একটা সপ্তাহ স্বপ্নের মত কেটে যায় জোজোর। আবছা ভোরের আলোয় পর্দা সরিয়ে মিষ্টির ঘুমন্ত মুখটা দেখা তারপর ওর ঘর লাগোয়া ছোট বারান্দায় বসে পুজোর প্যান্ডেলের দিকে তাকিয়ে পুজোর গন্ধ নেওয়া। কখনো ভেজা চুলের জল ছড়ানো মিষ্টিকে দেখে শিশিরের পরশ পাওয়া আবার কখনো মিষ্টির কুয়াশাকাটানো হাসিতে নিজেকে খুঁজে পাওয়া বন্ধু থেকে আরো বিশেষ কিছু হিসেবে। কিন্তু মহা মুশকিল হয়েছে মিষ্টিটা তো এখনো ওর কাছে বড়ই হয়নি,ও এখনো সেই কালচিনিতে অঙ্ক করার ক্লাশেই পড়ে আছে। এই তো সেদিনই রান্নাঘরে রান্না করতে গিয়ে হাতে ছ্যাকা খেয়ে যেই উঃ করে উঠেছে জোজো ভালোমানুষী করে দেখতে যেতেই রীতিমতো খুন্তি নিয়ে ছুটে এসেছে.."রান্নাঘরে এলেই খুন্তি দিয়ে নাক পুড়িয়ে দেবো।আজকের খিচুড়ি আমিই বানাবো যা এখান থেকে।"
বাপরে এই মেয়ে নাকি কদিন আগে বালিশে মুখ ঢেকে কাঁদতো সেটা কি ভালোবাসা হারিয়ে? না কি হেরে গিয়ে? মাঝে মাঝেই এই কথাটা খুব মনে হয় জোজোর সত্যিই কি সায়মকে ভালোবাসতো মিষ্টি? নিশ্চয় ভালোবাসতো তাইতো বিশ্বাস করছিলো। ভালোবাসার বিশ্বাস নিয়ে যে কতজন যে এভাবে খেলা করে কে জানে?
মিষ্টির মন খারাপের মেঘটা উড়িয়ে দেওয়ার জন্য দুগ্গাঠাকুরকে অনেক ভালোবাসা জানিয়েছে জোজো। তাইতো এত ভালো কোয়ালিটি টাইম কাটাতে পারছে মিষ্টির সাথে।
দীপ্তদার সাথে কাটানো দুটো ঘন্টা যেন অনেকটা মেঘ কাটিয়ে আবার ঝকঝকে রোদ দেখালো দুষ্টুকে। মনটা পুরো খুলে দিয়েছে দীপ্ত দুষ্টুর সামনে। দুষ্টু চিনতে পারেনা মানে মেলাতে পারেনা সেই মুখচোরা দীপ্তদার সাথে আজকের দীপ্তদাকে। কখনো ঝরঝরে বাংলাতে আবার কখনো ইংরেজীতে কথা বলছে দীপ্তদা। দুষ্টু বলে ওঠে," দীপ্তদা এতো ভালো ইংরেজী কি করে বলো?"
" তুই তো দারুণ ইংরেজী বলছিস দুষ্টু। আমি তো ভাবতেই পারছিনা।তোর মনে আছে তুই মাঝেমাঝেই জোজোর কাছে টেস্টপেপার সল্ভ করতে দিতিস।"
আজকে আর লজ্জা পায়না দুষ্টু,তবুও মনে হয় কেজানে ওর লেখা চিঠিটা আদৌ দীপ্তদা পড়েছিলো কিনা? তবে তখন কিন্তু ওর লজ্জা আর রাগ দুটোই হয়েছিলো।
" আমি শিখেছি,আসলে আমার ইচ্ছে আরো কিছু করার।"
" মানে?" অবাক হয়ে তাকায় দীপ্ত।
" দেখি আরো বেশি যদি পড়াশোনা করা যায়।তাই সময় পেলেই একটু শান দিয়ে নিই। তুমি বাবার কাছে কবে যাবে বলো? তোমার ফোন নম্বরটা দাও। দুবারই তো স্কুল থেকে ফোন করেছো।"
শেষ কথাটা বলে ফেলে দুষ্টু।বাবার সাথে যদি একবার দেখা করাতে পারে দীপ্তদার তাহলে হয়ত বাবার খুব ভালো লাগবে। মনে জমা অভিমানের মেঘ জল হয়ে যাবে। স্কুলের বর্ষপূর্তির সময় বাবা খুব আশা করেছিলো দীপ্তদাকে।
কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে যায় দীপ্ত,মুখটা কেমন যেন কাচুমাচু হয়ে যায় তারপর নিজেকে একটু সামলে বলে..." নিজেকে একটু শান দিয়ে আর চকমকি ঠুকে আবার চেষ্টা করছি নিভে যাওয়া মশালটা জ্বালাতে।যদি কোনদিন জ্বালাতে পারি সেদিনই স্যারের কাছে যাবো। একদম সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে প্রণাম করবো।"
দীপ্তদার কথার মধ্যে এমন কিছু ছিলো যে আর কোন কিছুই বলতে পারলোনা দুষ্টু। তবুও বললো,"একবার ফোনে কথা বলবে বাবার সাথে?"
" না একদম সামনাসামনি কথা বলবো। অনেক কথা জমে আছে মনে। তুই বল স্যারের কথা আর তোর কথা শুনি। জোজো আর মিষ্টির কথাও বল। সবার কথা খুব শুনতে ইচ্ছে করছে।"
নিজের খেয়ালে কথায় আর হাসির ছন্দে মেতে ওঠে মিষ্টি ততক্ষণে আরো কিছুটা খাবার খাওয়া হয়ে গেছে। দীপ্ত দুষ্টুকে দেখে সাঁঝবেলার আলোতে। মনে পড়ে যায় এলোমেলো মনের কথা লেখা সেই প্রেমের প্রথম চিঠিটার কথা। দুষ্টু তো সেভাবে জোজোর কথা বলছেনা তাই নিজেই বলে.." উত্তীয়র সাথে যোগাযোগ আছে তোর? মানে ফোনে কথা হয়?"
" হ্যাঁ হয়তো,কালই তো কত বকবক করলাম অনেকদিন বাদে। খুব খুশি হলো এখানে এসেছি শুনে। বললো মনে মনে পৌঁছে গেছি তোর ওখানে।
তবে দিদির মনটা মনে হলো ভালো নেই। জানো দিদিকে দেখলে এখন পুরো মডেল ভাববে একদম পরী লাগে দেখতে।"
হাসে দীপ্ত," সময়ে তো সবাই পাল্টায়।এরপর কোনদিন হয়ত তোকেও চিনতে পারবোনা।"
এত কথার পরেও অচেনা দীপ্তদার মোড়ক খুলে সেই কালচিনির দীপ্তদাকে পেলোনা দুষ্টু।ফোন নম্বর নিলোনা কারো শুধু বললো," তোর নম্বরটা মগজে নোট করে নিয়েছি,তোকেই ফোন করে নেবো। এই কার্ডটা রেখে দে আমার স্কুলের নং ওখানে ফোন করলে আমার খোঁজ পাবি।"
**********************
দার্জিলিং ছেড়ে আসার পর আর খোঁজ নেওয়া হয়নি দীপ্তদার। অপেক্ষায় থাকাটাই ভালো লেগেছিলো দুষ্টুর বুঝতে পেরেছিলো ঠিক একদিন আসবে দীপ্তদা ঠিক বাবার কাছে। শুধু বাবা খুব আগ্ৰহ নিয়ে শুনেছিলো দীপ্তদার সব কথা। দুষ্টু অবশ্য একটা ছবি তুলে এনেছিলো।
" এই দেখো ছবিটা নাহলে তো বিশ্বাস করবেনা দেখা হয়েছিলো।"
অনু উঁকি দিয়ে দেখে বলেছিলো," ভালোই তো আছে মনে হয়।চেহারাপত্র তো ভালোই লাগছে।একবার তো ফোনও করতে পারতো মাস্টার মশাইকে।"
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রবীন," কার মনে কি আছে কে বলতে পারে অনু? থাক ওরা নিজের মতই ভালো।"
**************
তবে মিষ্টিকে কলকাতাতে রেখে ভালো থাকতে পারেনা রবীন।এর মধ্যেই মধুমিতার সাথে কথা হয়েছে ঠিক হয়েছে একবার যেতেই হবে কলকাতাতে আর ভালো লাগছেনা। মধুমিতাই প্রস্তাব দেয়.." দাদা আমি তো যাচ্ছি,আপনি গেলে যেতে পারেন।শুভ টিকিটের ব্যবস্থা করে দেবে।"
দুষ্টুও জলপাইগুড়িতে তাই রবীন হঠাৎই বলে ওঠে," অনু যাবে নাকি কলকাতাতে?"
অবাক হয়ে যায় অনু," হঠাৎ আমাকে? সামনে পুজো এখন আবার যাবো?"
" আমি জানি মিষ্টির জন্য তোমার মনটাও খারাপ চলো একবার ঘুরে আসি। আর ফেরার পথে নাহলে একবার পুরুলিয়া ঘুরে ফিরবো।"
মা আসবে সেটা জানতো জোজো আর মিষ্টি কিন্তু একসাথে সবাইকে দেখে দুজনেই অবাক হয়ে যায়। উঃ সত্যিই বোধহয় বাবা মায়েরা ওদের ওপর দিয়ে যায়।বাবাকে দেখে একটু ঘাবড়ে গেলেও মাকে জড়িয়ে ধরে মিষ্টি কতদিন বাদে মায়ের আঁচলের গন্ধ পেলো। অনেকটা শান্তি যেন উড়ে এলো ওর অস্থির মনে।
রবীন অনেকদিন বাদে আবার দেখলো শান্ত ধীর স্থির বদলে যাওয়া মিষ্টিকে আগের মত। একটু চমকে উঠলেও ভালো লাগলো।ততক্ষণে অনু খুলে বসেছে রসগোল্লা আর ছানার জিলিপির হাড়ি ঝাঁপিয়ে পড়ে জোজো। মধুমিতা বলে," দেখেছো তো দিদি আমার ছেলেটা বরাবর খাদক রয়ে গেলো।এত খায় তবুও তোমাদের ওখানের মিস্টি ভুলতে পারেনা।"
খুশিতে আনন্দে মিস্টিমুখে আর সুখে কেটে গেলো মনের অনেকটা অসুখ।মধুমিতা বরাবর কেনাকাটা করতে ভালোবাসে তাই পুজোর কেনাকাটা হলো সবার ইচ্ছেমতো। এর মধ্যেই মধুমিতার এক বান্ধবীর ওয়ানরুম ফ্ল্যাট ওরা ঠিক করলো মিষ্টির থাকার জন্য কারণ জবে জয়েন করলে মিষ্টিকে থাকতে তো হবে কোথাও। রবীনের ইচ্ছে নয় বেশিদিন এখানে থাকুক মিষ্টি। মধুমিতা বাধা দেয়না,হয়ত বাস্তবটা বাবা মায়েরা অনেক বেশি বোঝে তাই মনের খুশির ইচ্ছেটাকে ঝুড়িচাপা দিলো জোজো।
মেয়েকে দেখে পুরুলিয়ার গন্ধ মেখে অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরলো রবীন আর অনু যদিও অনুর মনে হচ্ছে পুজোটা বাপের বাড়িতে কাটাতে পারলে ভালো হত তবুও ফিরতেই হলো ঘরের টানে।
তবে এই ফাঁকে অনেকদিন বাদে ওদের দাম্পত্যের মাঝেও লাগলো একটু দখিনা বাতাসের ছোঁয়া। মনটা বেশ ফুরফুরে হলো দুজনেরই।
******************
ওরা বাড়ি ফেরার কয়েকদিন বাদে বাড়ির টানে ফিরলো মিষ্টিও। তার দুদিন বাদে এলো দুরন্ত হাওয়ার সুবাস ছড়িয়ে দুষ্টু। অনেক দিন বাদে দুইবোনে মিলে খুনশুটি আর কত গল্প। আর তারমধ্যে খুশির নেশার ছোঁয়া।
মিষ্টি শুধু দেখলো বোনটা সেই একই রকম রয়ে গেলো। এখন বোধহয় আরো বেশি পড়াশোনা করে। ওকে দেখে মিষ্টি বলেই ফেললো.." এত কি পড়াশোনা করিস রে? এক বস্তা বই নিয়ে এসেছিস হস্টেল থেকে।"
"স্বপ্ন বুনতে একটু বেশি পড়ি দিদি,দেখি কি হয়?"
" কত কথা বলতে শিখেছিস রে? কি স্বপ্ন বুনছিস রে? বলনা আমাকে? নতুন কেউ এসেছে নাকি?"
