লক্ষ্মীপুজোর আগে থেকেই চারিদিকে নাড়ু নাড়ু গল্প আর গন্ধ। আলপনায়,ধানের ছড়ায় খই,মুড়কি,নারকোল নাড়ু আর মোয়াতে সাজানো চারদিক মাঝে মা লক্ষ্মীর শান্ত,মিষ্টি লক্ষ্মীমন্ত মুখের ছবি মন কেড়ে নেয়।মন ডুবে যায় এক অদ্ভুত নস্টালজিয়ায়।আমাদের দেশের বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত গোপাল গিরিধারীর মন্দির থাকায় লক্ষ্মীপুজো আলাদা করে হতো না তবে জেঠিমার ঘরে খুব সুন্দর করে লক্ষ্মীপুজো হত। উঠোনে পড়ত রূপসী পূর্ণিমার চাঁদের আলোর ছটা আর তার মধ্যেই আমরা বাচ্চারা মেতে উঠতাম আনন্দে লুচি আর নাড়ু মুড়কির গন্ধে। আসেপাশের গ্ৰাম থেকে কিছু দুঃস্থ মানুষ এসে দাঁড়াতো..." কোজাগরীয়া দেগে বলে।" বাড়ির মহিলারা যত্নে তুলে দিতো প্রসাদ তাদের হাতে। কখনো বাবা,জেঠামণি কাকুকেও দেখেছি এগিয়ে যেতে। সে ছিলো এক আনন্দের দিন,অনেক শাসন আর না পাওয়ার মধ্যেও সব পাওয়ার এক আনন্দ।ভাইবোনেরা মিলে কত আনন্দ করতাম,সে আনন্দ ছিলো মুখোমুখি কোন মলিনতা ছিলোনা তারমধ্যে। এখন ফেসবুকে হয়ত সবাই সবাইকে দেখি শুধু মুখোমুখি কথা বলার ইচ্ছেটাই হয়ত আর নেই। কোথাও যেন নাড়ুর সেই পাকটা আর আঁটো হয়না সবটাই আলগা।
লক্ষ্মীপুজো আমাদের বেশিরভাগ দেশের বাড়িতে কাটতো আবার কখনো কাটতো দিদার বাড়িতেও। আমার মায়ের অনেক জায়গায় সংসার বলে আলাদা করে পুজো করা হয়নি। তাছাড়া বাবার বেড়াতে যাবার ঝোঁকের জন্যও হয়ত হয়নি,ঠাকুরদা নাকি বলতেন আমাদের বাড়িতেই তো মন্দির আছে তোমার কি দরকার আলাদা করে পুজো করার? তবে বাবাকে দেখতাম নিয়ম করে প্রতি বৃহস্পতিবার ঘটে কিছু টাকা ফেলতে।মৃত্যুর আগে পর্যন্তও তার অন্যথা হয়নি।
দিদার বাড়িতে লক্ষ্মীপুজোতে যে বছর থাকা হতোনা সেই বছরগুলোতে যখন লক্ষ্মীপুজোর পর ভাইফোঁটা উপলক্ষ্যে মায়ের সাথে আসতাম মামাবাড়িতে দেখতাম দিদা হরলিক্সের শিশিতে ভরে নাড়ু,মোয়া,মুড়কি সব রেখে দিতো। আমরা গেলেই সেগুলো বেরোতো..নারকেলের নাড়ুতে একটু ক্ষীর দিয়ে বোধহয় বানাতো দিদা।মাকেও দেখেছি একটু ক্ষীর দিতে নাড়ুতে।
দিদার ম্যাজিক বয়াম থেকে কত রকমের যে নাড়ু বেরোতো! তারমধ্যে মনে হয় খই গুড়ো করেও একটা নাড়ু হত,এছাড়া তিলের আর নারকেলের নাড়ু তো ছিলোই। দিদা চলে যাবার পর দুটো জিনিস খুব মিস্ করি একটা ষষ্ঠীর পাখার বাতাস আরেকটা লক্ষ্মীপুজোর নাড়ু।
আজকাল অবশ্য আমারও আর যাওয়া হয়না ষষ্ঠী বা লক্ষ্মীপুজোতে আসলে পুজোতে বাইরেই কেটে যায় মোটামুটি।
