#বন্ধন#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
অনেকদিন বাদে পর্দায় ঢাকা ভোরটাকে একটু অনুভব করার চেষ্টা করলো মানবী।আজকাল ভোরের দিকে বুকের মাঝে একটা শিরশিরে অনুভূতি হয়। মাঝে খুঁজতে চেয়েছিলো অনুভূতিটার মানে,একটা সময় মনে হয়েছিলো এটা বোধহয় আনন্দের মন ভালো করা একটা রিনরিনে আনন্দ। গত কয়েক মাসে একাকীত্ব আরো চারগুণ বেড়ে গিয়েছিলো মানবীর।আগে মাঝে মাঝেই ছেলে চলে আসতো সাথে বৌমা আর নাতি। দিনহাটাতে ওদের বাড়ির সামনে বাঁশের গেটে একটা আওয়াজ হত ক্যাঁচ করে আর মাধবীলতা গাছটা আনন্দে দুলে উঠতো তার সাথে দুলে উঠতো ওদের দুজনের মনটাও।
আর মানবী সেবার শান্তিনিকেতন থেকে কিনে আনা পরদা সরিয়ে বলতেন," উঃ কতক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে সবেই ঘরে ঢুকেছি আর তোরা এলি। ভাবলাম যাই,খাবার গুলো আবার একবার গরম করে রাখি।"
নাতির কলকলানিতে ভরে উঠতো মানবীর দুকামরার ছোট্ট বাড়ি শান্তিনীড়। নম্রতা এসে প্রণাম করে বলতো," মা তুমি এত ছটফট করো কেন বলতো? তোমার প্রেসারটা নাকি বেড়েছে শুনলাম। আমিই তো একটু গরম করে নিতে পারবো। নিশ্চয় আজও সেই ভোরের থেকে রান্না করেছো?"
এইটুকুতেই খুশি হয়ে যায় মানবীর মনটা ভালোলাগায়, অন্ততঃ নম্রতা দূরে থাকলেও ভাবে তার কথা। দূরত্বে হারিয়ে যায়নি সম্পর্কের গুরুত্ব আর ভালোবাসার ছোট ছোট ছোঁয়াটুকু।
অতীন থাকতে তো এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন রাস্তার মোড়ে,তারপর একটা সময় ছেলের বকুনিতে বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে সময় মাপতেন খুব ধৈর্য্য ধরে। তারমধ্যেই মাঝে মাঝে রান্নাঘরে এসে মানবীকে বলতেন," ওরা এখনো এলোনা কেন বলতো দেখি?আমি এগিয়ে যাবো একটু?"
" আচ্ছা তুমি এগিয়ে গেলে কি ওরা চলে আসবে তাড়াতাড়ি? শুধু শুধু রোদে গিয়ে শরীর খারাপ করবে।"
তারপর মাঝে কেটে গেছে তরতর করে কতগুলো বছর নিয়মের সিঁড়ি বেয়ে মানবীর নিজের শরীরও অশক্ত এখন।আগের মত আর জোর পাননা।ছেলে বৌমা অনেকবার বলেছে," মা দিনহাটার পাট চুকিয়ে এবার চলে এসো পুরোপুরি আমাদের কাছে। আর কতদিন এভাবে একা একা থাকবে?"
মাথার সাদা চুলগুলো হাওয়ায় ভাসিয়ে হেসেছেন মানবী," এই বাড়ির দরজা,জানলা,খাটে তোরঙ্গে যে তোর বাবার ছোঁয়া। আমি চলে গেলে ঐ মানুষটা কষ্ট পাবে।বাগানের গাছগুলো কাঁদবে।"
মুখের ডগায় এলেও নম্রতার ইশারায় মাকে বলতে পারেনি বাড়ি বিক্রির কথা অতনু। শুধু বলেছিলো," কিন্তু এভাবে,একা একা আর কতদিন?"
" আমি একা কোথায় রে? চারিদিকে তো সবাই আছে।এ কি তোদের কলকাতার মত নাকি? এক বাড়ির খবর আরেক বাড়ির লোকজন রাখেনা?
এখানে সবাই আসছে যাচ্ছে খোঁজ নিচ্ছে আর কি চাই বলতো? তারপর আমার অলকা আছে,সারাক্ষণ দেখভাল করছে আর কি চাই?"
সত্যিই অলকা দি অনেকদিন ওদের বাড়িতে আছে। বাবাই নিয়ে এসেছিলেন অলকাদিকে জয়ন্তীতে পোস্টিং থাকার সময়। বাচ্চা হয়নি বলে একটা সময় গলাধাক্কা দিয়ে রাস্তায় বের করে দিয়েছিলো ওর স্বামী তারপর থেকেই এই বাড়িতে ঠাঁই পেয়েছে বাবার হাত ধরে। অতনুর মনে পড়ে পাশের বাড়ির জেঠিমা বলেছিলো," ঠাকুরপোর কি হলো গো,বয়স্থা একটা মেয়েকে এনে ঘরে জোটালো? স্বামী নেয়নি ঘরে কে জানে কেমন?"
মা হেসে বলেছিলো," তোমার ঠাকুরপোকে তো জানো দিদি চিরকালই ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো স্বভাব। এনেছে থাকবে আমার মেয়ের মত।ভালো হলে রাখবো নইলে একদম তাড়াবো।"
অতনু দেখেছিলো পাশে দাঁড়িয়ে মুখটা কাচুমাচু করে বলেছিলো অলকাদি," মা আমাকে তাড়িয়োনা,আমি ভালো হয়ে থাকবো।"
মাকে মা বলাতে একটু রাগ হয়েছিলো অতনুর,মনে হয়েছিলো কোথা থেকে একটা কাকে এনে বাবা হাজির করলো আর সে ওর আদরে ভাগ বসালো?
