গুপী গাইন বাঘা বাইন যখন দেখতে গেছি অথবা সোনার কেল্লা তখন খুব ছোট আমি। আমরা গ্ৰামে থাকতাম সেখানে কোন সিনেমা হল ছিলোনা তাই গরমের ছুটিতে বা পুজোর ছুটিতে যখন মালদা যেতাম তখন বাচ্চাদের কোন সিনেমা এলেই বাবা নিয়ে যেতেন দেখতে। তখন বাড়িতে টিভি ছিলোনা,সিনেমা দেখা মানে একটা বেশ বেড়াতে যাওয়া যাওয়া ভাব।সকাল থেকেই যাবো কোথাও একটা এই ভেবে মনে খুব খুশি তাইজন্য একটু আগে বেরিয়ে বাবা কিনে আনতেন হলুদ রঙের পাতলা কাগজের টিকিট আবার কখনো গোলাপী রঙেরও দেখেছি। তারপর একটা ভালো জামা আর নিউকাট জুতো পরে বাবা মায়ের সাথে রিক্সায় সিনেমায় যাওয়া।এই ভাবেই ছোটবেলায় হাতে গোনা যে কয়েকটা সিনেমা দেখেছি তারমধ্যে মনে দাগ কেটে গেছিলো খুব বেশি করে সোনার
কেল্লা,হীরক রাজার দেশে কারণ দুটোই রঙীন ছবি আর তার মধ্যে যে মানুষটাকে খুব মনে আছে তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আমি অবশ্য তাকে তখন ফেলুদা বলেই চিনতাম।একটু বড় হয়ে পরে বই পড়ে জেনেছিলাম ফেলুদা আসলে একটা গোয়েন্দা চরিত্রের নাম। কোন সিনেমায় বাবা নিয়ে যেতে চাইলেই বলতাম.." ফেলুদা দেখতে যাবো তো?" ছোট্ট শিশুমন অবাক হয়ে ভেবেছিলো এত বুদ্ধি আছে ফেলুদার!
একটা সময় আবৃত্তি শুনে প্রেমে পড়েছিলাম সেই আবৃত্তিকারের কন্ঠের। রবীন্দ্রনাথের কবিতা তার কন্ঠে শুনে মন হারিয়ে যেতো,মনে হত সবটা অনুভব করতে পারছি।
আমায় বিয়ের আগে দেখতে এসে বর জিজ্ঞেস করেছিলো.."কাকে বেশি ভালো লাগে? মানে কোন অভিনেতাকে?"...উত্তর দিয়েছিলাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। একটা হাসি ছড়িয়ে গিয়েছিলো ওদের মুখে মানে মিলে গেলো।স্বামীরও ভীষণ প্রিয় মানুষ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বেশ কয়েকবছর আগে লিয়র দেখার সুযোগ হয়েছিলো।স্কুল ফেরার পথে টিকিট কেটে এনেছিলাম দীর্ঘসময় লাইনে দাঁড়িয়ে। মা বাবা স্বামী সবাই মিলে দেখেছিলাম, কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিলো অবাক হয়েছিলাম দেখে একসাথে রূপে,গুণে,প্রতিভায় এত উজ্জ্বল একজন মানুষ হতে পারেন?
ফেরার পথে দেখলাম আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন উনি বোধহয় গাড়ির জন্য অপেক্ষায়।গায়ের রঙ যেন স্থলপদ্মের পাপড়ির মত। খুব ইচ্ছে হলো গিয়ে প্রণাম করি।হঠাৎই কেন যেন সঙ্কোচ হলো মনে হলো সূর্যকে দূর থেকেই দেখতে হয়।
যখনই উনার কোন ছবি আসে দেখার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠি শেষ দেখেছিলাম সাঁঝবাতি। কতবার যে উনার গলায় শেষের কবিতা শুনেছি আবার কখনো শুনেছি রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা। আজকে আবার শেষের কবিতা শুনলাম প্রতিটা শব্দ যেন আজ সত্য তার প্রয়াণে।মৃত্যুর নাগপাশ থেকে আর মুক্তি হলোনা তবে তিনি রইলেন এই ধরিত্রীর মায়াময় প্রকৃতির সাথে মিশে।তার কাজ তাকে অক্ষয় করে রাখবে..স্রষ্টাকে তো সৃষ্টিই অমর করে রাখে তাই তার সৃষ্টির ভান্ডার বলে যাবে প্রতিক্ষণ..তিনি ছিলেন,আছেন আর থাকবেন। খুব কান্না পেয়েছিলো সেইদিন যেদিন প্রথম শুনেছিলাম তার অবস্থার অবনতি হচ্ছে।
মা দুগ্গাকে খুব বলছিলাম ঠিক করে দাও সব কোন একটা ম্যাজিক করে,করোনাসুরটাকে মেরে তাড়াও ফেলুদার শরীর থেকে। তবে করোনাসুরটা গেলেও তার আক্রমণের ধকলটা নিতে পারলোনা শরীর। আসলে জরা বার্ধক্যের হাত থেকে তো কারোর রেহাই নেই তাইনা?