দিদা,ঠাকুমার, মায়ের হাতের নাড়ু সব স্বাদই মুখে লেগে। নারকেলের নাড়ু বানাতে পারলেও মোয়া বানাতে ভরসা পাইনা।যদিও মা হাতে ধরে গুড় জ্বাল দিয়ে মাটিতে ফেলে তা চিটচিটে হয়েছে কিনা কিভাবে দেখতে হয় সবই বলে গেছে তবুও কেন যেন আর ইচ্ছে করেনা।
আমিও এখন পাকা গিন্নী তবুও কিছু কিছু জায়গায় এখনো যেন নিজেকে সেভাবে তৈরি করতে পারিনি। শাশুড়ি বিহীন বাড়িতে বৌ হয়ে আসাতে আমাকে কোন নিয়ম কানুন কেউ হাতে ধরে শেখায় নি। তাই ঘরে ঠাকুর থাকলেও সেভাবে মা লক্ষ্মীর আরাধনা কোনদিনই করা হয়নি।অবশ্য হয়ত এর পেছনে আমার কর্তামশাইও কিছুটা দায়ী।পুজোর ছুটিতে তার পায়ের তলায় সর্ষে দিয়ে রাখার জন্যও এদিকে আর নজর দেওয়া হয়নি কোনদিন।তবুও মায়ের কাছে একটাই আকুতি আমার সংসারে তুমি অচলা হয়ে থেকো মা..আমার সন্তানেরা যেন ভালো থাকে।
প্রার্থনার ব্যাপারে আমি একটু বেশিই দাবীদার তাই মাকে আর্জি জানাই নিজের মত করে।
এবছর কলকাতাতেই আছি পুজোতে উপায় নেই কোন বাইরে যাবার, সকালে বসে পুরোনো ছবিগুলো দেখছিলাম মায়ের সাথে নাড়ু বানানোর। মনটা সত্যিই খারাপ লাগছিলো।হঠাৎই কেন যেন মনে হলো কতদিন নাড়ু খাইনা। আসলে কর্তামশাইয়ের রক্তে চিনির আধিক্যর জন্য মোটামুটি মিঠাই নো এন্ট্রি বাড়িতে। কিছু করার নেই,আর এবার করোনার করুণায় কেউ প্রসাদ দিতে আসবেনা তাও জানি। মেয়ে প্র্যাকটিক্যাল করতে কলেজে গেলো আর আমি মা লক্ষ্মীকে মনে করতে করতে নাড়ুর স্বপ্নে নস্টালজিক হয়ে গেলাম।
মেয়ে কলেজ থেকে ফিরেই হঠাৎই নাড়ু বানাতে তৎপর হয়ে উঠলো.." মা নাড়ু বানাবো বুঝলে।"
আমি অবাক হয়ে গেলাম আরে ও কি করে জানলো আমার মন নাড়ু নাড়ু করছে সকাল থেকে?
বললাম.." কি দিয়ে করবি?"
" দেখোনা,কেমন হয় খেতে।"
ও যখন রান্নাঘরে ঢোকে আমাকে বিদায় নিতে হয় কারণ আমি এতই ছোট যে রান্নাঘরে দুজনে ঘোরাঘুরি করাই মুশকিল।
যথারীতি নাড়ু করে ডাক দিলো...আরে ঘরে নারকেল গুড়োর প্যাকেট নলেন গুড়ের টিউব সব তো ছিলো। আর আমার গুড়ের নাড়ু খেতে ইচ্ছে করছিলো তাই আঁখের গুড়ের বদলে এই গুড়,মিল্কমেড আর নারকেল গুড়ো দিয়ে দিব্যি লাল নাড়ু হলো।
আরে হলো তো? মানে খাওয়া হলো তো।ব্যাস আর কি চাই? মন থেকে কিছু চাইলে স্বয়ং মা লক্ষ্মী যে কখন আমার স্বর্গীয় মায়ের সাথে যুক্তি করে আমার ইচ্ছেপূরণ করে তা আজ বুঝলাম।
সব সময় সব কথা বোধহয় মুখে বলতে হয়না..ইটস্ জাস্ট টেলিপ্যাথি।কোন ঘাম ঝরাতে হলোনা ঠিক মায়ের মতই হাতের কাছে ছোট মা নাড়ু এনে বললো নাও খাও।
মা লক্ষ্মী তুমি এভাবেই সবার মনের কথা বুঝে নিয়ে ভালো রেখো সবাইকে। কেউ যেন কষ্ট না পায় অন্নের অভাবে।
Comments
Post a Comment