দুষ্টু দৌড়ে গাড়ি থেকে নেমে এসে ছুটে যায় গাড়ির সামনে ওর হাসিতে নিঃশব্দ প্রকৃতি হেসে ওঠে না কেঁপে ওঠে খুবই বলা মুশকিল..." হোয়াট আ সারপ্রাইজ! মামু,মিমি,ছোটমাসি তোমরা সবাই! আমি তো ভাবতেই পারছিনা।ইশ্ আমরা তো ভেবেছি ডাকাত পড়েছে।"
জোজো আর দীপ্ত কি করবে ঠিক বুঝতে পারেনা তবে মিষ্টি জোজোর হাত ছেড়ে নেমে এসেছে রাস্তায়।
কৃষ্ণমামা আর ওদের ছোটমাসি বেবি বলে.." জামাইবাবুর কাছে শুনলাম তোরা এখানে। খুব পাজি হয়েছিস তোরা,এত কাছে এসে দেখা করলিনা? দাদুরা দিদারা সবাই মন খারাপ করছে। তাই আমরা এসেছি ধরে নিয়ে যেতে।"
" জোজোদার সাথে আর কদিন বাদে হবে দিদির বিয়ে মাসি,তাই ওদের একটু সঙ্কোচ আছে। সেইজন্য এবার আর যাবোনা। তোমরা কোথায় এসেছো?"
যে কথাগুলো ওদের মধ্যে হয়েছিল তা দুষ্টু অবলীলা ক্রমেই বলে যায়।মিষ্টিকে জড়িয়ে ধরেছে ওর মাসি," কি সুন্দর হয়েছিস রে দেখতে! কতদিন বাদে দেখলাম।"
জোজো আর দীপ্ত গাড়ি থেকে নেমে এসেছে।ততক্ষণে ওরা জানতে পেরেছে যে ওদের ওখানেই গেছিলো ওরা দলবেঁধে।তারপর ওরা নেই শুনে রাস্তায় ওদের খুঁজতে বেরোনো সারপ্রাইজ দিতে।
দীপ্তই বলে," চলুন,আমরা তো এসেই গেছি।বাকি কথা বাড়ি গিয়েই হবে।"
সুতরাং সবাই মিলে আবার ফিরে আসা। ফুলিয়া গরম পকোড়া, পরোটা মাংস সব বানিয়ে ফেলেছে এর মধ্যেই। আরো গোটা চারেক মুরগির ব্যবস্থা করেছে লোকজন দেখে। তাই আর কোন অসুবিধা নেই।
দীপ্তর কোয়ার্টারের বারান্দা বেশ চায়ের সাথে পকোড়া মিলিয়ে মুচমুচে আড্ডাতে ওরা জমলো সবাই।
কৃষ্ণমামা বলে," আর বলিসনা তোদের মামী আর মাসির উৎপাতে বিকেলে বেরোতে হলো গাড়ি নিয়ে।যতই বলি ওরা একটু আনন্দ করতে এসেছে করুক।তা নয় চলো একবার দেখে আসি ছেলেমেয়েদের।ওদের আসতে বলে আসি,না বললে আসবে কেন,যতই আত্মীয় হোক হবু জামাই আমাদের।"
মিষ্টি জোজোর দিকে তাকায়, কলার উঁচু করে জোজো।মিষ্টি বলে," আমাদের মামাবাড়ির আদর কত মিঠে দেখেছিস। মামু,মাসি,মিমি সবাই এসে গেছে। তোমরা আজকে থাকবে তো এখানে?"
ওদের মাসি আর মিমি বলে," না সোনা তোদের সাথে দেখা করতে এসেছি,চলে যাবো আমরা।বাড়িতে ভাই বোনেরা আছে তো।"
"তবে কাল দুপুরে যাচ্ছিস কিন্তু মানে সকালে ঘুম থেকে উঠেই চলে যাবি একদম। সবাই যাবে কিন্তু।" ওদের মামা বলে সবাইকে। মাসিমা আর ফুলিয়া সবাইকে যাওয়ার কথা বললো ওরা। ফুলিয়া খুব খুশি ওদের নেমন্তন্ন পেয়ে তবে বললো ওর যাওয়া হবেনা,মাসিমাকে কে দেখবে ও চলে গেলে। মাসিমা বললেন," ওরা আনন্দ করে আসুক,আমার শরীর ভালোনা বাবা আমি বাড়িতে থাকবো।"
ওদের কথার মাঝেই দীপ্তর একটু মন খারাপ হলো,হাতে তো ছিলো কালকের দিনটাই দুষ্টুকে খুব কাছ থেকে দেখার।সেই দিনটাতে সবার মাঝে হারিয়ে যাবে দুষ্টু। কখনো কখনো ভালোবাসা কেমন যেন স্বার্থপর করে দেয়। তবুও খুশি হলো এই ভেবে যেটুকু পেয়েছে তাতে ক্ষতি কি?
ওদের পকোড়া খাওয়ার মাঝেই ফোন করে রবীন... ওরা সবাই দীপ্তর ওখানে শুনে খুব খুশি হয়ে ওঠে, খুশি হয় অনুও।মনে মনে ভাবে ওরা ঠিকই করেছে ওদের দিক দিয়ে। রবীন বলে," ইশ্ তোরা সবাই একসাথে! আমিও কেমন যেন মনে মনে পৌঁছে গেছি তোদেরই সাথে ওখানে। সত্যিই খুব আনন্দ হচ্ছে রে।"
কৃষ্ণ বলে," চলে আসতেই পারতে দাদা।খুব ভালো লাগতো।ওদের নেমন্তন্ন করতে এসে এখন আমরা খাচ্ছি পরোটা মাংস। তবে ছাত্রদুটি আপনার বটে,একদম রত্ন।
অবশ্য আমাদের মেয়েরাই বা কম কিসের?"
মামার কথাটা কেমন যেন মনে এসে ধাক্কা দেয় দুষ্টুর। মামা কি তাহলে ওকে দীপ্তদার জন্য ভেবে এমন বলছে নাকি? ইশ্ সত্যিই বোধহয় ওর কথাই বলছে এভাবে।"
দুষ্টুর নজর হঠাৎই পড়ে দীপ্তদার দিকে ওর মুখটা কেমন যেন লাগে।সকালের উচ্ছ্বলতা অনেকটা ম্লান যেন।ওরা আসাতে কি একটু অস্বস্তি হচ্ছে ওর? অবশ্য হতেই পারে,জোজোদা ওদের চেনে কিন্তু দীপ্তদা সত্যিই অপরিচিত।
তবে কিছুক্ষণ বাদেই দেখলো মামা,মিমের সাথে বেশ গল্প করছে দীপ্তদা।
মামা চলে যাবার জন্য ব্যস্ত এবার তবে জোজো বলে ফেললো," আজকে থেকে যাও এখানে,কাল একসাথে চলে যাবো। অনেকটা রাত্রি হয়ে গেছে। তখন মিষ্টি যা ভয় পেয়েছিলো ভেবেছিলো ডাকাত এসেছে।"
হাসে কৃষ্ণ," আসলে এই লালমাটির দেশের কুঠুরিতে এখনো অনেক না পাওয়া আর অভাব লুকিয়ে আছে তবে এখানকার মানুষ খুব সৎ। আর আমার তো মা এই পুরুলিয়ার মাটি তাই কোন ভয় নেই।"
ওদের সবাইকে খুব করে যেতে বলে কৃষ্ণ গাড়ি স্টার্ট দেয়। সত্যি তো মামা এখানে থেকে গেলে ওদিকে সামলাবে কে? ওদের চলার পথের দিকে তাকিয়ে দীপ্ত বলে," সত্যিই তোরা কত লাকি, সবার কাছে কত আদর পাস। আমি তো তেমন ভাবে আত্মীয়দের সহযোগিতা পাইনি।"
জোজো ওকে ধরে জড়িয়ে," আমরা আছি তো,অবশ্য তুই আমাদের আপন ভাবিসনা জানি। আর স্যারও তো আছেন। আরে চল এবার ক্যাম্পফায়ারের জোগাড়টা করে ফেলি।"
সবাই হৈ হৈ করে ওঠে...দীপ্ত বলে," ফুলিয়া,সব রেডি করে রেখেছে পেছনের উঠোনে। ওর মতে ঐ দিকটাই ভালো হবে।একটু নিরিবিলিতে আনন্দ করা যাবে। আসলে ওরা আবার দেব দেবী দত্তি দানো সব বিশ্বাস করে খুব। তাই একদম খোলা মাঠে ওর মত নেই।"
মিষ্টি দুষ্টুর কাছ ঘেঁষে বসে," আমিও বিশ্বাস করি খুব। না না ও যেখানে করতে বলেছে সেখানেই হোক। তারপর যদি ভূতে ধরে দেখতে হবেনা। মানে মাংসের গন্ধে যদি আসে ভূত।"
মিষ্টির কথা শুনে সবাই হেসে ওঠে,রাগ হয় মিষ্টির..
" দিদি তুই কি কোনদিন বড় হবিনা?"
