ভেজা চোখেও সব মেয়ের মতই স্বপ্ন সাজিয়ে পা রাখা শ্বশুরবাড়িতে একটা সময় চাবাগান কালচিনি ফিকে হয়ে গিয়েছিলো সামনে ছিলো দিগন্তবিস্তৃত পথ যে পথে এখন পথচলা শুরু এক নতুন মানুষের সাথে। বাবার মত হয়ত আর কেউ শাসন করবেনা,বাড়ি থেকে যাবার সময় হাতে মুঠো করে টাকা দিয়ে বলবেনা কেউ..রেখে দিস দরকারে খরচ করবি। ও হেসে আছে বাবা,দিয়োনা বললে বলতো হেসে রবীন.."জীবনে হিসেব করতে শেখাও জরুরী তবে এটা হিসেবের বাইরে রইলো, বাবা মা তো অদৃশ্য ব্যাঙ্ক যেখানে লাইন দিতে হয়না,কার্ড লাগেনা ছোটখাটো আব্দারের খরচের জন্য অদৃশ্য চেকবুকটা রেডি থাকে।"
তবে গাড়িতে সারাটা পথ মণিমা,জেম্মা..অবশ্য এখন মামণি আগলে রেখেছে ওকে তার সাথে জোজোর উষ্ণতা ঘিরে রেখেছে। হয়ত এই একটু স্নেহ ভালোবাসার লোভেই মেয়েরা নিজেকে প্রমাণ করতে কাটিয়ে দেয় সারা জীবনটাই।
মধুমিতা একদম সোজা বলে দিয়েছে," আমি জানি মা বলতে তোর একটু বাধবে এতদিনের জেম্মা ডাক।আমিই তো শাশুড়িকে অনেক দেরিতে মা বলতে পেরেছি জিভটা অবাধ্য হয়ে যেতো।তুই বরং মামণি বলিস আর ওকে বাপি।"
*****************
দুষ্টুর রেজেস্ট্রীর ব্যাপারটা একটু গোপনীয়তা রেখেই সারতে চাইলো রবীন। যদিও দুষ্টু বলেছিলো," থাকনা বাবা এখন",কিন্তু চিরকাল সত্যিকে সমর্থন করে আসা রবীন কেন যেন মানতে পারেনি ব্যাপারটা মনে হয়েছিলো একটা মিথ্যেকে ঢাকতে গিয়ে যদি আরো মিথ্যে আসে ছুটে। সত্যি কঠিন হলেও ভালো, মিথ্যে আর গোপনীয়তা নানা সমস্যা নিয়ে আসে জীবনে।
বাড়ির পেছনে চাবাগানের সামনে এসে দাঁড়ায় দুষ্টু, আসার পর থেকে দীপ্তদার সাথে ভালো করে কথাই হয়নি। এই জায়গাটা ওর খুব আপন,বড় একান্তে সময় কাটানোর গোপন নীড়।
দীপ্তও অবাক হয়ে যায়,সত্যিই এদিকটায় আসেনি কখনো অথচ এতদিন কালচিনিতে থেকেছে।অবশ্য আসবেই বা কি করে,এদিকে আসতে হলে তো দুষ্টুদের বাড়ির ভেতর দিয়ে আসতে হয়।
এলোমেলো হাওয়ায় দুষ্টুর লাল ওড়না উড়ছে ওর হালকা কচি কলাপাতা কামিজে তারুণ্যের ছোঁয়া আজ আনমনা করে দেয় দীপ্তকে।সত্যিই জীবনের প্রতি পাতায় কি যে লেখা হবে কেউ ভাবতে পারেনা।কোনদিন কি ভেবেছিলো এই কালচিনিতে হেডস্যারের মেয়ে দুষ্টু ওর মন কেড়ে নেবে। অথচ কবে থেকে দুষ্টুকে ভালোলাগার অনুভূতিটা মন পকেটে বন্দি করে যাতায়াত করতো স্কুল।
দুষ্টু অপেক্ষা করে দীপ্তদার কাছে কিছু শোনার জন্য।আজ এই নির্জন গোধূলির রঙে একবার রাঙিয়ে নিতে চায় মনটাকে। দুই বন্ধু যেন দুই মেরুর বাসিন্দা এরা একজনের মাথা ফাটলেও মুখে খই ফুটছে আর আরেকজনের বুক ফাটলেও মুখ ফোটেনা।এত ভয় কিসের ছেলেটার বুঝতে পারেনা।
" তোমাকে আমি জোর করছিনা তো দীপ্তদা? মানে এই বিয়ের কথা রেজেস্ট্রী? তুমি এখনো বলো যদি কোন আপত্তি থাকে।"
নিজেকে আর সামলাতে পারেনা দীপ্ত..দুষ্টুর হাতদুটো ধরে ওকে হাতের বাঁধনে বাঁধে। দুষ্টু বাধা দিতে পারেনা,ওর মনও যে দীপ্তকেই শুধু চাইছে।
" আমি তো তোদের মত এত ভালো কথা বলতে পারিনা।আসলে নিজের চাওয়া পাওয়া কোনকিছু নেই এভাবেই বড় হয়েছি। কিন্তু তুই আমাকে নিয়ে চলতে পারবি তো? একটা সময় মনে হবেনা তো আমি..."
দুষ্টু জানে দীপ্তদা এবার কি বলবে তাই ঠোঁটে হাত দিয়ে ওকে চুপ করতে বলে.." কে কাকে নিয়ে চলে জীবনে? জীবনতরী বাইতে হয় সবাইকে একা একাই,শুধু একটু শেয়ার করার জন্য আর পাশে থাকার জন্য কাউকে লাগে যাতে একটু মানসিক সান্ত্বনা পাওয়া যায় আমি আর একা নই।"
দীপ্ত দুষ্টুকে ছাড়তে যায়,হঠাৎই একটু বেশিই আবেগে ভেসে গেছিলো। দুষ্টু মাথা রাখে ওর বুকে,দীর্ঘদিনের না বলা আবেগ আর ভালোবাসা আজ ভেসে গেছে বাহুবন্ধনে।
আকাশ দিয়ে একঝাঁক টিয়াপাখি ভেসে যায় নিজেদের বাসায়। ওদের সবুজ রঙে মন হারায় দুষ্টু," ঐ দেখো টিয়াপাখির ঝাঁক,কতদিন বাদে দেখলাম। এইদিকে আর আসাই হয়না।"
দীপ্ত ওর চোখে তাকিয়ে স্বপ্ন বোনে একটু লজ্জা পায় দুষ্টু। সত্যিই বেশ কিছুটা সময় বাড়ি থেকে এদিকে চলে এসেছে দিদি চলে যাবার পর। দীপ্তর ছোঁয়া লেগে রইলো ওর মনে আর শরীরে।দুষ্টুর গায়ের নরম গন্ধ ছুঁলো দীপ্তকে। আর হয়ত সঙ্কোচের বেড়াটা রইলোনা।এখন শুধুই অপেক্ষা জীবনে এগিয়ে যাওয়ার পথে একসাথে পথ চলার।
***************
মিষ্টিকে সাদরে বরণ করতে মণিমাদের সেই কত্তবার দেখা দোতলা বাড়িটা সুন্দর করে সেজেছে। শাশুড়িমা একেবারে বৌ নিয়ে ফিরলো এই ঘটনা পাড়াতে প্রথম তাই আসেপাশের বাড়ি থেকে অনেকেই মুখ বাড়ালো। মধুমিতা মিষ্টিকে বলে," আমাকে পাঁচমিনিট সময় দে,কত শপিং করেছি বলতো সাজবো বলে। আসছি আমরা।"
গাড়ির কাঁচটা তুলে দিয়েছে আগেই মধুমিতা।মা নেমে যেতেই জোজো বলে," এবার যা পারিস কর তোর মণিমা আর মামণির সাথে। আমি তো এখন ঘুমোবো.. ওহ্ বিয়ে করবো বলে কত রাত ঘুমোইনি। আবার তো কাল জাগতে হবে।"
এবার সত্যিই লজ্জা পায় মিষ্টি সবই চেনা জানা,বন্ধুত্বও পুরোনো অনেকদিনের তবুও অনেক কিছুই যেন পাল্টে গেছে একটা রাতে।
অনেক ঝড়ে যেমন মাথা নোয়ায়নি কখনো মধুমিতা তেমনি আজকে তাড়াতাড়ি নিজেকে বদলে ফেলে আটপৌরে সাজে বহুদিনের ইচ্ছে এই সাজে বধূ বরণ করবে। জোজোর বাবা অবাক হয়ে যায় মধুমিতাকে দেখে,এত এনার্জি কোথায় পায় কে জানে! একা হাতে ছেলে সামলেছে।সত্যিই তো সংসারে তেমন সময় দিতে পেরেছে কই?