কিন্তু একটা সময়ে অলকাদিকে দিদি ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি অতনুর। তাই খাওয়াদাওয়া সব ব্যাপারেই জুলুম করতো অলকাদির ওপর। তারপর তো বিয়ের পর নম্রতার সাথেও ভাব হয়ে গিয়েছিলো অলকাদির। আর ভাব না হয়ে যাবে কোথায়? নম্রতাকে তো অলকাদিই পছন্দ করেছিলো প্রথমে বাজার করতে গিয়ে। কি কান্ড না সব্জিওয়ালার নাকি ওজনে গন্ডগোল আর তাই নিয়ে ধুন্ধুমার কান্ড বাধিয়েছে ঐ মেয়ে বাজারে। ব্যাস অলকাদি দেখে হাঁ মনে মনে নাকি তখনি ভেবে নিয়েছে ঐ মেয়েকেই চাই অতনুর বৌ করে। বাড়ি এসে বলাতে একটু রাগ হয়েছিলো অতনুর।ছেলের রাগ দেখে অতীনও বকেছিলো অলকাকে.." তোকে মেয়ের মত রেখেছি বলে কি তুই সব ব্যাপারে মাতব্বরি করবি নাকি? আজকালকার ছেলে কলকাতায় চাকরি করে সে বিয়ে করবে ঐ বাজারের ঝগড়ুটে মেয়েকে?"
পাশের থেকে পান চিবোতে চিবোতে মানবী বলেছিলো," হ্যাঁ রে অলকা কেমন দেখতে রে? খুব ঝগড়ুটে নাকি? চিনিস তাকে?"
অতনু বিরক্ত হয়ে যেতে যেতে শুনেছিলো..
" হ্যাঁ মা,আমি ফলো করলাম।সেইজন্য তো আসতে এত দেরি হলো। বাবা সেই কোথায় কত দূরে একটা বাগানওয়ালা বাড়ি,সামনে বড় বড় নারকেল গাছ।"
অতনু ঘরে গিয়ে দরজা ভেজায়,মনে মনে বলে অসহ্য। সত্যিই অলকাদি খুব মাতব্বরি শুরু করেছে।
রান্নাঘরে ছ্যাঁঁকছোক আওয়াজে কথায় ডুবে যান মানবী অলকার সাথে। প্রথমে অলকাকে তার ছোট্ট সংসারে সত্যিই একটু উৎপাত মনে হলেও কখন যে জড়িয়ে গেছে মেয়েটা এই সংসারে বুঝতেই পারেননি। বুঝতে পারেন বাজারে দেখা মেয়েটা মন কেড়ে নিয়েছে অলকার।
" কাল একবার তোর বাবাকে নিয়ে ভোরবেলা মানে তোর বাবা যখন হাঁটতে বেরোয় তখন বাড়িটা দেখিয়ে নিয়ে আসতে পারবি?"
কুটনো কাটতে কাটতে ঘাড় নাড়ে অলকা।
" মানে অতনু যেন জানতে না পারে।"
******************
গতকাল ছেলের মেজাজ দেখে অতীনের একদম ইচ্ছে ছিলোনা অলকার কথায় নেচে উঠে সেই মেয়ের বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করার তবুও উপায় নেই,গিন্নীর ইচ্ছেতে যেতেই হলো।
বাড়ির সামনে এসে একটু দ্বিধা হয় অতীনের,অলকার কথা শুনে এই সাত সকালে এতটা না এলেই ভালো হত। বাড়িটা তো বেশ শুনশান তবে সামনে বেশ গাছগাছালি আছে।নারকেল গাছে অনেক নারকেল আনন্দে জড়িয়ে আছে ছানাপোনার মত মায়ের কোমর।
গেট খুলে ততক্ষণে পা রেখেছেন উঠোনে তবুও কারো সাড়া নেই। একটু ভয়ও লাগছে,কাল মেয়ের যা মেজাজ শুনেছেন আজ যদি সে কোমরে ওড়না পেঁচিয়ে ছুটে আসে তাহলে কি হবে কে জানে। এদিক ওদিক তাকাতেই চোখ পড়ে কলিংবেলে অবশ্য পাশে লেখা সুন্দর হাতের লেখায়...অপ্রয়োজনে বেল বাজাবেননা,আমরা কিছু কিনিনা।
তবুও অপ্রয়োজনেই বেলে হাত দিয়েছিলেন অতীন মানে কিছুটা অজ্ঞাতপরিচিতের কৌতূহল নিরসনে।
দরজা খুলে যিনি এসেছিলেন তার মুখে অবশ্য হাসি মাখানো ছিলো কারণ অতীনকে উনি চিনতেন যদিও চেনাটা একতরফা ছিলো..." আসুন আসুন মাস্টারমশাই.. আমি সৌমেন্দু। কিন্তু এই সকালে আপনাকে দেখে অবাক হলাম।তবে খুব ভালো লাগছে অনেকদিন আলাপ করার ইচ্ছে ছিলো।"
অতীন পেছন ফেরেন অলকাকে ডাকতে দেখেন ম্যাজিকের মত ভ্যানিশ অলকা।বুঝতে পারেন তাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে পালিয়েছে।
অতীন একটু এদিক ওদিক তাকান আবার,একতলা বাড়িটার আর বাগানের সর্বত্র যত্নের ছাপ।কিন্তু আর কাউকে দেখছেননা কেন? সেই মেয়েটি বা কোথায়।
অতীনকে চুপ করে থাকতে দেখে সৌমেন্দু বলেন.." একটু চা করে আনি,তারপর বসে বসে গল্প করবো। আসলে আমার স্ত্রী নার্ভের পেশেন্ট,প্রায়ই সমস্যায় ভোগেন।"
উনার কথার সূত্র ধরেই অতীন বলেন," আর কেউ থাকেনা এখানে মানে ছেলে মেয়ে?"