দিদির কথাটা শুনে একটু লজ্জা পায় দুষ্টু তবুও দাপটের সাথে বলে," ধুৎ ওসব নয়,অনেক বড় স্বপ্ন দেখি যদি একভাগও মেটে।"
********************
সত্যিই কি সব স্বপ্ন তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে ওঠে আকাশের কাছাকাছি।সব রঙ মিলেমিশে হয় রামধনু? অথবা সব ভালোবাসার গল্পগুলো হয় সত্যি, যেমন হয় সিনেমায় যেখানে ছবিগুলো ছায়াপথ ধরে ধরে এগিয়ে জড়িয়ে ধরে কোন স্বপ্নের রঙকে গানে আর গল্পে।
পুজোর প্যান্ডেল ঢাকের বাদ্যি কাশফুল আর শিউলির টুপটাপে সুখ নামে দুষ্টুর ঘুমন্ত চোখের পাতাতেও আল্পনা আঁকে মনে। এবারও সপ্তমীতে মণিমার বাড়িতে যাওয়া,বাবাকে এখন আর বলতে হয়না তেমন জোর করে কখন যে ওরা একটা পরিবারের মতই হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি। তাই কালচিনিতে কিছু হলেই যেমন মণিমা আর জেম্মা চলে আসে তেমনি ওরাও শিলিগুড়িতে চলে যায় ঐ বাড়িতে কোন আনন্দের বাদ্যি বাজলেই।
এবারও তাই আনন্দের কল্পনায় বুক ঢিপঢিপ করে দুষ্টুর। এবার জোজোদাকে বলতে হবে ওর মনের কথাটা কোন একটা ফাঁকে। নাহ্ এবার যা বলার মুখেই বলবে,আর চিঠিতে বা মেসেজে লিখবেনা।
বইয়ের পাতায় ডুবতে গিয়েও মন হারায় দুষ্টু আচ্ছা জোজোদা যদি এরমধ্যে অন্য কাউকে ভালোবেসে ফেলে তাহলে কি হবে? সত্যিই বোধহয় বড় হতে গিয়ে আর নিজেকে গুছোতে অনেকটাই সময় নিয়েছে দুষ্টু। ওর বন্ধুদের তো কতই বয়ফ্রেন্ড আছে।মানে অনেকের একের অনেক বেশি,ওরা নদীর স্রোতের মত প্রেম গায়ে মাখে কখনো বা সমুদ্রের ঢেউয়ে ভেসেও যায় তারপর আবার বালি ঝেড়ে উঠে আসে।
কিছুটা বাবার কাছে আর কিছুটা দিদির কাছে শুনেছে দুষ্টু। দিদি হয়ত ভেসেই যেতো কোন এক মুহূর্তের ভুলে।সত্যিই অপরিচিত কাউকে বিশ্বাস করে যে কিভাবে ঠকতে হয় ভাবলেই কেমন যেন শিউরে ওঠে দুষ্টু। জানাশোনা আর চেনাশোনা ছাড়া কাউকে নিজের মনের মত পাওয়া বোধহয় লটারি জেতার চেয়েও কঠিন। বাবা ওকে খুব বুঝিয়েছে নিজের মত করে। দিদিও নিজের কথা বলতে গিয়ে গুমরে কেঁদে উঠেছিলো ওর কাছে।
অনেকটা দুঃখ আর অবিশ্বাসের যন্ত্রণার মাঝেও হঠাৎই দুষ্টুর মনে হয় এমন দিন হয়ত কখনোই ওকে দেখতে হবেনা।ও তো সেই কবেই প্রেমে ভেসেছে,তখন তো ভালোলাগা টুকু ছাড়া ওর কিছুই ছিলোনা। জোজোদাকে সেই এইটুকুনি থেকে ও জানে,কত চুল ধরে মেরেছে ওকে।ও অবশ্য ছাড়েনি দুমদাম ঘুসি মেরেছে কখনো খিমচে দিয়েছে। তাই জোজোদা ওকে কোন কষ্ট দেবেনা দিদির ঐ বদমায়েশ সায়মের মত।
পড়তো ঐ ছেলেটা দুষ্টুর খপ্পরে একদম সোজা করে দিতো পিটিয়ে। দিদি যদিও সেই কথাটা শুনে একটা দুঃখের হাসি হেসেছিলো.." সবটাই অত সোজা নয় দুষ্টু। সবটাই কি আমাদের কালচিনি? অনেক কিছুই ক্ষতি করতে পারে অতবড় শহরে ছেলেটা আমার।অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি দুষ্টু। দিদির চোখের জল দেখে সেদিন খুব খারাপ লেগেছিলো। তখন চুপটি করে শুয়ে বালিশে মুখ রেখে দুষ্টু ভেবেছিলো আমি আর কোনো ভুল করবোনা।খুব সাবধানে পা রাখবো জীবনে।
তবুও হয়ত বেশি সাবধানী মানুষও কখনো হোঁচট খায় আর মুখ থুবড়ে পড়ে।হয়ত বা মুখ থুবড়ে পড়ে কেটে যায় চোখ মুখ তবুও আবার উঠে মুখে হাসি নিয়ে এই বেশ ভালো আছি বলার নামই জীবন।
পঞ্চমী থেকে ষষ্ঠী পার হয়ে সপ্তমীতে পা দিলো দুর্গা পুজো এরমধ্যেই অনেক ঘোরাঘুরি ফুচকা ঝালমুড়ি,চপ,রোল,জিলিপি সব খাওয়া হয়ে গেছে বন্ধুদের সাথে দুষ্টুর আর মিষ্টির। আজকাল দুই মেয়েকে নিয়ে বাইরে যেতে ভালো লাগে রবীনের,ওদের ছোটবেলার কত কথা মনে পড়ে যায়। বাড়িতে এসে অনুকে বলে," যারা ছোটবেলায় এটা কিনবো ওটা কিনবো বলে মাথা খেতো তারাই এখন আমাকে বকছে মিস্টি খেয়োনা এই বলে।"
সপ্তমীর সকালেই ওদের সবার মনে খুশি খুশি ভাব কারণ সাজুগুজু করে মণিমার বাড়ি যাওয়া আর তার সাথে আরো আনন্দ আছে জোজো আর জয়ের সঙ্গে প্যান্ডেল হপিং আর আড্ডা। জোজোর কথা মনে হতেই দুষ্টুর মন উচাটন,অনেকদিন দেখা হয়না
******************
এবার মণিমার বাড়িতে যাওয়া ওদের নিজেদের গাড়িতে করে তাই আরেকটু বেশি মজা। খুশি অনুর চোখে মুখেও। রাস্তায় যেতে যেতে গাড়ির গানের ভলিউম একটু বাড়িয়ে দেয় দুষ্টু...
'আলো আলো রং জমকালো চাঁদ হয়ে যায়
চেনাশোনা মুখ জানাশোনা হাত ছুয়ে যায়
ধীরে ধীরে মন ঘিরে ঘিরে গান রেখে যায়
কিছু মিছু রাত পিছু পিছুটান ডেকে যায়
আজও আছে গোপন
ফেরারি মন
বেজে গেছে কখন
সে টেলিফোন।'
চেনাশোনা মুখ জানাশোনা হাত ছুয়ে যায়
ধীরে ধীরে মন ঘিরে ঘিরে গান রেখে যায়
কিছু মিছু রাত পিছু পিছুটান ডেকে যায়
আজও আছে গোপন
ফেরারি মন
বেজে গেছে কখন
সে টেলিফোন।'
পুজোর খুশির মাঝে একসাথে সবাই থাকার আনন্দই বোধহয় আলাদা আর মণিমার বাড়িতে আসা তো রীতিমতো অভ্যেস হয়ে গেছে।তাই গানে আড্ডায় আর খাওয়া দাওয়ায় মেতে ওঠে ওরা সবাই। প্রায় সাতদিন বাদে আবার মিষ্টির সাথে দেখা। এই কয়েকটা দিন উড়ু উড়ু মন নিয়ে একটা ঘোরের মধ্যে কাটিয়েছে জোজো। মিস্ করেছে মিষ্টিকে আর ওর সাথে কাটানো রঙীন অথবা রঙমোছা মুহূর্তগুলোকে।
এই কয়েকদিনের না দেখা যেন ভালোবাসাটাকে বাড়িয়ে দিয়েছে আরো কয়েক গুন যদিও এর মাঝে ফোনে কয়েকবারই কথা হয়েছে তবুও বলতে পারেনি মনের কথাটা কিছুতেই জোজো। নিজেকে কেমন যেন বোকা বোকা মনে হয়েছে। হয়ত মিষ্টির কোন ফিলিংস নেই ওর জন্য তাছাড়া সবেই এইরকম একটা ঘটনার পর কি করে বলবে?
দুর্গাপুজোর ঢাকের বাদ্যির মাঝে অদ্ভুত এক ভালোবাসার বাদ্যি মনের মধ্যে জোজোর একটা অস্থির অস্থির ভাব। মধুমিতার চোখ এড়ায়নি সেটা স্বামী দীর্ঘদিন বাইরে থাকায় খুব কাছ থেকে সন্তানকে দেখেছে মধুমিতা তাই আজকাল বন্ধুর মত পাশে থেকে ওকে বুঝতে চায়।
" তোর কি হয়েছে রে? কেমন অস্থিরতা? আড্ডা মারতে বাইরে গেলিনা,বাড়িতেই বসে আছিস।"
" এমনি মা অনেকগুলো কাজ আছে,তুমি ভেবোনা অত কিছু আমি একদম ঠিকঠাক আছি।"
তবে দুষ্টু আর মিষ্টি আসাতে মধুমিতা ছেলেকে দেখে শান্তি পেলো যাক এই তো বেশ সবার সাথে মিলেমিশে আনন্দ করছে ছেলেটা।
সেদিন রাতে অনেকটা সময় ঠাকুর দেখে কাটে। সবাই যখন ফুচকা খেতে ব্যস্ত তখন দুষ্টুর কাছে এসে জোজো বলে," তুই তো খুব ভোরে উঠে পড়িস কাল একটু ছাদে আসবি,তোর সাথে একটু কথা আছে।"
ওদের কথার মাঝেই মিষ্টি এসে দাঁড়ায়," এই কি ফিসফিস করছিস রে? আমাকে বাদ দিয়ে?"
দুষ্টুমি ভরা হাসি হাসে জোজো," কিছুনা,এই দুষ্টুকে বলছিলাম তোর দিদিটা কি বোকা! মোটা হয়ে যাবে বলে ফুচকা খেলোনা!"
দিদির সাথে জোজোদার কথা আর কানে ঢোকেনা মিষ্টির।ওর মন তখন পাখনা মেলেছে ঐ দূরের আকাশে।জোজোদা ওকে কিছু বলতে চায় কেজানে কি বলবে কাল ভোরে ওকে? হয়ত ওর মনে যা আছে এতদিন ধরে তেমনি কিছু?
সারারাত ভালো করে ঘুম হয়না দুষ্টুর,মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত উচাটন। মণিমার বাড়িতে এলেই ও ভোরবেলা ছাদে ওঠে,খুব ভালো লাগে আসলে কালচিনিতে ওদের একতলা বাড়ি তাই ছাদে ওঠা হয়না। এখানে ভোরের সকালের রঙটা সুন্দর দেখতে পায় ছাদ থেকে। শহরের রঙই বোধহয় আলাদা চারদিকে কত বড় বড় বাড়ি তবে ছাদ থেকে দূরের পাহাড়ও দেখা যায়।
আজ ভোরের সকাল দেখাতে মন নেই দুষ্টুর ধ্যাৎ ওকে আসতে বলে জোজোদা বেপাত্তা।এখনো সবাই ঘুমোচ্ছে,একটু বাদেই হয়ত বাবা উঠে যাবে ওকে খুঁজবে।রাগ হয় খুব দুষ্টুর হঠাৎই পেছন থেকে এসে জোজো ওর চোখটা ধরে সেই ছোটবেলার মত.." বলতো আমি কে?"
সেই সময় দুষ্টু ছাড় ছাড় আমাকে করলেও আজ আর কিছু বলতে পারেনা।জোজো বললো," এই আবছা অন্ধকারে ছাদে উঠেছিস? পাশের নিমগাছে কিন্তু ভূত আছে?"