দুধে আলতায় পা ডুবিয়ে গোলাপের পাপড়ি মাথায় নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে পা রাখে মিষ্টি। রাণু বলে," কোন অসুবিধা হলে আমাকে বলবি,আমি কিন্তু আগে তোর মাসি। জানিস তো মাসির দরদ মায়ের চেয়েও বেশি।"
রাণুর কথায় হেসে ওঠে সবাই...
রবীনের বাড়িতেও নিরালায় হয়ে গেলো কলমের আঁচড়ে সারাজীবন পাশে থাকার অঙ্গীকার।
পুরুলিয়াতে অদ্ভুত একটা শান্তি পেলেন দীপ্তর মা, ছেলেটা দুটোদিন না থাকতেই মনটা কেমন যেন অস্থির হয়ে গেছে। তারমধ্যেই যখন মাস্টারমশাই নিজে ফোন করে বললেন কথাটা তখন বললেন," ওকে তো সেই কবেই আপনাকে দিয়ে দিয়েছি মাস্টারমশাই। আজ যে একদম নিজের করে নিলেন কাগজে কলমে সেটা জেনে মনে হলো এবার শান্তিতে মরতে পারবো।"
রবীনের মনটা ভারী হয়ে উঠলো কথাটা শুনে তবে বললো.." এখন এসব কথা কেন? কত আরো ভালো খবর আসবে এখন।"
বেবিমাসি আর মামীর আব্দারে একটু সাজতেই হলো দুষ্টুকে তবে সেই পলাশ রঙের শাড়িটাই আবার পরলো আদরে।অনু ওর জন্য বানানো গলার হারটা পরিয়ে দিলো ওকে। দীপ্তর হাতে ঘড়িটা দিয়ে মিষ্টি বললো," এটা পরা হয়নি,পরিয়ে দাও।"
আলতো ছোঁয়া আর ভালোবাসার উপহারে কুঁঁড়িতেই ফুটলো পলাশ রবীনের কোয়ার্টারে।
আজকের দিনটা সত্যিই ওদের দুইবোনের জন্যই খুব বিশেষ দিন দুজনেরই জীবনের আঁকাবাঁকা পথ এক নতুন মোড় নিলো ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে।
****************
বৌভাতের দিন মাসিমণি আর মামীকে তত্ত্বগুলো আরেকবার দেখে গুছিয়ে নিতে বলে অফিসে যেতেই হলো দুষ্টুকে। বেশ কয়েকটা কাজ আছে সারতে হবে কথা হলো ওখান থেকেই বিয়েবাড়িতে মানে শিলিগুড়িতে চলে যাবে। এতোটা সময় নিয়ে এদিকে আর আসবেনা।
দীপ্তকে দুষ্টুই জোর করে," তুমিও চলো আমার সাথে।দেখে আসবে আমি কোথায় থাকি।" মামা মাসিকেও বলেছিলো তবে রবীনই বলে.." ওরে সবাই ওদিকে চলে গেলে এদিকে কি হবে? দীপ্ত বরং সঙ্গে যাক ঘুরে আসুক।"
রবীনের স্কুলের মাস্টারমশাইদের মধ্যে ওর অনুপস্থিতিতে বেশ জোরদার আলোচনা হলো," হেডমাস্টার মশাইকে দেখেছেন ঠিক ভালো ছাত্র তৈরী করে নিজের জামাই বানিয়ে ফেললেন। অবশ্য গাছ লাগিয়েছেন কষ্ট করে ফল তো খাবেনই।"
স্যারের হিতাকাঙ্খী যারা তারা অবশ্য প্রতিবাদ করে," না না ছেলের বাড়ি থেকেই সম্বন্ধ এসেছে,ওদের আত্মীয় তো।"
" আরে ছাড়ুন স্যার, ছোটমেয়ে মানে স্যারের রত্নটিও তো আমাদের প্রাক্তন ছাত্র দীপ্তর সাথে ঝুলেছে মনে হয়।ইশ্ মানুষ এত সুযোগসন্ধানী!"
" তবে দীপ্তর সাথে ওনার মেয়ের সম্পর্ক মনে হয় উনি করবেননা,ও তো মেয়ের কাছাকাছি নয়। যাক আমাদের আর কি?"
" আরে দত্তস্যার আমার কাছে খবর আছে,বিয়েটা নাকি হয়ে গেছে কলমে শুধু সিঁদুর পরার অপেক্ষা। দেখুন না কি হয়,মানে আমাদের আর কি আছে নেমন্তন্ন খাওয়া ছাড়া।"
চাপা কৌতুক আর পিএনপিসিতে টিচার রুম একদম সরগরম রবীনের অনুপস্থিতিতে।
দুষ্টুর কোয়ার্টারে এসে মন জুড়িয়ে যায় দীপ্তর।খুব সুন্দর করে সাজানো গোছানো সবটা।সামনে খুব সুন্দর বাগান কত ফুল ফুটেছে সেখানে। ওকে ওখানে রেখে অফিসে চলে যায় দুষ্টু," তুমি রেস্ট নাও,একটু ঘুমিয়ে নাও একেবারে। আমি কাজগুলো সেরে আসছি তারপর আবার যাওয়া আছে।"
এরমধ্যে মিষ্টি আর জোজো কয়েকবার ফোন করেছে। মিষ্টিকে তো অত কিছু বলাই হয়নি তবে সবটা বলেছে রবীন আজ ওকে। একটু অভিযোগ করলো মিষ্টি,"বাবা এবার থেকে আমাকে বাদ দিয়ে সব করবে তাইনা?"
তবে রবীনের সব কথা শুনে খুশি হয়েছে ওরা দুজনেই।ফোন আসে দীপ্তর কাছে.." আমি কপাল ফাটিয়ে একদম রাস্তা খুলে দিয়েছি তাইতো? যাক উৎসবের সবে শুরু। অনুরাগ,পূর্বরাগ সব করে নে এই সুযোগে। তাড়াতাড়ি চলে আসিস আজ।"
***********************
সত্যিই গা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো দীপ্ত,স্বপ্নে চলে গিয়েছিলো কোন একটা সবুজ চা বাগানে যেখানে দুষ্টুর হলুদ ওড়না উড়ছে সবুজের মাঝে।দুষ্টু যেন ওকে ডাকছে চলে এসো দীপ্তদা কি এত ভাবছো?
ঘুমটা ভেঙে যায় দীপ্তর সত্যিই দুষ্টু ডাকছে পাশে চায়ের ট্রে হাতে রাধেশ্যাম। ওর হেফাজতে তো দুষ্টু ওকে রেখে গিয়েছিলো।
আজ মনের মাধুরী দিয়ে নিজেকে সাজায় দুষ্টু সত্যিই কি সাজগোজ নতুন মাত্রা এনে দেয় চেহারায়?