হাসেন সৌমেন্দু," দুই মেয়ে আমার, বড়জন বিয়ের পর কানাডায় চলে গেলো আর ছোটজন কলকাতাতে চাকরি করে।"
একটু অবাক লাগে অতীনের তাহলে কাকে দেখলো অলকা? ওর কথা শুনে এতটা আসা একদম ঠিক হয়নি। তবুও বলেন..." ওরা আসেনা? মানে আপনারা একাই থাকেন?"
" বড়জন আসে বছরে একবার। তবে ছোটজন তো মাসে একবার আসেই,কখনো দুবারও। একটু বেশি আদুরে আর কেয়ারিং আমার ছোট মা। এসেছিলো তো তবে কাল রাতেই চলে গেছে থাকলে ও নিজেই দরজা খুলতো।এতক্ষণে চা ও করে আনতো।"
যাক এতক্ষণে পুরোটা বোঝা হয়ে গেছে অতীনের মানে অলকার দেখা লক্ষ্মীবাঈ মানে যাকে ঘরের লক্ষ্মী করার ইচ্ছে তার খুবই সেই মেয়ের অস্তিত্ব আছে।
তাই নিশ্চিন্তে গল্প করে মেয়ের সম্বন্ধে অনেক কিছু জেনে এবং সব শেষে তার একখানা ছবি নিয়ে রীতিমতো চা আর মিস্টিমুখে খুশি হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন অতীন।
তারপর অতনু যতই প্রথমে বিরক্তি প্রকাশ করুকনা কেন নম্রতার ছবি দেখে মোটামুটি একদম সপাটে না বলতে পারেনি। দেখছি বলে সে যাত্রা কলকাতা চলে গিয়েছিলো।
তবে অতীন আর মানবী বুঝতে পারেননি দেখছি মানে যে দেখাটা নিজেদের মধ্যেই প্রথমে সেরে ফেলবে। কাছাকাছি অফিস হওয়াতে আর ফোননম্বর থাকাতে যোগাযোগ হয়েছিলো দুজনের কথা বলে ভালোও লেগেছিলো নম্রতাকে অতনুর।
প্রথমে একটু ভয়ে ভয়ে থাকলেও জয় হয়েছিলো অলকারই শেষে। মোটামুটি এক বছর ভিক্টোরিয়া, বাবুঘাট,কফিহাউস ইত্যাদি ইত্যাদি প্রেমের রঙে সাজিয়ে একজন আরেকজনকে বেঁধে নিয়েছিলো সাতপাকে আর মালাবদলে।
হাঁফ ছেড়েছিলেন মানবী.." যাক বাবা লাখ কথা না বলেই বিয়েটা হয়ে গেলো এক কথাতেই। আমাদের অলকার পছন্দ আছে তবে।" একদম যেমন বৌমা চেয়েছিলেন নম্রতা ঠিক তেমনি।তবে স্পষ্টবাদী ভীষণ বকুনি দিতে শুরু করলে দুই বাবা আর মা কাউকেই ছাড়েনা।
অতীন মাঝে মাঝে অভিযোগ করতো," কি দাপট বাপরে মেয়ের! এত ঝাঁঝ ভালোনা মেয়েদের।"
মানবী হেসে বলতো," ঝাঁঝই ভালো,তাহলে মুখ লাগানোর আগে লোকে ভাববে।"
*****************
আনন্দে হাসিতে কখনো বা ঝাঁঝে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। এই এতগুলো বছরে একটা সময় নম্রতা অতনু আর নাতিকে ঘিরে আনন্দের হাট বসলেও একটা সময় বিয়োগ হলো জীবনে অনেক কিছুই অতীন যেমন চলে গেলেন হঠাৎই ঠিক তেমনি অনেকদিন ভোগার পর নম্রতার মাও চলে গেলো। মানবী অলকার সাথে স্বামীর ভিটেতে রয়ে গেলেও নম্রতার বাবাকে ওরা কলকাতায় নিয়ে গেলো ফ্ল্যাটে। মানে ওনার একটা ফ্ল্যাট আগেই কেনা ছিলো সেখানেই চলে যেতে হলো,দুই মেয়েরই তাই ইচ্ছে।
নম্রতার একটু ছুটোছুটি বাড়লো,মানবী অবশ্য বলেছিলেন.." দাদাকে তোমাদের কাছেই রাখো বৌমা তাহলে তোমার অত ছোটাছুটি থাকবেনা।"
অতনু হেসেছিলো," বলেছিলাম মা,উনি থাকবেননা। তোমার মতই আর কি?"