জোজোর গায়ের গন্ধ ওর আঙ্গুলের ছোঁয়া ছুঁয়ে আছে দুষ্টুকে। ও বলে," আমি ভূতে ভয় পাইনা,কি বলবি বল।কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি আমি।"
দুষ্টুর সাথে ছাদের কোণে গিয়ে দাঁড়ায় জোজো..." কি করে যে তোকে কথাটা বলবো,বুঝতে পারছিনা। কিন্তু তোকেই হেল্প করতে হবে আমাকে,ছোটবেলায় তুই তো আমার বন্ধু ছিলি কত মারামারি করেছি তোর সাথে আবার আদরও করেছি।"
দুষ্টুর কেমন যেন লাগে,পুরোনো কথায় মন ভেসে যায় তাই বলে ফেলে.." কি বলবি বলনা,এতো ভাবছিস কেন? শুনবো বলেই তো কতক্ষণ থেকে এসে দাঁড়িয়ে আছি।"
এতটা সময় যে কেন নিচ্ছে জোজোদা কে জানে? তাহলে কি ও নিজেই বলে দেবে সেই কবে থেকে তোকে আমার ভালো লাগে।
হঠাৎই ভোরের সূর্যটা আলো ছড়ায় চারিদিকে আর জোজো বলে ওঠে আকাশের দিকে তাকিয়ে.." আমার একজনকে খুব ভালো লাগে দুষ্টু মানে তাকে ভালোবেসে ফেলেছি।"
বোকার মত আবেশে মাখামাখি হয়ে দুষ্টু বলে ওঠে.." কাকে?"
" মিষ্টিকে রে। সত্যিই খুব লজ্জা লাগছে বলতে কারণ জানি স্যার জানলে রাগ করবে।মা কি করবে জানিনা তবে মিষ্টি কি আমাকে....? সেটা যদি একটু তুই একটু দিদিকে বলে দিস।মানে যদি মিষ্টিকে বলিস।মানে আমি ঠিক....আসলে প্রথম তো।"
দুষ্টু কেন যেন নিজেকে সামলাতে পারেনা হঠাৎই অনেকটা জল চোখ ছাপিয়ে নাক মুখ গাল সব ভাসিয়ে দেয় নোনা স্বাদে.." জোজোদা তুই দিদিকে ভালোবাসিস? কি প্রথম? প্রথম প্রেম?"
জোজো কেমন যেন অবাক হয়ে যায় দুষ্টুকে কাঁদতে দেখে।
" এই বোকা মেয়ে তুই কাঁদছিস কেন শুনি? আমি কি এখনি তোর দিদিকে নিয়ে গেছি নাকি? কি হলো?
দুষ্টু আর নিজেকে সামলাতে পারেনা জোজোর জামাটা ধরে ওর বুকের কাছে গিয়ে কাঁদে হুমড়ি খেয়ে।
জোজো ওকে দুহাতে ধরে," পাগলী একটা,কি বলতে গেলাম আর কি হলো। এই তোর সাহস? চল নিচে যাই এতক্ষণে সবাই উঠে পড়েছে হয়ত।"
চোখটা মুছে দুষ্টু বলে," তুই যা আমি আসছি।"
ততক্ষণে রাণু উঠে এসেছে ছাদে দুষ্টু আর জোজোকে দেখে অবাক হয়ে যায়।এত ভোরে ওরা কি করছে এখানে? কখন এখানে এসেছে কে জানে?
কাম্মাকে দেখে জোজো সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায়।দুষ্টু খেয়ালই করেনি মণিমাকে। পেছন থেকে এসে দুষ্টুর মাথায় হাত রাখে রাণু.." কি রে ছাদে কি করছিস? কাঁদছিস কেন? জোজোর সাথে ঝগড়া হয়েছে?"
মাথা নাড়ে দুষ্টু.." মনটা ভালো লাগছিলোনা গো,দিদির কথা মনে হচ্ছিলো।দিদির কত বড় ঝামেলা হলো।সব শুনছিলাম জোজোদার কাছে।"
" তা তুই কাঁদছিস কেন বোকা মেয়ে? সেই তোর পুচকুকাল থেকে তোকে বড় করেছি তুই পুজোর দিন কাঁদলে কি আমার ভালো লাগে? জামাইবাবুও কষ্ট পাবে।"
রাণুর গলাটা জড়িয়ে আরেকটু কেঁদে নেয় দুষ্টু।তারপর হঠাৎই খুব রাগ হয় নিজের ওপর।জোজোদা তো জানলোই না ওর ভালোবাসার কথা দোষ তো ওরই এখন কেঁদে কি হবে? জোর করে প্রেম হয় নাকি? তবে পড়াশোনাটা হতে পারে। সেই ছোট্টবেলা থেকে দিদিই সব ব্যাপারে সেরা এমন কি ওর প্রেমটাও দিদিরই হলো ওর পছন্দ করা জামা আর খেলনার মত।
সব হারিয়ে যায়নি সব হারাতে পারেনা।ও এগিয়ে যাবেই,ওকে যেতেই হবে অনেক দূরে
পড়াশোনার হাত ধরে।
ছাদের গাছে জল দিতে দিতে অবাক চোখে দুষ্টুকে দেখে রাণু,ওর কেন যেন মনে হলো দুষ্টু ওকে সত্যি কথা বললোনা।
*********************
একটা টুকরো কালো মেঘ ভোরবেলাতে দুষ্টুর চোখে জল ঝরালেও একটু বেলাতে একটু একটু করে হাসিতে ঢাকলো মনের কষ্টটা দুষ্টু। এমন কষ্ট তো সেদিনও পেয়েছিলো যেদিন ওর টেস্টপেপারের ভেতরে রাখা চিঠিটা উত্তর না পেয়ে এমনিতেই ফেরত এসেছিলো।
দিদির দিকে তাকায় দুষ্টু,এখানে এসেও মায়ের পাশে বসে আদর খাচ্ছে।ওর থোকা থোকা চুলগুলোত মা হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছে," দুষ্টু কখন উঠে পড়েছে এই তো মণিমার সাথে ফুল নিয়ে ফিরলো।অঞ্জলি দিতে যাবিনা? তাড়াতাড়ি কর।"
মিষ্টি তখনো মায়ের কাছে আদর খাচ্ছে," যাবো তো দেরি আছে এখন অনেক। তুমিও তো যাবে।"
দুষ্টুর আজ যেন কেন মায়ের আঁচলে মুখ রাখতে খুব ইচ্ছে হলো। দিদিকে মা সবসময় বেশি ভালোবাসে।দিদি ফর্সা সুন্দর,ও শ্যামলা না শ্যাওলা নিজেও জানেনা।তাই হয়ত ঝাড়ু দিয়ে ঘষে ফেলে দেয় সবাই।
হঠাৎই দুষ্টুর ভেতর থেকে কে যেন বলে ওঠে,বাবা বলেছে না নিজেকে ছোট ভাবা পাপ আর অপরাধ। ভালো করে নিজের মধ্যে ডুবে যাও দেখবে অনেক কিছু ভালো আর খুশি হওয়ার মত জিনিস তোমার মধ্যেই আছে। নিজেকে ছোট ভাবা মানে আত্মাকে অসম্মান করা। মৃত্যুর পরের জীবন নিয়ে একটা সময় মিশরীয়রা ভেবেছিলো।যত্নে সাজিয়েছিলো জীবিত অবস্থায় মৃত্যু পরবর্তী জীবনে ভালো থাকার জন্য কত কিছু। আর ও হঠাৎ কেন অসম্মান করছে নিজেকে? দিদির সাথে তুলনা করছে?
" দুষ্টু এতক্ষণ ছাদে ছিলি রাণু বললো।এবার স্নান করে তৈরি হয়ে নে।"
" ছাদে কি করছিলি রে তোরা? আমাকে ডাকলিনা কেন?" আদুরে গলায় মিষ্টি বলে।
" ঐ কিছুনা কলকাতার গল্প করছিলাম মানে শুনছিলাম।"
ওদের কথার মাঝে রবীন আসে.." তোর মুখটা এমন শুকনো কেন রে দুষ্টু? কাল ভালো ঘুম হয়নি?"
" না বাবা ঠিক আছে,পুজোর দিনগুলোতে আমার অনেক ভোরে ঘুম ভেঙে যায় আর দিন গুনি। এই তো আজ অষ্টমী হয়ে গেলো।"
সপ্তমী থেকে অষ্টমীতে পা রাখার মাঝে দুষ্টুর মন ভাঙার শব্দ ঢাকের শব্দে চাপা পড়ে গেলো।
অষ্টমীর সাজে মিষ্টিকে দেখে আরেকবার ফিদা হয়ে গেলো জোজো।যথারীতি এবারও বন্ধুরা আওয়াজ দিলো কি লাক রে তোর! উফ্ সেই মডেল তো আরো সুন্দরী হয়েছে এখন।কিন্তু কোন দিকেই তাকায়না।
জোজো ভাবে যাক মিষ্টির দিকে যেন আর কারো নজর না পড়ে। সত্যি বলতে দুষ্টুকে একটা সময় মেয়ে বলেই ও ভাবতোনা সব সময় মনে হত ওরই মত একটা ছেলে দুষ্টু যার সাথে দেখা হলেই মারামারি আর ঝগড়া হয়। যখনই ছোটবেলায় মণিমার সাথে এই বাড়িতে এসেছে তখনই মারামারি করে গেছে।
মিষ্টিকে ভালো লেগেছিলো কালচিনিতে থাকতেই।মিষ্টির হাসি,কথা আর নাচ মাঝে মাঝেই ওকে নিয়ে যেতো চাবাগানের সবুজে। ভালোলাগায় ঘন সবুজে ডুব দিতো অবুঝ মন।
দুষ্টু মিষ্টি দুজনেই শাড়ি পরেছে।বোনকে জোর করে শাড়ি পরিয়েছে মিষ্টি।কিছুতেই শাড়ি পরবেনা ওর নাকি মাথা ধরেছে। সত্যিই বোনকে নিয়ে আর পারা যায়না।সবাইকে সামলাতে গিয়ে নিজের মনটাই কখনো রোদেলা আবার কখনো মেঘলা।
কালই কত খুশি ছিলো,আজই মুখটা ভার ভার নিশ্চয় জোজোর সাথে ছাদে ঝগড়া করে এসেছে। ওকে শাড়ি পরাতে হিমসিম খায় মিষ্টি
" উরিবাবা বোন তুই কি দিন দিন আরো লম্বু হচ্ছিস নাকি? তোর প্যান্ট পরাই ভালো। ঘেমে নেয়ে গেলাম একদম।"
" আমি তো না করেছিলাম তুই তো শুনলিনা।কি যে শাড়ি পরতে ভালোবাসিস!"
" সরস্বতী পুজো আর অষ্টমীর অঞ্জলির দিন শাড়িতেই মেয়েদের সবচেয়ে সুন্দর লাগে বুঝেছিস।"
দুষ্টুর মনে হয় কেন যে শুধু শুধু ও মেয়ে হলো? মেয়েদের কোন কিছুই তো ওর তেমন ভালো লাগেনা। তবুও বাবা বলে," তোর মুখটা একদম আমার মায়ের মত লক্ষ্মী লক্ষ্মী।"
চারদিকে ধূপধুনোর গন্ধে আর মন্ত্রের উচ্চারণে দেবী আজ জাগ্ৰত।আজ নাকি মায়ের পায়ে অঞ্জলি দিয়ে সব পাওয়া যায়।মা তার অকৃপণ হস্তে রূপ,যশ,শক্তি,মুক্তি,ভক্তি, কাম,অর্থ,মোক্ষ সবই দেন। রবীনের অঞ্জলি দেওয়ার অভ্যেস নেই,খুব ছোটবেলায় মায়ের সাথে যেতো।বিয়ের পর অনুকে নিয়ে গেছে। এখন শুধু বাড়িতে বসে পুজোর গন্ধটুকু অনুভব করে ভালো লাগে মেয়েদের আর অনুর সাজগোজ সবার মধ্যেই যেন দেবীর অংশ দেখতে পায়।
মায়ের সামনে হাতজোড় করেছে দুষ্টুও দিদির পাশে দাঁড়িয়ে। মন্ত্রের সুরে সুরে মনে চলছে তার অনুরণন।মন দিতে পারছেনা সব কথাতে বার বারই মনে হচ্ছে ভোরবেলার কথা।হঠাৎই মনে হলো হয়ত যা হয়েছে ভালোই হয়েছে,ভাগ্যিস ও বলেনি জোজোকে ওর ভালোবাসার কথা।
মন্ত্রোচ্চারণ এগিয়ে চলেছে দুষ্টু মনে মনে বলে শক্তি দাও মা,শুধু শক্তি দাও যাতে না পাওয়াগুলোকে অনেক কিছু পাওয়াতে বদলে দিতে পারি।
হঠাৎই পেছন থেকে কে যেন ঠকাস করে ওর মাথায় কিছু একটা ছুঁঁড়ে মারে...খুব বিরক্ত হয়ে মুখ ফেরায় দুষ্টু একগাল দুষ্টুমি ভরা হাসি নিয়ে ওর দিকে জোজো তাকিয়ে আছে।
হেসে ফেলে দুষ্টুও,জোজোরও মনটা ভালো হয়ে যায়। সেই কোন ছোটবেলার খেলার বন্ধু দুষ্টু।হঠাৎই সকালে খুব কাঁদলো মেয়েটা,প্রশ্নের ভিড় জমেছে জোজোর মনেও তবে সব প্রশ্নের উত্তর না খোঁজাই ভালো।
মন্ত্র থামার পরই দুষ্টু শুনতে পায় কোন পাজি ছেলে বোধহয় গানটা চালিয়েছে।তবে কেন যেন কথাগুলো একদম ওর মনের কথা..
