছে করে মহুয়ার নেশায় আর পলাশের রঙে মেশা পুরুলিয়াকে আবার।বড়ন্তির লেকের ধারে বসে দেখতে ইচ্ছে করে বিদায়ী সূর্যের রঙ অথবা গড়পঞ্চকোটে খুঁজতে ইচ্ছে করে সবুজে লুকোনো গেরুয়া গড়ের শোভা।
তবুও দীপ্তর সংকোচ আর আত্মসচেতনতা নিজেকে খুলতে দেয়না দুষ্টুর কাছে। রাতজাগা পাখিদের সাথে রাতজাগে দীপ্ত পাশে গানটা বেজে যায় আপন খেয়ালে....
আমার একলা আকাশ
থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে,
শুধু তোমায় ভালবেসে।
আমার দিনগুলো সব
রঙ চিনেছে তোমার কাছে এসে,
শুধু তোমায় ভালবেসে।
**********************
মাঝে কেটে গেছে দুটো মাস,দুষ্টু অনেকটা এগিয়েছে অভীষ্টের দিকে তবে সরকারী চাকরীতে
বোধহয় অনেক কিছুই দরকারি তাই মিটছেনা সব কিছু।খুচখাচ ঝামেলায় হচ্ছে দেরি,মাঝে এসে গেলো ভোট তার ফলে আরেকটু পিছোলো।
মাঝে মাঝে আজকাল বিরক্ত হয়ে যায় দুষ্টু.." আচ্ছা বাবা এই ঝামেলা কি মিটবেনা বলতো? একটার পর একটা কিছু এসে পিছিয়ে যাচ্ছে।"
রবীন বোঝায়," এতো ভাবছিস কেন? ভালো কাজে একটু সময় লাগে।হবে সব ঠিকমত। আর তো কোন চাপ নেই তোর এবার ওদের এগোতে দে।এখানে আমাদের তো কিছু করার নেই।"
দেখতে দেখতে কেটে গেছে আরো কয়েকটা দিন দুষ্টু একটু বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে দিদির আশীর্বাদ আছে সামনে।বাবার হয়ে অনেক কাজ ওকেই করতে হয়।
মিষ্টি আর জোজো অল্প কয়েকটা দিনের ছুটি নিয়ে এসেছে।সব মিলে দিন সাতেক থেকে চলে যাবে তারপর আবার বিয়ের সময় আসবে। অনুর আর ওদিকে মধুমিতার ব্যস্ততাও আছে কিছুটা।
" বিয়ের দিন আশীর্বাদ হলেই ভালো হত।" একটু গজগজ করে অনু।
রবীন আর দুষ্টু অনুকে বোঝায় মিষ্টিকে কিছু না বলতে।
এরমধ্যে হঠাৎই দুষ্টুকে কলকাতা যেতে হলো,কিছু করার নেই।যদিও মিষ্টি খুব অভিমান করলো তবুও দুষ্টু বললো দিদি তোর আশীর্বাদ যেদিন সেদিন ফিরবো কথা দিলাম।আর বাবা তো ফ্লাইটে ব্যবস্থা করে দিয়েছে ভাবিসনা।
****************
হাতে গোণা দুতিনটে দিন এরমধ্যে ঘরদোর পরিস্কারের কাজে লাগে অনু।লোকজন আসবে,দুষ্টুর মিষ্টির কত বইপত্রে পুরো ঘর ভর্তি।অবশ্য দুষ্টু কিছু কাগজপত্র আর বই আলাদা করে রেখে গেছে।তবুও হাত না লাগালে চলেনা। বাইরে কাগজওয়ালা বসে তার কাছে অনেককিছু দিয়ে দিয়েছে অনু।
" মা আমি হাত লাগাই তোমার সাথে?"মিষ্টি বলে।
" না তুমি আর পরিশ্রম করিসনা,যা চোখমুখ করেছিস।আমি সব গুছিয়ে রেখেছি ওকে দেবো নিয়ে যাবে।"
মিষ্টি এসে বাইরে দাঁড়ায়, কাগজওয়ালা ওজন করতে ব্যস্ত হঠাৎই একটা লাল ডাইরির দিকে নজর পড়ে মিষ্টির "দেখি দেখি একমিনিট"
বিরক্ত হয় অনু," উঃ মিষ্টি কি দেখবি ঐ নোংরা কাগজের মধ্যে? ওকে তাড়াতাড়ি বিদায় করতে দে আমাকে।"
" মা দাঁড়াওনা,আমাকে দেখতে দাও। এই ভাই ঐ খাতাটা আমাকে দাও তো।"
লোকটা ওজন করা থামিয়ে ধুলো ঝেড়ে খাতাটা মিষ্টির দিকে এগিয়ে দিতে যায়। অবাক হয় অনু " উঃ এই পুরোনো খাতায় আছেটা কি? যতসব।"
" মা এটা বোনের ডাইরি,তোমার মনে নেই লুকিয়ে রাখতো।একটা সময় কত খুঁজেছি পাইনি।"
" আচ্ছা সেই পুরোনো ডাইরি এখন কি হবে? দুষ্টু ভুলে গেছে সেই ডাইরির কথা তাই তো কাগজের বস্তাতে ছিলো।দে দে ওটা।"
মিষ্টি ডাইরিটা মাকে দেয়না,শুধু বলে " ওটা একসময় ওর প্রাণ ছিলো মা। ও আসুক যদি ফেলে দেয় দেবে এখন থাক ঘরে।
মিষ্টি ডাইরিটা নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে মনের মধ্যে একটা অদম্য ইচ্ছে হয় ডাইরিটা পড়ার কিন্তু এখন হবেনা মা খারাপ ভাববে।ভাবে থাক বালিশের তলায় রাতে পড়বে।
অনু কাগজওয়ালাকে তাড়া দেয়.." তাড়াতাড়ি করো,আমার অনেক কাজ বাকি। মিষ্টি ঘর থেকে বাইরে আসে আবার। যাক মায়ের তাড়ায় কাগজগুলো নিয়ে লোকটা গেছে অনু ভেতরে যায়।হঠাৎই মিষ্টির কানে আসে একটা পরিচিত হর্ন...এই রে এখন আবার কেন? কে জানে আর কে কে আসছে? হাজার হোক ওর হবু শ্বশুরবাড়ি এখন তাই একটু অস্বস্তি হয় মিষ্টির।তবে যখন দেখলো গাড়ি থেকে শুধু ড্রাইভার নামলো তখন নিশ্চিন্ত হলো।
" তুই আবার এলি কেন?"
" এবার তুমি বলা অভ্যেস কর,আমি তোর হবু বর।এখন এসেছি শ্বশুরবাড়িতে।"
মুখ ভ্যাঙচায় মিষ্টি.." ওসব এখন আসবেনা,এই তো সেদিন একসাথে এলাম দুজনে তারমধ্যেই আবার কি হলো?"
" ঢুকতে দিবি না শুধু প্রশ্নের বাণ মারবি?"