নম্রতা বলেছিলো," তুমি চলো আমাদের কাছে, তাহলে বাবাকে বুঝিয়ে নিয়ে আসবো।"
ব্যাস সব কথা ওখানেই শুরু হয়ে শেষ আর এগোয়নি।
নম্রতা তবে সবই সামলায় একা হাতে,আর মাঝে মাঝে দিনহাটাতে আসতে পারে মানবীর কাছে ওটাও হয়ত একটা প্রাপ্তি।অবশ্য ভালো লাগে নম্রতারও,শিকড়ের টানে ঘরে ফেরা মাঝে মাঝে।
দেখতে দেখতে ওদের ছেলে শ্রেয়ানও বড় হয়েছে আর একবছর বাদেই বোর্ডের পরীক্ষা দিয়ে ইলেভেন ক্লাশে উঠবে। তারমধ্যেই সারা পৃথিবী জুড়ে এক জীবাণুর দাপটে উল্টেপাল্টে দিয়েছে কতকিছুই।
প্রথমটা মানবী তেমন করে কিছু বুঝতে পারেননি মনে হয়েছে সব ঠিক হয়ে যাবে তাড়াতাড়ি তারপরই অতনু,নম্রতা দাদাভাইকে নিয়ে আসবে।কতদিন দেখা হয়না ওদের সাথে। কিন্তু এমনটা যে হবে ভাবেননি।আজকাল পাড়ার কারো বাড়ি যেতে পারেননা,তারাও আসেনা ভয়ে।
মনে হয় ভাগ্যিস অলকা ছিলো নাহলে কি করতেন এটা একা? অতীন এক অতন্দ্র প্রহরীকে দিয়ে গেছেন তার রক্ষণাবেক্ষণ করতে। আজকাল তো পুরোটাই ও সামলায়।মাঝে মাঝে মনে হয় উনি মরে গেলে অলকার কি হবে? মেয়েটা যে বড় একা? নম্রতা বা অতনু কি ওকে দেখবে? কে জানে হয়ত এটাও একরকম দাসত্বের জীবন তবুও তার মাঝে ওর হাসিমুখটা অভয় দেয় মানবীকে বলে ভয় পেয়োনা মা আমি তো আছি।
আজকাল অলকার মত মানুষ সত্যিই মেলা ভার। তবুও খুব দেখতে ইচ্ছে করে ছেলে, বৌমা আর নাতিকে। অতনু একবার গাড়ি ভাড়া করে চলে আসতে চাইলেও বাধা দিয়েছেন মানবী.." থাক একদম পুজোর সময় আসিস,লক্ষ্মীপুজো কাটিয়ে যাস।"
মাঝে কেটে গেছে বেশ কিছুদিন আজকাল অতনু ফোন করলে বেশি কথা বলেনা,নাতি তো সময়ই পায়না। নম্রতা আগের মতই প্রতিদিন অফিস থেকে এসে রাতে ফোন করে।
একসাথে তিনজনের সাথে যেমন আগে কথা হত তেমন আর কথা হয়না মানবীর।অতনুকে নম্রতার কথা বললেই বলে," বাথরুমে গেছে,বা বেরিয়েছে নাহলে ও বাড়ি গেছে বাবার কাছে।"
নম্রতার সাথে কথা বলে ছেলে বা নাতিকে দিতে বললে বলে ওরা এখন ব্যস্ত পরে কথা বলে নেবে। কোথায় যেন একটা সুর কাটার অনুভূতি, মানবীর মনে হয় তবে কি কিছু হয়েছে? বাকিটা ভাবতে পারেননা..মানে কোন অশান্তি? নম্রতা কি এই বাড়িতে থাকেনা?
না পেরে অলকাকেই বলেন কথাটা," ওদের তিনজনকে একসাথে পাইনা কেন বলতো? আমার যেন মনে হয় কিছু হয়েছে?"
অলকা বকে," কি আবার হবে? হয়ত বাপের বাড়ি গেছে বৌমণি। মা তুমি কাকুকে ফোন করো।"
সৌমেন্দুকে মানবী ইচ্ছে করেই দুপুরের দিকে ফোন করেন..দুবার রিং হওয়ার পর ফোন ধরেন সৌমেন্দু। পাশে একটা বাচ্চার গলা পাওয়া যায় আর কারো একটা কথার শব্দ। মানবী এ পারে বসে অবাক হন।বাড়িতে আবার কে এলো এই সময়ে? সৌমেন্দু তো একাই থাকেন।
সবকিছুর মাঝে কেমন যেন মনে একটা প্রশ্ন জাগে।
"হ্যালো দাদা,আমি মানবী।আপনি ভালো আছেন তো? কদিন ফোন করা হয়নি।"
ওপাশ থেকে সৌমেন্দু বলেন," হ্যাঁ চলে যাচ্ছে ঠিকঠাক আসলে যা সময় চলছে তাই মেয়ের শাসনে একদম ঘরবন্দি।"
" হ্যাঁ আমিও তো তাই।আচ্ছা নম্রতা কোথায়?"
মানবীর আচমকা প্রশ্নে একটু দ্বিধাগ্ৰস্ত হয়ে পড়েন সৌমেন্দু তবুও বলেন," কেন ফোন করেনি আপনাকে? রাতে ফোন করে তো অফিস থেকে এসে।"
" না মানে ও কি এখানে আছে? আমার কেন যেন মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে।"
মানবীর কথার জেরায় সৌমেন্দু আর নিজেকে বাঁধতে পারেননা," হ্যাঁ ও কদিন এখানেই আছে।আমার কাছ থেকেই অফিস করছে।"
" তা ঠিক আছে,কিন্তু অতনু দাদুভাই ওরা?"
" ওরা ও বাড়িতেই আছে।"
মানবী অবাক হয়ে যান,তা থাকতেই পারে বাবার কাছে তবে সবাই ওকে গোপন করছে কেন?
কথায় কথায় মানবী সৌমেন্দুর কাছ থেকে জানতে পারেন নম্রতা ওর এনজিও থেকে একটা ছোট্ট মেয়েকে বাড়িতে এনেছে।মেয়েটাকে খুব অল্পদিন আগেই পেয়েছে ওরা বছর চারেক বয়েস হবে কেউ দেখার নেই মাকে সদ্যই হারিয়েছে বাবা তার আগেই ঘরছাড়া। বাড়ির অন্য কেউ ওর দায়িত্ব নিতে চায়না তাই অগত্যা এখানে ঠাঁই হয়েছে।কিন্তু তাকে ওখানে কিছুতেই রাখা যাচ্ছেনা কান্নাকাটি করে অসুস্থ হয়ে পড়েছে।বাচ্চাটা অনাথ...নম্রতা ওকে নিয়ে একদিন বাড়িতে আসে,ভেবেছিলো এখন অসুস্থ কেন যেন খুব মায়া পড়ে গেছে আসলে এত ছোট বাচ্চা এই প্রথম ওদের এখানে এলো। ওকে সামলাতে গিয়ে অফিসও কামাই হয়েছে কদিন তারসাথে শুরু হয়েছে বাড়িতে অশান্তি।ছেলেকে কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারেনি কয়েকদিনের জন্য এনেছে ওকে,একটু ঠিকঠাক হলেই দিয়ে আসবে।
ছেলের সাথে সাথে অতনুও ক্ষেপে উঠেছিলো.." তোমার একটা চাকরি আছে,তার ফাঁকেও এনজিও জয়েন করেছো।ঠিক আছে আমি তাও মেনে নিয়েছি।তাই বলে একটা ছোট বাচ্চা এনে জোটালে বাড়িতে।সারাদিন মা মা করে ঘুরছে নাহলে কাঁদছে। উঃ হরিবল বাড়ি না অনাথআশ্রম এটা?"