প্রেমে পড়া বারণ
কারণে অকারণ,
আঙুলে আঙুল রাখলেও হাত ধরা বারণ।
তোমায় যত গল্প বলার ছিল,
তোমায় যত গল্প বলার ছিল,
সব পাপড়ি হয়ে গাছের পাশে ছড়িয়ে রয়ে ছিল,
দাওনি তুমি আমায় সেসব কুড়িয়ে নেওয়ার কোনো কারণ।
প্রেমে পড়া বারণ,
কারণে অকারণ,
ওই মায়া চোখে চোখ রাখলেও ফিরে তাকানো বারণ।
গানটা শুনে আবারও রাগ হলো দুষ্টুর,দিদির সাথে ভালোবাসা বাসি আর ওকে ফুল ছুড়বে। আর দিদিটা যেন রাণী কত অ্যাডমায়ারার ওর!
ওরা প্যান্ডেল ছেড়ে বেরোতেই জোজোর বন্ধুরা এগিয়ে এলো,আলাপে আর আড্ডায় অনেকেরই মন হারালো পুজোর খুনশুটিতে ভরা মিঠে প্রেমে। তারমধ্যেই আবার কে যেন গানটাকে চালিয়ে দিলো দুষ্টুর দিকে তাকিয়ে হাসলো জোজো,মুখ ফেরালো দুষ্টু অভিমানে।হয়ত কেউই বুঝলোনা সেই অভিমানের ভাষা।
********************
প্রেমে পড়া সত্যিই বারণ আপাততঃ দুষ্টুর তাই মনে হলো তবে পড়া তো আর বারণ নয় সুতরাং দুষ্টু এবার আবার একটু বেশি করেই বইয়ের প্রেমে পড়লো।অবাক হলো মিষ্টিও," বোন এত পড়াশোনা তোদের করতে হয়? বাপরে এখানে তো খুব পড়াশোনা দেখছি।আমাদের কিন্তু এত পড়তে হতোনা। পুজোর কটা দিন মানে লক্ষ্মীপুজো পর্যন্ত একটু ব্রেক নে।"
"ব্রেকেই তো আছি বাবা,একটু রাত জেগে না পড়লে কেন যেন ঘুম আসেনা আমার।"
মনে মনে ভাবে দুষ্টু এই ব্রেক বোধহয় ভাঙতে ভাঙতে সোজা হয়ে দাঁড়ানো।দিদির ব্রেক আর ওর ব্রেক একদম আলাদা।
মিষ্টি হেসে বলে," হুঁঁম বুজেছি রাত জেগে ডাইরি লেখা চলে সেই আগের মত। লিখিস তো ডাইরি? কি রে বোন?"
" মাঝে মাঝে লিখি ইচ্ছে হলে।জীবনের সব কথা কি ডাইরিতে লেখা যায়? তোর জন্যও কতজন কত কথা জমিয়ে মনে মধ্যে নিয়ে বসে আছে। তুই কি তার খবর রাখিস?"
কেন যেন বলতে গিয়েও এই পুজোর মধ্যে কথাটা বলতে পারেনি দিদিকে দুষ্টু আসলে দুজনের মনের মধ্যেই একটা গভীর ক্ষত। দিদির ক্ষততে মলম লাগিয়েছে সবাই তাই ও কিছুটা শান্ত এখন কিন্তু ওর ক্ষতটা তো কাউকে দেখাতেই পারলোনা তেমন করে তাই ভালোবাসার সুখ আর দুঃখ পুরোটাই যেন নিজেকেই সইতে হলো আর কিছুটা ডাইরিকে বলে ভারমুক্ত হলো।
দিদির দিকে তাকিয়ে দেখে দিদি দিব্যি ওর খাটে গড়াগড়ি খাচ্ছে আরামে।তারমধ্যেই বলে," কার কথা বলছিস? কে মনের মধ্যে কথা জমিয়ে আছে? নিশ্চয় জোজো?"
অবাক হয়ে যায় দুষ্টু," দিদি তুই জানিস? মানে কি জানিস?"
দিদি সেই মিষ্টি হাসিটা হাসে আবার," আগে তুই কি জানিস বল?"
দুষ্টু এবার খাটে গিয়ে মিষ্টিকে জড়িয়ে ধরে.."জোজোদার তোকে খুব ভালো লাগে। আমাকে বলতে বলছিলো।"
" ধ্যাৎ এ আবার নতুন কি? ও তো এখানে থাকতেই অনেকবার বলেছে সেটা..মিষ্টি তুই কি ভালো নাচিস,অঙ্ক করিস,হেসে গড়াগড়ি খাস।তোর সব কিছুই সুন্দর।"
অবাক হয়ে যায় দুষ্টু তাও দিদি ঐ সায়মের সাথে!
" তোর কিছু মনে হয়নি এসব শুনে?"
" কি আবার মনে হবে? আরে ওকে আমি বন্ধু ছাড়া আর কিছু ভাবিনি।তাছাড়া ওরা আমাদের আত্মীয়।মণিমাই বা কি ভাববে? তাছাড়া জেম্মাও তো ভাববে ওকে এখানে রেখে বাবা সুযোগ নিলো।"
অবাক হয়ে যায় দুষ্টু সত্যিই দিদির বুদ্ধি আছে আর ও বোকার ডিম। তবুও বললো," সেদিন আমাকে ছাদে বললো,তোকে ভালোবাসে সেকথা বলতে সাহস পাচ্ছেনা আমি যেন বলে দিই।"
" দাঁড়া তো ওকে এখনি ফোন করে বকা দিই,ভালোবাসা তিস্তার জলে ভেসে যাবে।"
" এখন না দিদি পরে বলিস কিছু বলার থাকলে।"
ওদের কোন কথাই আর শুনতে চায়না দুষ্টু। নিজেদের ঝগড়া,খুনশুটিতে ওরাই থাক প্রেমে।অপ্রেমে কাটুক নাহয় ওর একলাবেলা।
***********************
মাঝে কেটে গেছে বেশ কিছুদিন মিষ্টি চাকরিতে জয়েন করেছে।জেম্মার ঠিক করা ওয়ানরুম ফ্ল্যাটটা বেশ ভালো। নিজেকে এখন বেশ বড় বড় মনে হয় ওর। একার ঘর,একার দোর একার সংসার।সময় ছুটে যাচ্ছে নিজের ছন্দে।বেশ কিছুটা নিশ্চিন্ত রবীন একটু একটু করে সংসারের সুতো গুটোনোর সময় আসছে। সংসার লাটাইয়ের চাকা ঘুরিয়ে নিজেও খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আর দুটো বছর বাদে দুষ্টুরও নিশ্চয় একটা কোথাও চাকরি হয়ে যাবে। রিটায়ার্ড লাইফে ঢোকার আগে একটু নিশ্চিন্তে অবসর নেবে।
তবে রবীনের জানার বাইরেও দুষ্টু এগিয়ে চলেছে নিজের মত করে। দিদির মত ওর অত সাজগোজ নেই তবে যখন একদম বয়েজ কাট কেটে ফেললো ওর লম্বা চুলগুলো তখন অনু কুরুক্ষেত্র করার সাথে সাথে রবীনও রাগ করেছিলো.." তোকে দেখলে আমার মায়ের কথা মনে হয় খুব। চুল ছোট করতি ঠিক আছে কিন্তু তাই বলে এত ছোট! ইশ্ কেমন যেন লাগছে!"
দুষ্টু আগাগোড়াই ভালো দৌড়তো,খেলতো।ওর আনা অনেক প্রাইজই জ্বলজ্বল করে রবীনের আলমারিতে। সবচেয়ে ভালো লাগে ওর দুই বিণুনী বাঁধা ছবিটা হাতে একটা এত বড় কাপ। ঠিক এমনি একটা ছবি আছে স্কুলে দীপ্তর। আবার ছেলেটার কথা মনে পড়লো রবীনের। আশ্চর্য ছেলে একটা দিন ফোনও করলোনা। এতটাই অকৃতজ্ঞ হয় মানুষ! ঠিকই তো মানুষই বোধহয় অকৃতজ্ঞ হয়।
দুষ্টুর সাথে ওর যোগাযোগ হয়েছিলো একবার, তারপর দুএকদিন জিজ্ঞেস করেছে "হ্যাঁ রে দীপ্ত ফোন করেছিলো?"
ঠোঁট উল্টে বলেছিলো দুষ্টু," না তো। "
" তুই করেছিলি কখনো ফোন?"
" না বাবা, ওটা স্কুলের নম্বর ওখানে ফোন করতে ভালো লাগেনা। কোন দরকার হলে করবো। তুমি ভেবোনা বাবা দীপ্তদা একদিন ঠিক আসবে।"
কেন যেন দুষ্টুকে বিশ্বাস হয়নি রবীনের।
মিষ্টির কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে মানে কোন রিঅ্যাকশন না দেখে অবাক হয়ে যায় জোজো দুষ্টু কি তবে কিছুই বলেনি ওকে?
একটু একটু করে বেশ কিছুটা সাহস নিয়ে নিজেই বলে ফেলবে কিনা ভেবেছে অনেকদিন। তারপর যখন দেখে দিব্যি আছে মিষ্টি সেই আগের মতই একদিন নিজেই প্রপোজ করে ফেললো।
বুকের ভেতরটা একটু কাঁপলো মিষ্টির আবার প্রেম? আজকাল মাঝে মাঝে প্রেমটা গেম বলেই মনে হয় ওর।
তবুও জোজো সত্যিই ওর ভালো বন্ধু আর আত্মীয় তাই প্রথমটা একদম সিধে না বলে বললো," দুষ্টু আমাকে অনেকদিন আগে বলেছে রে। আসলে বন্ধুত্বটাই খুব ভালো রে আমাদের। তুই প্রথম আমার ছেলেবন্ধু,দাদা,আত্মীয় সব। তাই এত একটা মিঠে আর ভালোবাসা ভরা দোস্তি একদম হারাতে চাইনা।"
মিষ্টির কথা শুনে কেমন যেন একটু বোকা বোকা হয়ে জোজো বলে," হারাবে কেন? হয়ত আরো ভালো হবে।"
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিষ্টি," সবটাই হয়ত তাইনা? হয়ত ভালো হবে,হয়ত জেম্মা রাগ করবে,হয়ত মণিমা আর বাবাকে ছোটো হতে হবে। হয়ত তুই আমাকে দয়া করছিস বিচ্ছিরি ভাবে ঠকে যাওয়ার জন্য।মানে বন্ধু হয়ে আমাকে হেল্প করতে চাইছিস? আমি এখন অনেক কিছু সইতে শিখেছি রে তুই ভাবিসনা।"
" বিশ্বাস কর সেই কালচিনিতে যেটা ভালো লাগা ছিলো এখন সেটা ভালোবাসা এর মধ্যে দয়া দাক্ষিণ্য কিছু নেই আর মা ঠিক তোকে মেনে নেবে।কেউ অসম্মানিত হবেনা সবাই খুশি হবে। আচ্ছা আমি মাকে বলবো।"
ওদের কথার মাঝেই মিষ্টির অ্যাপার্টমেন্ট এসে গেছে। গাড়ি থেকে নেমে যায় মিষ্টি।
মাকে বলতেই অবাক হলো মধুমিতা... "মিষ্টি! মিষ্টিকে ভালো লাগলো তোর?"
মায়ের সাথে এখন অনেকটা বন্ধুত্ব জোজোর যাকে অনেক কিছু বলা যায় এমনকি বন্ধুত্ব প্রেম ভালোবাসা ভালোলাগা খুব খারাপ লাগা সবটুকু একদম অকপটে।
তাই বললো," সেই কালচিনিতে প্রথম গিয়ে ওকে ভালো লেগেছিলো। আসলে ও আমাদের বাড়িতে কম আসতো দুষ্টুই বেশি আসতো।ভীষণ শান্ত আর সুন্দর ছিলো মিষ্টি।পড়াশোনাতে কত আমাকে হেল্প করেছে ও আর দীপ্ত ভাবতেই পারবেনা।"
মধুমিতা বলে," এটাই তো বন্ধুত্ব যার মধ্যে কোন শর্ত,চুক্তি কিছুই থাকেনা। শুধুই নিখাদ ভালোবাসা আর পাশে থাকার সন্ধি।"
" হ্যাঁ মা ঠিক বলেছো কিন্তু তুমি হঠাৎ বললে কেন মিষ্টিকে তোর ভালো লাগে?"