ওদের কথার মাঝেই অনু আবার বাইরে আসে.." ইশ্ সত্যিই আমার মেয়েদুটো একদম ডাকাত।এইভাবে ছেলেটাকে বাইরে রেখে হাজার জেরা করছে! এসো এসো ভেতরে।"
অনুকে দেখে জোজো হাঁফ ছেড়ে বাঁচে," ওহ্ কাকিমা, ভাগ্যিস তুমি এলে।তোমাদের বাড়ির দ্বিতীয় অফিসার কোথায়? তাকে তো দেখছিনা?"
" মা দেখেছো তো? এসেই দুষ্টুর খোঁজ করছে।সবাইকে চাই ওর।"
" আমার কাউকে চাইনা উঃ কি জ্বালা। নে মা কিসের সব মাপ দেখতে বলেছে একবার পরে।সেগুলো দেখে আমাকে উদ্ধার কর। আমি এক্ষুণি চলে যাবো।"
অনু এবার মিষ্টিকে বকে.." যা ওকে নিয়ে ঘরে বসা।পাশের বাড়ির কাকিমা হাসছে ঐ দ্যাখ তোদের কান্ড দেখে। আর পারিনা।"
জোজো মিষ্টির দিকে ব্যাগটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে," তুই ভেতরে যা আমি আসছি,অনেকদিনের ফেলে আসা পুরোনো জায়গা তো মনে কত স্মৃতি ভিড় করে আসছে। আমি একটু হস্টেলের ওদিকটা ঘুরে আসছি।"
সত্যিই তো জোজো যখন প্রথম ওদের বাড়ি আসে।তখন ওরা কতটুকু, কখনো ভাবেইনি এভাবে কোনদিন ওদের বিয়ে হবে।
মিষ্টি ব্যাগটা নিয়ে ভেতরে যায়...জোজো পা বাড়ায় পুরোনো ঠিকানার দিকে খুঁজে নিতে ফেলে আসা অতীতকে।
ব্যাগ খুলে মাথায় হাত দেয় মিষ্টি.." এত ব্লাউজ! আবার কুর্তা? সব এখন পরে দেখতে হবে।উঃ! সত্যিই জোজোটা চালাক,জানে এইসব করতে অনেকটা সময় যাবে তাই চলে গেলো অতীত খুঁজতে। আর কি ওকে এখন আগত ভবিষ্যতে মানে বিয়ের সমুদ্রতে হাবুডুবু খেতে হবে।
যথারীতি মাকে ডাক দেয় মিষ্টি..." মা একটু হেল্প করবে।কি করছো তুমি? একটু এসোনা।"
শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে আসে অনু...মিষ্টি বলে ওঠে," তোমাকে এখনো কি সুন্দর দেখতে মা!"
ওকে পাত্তা না দিয়ে অনু বলে," কি করতে হবে বল? ওসব শোনার সময় এখন নেই। জোজোর জন্য একটু মাছ করছি আবার। আমাদের খাবার দিয়ে খেতে দেওয়া যায় নাকি?"
" এতো ভালো একটা কথা বললাম, শুনলেনা তো? ও কে,যে ওর জন্য এত কিছু রাঁধতে হবে?"
অনু ওকে বকা দিয়ে দুষ্টুর ব্লাউজ দেখার কাজে লেগে পরে।
" মা একটু পেছনটা টানো,উঃ কত যে ডিজাইনার ব্লাউজ হয়েছে আজকাল!"
" খুব মানিয়েছে তোকে মিষ্টি,সত্যিই ভাগ্য করে শ্বশুরবাড়ি পাচ্ছিস।এমন শাশুড়িমা কটা হয়?"
" কেন মা আমি কি ফেলনা নাকি? ওরাও ভাগ্য করে বৌ পেয়েছে। ভাগ্য করে সবসময় বর পেতে হবে কেন,ভাগ্য করে বৌ ও পেতে হয়।"
" ওহ্ কিছু কথা জানে আমার মেয়েদুটো।"
" তোমার গর্ব হয়না আমাদের জন্য।সব সময় ভাবো কেন তোমার ছেলে নেই।আমরাই বা কম কিসে? এই তো কিছুদিন বাদেই হয়ত লালবাতির আলো জ্বালিয়ে আসবে তোমার ছোট কন্যাটি।"
ওদের কথার মাঝেই পরিচিত গাড়ির আওয়াজ কানে আসে মিষ্টির।
অনু ব্যস্ত হয়ে বাইরে আসে। জোজোর পছন্দের মিস্টি পাঠিয়ে দিয়েছে এরমধ্যেই রবীন।
মিষ্টি কাজ সেরে বাইরে আসে। জোজোর মিষ্টিকে দেখে আবার প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করে।মিষ্টির গায়ে হলুদ সবুজের ছোঁয়া,সবুজ লাল কুর্তার সাথে লাল ওড়না নিয়েছে মিষ্টি।জোজোর খুব মিষ্টিকে নিয়ে একদম ওর পঙ্খীরাজে উড়ে যেতে চাবাগানের ঐ সবুজের মাঝে। কিন্তু এখন বলার উপায় নেই বুঝতে পারে কাকিমা না খাইয়ে ছাড়বেনা ওকে।
টেবিলে সাজানো জামাই আদরের উপকরণ।অনু নিজে যতটা পেরেছে সব সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়েছে।
" এতো কিছু! তোমাদের যা রান্না হয়েছে তা দিলেই তো পারতে। ঐ জন্যই মা বলছিলো খেয়ে যেতে।"
" খাও খাও,সবে তো কলির সন্ধ্যে।জামাই হলে মা তো চিনতেই পারবেনা আমাদের। তবে আমি কিন্তু ভাগ নিয়েই ছাড়বো। দুষ্টু থাকলে আজ খুব ভালো হত।"
মুচমুচে আলুভাজায় মন দিয়েছে জোজো,বলে ওঠে.." সত্যিই তো,দুষ্টুর খোঁজ প্রথমেই করেছি এসে।যা বকা দিলি।কোথায় গেলো রে সে?"
" আর বলিসনা,হঠাৎ কলকাতা গেলো।"
" হোয়াট! মানে সেদিন থাকবেনা?"
" থাকুক না থাকুক তোর কি রে? তুই তো সেদিন আসবিনা।"
" আমি আসবোনা! খাওয়াটা মিস্ করবো?"