তবে আজ কেন যেন মনে হলো বড় কষ্ট পাচ্ছিলেন মানুষটা..ঠান্ডা ঘর, কত সূঁচের যন্ত্রণা মেশিনপত্র,কত ওষুধের অত্যাচার আর একলা শূন্য জীবন। আর কত দিন ধকল সইবে ছিয়াশি বছরের বৃদ্ধ লিয়র।তার চেয়ে বোধহয় এই ভালো,চিরশান্তির দেশে গিয়ে ভালো থেকো তুমি। তোমার অমৃতস্বরে সেখানে গিয়ে রবিঠাকুরের শেষের কবিতার শেষ কবিতা পাঠ কোরো উদাত্ত কন্ঠে..সেই কবিতার মাধুর্যে মুগ্ধ হবে স্বর্গলোক ফুটবে পারিজাত কিছু ঝরে পড়বে তোমার চারপাশে...
শেষের কবিতার শেষ কবিতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও।
তারি রথ নিত্যই উধাও
জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন,
চক্রে-পিষ্ট আঁধারের বক্ষফাটা তারার ক্রন্দন।
ওগো বন্ধু,
সেই ধাবমান কাল
জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেরি তার জাল--
তুলে নিল দ্রুতরথে
দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে
তোমা হতে বহু দূরে।
মনে হয়, অজস্র মৃত্যুরে
পার হয়ে আসিলাম
আজি নবপ্রভাতের শিখরচূড়ায়--
রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়
আমার পুরানো নাম।
ফিরিবার পথ নাহি;
দূর হতে যদি দেখ চাহি
পারিবে না চিনিতে আমায়।
হে বন্ধু, বিদায়।
কোনোদিন কর্মহীন পূর্ণ অবকাশে
বসন্তবাতাসে
অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস,
ঝরা বকুলের কান্না ব্যথিবে আকাশ,
সেই ক্ষণে খুঁজে দেখো--কিছু মোর পিছে রহিল সে
তোমার প্রাণের প্রান্তে; বিস্মৃতিপ্রদোষে
হয়তো দিবে সে জ্যোতি,
হয়তো ধরিবে কভু নাম-হারা স্বপ্নের মুরতি।
তবু সে তো স্বপ্ন নয়,
সব-চেয়ে সত্য মোর, সেই মৃত্যুঞ্জয়,
সে আমার প্রেম।
তারে আমি রাখিয়া এলেম
অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশে।
পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই ভেসে
কালের যাত্রায়।
হে বন্ধু, বিদায়।
তোমার হয় নি কোনো ক্ষতি
মর্তের মৃত্তিকা মোর, তাই দিয়ে অমৃতমুরতি
যদি সৃষ্টি করে থাক, তাহারি আরতি
হোক তব সন্ধ্যাবেলা,
পূজার সে খেলা
ব্যাঘাত পাবে না মোর প্রত্যহের ম্লান স্পর্শ লেগে;
তৃষার্ত আবেগ-বেগে
ভ্রষ্ট নাহি হবে তার কোনো ফুল নৈবেদ্যের থালে।
তোমার মানস-ভোজে সযত্নে সাজালে
যে ভাবরসের পাত্র বাণীর তৃষায়,
তার সাথে দিব না মিশায়ে
যা মোর ধূলির ধন, যা মোর চক্ষের জলে ভিজে।
আজো তুমি নিজে
হয়তো-বা করিবে রচন
মোর স্মৃতিটুকু দিয়ে স্বপ্নাবিষ্ট তোমার বচন।
ভার তার না রহিবে, না রহিবে দায়।
হে বন্ধু, বিদায়।
মোর লাগি করিয়ো না শোক,
আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্বলোক।
মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই--
শূন্যেরে করিব পূর্ণ, এই ব্রত বহিব সদাই।
উৎকণ্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে
সেই ধন্য করিবে আমাকে।
শুক্লপক্ষ হতে আনি
রজনীগন্ধার বৃন্তখানি
যে পারে সাজাতে
অর্ঘ্যথালা কৃষ্ণপক্ষ রাতে,
যে আমারে দেখিবারে পায়
অসীম ক্ষমায়
ভালো মন্দ মিলায়ে সকলি,
এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি।
তোমারে যা দিয়েছিনু তার
পেয়েছ নিঃশেষ অধিকার।
হেথা মোর তিলে তিলে দান,
করুণ মুহূর্তগুলি গণ্ডূষ ভরিয়া করে পান
হৃদয়-অঞ্জলি হতে মম।
ওগো তুমি নিরুপম,
হে ঐশ্বর্যবান,
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান--
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।
হে বন্ধু, বিদায়।
Comments
Post a Comment