"আরে এই জন্যই তো এই ছোট্টখাট্টো মিষ্টিকে এতো ভালো লাগে। কোনদিন বড় হবেনা,এমনি ছোট থাকবে চিরকাল।" জোজো বলে।
কথাগুলো দুষ্টুকে কেন যেন নাড়া দেয় তবুও বলে..." হম্ বুঝেছি একদম টিপিক্যাল আদুরে বৌ লাগবে তোর।"
দীপ্তর মন আগুনের লালচে শিখায় রাঙা হয় প্রেমের টুকরো টুকরো অনুভূতিতে তবে ওর কিন্তু সাহসী, স্পষ্টবক্তা আর জেদী দুষ্টুকে বেশি ভালো লাগে যে জীবনে হাল ছাড়েনা।হার মেনেও উঠে দাঁড়াতে পারে।আঘাতে গুড়িয়ে যায়না বরং গুছিয়ে নেয় আবার নতুন করে।
************
ভেতরের উঠোনে কাঠ একজায়গায় করে একদম উঁচু মতো করে দিয়েছে ফুলিয়া।মুরগি ছাড়িয়ে একদম ম্যারিনেট করে রেখে দিয়েছে। মোটামুটি সব আয়োজন একদম রেডি।ফুলিয়া আদিবাসী মেয়ে।কিছুদিনের মধ্যে একদম আপন করে নিয়েছে ওরা দীপ্তকে। ওর মরদ শিবু দীপ্তর মালীর কাজ করে,বাগান সাফ করে দেয় দরকারে।পেছনের উঠোনটাতে তো এর আগে আসাই হয়নি। এতোটা যে সুন্দর উঠোনটা জানতোই না ওরা। একটা দরজাও আছে ওখান দিয়ে গেলে একটা হাঁটা পথ চলে গেছে গ্ৰামের দিকে। বেশ কিছু টুকটাক গাছও লাগিয়েছে ফুলিয়া আর শিবু ওখানে। লাউগাছ,কুমড়োগাছ টম্যাটো আরো কত কি?
জোজো খুশি হয়ে যায় দেখে," আরে এতো একদম সুন্দর কিচেন গার্ডেন করে ফেলেছিস দেখছি এখানে।দারুণ সুন্দর।"
কাঠগুলো জ্বলতে শুরু করেছে,মাসিমা ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে। কৃষ্ণমামা পৌঁছে ফোন করে ওরা ঠিকমত পৌঁছে গেছে,কাল যেন ওরা তাড়াতাড়ি চলে আসে সকালে।
গরম কাঠের তাপ লাগছে গায়ে হাল্কা শীতে খুব আরাম লাগছে।শরীরে একটা উত্তাপের ছোঁয়া মনকেও ছুঁয়ে যায়।ওরা দুইবোন হাত ধরে বসে আছে।জোজো আর দীপ্ত দুজনে ব্যস্ত মুরগী গুলোকে সুস্বাদু করতে।
মিষ্টি বলে," কি কাজের দেখেছিস ছেলেদুটো? ওহ্ শান্তি আমরা শুধু গেস্টের মত খাবো।নে ভালো করে বানা। অবশ্য তেমন খিদে কই পরটা আর মাংস তো খেয়েছি। যাক তবুও আনন্দটাই আসল।"
জোজো বলে,"দীপ্তর দেওয়া উপহার টা চালাই,একটু গান না হলে জমছেনা। দুষ্টুকে বললে হয়ত বলবে..টায়ার্ড লাগছে।"
গান শোনার উদ্যোগ নিতে নিতেই হঠাৎই পেছনের কাঠের দরজাটা কড়া নাড়ার শব্দে কাঁপে। মিষ্টি চেয়ার থেকে উঠে জোজোর হাত ধরে.." এতো আগুন জ্বালিয়ে বসে আছিস তোরা,নিশ্চয় হাতি এসেছে। নাহলে আবার ডাকাত।"
দীপ্ত হাসে," আগুন দেখে যে হাতি আসে এই প্রথম জানলাম আমি। দাঁড়া আমি দেখছি কে এলো?"
" আমিও যাচ্ছি সাথে চলো।" দুষ্টু বলে।
আবার জোরে কড়া নাড়ে কেউ,মিষ্টি জোজোর গলা জড়িয়ে ধরে।
দীপ্ত দরজা খুলতেই ওরা হৈ হৈ করে ঢুকে পড়ে..." বাবু তোর বন্ধুরা এসেছে আমাদের খবর দিস নাই।ফুলিয়া বললো। ওই তো পাঠায় দিলে আমাদের।"
দীপ্ত হেসে ফেলে এবার দ্যাখ কান্ড ফুলিয়া নিজে না এলেও ওদের দিয়ে মহুয়া পাঠিয়ে দিয়েছে। কি কান্ড দেখ! কাল আসুক ফুলিয়া।"
জোজো ওর কাছে এসে বলে," ফুলিয়া বুঝেছে বাবুর চোখেমুখে নেশা লেগেছে।তাই বোধহয় আরো গাঢ় রঙের প্রলেপ দিতে চেয়েছে। আমি কিন্তু একটু টেস্ট করবো।"
দীপ্তর গালে আগুনের তাত লেগে লালের ছোঁয়া,জোজোকে আবার গলা জড়ায় আবেগে.." ইশ্ এমন বলিসনা,দুষ্টু শুনলে কি ভাববে? আর তুই একদম ওসব খেতে যাসনা কাল মামাবাড়ি যাওয়া আছে।"
দুষ্টু মিষ্টিও এগিয়ে আসে এবার.." আমরাও একটু টেস্ট করবো।"
" আমি জানিনা,ফুলিয়া কাল আসুক খুব বকা খাবে।"
ওদের হাসিতে আর নাচে সবটা চাপা পড়ে যায়... মহুয়া একটু মুখে দিয়েই অদ্ভুত লাগে জোজোর বুঝতে পারে এ জিনিসের স্বাদ নেওয়া একটু মুশকিল হয়ে যাবে।
দুষ্টুর শখের জন্য দীপ্ত কিছু না বললেও বলে," একদম সামলে কিন্তু।"
তবে যেটুকু খেয়েছিলো সেটাই সামলানো মুস্কিল।
চোখে তখন শুধুই রঙের ছোঁয়া,বাজনার তালে তালে আর গানের ছন্দে মেতে ওঠে ওদের মনও। আজ নাচের তালে মিষ্টির সাথে তাল দেয় দুষ্টুও। সত্যিই আজ দীপ্তর মনে হলো আজ ফাগুনী পূর্ণিমার রাতে চল পলায়ে যাই। জোজোর ক্যামেরা আর দীপ্তর ক্যামেরা নাচকে বন্দি করলো খুশিতে।আকাশে তখন পূর্ণিমার চাঁদের হাসি।
নাচ গানের নেশায় মাতলো রাত। বকশিস নিয়ে খুশি হয়ে ওরা চলে গেলো। তার সাথে দিদিমণিদের অনেক প্রশংসা করে গেলো।
সত্যিই ফুলিয়া কখন যে ঘরের মানুষ হয়ে গেছে ভাবতেই পারেনি দীপ্ত। ওদের খাওয়াদাওয়ার সাথে সাথে এভাবে গানে নাচে জমিয়ে দিলো ওদের রাতটা। দীপ্তর বারবারই মনে হলো এই রাতটা যেন শেষ না হয়,আর তো একটা দিন। দুষ্টু কি ওর মনের কথা বুঝতে পেরেছে? হয়ত পেরেছে তাই আজ ব্রেকে হাত রেখে ওকে সাবধান করেছিলো। কিন্তু ভালোবাসি কথাটা কিছুতেই বলতে পারছেনা ওকে...
দুষ্টু মিষ্টি শুয়ে পড়েছে,জোজোও ঘুমের দেশে অনেকক্ষণ। সারাটা দিন আজ সবারই আনন্দের সাথে সাথে ধকলও গেছে। জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসেছে ঘরে তবুও দুষ্টুর চলে যাওয়ার কথা মনে হতেই মন কেমন হলো..কানে হেডফোনটা দেয় দীপ্ত। আপনমনে বাজতে থাকে গানটা..
চাঁদ কেন.. আসেনা আমার ঘরে
চাঁদ কেন আসেনা আমার ঘরে
হো.. চাঁদ কেন আসেনা আমার ঘরে
চাঁদ কেন আসেনা আমার ঘরে
সে অভিমানীনি আজো তো বলেনি
অভিমানিনী আজো তো বলেনি
আসবে কিনা সে ফিরে ওও ..
চাঁদ কেন আসেনা আমার ঘরে..
চাঁদ কেন আসেনা আমার ঘরে
গান শুনতে শুনতে চোখের পাতাটা ভারী হয়ে আসে দীপ্তর। দুই চোখে নামে ঘুমের পর্দা আর সব মনভালো আর মনকেমন ডুবে যায় ঘুমের চাদরে।
*****************
ভোরে পাখির ডাকে ঘুম ভেঙে যায় দুষ্টুর, বরাবর ওর সকালে ওঠার অভ্যেস বাবা একটুও পছন্দ করতোনা বেলায় ওঠা। বুঝতে পারে তখনো সবাই ঘুমোচ্ছে, কাল রাতের মহুয়ার কথা মনে পড়ে যায়। ওহ্ বহুদিন ইচ্ছে ছিলো একবার একটু দেখবে অন্ততঃ গন্ধ শুকে তবে বাবা আর মা বকুনি দিয়ে শেষ করতো।যাক কাল সেই সাধ পূরণ হয়েছে তবে তারপর যে কি নাচ নেচেছে জানেনা। সত্যিই তখন খুব ইচ্ছে করছিলো নাচতে আর গাইতে।
মুখে চোখে জলের ঝাপটা দেয় দুষ্টু, পেছনের উঠোনে আবার আসে, বেশ অনেকটা ছড়ানো উঠোন,কত গাছ প্রাচীর ঘেঁষে। কাল রাতের কাঠের টুকরো ছড়ানো। আস্তে আস্তে দরজা খুলে বাইরে পা রাখে দুষ্টু।কাল এখানেই নাচ হয়েছিলো,এদিকটা দেখা হয়নি শুনেছে এপাশের রাস্তাটা গ্ৰামের দিকে গেছে। তাই ভাবলো একবার হেঁটে আসবে ওদিক থেকে। বাইরের ভোরের শিশির আদরে চুমু খাচ্ছে পায়ে,পাখিরা ঘুম ভেঙে আনন্দে হইচই করছে নিজেদের মত। সকালটা ওদের ভালো থাকতে শেখায় আর আমরা ওদের দেখে ভালো থাকি।সত্যিই তো কত অল্পে ভালো থাকা যায়। সত্যিই কি ভালো থাকার জন্য বেশি কিছু লাগে?
পায়ে হাঁটা পথ ধরে দুষ্টু কিছুটা এগিয়ে গেছে তখন গাছপালাকে সঙ্গী করে। হঠাৎই শুনতে পায়.." দিদিমুণি যে,চললি কোথা?"