মধুমিতা ঠিক কি বলবে ভেবে পেলোনা, কালচিনিতে অনেকবার গেছে ও জোজোর জন্য ওরাও ওদের বাড়িতে এসেছে অনেকবার তবুও কেন যেন মধুমিতার মনে হয় মিষ্টি একটু বেশি আত্মসচেতন নিজেকে নিয়ে। কখনো বা একটু অহঙ্কারী আর স্বার্থপরও সেই তুলনায় দুষ্টু অনেক বেশি সরল,সাদামাটা আর প্রাণবন্ত।
তাছাড়া জোজো আর মিষ্টি প্রায় এক বয়েসী। এছাড়াও মধুমিতার মনে কেন যেন একটা খটকা যেটা হয়ত কিছুতেই ছেলেকে বলতে পারবেনা...মিষ্টি তো একটা ছেলেকে ভালোবাসতো মানে অনেকদিন ওর সাথে ঘুরেছে আজকাল প্রেমের কদিনের মধ্যেই শরীর এসে পড়ে। মিষ্টি হোটেলেও গেছিলো ছেলেটার সাথে। মনটা কেমন যেন ভারী হয়ে যায় মধুমিতার.. জোজোটা সরল,ভালো আর সত্যিই বুদ্ধিসুদ্ধি কম তাই তো চট করে ঠকে যায়।
কয়েকদিন ওদের বাড়িতে মিষ্টি থাকার ফল যে ভালোবাসায় যাবে তা ভাবেনি মধুমিতা।
দুষ্টু হলেও ঠিক ছিলো তাই বলে মিষ্টি!
মাকে চুপ করে থাকতে দেখে জোজো বলে," কি ভাবছো মা? চুপ করে আছো কেন? তোমার মিষ্টিকে ভালো লাগেনা?"
মধুমিতা বলে," মিষ্টির একটা অ্যাফেয়ার্স ছিলো জোজো। জানিনা সেটা এখনো আছে কি না? তারপর মিষ্টি কেমন যেন চুপচাপ। তোরা প্রায় এক বয়েসী। আমার তো দুষ্টুকেই বেশি ভালো লাগে।"
" মা তুমি যে কি বলো না,দুষ্টুকে তো আমি ছোট বোন বা ভাইও বলতে পারো এমনটাই মানি। ইশ্ ওর সাথে প্রেম!"
" কেন রে দুষ্টু তো খুব মিষ্টি আর প্রাণবন্ত। আমার তো ওকে খুব ভালো লাগে। মন মাতানো হাসি হাসে,পড়াশোনাতে ভালো,খেলাধূলাতে ভালো,ভালো লেখে......"
" ভালো মারামারি করে সেটাও বলো। উরিবাবা ও তো আমাকে মেরেই শেষ করবে।কি মারকুটে ছিলো তুমি দেখোনি..."
" ঠিক আছে তোর যা ভালো লাগে তাই কর। জোর করে তো কাউকে ভালো লাগানো যায়না।"
মায়ের এই কথাটা অনেকবার শুনেছে জোজো এর মানেই হলো আমার খুব একটা ইচ্ছে নেই এবার তুমি বোঝো।
কারো দিক থেকেই তেমন সায় পেলোনা জোজো,না মিষ্টি না মা। মনটা সত্যিই খুব খারাপ হয়ে গেলো কেন যেন মনে হলো মিষ্টি আর ওর মাঝে সায়মটা এখনো আছেই।
সায়ম যে সত্যিই আছে তা কিছুদিন বাদেই বুঝলো জোজো। মাঝে কেটে গেছে বেশ কিছু দিন। মন ভালো না লাগলেও ওরা কেউই বন্ধুত্বটাকে হারাতে দিলোনা তাই সম্পর্কের জটিলতা আর আনলোনা জোজো মনে মনে ভাবলো অপেক্ষা করেই দেখা যাক।
মিষ্টিকে নিয়ে একদিন বাইকে করে ফিরছিলো জোজো,হঠাৎই সায়ম ওদের সামনে দাঁড়ায়। প্রথমে মিষ্টিকে শাসায় তারপর জোজোকে ওর বোনকে হুমকি দেবার জন্য।
" এই যে সুন্দরী,জানি তোমার বয়ফ্রেন্ডের অভাব হবেনা তবে এত পুরোনো বয়ফ্রেন্ড থাকতে হঠাৎ আমাকে ফাঁসালে কেনো? আগে আমার কোমর জড়াতে এখন গলা জড়াচ্ছো।"
সায়মের সুন্দর চেহারার পেছনের নগ্ন বীভৎস চেহারা দেখেছে মিষ্টি। ওর কথা শুনে প্রতিবাদ করলেও গুটিয়ে যায়। জোজোকে বলে," চল এখান থেকে।"
তেড়ে আসে সায়ম," খুব তো আমার বোনকে শাসিয়ে হিরোইন নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে। আমি এর বদলা নিয়ে ছাড়বো।"
জোজো আর নিজেকে সামলাতে পারেনা বরাবর খেলাধূলা আর শরীরচর্চা করা শরীরটা কেমন যেন আর বাড়াবাড়ি সইতে চাইলোনা। তবুও মিষ্টির কথায় সংযত হতেই হলো। ভয়ে বুকটা কাঁপলো মিষ্টির এই ঘটনাটা নিয়ে অনেকটাই জল গড়িয়ে গেছে এর মধ্যে। ওর জন্য জোজোর কোন ক্ষতি হলে সেই ঘটনার আঁচ আবার পড়বে বাড়িতে।
শুধু একটু থেমে কড়া গলায় জোজো একজনের নাম বললো। আজকাল বোধহয় পুলিশের চেয়েও রাজনৈতিক নেতাকে কখনো মানুষ ভয় পায়।মুহূর্তে সায়মের চেহারার পরিবর্তন হলো। অবাক হয়ে গেলো মিষ্টি জোজো কোথা থেকে এত কিছু জোগাড় করেছে? সত্যিই কি ঐ যার নাম এক্ষুণি বললো তাকে চেনে?
সায়মের মুখ দেখে মনে হলো আর হয়ত ও
মিষ্টিকে বিরক্ত করবেনা। ওষুধটাতে কাজ হয়েছে।
সেদিনের পর জোজো আর মিষ্টির ওখানে আসেনি। বুঝতে পার মিষ্টি জোজোর অভিমান হয়েছে। অনেক দিনই তারপর আসেনি। তবে আজ ভাগ্যিস জোজো ছিলো!
মিষ্টিকে আজ আর রাস্তায় ছাড়তে পারলোনা জোজো।আসতেই হলো ওর ফ্ল্যাটের দরজা পর্যন্ত।
সত্যিই কি ভালোবাসা শুধুই মনের অনুভূতি? নাকি তার সাথে অনেকটাই জড়িয়ে থাকে নির্ভরতা। সেদিন হোটেলে হয়ত অবাক হয়েছিলো জোজোকে দেখে তারপর ওর ওপর নির্ভর করেছিলো। সেই সময় একটু একটু করে ওর নরম ঘা খাওয়া মনটাকে ভালো করেছিলো জোজোই। ওর খুনশুটিতে, মজায় আর বকুনিতে একটু একটু করে সাহস পেয়েছিলো ফিরে এসেছিলো আবার একটু একটু করে জীবনের ছন্দে।
আজ আবার ওর বিপদে সামনে এসে দাঁড়ালো জোজো। আজ মিষ্টির জোজোকে শুধুই বন্ধু মনে হলোনা,মনে হলো হয়ত এই অচেনা শহরে এমনি কাউকে পাশে চাই ওর যে ওর ভালো মন্দতে ওর পাশে থাকবে।
পরক্ষণেই মিষ্টির মনে হলো ভালোবাসা ও হয়ত একটা সন্ধি যার মধ্যে কি কখনো ফন্দীও থাকে? না না ওর তেমন কোন ফন্দী নেই তাই তো ও জোজোর ভালোবাসার ডাকে সাড়া দেয়নি শুধু বন্ধুত্ব জড়িয়ে নিয়েই আছে।
ভেতরে এসে জোজো ঢকঢক করে কিছুটা জল খায়.." কেন আটকালি আমাকে? আজ বুঝিয়ে দিতাম ছেলেটাকে শিলিগুড়ির ছেলেরা ঘাস খায়না। মেরে মুখ ফাটিয়ে দিতাম।"
" কোন দরকার নেই,তোর সামনে অনেক কিছু আছে বাজে ঝামেলায় জড়াসনা। তবে তুই সত্যিই ঐ রাজনৈতিক নেতাকে চিনিস? তুই কি আজকাল রাজনীতি করিস নাকি?"
ঘাড় নাড়ে জোজো," না রে সংবাদ মাধ্যমে থাকলে একটু যোগাযোগ হয়ে যায় অনেকের সাথেই। আমি একটু বলে রেখেছি রে।"
" তাই তো তোর ওপর ভরসা করি।"
জোজোর চোখে হাসি খেলে যায়.." সত্যিই ভরসা করা যায়?"
মিষ্টির সেই শান্ত হাসিটা বলে যায় অনেক কিছু। মনে একঝলক খুশির হাওয়া মেখে বাড়ি ফেরে জোজো।
**********************
দার্জিলিংয়ে একটু গুছিয়ে নিলেও নিজেকে সেখানেও সামলে রাখতে পারলোনা দীপ্ত। পাহাড়ের ঘোরানো পথে স্কুলে যাবার সময় হঠাৎই একদিন দেখা হয়ে গিয়েছিলো শিশিরদার সাথে। ওকে ছাড়েনি কথায় বিঁধতে," বাহ্ বেশ ভোল পাল্টে ফেলেছিস তো দেখছি।আমি তো চিনতেই পারিনি। পার্টি থেকে বেরোলি ইউনিভার্সিটি পড়লিনা আমি তো ভাবলাম উবেই গেলি। অথবা ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট দীপ্ত আবার হয়ত হঠাৎই উদয় হয়েছে কোথাও মানে আকাশে তার দীপ্তি নিয়ে। সেখানে এই মাস্টারি তাও আবার প্রাইভেট স্কুলে,ক টাকা দেয় রে?"
বাড়ি ফিরে এসে মনটা ভেঙে গিয়েছিলো দীপ্তর। মা বুঝিয়েছিলো খুব তবুও মনে জেদ চেপে গিয়েছিলো হয়ত শিশিরদাই খুঁচিয়ে দিয়েছিলো ঠাট্টা করে ওর মনের আগুনটা।
পুরোনো বইপত্র নিয়ে আবার বসেছিলো,নাহ্ এবার একটা ভালো ফোন অথবা ল্যাপটপ রাখাটা জরুরী।এভাবে সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে পড়াশোনা করা অসম্ভব। কিন্তু খরচ? তবুও জেদ চেপে গিয়েছিলো দরকারে আরো কিছু ছাত্রকে পড়াবে।
************
নিজের পড়াশোনার মাঝে অনেকদিনই দীপ্তদার কথা মনে হয়েছে দুষ্টুর। একবারও ফোন করলোনা দীপ্তদা। তাহলে কি বাবাকে বলা কথাটা মিথ্যেই হলো?
মাঝে মাঝেই নম্বরটা চোখে পড়ে দুষ্টুর,কিন্তু ইস্কুলের নম্বরে ফোন করাটা কি ঠিক হবে?
আজকাল মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে কোথাও গিয়ে ঘুরে আসতে কয়েকদিনের জন্য। দিদিকে বলছিলো," দিদি যাবি কয়েকদিনের জন্য কোথাও? মনটা কেমন যেন একলা হয়ে যায় মাঝেমাঝে।"
মিষ্টি হাসে," সারাদিন লম্ফঝম্প,বাস্কেটবল আরো ইত্যাদি ইত্যাদি না করে এবার একটা প্রেম কর দেখি। জোজোর বন্ধু অভ্রর তোকে খুব পছন্দ তুই বললে কথা বলি। একদিন জলপাইগুড়ি চলে যাবে। বেচারা ফিদা একদম তোর ওপর।"
দুষ্টু বুঝতে পারে দিদিটা হয়ত একটু বেশিই খুশি আছে। জোজোদার ফেসবুকের স্ট্যাটাসে দেখে ইন আ রিলিশনশিপ। মনটা আর খারাপ হয়না দুষ্টুর সয়ে গেছে সবই।
আচ্ছা দার্জিলিং গেলে কেমন হয়?