" না মশাই পেটুক রাজা,সব পাঠিয়ে দেবো বাক্সবন্দী করে।"
*******************
জোজোর সাথে কথায় আড্ডায় আর খুনশুটিতে অনেকটা সময় কেটে গেছে তারমধ্যেই যাওয়ার আগে বেচারা এমন করুণ করে বললো.."সব সময় তো বন্ধু বলে দাবিয়ে রাখলি,প্রেমটা চুটিয়ে হলো কই। আজ একটু ঘুরে আসি স্বপ্নের জায়গাগুলো তোর সাথে।"
সবুজের মাঝে আর নদীর পাশে মন হারালো মিষ্টি। অনেকটা হাসি আর গল্পে ভরা একটা বিকেল ঝুলিতে ভরে নিয়ে রবীনের সাথে দেখা করে একদম মনের অক্সিজেন সিলিন্ডার ভর্তি করে জোজো ফিরে এলো বাড়িতে।
রাতে খাওয়াদাওয়া শেষ করে বালিশে মাথা রাখে মিষ্টি।সত্যিই আজ একটা দিন গেলো,ওহ্ ছেলেটা কিছু পারে বটে! মনের মধ্যে আজ একরাশ খুশি আর সবুজের আনাগোনা।
হঠাৎই মনে হয় সেই লাল মলাটের মোড়কে বাঁধানো দুষ্টুর গুপ্ত সম্পত্তির কথা।
নিজের মনকে বারবার জিজ্ঞেস করে না জবাবই পায় মিষ্টি।তবুও কেন যেন ঘুম আসতে চায়না ভাবে একটা দুটো পাতা পড়েই রেখে দেবে।
ঘরের দরজাটা বন্ধ করে মিষ্টি,মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা শিহরণ হতে থাকে।ঠিক যেন মনে হয় একটা নিষিদ্ধ কিছুতে হাত দিতে চলেছে। উফ্ কতদিন বোনকে দেখেছে ও ঘুমিয়ে গেলে চুপচাপ লিখতে বসতে।আর কোথায় যে লুকিয়ে রাখতো কখনো খুঁজে পায়নি। অবশ্য একটা সময়ের পর দুষ্টু এতটাই পড়াশোনা করতো যে আর কোনো দিকে মেয়েটা তাকায়নি।
ঘরের টেবিল লাম্পটা জ্বালায় মিষ্টি। জোজো আসাতে,ওটাকে তোশকের তলায় রেখে দিয়েছিলো।
তোশকটা তোলে মিষ্টি,কিন্তু কোথায় ডায়েরি?কিছু তো নেই! তাহলে কি অন্য পাশে রেখেছে? বারবার উল্টেপাল্টে দেখে বিছানাটা কিন্তু নাহ্ নেই কোথাও নেই। অদ্ভুত লাগে মিষ্টির,ভুতুড়ে ব্যাপার চলছে নাকি বাড়িতে? জলজ্যান্ত জিনিসটা হাওয়া হয়ে গেলো? বাড়িতে তো কেউ ছিলোনা।মা ব্যস্ত ছিলো ওদিকে রান্নাঘরে।তবে জোজো অনেকক্ষণ এইঘরে বসেছিলো তবে কি ও নিয়ে গেলো?
অস্থির লাগে মিষ্টির কি জানি দুষ্টু কি লিখতো ওতে? শেষপর্যন্ত ওর বোকামিতে বোনের ডায়েরিটা জোজোর হাতে পড়লো?
হঠাৎই জোজোর ওপর রাগ হলো খুব।তারপর মনে হলো আগে মাকে জিজ্ঞেস করবে।মা কি বলে শুনবে।হয়ত মা রেখেছে ওটা সরিয়ে। শুধু শুধু জোজোকে এমন ভাবাটা একদম ঠিক নয়।
হয়তোর চিন্তা মাথাতে নিয়ে রাতে ঘুমোতে গেলো মিষ্টি।
**********************
অনুর আজ ঘুম আসেনা,রবীন অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে গেছে।সারাদিন অনেক কাজ করে আসে তাই বিছানায় শুয়ে একদম ঘুমের দেশে চলে যায়।
দরজাটা বন্ধ করে অনু,ঘরের কোণের দিকে রবীনের কাজের টেবিলের আলোটা জ্বালায়।
মিষ্টি দুষ্টুর ডায়েরি নিয়ে ছোটবেলায় অনেক নালিশ করেছে।ঝগড়াও হয়েছে দুজনের এই নিয়ে কখনো উত্তেজিত হয়েছে অনুও ভেবেছে ছিঁড়ে ফেলবে ঐ ডায়েরি। কিন্তু কেউ নাগাল পায়নি,অথচ আজ সেই মনের কথা বুকে বেঁধে নিয়ে ডায়েরির ঠাঁই হয়েছে পুরোনো কাগজের বস্তায়।তবুও আজ মিষ্টি কৌতূহলী সেই রঙচটা লাল মলাটের খাতাখানা নিয়ে। অত বড় মেয়ের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া যায়না ওটা তবুও ভালো লাগেনি একদম অনুর।
হয়ত ভগবান সেইজন্য সুযোগ করে দিয়েছিলেন ওকে।হঠাৎই জোজো এসে পড়ায় মিষ্টির ঘরের বিছানাটা ঠিক করতে যায় অনু হঠাৎই একটা জায়গা উঁচু দেখে ঠিক করতে গিয়ে চোখে পড়ে আবার ডায়েরিটা। অনু ভালোমন্দ কিছুই আর চিন্তা না করে ওটা সরিয়ে নেয় ওখান থেকে।
কেজানে কি লিখেছে মেয়েটা ওতে? এখন আর কোন সমস্যা হোক কিছুতেই চায়না অনু কারণ সামনেই আশীর্বাদ। দুইবোনের এখন খুব মিল,দুষ্টুর মিষ্টির দুজনের নতুন জীবন শুরু হতে চলেছে এরমধ্যে হঠাৎই এলো ঐ হতচ্ছাড়া ডায়েরি।আর মিষ্টির এত আদিখ্যেতা কেন কে জানে? একদম হামলে পড়ে নিলো ওটা।
**********************
মিষ্টির কাছ থেকে ডায়েরিটা নিয়ে ওটা পুড়িয়ে ফেলবে ভেবেছিলো অনু,কিন্তু সারাদিন সুযোগই হলোনা। কাল ভোরে উঠেই পুড়িয়ে ফেলবে ওটা তবুও এক অমোঘ আকর্ষণে ডায়েরির পাতা খোলে অনু।কিছু কিছু অযত্নে পোকা কেটেছে তবুও তারমধ্যে লুকোনো এক কিশোরী মনের আপপৌরে চাওয়া পাওয়ার গল্প।
অনুর ওকে অবহেলা করার গল্প,মিষ্টির ওর পছন্দের জামা নিয়ে নেওয়ার গল্প। আর অনেক ব্যাপারেই মায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ.." ও বড়,ওকে দিয়ে দে দুষ্টু।বড়দিদির কথা শুনতে হয়।"
দুষ্টুর কান্না কখনো মিশেছে লেখায়," ও বড় বলে পুরো চকলেট খেয়ে গেলো।ও বড় বলে ওর ইচ্ছেটা সবসময় তোমরা মানবে। কেন? ছোট হওয়াটা কি অপরাধ? তবে আমায় কেন আগে জন্ম দাওনি মা।"
কখনো আহত হয়েছে গায়ের রঙের তুলনায়,কখনো বা পড়াশোনার তুলনায়....চোখদুটো আজ বড় ঝাপসা অনুর।সত্যিই ভীষণ অন্যায় করেছে ডায়েরিটা পড়ে।যে কথা ও কোনদিন কাউকে বলেনি,তা থাকতো সাদা কাগজের এককোণে নিজের মত।হঠাৎ কেন আবিষ্কার করতে গেলো তাকে?