আরে ফুলিয়া তো,সময়কে সাথে নিয়ে ঠিক চলে আসছে ওদের জলখাবারের জোগাড়ে। জানে ওরা যাবে মামাবাড়িতে।ওর হাতে কিছু ডালপালা বললো জ্বালানি, বাড়ি যাবার সময় নিয়ে যাবে।ফুলিয়ার হাসিমাখা মুখ ছুঁয়ে যায় দুষ্টুকে।
হঠাৎই ফুলিয়া বলে," পিছনটোতে দেখ একবার।"
অবাক হয়ে দেখে দুষ্টু দীপ্তদা। সকালে ঘুম থেকে উঠে আবার ছোটাছুটি করার প্ল্যান নাকি ছিলো ওনার তা দুষ্টুকে না দেখতে পেয়ে দেখেছে পেছনের দরজা খোলা তাই ছুটে এসেছে পাহারা দিতে।
" আমি কি হারিয়ে যাবো নাকি? ওরে বাবা কি গার্জেনগিরি করছো তোমরা দুটোতে!"
ফুলিয়া হাসতে হাসতে চলে যায়...." বেশ তো তোমরা এবার যাও ঘুরে এসো,আমি ওদিকে চা বসাই।"
ফুলিয়ার যাওয়ার পথে তাকিয়ে দীপ্ত মনে মনে বলে.. আজ যেন হারিয়ে যেতেই বেশি ইচ্ছে করছে। বুনো ফুলের গন্ধ নিতে নিতে কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে ফিরে আসার পথে পলাশফুলের গাছের দিকে নজর পড়ে দুষ্টুর," একবার বসন্তে আসবো এখানে।যদিও আমি অনেকবার এসেছি বসন্তে।তোমার এখানে অনেক পলাশ গাছ।"
" আমার কোয়ার্টারের সামনে আর পেছনে পলাশ গাছ দেখেছিস। ঐ দেখ সামনে।"
হাত উঁচু করে দীপ্ত,ওদিকে তাকায় দুষ্টু।আর দীপ্ত তাকায় দুষ্টুর দিকে..আস্তে আস্তে বলে ওঠে," তুই এলে হেমন্তেও পলাশ ফোটে দুষ্টু।"
দীপ্তর কথাগুলো দুষ্টুর গালে পলাশের পাপড়ির রঙ ছড়ায়। দুষ্টু একটু লজ্জা পায়,সত্যিই দীপ্তদা মন হারিয়েছে। হঠাৎই একটা ব্যাচেলর পার্টিতে এসে কালচিনির দুষ্টু চা পাতার সাথে পলাশফুলের অদলবদল করে চলে গেলো আর দীপ্তর মনে মাখানো রইলো দুটো দিনের স্মৃতির মিঠে রঙ।
*******************
ওরা এসে পৌঁছতেই জোজোদা বোমা ফাটালো," মিষ্টি চল এবার আমি আর তুই ঘুরে আসি। এটা একটা পার্টি হচ্ছে নাকি? আমাদের ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে ওরা ভোর দেখছে?"
জোজোর কথায় হেসে ওঠে সবাই...ফুলিয়া চা আর জলখাবার এনে টেবিলে রাখে। জোজো দীপ্তকে বলে," কি ব্যাপার আজ মুখটা এতো মানে মুডটা এতো লাজুক কেন? বলেছিস ওকে?"
মাথা নাড়ে দীপ্ত,জোজো ওকে বলে.." তোকে মানুষ করার জন্যই এখানে আসা দরকার ছিলো।"
দীপ্ত দুষ্টুর দিকে তাকায়,তবুও ভালো ওরা মায়ের সাথে গল্প করছে।
ঠিক হলো ওরা একদম এখান থেকে চলে যাবে তারপর মামাবাড়িতে খেয়েদেয়ে একদম বাড়ির পথে গাড়িতে রওনা দেয়া। আজ তো ওদের চলে যাওয়াই ছিলো।
রায়বাবু হঠাৎই এসে হাজির হলেন কাজের ফরমান নিয়ে,গতকাল থেকেই নাকি উনি ঘুরছেন কাজটা নিয়ে অথচ স্যারকে ফ্রী পাচ্ছেননা। রায়বাবুর আনা জরুরী কাজের জন্য দীপ্তর আর যাওয়া হলোনা।
অবশ্য দুষ্টু জানে দীপ্তর যাওয়ার ইচ্ছে ছিলোনা আগে থেকেই ইতস্ততঃ করেছে তারপর যখন শুনেছে ওরা ওখান থেকেই চলে যাবে।তখন দুষ্টুকে বলেছে.." অনেকটা আনন্দ দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছিস তোরা। আমার আর একা ফিরতে ভালো লাগবেনা একদম।প্লিজ মামাকে বুঝিয়ে বলিস যেন কিছু মনে না করে।"
সবাই ওরা যথেষ্ট ম্যাচিওর সুতরাং জোর করলোনা কেউ..তাছাড়া একা গাড়ি চালিয়ে ফিরবে ছেলেটা সেটা ঠিকও নয়।তাই ওরা জোজোর গাড়িতেই রওনা দিলো মামাবাড়ির দিকে.. তবুও বোধহয় কিছুক্ষণের জন্য সবার মনটা খারাপ হলো খুব। দীপ্তর জন্য রইলো আবার সবুজের নির্জনতা আর শূন্যতা..দুষ্টু অপেক্ষা করবে রাতজাগা মেসেজের আর জোজো মিষ্টি মিস্ করলো বন্ধুত্বটা।
...." বিয়েতে কিন্তু আসা চাই।"ওদের সবার কথার উত্তরে আর দেখি বলতে পারলোনা দীপ্ত।
বিয়েতে তো ওকে যেতেই হবে এখন মনে হচ্ছে,হয়ত বিশেষ করে দুষ্টুর জন্য।
******************
গাড়িতে কিছুক্ষণ চুপ করে দুষ্টুর মন ডুব দিলো ফেলে আসা স্মৃতির অনুরণনে তারপর যথারীতি দুইবোন গল্প শুরু করলো। হয়ত ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই পৌঁছে যাবে মামাবাড়িতে।
ওখানে শুধু পৌঁছনোর অপেক্ষা,একদম আনন্দের হাট বসে গেলো বাড়িতে। প্রথমেই দাদু দিদা বকুনি দিলো.." তোরা কি রে? আমরা আর কদিন আছি? দেখা করবিনা?"
হৈ হট্টগোলের মাঝে দুষ্টুর ফোনে মেসেজ আসে আর দীপ্তর ফোনটা বাজে..." পৌঁছে গেছিস?"
"হ্যাঁ একটু আগেই,আরে এসেই লোকজনের মাঝে চাপা পড়ে গেছি। তুই বেঁচে গেছিস ভাই।"
দুষ্টু মেসেজের উত্তর দেয়," সবাই তোমার কথা বলছে।"
অনেক গল্প আড্ডা আর খাওয়াদাওয়ার মধ্যে দুষ্টুর মনের মধ্যে ভাসে কয়েকটা কথা...তুই এলে হেমন্তেও পলাশ ফোটে পুরুলিয়ায়।
****************
মামাবাড়িতে দিদাদের আদর,মামা,মামী আর মাসিমণির ভালোবাসা যে এত মিস্টি আর পেটভরানো হয় এই প্রথম বুঝলো জোজো। ওর মামাবাড়িতে তো শুধুই দাদু এখন। তবে খাওয়ার গুঁঁতো এখানে সাঙ্ঘাতিক, মোটামুটি জামাই আসবে বলে গোটা পাঁঠা কেটে ফেলেছে মামা।
ওদের গল্প শুনে তো কাম্মা ওখান থেকেই লাফাচ্ছে.." ইশ্ আগে জানলে আমিও চলে যেতাম। তবে আমার ঐ একবেলা থেকে পোষাতোনা। এরপর আসবো সবাই একসাথে।"
"হ্যাঁ মণিমা একসাথেই আসবো সবাই আমরা। দারুণ মজা হবে।"
সত্যিই ওরা ক্যাম্পফায়ারে যা মজা করলো ভাবা যায়না। মহুয়ার নেশা আর মিঠে ভালোবাসার ছোঁয়া মনে লেগে আছে এখনো দুষ্টুর। আজকের ভোরটা,কালকের দিনটা সত্যিই ভীষণ ভালো ছিলো। একটা অন্যরকম অনুভূতি দুষ্টুকে ঘিরে থাকে।
অফিসে গিয়ে কাজের ফাঁকে বারবার মনটা বেয়ারা হয়ে যাচ্ছে দীপ্তর।কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারছেনা,বারবারই চোখটা ফোনের দিকে যাচ্ছে, জোজোর পাঠানো অযোধ্যা পাহাড়ে দুষ্টুর পাশে দাঁড়ানো ছবিটাতে যদিও ওকে একটু বোকা বোকা লাগছে তবুও বারবারই দেখতে ইচ্ছে করছে ছবিটা।
কিছুক্ষণ আগেই জোজোর সাথে কথা হয়েছে,ওখানে অনেক লোকজন সবাই খুব ভালো। মজা আর খাওয়াদাওয়া খুব হচ্ছে তবে আর নাকি পারছেনা খেতে। ও বলেছে জোজোকে এই তো সবে খাওয়ার শুরু এরপর জামাই হলে আর রক্ষে নেই।
সবার মাঝে একটু আনমনা হয়ে যায় দুষ্টু, দীপ্তদার সকালে বলা কথাগুলো কেন যেন বারবার করে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে মনের মাঝে। মামী মাসিরা বারবারই বলছে একটা দিন থেকে যদি কাল ভোরে রওনা দেওয়া যেতো...দুষ্টু বলে আমি রাজি আমার তো বেসিক্যালি এখন কোন কাজ নেই তেমন তবে দিদি আর জোজোদাকে কাল অফিসে যেতেই হবে।"
সুতরাং সবাইকে মনের আদরে জড়িয়ে নিয়ে আবার রওনা দেওয়া একদম কলকাতার উদ্দেশ্যে।
গাড়িতে যেতে যেতে বারবার পেছনের পানে মন টানে দুষ্টুর। কিছু মুহূর্ত মনের মণিকোঠায় রয়ে যাক এমনি জীবন্ত হয়ে। দীপ্ত ফোন করেছে ওদের,ওরা রওনা দিয়েছে শুনে সত্যিই মনে হলো..