রবীন দুষ্টুর কথা শুনে এক কথায় রাজি হয়ে গেলেও অনু আপত্তি করে।
" মিষ্টি যাবেনা,তারপর তুমি জানো তো আমার বমি হয় পাহাড়ে উঠতে।"
হাসে রবীন," রাণুকে নিয়ে নি তাহলে আর বমি হবেনা।আমরা এবার গাড়িতে যাবো অনু। তুমি ওষুধ খেয়ে নিয়ো।"
কেন যেন দুষ্টুর মনে হলো বাবার একটু বেশিই উৎসাহ। হয়ত দীপ্তদাকে দেখতে চায় বাবাও,কিছু বলতেও চায়।
তাই প্যাকিং করতে করতে দুষ্টু ঠিক করে নেয় যেদিন পৌঁছবো পরদিন ধরবে দীপ্তদাকে সোজা আনবে টেনে বাবার কাছে।
অনু প্রথমে কিন্তু করলেও দুইবোনে গল্পে মেতে উঠলো।সত্যিই আবার অনেকদিন বাদে পাহাড়ে। রবীনের মন ছুঁলো পাহাড়ের রূপ,রঙ আর গন্ধ।
"শোনো আমি শুধু হোটেলে বসে পাহাড় দেখবো,তোমরা যা পারো করো।"
দুষ্টু বোঝে বাবা আজকাল যেন বেশ মানসিক ক্লান্তিতে কষ্ট পায়। যাক একবার দীপ্তদাকে আনলেই বাবা জমে যাবে।
পরদিন সকালে ঐ জায়গাটায় অপেক্ষা করেও দীপ্তকে পেলোনা দুষ্টু তাই গুটিগুটি পায়ে স্কুলের পথে। ওখানে গিয়ে অবাক হলো দুষ্টু দীপ্তদা নাকি চাকরি ছেড়ে দুমাস আগে চলে গেছে।
মনটা ভারী হয়ে যায় দুষ্টুর তবুও বলে যদি ফোন করে কোন কারণে তাহলে একবার এই নম্বরে যেন ফোন করে। নিজের নম্বরটা আবার রেখে দেয় অপেক্ষায় দুষ্টু। ইশ্ কেন যে এতদিন ফোন করেনি! বোহেমিয়ান দীপ্তদাকে কোথায় পাবে?
******************
কালচিনির সকালও খুব সুন্দর লাগে রবীন,আসলে ভোরের বোধহয় একটা আলাদা সৌন্দর্য্য আছে। আলো ছড়ায় সূর্য আর আঁধারের ঘোমটা খুলে সেই আলো মুখে মাখে পৃথিবী। ভোরের পৃথিবী হাল্কা আলোতে রাঙা হয়ে লালিমায় হয় ভরপুর।
সকালে ঘুম ভাঙতে একটু দেরিই হয়েছে রবীনের। শীতের ওমটুকু গায়ে জড়িয়ে নিতে নিতে আলসে শরীরের একটু লেপের আদরে মাখামাখি করা ছুটির আনন্দে।
বাইরে তখন রাণু,জয় আর অনুর কিচিরমিচির।ওরা বারান্দায় বসে আড্ডা দিচ্ছে তার মধ্যে রাণুর বর শুভর ফোন। একদিক দিয়ে শুভ খুব ভালো, দিদি কোথাও যেতে বললে ছেলে বৌকে ছেড়ে দেয়।হয়ত এটুকু বুঝতে পারে রাণুকেও একটু সংসার থেকে আনন্দের মুক্তি দেওয়া দরকার যদিও ব্যাঙ্কের ম্যানেজারি ছেড়ে নিজে আসতে পারেনা সবসময়। দেখতে দেখতে জয়ও বড় হয়ে গেলো।টেন হবে এবার সুতরাং রাণুরও চাপ বেড়েছে।
দুষ্টুকে দেখতে পায়না রবীন.." দুষ্টু কোথায় রে জয়? নিচে নেমেছে নাকি?"
" হ্যাঁ মেসো,ছোট্টু বললো ও হাঁটতে যাচ্ছে। আমাকেও বলছিলো আমি গেলাম না।"
" গেলেই তো পারতিস খুব ভালো লাগতো। ইশ্ আমাকে ডাকলোনা!"
" তুমি ঘুমোচ্ছিলে তো,বললো বাবার মনটা আর শরীরটা অনেক কাজ করে এখানে একটু আরাম করুক। বেলায় যাবে।"
অনু গজগজ করলেও রবীন অত ভাবেনা,মেয়েরা বড় হয়েছে আর কতদিন মা বাবার হাত ধরে ঘুরবে?
তাছাড়া দুষ্টু এর আগেও এসেছে এখানে,আর ফোন তো আছেই চলমান ফোনের এই এক মজা... যতক্ষণ প্রাণ আছে ফোনে, ততক্ষণ জানা যাবে তুমি আছো পৃথিবীর কোন কোণে?
যাক নিশ্চিন্তে রোদ মাখা দার্জিলিংয়ের শোভা দেখতে দেখতে সুগন্ধে ভরা দার্জিলিং টিতে ঠোঁট ডোবায় রবীন।
রাণু বাড়িতে একটু আধটু শুনছে মানে কানে এসেছে যদিও দিদিভাই ওকে সরাসরি কিছু বলেনি তবুও ওর মনে হচ্ছে জোজোকে নিয়ে একদিন একটু কথা কাটাকাটি হচ্ছিলো দাদাভাই আর দিদিভাইয়ের মাঝে। অবশ্য রাণুকে দেখে দুজনেই চুপ করে গেছে তবুও তার মাঝেই মিষ্টির নামটা কানে এসেছে ওর আচ্ছা দিদি বা জামাইবাবু কিছু জানে?
মিষ্টির সঙ্গে কি জোজোর কিছু? কৌতূহল হলেও কথাটা আর তুললোনা রাণু।বেড়াতে এসে সবার মন ভালো, মিষ্টিটাও খোঁজ নিচ্ছে বারবার আর বলছে তোমরা ভালো করে ঘুরে এসো,আমি খুব ভালো আছি এর থেকে ভালো আর কি হতে পারে? তাই থাক আজকের আনন্দটা মুঠোতে ভরা।
***************
কিছুক্ষণ বাদেই দুষ্টু এলো মুঠোতে একগুচ্ছ পাহাড়ী রঙবেরঙের ফুল। পাহাড়ের অনেকটা চড়াই ভেঙে উঠেছে বোধহয় মেয়েটা ওর গালদুটো চকচক করছে তাতে লালচে আভা। রাণু অবাক হয়ে যায় দুষ্টুর শরীরে বসন্তের আনাগোনা।এই সময় মনে হয় সব মেয়েকেই সুন্দর লাগে তবে দুষ্টুর কেয়ারলেস বিউটি বোধহয় ওকে এত সুন্দর করেছে। স্মার্ট, ঝকঝকে দুষ্টুকে দেখে রাণুর মনে হলো ছোট চুলেই বোধহয় বেশি সুন্দর লাগছে দুষ্টুকে। যদিও দিদি খুবই অভিযোগ করলো.." দেখেছিস বেশি শিক্ষিত হওয়ার নমুনা। ফাইনাল ইয়ারে উঠে ল্যাজ গজিয়েছে কেমন।"
দুষ্টু যদিও গড়াগড়ি খেলো আর হাসলো মায়ের কথাতে পাত্তাও দিলোনা।
রাণুর ভাবনার মাঝেই দুষ্টু বললো," উফ্ অনেক ক্যালরি ঝরিয়ে এলাম গো।তোমরা শুধু ঘুমোও আর এখানে ব্যথা সেখানে ব্যথা করো।"
" হয়েছে অনেক এবার নে চা খা।"রাণু বলে।
হাত পা ছড়িয়ে বেতের সোফায় বসে পড়ে দুষ্টু," ধ্যাৎ কিছুই হলোনা,শুধু হাঁটাই হলো।"
" কি হবার ছিলো রে? কোন বন্ধু টন্ধু?" রাণু বলে।নিজেকে সামলায় দুষ্টু। ভেবেছিলো বাবাকে সারপ্রাইজ দেবে কিন্তু কিছুই হলোনা।
তবে এই কথাটা বাবাকে বলা যাবেনা।বাবার খারাপ লাগবে।
বাবা যে কখন পেছনে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারেনি দুষ্টু শুধু কথাটা কানে যেতেই বুঝলো বাবা মায়েরা অনেক না বলা কথা জেনে যায়।ওদের বোধহয় মাথার পেছনেও দুটো চোখ আছে।
" দীপ্তটাকে ধরে আনতে পারলিনা তাইতো? সে নিশ্চয় এখানে আর নেই।"
'' বাবা.. তোকে না দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম এই সাতসকালে হয়ত কিছু সাতকাহন করার জন্য মেয়েটা ছুট লাগিয়েছে কোথাও।"
সত্যিই মুখটা একদম বুদ্ধুরামের মত হয়ে যায় দুষ্টুর।
বাবাকে আর কি বলবে বাবা সবই বুঝতে পেরেছে তাহলে। হয়ত বাবারও ইচ্ছে ছিলো দীপ্তদার সাথে দেখা করার। হয়ত না কথাটা বাবার মনের সেটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারে দুষ্টু।
পাহাড় দেখতে দেখতে বাবা ম্যাজিসিয়ানের মত জেনে নিলো ওর মনের সব কথা। ও সকালে অনেকটা সময় শুধু অপেক্ষা করেছে দীপ্তর জন্যই।
" বুঝেছি,এই জন্যই এত দার্জিলিং আসার বায়না। তবে ও একদিন ঠিক আসবে আমার বিশ্বাস। মানে মাথা উঁচু করে ফিরে আসবে দেখিস। আমি সব বুঝতে পারি।"
সত্যিই কি মানুষ সব বুঝতে পারে? মা বাবাও হয়ত সবসময় বুঝতে পারেনা সন্তানের মনের কথা। তাই ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর দুষ্টু যখন চাকরি নিলোনা অবাক হলো রবীন।
কলেজে ভালো রেজাল্ট করার জন্য ওর চাকরি পেতে কোন অসুবিধা হলোনা। তবুও কেন যেন বেঁকে বসলো দুষ্টু।
অবাক হলেও মেনে নিলো রবীন শুধু বললো," তুই যখন এই লাইনেই থাকবিনা অযথা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়ে একটা সিট নষ্ট করলি কেন?
এই প্রথম বাবার কথার ওপর কথা বললো দুষ্টু," ওটা তোমার ইচ্ছে ছিলো বাবা,তুমি আমাকে কলকাতা পাঠাওনি।আমিও জোজোদার মত অনার্স পড়তে চেয়েছিলাম ভালো কলেজে তুমি রাজি হওনি বলেছিলে এত খরচ একসাথে সামলানো যাবেনা।কারণ দিদি তখন ওখানে পড়ছে।আচ্ছা বাবা সবসময় দিদি সব ব্যাপারে এগিয়ে থাকবে আর আমি পিছিয়ে থাকবো কেন? দিদি ইঞ্জিনিয়ার বলে কি আমাকেও ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে? একটা চাকরি করতে হবে আমি স্বপ্ন দেখি একটা অন্য কিছুর। বড় কিছু হতে চাই জীবনে,দিদির চেয়েও বড়।"
একনাগাড়ে অনেকগুলো কথা বলে হাঁফিয়ে যায় দুষ্টু।আজ যেন মনের সব কথা মুখে চলে আসে।শুধু ভালোবাসার কথাটাই বলতে পারেনা। দিদিই সব পাবে,ওর জন্যই সব থাকবে? এই পৃথিবীতে ওর কি কিছুই থাকবেনা? ছোট থেকে সব সময় দিদির মত হয়েছে মানে সবাই তাই বলেছে ওকে হতে। আজ ওর নিজের মত হবার ইচ্ছে।
"দেখেছো কি অবস্থা! কত কথা ওর মনের মধ্যে আছে। দুষ্টু এত হিংসুটে তুই আমি ভাবতেই পারছিনা। ঠিক আছে পড়বি পড় তবে চাকরিটা নিয়ে নিলে পারতিস। কেন চাকরি করতে করতে পড়া যায়না? পরে ভালো কিছু পেলে ছেড়ে দিতিস।"
রবীন ইশারায় থামতে বলে অনুকে। দুষ্টুর তখন চোখ ভর্তি জল। ওকে কাছে ডাকে রবীন মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়.." পাগলী একটা আমার। আচ্ছা তোকে চাকরি করতে হবেনা,তুই পড় যত খুশি। বিয়ের সময়ও আমি চুক্তি করেই নেবো আমার মেয়ে যত খুশি পড়বে।"
" আমি তোমাদের কাছে থাকবো বাবা,আমাকে রাখবেনা তোমাদের কাছে?"