" ও সুস্থ হলেই দিয়ে আসবো ওকে।কেন যেন আমার পেছনই ছাড়তোনা। বিশ্বাস করো।হয়ত মায়ের সাথে কোন মিল পেয়েছে আমার"।
" ওর জন্য আমার ছেলেটা অসুস্থ হয়ে যাবে তাই তুমি চাও? একা বড় হয়েছে এতদিন হঠাৎ করে একটা রাস্তার বাচ্চা তোমার কোলে উঠছে। শুচ্ছে তোমার সাথে তা কি ওর সহ্য হয়। শোনো ওর পড়াশোনার ক্ষতি হলে আমি কিন্তু ছেড়ে কথা বলবোনা।"
নম্রতা বোঝাতে গিয়েও অসহায় হয়ে পড়ে..কেন যে বাচ্চাটার দায়িত্ব নিতে গেলো ওরা? এখন সামলানোই মুশকিল।
" ও একটু সামলে উঠুক,আমি রেখে আসবো যত তাড়াতাড়ি পারি বিশ্বাস করো।"
" এখনি কোন অনাথআশ্রম দেখে ওর ব্যবস্থা করো।"
তবুও কেন যেন এক অদৃশ্য মায়ার বাঁধনে আটকা পড়েছিলো নম্রতা,মাতৃত্ব হাহাকার করেছিলো বুকের নিভৃত কোণে। হ্যাঁ ওকে দিয়ে আসবে,মানে আসতেই হবে।তবুও আরো কটা দিনে অন্ততঃ একটু সুস্থ হয়ে উঠুক মেয়েটা।
তবে না প্রতিনিয়ত অশান্তি টিকতে দেয়নি ওকে। হঠাৎই অপরিচিত লেগেছিলো ছেলেকে আর স্বামীকে।অবশ্য হয়ত অতনুর দিক থেকে এটা স্বাভাবিক ছিলো সারাদিন বাদে নম্রতা আর ওর বেডরুমের নিভৃত কোণে এক অতিথির আগমন যে নম্রতাকে বেশ দাবীতে আগলে রাখে।এমন হলে তো আরেকটা সন্তানই হতে পারতো। তখন ছেলের কথা ভেবেছিলো, আর এখন সে কথা একবারও মনে হয়না নম্রতার।
তবে অশান্তি নিজেদের মাঝেই ছিলো মায়ের কাছে যেতে দেয়নি অতনু। শুধু শুধু একটা বয়স্ক লোককে বিরক্ত করার কি দরকার।
নম্রতার বন্ধু বাসবী সবটা শুনে বলেছিলো.." আগে ঘরটা দেখ,সারা পৃথিবীতে এমন বাচ্চা অনেক আছে। তুই কতজনের কথা ভাববি? তোর নিজের ছেলেটা যে কষ্ট পাচ্ছে।"
" আচ্ছা ও তো চলেই যাবে,অসুখ করেছে বলে কয়েকদিনের জন্য রেখেছি। বড় মায়ামাখা রে বাচ্চাটা।"
" টিকলিকে তো আমি দেখেছি সত্যিই খুব মিষ্টি বাচ্চা কিন্তু কি করবি? ও ঠিক মানুষ হয়ে যাবে। আরো বাচ্চা তো আছে।"
নম্রতার মনে পড়ে যায় সেই দিনটার কথা,ছেলে তখন ছোট তবুও ডাক্তার বলেছিলো এটাই ঠিক সময় দ্বিতীয় বাচ্চা নেবার।খেলার সঙ্গী হয়েই আসুক বাচ্চা আরেকজনের।কিন্তু সেই খেলার সঙ্গীকে আনতে পারেনি নম্রতা সাতমাসে মিসক্যারেজ হয়ে গিয়েছিলো। ডাক্তার বলেছিলো মেয়ে ছিলো..তারপর থেকে আর সন্তান আসেনি।
হয়ত সেই কষ্টটা মাঝে মাঝেই হয় আজও অবচেতনে।
রাগ করেই টিকলিকে নিয়ে বাবার কাছে চলে এসেছে দিন দশেক আগে নম্রতা। তবে দেখেছে ছেলে আর বর ওকে ফিরে যেতে বললেও টিকলিকে নিয়ে ফিরতে কেউ বলেনি।অদ্ভুত একটা জেদের মধ্যেই কেটে গেছে প্রায় কুড়িদিন।সৌমেন্দু পর্যন্ত এবার বলছেন," অনেক হলো নমু এবার টিকলিকে রেখে তুই ফিরে যা। এখন তো ও ভালো আছে। আর তুই তো অফিস ফেরত যাস মাঝে মাঝে তেমনি ঘুরে আসবি।আর এভাবে ইচ্ছেমত কোন বাচ্চাকে কাছে রাখা যায় নাকি? আমার দাদুভাই কষ্ট পাচ্ছে ওদিকে?"