কাছে ছিলে, দূরে গেলে--দূর হতে এসো কাছে। ভুবন ভ্রমিলে তুমি--সে এখনো বসে আছে।
দীপ্তকে দেখে সত্যিই রায়বাবুর কেমন যেন লাগে।বেশ ছিলেন স্যার, নিজের ঘরের কোণে কোথা থেকে দূরন্ত ঝড়ের মতো একটা লম্বা মেয়ে এসে একদম আগুন জ্বালিয়ে দিলো মনে। রকম সকম পাল্টে গেছে এই দুদিনে! আর শালীর মেয়ের সাথে সম্বন্ধের ব্যাপারটা একদম জলে গেলো।
*****************
কলকাতায় ফিরে এসে আবার যান্ত্রিকতায় অভ্যস্ত হয়ে যায় জোজো আর মিষ্টি।দুষ্টু দু তিনদিন থেকে নিজের কাজগুলো সেরে ফিরে যাবে কালচিনিতে।বাবা বারবার ফোন করছে। ওকে ছাড়া নাকি একদম ভালো লাগছেনা।অনেক অভিযোগ রবীনের..মেয়েরা সব কোথায় কোথায় চলে যাবে এখন বাবার কাছে থাকবে তা নয় কোথায় কোথায় ঘুরছে।
ওরা বাবাকে বলেছে.." সারাজীবন তুমি আমাদের আর ছাত্রদের পেছনে সময় দিয়েছো এবার মাকে সময় দাও।"
রবীন শুনে হাসে কি করে বোঝাবে বসন্তের যে দিন চলে যায় তা কি আর ফিরে আসে? মনের রঙগুলো একটু হলেও ফিকে হয়ে যায় বয়েসের সাথে সাথে।ভালোবাসা ভরা আবেগী মনগুলো কখন যেন একদম ছাপোষা মানে ছানাপোনা পোষা সংসারী হয়ে যায় নিয়ম মেনে বুঝতেই পারা যায়না। পাকা অভিজ্ঞতার রঙে সাজে মাথার চুল, আর মনের জটিলতার আর চিন্তার ছাপ পড়ে মুখে।
" তুমি হাসছো কেন বাবা? বলো হাসছো কেন? দাঁড়াও আমি চাকরি পেয়ে একদম তোমাকে আর মাকে হানিমুনে পাঠিয়ে দেবো।"
ফোনটা স্পীকারে দেওয়া ছিলো,মেয়ের কথা কানে যায় অনুরও।সত্যিই তো তেমনভাবে হানিমুনে যাওয়া হলো কোথায়? তখন একার চাকরিতে তারপর মাইনে কম সুতরাং বাড়িতেই প্রেমের ছোটছোট ছোঁয়া।আর তারপরেই তো কোলে এলো ওরা, একদম পিঠোপিঠি।
" তুই চাকরি পেলেই আমার চাঁদ পাওয়া হবে।আমি তো এখনি কল্পনা করি আমার মেয়ে জিপ থেকে নামছে...ওহ্ তাতেই মন ভরে যায়।"
সত্যিই তো এমন স্বপ্ন তো দুষ্টুও দেখছে তবে একটা নয় দুটো।একটা ওর জন্য যেটা সত্যি ছোঁবে আর কিছুদিন বাদেই আর আরেকটা দীপ্তর জন্য যে স্বপ্ন সত্যি হওয়ার জন্য নিজেও অনেকটা চেষ্টা করেছে একদম মন থেকে দুষ্টু।
" মিষ্টিকে জিজ্ঞেস করেছিস হানিমুনের কথা?"অনু বলে।
" মা আমি মিষ্টি বলছি,আমি রীতিমতো এসে গেছি অফিস থেকে। তুমিও তো কম যাওনা? তুমি না শাশুড়ি?"
" তাতে কি আজকাল মায়েরা বন্ধু,আমি জানবোনা আমার রাজকন্যা কোথায় যাবে?"
" হ্যাঁ দাঁড়াও তোমাকে আর বাবাকে এবার আমরা পাঠাবো হানিমুনে।দুষ্টু ঠিকই বলেছে।"
মা মেয়ের খুনশুটি আর মজাটুকুই হয়ত অবসরে ভালো রাখে ওদের। দুষ্টু স্বপ্ন দেখে এক নতুন কোন পছন্দের জায়গার যেখানে পাশাপাশি হাঁটবে ও আর দীপ্তদা। নাইবা ফুটলো পলাশ তবুও পলাশের রেশটুকু যেন থাকে জীবনে।
দুঃখ ভুলতে যেমন অনেকটা সুখ লাগে তেমনি ভালোবাসা ভুলতেও অনেকটা বেশি ভালোবাসা লাগে। ছোটবেলার কথা মনে করে সত্যিই হাসি পায় দুষ্টুর.. একতরফা ভালোবাসা নিয়ে বেঁচেছে ও জোজোদা কোনদিন বোঝেইনি সেটা।ভালোবেসে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার দুঃখ দুষ্টু বোঝে তাই এমন কষ্ট ও কাউকে দেবেনা।
মায়ের আর বাবার সাথে অনেকক্ষণ কথা বলে বিছানায় এসে গা এলিয়ে দেয় দুষ্টু.. ফোনটা খোলে।ফোনে তখন অযোধ্যা পাহাড়,ওদের নাচ গান,বড়ন্তী আর ভোরের হিমের ভেজা সুবাসে ভালোবাসা মাখানো। কিছুক্ষণ এলোমেলো কথায় ডুবে যায় দুষ্টু দীপ্তর সাথে। হঠাৎই দীপ্ত বলে.." আচ্ছা আমার যদি এবারও না হয় তাহলে?"
দুষ্টু ফোনটা নিয়ে ভাবে কি উত্তর দেবে...
হঠাৎই মিষ্টি এসে ওর কাছে বসে..." দীপ্ত কি তোকে ভালোবাসে? আমার তো মনে হয় একদম গেছে ছেলেটা। আসার সময় দেখলাম মনটা খুব খারাপ।ঠোঁট ওল্টায় দুষ্টু আমি কি জানি? তোদের জন্য মন খারাপ হয়তো?"
"বোন,বাজে বকিসনা একদম।তোর সত্যিই কোন ফিলিংস নেই? অবশ্য ওর ডেজিগনেশন তো তোর চেয়ে?"
" দিদি ভালোবাসা কোন সীমা মেনে হয়না।আর যদি হয় সেটা হিসেব করে ভালোবাসা।"
কিছুটা সময় কেটে যায় কথার মাঝে দীপ্ত বুঝতে পারে প্রশ্নটা দুষ্টুকে ভাবিয়েছে তাই উত্তর দিলোনা।মনটা খারাপ হয়ে যায়।
হঠাৎই নীল আলোটা জ্বলে ওঠে...." পলাশ ফুটবেই নাই বা হলো বসন্ত। কি এসে যায় পাওয়া না পাওয়ায়?"
*****************
পুরুলিয়াতে যখন পলাশের অকালবোধন তখন কলকাতার আর কালচিনির বাতাসে প্রজাপতির ঝাঁক উড়ে এসেছে বিয়ের গন্ধ নিয়ে।দুষ্টু জানতোইনা মধুমিতা জেম্মা এরমধ্যে কলকাতা আসবে।
" আরে সত্যিই কোন কথা ছিলোনা আমার আসার, হঠাৎই ভাবলাম দুষ্টু আছে তো চলে যাই এখনি।ওরা তো দিনরাত কাজ করে আর আমি বোর হই।তুই আর আমি দুজনে মিলে তো শুরু করি তারপর ওদের ডেকে নেবো।"
মাথায় হাত দেয় দুষ্টু," এই তো সেদিন আশীর্বাদের সময় কত কি দিলে? আবার বাজার? বাবা বিয়ের তো অনেক হ্যাপা। আমি চলে যাবো কালচিনিতে, সত্যি জেম্মা আমার পছন্দ নেই একদম দিদি পারে এসব।"
মধুমিতা বলে," যাবি তো,তবে একসাথে যাবো আমি আর তুই। অনু বারবার বলে দিয়েছে মিষ্টির বিয়ের শাড়িটাও একবারে কিনে নিতে। সোনা মেয়ে আমার একটু হেল্প কর।সত্যিই তোকে আমি মেয়ের মতই ভাবি সেই কোন ছোট্ট থেকে। মিষ্টি বৌ হয়ে আসুক তবে তুই আমার মেয়ে হয়েই থাকিস।"
সম্পর্কের মিঠেভাবে দুষ্টুর মনও ডুবে যায়।শুধু ভাবে এতো ভালো যদি সব হত তাহলে পৃথিবীতে আর বোধহয় খারাপ থাকতোনা।যদিও বাবা বলে," অনেক খারাপ এবার দেখতে হবে তোকে,মাথা ঠাণ্ডা রাখিস। তুই পারবি সবটা।"
********************
উত্তর থেকে দক্ষিণে আবার কখনো দক্ষিণ থেকে উত্তরে কদিন দুষ্টু ঘুরে বেড়ালো জেম্মার সাথে। দিদিকে ম্যানেজ করে আসতে হলো তারমধ্যেই তবে দিদির বিয়ের এই ধকলটা যে অনেকটাই ওর ওপর দিয়ে যাবে তা ভালোই বুঝলো দুষ্টু। উঃ বাবা লালের যে এতো দশমিকে ভাগ হয় কে জানতো? নীলের অনুপাতিক আরো কত রঙ হয়,সবুজ রঙের প্রকারভেদ কতো এইসব জানতে জানতে দুষ্টু একদম বোর হয়ে গেলো।উফ্ বিয়ে করা যে এত ঝকমারি কে জানে?
তবে দিদি সত্যিই লাকি জেম্মার জবাব নেই মানে মার্কেটিং করাটাই রীতিমতো প্যাশন জেম্মার।তাই কোন কিছুই বাদ পড়লোনা,মা বাবার জন্য ম্যাচিং ড্রেস,মণিমা আর মেসো,ছোটমাসি আর মেসো,মামা মিমি সবাই ঢুকেছে জেম্মার লিস্টে। এমনকি দাদু দিদারাও আছে।" আচ্ছা বিয়েটা কার বলতো জেম্মা"
"বিয়েটা তো শুধু একজন মানুষের সাথে একজনের নয় দুষ্টু।বিয়েতে মিলে মিশে যায় দুটো পরিবার একসাথে। জানিস তো এই বাঁধনটা খুব জরুরী।"
" বুঝেছি,তাই তুমি জামাকাপড়ের বাঁধনে সবাই কে টাইট করে বাঁধছো।যাতে সবাই ভালো থাকে ভালো পোষাকে তাইতো?"
" এই মেয়েটা শুধুই পড়াশোনা করলো,ধুর পাগলি,শুধু বর বৌ সাজবে? আমরা সাজবোনা? আমি তো সকালে বিকেলে সাজবো।নিজের বিয়েতে সাজতেই জানতামনা। তখন এত কিছু ছিলোনা,আর টাকা কোথায় হাতে?"
দুষ্টু হেসে বলে হ্যাঁ বুঝলাম," কিন্তু আমাদের তো একটা লরী বুক করে যেতে হবে।"
" সে ভাবিসনা, ঠিক সব হয়ে যাবে। তবে তোরটা আমি কিনবোনা,তোরটা নাকি জোজো কিনবে। অবশ্য আমি বলেছি আমি আমার মত কিনবো,তুই তোর মতো কেন।"
দুষ্টু অবাক হয়ে যায়...জোজোদা হঠাৎ ওর কথা এত ভাবছে! জোজোদা কি বোঝে জামাকাপড়ের যে ও কিনবে ওর জন্য ড্রেস?
তবে সত্যিই ওকে অবাক করে জোজো ওকে নিতে এলো তাড়াতাড়ি অফিস থেকে এসে।দুষ্টু যথারীতি ফোনে দিদিকে জানালো," আমি বেরোলাম,জোজোদা গাড়ি নিয়ে এসে হাজির।তুই জানিস? বললাম তুই ফেরার পর যাবো তা ধমকাচ্ছে।"
মিষ্টি হেসে অস্থির হলো ফোনের ওপার থেকে," তোর দাদা তোকে নিয়ে যাবে যা। আমি এসবের মধ্যে নেই।ঘুরে আয়না বাবা,আমি তো জানি ও তোকে নিয়ে যাবে।"
দুষ্টু বুঝতে পারে ওদের সব প্ল্যান হয়ে গেছে নিজেদের মধ্যে সুতরাং যেতেই হবে উপায় নেই।
হয়ত জোজোদার এই দুষ্টুমি আর বায়নাটা একটু বেশিই প্রিয় দুষ্টুর। জোজোদা যদি সমুদ্রের বাঁধভাঙা ঢেউ হয় তাহলে দীপ্তদা গভীর নদী।কত কি যে যত্নে ধরে রাখে নিজের গভীর জলে বোঝাই যায়না। আর জোজোদার সব আবেগ উচ্ছ্বাস ঢেউয়ের সাথে তীরে এসে আছড়ে পড়ে কখনো ছিটকে পড়ে কিছূ মুক্তোভরা ঝিনুকও।
সুতরাং দুষ্টুকে ভাসতে হলো আজ সেই ঢেউয়ের খেয়ালে।
বায়নার সুরে জোজো বলে," সবার সব পছন্দ করবে আমার ছোট শালীটা,আর ওরটা আমি কিনবোনা তা হয় নাকি? তারপর আরো কিছু তো কিনতে হবে।সব মায়ের সাথে হয় নাকি?"
জোজোদার দুষ্টুমি টের পেলো দোকানে এসে এবার দুষ্টু। হায় ভগবান একটা নয় একেবারে দুটো ড্রেস তার সাথে ম্যাচিং একটা কাপল ড্রেস।
অবাক হয়ে যায় দুষ্টু," তুই আমার সাথে ম্যাচিং করে ড্রেস কিনছিস কেন শুনি? জেম্মা তো কিনেছে,তোর আর দিদির মিলিয়ে।"
জোজোর চোখটা হঠাৎই আলো জ্বালে আর সেই আলোতে দুষ্টুর মনের অন্ধকারে ভেসে ওঠে একটা মুখ...দীপ্তদার জন্য তাহলে ! কি পাজি ছেলে তো,উফ্। না না হয়ত পাজি নয় একটু বেশিই ভালো।
তাই মিষ্টির জন্যও স্পেশাল গিফ্ট,ওর আঙটি আরো পছন্দের কিছু কিনলো জোজো।
দুষ্টু হাসলো.." এই শোন এই কেনাকাটা করার জন্য যা ঘোরাঘুরি করাচ্ছিসনা তারজন্য আমি একটা স্পেশাল প্রাইজ নিয়েই ছাড়বো।"
" তুই বল কি চাই আমি একদম রাজি।দরকারে তোকে নিয়ে হানিমুনেও যেতে পারি।"
...." যা খুশি তাই বলে যা।চল এবার বাড়ি যাই,দিদি এসে পড়েছে।"
মনের ভেতরে একটা রিনরিনে ছোট ঢেউ বয়ে গেলো হানিমুনের কথায়।দুষ্টুকে ওরা যতই ছোট ভাবুক,দুষ্টু এখন অনেক পরিণত আর বুদ্ধিদীপ্ত। তাই আজকাল এই ছোটছোট মজাগুলো উপভোগ করার ফাঁকে ফাঁকে মনটাকে শান দেয় ভালো করে ভবিষ্যতের কথা ভেবেই।
প্রেম ভালোবাসার যেমন দরকার জীবনের মিঠে রঙটুকু ছুঁতে,ঠিক তেমনি দরকার নিজেকে তৈরি করা ভবিষ্যতের জন্য। হয়ত মেয়েদের নিজেদের জন্যই নিজেকে স্বাবলম্বী করা উচিত।
ওকে বাড়ির সামনে নামিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা মিষ্টিকে হাত নেড়ে জোজো রওনা দেবার আগে বলে গেলো," দিদির কাছে প্লিজ ওর সারপ্রাইজ গিফ্টের কথা বলিসনা।"
দুষ্টু মাথা নাড়ে..
মিষ্টির সাথে অনেকটা সময় বকবক করলো দুষ্টু.. দুজনের এইটুকু সময় সারাদিনের শেষে।
দুষ্টু থাকাতে কালচিনির রাতগুলো আবার মনের মাঝে উঁকি দেয় মিষ্টির। আর হয়ত সিঙ্গেলবেডে শুয়ে শুয়ে গল্প করার রাত্রিগুলো তেমন ভাবে আসবেনা। অনেক গল্প করলেও সারপ্রাইজ গিফ্টগুলোকে মিস্ করে গেলো দুষ্টু...
.." আর কি কিনলি বললি না তো?" জিজ্ঞেস করে মিষ্টি।
" ঐ তো আমার জামাকাপড়,আর সাজগোজের জিনিস। সবই তো নিয়ে চলে গেলো জোজোদা। তুই পরে দেখে নিস।"
দুষ্টুর ফোনের আলোটা জ্বলতে দেখে,আজ সারাদিন তেমন কথা হয়নি দীপ্তদার সাথে।ছোট দুএকটা মেসেজ ছাড়া হঠাৎই জোজোদার কেনা রঙীন ধুতি আর কুর্তা সেটটা মাথায় ছবি আঁকে। ওর পাশে দাঁড়িয়ে কেমন লাগবে ছয় ফিটের ওপর লম্বা দীপ্তদাকে? জোজোদা তো একদম সারপ্রাইজ করে রাখলো সবটা। সত্যিই বোধহয় এমন বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।
ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় দুষ্টু, মিষ্টি জেগে থাকলেও এই সময়টা বোনকে স্পেশ দেয় যদিও ওর একটু সন্দেহ থেকে যায়..সত্যিই কি হবে কিছু ওদের মাঝে? বাবা কি রাজি হবে? ভবিষ্যতে দুষ্টুর বা দীপ্তর ইগো প্রবলেম হবেনা তো?
নিজের মত উত্তর গুছিয়ে নিয়েছে মিষ্টি,আচ্ছা মেয়েরা যদি স্বামী উচ্চপদে চাকরি করে বলে গর্ব করতে পারে,তাহলে ছেলেরা পারেনা কেন?
ওরা দুজনেই অনেকটা বড়,নিজের মত নিশ্চয় একটা কিছু ভালো ভেবে নেবে দুষ্টু, ওকে ঠকতে হবেনা ওর মত।
যেদিন প্রথম সায়ম ওর ঠোঁট ছুঁয়েছিলো সেই কথাটা রাতের বিছানায় শুয়ে আজ হঠাৎই মনে পড়ে গেলো মিষ্টির।নিজেকে হঠাৎই ভীষণ খারাপ আর বোকা মনে হলো ওর। জোজোকে হয়ত কোনদিনই বলতে পারবেনা সেই কথা। আচ্ছা জোজো কি জানে? মানে বুঝতে পেরেছে? এই কথা কি কোনদিন বিয়ের পর আবার উঠবে?
হঠাৎই জোজো পুরুলিয়াতে.... মিষ্টির মনের লুকোনো অনুভূতি হঠাৎই মনে আসে। ঘরের বাইরে বারান্দায় বসে দুষ্টু কথা বলছে। মিষ্টির মনে পড়ে যায় পুরুলিয়া থেকে আসার দিন সকালটার কথা। দীপ্তর পেছনের বাগানটা বোধহয় ওদের সবারই স্মৃতিতে থেকে যাবে সারাজীবন। ঘুম থেকে উঠে দুষ্টু আর দীপ্তকে না দেখতে পেয়ে ফুলিয়াকে বলে ওরাও হারিয়েছিলো নির্জনে...মিষ্টি জোজোকে বলতে চেয়েছিলো কিছু কথা...জোজো শুনতে চায়নি কেন যেন শুধু বলেছিলো," পুরোনো যা কিছু আজ থাক না ফোঁটা পলাশের মাঝে। আমাদের মাঝে ফুটুক গোছা গোছা লাল পলাশ এক নতুন ভালোবাসার আশ্বাসে।"
তবুও মিষ্টি বলতে গেছিলো আবার..." সায়ম আমাকে।"
" আজ থাকনা মিষ্টি ঐ নামটা,মুছে ফেলা কষ্ট জানি তবুও চেষ্টা কর একটু একটু করে। আমি জানতে চাইনা কিছু।"
না দেখতে চাইলেও যে অনেকটা দেখে আর জেনে ফেলেছিলো জোজো।
অদ্ভুতভাবে আজ দুষ্টুর আর মিষ্টির দুজনের ভাবনাতেই একটাই নাম জোজো।
দীপ্তর সাথে কথা বলতে বলতে হেসে গড়িয়ে পড়ে দুষ্টু.." উফ্ জোজোদা একটা ছেলে বটে।আমাকে আজ একদম ঘুরিয়ে ছেড়েছে।"
দুষ্টুর কথা শুনে দীপ্তর মনও হারায়, সত্যিই ভীষণ ভালো ছেলে উত্তীয়। এমন ভাবেই কি দুষ্টুর মনে ও জায়গা করে নিতে পারবে?
তবে একটা কথা দুষ্টুকে বলতেই হবে ওকে যে চিঠিটা ও পড়েছিলো।দুষ্টু ওকে ভুল বুঝবেনা তো?
বোন গান শুনবে বলে চালিয়ে দিয়ে বাইরে চলে গেছে...একটার পর একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছে আপন খেয়ালে।
" গোপন কথাটি রবেনা,গোপনে... না না না রবেনা গোপনে।"
সত্যিই কি ওর গোপন কথা জোজোকে বলতে পারবে? ও তো বলতে চেয়েছিলো কিন্তু জোজোই শোনেনি।
দীপ্ত দুষ্টুকে জিজ্ঞেস করে..." গানটা কোথায় হচ্ছে?"
" এই তো ঘরে,আমি এবার ঘরে এলাম। অনেকটা রাত হলো ঘুমিয়ে পড়ো এবার। কাল রাতে আমাদের ট্রেন। তোমার দেওয়া যন্ত্রটা ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমাদের ইচ্ছেমতো।
*************************
মধুমিতা যতটা কম পেরেছে নিয়েছে জিনিসপত্র,বাকিটা জোজোর বাবা এসে নিয়ে যাবে।আর কিছুটা ছেলে। জেম্মার ব্যাগটা দেখে অনেকটা নিশ্চিন্ত হয় দুষ্টু।
তবে অত কেনাকাটা গেলো কোথায়....মধুমিতা ওর কথা শুনে হাসে।
"ভাগে ভাগে গুছিয়ে নিয়েছি আর কিছু প্যাক করে রেখে এসেছি ঠিক চলে আসবে সময়ে ভাবিসনা। লাখ কথা আর হাজারো জিনিস লাগে বিয়েতে।তবে আমার ভাগ্য ভালো। তেমন কিছুই কথা বলতে হয়নি।"
জেম্মাকে আর ওকে ট্রেনে তুলতে জোজোদা আর দিদি দুজনেই এসেছিলো।
মাঝে আর খুব একটা বেশি সময় নেই। দিদিকে জড়িয়ে আদর করে আর জোজোদার সাথে মজা করে ট্রেনে পা দেয় দুষ্টু।
মধুমিতা বারবার বলে দিলো সাবধানে থাকতে এই কয়েকটা দিন এমনিতেই অনেক ঘোরাঘুরি করে এসেছে। দুষ্টু দেখলো দিদি বেশ বাধ্য মেয়ের মত মাথা নাড়লো।
বাবা তারমধ্যেই ফোন করে বারবার সাবধান করলো দুষ্টুকে, কারো সাথে যেন কোন ঝামেলাতে না আসে কারণ এরপর চাকরিতে যেতে হবে।
দুষ্টু হাসে," আমি এখন বড় হয়ে গেছি বাবা ভেবোনা।"
সত্যিই বোধহয় বাবা মায়ের চিন্তার কোন শেষ নেই। বাড়িতে এসে সেটা খুব বুঝতে পারলো দুষ্টু।তবে ওর মনে এখনো মহুয়ার নেশা আর পলাশের গন্ধ.....কলকাতা আর পুরুলিয়া মিলে অনেকটা স্মৃতি মনের মাঝে রয়ে গেলো।
****************
মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন এরমধ্যে রবীনের স্কুলের ব্যস্ততা বেশ বেড়েছে। স্কুলবিল্ডিংটা খুব সুন্দর ভাবে সেজেছে,বাগানের সবুজের বাহারে মন ছুঁয়ে যায় সবারই। এরমধ্যেই স্কুল অনেক পুরস্কার পেয়েছে,প্রতিবারই একটা করে রঙিন পালক যোগ হয়েছে রবীনের মুকুটে।
" স্যার আমাদের স্কুল অঞ্চলের সেরা স্কুলের জায়গায় পৌঁছে গেছে সবটাই আপনার জন্য।"
রবীন কৃতীত্বের মুকুট একা মাথায় রাখতে পারেনা...সত্যিই তো সবাই সহযোগিতা না করলে এইসব কিছু হতনা।
অনেকেই বলছেন হয়ত সামনেবার পুরস্কৃত হবেন রবীনস্যার সেরা শিক্ষক হিসেবে। তবে রবীনের মনে হয় নিজে সেরা হবার জন্য বোধহয় কিছুই করেননি সবটাই ছাত্রদের জন্য। তাই সেরা শিক্ষকের কৃতীত্বের শিরোপা ইতিমধ্যেই পেয়েছেন ছাত্রদের কাছেই, হয়ত সেটাই পরম প্রাপ্তি।
*******************
বাড়িতে এসে দুষ্টুকে দেখে নিজেকে আরো পরিপূর্ণ মনে হয় রবীনের। পিতা আর শিক্ষক দুই ভূমিকাতেই হয়ত পরিপূর্ণ রবীন। দুষ্টুর পাশে আবার দীপ্তকে মনে হয় রবীনের, কিন্তু দুষ্টুর কি পছন্দ হবে দীপ্তকে? এলোমেলো চিন্তার মধ্যে অনু আর ক্যালেন্ডারে দেওয়া লাল দাগটা বলে যায় অনেক কাজ সামনে....মিষ্টির বিয়েটা যেন ভালোভাবে হয়ে যায়।
******************
চাবাগানের দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে যায় দুষ্টুও প্রায় দিনই এখন অপেক্ষা অর্ডার আসার। এলেই জয়েন করতে হবে।যদিও রবীনের খুব ইচ্ছে মিষ্টির বিয়েটা হয়ে যাওয়ার পর দুষ্টুর কাজ শুরু হলেই ভালো হয়।
"বাবা,শুভ শুভ বলো,আর কতদিন ঝুলে থাকবে চাকরিটা? এবার আসুক চিঠি,আমি জয়েন করবো বাবা।"
" তুই চলে গেলে যে আমার কি হবে কে জানে? তোকে তো কখনো দূরে যেতে দিইনি।একদম কাছে কাছে রেখেছিলাম। সত্যিই দুষ্টু, এক দিক দিয়ে হয়ত স্বার্থপরতাই করেছি আমি। মিষ্টির বিয়ের কত কাজ করছিস আমার হাতে হাতে।"
" বাবা আমি তোমার বেটা তো,তাহলে করবোনা কেন?তাছাড়া দিদিটা তো আমার তাইনা?"
রবীনের মনের মাঝে এখনো উড়ে আসে হঠাৎই একটুকরো কালো মেঘ। আদরের এই ছোট মেয়েটা কত দুঃখ পেয়েছে একসময় ভালোবাসা ভেঙে যাওয়াতে কে জানে? কত দুঃখই জমা হয়ে আছে এই রকম মনে কেজানে? ওকে একটু আনন্দে রাখতে পারলে ভালো লাগে রবীনের।
মেয়ের কাছে এসে মাথায় হাত রাখে রবীন.."তোর জামাকাপড় সব কিনেছিস তো? একটা কথা বলবো দুষ্টু, তুই কি এই বিয়েটাতে থাকতে চাসনা তাই তাড়াতাড়ি চাকরিতে চলে যাচ্ছিস?"
" বাবা তুমি কি দিন দিন বাচ্চা হয়ে যাচ্ছো? এরপর কিন্তু হেডস্যার বলে তোমাকে কেউ মানবেনা।"
মেয়ের গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে রবীন," কেন বলতো?"
" আমি দিদির বিয়েতে আনন্দ করবো বলে কত জিনিস কিনলাম মানে আমাকে জেম্মা,দিদি আর জোজোদা কিনে দিলো। আর আমি থাকবোনা?তুমি কি বলছো বাবা! তবে চাকরিতে যেতে তো হবে নাকি?"
রবীন শুনে অবাক হলো জোজো দুষ্টুকে নিয়ে গিয়ে জামাকাপড় কিনে দিয়েছে। অবশ্য ছেলেটার তো কোন দোষ নেই আগেই বলেছে দুষ্টু। ওদের আনন্দে এখন খুশি হতেই ভালো লাগে।
একগোছা কার্ডও এসে গেছে প্রজাপতি খামের ওপর আর বুকে নিয়ে। মিষ্টিকে নিয়ে পছন্দ করেই কিনেছে দুষ্টু... যদিও ওদের দুজনের এক মতই ছিলো কার্ডে বেশি খরচ করে লাভ নেই।
সন্তানদের মানুষ করার সাথে সাথে হয়ত এভাবেই সংযমী হতে শিখিয়েছে রবীন। দুষ্টুর তাই সবসময় মনে হয় বাবা বলে.." যতটা প্রয়োজন খরচ কর,কৃপণতা করিসনা।তাহলে আবার সম্মানহানি হবে তবে খাবার,জল আর অর্থের অপচয় করিসনা। ওগুলো কিন্তু খুব দরকারী, সংকটে পড়লে আমরা বুঝতে পারি।"
সুতরাং কেনাকাটার ব্যাপারে মিষ্টি সবসময় বাবার কথা মনে রেখেছে.. "হাতে আজ অর্থ আছে বলে অপব্যবহার করিসনা,কাল নাও থাকতে পারে। লক্ষ্মী বড়ই চঞ্চল,তাকে যত্নে ধরে রাখিস।
জোজো বেহিসেবে যা খুশিই করুকনা কেন,মধুমিতা নিজেও লক্ষ্য করেছে ওদের দুইবোনকে আর আশ্চর্য হয়েছে।একটা সময় মিষ্টিকে অহঙ্কারী, স্টাইলিশ আর অন্যরকম মনে হলেও মধুমিতা দেখে অনেক পাল্টে গেছে মিষ্টি।
সত্যিই রবীনদার কোন তুলনা হয়না বইয়ের শিক্ষা তো সবাই দিতে পারে কাগজে কলমে কিন্তু জীবনের শিক্ষা কজন দিতে পারে এভাবে?
তবে দেওয়া আর নেওয়ার ক্ষেত্রে দাতা এবং গ্ৰহীতা দুজনেরই ভালো হওয়া প্রয়োজন।সঠিক গ্ৰহীতা হওয়াও বোধহয় দরকার, নাহলে দাতার সব দানই ব্যর্থ হয়ে যায়। ঠেকে বা ঠকে যেভাবেই হোক তাই শেখাটা খুব জরুরী।
********************
বিয়ের নিমন্ত্রিতের তালিকা,ক্যাটারিং,প্যান্ডেল সবের ব্যবস্থা প্রায় ঠিকঠাক।প্রথমে রবীন ভেবেছিলো সবটাই নিজে করবে,দুষ্টু আর মিষ্টি দুজনেই বাধা দিয়েছে।বকুনি দিয়েছে রাণুও," জামাইবাবু শুভর পরিচিত একজন আছে সবটা করে দেবে,আগে পরে আর বিয়ের দিন সব।সুতরাং আপনি শুধু কেন পরিশ্রম করবেন?"
"কিন্তু কৃষ্ণ বলছিলো সেই কলাপাতা পেতে খাওয়া আর মাটির গ্লাসে জল তার আমেজই আলাদা। তোমরা সবাই তো ছিলে।"
অবাক হয়ে যায় রাণু," এবার মিষ্টিকে বকতে হবে,না না জোজোকে এভাবে কেন নিজেদের মধ্যে প্রেম ভালোবাসা করলো? আমি তো ওখানে তেমনভাবে যেতেই পারবোনা। এদিকে কে সামলাবে?"
সত্যিই রবীনের মাথাটা মাঝেমধ্যেই কাজ করেনা,কাছের শালীটা তো আটকে পড়লো।দূরের শালা,শালাবৌ,শালী যারাই আসুক সবাই তো এসে অপরিচিত জায়গায় পড়বে। তবুও ছাত্ররা আছে,কলিগরা আছে ওরাই এখন বল ভরসা। এছাড়াও ভাই আসবে,নিশ্চয় সব ঠিকঠাক মত হয়ে যাবে।
" হ্যাঁ বাবা সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে তুমি ভেবোনা একদম। আমরা তো সবাই আছি,তুমি শুধু শরীরের যত্ন নাও। এত সবাই আসবে,ভাবনা কি?"
রবীন একটু হাসে তারপর বলে, " হ্যাঁ রে দীপ্ত আসবে তো? আমি অবশ্য ফোন করবো ওকে।"
দুষ্টুর উচ্ছ্বলতা একটু বেড়ে যায়.."হ্যাঁ বলেছে চেষ্টা করবে তবে দিদি আর জোজোদা বলেছে না এলে ঝগড়া হবে।"
দুষ্টুর হাসিমুখে রবীন পড়তে চেষ্টা করে কিছু..." ওখানে তো খুব মজা করে এসেছিস তোরা,জায়গাটা মানে ওর কোয়ার্টার অফিস সব ঠিকঠাক তো? এখন কোন ঝামেলা নেই তো?"
বাবার কথায় দুষ্টুর চোখে ভাসতে থাকে এক অন্য পুরুলিয়া যার পরতে পরতে দুদিন মিশে ছিলো টুকরো ভালোবাসার মিঠে গল্প...অল্প অল্প প্রেম,বেশি অনুভূতির অনুরণন।
...." না বাবা,এখন তো সব ঠিকঠাক চলছে মনে হলো।তবে দীপ্তদা আর কতদিন ওখানে থাকবে কেজানে? যদি এবার হয়ে যায় তাহলে তো..."
" তোর কি মনে হয় ওর হয়ে যাবে এবার? মানে এত সহজে?"
" হতেই পারে বাবা,একটা পরীক্ষা দিয়ে চাকরি তো পেয়েছে তারপর প্রচুর পড়াশোনা করে বাবা।"
" তোর থেকেও বেশি?"
" আমার থেকে সিনিয়র বাবা,এটা তুমি ভুলে যাচ্ছো।হি ওয়াজ আ ব্রাইট স্টুডেন্ট।তুমি তো অনেকবার বলো এমন ভালো ছেলে কম পেয়েছো জীবনে। অভাবটা ওকে উঠতে দিলোনা।"
রবীন চুপ করে ভাবে।ভাবে দুষ্টুও,হয়ত ওর পাওয়াটাও সহজ করে দিয়েছে দীপ্তদাই। তবে কিছু কথা না বলাই থাক।
অনু কাজের মাঝে এসে তাড়া দিয়ে যায়.." তুমি বেরোও ওকে নিয়ে একবার।পড়াশোনা পেলে কি সব ভুলে যাও।"
অনুর কথাতে একটু লজ্জা পেলেও রবীনের মনে হয় সারাজীবন পড়াশোনা করা যায় বলেই হয়ত এই জীবনটা এত প্রিয় ওর কাছে। যে যেখানেই পৌঁছোও জীবনে আগে আসতেই হবে পাঠশালাতে পাঠ নিতে।
********************
বাবাকে বাইকের পেছনে বসিয়ে কাজগুলো সেরে ফেলে দুষ্টু। রাস্তায় পরিচিত অনেকের সাথেই দেখা হয় রবীনের, কার্ডসহ আর কার্ডছাড়া কতজনকে যে বলে ফেলছে বাবা ভেবে অবাক হয় দুষ্টু। অনুও অশান্তি করে মাঝে মাঝে..." দেখবে ঠিক তোমার মেয়ের বিয়েতে খাবার কম পড়বে।"
রবীন হেসে বলে," আমি কে খাওয়াবার শুনি? মানুষ খাবে নিজের ভাগ্যে।"
তবে ভাগ্যের কথা বলতে বলতে অবাক হয়ে গেলো রবীন কখন যে ভাগ্য কাকে কোথায় নিয়ে যায় ভাবাই যায়না সত্যিই দুষ্টুর ভাগ্যটা ভালো। পোস্টিং হয়েছে তাও কাছাকাছি সত্যিই ভাবা যায়না,এখন প্রোবেশনারি পিরিয়ডে আপাততঃ সাবডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট তারপর পরে আরো পদন্নোতি।
আনন্দে বাবাকে জড়িয়ে ধরে দুষ্টু, আজ রবীনের চোখের জল বাধা মানেনা। অনুর চোখও ঝাপসা,খুব মনে পড়ছে আজ দুষ্টুর ডায়েরিতে লেখা কথাগুলো।চিরকাল মিষ্টি বড় বলে বোধহয় বেশি ভালোবাসা আর গুরুত্ব দিয়ে এসেছে ওকেই।কবে যে নিজের পায়ের তলার মাটি খুঁজতে এত লড়াই করে গেছে মেয়েটা বুঝতেই পারেনি।
ভেজা চোখে মায়ের আদর খায় আজ দুষ্টু মন ভরে,অনু বলে," কখন কি বলেছি রাগ করে সেগুলো মনে করে কষ্ট পাসনা যেন।আজ গর্বে বুকটা ভরে যাচ্ছে আমার। সত্যিই আজ কত যে আনন্দের দিন। কখনো ভাবতে পারিনি মেয়ে আমার এত বড় হবে।"
" আমি বড় হইনি মা,তোমার কাছে সেই ছোট দুষ্টু। কোন কিছু জীবনে খারাপ নয়।যদি তুমি শাসন না করতে তাহলে হয়ত লড়াই করার শক্তিটাই পেতামনা।"
আসলে সবসময়ই বোধহয় সবকিছু খারাপেথ জন্য হয়না।হয়ত জীবনের কিছু খারাপ লাগা অনেক বেশি সাহসী আর লড়াকু করে তোলে।
মুঠোফোনে খবরটা ছড়িয়ে যায় সবার কাছেই। জোজো, মিষ্টি আর দীপ্ত দূরে বসেও ছুঁতে পারে দুষ্টুর খুশিটাকে।
জোজো মনে মনে বলে.." তোর এত শক্তিকে আমি ধরে রাখতে পারতাম না দুষ্টু। তারচেয়ে খুনশুটি আর মাতব্বরি করার সম্পর্কটাই থাক আমাদের। তোকে দীপ্তর সাথেই মানায় ভালো। অদ্ভুত একটা আগুন আছে তোদের মধ্যে,তোরটা সবসময় জ্বলে আর দীপ্তরটা ঘুমন্ত ওকে জ্বালিয়ে আর জাগিয়ে দিতে হয় মাঝেমাঝেই।"
দীপ্তর মনে খুশির হাওয়া কখনো উত্তরে কখনো পশ্চিমে বইতে থাকে..." ও কি হাত ধরে হাঁটতে পারবে? এই বসন্তে কি পলাশের রঙ গাঢ় হবে? নাকি পলাশ ফুটতে এখনো বাকি?"
একটু ভয়ও হয় দুষ্টুর ডেজিগনেশন নিয়ে।তবুও একটু হাসি নিয়ে বলে," এরপর তো ম্যাডাম বলতে হবে সেই ছোটবেলায় স্কুলে যেতে দেখা দুষ্টুকে।"
" কেন দুষ্টু কি বদলে গেলো নাকি? আগেও যা বলতে এখনো তাই বলবে।"
দীপ্তর চুপ করে যাওয়া দুষ্টুকে ভাবায় একটু হলেও বুঝতে পারে দীপ্তদার সঙ্কোচ হয়ত বা ইগোও। তবে ইগোকে তো ভাগো বলতেই হবে তাই মনে মনে ভাবে ঠিক আছে,এখন যা খুশি ভেবে নাও। তারপর আমি পরে কথা বলবো।
সারাদিনের অনেক আনন্দর মাঝে রাত্রি নামে নিয়ম মেনেই। এই সময়টা খুব প্রিয় দুষ্টুর কত একলা রাতে কখনো ভেবে,কখনো পড়ে আবার কখনো নিজেকে শান দিয়ে কাটিয়েছে দুষ্টু, তবে আজকাল ঐ সময়টাতে কালচিনি আর পুরুলিয়া কিছুক্ষণের জন্য একাকার হয়ে যায় দূরত্বকে গুরুত্ব না দিয়ে।
রায়বাবুকে আজ খবরটা দিয়েছে দীপ্ত,রায়বাবুর মনে একটু খটকা লাগে সম্বন্ধ দেখতে গিয়ে নিজের থেকে পড়াশোনাতে একটু কমা মেয়ে হলেই চলতো সেই যুগে তবে এযুগে কি সেসব উঠে গেলো? কেজানে? দিব্যি আনন্দে সবাইকে মিষ্টি খাইয়ে দিলো স্যার কারণ তার বান্ধবীর পোস্টিং হয়ে গেছে। যত্তসব আদিখ্যেতা।
মনে মনে বলেন," দ্যাখ তোকে শেষে পাত্তা দিলে হয়। অবশ্য না দিলে তো ওনারই লাভ যাক দেখা যাক।
******************
দুষ্টুর ঘরে ফোনের নীল আলোটা জ্বলা নেভা করে.." তখন চুপ করে গেলে কেন? কোন প্রবলেম?"
" অফিসে তো,সামনে রায়বাবু তাই।"
" না শুধু তাই নয় ঠিক করে বলো।"
" কেন যেন মনে হলো এবার বসন্তে পলাশের রঙটা গাঢ় হবে তো?"
"তুমি এসেই দেখো বসন্তে কে বলতে পারে চাবাগানের মাঝেও হয়ত উঁকি দেবে পলাশ।"
মনে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয় দীপ্তর কেন যেন আজ খুব ইচ্ছে করছে বলতে....আমার মতে তোর মত কেউ নেই।অথবা তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা।
আস্তে করে গানটা চালিয়ে দেয় দীপ্ত....দুষ্টুর কানে পৌঁছয় গানটা...দীপ্ত বলে শুনতে পাচ্ছিস?হ্যাঁ পাচ্ছি।
"আমার গলায় তো সুর নেই তাই,এমনিতে শোনালাম।"
দুষ্টু গলা মেলায় ওপারের গানের সাথে...
তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা,
এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা॥
যেথা আমি যাই নাকো তুমি প্রকাশিত থাকো,
আকুল নয়নজলে ঢালো গো কিরণধারা॥
তব মুখ সদা মনে জাগিতেছে সংগোপনে,
তিলেক অন্তর হলে না হেরি কূল-কিনারা।
কখনো বিপথে যদি ভ্রমিতে চাহে এ হৃদি
অমনি ও মুখ হেরি শরমে সে হয় সারা॥
এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা॥
যেথা আমি যাই নাকো তুমি প্রকাশিত থাকো,
আকুল নয়নজলে ঢালো গো কিরণধারা॥
তব মুখ সদা মনে জাগিতেছে সংগোপনে,
তিলেক অন্তর হলে না হেরি কূল-কিনারা।
কখনো বিপথে যদি ভ্রমিতে চাহে এ হৃদি
অমনি ও মুখ হেরি শরমে সে হয় সারা॥
বিছানায় শুলেই আজকাল নানা চিন্তা মাথায় ভিড় জমায় রবীনের। আজ স্কুলে সবাইকে মিস্টি খাইয়েছে মনটা একদম পরিপূর্ণ।কে জানে উত্তেজনা বেশি হলেও হয়ত ঘুম আসেনা। অনু সারাদিনের ক্লান্তিতে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। বন্ধ জানলা ভেদ করে এসেছে চাঁদের আলো,অনুর গায়ে কম্বলটা জড়িয়ে দেয় ভালো করে রবীন।ওর খোলা হাতের শাঁখাপলাতে ভালোবাসার বন্ধনের রঙ হয়ত বা বন্দিত্বের শৃঙ্খলও তবুও আজ সবটুকু দিয়ে ভালো লাগে অনুর ঘুমন্ত মুখটা। কোন সময় রাগ হয়েছে,কখনো স্বার্থপর মনে হয়েছে তবুও ওর শাসনেই মেয়েদুটো ভালো হয়েছে।
বিছানা থেকে উঠে বাথরুমে যাবার পথে দুষ্টুর গলার মিঠে গান হাল্কা আওয়াজে শুনতে পায়।আজ মেয়েটা খুব খুশি..তবে এত রাতে গান গাইছে কেন? হয়ত বা মনের আনন্দেই।হঠাৎই হাল্কা হাসির আওয়াজ পায় দুষ্টু কথা বলছে। রবীন বুঝতে পারে প্রেমপর্বের গান হয়ত বিশেষ কাউকে শোনাচ্ছিলো দুষ্টু।
হঠাৎই ইচ্ছে করলো ওকে ডেকে কিছু বলতে..
দুষ্টু.. "এখনো জেগে আছিস? কতদিন পরে তোর গান শুনলাম।সেই পরীক্ষার আগে শুনেছিলাম।"
" হ্যাঁ বাবা,দীপ্তদার সাথে কথা বলছিলাম।"
মেয়ের সহজ অথচ স্পষ্ট স্বীকারোক্তি মুগ্ধ করে রবীনকে বুঝতে পারে দীপ্ত নামটা বলে হয়ত বাবার মনটাও পড়তে চায় দুষ্টু।
" আচ্ছা কথা বল,আসলে তোর গানটা নিঃশব্দ রাতে এতো ভালো লাগছিলো,শেষ হয়ে গেলো তাই ডাকলাম।"
বিছানায় এসে নিশ্চিন্তে শরীরটা এলিয়ে দেয় রবীন বুঝতে পারে দুষ্টু বড় হয়েছে। হয়ত অনেকটা দায়িত্ব এবার কমে গেলো,দীপ্ত যে তারও বড় আদরের।
*************************
" বাবা বোন খুব আদর খাচ্ছে,আমি সব শুনছি। এবার আমি যাবো তোমাদের আদর খেতে।"
রবীনের মনটা একটু ভারী হয়ে যায়," সবসময় তোর কথাই তো হচ্ছে। একসাথে সব পড়ে গেলো আমার সামনের সপ্তাহে ও যাচ্ছে জয়েন করতে আর তার দশদিন বাদে তুই আসছিস। তবে চিন্তা নেই ও চলে আসবে, ভাগ্য ভালো কাছেই আছে আপাততঃ।
মাঝে কেটে গেছে কয়েকটা দিন,দুষ্টুর মনে অদ্ভুত একটা অনুভূতি। কি জানি কেমন হবে অফিসের দিনগুলো? যদিও বাবা বারবার বলছে সময় সব শিখিয়ে দেবে কিভাবে চলতে হয় একদম ভাবিসনা সেসব নিয়ে।
সত্যিই বোধহয় সবসময় সবকিছু ভেবে হয়না তবে পদের সম্মান যে এতোটা হয় তা ভাবেনি দুষ্টু।মনটা অদ্ভুত একটা ভালোলাগায় ভরে যায়। বাবার কথা খুব মনে পড়ে...বাবার মত হতে খুব ইচ্ছে হত। বাবা বলতো তুই তোর মত হবি,একদম মনের মত। সত্যিই এতদিন অপেক্ষা করে হয়ত মনের মত জায়গায় পৌঁছতে পেরেছে কিন্তু মনের মত কাজ করতে পারবে কিনা তা হয়ত সময়ই বলবে।
দেখতে দেখতে মিষ্টির বিয়ের দিন এসে যাচ্ছে,মিষ্টি আপত্তি করলেও এবার আর রবীন শোনেনা.." না না কদিন বাদে বিয়ে তা হবেনা,জোজো আমাদের সাথে আসুক কিন্তু আমি এবার তোকে আনতে যাবো।"
মিষ্টি আদুরে গলায় বলে," বাবা এখনো আমি ছোট নাকি?"
" আমার কাজ আছে কিছু তাই যাবো,তারপর তোকে নিয়ে ফিরবো।"
জোজো শুনে বলে," বিয়ের সময় লোকে হ্যান্ডিক্যাপড হয়ে যায় জানিসনা? সব সময় ধরে ধরে আর পিঁড়িতে বসিয়ে নিয়ে যায় লোকে জানিসনা?"
দিন গোনার শুরু সবাই,দুষ্টুও অনেক কাজের মধ্যেও দিন গোনে।দীপ্তদা কথা দিয়েছে আসবে...এবার দীপ্তদাকে দেখাবে সবুজ চাবাগানের মাঝেও কখনো পলাশ ফোটে।
Comments
Post a Comment