হাসে রবীন," মনে থাকে যেন পরে আবার বলিসনা,বাবা বিয়ে দিয়ে দাও অনেক হলো।"
জলভরা চোখেও একঝলক খুশি ঝিলিক দিয়ে ওঠে দুষ্টুর আদুরে গলায় বলে," বাবা।"
রবীন আদরে কাছে টানে মেয়েকে। অনুও পাশ থেকে মাথায় হাত রাখে.." এমন কেন ভাবিস আমাদের কাছে তোরা দুজনেই আদরের।"
********************
রাতে কিছুতেই ঘুম আসেনা রবীনের বুঝতে পারে মেয়েটার মনে কোথাও একটা দুঃখ আছে যেটাকে সফলতার আগুনে পুড়িয়ে দিতে চায়।
হয়ত মা বাবা হিসেবে ওরা বেশি প্রাধান্য দিয়েছে বড় মেয়েকে।সত্যিই তো দুষ্টুকে কলকাতার কলেজে পড়তে পাঠায়নি একটা সময়। কি জানি ওর কি ইচ্ছে ছিলো?
নেটে ঘেরা বারান্দার সামনে এসে দাঁড়ায় রবীন। দুষ্টুর ঘরের আলো নেভানো নিশ্চয় মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে। মনটা আজ যেন একটু বেশিই অশান্ত রবীনের মিষ্টির সাথেও একটু কথা বলতে হবে দুষ্টুর ব্যাপারে।ভালো করে জানতে হবে দুষ্টু কি করতে চায়,দরকারে ওকে কলকাতা পাঠিয়ে দিতে হবে যদি ওর কোচিং লাগে।
মিষ্টি খুশি হলো শুনে দুষ্টু আরো পড়তে চায়.." বাবা ও কি করতে চায়,কি পরীক্ষা দেবে সেসব তো জানো আগে।এখানে থাকতেই পারে আমার আপত্তি নেই।বরং মজাই হবে,দুজনে একসাথে থাকবো।"
কখন যে দুষ্টু এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি রবীন।ওদের কথার মাঝেই ও বলে," এখনি কলকাতা গিয়ে থাকার দরকার নেই আমি ওখান থেকে বইপত্র নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি।তারপর দরকার হলে গিয়ে থাকবো। কারণ পড়াশোনা করতেই তো কয়েকটা বছর যাবে। তুমি আমার সাথে থাকবে তো বাবা?"
দুষ্টুর মাথায় হাত রাখে রবীন.." এগিয়ে যা তোর স্বপ্নকে সাথে নিয়ে।সবসময় আছি সাথে।"
*****************
ট্রেনে করে একা একাই কলকাতা গেলো দুষ্টু,বাবা যদিও বারবার বলছিলো সঙ্গে আসার জন্য রাজি হয়নি। দিদি সেই কবে থেকে একা যাতায়াত করে। ট্রেনে বসে বসেও ল্যাপটপ নিয়ে নিজের কাজেই মন দেয় দুষ্টু। কালকেই বেরোবে কলেজ স্ট্রীটে। দুষ্টুর কাছে এখন অনেক জায়গাই চেনা হয়ে গেছে। এর আগেও বেশ কয়েকবার এসেছে কলকাতায়।
তবে দিদি যে এত কাজের হয়ে গেছে ভাবতেই পারেনি দুষ্টু, ফ্ল্যাটটাকে সাজিয়ে গুছিয়ে সুন্দর করে রেখেছে। টেবিলে কাঁচের পাত্রে লাকি বাম্বু আর ফুলের গোছা।বারান্দায় হ্যাঙ্গিং টবে কিছু মরসুমী ফুল।
" দিদি অফিস করিস,রান্না করিস আবার এত কিছু করেছিস কখন? কালচিনিতে তো কিছুই করতিসনা।"
বোনের প্রশংসা আদরে গালে মাখে মিষ্টি.." এ ও আসছে,একটু পরিষ্কার না থাকলে লোকে বলবে কি?"
বারান্দায় দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি করে দুষ্টু.." এ ও কে আসে রে? আমাকে নজর দিতে হবে এবার। ইস্ এখান থেকে তো ভালো করে আকাশই দেখা যায়না।"
" এটা কলকাতা বোন এখানে আকাশও দামী সবাইকে দেখা দেয়না। আর এ সে এক্ষুণি আসছে তোকে নিয়ে যাবে কলেজস্ট্রীটে। তুই বলেছিলি বই কিনতে যাবি। আমার তো অফিস আছে ও যাবে তোর সাথে।"
দুষ্টু বুঝতে পারে জোজোদার কথা বলছে দিদি,কিন্তু ও জোজোদার সাথে যাবে কেন? ও কি বাচ্চা! ও একাই যাবে।
একটু বাদেই জোজোদা আসে,দুষ্টুকে দেখে আনন্দে হৈ হৈ করে ওঠে.." জমে যাবে এখন কয়েকটা দিন। দুষ্টু এসে গেছে, কি মজা!"
একটুও পাল্টায়নি জোজোদা পকেট থেকে চকলেট বের করে দুষ্টুর হাতে দেয়," পুরোটা একা খাবি,দিদিকে দিবিনা খেয়ে খেয়ে মোটা হচ্ছে।"
মিষ্টি এসে আদুরে গলায় বলে," একটু দিস বোন।"
অনেকদিন বাদে জোজোদাকে দেখে বেশ ভালো লাগলো।ভালোবাসা আর প্রেমের ফিলিংসটা ভ্যানিশ হয়ে গেছে অনেকদিন তাই আর মন কেমন করলোনা।
তবে দুষ্টু কিছুতেই রাজি হলোনা জোজোর সাথে কলেজস্ট্রীটে যেতে।অনেক ধমকে মিষ্টি রাজি করালো জোজো ওকে কলেজস্ট্রীটে নামিয়ে দিয়ে চলে যাবে। তারপর দুষ্টু একা ফিরবে। জোজোর বাইকে বসে দুষ্টু.." ভালো করে ধরে বোস,মাঝ রাস্তায় পড়ে যাসনা আবার।"
" আমি না ধরলেও পড়বোনা,তুই সর আমি চালাই।" দুষ্টু বলে।
" এতো সাঙ্ঘাতিক হয়ে গেছে কিছুদিনেই দেখছি।" হাসে জোজো।
কলকাতার পথে চলতে চলতে মনটা হারিয়ে যায় দুষ্টুর। কিভাবে কি যেন হয়ে গেলো কতদিন এমন স্বপ্ন দেখেছে জোজোদার বাইকের পেছনে বসবে ও। আজ সেটাই হয়েছে,সম্পর্কটা আগেও ছিলো এখনো আছে শুধু রঙ বদল হয়েছে।
কলেজ স্ট্রীটে ওকে নামিয়ে জোজো চলে যায় বার বার সাবধান বাণী শুনিয়ে।
দোকানে খুঁজে খুঁজে বই দেখতে থাকে দুষ্টু মাঝে মাঝে ফোনে দেখে নামগুলো...." না না এটা নয়,দেখুন না যদি এটা হয় ভালো হয়।"
হঠাৎই শুনতে পায় ওর কাঁধের পাশ দিয়ে কে যেন মুখ বাড়িয়ে ওর কানের কাছে বলছে.." এই বইটা ভালো হবে। আর ঐ যে ওটাও নিতে পারিস।"
অবাক হয়ে তাকায় দুষ্টু... "আরে দীপ্তদা! হোয়াট আ সারপ্রাইজ তুমি এখানে?"
দীপ্তর মুখে সেই লাজুক একটা হাসি শুধু মনে হলো দার্জিলিংয়ে দেখা দীপ্তদা যেন একটু ম্লান হয়ত আরো বেশি যোদ্ধা।
" আমি মাঝে মাঝে আসি রে সব বই তো কিনতে পারিনা তাই একটা দুটো বই কেনার ফাঁকে অন্য বইগুলোতে চোখ বোলাই তারপর কখনো মগজে আর কখনো কাগজে কিছু তুলি তারপর আবার ইন্টারনেট দেখে চেষ্টা করি জোগাড় করার।"
" কি জোগাড় করার? মানে তুমি ইন্টারনেট দেখো? তোমার ফোন নম্বরটা একটু দেবে?"
বইয়ের দোকানের ভদ্রলোক একটু বিরক্ত হয়।ততক্ষণে ভিড় জমেছে দোকানে।
-"আপনার বইগুলো আমি দেখে রাখছি,আপনার যদি একটু বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলেন ভালো হয়।আসলে ছোট দোকান তো।"
দুষ্টুর মাথাটা গরম হয়ে গেলেও বুঝতে পারে ব্যাপারটা সত্যিই ওনার কিছু করার নেই।
হঠাৎই দীপ্ত বলে," শোন আমার কিছু কাজ আছে তুই বই আর যা কিছু কিনবি কিনে ইউনিভার্সিটির সামনে দাঁড়াস আমি থাকবো।"
হঠাৎই দুষ্টুর মনে হয় দীপ্ত হয়ত আবার হারিয়ে যাবে।তাই কেমন যেন এক সেকেন্ডেই ওর মাথা কিছু বলার আগেই রিফ্লেক্সে দীপ্তর হাতটা চেপে ধরে দুষ্টু। বই কেনার আগে বোধহয় দীপ্তকে চেপে ধরে রাখাটাই জরুরী যাতে ও কিছুতেই চলে যেতে না পারে।
বাবাকে তাহলে কি বলবে ও?বাবা ভাবে দীপ্তদা সেই অন্য ছাত্রদের মতই একটা সময়ের পর স্কুলের স্মৃতি যাদের কাছে আবছা হয়ে যায়।মুছে যায় স্যারেরা মন থেকে।
অবাক হয়ে যায় দীপ্ত,হয়ত ওর কাছে এটাই দুষ্টুর প্রথম স্পর্শ।অনেক সময়ই খেলার ছলে বা দুষ্টুমি করে পেয়ারা ছুঁড়ে দিয়েছে দুষ্টু।কিন্তু আজ যেন দুষ্টু জড়িয়ে রেখেছে ওকে। তাই কাজ আছে বলে আর বাইরে আসতে পারেনা দীপ্ত।দুষ্টুও হঠাৎই হাত ধরে কেমন যেন একটু বোকা বোকা হয়ে যায় তাই পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে বলে.." চট করে কাজটা সেরে নিচ্ছি তুমি যেয়োনা প্লিজ কতদিন বাদে দেখা হলো।অনেক কথা আছে তোমার সঙ্গে।"
দীপ্ত আর যেতে পারেনা দুষ্টুমি ভরা দুষ্টুর মুখে আজ এমন একটা অনুরোধ যা এড়ানো সম্ভব হয়না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বইয়ের দোকানের কাজটা মিটে যায়। বইগুলো ব্যাগে নিয়ে এগিয়ে চলে ওরা।
দুষ্টুর মনে ভীড় করে আসে কত স্মৃতি কখনো যা ভাবেনি তাই বোধহয় ঘটে যায় হঠাৎই। দুষ্টু জীবন থেকে হারিয়ে যেতে দেয়না কিছুই, যা হারিয়ে যায় তাকে পূরণ করে নিজের আত্মবিশ্বাস আর পজেটাভিটি দিয়ে।তাই বোধহয় ভাঙার দুঃখ থেকে গড়ার আনন্দটুকু নিয়েই থাকতে চায়।
..." তুই চল তোকে একটা ভালো বইয়ের দোকানে নিয়ে যাই।আরো কিছু বই লাগবে তোর মনে হয়।"
" তুমি এত কিছু জানলে কি করে? আমি তো তোমাকে কিছুই বলিনি আমার কি বই লাগবে?"
অবাক হয়ে যায় দুষ্টু, হাসে দীপ্ত।
" কোন ছোটবেলা থেকে তোকে দেখছি বল,এইটুকু তো জানতেই হবে। আমি বুঝতে পেরেছি ইঞ্জিনিয়ারিং টা তোর প্যাশন নয় এবার তুই ছুটতে চাস।"
প্রায় ছুটতে ছুটতেই কথাগুলো বলে দীপ্ত,ওহ্ যেমন লম্বা তেমন হাঁটতেও পারে।দুষ্টুও দৌড়য় ওর সাথে,ট্রামলাইন আঁকা বড় রাস্তাটা পার হচ্ছে ওরা। হঠাৎই দীপ্ত ওর হাতটা ধরে.." কলকাতাতে একটু সাবধানী হতে হয়।এমন অন্ধের মত হাঁটলে হবে? এক্ষুনি বিপদ হতো।"
দুষ্টু রাস্তার ওপারে এসে একটু হাঁফিয়ে নেয়.." উঃ কিছু ছুটতে পারো তুমি! তাই তো তোমাকে দেখতে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম।"
কেন যেন দুষ্টুর মনে হলো বাবার শিক্ষা আর শিক্ষার আলো ছড়িয়ে আছে চারদিকে।দূরে থেকেও বাবা এভাবেই হাত ধরে রেখেছে ওর। দীপ্তদার সাথে দেখা নাহলে এত সহজে বইপত্র কেনা হতোনা। বাবার ছাত্ররা বোধহয় পৃথিবীর সব জায়গাতেই আছে ছড়িয়ে।আজকাল ফেসবুকের দৌলতে কত ছাত্রই আবার এসেছে এক ছাদের তলায়।হয়ত কোন স্মৃতিই হারিয়ে যায়না।
দুষ্টুর ফোনটা বেজে ওঠে,দীপ্ত পাশের দোকানে কয়েকটা জিনিস কিনছে...
---" আমি যাবো তোকে আনতে? হয়নি তোর এখনো? কলেজস্ট্রীটে হারিয়ে গেলিনা তো কালচিনির ডাকুরানী?"
জোজোদা সেই পরিচিত গলায় ওর সাথে ফোনে কথা বলছে। আজকাল আর কোন অভিযোগ নেই দুষ্টুর ওর প্রতি আরে ও তো জানারই সুযোগ পায়নি দুষ্টুর মনের কথা।স্টেশনে পৌঁছতেই দেরি করে ফেলেছিলো দুষ্টু ততক্ষণে জোজোদা অন্য ট্রেনে উঠে পড়েছিলো।
--" আমি একদম ঠিকঠাক আছি ভাবিসনা,তুই বাড়ি যা কাজ হয়ে গেলে।আমি দিদিকে বলে দিয়েছি আমার ফিরতে একটু দেরি হবে।"
" কেন রে? আরো কেউ আছে নাকি তোর সাথে? এতক্ষণ বই কিনতে লাগে নাকি?"
" হ্যাঁ আছে,আমি তার সাথে ঘুরে ফিরে বাড়ি যাবো। তোর কি?"
ওপার থেকে জোজোর হাসির আওয়াজ পাওয়া যায় ফোনটা কেটে দেয় দুষ্টু।
কেন যেন দীপ্তদার কথাটা আজ মনের আলমারিতে বন্ধই রাখলো দুষ্টু।প্রতিবার বলেছে সবাইকে দীপ্তদাকে দেখেছে অথচ কখনো দীপ্তদাকে মেলাতে পারেনি বাবার সাথে আর জোজোদার সাথে। হয়ত দীপ্তদা কোথাও একটা পৌঁছে তারপর দেখা করতে চায় সবার সাথে।শুধু কেন যেন দুষ্টুর সাথেই বারবার দেখা হয়ে যায় দীপ্তর,কখনো পাহাড়ে আবার কখনো সমতলে। আর বারবারই এক নতুন দুষ্টুকে দেখে দীপ্ত,তবে কেউ কাউকে পুরোটা জেনে উঠতে পারেনা।
একটা সময় দীপ্তর কাজ শেষ হলো,দুষ্টু দেখে দীপ্তদার মুখটা ততক্ষণে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত।
দুষ্টুর কাছে এসে বলে," বাড়ি যাবি তো? মানে কোথায় উঠেছিস?তোকে বাসে তুলে দিই বরং।"
দুষ্টুর মনটা যেন কেমন করে ওঠে,আজ যদি দীপ্তদাকে একটু জোর করে তাহলে কি বাড়াবাড়ি হবে? হোক বাড়াবাড়ি, ও তো দিদিকে বলেছেই ওর দেরি হবে ফিরতে।
দুষ্টু সত্যিই হয়ত জোর করতে জানে অনেকটা স্যারের মত তাই দীপ্ত প্রথমে না বললেও পরে আর কিছু বলতে পারেনা।
...." আমার খুব খিদে পেয়েছে আর তুমিও খাবে আমার সাথে। কথাই তো হলোনা তোমার সাথে।কোথায় আছো? কি করছো? আর তোমার ফোন নম্বর?"
কলকাতা দার্জিলিং নয়,নেই এখানে পাহাড়ের সৌন্দর্য্য আর কখনো অবকাশে ডুব দেওয়া তবুও কফির কাপ আর স্যান্ডউইচ তো আছে এখানেও। কফি হাউসের ওপরটায় একটু ফাঁকা দেখে বসে দুষ্টু আর দীপ্ত।
" আমরা দার্জিলিং গেছিলাম। তোমাকে খুঁজেছি তোমার স্কুলে পাইনি।"
" আমি জানি ওরা বলেছিলো,পরে একবার যেতে হয়েছিলো।"
" তোমার মগজ থেকে কি আমার নম্বরটা মুছে গেছে? একবার ফোন তো করতে পারতে।"
দীপ্ত গড়গড় করে দুষ্টুর দশ সংখ্যার মোবাইল নম্বরটা বলে যায়। অবাক হয়ে যায় দুষ্টু। দীপ্তদা!
" ফোন করেছিলাম তো,তুই ধরিসনি।"
অবাক হয়ে যায় দুষ্টু.." কবে?"
প্রায় ছমাস আগের একটা তারিখ আর সময় বলে দীপ্ত। স্মৃতির পাতা হাতড়ায় দুষ্টু,ঐ সময় প্রায় ফোন আসতো আননোন নম্বর থেকে ওর ফোনে,জোজোর বন্ধু অভ্র খুব ডিস্টার্ব করেছে কিছুদিন তাই হয়ত ধরেনি।
হাসে দুষ্টু.." ইশ্ আমি ল্যান্ডফোন দেখে আর ধরিনি। ভেবেছিলাম হয়ত কোম্পানির নম্বর।জানো বাবা গেছিলো তখন,তোমাকে খুব মিস্ করেছে। একবার এসো প্লিজ আমাদের বাড়ি। আর তোমার ফোননম্বরটা দাও।"
দশ সংখ্যার নম্বরটা নিয়েও স্বস্তি পায়না দুষ্টু ডায়াল করে নম্বরটা,দীপ্তর পকেটে নিজের ছন্দে বাজতে থাকে ফোনটা। নিশ্চিন্ত হয় দুষ্টু।
দীপ্তকে আজ আর কুয়াশাচাপা মন নিয়ে থাকতে দেয়না দুষ্টু। হঠাৎই ঝলমলে রোদ হয়ে ঢুকে পড়তে চায় ওর মনে।জানতে পারে কলেজে পড়ার সময় ওর অপছন্দের অনেক কাজ চাপে পড়ে করতে হয়েছে দীপ্তকে। একটা অদ্ভুত অপরাধের বোঝা ঘিরে ধরেছে চারিদিকে। তারপরেও শান্তি দেয়নি ওরা,যার ফলে ইউনিভার্সিটি পড়া হয়নি। দার্জিলিংয়ে পর্যন্ত দেখা হয়েছে ওদের সাথে ওরা বিদ্রূপ করেছে। তারপরই মনে হয়েছে এবার ফিরতে হবে কিছু করে দেখাতে হবে।
দীপ্তদার গল্পের উপসংহারে হঠাৎই নিজের সাথে অদ্ভুত একটা মিল পেলো দীপ্তদার। হয়ত তেমনি চিরকালই দিদির সাথে তুলনায় পিছিয়ে পড়া দুষ্টুও নিজেকে প্রমাণ করতে চায় নিজের মতই।
" কি ভাবছিস এতো? তোর অনেক পরিবর্তন হয়েছে দুষ্টু। সেবার দার্জিলিংয়ে যেমন দেখেছিলাম তার থেকেও একদম আলাদা। আমি সত্যিই প্রথমে দেখে অবাক হয়েছিলাম। মিস্ ইন্ডিয়া কনটেস্টে যাবি নাকি?"
দীপ্তদা যে এমন কথা বলতে পারে ভাবতেও পারেনা দুষ্টু।
" মানে মিস্ ইন্ডিয়া! হোয়াট! তুমিও শেষে?"
মাথা নিচু করে হাসে দীপ্ত,তোর হাইট তো ভালো হতেও পারে। একটু মজা করলাম।"
অবাক লাগে দুষ্টুর, দীপ্তদাও মজা করে তবে?
'' তোমার মত হতে পারলাম কই আর?"
*****************
এক জায়গায় এসে বোধহয় মত শব্দটা মিলে গেলো মানে দুজনেরই লক্ষ্য এক সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষাই দিতে চায় দুজনেই।
আজকের দেখাটা বোধহয় দুজনের জন্যই জরুরী ছিলো। তাই এই সুযোগে একটা ডিল করে ফেললো দুষ্টু যখন দীপ্ত বললো.." স্যারকে বারবার বলিস না আমাকে দেখেছিস। আমি নিজেই যাবো স্যারের কাছে আমাকে একটু সময় দে।"
দুষ্টুর মুখের হাসিটায় চোখদুটো নাচে
" তাহলে তুমি আমার গাইড হবে বলো?"
" আমি গাইড!"
" তুমি তো বড় মানে সিনিয়র, এতদিনে কিছুটা পড়েছো জেনেছো।আমাকে হেল্প করবেনা?"
হাসে দীপ্ত," আচ্ছা দরকার হলে বলিস যদি পারি।"
দীপ্ত আজই ফিরে যাবে কালিম্পং শুধু হেসে বললো "তোদের কাছাকাছি আছি। উত্তর ছাড়া আর হলামনা,স্কুলটা ওদেরই ব্রাঞ্চ,শুধু চাপটা একটু কম পড়াশোনা করতে পারছি।আর টিউশন একটু বেশি করছি।"
দুষ্টু ফিরে গেছে অনেকক্ষণ,দীপ্ত ট্রেনের জানলায় মুখ রেখেছে বাইরের শীতলতা ওকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। সব কথার মধ্যে একটা কথাই মনে ভাসলো যেটা দুষ্টুকে বলা হলোনা।
ওকে ভালো করতে আর বাঁচাতে চেষ্টা করেছিলেন স্যার,বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ওর দিকে সাহায্যের হাত। কিন্তু নোংরা পাঁকে পা দিয়ে উঠতে পারেনি সহজে দীপ্ত আবার পা পিছলে ছিলো...স্যারের সাথে সেটাই শেষ দেখা। মুখে একরাশ অবসাদ মাখিয়ে বলেছিলেন," দড়িটা ঝুলিয়ে দিমেছিলাম বাইতে পারলিনা?"
মাথা নিচু করেছিলো দীপ্ত
"কোনদিন যদি মাথা উঁচু করে ফিরতে পারিস আবার দেখা হবে আমাদের। জানিনা ততদিন বাঁচবো কিনা? তবুও অপেক্ষায় রইলাম।"
কি ছিলো স্যারের কথায়? হয়ত এমন কিছু যার একটা শব্দও আজও ভুলতে পারেনি দীপ্ত।
রবীনও ভুলতে পারেনি সেই গুরুশিক্ষক বা পিতা সন্তানের গোপন সাক্ষাৎকারের কথা।
*****************
আজ যেমন দীপ্তদার অনুরোধে গোপন রাখলো দীপ্তর নামটা দুষ্টু । শুধু ওর ফোন নম্বরটা গাইড বলে সেভ করে লাখলো।
দিদি মাঝে দুবার ফোন করেছে তখন দীপ্তদা সাথেই ছিলো। ওদের কথাও টুকরো টুকরো শুনলো দীপ্ত। তবে দুষ্টু আজ ওর টুকরো সাক্ষাৎকারে আর কাউকেই নিলোনা।
দিদিটা খুব সংসারী হয়ে গেছে দেখে অবাক হলো দুষ্টু। অফিস থেকে এসেই রান্নায় লেগে পড়ে বানিয়ে ফেলেছে চিলিচিকেন আর ফ্রায়েড রাইস। তারপর ঘেমে অস্থির হয়ে শুয়ে পড়েছে ধপ করে। বাবার সাথে কলকাতার কত কথাই হয় ওদের দুই বোনের। কালচিনিতে বসে নিশ্চিন্তে মন ভরে রবীনের মেয়েগুলো সত্যিই বড় হয়ে গেলো। মায়ের পাঠানো খাবার বার করে দুষ্টু জোজোকে কিছুটা দিয়ে দিয়েছে সকালেই।ওর জন্য মা প্রতিবার পাঠায় ছানার জিলিপি।মেয়ের মনের খবরের হদিস জানেনা অনু শুধু জানে যে ছেলেটা মিষ্টির খেয়াল রাখে।
দিদি ডাইনিং স্পেশে কাজে আর কথায় ব্যস্ত।দুষ্টু চোখ রাখে বইগুলোতে, একটু জোরে দৌড়তে হবে এবার নাহলে সবেই লেট হয়ে যাবে।
মিষ্টির রিনরিনে হাসিটা কানে বাজে দুষ্টুর।প্রেমে পড়লে বোধহয় সবই ভালো লাগে।সত্যিই কি দিদি রাজি হয়েছে? নাকি বন্ধুত্বটাই শুধু আরেকটু মিঠে হয়েছে সময়ের সঙ্গে।
দুষ্টুর ফোনটাতে হাল্কা নীলচে আলো জ্বলে ওঠে.... "নোটিফিকেশন দেখে..ট্রেন চলছে অনেকটা এলাম। তুইও এগিয়ে যা।"
দীপ্তদা মেসেজ করেছে! অবাক হয়ে যায় দুষ্টু।
***********************
Comments
Post a Comment