আর পড়বেনা ঠিক করে অনু।রবীন যে কোন সময় উঠে যেতে পারে।আজকেই এটাকে ছিঁড়ে সকালে পুড়িয়ে দেবে।কিন্তু মাঝখানটা না পড়লেও ছিঁড়তে গিয়ে শেষটা চোখে আটকে যায় অনুর। কাগজের একটা ছোট ডায়েরির প্রতিটা পাতা সেজেছে অনুরাগের রঙে আর কল্পনায়।
দুষ্টু ভালোবাসতো জোজোকে? অবাক হয়ে যায় অনু? তাহলে কি করে সামলাতে পারলো দুষ্টু নিজেকে? শেষ পাতাটা দেখতেই হবে।
হঠাৎই রবীনের গম্ভীর আওয়াজ কানে যায় অনুর....কখন যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারেনি। রবীনকে এতোটা রেগে যেতে কখনো দেখেনি অনু।
" বিয়ের পর থেকে তোমাকে বিশেষ পড়াশোনা করতে কখনো দেখিনি। সংসারটাকে তুমি ভালোবাসো আর সেটাই ধ্যান জ্ঞান দিয়ে করেছো। হয়ত তোমার জন্য আমাদের মেয়েরা ভালো মানুষ হয়েছে। তবে তুমি এটা কি করছো অনু? আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে এখানে তুমি পুরো ডুবে রয়েছো। এটা তো দুষ্টুর লেখা...মনে হচ্ছে ডায়েরি।"
অনু কেঁদে ফেলে এবার.." আমি এটা মিষ্টির কাছ থেকে নিয়ে ভেবেছিলাম পুড়িয়ে দেবো কিন্তু পারিনি। এখন ভাবছি কি করলাম! তবে এটা না পড়লে হয়ত মেয়েটার এত কষ্ট জানতেই পারতাম না।"
রবীন হাতে তুলে নেয় ডায়েরিটা... শেষ পাতাটা খোলা,তারিখে চোখ পড়ে রবীনের।অনেকগুলো বছর কেটে গেছে তারপর।
পাতাটাতে লেখা," আমার জামা,খেলনা,পুতুল সব তোর পছন্দ ছিলো নিয়েছিস।আজ আমার ভালোবাসা তোকে দিয়ে দিলাম...খুব কেঁদেছি আমি দিদি তবুও সহ্য করে নিলাম। আজ অষ্টমীর অঞ্জলিতে মা দুর্গার কাছে শক্তি চেয়ে নিলাম। আমি যেন জীবনযুদ্ধে এগিয়ে যেতে পারি সব কিছু জয় করে।"
তারপর সব ফাঁকা,আর কিছু লেখেনি দুষ্টু।
********************
পরদিন বেশ বেলাতে ঘুম ভেঙেছে মিষ্টির,উঠে বাথরুমের দিকে যেতে গিয়ে মাকে দেখে রান্নাঘরে। প্রতিদিন সকালে মাকে এখানেই দেখে।হঠাৎই মনে হলো মাকে জিজ্ঞেস করবে ডায়েরির কথা? তারপর ভাবলো একটু বাদে করবে।
অনু চা করে ডাকে মিষ্টিকে..বাবাকে দেখেনা চায়ের টেবিলে মিষ্টি।
" মা বাবা কোথায় দেখছিনা তো? বাজারে গেছে?"
" তোর বাবা হঠাৎই ভোরে শিলিগুড়ি গেলো, কিছু অফিসের কাজ এসে গেছে।ওখানে না হলে কলকাতা যেতে হবে।"
মিষ্টির একটু রাগ হয়ে যায়, " কেজানে আমার আশীর্বাদ হবে কিনা সেদিন? আমি এখানে এসে বসে আছি আর প্রথমে দুষ্টু গেলো কলকাতা এখন বাবাও?"
মনটা ভীষণ অশান্ত অনুরও,রবীনের রাগ এবং জেদ দুটোই ও জানে। রবীন বলে গেছে.." আমি দুষ্টুর সাথে কথা বলবো, ও কি বলে শুনবো।দুষ্টুর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া ভালোবাসাতে মিষ্টির বিয়ে হতে পারেনা।দরকারে এই বিয়ে হবেনা,তুমি আমাকে দাও ডায়েরিটা।"
অনুর নিজের বোকামির জন্য গালে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করছিলো,কেন যে এতদিন বাদে অতীত সামনে এলো? কেজানে ভগবানের কি ইচ্ছে? তবে জোজো তো মিষ্টিকে ভালোবাসে। রবীনকে বলেছিলো ফোনে কথা বলতে,শোনেনি রবীন.." সব কথা ফোনে হয়না বুঝলে। আমাকেই যেতে হবে। কালই ফিরবো আমি।"
মনের ঝড় মনে চেপে মিষ্টিকে বলে," ওরা দুজনেই চলে আসবে ভাবিসনা।"
" মিষ্টি বলে," আচ্ছা মা আমার তোষকের তলা থেকে তুমি কিছু নিয়েছো?"
" কি নেবো আবার?"
" আরে বোনের সেই লাল খাতাটা।"
" হ্যাঁ,তোষকটা উঁচু হয়েছিলো।জোজো আসাতে তাড়াতাড়ি বিছানা গুছোতে দেখি টুপলি হয়ে আছে।তাই নিয়েছি।"
নিঃশ্বাস ফেলে মিষ্টি "বলবে তো আগে? আমি ভাবছি কে নিলো? কোথায় ওটা?"
" জঞ্জালের সাথে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি।"
বাধ্য হয়ে মেয়ের কাছে মিথ্যেটাই বলতে হলো অনুকে।মনে মনে ভাবলো সত্যিই যদি ছিঁড়ে ফেলে দিতে পারতো!"
অবাক হয়ে যায় মিষ্টি মায়ের কান্ড দেখে,শেষে ছিঁড়েই ফেললো!
***************
অনু খুব অন্যায় করেছে দুষ্টুর লুকোনো ডায়েরি পড়ে হয়ত ওটা ছিঁড়ে ফেলে দিলেই হত।তবুও দুষ্টুর মনের কথা জানতে ওটুকু প্রমাণ রাখতেই হবে। সত্যিই যদি দুষ্টু বলে ও জোজোকে ভালোবাসে তাহলে মধুমিতা বৌদিকে ফোন করবে। নিজের মাথাটা গুলিয়ে ওঠে রবীনের। কি জানি কি যে করবে ও? মিষ্টিরই বা কি হবে?
মনে একটা ঘূর্ণিঝড় চাপা দিয়ে কলিংবেলে হাত দেয় রবীন..কিভাবে যে সব কিছু সামলাবে?
দরজা খুলে অবাক হয়ে যায় দুষ্টু," বাবা,তুমি এখন! কেন?"