বাবার কথার ইঙ্গিতে অনেকটাই বুঝতে পারে নম্রতা। সেদিন ছেলের গলাটাও ভাবিয়েছে ওকে..." মা প্লিজ চলে এসো এবার, তোমাকে খুব মিস্ করছি।"
মানবীকেও খুব ভাবালো ব্যাপারটা, ছেলের সংসারের সমস্যা কখনো বোধহয় মা বাবাকে আরো বেশি ছুঁয়ে যায়। তারপর নম্রতাকে ঠিক বৌমা বলে কোনদিন ভাবেনি মানবী সবসময় মনে হয়েছে ঠিক অতীনের মতই স্পষ্টবক্তা আর পরোপকারী নম্রতা। ওকে বোধহয় অতীনের মেয়ে বললেই বেশি মানায়,তাই বোধহয় শ্বশুর আর বৌমাতে খুব মিলও ছিলো। আজ থেকে অনেকগুলো বছর আগে অলকাকেও তো এইভাবেই নিয়ে এসেছিলো অতীন জয়ন্তী থেকে। অনেকেই বলেছিলো এইভাবে কেউ দায়িত্ব নেয়! বাড়িতে ছেলে রয়েছে তারপর ঐ এক কার ঘরের তাড়ানো বৌকে নিয়ে এলো একদম।
কিন্তু সেই অলকাই একসময় মানবীর সহায়িকা,কন্যাসম হয়ে উঠেছিলো।আর এখন তো একদম সর্বক্ষণের সঙ্গী।
*********************
মানবী বুঝতে পারে ছেলে বা বৌমা কেউই তাকে কিছু জানাতে চায়না। তাই তেমনভাবে আর কাউকেই কিছু জিজ্ঞেস করেননি মানবী। দেখতে দেখতে পুজো আসছে।কদিন নিজের শরীরটাও খুব একটা ভালো ছিলোনা,হয়ত মানসিক চিন্তাতে একটু বেশিই খারাপ হয়েছিলো।
অতনুর মনটাও কেমন যেন লাগছে,অনেকদিন মায়ের কাছে যাওয়া হয়না। মা বারবার বলেছিলো পুজোর সময় আসিস। কিন্তু নম্রতা ও যদি না যায় তাহলে মাকে কি বলবে? ছেলেটাও প্রথমে জেদ করলেও মাকে খুব মিস্ করছে এখন। সব কিছুর মাঝে একটা ইগোতে কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেলো অনেক কিছু।কবে যে সমাজসেবার ভূত নামবে নম্রতার মাথা থেকে কে জানে?
******************
মাঝে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা দিন বাড়িতে যাবার টিকিট ওদের আগেই কাটা ছিলো..কদিন অতনুরও মনে হয়েছে এত জেদ কেন নম্রতার? তবুও মায়ের শরীর ভালো না ওকে বাড়ি যেতে হবে তাই নম্রতার সাথে একবার দেখা করতে হবে। তাহলে কি ও বাড়িতে যাবে? না কি সেই আগের মত অফিসের পর দেখা করবে?
আলমারি থেকে অলিভ শার্ট আর সাদা প্যান্টটা বের করে পরে অতনু। ছেলে দেখে অবাক হয়," কোথাও যাবে বাবা? আজ তোমাকে খুব ভালো লাগছে মা থাকলে খুশি হত। মা যে কবে আসবে?"
" তোকে ফোনে কি বললো? কবে আসবে? বললিনা আমরা দিনহাটা যাবো ষষ্ঠীতে টিকিট কাটা।"
"বলেছি তো,বললো 'এখন বড় হয়ে গেছিস এত মা মা কিসের? আমার বাবাকেও তো দেখতে হবে নাকি?' সব ঠিক আছে কিন্তু ঐ মেয়েটাকে আমার একটুও পছন্দ না।"
ছেলেকে কিছু বলতে পারেনা আর অতনু চিরকালই একরোখা নম্রতা তবে মনটা বরাবরই ভালো।বাবা বলতেন মা দুর্গা,ক্ষেপে গেলে ত্রিনয়নে আগুন ঝরতে থাকে।
তাই আজ দুগ্গা বলে অফিসের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় অতনু হঠাৎই মনে হয়েছিলো ইগোর লড়াইয়ে কত সম্পর্ক ভেঙে যায় এভাবে তার থেকে একবার কথা বলে দেখাই যাকনা। অবশ্য খুব মিস্ করছিলো নম্রতাকে,নম্রতা ছাড়া বাড়িটা কেমন যেন লক্ষ্মীছাড়া হয়ে গেছে।যদিও রান্না খাওয়ার কোন অসুবিধা নেই ওই বাড়িতে বসেই রিমোট কন্ট্রোলে মানদা মাসিকে দিয়ে সব পরিচালনা করছে নম্রতা।
অনেকদিন বাদে পরিচিত জায়গায় সেই পুরোনো সময়ে এসে দাঁড়িয়েছে। বাসবীর সাথে নেমে আসছিলো নম্রতা হঠাৎই অতনুকে দেখে বুকে একটা ভালোলাগার পালকের আলতো পরশ অনুভব করে। বাসবী ওকে বলে," মিটিয়ে নে,আজ চুটিয়ে প্রেম কর আমি এলাম।"
অতনুকে হাত নেড়ে হ্যাভ আ নাইস টাইম বলে বাসবী চলে যায়। বেশ কয়েকদিন নম্রতাকে দেখেনি অতনু,ওর মুখটা একটু শুকনো লাগে দেখতে। নম্রতা একটু অভিমানী জানে অতনু তাই ও নিজেই এগিয়ে আসে.." চলো গাড়িতে বসো। ভালো লাগছেনা তাই চলে এলাম। একদম ডিনার করে ফিরবো।"
" বাবান একা আছে বাড়িতে,ওদিকে বাবা আছে।আর টিকলিও আছে মাসির কাছে।"
উফ্ সেই টিকলি! একটু বিরক্ত লাগলেও কিছু বললোনা অতনু।
' বাবানের জন্য আর বাবার জন্য পার্সেল নেবো।এবার চলো তো..তুমি ওকে ফোন কোরো ও খুশি হবে আমরা একসাথে বাইরে এসেছি শুনে।"
কিছুক্ষণের জন্য বাইরের খোলা হাওয়ায় মন হারালো নম্রতা,ওর মুখের হাসি মন ছুঁয়ে নিলো অতনুরও।সেই সুযোগে কথাটা বললো," মা কিন্তু অনেক আশা করে বসে আছে আমরা যাচ্ছি পুজোতে।অলকাদি বলছিলো মায়ের শরীরটাও ভালো যাচ্ছেনা আজকাল।অনেকদিন যাওয়া হয়নি আমাদের। তুমি যাবে তো?"