ব্লেজার পরে দীপ্তদাকে একদম অন্যরকম লাগছে।আজ হয়ত দুজনেই মুগ্ধ দুজনের মাঝে।
একরাশ মিঠে বাতাস মাতিয়ে দিলো সদ্য প্রেমের অনুভূতিকে বাসন্তী রঙে।
মিষ্টির জীবনে আজ হাজার প্রজাপতির আনাগোনা।সিঁদুরে শাড়িতে মিষ্টির শান্ত স্নিগ্ধ চেহারায় আজ পরিপূর্ণতা। অনেকটা ঝড়ের পর একটা প্রাপ্তির আনন্দ সবার চোখেমুখে। হাসিতে গল্পে আর আলোর মালায় সেজেছে বাড়িটা,মধুমিতা ইচ্ছে করেই বিয়েবাড়ি কাছেই ভাড়া নিয়েছে। ফুলের জলসায় ফুলের সাজে বসে আছে মিষ্টি।জোজোর আর আজ কাউকে ধরতে হয়নি ছবির জন্য,ক্যামেরা আর চোখ সবেতেই আজ শুধুই মিষ্টি।
দুষ্টুরা পৌঁছনোর আগেই রবীনরা এসে পড়েছে,মিষ্টির মুখ হাসিতে ভরে সবাইকে দেখতে পেয়ে। রবীন অনুকে বলে," আমাদের মেয়ে এত সুন্দর! সবার মধ্যে যেন আলো করে বসে আছে মেয়েটা।"
অনু বলে," ওসব বলতে নেই ভালো থাক ওরা।মেয়েটা আজ খুব খুশি আছে মুখটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।"
বাবা মাকে দেখে মিষ্টির মুখের হাসি আরো সুন্দর হলো। এ বাড়ির সবাই চেনা অনুর তাই নিমেষেই কনেপক্ষ বরপক্ষ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো।বরং মধুমিতা এসে বললো," দাদা এসে পড়েছেন আর কোন চিন্তা নেই আমার।"
মায়ের চিন্তামুক্তি হলেও জোজোর খুব চিন্তা তার বন্ধু আর শালীকে নিয়ে। সদ্য প্রেমে পড়েছে দুজন তারপর আবার সিলমোহর পড়ছে সম্পর্কে কে জানে কি করছে দুটোতে? এখনো কারো পাত্তা নেই।তবে বাইরে এসে দুএকবার দাঁড়াতেই গাড়ি থেকে দুজনকে নামতে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে দীপ্তকে বললো," উফ্ কি যে চিন্তায় ছিলাম!"
অবাক হয়ে যায় দীপ্ত," মানে? আজকেও কোন সমস্যা হয়েছে নাকি?"
দুষ্টু সবটাই বুঝতে পারে তাই বলে," অনেক সমস্যা আছে তোমরা দুই বন্ধুতে মেটাও আমি দিদির কাছে চললাম।"
"আরে দাঁড়া একবার দেখি তো তোকে।"
" একদম না,আজ শুধু দিদির দিকে নজর দে,আর কোনদিকে নয়।"
***********************
কনেযাত্রীর অনেকের সাথে রবীন আর অনু ফিরলেও। কৃষ্ণরা,বেবি আর দুষ্টু দীপ্ত রয়ে গেলো ওখানে। কালই ওরা ফিরে যাবে পুরুলিয়া। তাছাড়া রাণু মধুমিতা সবার আব্দার এক বোনের বাড়ি থাকলেই হবে? আরেক বোনের বাড়িতেও তো থাকতে হয়.." দাদা আবার কবে আসবি কে জানে? তাছাড়া এখান থেকেই তো তোদের ট্রেন।"
কথাটা ভুল নয় তাই রবীনকেও মানতে হলো কথাটা।
রাতের অন্ধকারে ঐ পথটাতে কেন যেন আর যেতে ইচ্ছে করেনা দীপ্তর একদিকে থাকাও হলো আবার বন্ধুর আব্দারও মেটানো হলো।
সেদিনের বাসরের অসমাপ্ত আড্ডাটা আজ ফুলের বাসরে জমে উঠলো পুরোপুরি। আজ সত্যিই আশঙ্কা,ভয় আর অনিশ্চয়তামুক্ত একটা মিঠে রাত। আড্ডা,গান আর তার সাথে কাপল ফটোসেশন।বিয়ের আনন্দ পুরো জমজমাট।
বিয়ের রাতের ঝোড়ো হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাওয়া খুশির নৌকোটা আজ পাল তুলে আনন্দে ভাসলো।
" ওরে তোরা এবার ঘরে যা,ফুলশয্যার ঘরে ঢুকবিনা নাকি?"রাণুকে শেষে মধুমিতা পাঠিয়েছে ওদেরকে ঘরে তুলতে।ছেলেটা আনন্দের চোটে রাত হয়েছে তাও ভুলতে বসেছে।
ওদেরকে ঘরে পৌঁছে দিয়েও আড্ডা শেষ হয়না..যদিও জোজো আর মিষ্টি বারবার বলে যায়," আর আড্ডা দিবিনা আমাদের ছাড়া।"
তবুও দুষ্টু এই রাতের গল্প আর টুকরো মুহূর্ত গুলো কেন যেন ছেড়ে যেতে চাইলোনা। অনেকটা সময় ওরা বসে গল্প করলো।
দীপ্ত বলে," মনটা কেন যেন সবুজ চাবাগানেই রেখে গেলাম দুষ্টু। এবার গিয়ে তোকে খুব মিস্ করবো দুষ্টু, ভীষণ মিস্ করবো।"
" ওখানে গিয়ে কত কাজ তোমার ব্যস্ত হয়ে পড়বে তখন সব ভুলে যাবে।"
হয়ত অনেক কিছুই শত কাজের ভিড়েও ভোলা যায়না। দুষ্টুর হাতের ছোঁওয়া,দুষ্টুর গায়ের গন্ধ আর পলাশের রঙ হয়ত সব কাজেই জড়িয়ে থাকবে দীপ্তকে।
*******************
ফুলের বিছানায় বসে আছে মিষ্টি,জোজো ফুলের সাজে মিষ্টিকে ধরে রাখতে চায় মুঠোফোনে। বন্ধুত্বের মিঠে রঙে আজ অনুরাগের লজ্জামেশানো ভালোবাসার মিশেল। চোখে স্বপ্ন আর মনের ভালোবাসা ফুলের সাথে মিলেমিশে আজ এক অন্য রামধনু রঙ এঁকেছে ওদের প্রেমের আকাশে..হঠাৎই খাটের তলা থেকে বেজে ওঠে...
সুরের আসর থেকে মন নিয়ে এসেছি গো ফুলের বাসর ঘরে বন্ধু,
পারো তো ধরোনা মোরে বাঁধোনা মালার ডোরে
বন্ধু আমি যে ওগো এসেছি।
অবাক হয়ে যায় ওরা, বারবার ঘর চেক করে ঢুকেছে তার মধ্যে কে ঢুকেছে এই ঘরে?
" এই রে কে ওখানে?"
মিষ্টি জোজোকে জড়িয়ে ধরে...জোজো খাটের তলায় উঁকি দিয়ে দেখে কে একটা ছোট টেপরেকর্ডার জাতীয় কি রেখে গেছে।
হেসে ওঠে ওরা দুজনেই তবে গানটা কিন্তু ভীষণ রোমান্টিক।যে করেই থাক,পরিবেশটা সত্যিই পাল্টে গেলো।তাই ওরাও ডুবে যায় গানের সুরে।
*********************
মণিমার বাড়ির ছাদটা ভীষণ প্রিয় দুষ্টুর।এখানে এলেই ভোরে ঘুম থেকে উঠে ও ছাদে ওঠে।কারণ ওদের কালচিনির কোয়ার্টার একতলা। আজও ভোরে উঠে ছাদে আসে দুষ্টু, কত গাছ লাগিয়েছে মণিমা আর মেসো ছাদে।সবুজ ছুঁয়ে যায় দুষ্টুকে, টবে লাল সাদা ফুলের মেলা। হঠাৎই নজর পড়ে যায় ছাদের সেই কোণটার দিকে..ওখানে কে দাঁড়িয়ে?
চিনতে একটুও ভুল হয়না দুষ্টুর দীপ্তদাকে। এত ভোরে উঠে কি করছে এখন? সারারাত কি ঘুমোয়নি?
হাসে দীপ্ত " ঘুমিয়ে ছিলাম তো,আমি জানি তুই আসবি ছাদে তাই চলে এসেছি একটু কথা বলার জন্য।"
অবাক হয়ে যায় দুষ্টু," কি করে জানলে? আমি তো বলিনি কখনো..."
দীপ্ত বলতে পারেনা ঠিক...উত্তীয়র কাছে শুনেছে কথাটা। কিছু কথা নাহয় আজ না বলাই থাক পরে কখনো বলবে। দুষ্টুকে যে আরো কিছু কথা বলার আছে ওর।কিন্তু সেসব শুনলে দুষ্টু ওকে ভুল বুঝবেনা তো?
********************
মামা,মাসি আর দীপ্ত এক ট্রেনেই যাবে,ওদের স্টেশনে ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষা দীর্ঘায়িত করার সুযোগ পেলোনা দুষ্টু। ওকে পৌঁছতে হবে এবার ওর নিজের জগতে যেখানে একা মুখোমুখি হবে অনেক কিছুরই। খুব থাকতে ইচ্ছে করলেও আর উপায় নেই থাকার তাই ফেলে আসা মুহূর্তগুলোকে
বন্ধু করে এগিয়ে চলা সামনের দিকে।
দুষ্টুর শেষ ছোঁয়ার রেশটুকু মেখে নিয়ে দীপ্ত ট্রেনের জানলায় বসে হারিয়ে যায়।তার মাঝেই উঁকি দেয় সদ্য দেখা একটা নগ্ন মুখ যাকে ভুলতে চেয়েছে বহুবার কিন্তু যখন প্রায় ভুলতে বসেছিলো ঠিক তখনি আবার অতীত এনে ওকে সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো।হঠাৎই ভেতর থেকে ওর ভয় পাওয়া মনটাকে কে যেন বলে উঠলো.." এতো ভয় পাও কেন তুমি? আমি আছি তো। এগিয়ে যাও মনের জোর নিয়ে সামনের দিকে।"
মামা, মাসিদের সিট একটু দূরে পড়েছে আপাততঃ দীপ্ত অনেক অপরিচিত মানুষের মাঝে একা। তার মাঝেই ফোন আসে বারবার কখনো স্যার,দুবার জোজো আর দুষ্টু। অবশ্য এখন মাঝে মাঝেই কথা শুধু নীরবে শব্দের সাথে বন্ধুত্ব করে দুষ্টু ওর কাজের মাঝে শব্দ সাজিয়ে ছুঁয়ে যায় ওকে।
"এখনো খাইনি,কাজ করছি।
তুমি ঠিক তো?
মিস্ করছি।"
জোজোর আনন্দ ভরা উচ্ছ্বাস ধরা পড়লো ফোনে..." আরে ভাই বিয়ে করিসনা,সব শান্তি যাবে চিরতরে। কত রাতে একটু ঘুমোলাম একা থাকতে নটার আগে চোখ খুলতামনা। বৌ এসে সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে তুললো,বিয়ের পর নাকি এত ঘুমোতে নেই।"
সবটাই দীপ্ত জানে তবুও জোজো ওর জীবনে নতুন কিছু পাওয়ার আনন্দের সুখ হয়ত ওর সাথে ভাগ করে নিতে চাইছে। তাই শান্ত গলায় বলে.." ঠিক হয়েছে, আমরা চলে আসবো আর তুই তখনো ঘুমোবি।"
সবার সাথে কথা বলে একটা সময় দীপ্ত নিজেও গা এলিয়ে দেয় সীটে। অনেকটা সময়ের ট্রেনে যাতায়াতের ফাঁকে একটু মামাদের সাথে গল্প করে এলো। তারপর টুকটাক কথা আর মেসেজের ফাঁকে পৌঁছে যাওয়া নিজের জায়গায়।মা,অফিস সবই তো ওখানে তাই স্যার থাকতে বললেও উপায় ছিলোনা আসলে সেভাবেই টিকিট কাটা কিছু করার নেই। তবে মনের বেশ কিছুটা রয়ে গেলো কালচিনিতে, পুরোটা রেখে আসার উপায় নেই কারণ অফিসের কাজটা তো করতে হবে। তবে হয়ত মাসখানেক বাদে কালচিনি না হলেও শিলিগুড়িতে যেতে হতে পারে কারণ রেজেস্ট্রীর ব্যাপারটা তো পুরোটা হয়নি শুধু প্রাথমিক ব্যাপারটা হয়েছে। আপাততঃ হয়ত সেটা ভেবেই মনকে শান্ত করা।
মনে একটা হাল্কা ভয় নিয়ে ফিরলেও মা সেটা মুছে দিলো। আসলে জীবনে কখনো মাকে না বলে কোন বড় কাজ করেনি,যদিও ফোনে মায়ের সাথে স্যারও কথা বলেছেন অনুমতি নিয়েছেন তবুও মা যদি কিছু ভাবে? হয়ত মায়ের খারাপ লাগতে পারে। দরজার সামনে গিয়ে পৌঁছতেই ফুলিয়া দরজা খুলে একটা রহস্যের হাসি হাসে। দীপ্ত জিজ্ঞেস করে," মা কোথায় রে? মা ঠিক আছে তো?"
ফুলিয়া বলে," দাড়াইন ক্যানে মা আসতিছে।"
এ আবার কি কথা? বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়িয়ে থাকবে? কেন?
হঠাৎই দেখে মা আসছে... হাতের থালায় প্রদীপ আর ফুল। মাথায় ফুল ঠেকিয়ে কপালে চুমু খায় মা সেই ছোটবেলার মত। দীপ্ত বুঝতে পারে মায়ের আশীর্বাদ টুকু এভাবেই সেরে নিলো মা।
" এরপর গেলে আমাকে নিয়ে যাস,তার জন্য যে কিছু জিনিস যত্নে রাখা আছে সেটা দিয়ে আশীর্বাদ করবো।"
দীপ্ত জানে কি রাখা আছে? মায়ের কিছু গয়না আর ওর দিদার একজোড়া বালা। মা হয়ত দুষ্টুকে সেইটুকু দিতে চায়।
আজ কোথায় যেন মধুমিতা কাকিমার সাথে মায়েরও মিল পেলো। শুধু ও আর মা কেউই তেমন ভাবে মনের কথাগুলো বলতে পারেনা।
********************
মাঝে কেটে গেছে বেশ কিছুদিন, ছেলে আর নতুন বৌমাকে ছাড়তে মধুমিতার মন খারাপ হলেও কিছু করার নেই।ওদেরও কাজে ফিরতে হবে এবার।
তবে অষ্টমঙ্গলার পর কালচিনিতে যাওয়া হয়নি তাই যাওয়ার আগে একদম দুষ্টুর ওখানে ঘুরে দুষ্টুকে নিয়ে সোজা কালচিনি তারপর একটা রাত কাটিয়ে দুষ্টুকে রেখে দিয়ে আবার ফেরা।
উঃ অফিস অফিস করেই গেলো মেয়েটা! দুষ্টু কি করে বোঝাবে কত দায়িত্ব নিয়ে ওকে সব সামলাতে হচ্ছে।তাই বলেছিলো," তোরা চলে যা,আমি পরে দেখা করে নেবো।"
মিষ্টির আর জোজোর দুজনেরই খুব আপত্তি," তুই না থাকলে ওটা কালনুন হয়ে যাবে আর কালচিনি থাকবেনা। তাই তোর কাজের যাতে ক্ষতি না হয় সেভাবেই নিয়ে যাবো।"
দুষ্টু মনে মনে ভাবে ভাগ্যিস পোস্টিংটা খুব একটা দূরে হয়নি।
দুষ্টুর ওখানে গিয়ে মন হারায় মিষ্টি," ওহ্ এই রকম একটা কোয়ার্টার আর লোকজন আমার থাকতো! সত্যিই খুব সুন্দর বোন।"
" হ্যাঁ তোরা হানিমুনের মুডে এনজয় কর,রাধেশ্যাম চা কফি যা বলবি সব দেবে। আর দুপুরের লাঞ্চের সময় আমি একবার হাজিরা দিয়ে যাবো। আচ্ছা তোদের হানিমুন কবে হচ্ছে? এই রে আমার তো মনেই ছিলোনা।"
" আমার সব মনে আছে,সব হবে হবে।"
" কিন্তু সবাই তো বিয়ের পরই যায় হানিমুনে?"
মিষ্টি বোনের কথা শুনে হাসে.." হ্যাঁ যায়,আমরা যাবোনা।যখন ইচ্ছে হবে তখন যাবো। মানে যখন বোর হয়ে যাবো তখন যাবো।"
" এখন শুধুই হানি আর মুন সর্বত্র।"জোজো বলে।
দুষ্টু লজ্জা পায়.." তোরা তাই কর আমি আসি।"
দীপ্তর স্পর্শ,ওর সাথে দৌড়নো,পাশাপাশি হাঁটা,গাড়িতে বসা। ওর কোয়ার্টারে নিভৃতে গল্প আর মনখারাপ শেয়ার করা সবটাই মনে পড়ে যায়।
কালচিনি সত্যিই আর চিনি নয় একদম মিছরি হয়ে গেলো রবীনের কাছে বাড়িতে বসলো চাঁদের হাট। মিষ্টি কলকাতা ফেরার আগে চেটেপুটে নিতে চায় বাবা মায়ের আদর নিরালায় কারণ অষ্টমঙ্গলাতেও কেমন যেন একটা পুজো পুজো ভাব ছিলো,লোকজনের ভিড়ে।
অনেকদিন বাদে আবার সেই ছানার জিলিপি ডাকছে জোজোকে একদম জামাই আদরে।কত স্মৃতি যে জড়িয়ে আছে এর সাথে।
" খাও,খাও ভালো করে খাও জোজোদা।"
" কি রে হঠাৎ করে তুমিতে প্রত্যাবর্তন? আমার কিন্তু কেমন যেন লাগছে! তুই ডাকটাই তো বেশ ছিলো। বেশ দাদা বোনের ডাক তাইনা?"
কথাটা কেন যেন কানে লাগে দুষ্টুর তবুও হাসে," আর বোলোনা,মা বাবা দুজনেই বকছে ভীষণ... বলছে জামাইবাবুকে কেউ তুই বলে নাকি?"
" কিন্তু দাদাকে তো বলে তুই,দাদা যদি হঠাৎ করে জামাইবাবু হয়ে যায় কি করা যাবে? দোষ তো দাদারই।"
দুষ্টুর মন ছুঁয়ে গেলো কথাগুলো, দাদা বোনের সম্পর্কের মধ্যে হঠাৎই কি যে হয়ে গেছিলো!
অফিসে ফাইলপত্রের মধ্যে হঠাৎই দুষ্টুকে কাছে টেনে নেওয়ার কথা মনে পড়ে যায় দীপ্তর। ইশ্ দুষ্টু কি ভেবেছিলো কে জানে? সত্যিই প্রেমে পড়লে হঠাৎই যে কত ছেলেমানুষী হয়ে যায় ভাবাই যায়না।
রায়বাবু দুবার এসে উঁকি দিয়ে স্যারের মতিগতি দেখে গেছেন। এবার ফিরে আসার পর স্যার যেন অদ্ভুত হয়ে গেছে,মাঝেই অকারণে হাসছেন আবার হঠাৎই গুরুগম্ভীর তারমধ্যে কখনো ভুল হয়ে যাচ্ছে কাজও। কই এমন তো হয়নি এর আগে? নির্ঘাৎ ঐ মেয়ে আবার মাথাটা ঘুরিয়ে দিয়েছে একদম বনবন করে। অবশ্য বাকিটা তো এখনো জানাই হয়নি,জানলে বোধহয় ওনার নিজের মাথাটাই বোঁ করে ঘুরে যেতো। বাড়ি গিয়ে গিন্নীর কাছে যথারীতি আপশোষ করলেন.." আর বোলোনা গো,কি যে হয়েছে স্যারের কে জানে? এমন তো কখনো আগে দেখিনি।যেন নতুন রঙ ধরেছে মনে।
সত্যিই এমন তো দেখিনি আগে দুষ্টুকে..ওকে দেখে মিষ্টিরও তাই মনে হলো। দুষ্টুর চোখে হাল্কা কাজলের ছোঁয়া, ঠোঁটে লালচে আভা আর কপালে ছোট্ট টিপ...মিষ্টি চোখ বড় করে বোন..".না না আমি কিছু বলবোনা তবে বেশ লাগছে দেখতে।"
"দিদি তোকেও খুব ভালো লাগছে দেখতে,একদম বেশ অন্যরকম।সিঁদুরের ছোট টিপ আর সিঁথের রঙে ঠিক লক্ষ্মী ঠাকুর।"
অনু ওদের কথা শুনে হাসে,সত্যিই আজ গর্ব হয় এত সুন্দর দুটো মেয়ে ওর। অথচ একটা সময় দুষ্টু হওয়ার পর রীতিমতো চোখের জল ফেলেছিলো অনু। আজ সেকথা ভাবলে নিজেরই খুব খারাপ লাগে। শুধুই দুচোখ মেলে দেখতে ইচ্ছে করে মেয়েদের ওরা আসাতে বাড়িটা যেন ভরে গেছে।
সত্যিই কি ভালোবাসা পাল্টে দেয় অনেক কিছুই,হয়ত ভালো থাকতে আর রাখতেও শেখায়। অন্যের সাথে সাথে নিজেকেও একটু ভালো রাখতে বলে। সকালে ওয়ার্কআউট,দৌড় সব কিছুর পর নিজের ছিমছাম লম্বা শরীরটা আয়নায় দেখে দীপ্ত হয়ত সেখানেও আরো বেশি বেশি যৌবনের জয়গান। জানলা দিয়ে হঠাৎই অকারণে কোকিলের গান কানে আসে...সবুজ চাবাগানে পলাশের ছোঁয়া আজও ভরে রেখেছে দীপ্তকে। তবে অনেক কিছুর মাঝে মনে হয় এরমধ্যেই যে কোনদিন রেজাল্ট আউট হবে।তবে তার আগেই অন্ততঃ একদিনের জন্য হলেও শিলিগুড়িতে যেতে হবে ওকে।অপেক্ষায় আছে দুষ্টুও,অফিসের চেনা অচেনা নানা ছন্দে সদ্য প্রেমে ফোঁটা লাল পলাশের উঁকিঝুঁকি মনের মাঝে। দিদির চেয়েও বোধহয় কোথাও কোথাও অনেক বেশি রোমান্টিক দুষ্টু। তাই মনে অনেক স্বপ্নই আনাগোনা করছে ইতিমধ্যেই।
********************
সেদিন সকালে হঠাৎই রবীন ফোন করে,দীপ্তর একটু অবাক লাগে তাহলে কি কোন সমস্যা? দুষ্টু তো কিছু বলেনি আগে।এখনো স্যারের গলার আওয়াজের গাম্ভীর্যে একটু ভয় ভয় করে দীপ্তর।
" তোর সাথে একটু দরকার ছিলো,মানে তুই কি আসতে পারবি?''
হঠাৎ এভাবে যাওয়া, তবুও দরকার হলে নিশ্চয় যেতে হবে.." কেন স্যার কোন সমস্যা,মানে আমাকে যেতেই হবে।"
স্যারের গলাটা আরো গম্ভীর শোনায় ফোনে,"হ্যাঁ মানে খুব জটিল সমস্যা,আরে হতভাগা এখনো এত ভয় পাস আমাকে।রেজেস্ট্রী টা হাফ করে চলে গেছিস এবার তো ওটা কমপ্লিট করতে হবে নাকি? আগেই তো জানিস আসতে হবে।উঃ এই দুই ছাত্রকে করেছি জামাই কোনদিন আর এরা বাবা বলবেনা চিরকাল স্যার স্যার করবে আর বেতের ভয় পাবে।"
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে দীপ্তর,সেটা করতে তো যেতেই হবে তা ও জানেও।তবুও স্যারকে আবার বলে," মানে মা বলছিলো মাকে নিয়ে যেতে।"
সত্যিই মনটা এবার খুশিতে ভরে ওঠে রবীনের," তাহলে তো খুব ভালো হয়,আমি তো ওনাকে বলতাম আসতে।"
সুতরাং ঠিক হলো দীপ্ত মাকে নিয়েই আসবে আর মধুমিতার আবদার একটা ছোটখাটো গেটটুগেদার ওদের বাড়িতেই হোক এই উপলক্ষ্যে কি দরকার কালচিনিতে বেশি লোক জানাজানি করে। "দাদা দীপ্ত আমারও ছেলে,ওর জন্যই আমার ছেলেটা পাল্টেছে অনেকটা আর দুষ্টুকে তো কবেই আমি মেয়ে করে নিয়েছি"। সুতরাং এই কথার পর রবীনের আর কিছুই বলার থাকেনা এমনিতেই এবার দীপ্তকে কালচিনিতে নিয়ে যেতোনা ভেবেছিলো শিলিগুড়িতে কোন হোটেলে কাটিয়ে তবে আর হলোনা। ভগবান যে কোথায় কি ভেবে রেখেছেন কে বলতে পারে? দীপ্তর বারবার কালচিনি আসা বোধহয় এখন ঠিকও নয়।
তবে জোজোকে থামানো গেলোনা,অবশ্য রবীন আর মধুমিতা দুজনেরই খুব ইচ্ছে ছিলো ওরাও আসুক। এই সুযোগে একটু আনন্দ হবে।
তাই বিয়ে না হলেও ছোটখাটো একটা বিয়ের মহড়া হয়ে গেলো এই সুযোগে। অনু অবাক হয়ে গেলো দীপ্তর মায়ের চোখে জল দেখে.." একি আপনি কাঁদছেন কেন দিদি? আমার তো কাঁদার কথা।সবেই এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি।"
দুষ্টুকে গলার হার আর হাতের বালা পরিয়ে দিতে দিতে উনি বলেন," ছেলেটা আমার বড় একা আর মুখচোরা,চিরকাল হেনস্থা হয়েছে লোকের কাছে। আমি ছাড়া আর কেউ নেই।আজ মনে হচ্ছে আমরা একা নই সবাই আছে সাথে। এত ভালো বৌমা আমার কপালে হবে কখনো ভাবিনি স্বপ্নেও।"
হয়ত এর থেকে বড় প্রাপ্তি হয়না।কটা মেয়ের ভাগ্যে হয় এমন। দুষ্টুর মনের আনাচে তখন স্বপ্নের আনাগোনা। ভালো লাগে জোজোর ওর মনে যে একটা ছোট লুকোনো ক্ষত ছিলো সেটাতে একটু হলেও প্রলেপ লাগলো। ওদের মতই হাসিমুখে থাক দুষ্টু আর দীপ্ত,দুষ্টু যেন ভালোবাসতে পারে দীপ্তকে সব ভুলে গিয়ে।
ছোট একটু দেখা অনেকটা ভালোলাগা আর স্বীকৃতি নিয়ে আর দিয়ে দীপ্তর ফেরা। এবার আসার সময় দুষ্টুর মনটাও একটু খারাপ দেখেছিলো হয়ত এটাকেই ভালোবাসার টান বলে।
...." তোমাকে মিস্ করতে শুরু করে দিয়েছি কিন্তু অলরেডি।তবে আমাদের সম্পর্কটা বোধহয় বাধা থাকবে দূরত্বেই দীপ্তদা। কখনো তুমি দক্ষিণে বা পশ্চিমে আর আমি উত্তরে বা পূর্বে।তবে এটাই ভালো নাহলে ঝগড়া হত।"
দীপ্ত হেসে বলেছিলো," আমি তো ঝগড়া করতে পারিনা।তুই বলবি আমি চুপ করে শুনে যাবো।"
জোজো ওকে থামিয়ে বলেছিলো.." আরে বিয়ের পর সব শিখে যাবি।তখন কথার পর কথা বসিয়ে একদম লড়ে যাবি দেখবি।"
দুষ্টু হেসে গড়াগড়ি খায় মিষ্টিও হাসে একচোট।
" দিদি তোরা এর মধ্যেই ঝগড়া শুরু করেছিস?"
" হ্যাঁ, আচ্ছা ক্লাশমেটের সাথে ঝগড়া ছাড়া আর কি হবে বলতো?"
গাড়িতে যেতে যেতে সব কথাগুলো কানে বাজে দুষ্টুর। অবশ্য ওর তেমন কোন চিন্তা নেই,দীপ্তদা ওর ক্লাশমেট নয়।
শুধু ওদের মত যদি একটু খোলামেলা হত ছেলেটা তাহলেই হয়ে যেতো। এবার যেন একটু চুপচাপ দেখলো পরীক্ষার রেজাল্টের চিন্তা। অবশ্য দুষ্টু সবটা নিয়ে রেখেছে।এখন তো আর শুধু গাইড দীপ্তদা নয়, আরো অনেকটা বেশি।
হয়ত কিছুই এখন হতোনা শুধু সেদিনের সেই ঝামেলাটার জন্য। শুধু শুধু একটা অশান্তি আর অর্থদণ্ড গেলো অনেকটা। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছে দুষ্টু টাকা আদায় করাটাই ওদের উদ্দেশ্য ছিলো তবে সবটা তো দুষ্টু জানেনা যে দীপ্তকে দেখে আবার লালসা জেগে উঠেছিল রূপসীর।
অনেক সময় কিছু খারাপ হয়ত ভালোর জন্যই হয় এই কথাটা বারবারই মনে হয়েছে দীপ্তর।
********************
আজ অফিসে যেতেও ইচ্ছে করছে না দুষ্টুর আজ তো রেজাল্ট কি জানি কি হবে? এতদিন যা নিয়ে তেমন ভাবেনি আজ যেন সেটা একদম নিজের হয়ে গেছে।
তবুও অফিসে যেতেই হয়,আর যথারীতি ফাইলে ডুব দিতে দিতেও ডেক্সটপ আর ফোনটা নেড়েচেড়ে দেখে মাঝে মাঝে। রাধেশ্যাম লাঞ্চটা প্যাক করে দিয়েছে,কেন যেন আজ খেতেও ইচ্ছে করেনি ওর।
হঠাৎই কাজের মাঝে ফোনটা বেজে ওঠে..বাবার ফোন।নিশ্চয় রেজাল্ট জানতে চেয়ে ফোন করেছে..."হ্যাঁ বাবা,এখনো খবর পাইনি।"
বাবার গলার উচ্ছ্বাস আজ তুঙ্গে," আমি খবর পেয়েছি,এইমাত্র আমাকে জানিয়েছে বললো আমাকেই প্রথম খবর দিয়েছে ফোনে। আমি তোকে ফোন করতে বলতেই বললো...আমি পেরেছি স্যার মশালটা নিভতে দিইনি।"
দুষ্টুর চোখটা কেন যেন ভিজে ওঠে..বাবা বলতেই থাকে," একটা অপুষ্টিতে ভোগা রুগ্ন ছেলে ভর্তি হয়েছিলো কিন্তু চোখদুটোতে যেন আগুনের ফুলকি প্রথম দিন অঙ্ক করাতে গিয়েই বুঝেছি এ ছেলের হবে।"
দুষ্টু বুঝতে পারে দীপ্তদা ঠিক লোককেই ফোন করেছে আগে,বাবার মত এতটা বোধহয় ওকে কেউই ভালোবাসেনা..সব শিষ্যের চেয়ে প্রিয় অর্জুন।
দুষ্টুর ফোনে ওদের রেজেস্ট্রীর দিন জোজোদার তুলে দেওয়া ছবিটা উঁকি দেয়..বাবাকে বলে," বাবা দীপ্তদা বোধহয় এবার আমাকে ফোন করেছে।"
" হ্যাঁ হ্যাঁ কথা বল তোরা,আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে আজ।"
দুষ্টু আজ কেন যেন বেশি কথা বলতে পারেনা আনন্দে সবটা এলোমেলো হয়ে যায়। শুধু বলে," বলেছিলাম না তুমি ঠিক পারবে,তোমার হবে।"
ওদিক থেকে দীপ্তদা বলতে থাকে.." স্যারের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবো এবার জানিস।ভাবছি আইপিএস নেবো,তোর আপত্তি নেই তো? তুই সত্যিই আমার জীবনের ভাগ্যলক্ষ্মী।"
দুষ্টু আর নিজেকে সামলাতে পারেনা এবার মুক্তোর মত দুএকফোঁটা জল গড়িয়ে ফোনে পড়ে গাল বেয়ে।একটা সময় তো নিজেই নিজেকে আনলাকি ভাবতো।
নিজেকে সামলে বলে," তোমার ভাগ্য তুমি নিজের যোগ্যতায় গড়েছো আমি শুধু পাশে থেকেছি তোমার। আইপিএস নাও ভালোই হবে,আমার খুব শখ ছিলো জানো তাই তো প্রতিদিন দৌড়োতাম,মাথার চুল কেটে ছোট করেছিলাম। কিন্তু শেষটায় ঠিক সাহস পেলামনা,বাবাও বললো আইএএস নিতে। তুমি তো একদম পাক্বা স্পোর্টস ম্যান এখনো,খুব ভালো হবে।"
দত্তবাবুকে হঠাৎই ডেকে পাঠিয়ে দুষ্টু বলে "একটু বেশি করে মিস্টি,চা আর জলখাবার এনে সবাই খান।"
সবাই বুঝতে পারে ম্যাডামের কিছু স্পেশাল আজ। সত্যিই আজ একটা ভীষণ স্পেশাল দিন।পরপর অনেকগুলো ফোন আসতে থাকে.." বোন,আমি তো ভাবতেই পারছিনা তোরা তো একদম রাজযোটক। ইশ্ একটা সময় আমিই বলেছিলাম তোর কোন ইগো প্রব্লেম হবেনা তো? ওহ্ দীপ্ত একদম করে দেখালো।সত্যিই ওকে ঠিক ওখানে মানাতোনা।"
" দিদি দাঁড়া আগে ওকে একটু ভোকাল টনিক ভালো করে দে। মানে আমরা সবাই দেবো যা ভীতু ও।তারপর হয়ত পালিয়ে আসবে সব ছেড়ে।এখনো ফাউন্ডেশন ট্রেনিং আছে,তারপর বেসিক কোর্স আছে এসভিপিএনএ হায়দ্রাবাদে,তারপর ডিস্ট্রিক্ট প্র্যাকটিক্যাল ট্রেনিং ছমাসের তারপর আবার ফেজ টু ট্রেনিং এসভিপিএনএ তে।"
অবাক হয়ে যায় মিষ্টি.."এত কিছু!অবশ্য তুইও তো মুসৌরী এলএসবিএনএএ তে গেছিলি। প্রথমে সত্যিই আমিও অত কিছু বুঝিনি। পরে বাবাই সবটা বুঝিয়ে বললো, ঐ সময় তোরও খুব ছুটোছুটি গেছে।"
দুষ্টু হাসে," হ্যাঁ এত কিছু,একদম আগুনে পুড়িয়ে ইস্পাত করে পাঠাবে। তবে আমার বিশ্বাস দীপ্তদা পারবে,দেখিস ঠিক পারবে।"
দিদির পাশ থেকে জোজোদা বলে ওঠে," আরে আমাদের চ্যাম্প আবার ট্রফি হাতে দাঁড়াবে রাজকন্যার সামনে। দারুন মানাবে কিন্তু ওকে।"
কিছু আনন্দের কোন ভাষা হয়না,আজ দুষ্টুর মনে হলো দীপ্তদা চোখের সামনে থাকলে হয়ত চোখের ভাষা দিয়ে বোঝাতে পারতো ওর খুশিটা।
মাঝে কেটে গেছে কয়েকটা দিন হঠাৎই একদিন জোজোদা ফোন করে...." শোন আমি আর দেরি করতে চাইনা আমাদের হানিমুনের বুঝলি।"
হঠাৎই অন্য কোন কিছুর ইঙ্গিত পায় দুষ্টু," দিদি কি তাহলে? না না তাহলে বেড়াতে যাবে কি করে? তোমরা হানিমুনে যাবে আমি কি করবো? যাও যেদিন খুশি।"
" হ্যাঁ দীপ্তও তাই বললো,ওর হাতেও বেশিদিন নেই।তাই এখন একটু খুশি থাকতে চায়।"
অবাক হয়ে যায় দুষ্টু," মানে কি হয়েছে দীপ্তদার! কি বলছো তুমি?"
" আরে ওর ট্রেনিংয়ে যাওয়ার বেশিদিন নেই তাই ইচ্ছে এবার হানিমুনটা হয়ে যাক।"
" জোজোদা একদম ভালো হচ্ছেনা কিন্তু।"
" আরে আমাদের হানিমুনের কথা বলছি,তবে তোদের সাথে নিয়ে যাবো লাদাখ। রাজি তো? আরেকজন রাজি।"
বাবাকে বলে অফিসে ম্যানেজ করে কোনরকমে হাতে গোণা কয়েকটা দিনের ব্যবস্থা করা। শ্রীনগর পর্যন্ত ফ্লাইট তারপর গাড়ি। ফেরাটা লাদাখ থেকেই ফ্লাইট। মানালি হয়ে ফেরাটা হলোনা সময়ের অভাবে।
অনু একটু আপত্তি করছিলো," এখনো কপালে সিঁদুরের ছোঁয়া পড়েনি তুমি মত দিয়ে দিলে!"
" আমার ভরসা আছে অনু,আর বিয়েটা তো কাগজে হয়ে গেছে। সত্যিই ছেলেটার টানা ট্রেনিং চলবে এখন।একটু সময় কাটাতে দাও ওদের। আমাদের সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে সময়।"
********************
জোজোদার কথা কি বলবে দুষ্টু, ওর মাথায় কোথা থেকে এত প্ল্যান আসে কে জানে? বলতেই হেসে ওঠে জোজো," শোন তোর একটা ট্রিপ পাওনা ছিলঝ বাইকে লাদাখ। সরি রে সেটা হলোনা।পরে হবে।"
এই ট্রিপটা বোধহয় ওদের চারজনকে খুব কাছাকাছি এনে দিলো অবলীলায়। শ্রীনগর থেকে কার্গিল পার হয়ে লাদাখের পথে ওরা। চারিদিকে পাহাড় কোথাও রুক্ষ আবার কোথাও ক্যানভাসের মত হাল্কা তুলির টান পড়েছে তাতে।
লাদাখের পথে বারবারই গাড়ি থামে ছবি তুলতে আর মনাস্ট্রী দেখতে।এক অদ্ভুত শান্ত নীরবতা মনকে ছুঁয়ে যায় সবারই। দীপ্ত চোখ রাখে দুষ্টুর চোখে যেখানে আজ শুধুই পলাশের রঙ।
লেহ পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় বিকেল হয়ে যায় ওদের। গাড়িতে থামতে থামতে আসাতে শরীর মোটামুটি ঠিক আছে।আদরে মিষ্টির গায়ে জ্যাকেট জড়ায় জোজো। আদরে ভালোবাসায় আর প্রেমের ছোঁয়ায় ভরে ওঠে দিনগুলো। এই কদিনে লেহ ঘুরে নুবরা ভ্যালি দেখে প্যাঙ্গং লেকে ওরা..নীল লেকের জলের পাশে পাথরে পাশাপাশি দাঁড়ায় ওরা,জোজো এগিয়ে এসে দীপ্তর হাতটা দুষ্টুর কোমরে রাখতে বলে।মিষ্টি হাসে," কার হানিমুন হচ্ছে বলতো?"
দীপ্ত বুঝতে পারে দুষ্টুর জীবনের ভালোবাসার অপ্রাপ্তিটুকু এভাবেই ভরিয়ে দিতে চায় জোজো।
রাতে লেকের কাছে টেন্টে আছে ওরা,ভীষণ শীতের দাপট তবুও রাতে টেন্টের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে দীপ্ত আর দুষ্টু। ওরা আগুনের ব্যবস্থা করেছে একটু উষ্ণতার জন্য। পাশাপাশি দাঁড়ায় দীপ্ত আর দুষ্টু সামনে লেকের জল এই অন্ধকারেও নির্ঘুম বয়ে চলেছে নিজের মত আকাশে তখন পূর্ণিমার চাঁদ আলো ছড়াচ্ছে।
" তোকে একটা কথা বলার ছিলো,আমাকে ভুল বুঝবিনা বল।"দীপ্ত বলে।
" থাকনা দীপ্তদা,তারচেয়ে বরং এই শীতল মরুভূমির রাতের সৌন্দর্য্য দেখি দুজনে।এরপর তো আবার কবে দেখা হবে কে জানে?"
" আমাকে বলতে দে দুষ্টু আজ...তোর প্রথম প্রেমের চিঠি মানে জোজোকে লেখা চিঠিটা আমি পেয়েছিলাম। কিন্তু জোজোকে দিতে পারিনি,কিন্তু ওটা বইয়েই ছিলো।জোজোই তো আমাকে বইটা দিয়ে গেছিলো কাজটা করে দেবার জন্য...কি করতাম আমি?"
বলতে বলতে গলাটা একটু আটকে আসে দীপ্তর,কে জানে এই কথাটা শোনার পর দুষ্টু কি বলবে?
পাহাড়ের বরফের সাথে হঠাৎই ভাব করে নেয় দুষ্টুর খিলখিলিয়ে হাসা হাসিটা..." আস্তে বলো,আর বোলোনা কিছু।দিদি আর জোজোদা ওদের পারফেক্ট হানিমুন নাইট এনজয় করছে।আ নাইট অফ ফুল মুন অ্যান্ড ইন লাভ উইথ হানি। আমি তো জানি তুমিই চিঠিটা পেয়েছিলে জোজোদা দেখেনি ওটা। কাজগুলো তো তুমিই করে দিয়েছিলে। তবে সবটাই হয়ত ভালোর জন্যই হয়েছিলো,কে জানে জীবন কার সাথে কাকে হঠাৎই বেঁধে ফেলে আপন খেয়ালে।"
দীপ্ত তবুও বলে," তোর একটুও রাগ হয়নি আমার ওপর? আমি তো চিঠিটা দিতে পারতাম? আর রূপসী ওর কথা?"
" আমি সব জানি দীপ্তদা,বাবা আমাকে বলেছে। আজকের রাত্রিটা এইসব কথা বলে আর নষ্ট কোরোনা।"
ব্ল্যাঙ্কেটটা গায়ে জড়িয়ে নেয় ভালো করে দুষ্টু,আকাশের চাঁদের হাসি ছড়িয়েছে ওদের রাতের মিঠে প্রেমে। এমন ফুল মুন রাতে লেকের পাশে বসে ভালোবাসার কথা বলার উষ্ণতা বোধহয় হারিয়ে দেয় সত্যিই কনকনে শীতকে।
দীপ্ত আর দুষ্টুর টেন্টের মাঝে একটা পার্টিশন,দীপ্ত জিজ্ঞেস করে" ঘুমোলি?"
দুষ্টু বলে," এখনো না,সত্যিই খুব ভালো লাগছে আজ।"
মনে মনে দুষ্টু বলে সত্যিই সেদিন খুব কষ্ট হয়েছিল, তোমার ওপর খুব রাগও হয়েছিল।তবে এখন মনে হচ্ছে সবটাই হয়ত ভালোর জন্য হয়েছিলো।তোমরা দুই বন্ধুই ঘিরে রইলে আমাকে ভালোবাসায়।
*****************
জীবন শেখায় অনেক কিছু কখনো জেতায়,কখনো হারায় তবে অল্পে যারা সুখী হতে পারে আর ক্ষমা করতে পারে তারা হয়ত জানে ভালো থাকার সিন্দুকের হদিস।
সব কিছু ঠিক ঠাক থাকা সত্ত্বেও রবীনের সেরা শিক্ষকের পুরস্কারটা পাওয়া হলোনা সেবার।শোনা গেলো পাশের স্কুলের হেডমাস্টারমশাই পাচ্ছেন পুরস্কারটা। অনেকে খুশি হলো,কেউ বা আবার শোক প্রকাশ করলো। তবে দীপ্তকে ওর জয়যাত্রার পথে এগিয়ে দিতে এয়ারপোর্টে এসে রবীনের মনে হলো এমন শিক্ষকরা বোধহয় এভাবেই সেরার শিরোপা পায় সেরা ছাত্রের মাঝে। এভাবেই আরো অনেক দীপ্ত,দুষ্টু, মিষ্টি,জোজো নিজেকে পুড়িয়ে খাঁটি সোনা হোক। আজকের সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ওদেরই যে খুব দরকার।
************************
মাঝে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা মাস আপন খেয়ালেই মিষ্টিকে নিয়ে নতুন সংসারের মিঠে স্বাদের সাথে সাথে কখনো টক,ঝাল আর তেতোও এসে যাচ্ছে মানে জীবনে যা হয়। জীবনও তো একটা যাত্রা সেখানে কখনো হাসি,কখনো কান্না,কখনো রাগ আবার কখনো অনুরাগ।
গতকাল রাতে বেশ ঘুমোতে দেরি হয়ে গেছে যথারীতি সকালে ঘুম ভাঙেনা মিষ্টির।রবীন থাকলে বকুনি লাগাতো ঠিক...সকালে উঠবিনা দেরি করে উঠবি। চোখটা খুলেই রক্তচক্ষু সূয্যিমামাকে দেখে মিষ্টির মনে হলো,এই রে আজও অফিসে যেতে দেরি হবে নাকি? চোখ ঘুরিয়ে খোঁজে জোজোকে দেখতে পায়না। ইশ্ খুব পাজি ওর বরটা সকালে ঘুম ভাঙিয়ে দেয়না।
হঠাৎই দেখতে পায় জোজো ঘরে ঢুকছে । ওর গালদুটো চকচক করছে ব্লেডের আদরে ক্লিনলি সেভ করাতে বুঝতে পারে অফিসের জন্য হাফ রেডি জোজো।
" গুডমর্ণিং,উঠে পড় এবার। তোর সব রেডি আছে। উঠেই গরম কফি আর স্যান্ডউইচ টেবিলে পাবি।"
" ইশ্ আমার বেচারা বরটা,বিয়ের পরও বৌয়ের সব গুছিয়ে দিতে হচ্ছে। ইশ্ মা যদি জানতে পারে।"
দুষ্টুমি খেলে যায় জোজোর চোখেমুখে," তারজন্য একটু বাড়তি আদর করে দিস তাহলেই হবে। আর আমি বিশ্বাস করিনা কাজের শ্রেণীবিভাগ হয়। মেয়েদের আর ছেলেদের কাজ বলে কিছু আছে নাকি? যেদিন আমি উঠবো সেদিন আমি করবো।আর যেদিন তুই আগে উঠবি তুই করে নিবি।"
মিষ্টির দুষ্টুমি করে বলতে ইচ্ছে করে," তাহলে আমি একটু বেশি বেশি আদর করে প্রতিদিনই দেরি করে উঠবো।"
জোজোর আফটার সেভ লোশনের গন্ধটা ছুঁয়ে আছে মিষ্টিকে ভালোবাসার বাঁধনে বিছানায় মিষ্টিকে একটু জড়িয়েই জোজো তাড়া দেয়," জলদি,তোকে ড্রপ করে আমি অফিসে চলে যাবো। উফ্ বিবাহিত পুরুষ মাল্টিটাস্কার,অন্ততঃপক্ষে আমি তো তাই।একাধারে শেফ,ড্রাইভার, বডিগার্ড আরো কত কি?
Comments
Post a Comment