" ভেতরে আসতে দে আগে,তারপর একটু বিশ্রাম নিই।একটা কাজে হঠাৎই চলে আসতে হলো।"
দুষ্টুর মুখটা কেমন যেন লাগে রবীনের, মনে হচ্ছে ও এসে একটু অসুবিধাতে ফেলেছে মেয়েটাকে। তাই বলে..তোর সব কাজ হয়ে এসেছে তো? তাহলে ফিরবি তো?
"বাবা তুমি ফ্রেশ হও তারপর বলছি। আমি একটা ফোন করে আসছি।"
হঠাৎই আবার বেল বেজে ওঠে।ব্যস্ত হয় রবীন," কে এলো? আমি দেখবো?"
তার আগেই দুষ্টু দরজা খুলে দাঁড়ায়, ঘর থেকে বেরিয়ে আসে রবীনও দেখে একটা খুব পরিচিত মুখ তবে এখন অনেক পরিণত.... দীপ্ত!
********************
রবীনের হঠাৎই খেয়াল হয় দীপ্তর মুখে একটা অদ্ভুত হাসি মাখানো ছিলো কিন্তু রবীনকে দেখে মুখের ভাবটা একটু পাল্টে যায়।ঠিক ছোটবেলায় অপকর্ম করতে গিয়ে ধরা পড়ে যাওয়া একটা মুখের মত।
তবে কেন যেন ওকে দেখে গতকালের ঘূর্ণি ঝড়ের দাপটে বিধ্বস্ত রবীনের বুকটা একটা নতুন ঢেউয়ের দাপটে যেন কিছুটা শান্ত হলো। তপ্ত শরীরে লাগলো বর্ষার ছোঁয়া। কিন্তু দীপ্ত এখানে কেন? ও কি এর আগেও এসেছে মিষ্টির ফ্ল্যাটে? কই মিষ্টি তো কিছু বলেনি কখনো। দুষ্টুই বা হঠাৎ ওকে ডেকেছে কেন? নাকি ও এমনিতেই এসেছে।
চিরকাল অঙ্ক কষিয়ে এসেও রবীনের পরিণত মস্তিষ্ক সব অঙ্ক মুহূর্তে মেলাতে পারেনা। তাই কলম হাতে অপেক্ষা করে সংখ্যাগুলোকে ধরতে আর বুঝতে।
দুষ্টু স্বভাবজাত উচ্ছ্বলতাতে বলে ওঠে," বাবা তোমাকে তো বলাই হয়নি আজ দীপ্তদার আসার কথা ছিলো।মানে আমিই বলেছিলাম যে আমি আছি এখানে।"
রবীন কিছু বোঝার আগেই দীপ্ত এসে প্রণাম করে।যে মানুষটার মুখোমুখি হতে কত দ্বিধা জড়িয়ে ধরেছিলো পায়ে আজ সেই মানুষটাকে কখন যে সময় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে সামনে।
অন্তরঙ্গতা আর স্নেহ সময়ের দুরন্ত গতিতে ম্লান হয়নি একটুও রবীনের কাছে।কেন যেন তাই আজও দীপ্তকে দেখে ভালো লাগলো রবীনের।
যদিও দুষ্টুকে অনেক কথা বলার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে এখানে,হাতে সময় ভীষণ কম।দুদিন বাদেই মিষ্টির আশীর্বাদ তারমধ্যে কি ঘটতে চলেছে এখনো জানেনা। অথচ দীপ্ত এসে গেলো এরমধ্যে কথাগুলো বলবে কি করে?
দীপ্ত ঘরে এসেছে,কিছুটা সহজ এখন দীপ্ত। যদিও এখন ওকেই অনেকে স্যার বলে তবুও স্যারের সামনে আগের মতই বোকাবোকা লাগে হয়ত বা ভয়ও করে। কে জানে স্যার কি ভাবছেন হঠাৎই ওকে এখানে দেখে।
অনেক ভেবে ঠিক করেছিলো আবার পরীক্ষা দেবে,অবশ্য দুষ্টু সবসময় উৎসাহ দিয়ে গেছে।কখনো পাঠিয়েছে নোট আর সলভড পেপার,তবুও মনের দ্বিধাটা পুরোপুরি জয় করতে পারেনি।
হয়ত লাল পলাশের দেশে দুষ্টুর উপস্থিতি আর সাহসের ছোঁয়া ওকে এগিয়ে দিয়েছিলো অনেকটা। ঐ ছোট চুলের লম্বা ধারালো মেয়েটার জাস্ট প্রেমে পড়ে গেছে আবার সেদিন নতুন করে। প্রেমে পড়েছে সে হয়ত অনেক আগেই,যখন প্রেম কাকে বলে ঠিক বুঝতোনা। দুষ্টুর পেয়ারা ছুঁড়ে মারা,দুই বিনুনী ঝুলিয়ে স্কুলে যাওয়া।স্পোর্টসের মাঠে দৌড়নো সবটাই মনের মণিকোঠায় যত্নে রেখেছিলো দীপ্ত।
জোজোকে লেখা দুষ্টুর চিঠিটা বারবার পড়ে মনে একটা আলোড়ন জেগেছিলো মনে হয়েছিলো ওর স্বপ্নের রাজকন্যা যদি কোনদিন এমন চিঠি ওকে লিখতো!