" হ্যাঁ আমি জানি,মায়ের সাথে কথা হয়েছে। ঠিক আছে আমি বলে দেবো মাকে একটা কিছু অসুবিধার কথা।"
নম্রতার হাতে হাত রাখে অতনু," এখনো তুমি অভিমান করে আছো ফিরে এসো নম্রতা। টিকলি মানে জানা নেই চেনা নেই একটা বাচ্চার জন্য আমার ছেলেটা কষ্ট পাবে?
খুব মিস্ করছি তোমাকে,সত্যি। একা বিছানায় আর....."
নম্রতা বুঝতে পারে সবটাই,অতনু একটু বেশিই আদর প্রিয়।নম্রতাকে ছাড়া ওর চলেনা,সবই গুছিয়ে দিতে হয় হাতে হাতে..." মা আদর দিয়ে মাথাটা খেয়েছে একেবারে। অবশ্য অলকাদিও বা কম কি?"
নম্রতার মনটাও একটু ভারী হয়..নাহ্ এবার টিকলিকে ওখানে রেখে ও ফিরে যাবে ছেলের কাছে। হয়ত কাঁদবে কিছুদিন,তারপর ঠিক হয়ে যাবে সব।
*********************
মাঝে কেটে গেছে বেশ কিছুদিন, হঠাৎই একদিন নম্রতা ফিরে এলো বাড়িতে। অনেকদিন বাদে খুশির হাওয়া খেললো বাড়িতে।ছেলের আর বরের আদরে নম্রতা আবার খুঁজে পেলো সেই পুরোনো সংসারের পুরোনো মিঠে গন্ধ।
তবে ওরা কেউ টিকলির কথা জিজ্ঞেস করলোনা একবারও। নম্রতা দেখলো অশান্তির দিনগুলোতে বারবার একটা নাম উঠতো অথচ আজ শান্তি ফিরেছে হয়ত ওদের সবার মনে কিন্তু টিকলি নামটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
সেদিন অতনুর সাথে দেখা হওয়ার পর সত্যি নিজের বাড়িতে ফিরতে চেয়েছিলো নম্রতা,সৌমেন্দু ও কদিন বারবার বুঝিয়েছে..." নমু আমার দাদুভাইয়ের ক্ষতি হচ্ছে একবার ভাব সেটা। সামনেই ওর পরীক্ষা,এমন বাচ্চা অনেক আছে তুই কজনের দায়িত্ব নিবি? যাকে কেউ দেখার নেই তাকে ভগবান দেখবে। তুই বরং কদিন যাসনা হোমে দেখবি ও ভুলে যাবে ঠিক।"
ঠিক বেঠিক ভাবতে ভাবতেই একদিন ফিরে আসা অবশ্য বাবা খুব বলছিলেন ফিরতে বারবার।
মানবী চুপ করে রইলেন সবই না জানার ভান করে। অতনুও ভাবলো মা কিছুই জানেনা। যাক মনটা ছুটেছে বাড়ির দিকে এবার, কতদিন মাকে দেখেনা। সবাই মিলে যাবে মায়ের কাছে অনেকদিন বাদে। মানবী ফোন করে বুঝতে পারলো পুরোনো ছন্দ আবার ফিরে এসেছে ওদের সংসারে।
চারদিকে পুজো পুজো গন্ধ,জীবাণুর দাপটে জীবন থেমে গেলেও প্রকৃতির নিয়মে ভেসে এলো সে গন্ধ বাঙালির ঘরে ঘরে আর মনের অভ্যন্তরে। ট্রেনে উঠে বসেছে ওরা,সবার মনেই খুশির ছোঁয়া..অনেকদিন বাদে মাটির টানে ঘরের পানে।জানলা দিয়ে আসা চেনা মাটির গন্ধ আর মনে ছুটির আনন্দ।
************************
মাধবীলতার গুচ্ছ লতিয়ে লতিয়ে গেটের ওপর করে রাখা পুরো মাচাটার ওপর আপন সুখে ছড়িয়েছে ডালপালা মেলে। মানবী কদিন ধরেই নাড়ু মোয়া বানিয়েছেন অলকাকে নিয়ে।গাছপালা ছেটে বাগানটাকে ভদ্রস্থ করেছেন। জানলায় অলকা লাগিয়েছে নতুন পর্দা,অতনুদের বিছানা সেজেছে নতুন চাদরে।
ঢোকার মুখেই শিউলি গাছটা প্রতি ভোরেই ঝরায় ফুলের রাশি উমা মায়ের আগমনের আনন্দে। তার থেকে কিছুটা অলকা সাজি ভরে তুলে নিয়ে আসে ঠাকুরের জন্য।
গেটে হাত রাখে অতনু,এখনো সেই পরিচিত আওয়াজটা সেই একরকম আছে।একটা সময় বাবা বসে থাকতো বাইরে ওদের অপেক্ষায়।হঠাৎই অবাক হয়ে যায় অতনু...ছেলে বলে ওঠে," দাদু! তুমি কখন এলে এখানে?"