কিন্তু দীপ্তর সেই সাহস ছিলোনা দুষ্টুর মুখোমুখি হওয়ার। হয়ত মাঝে দাঁড়িয়েছিলেন স্যার স্বয়ং। তারপর একটা সময় হারিয়ে গিয়েছিলো দীপ্ত, ডুবে গিয়েছিলো মরীচিকায় হয়ত ওকে ফেরানোর তেমন কেউ ছিলোনা যে ভালোবেসে বলতে পারতো..." আমি জানি তুমি পারবে দীপ্তদা।"
আজ দীপ্ত নিজের সাফল্যের পেছনে কেন যেন দুষ্টুর মুখটা দেখতে পায়। হয়ত জোজো আর মিষ্টির বিয়েটাতে আবার একটা স্বপ্ন ঘোরাফেরা করছে সামনে। তবে যোগ্যতা সম্বন্ধে একটা প্রশ্ন থেকে যায়। কি করে স্যারের কাছে...না না অতটা সাহস ওর নেই।তবে দুষ্টুকে যদি বলে? কিন্তু দুষ্টুও তো এখন আইএএস হতে চলেছে। তবুও আজ মনে হয় একতরফা ভালোবাসা হয়ত তবুও প্রেম সবসময় খারাপ নয়।কখনো মনের ভেতরে লুকোনো অনেক ইচ্ছেকে সফল করতে এগিয়ে নিয়ে যায় প্রেম।
তাই হয়ত দারিদ্র্য, বিরহ আর বঞ্চনা সবই এগিয়ে নিয়ে যায় মানুষকে অনেকটা।
আজও ওর আর দুষ্টুর মাঝে দাঁড়িয়ে স্যার। দীপ্তর মনে হয় স্যার হয়ত সেই লক্ষ্মণরেখা যিনি বারবার সচেতন করেন দীপ্তকে বলেন শান দিতে ওর নিজের মেধা,জ্ঞান আর বুদ্ধিকে।
দুষ্টু মিলিয়ে দেয় বাবার সাথে দীপ্তদাকে বুঝতে পারে দুজনের মধ্যেই এখনো জমে আছে অনেকটা দূরত্বের ফলে গড়ে ওঠা কথোপকথনে জড়তা।
" বাবা দীপ্তদা এবার পরীক্ষা দেবে জানো তো? তাই এসেছে। হঠাৎই আমার সাথে সময়টা মিলে গেলো। তুমি তো জানো কেমন দীপ্তদা,কিছুতেই আসবেনা এখানে আমি ঠিকানা দিয়ে দিয়েছিলাম। তোমরা বোসো আমি আসছি।"
দুষ্টুও যেন আজ বাবার কাছে ধরা পড়ে গেছে।তাই রান্নাঘরে চায়ের কাপের ঠোকাঠুকিতে মনটাকে একটু ঢেকে নেয়। ভেবেছিলো একটা ফোন করবে দীপ্তদাকে হঠাৎই বাবা এসে পড়েছে কিন্তু ফোন করার আগেই দীপ্তদা এসে পড়েছে।
বাবা যদি ভাবে দীপ্তদার জন্যই দুষ্টু এখানে এসেছে। আনমনা দুষ্টু বাবার চায়ের কাপে চিনি দিয়ে ফেলছিলো হঠাৎই নিজেকে সাবধান করলো।
চায়ের ব্রেকের ফাঁকে দুষ্টু এসে দেখে বাবা আর দীপ্তদা মেতে উঠেছে নিজেদের কথায়।
বাবা গল্পের ছলে সবটা জেনে নিচ্ছে দীপ্তদার কাছ থেকে..." অধ্যাবসায়টা আসল,কখনো সফল হচ্ছিসনা কেন এটা ভাববিনা।শুধু মনকে একাগ্ৰ করে রাখ লক্ষ্যে নিঝেকে শান দিতে থাক ঠিক আসবে সাফল্য।"
শান দেওয়া কথাটা অনেকবার শুনেছে দীপ্ত স্যারের কাছে।প্রথমে একটু কেমন ভয় ভয় করলেও মনে হলো আজ একটা বড় প্রাপ্তির দিন তাই বোধহয় ওর এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নের দিনটাতে স্যারের আশীর্বাদ পেলো।
...." তোরা কথা বল,আমি একটু আসছি।দুষ্টু কখন সব সারা হবে একটু জানাস। আমার একটু দরকার ছিলো তোর সাথে।"
দুষ্টুর মুখের সরলতা ভরা সেই হাসিটা বড় ছুঁয়ে যায় রবীনকে...মনে হয় কত অভিযোগ, অভিমান আর দুঃখ মনে লুকিয়ে হাসছে মেয়েটা।
" বাবা কি বলবে বলো,দীপ্তদা একটু ফ্রেশ হয়ে নিক। চলো আমরা পাশের ঘরে গিয়ে বসি।"
ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে রবীন,হাতে সময় কম কি যে করবে? কেন যেন স্যারের মুখের ভাষা পড়তে পারে দীপ্ত মনে হলো স্যারের বোধহয় কিছু জরুরী কথা আছে যা ওর সামনে বলা যায়না।
রবীন ততক্ষণে পাশের ঘরে গেছে।
" আমি একটু বাদেই যাবো,সবই তো আমার চেনা অসুবিধা নেই।তোকে আর আমার সাথে যেতে হবেনা।স্যারের নিশ্চয় কোন দরকার আছে।কেমন যেন লাগছে স্যারকে।"
দুষ্টু অবাক হয় মনে মনে ভাবে সত্যিই তো দীপ্তদা এসে পড়াতে বাবাকে তো জিজ্ঞেসই করা হয়নি কেন এসেছে বাবা।তাই বলে," তুমি একটু ফ্রেশ হয়ে নাও। একটু খেয়ে বেরোবে,আমি ততক্ষণ বাবার সাথে কথা বলি।"
********************
সোফাতে মাথা রেখেছে রবীন শরীরটা বেশ ক্লান্ত।দুষ্টুর ঘরে ঢুকে হঠাৎই মনে হয় বাবা যেন অনেকটা বুড়ো হয়ে গেছে এই কয়েকটা দিনে।
আস্তে আস্তে বাবার পাশে বসে বাবার ঘাড়ে হাত রাখে দুষ্টু সেই ছোটবলার মত। "তোমার কি শরীরটা খারাপ বাবা? কি বলবে বলো। দীপ্তদা ফ্রেশ হতে গেলো।"
হঠাৎই বাঁধ ভেঙে যায় রবীনের নিজেকে কেন যেন সামলাতে পারেনা..." মিষ্টির বিয়েটা আমি ভেঙ্গে দেবো দুষ্টু। এই বিয়েটা হতে পারেনা।"
এক ঝলক ঝোড়ো হাওয়া হঠাৎই এলোমেলো করে দেয় দুষ্টুকে, মনে পড়ে যায় জোজোর দিদিকে ভালোবাসার কথা, তারপর ওদের দুইবোনের জোজোদার সাথে খুনশুটির কথা এই তো সেদিন কত মজা করে কেনাকাটা করলো।হঠাৎই কি হলো এমন? অবশ্য আগের কথাগুলো আর মনে রাখতে চায়না দুষ্টু, এখন আর ওর মনে সেই নিয়ে কোন দুঃখ নেই। জোজোদা তো নির্দোষ, কোনদিন ওকে ঠকায়নি হঠাৎই রাগ করবে কেন ওর ওপর।পুরোটাই তো ওর ছেলেমানুষী ছিলো।
" বাবা তুমি শান্ত হও,এর মধ্যে কি হলো? ওদের সাথে কোন ভুল বোঝাবুঝি? আমাকে বলো প্লিজ। তাড়াতাড়ি বলো বাবা,আমরা ছাড়াও এখানে আরেকজন আছে। বাবা...."
রবীন কি উত্তর দেবে ভেবে পায়না..সত্যিই তো দীপ্ত আছে এখানে।ও যদি শোনে কি ভাববে?
কিন্তু সময়ও নেই হাতে,অনু খুব উৎকন্ঠাতে আছে এরমধ্যে দুবার ফোন করেছে। কিন্তু দুষ্টুর কাছে কি করে বলবে ওর ডায়েরিটা অনেক গোপন জানলা খুলে দিয়েছে।সত্যিই তো অন্যায় এটা...তবুও কাঁপা হাতে এগিয়ে দেয় দুমড়ানো ডায়েরিটা।
অবাক হয়ে যায় দুষ্টু, ছোটবেলা হলে খুব রেগে যেতো।আজ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছে দুষ্টু।কারণ বাবা মায়ের চেয়ে বড় বন্ধু বোধহয় আর কেউ হয়না।বাবার শিক্ষা,ত্যাগ আর নিরাপত্তার ঘেরাটোপেই তো বড় হতে পেরেছে। একটা সময় লুকিয়ে লুকিয়ে ডায়েরিটার গলা জড়িয়ে ধরলেও সময়ের বিবর্তন দুষ্টুকে শিখিয়েছে সম্পর্কের মানে,মূল্যবোধ আর শিক্ষার স্বার্থকতা।
রবীনের বুকের ভেতরের যন্ত্রণাটা দুষ্টুর খিলখিল হাসিতে অদ্ভুতভাবে মুছে যায়।
" বাবা,তুমি আবার কবে আমার মত তেরো বছরে চলে গেলে? কবেকার কথা ওগুলো।সেগুলো নিয়ে ভেবে এতদূরে ছুটে এসেছো। ওগুলো কবে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আর ওখান থেকেই জন্ম নিয়েছি আমি তোমার ছোট মা। এবার কিন্তু আমি তোমাকে বকবো।"
" কিন্তু এটাকে ওভাবে কেউ ফেলে রাখে? যদি মিষ্টি দেখতো?"
" ভালো থাকতে হলে কিছু জিনিস ভুলে যাওয়াই ভালো বাবা।তবে ভাবিনি এতটা...ঠিক বাবা। খুব ভুল হয়ে গেছে।"
রবীনের বুকের ভারটা কমলেও হাল্কা হলোনা পুরোটা..." তাহলে কি করবো?"
" মানে,আশীর্বাদ হবে একদম ঘটা করে। জোজোদা দিদিকে খুব যত্নে রাখবে বাবা।দিদিটা চিরকাল আদুরে,খুব ভালো থাকবে ও।"
রবীন বোকার মত হাত বাড়ায় দুষ্টুর দিকে..." এটা রেখে দে।"
" ওটা আর আমার নেই বাবা,ওটা সবাই দেখে ফেলেছো তোমরা।এবার চলো তো দীপ্তদার সাথে একটু বেরোবো।তুমিও যাবে আমাদের সাথে। ওটা ব্যাগে রাখো,কি করবে আমি বলে দেবো।"
আজ সত্যিই দুষ্টুকে কেমন যেন মায়ের মতই লাগে রবীনের তাই বোকার মত মাথা নেড়ে বলে," আচ্ছা,দাঁড়া তোর মাকে একটা ফোন করি।"
" হ্যাঁ বাবা,তুমি কথা বলে আমাকে দিয়ো। আমি একটু দেখি দীপ্তদা কি করছে।"
*******************
অদ্ভুতভাবে খুব তাড়াতাড়ি একটা সমস্যার সমাধান করে দিলো দুষ্টু হয়তো দীপ্তদা আসাতে সবটাই সহজ হয়ে গেলো।তবে মনের গভীরে একটা ছোট্ট ক্ষত থেকে একবিন্দু রক্ত বেরিয়ে এসেছে কোন ফাঁকে বুঝতেই পারেনি।একবারের জন্য হলেও মনে হলো ওর ডায়েরিটাও আজ ওর সাথে কেন যেন শত্রুতা করলো,যে কথাগুলো একদম মনের অভ্যন্তরের সেগুলো বিশ্বাস করে বলেছিলো ওকে সেটাও সবাই জানলো।
তবে ক্ষত সামলাতে ভীষণ অভ্যস্ত দুষ্টু দিদির বিয়ের খুশির আর দীপ্তদার সাথে যাওয়ার আনন্দের একটুকরো ব্যান্ডএড যত্নে বেঁধে সামলে নিলো মনটাকে।শুধু খারাপ লাগলো মা বাবার জন্য,আর কত লড়াই করবে মানুষগুলো? ওর হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন ওকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য শুধু শুধু মানসিক চাপ নিয়ে কতটা ছুটে এসেছে বাবা।
স্নান করে পোশাক পাল্টে দীপ্ত এখন অনেকটা ঝরঝরে। রাতের ক্লান্তি অনেকটাই মুছে গেছে।দীপ্তকে দেখে হঠাৎই অশান্ত মনে একটুকরো ভালোলাগা উঁকি মারে দুষ্টুর। চাকরির পদমর্যাদা, সময়ের সাথে সাথে লড়াই করে বুদ্ধিমত্তা অনেকটা বেশিই মার্জিত আর সুপুরুষ করেছে দীপ্তদাকে। সেই দীপ্তদা আর নেই যে হঠাৎই একদিন প্রথম দুষ্টুকে সাইকেল চালাতে দেখে আছাড় খেয়েছিলো কাদায়।
তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে রেডি করা ব্রেকফাস্টের প্লেট দুটো হাতে নিয়ে এসে বলে..." জলদি খেয়ে নাও,আমি বাবাকে দিয়ে একদম রেডি হয়ে নেবো।লাঞ্চ বাইরে করবো।"
অবাক হয়ে যায় দীপ্ত ওর কথায়.." স্যার আছেন তো? তোকে যেতে হবেনা,আমি চলে যাবো।"
" তুমি এখন খাও,আমি দেখছি।"
ঝড়ের মত এসেছিলো দুষ্টু আর সুপার সাইক্লোনের মত চলে গেলো ছুটে,দীপ্তর মনে জমা কথাগুলো কখন যে উড়ে গেলো এক ঝটকায়...."
*****************
রবীন আর দুষ্টুর সাথে কথা বলতে গিয়ে অনেকটা জমা কষ্ট আজ জল হয়ে টুপটাপ করে পড়লো অনুর দুচোখ বেয়ে।
দুষ্টু আদুরে গলায় মাকে শাসন করলো,মুছে দিতে চাইলো অভিমান আর কষ্টগুলো। ওদের কথার মাঝে মিষ্টি যে কখন এসে দাঁড়িয়ে বুঝতেই পারেনি অনু।
" আচ্ছা,মা তোমার চোখে এত জল কেন?"
চোখের জল লুকোয় অনু," এই তো দুদিন বাদে তোর আশীর্বাদ তাই মনটা ভালো লাগছেনা মা।"
ওদিকে দিদির সাড়া পেয়ে গলায় জোর আনে দুষ্টু..." আমরা চলে আসছি কালই তারপর শুধুই মজা।"
রবীনের মনটাও খারাপ লাগে,সেদিন রাগের মাথায় অনেকগুলো কথা অনুকে বলেছে। আজ অনুর কান্না মন ছুঁয়ে যায়।তাই বলে..." তোমরা ভেবোনা,আমি তেমন হলে আজই ট্রেনে উঠবো।"
" আজ বিশ্রাম নাও,কাল এসো দুষ্টুর সাথে।"
রবীনের মনটা দীর্ঘ অশান্তির পর অনেকটা শান্ত তাই দুষ্টুর আব্দারে ওদের সাথেই বেরোতে হলো।
" বাবা প্লিজ চলো আমাদের সাথে,একটু ঘুরে আসবে।বাড়িতে বসে রাজ্যের চিন্তা করবে তা হবেনা।"
দুষ্টুর উচ্ছ্বলতাতে কলকাতাকে আজ যেন অন্যরূপে দেখলো দীপ্ত।হয়ত চাকরিতে ঢুকলে এই উচ্ছ্বলতা আর থাকবেনা। রবীনের এক নতুন জয়যাত্রার পথে রওনা দেয়া ওদের সাথে। দুষ্টু আজ ইচ্ছেমত ছড়ি ঘোরালো ওদের ওপর।ছাত্র শিক্ষক দুজনেই চুপচাপ সহ্য করলো ওর সমস্ত কিছু ভালোবেসে। অনেকদিন বাদে রেস্তোরাঁয় খেতে আসা।একবার জোজোর সাথে এসেছিলো এর আগে হঠাৎই মনে পড়ে যায় রবীনের। অনেক কিছুর মাঝে হঠাৎই হারিয়ে ফেলা খুশিটাকে আবার মুঠোতে ধরতে পারে রবীন।
দীপ্ত আজ আবার মিশে গেছে এক সহজ আনন্দে ওদের সাথে..." আপনার সময় থাকলে আমি আপনাকে নিয়ে যেতাম পুরুলিয়া।"
" নিশ্চয় যাবো,তবে হয়ত এবার যেতে হবে অন্য কোথাও।"
অবাক হয় দীপ্ত "কেন?"
" পরীক্ষায় সাফল্য পেলে যেতেই হবে অন্য কোথাও।কে বলতে পারে কার কখন ঠিকানা বদল হয়?"
দুষ্টুর পাহাড়ি ঝর্ণার মত হাসিটা ছুঁয়ে যায় দীপ্তকে।দুষ্টু বলে..." হবে হবে,বাবা তখন আমরা যাবো একসাথে সবাই।"
হয়ত স্বপ্ন দেখে এমন একটা দিনের যখন কালচিনির ভালোবাসার লোকগুলো আবার মিলবে ওর নতুন ঠিকানায়।
দীপ্ত চলে যাবে আজই,তবুও দুষ্টুর বায়না একটু গঙ্গার ধারে ঘুরে যাবে।
পড়ন্ত বেলাতে দুষ্টুর উচ্ছ্বলতার ঢেউ মেশে দীপ্তর মনে। রবীন মাঝেমাঝেই একটু পিছিয়ে পড়ছে ওরা কত পড়াশোনার কথা বলছে।কখন যে এত পড়াশোনা করলো মেয়েটা কে জানে? কিছু না পাওয়া বোধহয় জীবনে অনেক কিছু পাওয়ার খবর নিয়ে আসে।
গঙ্গার ওপর একটা হাঁটা ব্রীজ ধরে হাঁটছে ওরা।হঠাৎই দুষ্টু ছুটে আসে বাবার কাছে,দীপ্ত চোখ রেখেছে গঙ্গার বুকে সূর্যের সিঁদুরে রঙের মাখামাখিতে।
" বাবা তোমার ব্যাগটা একটু খোলো।"
রবীন ব্যাগের চেনটা খুলতেই দুষ্টু ছোটবেলার মত হাতটা ঢুকিয়ে দেয় চকোলেট খোঁজার মত।
প্লাস্টিকের প্যাকেট মোড়ানো ডায়েরিটা মোড়ক থেকে খুলে হঠাৎই ফেলে দেয় গঙ্গার জলে যেখানে চিরতরে আজ ডুবে গেলো কিশোরী মনের অপ্রকাশিত ভালোবাসা, আবেগ আর কষ্টগুলো।
রবীনের চোখে ভাসলো দৃশ্যটা,অনেকবার ভেবেছিলো ওটা তিস্তাতে ফেলে দেবে পারেনি। আজ সেই বিসর্জন ঘটালো দুষ্টু।
অন্যমনস্ক দীপ্তর কানে শুধু বিসর্জনের আওয়াজ টুকু এলো।ওর অজান্তেই দুষ্টু একটা অশান্তির শেষ করলো।সত্যিই তো দিদি এটা পড়লে কি হত? ভেবেই ভয় করলো দুষ্টুর।
মনে মনে ভাবলো সবাই শত্রু,মনের কথা মন বন্দী করে রাখাই বোধহয় ভালো।
**********************
অনেকটা ভালোলাগা ভরা একটা দিন নিয়ে ফিরলো দীপ্ত,আরেকবার অনেকটা বেশি ভালোবেসে ফেললো দুষ্টুকে।
স্যার বারবার করে বলে দিয়েছেন বিয়েতে আসার জন্য তবে হয়ত একটা সুপ্ত ইচ্ছেকে হৃদপিণ্ডের মাঝে রেখেই ফিরে আসা সবুজের মাঝে ওর কোয়ার্টারে।
দীপ্তদা চলে যাওয়াতে অনেকটা সময় বাবার সাথে একা কাটলো দুষ্টুর...তবে মন খারাপের কিছু স্মৃতিকে বারবার টেনে না আনাই ভালো।তাই আজ দিদিকে নিয়ে কত স্বপ্ন আর প্ল্যানিংয়ে মাতলো দুষ্টু বাবার সাথে। অবাক হলো রবীন দুষ্টু কি আর একটুও কষ্ট মনে রাখেনি,নাকি কষ্টকে এই কল্পনার সুখটুকু দিয়ে আদরে ঢেকে রাখতে চাইছে।
ভালো ইচ্ছে আর হাসি বোধহয় কখনো একটু হলেও কষ্ট ভুলতে সাহায্য করে।
বাবাকে আর বোনকে ফিরে আসতে দেখে মিষ্টির প্রাণে খুশির ছোঁয়া লাগলো।ও ছুটে এলো বাইরে..." তোমরা এলে,উঃ বাবা বোনকে ছাড়া একদম ভালো লাগছিলো না।"
" এই তো,বোনকে এনে দিয়েছি আর কোন চিন্তা নেই। এবার দুজনে মিলে আবার খুশিতে ভরিয়ে দে বাড়িটা। আমি এবার একটু বিশ্রাম নিই,আবার কাজে লাগতে হবে।"
রবীন মেয়েদের কাছ থেকে এসে অনুর দিকে তাকায়..অনুর শুকনো মুখটাতে হাসির রেখা। সেটাকে আরো সুন্দর করে দেওয়ার দায়িত্ব হয়ত ওকেই নিতে হবে কারণ অনেকটা কষ্ট পেয়েছে অনু।
দুষ্টু এসে মাকে জড়িয়ে ধরে.." কতদিন পরে তোমাকে দেখলাম মা। আমাকে আগে আদর করো,দিদি আয় মায়ের কাছে।"
অনেকদিন বাদে এই সুন্দর দৃশ্যটা মন ছুঁয়ে গেলো রবীনের।অনেক অযত্ন আর অভিযোগের মধ্যেও এই টুকরো পাওয়ার মুহূর্তগুলো যত্নে ধরে রাখার নামই জীবন।কখনো কখনো সম্পর্কগুলোতেও তেল দিতে হয় যাতে মরচে না ধরে। কত সম্পর্কই তো আসে জীবনে,কিছু থাকে কিছু হারিয়ে যায় অযত্নে তাই যত্নে বাঁচুক সম্পর্কগুলো।
"
Comments
Post a Comment