সৌমেন্দু হেসে বলেন," তুমি তো আজকাল এই বুড়োটাকে ভুলেই গেছো।তাই ভাবলাম আমিই সারপ্রাইজ দিই তোমাকে। এসো এসো,কতদিন দেখিনি তোমাকে।"
ওদের সাড়া পেয়ে মানবীও ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছেন বাইরে। মানবীর মুখে সেই পরিচিত হাসিটা,হাসলো নম্রতাও।
ওরা উঠোনে পা রাখতেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো অলকা ওর কোলে যত্নে ধরে রাখা একটা কচিমুখ নম্রতাকে দেখেই.... মাম মাম বলে উঠলো।
সবটা দেখে অবাক হয়ে গেলো অতনু কিন্তু রাগ করতে পারলোনা কেন যেন...অলকাদি ওকে দুহাতে খুব যত্নে আগলে রেখেছে নিজের কোলে। স্বামী পরিত্যক্তা হয়েও অলকাদি সিঁদুরের লোভটুকু ছাড়তে পারেনি। হয়ত বা কিছুটা মানসিক শান্তি আর স্ট্যাম্প লাগানো নিরাপত্তাও। আজ অলকাদিকে দেখে পরিপূর্ণ এক নারী মনে হলো।
হলুদ ডুরে শাড়িতে লাল পাড় দেওয়া অলকাদির হাতে অতীতের শৃঙ্খলের চিহ্ন এখনো জ্বলজ্বলে স্বমহিমায় কপালে বড় সিঁদুরের টিপ।
যামিনী রায়ের সেই বিখ্যাত পোট্রেটটা আবার মনে উঁকি দিলো...তবে দুর্গার কোলে গণেশের বদলে লক্ষ্মী।
মাঝের আইনের ঝামেলাটুকু সামলাবার দায়িত্ব সৌমেন্দুকেই নিতে হয়েছে উকিল ভাইপোর সাহায্যে,কারণ এত সহজে তো কিছুই হয়না সময় লাগবে।তবুও বিকল্প না ভেবে উপায় ছিলোনা মেয়ের সংসারটা তো বাঁচাতে হবে। যদিও অলকাকে মানবী আর সৌমেন্দু অনেক বুঝিয়েছিলো.." কি করে কি করবি এই মেয়েটার দায়িত্ব নিয়ে? তোর নিজেরই কোন ঠিক নেই।"
তবুও মানেনি অলকা,বলেছিলো.." মায়েরা সব পারে,দেখো ঠিক বড় করবো ওকে মনের মত করে।"
অবাক হয়ে গিয়েছিলো মানবী সত্যিই কি সব মেয়ের ভেতরেই মাতৃত্বের অঙ্কুর লুকোনো থাকে? তাই বোধহয় দেবী দুর্গা মাতৃরূপেণ সংস্থিতা।
নম্রতা এগিয়ে এসে কোলে নেয় টিকলিকে। ওদের এখানে পাঠিয়ে দিয়ে তারপর তো ও ফিরেছিলো। আর ওকে ফেরত পাঠাবে শুনে অলকাদির কলকাতা ছুটে আসাটা গোপন ইতিহাসই থাক।
আড়চোখে একবার ছেলের আর বরের দিকে তাকায় নম্রতা।না সেখানে রাগ বা অভিমানের কোন চিহ্নই আর অবশিষ্ট নেই। ততক্ষণে সামনের প্যান্ডেলে বোধনের আয়োজন হচ্ছে....আজ যে এক অন্য মাতৃত্বের অকালবোধন নিজেদের বাড়িতেও দেখলো নম্রতা।
মানবী আদরে বৌমার চিবুক ছুঁয়ে আশীর্বাদ করেন," একদম বাবার মত হয়েছিস। আজ থাকলে কত খুশি হত। যাক অলকার একটা অবলম্বন হলো।"
নম্রতার কোল থেকে ততক্ষণে টিকলি নেমে গিয়ে অলকার আঁচল ধরেছে...অলকা হেসে বলে," যা একটা দুষ্টু মেয়ে হয়েছেনা,সারাদিন আমাকে ছুটিয়ে মারছে।"
মানবী অবাক হয়ে যায়...হয়ত একেই বলে মাতৃত্বের বন্ধন।
দুপুরে ঘরের মধ্যে আলতো আদরে নম্রতাকে জড়ায় অতনু..." সবাই আমার শত্রু দেখছি বাড়িতে। এত কিছু হলো,আমি কিছুই জানিনা।"
নম্রতার চোখটা ভারী হয় অভিমানে," তুমি তো কখনো জানতেই চাওনি কিছু। বরং আমি ফিরে আসাতে বেঁচেছিলে হাঁফ ছেড়ে। ভাগ্যিস মা আর বাবা ছিলো...আর অলকাদি।"
....." প্লিজ নম্রতা,আর কষ্ট পেয়োনা।"
"টিকলি..দাঁড়া ছুটিসনা। অলকা পিসি ওকে ধরো।"
জানলা দিয়ে উঁকি মারে নম্রতা বাবাই না?
বাগানের শিউলি গাছের তলায় দাঁড়িয়ে টিকলি মুখে দুষ্টু দুষ্টু হাসি...অলকাদি ছুটেছে ওকে ধরে আনতে। বাবাইয়ের দিকে তাকিয়ে হঠাৎই দাদা বলে খিলখিল করে হেসে উঠলো টিকলি।
নম্রতার মনে হলো মেঘলা আকাশে ফুটে উঠলো একমুঠো রোদের ঝিলিক। পুজোর গন্ধ আর আনন্দ দুটোই পাখনা মেলে সব দুশ্চিন্তা দূর করে এসে ঢুকলো ওদের ছোট্ট বাড়িটাতে।
সত্যিই অনেকদিন বাদে মনটা ভালো লাগছে নম্রতার,দশদিক আলো করে মা এসেছে যে।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment