#দুয়ো#
হঠাৎই একদিন ভেতরের বাড়িতে খবর গেলো তাড়াতাড়ি বরণডালা সাজাও অতীন নামছে গাড়ি থেকে দেখে তো মনে হচ্ছে সাথে বৌ নিয়ে ঢুকছে। কোন কথা নেই বার্তা নেই একেবারে বিয়ে করে এলো!
নিভা শুনে যে কি করবেন বুঝতে পারেননা, এর আগে দুই ছেলের বিয়ে নিজে দেখেশুনে দিয়েছেন। একদম মাথার চুল থেকে পায়ের নখ দেখে বংশ মর্যাদা যাচাই করে এনেছেন দুই বৌকে। নাতি নাতনি আর দুই বৌকে নিয়ে ভরা সংসার নিভার। তবে চোখের মণি ওনার ছোটছেলে।তা নিয়ে অবশ্য মাঝে মাঝেই আড়ালে কথা বলে বৌমারা..."তোমরা যতই মা মা করো মায়ের চোখের মণি কিন্তু সেই ছোটছেলে।"
অবশ্য ছেলেরা খুব একটা গায়ে মাখতোনা, কারণ মা বাবাকে চটিয়ে লাভ নেই এখনো সব বিষয় সম্পত্তিই বাবার হাতে।
"অযথা তোমরা কি সব যে বলো বুঝিনা অতীন আমাদের সবার প্রিয়। সবচেয়ে ভালো পড়াশোনায় ছিলো এখন কলেজে পড়ায়। সবাই ওকে ভালোবাসে।"
সবার নয়নের মণি অতীন যার ওপর সবার আশা ভরসা সে বন্ধুর বিয়েতে সাতদিনের জন্য ভাগলপুর গিয়ে শেষপর্যন্ত বিয়ে করে ফিরলো! কি এমন হলো?
ভেতর বাড়িতে খবর যেতেই বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে আসে। নিভা চোখের জলে ভেসে শাপ শাপান্ত করলেন ছোটবৌমাকে না দেখেই।
"ওরা কতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে? এরপর তো লোক হাসাহাসি হবে। বাইরে লোক জমা হয়েছে রীতিমতো, গ্ৰামের ব্যাপার জানোনা। বৌমারা যাও দেখি তাড়াতাড়ি তোমার শাশুড়িকে নিয়ে। আগে তো ভেতরে আসুক ওরা।"
নিভার দাপট সংসারে একটু বেশি বরাবরই, কারণ বড়লোকের মেয়ে নিভা তারই বাপের বাড়ির টাকায় আনন্দবাবুর এতো সম্পত্তিবৃদ্ধি। তাই গিন্নীকে জীবনসঙ্গীর সাথে সাথে ভাগ্যলক্ষ্মী বলেও মানেন কর্তা।
কমলা তখনো গাড়ির ভেতরে বসে, অতীনই আবার ভেতরে বসতে বলেছে লোকের ভিড় দেখে। ঘোমটা সরিয়ে কমলা দেখে অনেক বড় বাড়ির সামনে ওরা দাঁড়িয়ে। কমলার গালে তখনো চোখের জল শুকিয়ে লেগে আছে। ঠাকুমা বলতো সবসময় অলুক্ষুণে অপয়া মেয়ে জন্মেই তো বাবাকে খেলো। মাকে দেখেছে চিরকাল বাড়িতে দাসীবৃত্তি করতে। তবে মা সবসময় বলতো.."কমল পড়াশোনা বন্ধ করিসনা মা। যত কষ্ট হোক আমি পড়াবো তোকে।"
তবে কলেজের পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর আগেই যে মা মারা যাবে তা ভাবতেই পারেনি। পুরো জীবনটা অন্ধকার হয়ে গিয়েছিলো। কাকিমাদের অত্যাচার, সারাদিনের খাটুনি আর শেষে বিয়ের নামে প্রায় বিক্রি করে দেওয়া এক মদ্যপ চরিত্রহীন কয়লা ব্যবসায়ীর হাতে।
হয়ত কিছু ভালো কাজ আর মায়ের আশীর্বাদ ছিলো তাই অদ্ভুতভাবে অতীনের সাথে বিয়েটা হয় মানে অতীন ওকে রক্ষা করে। ওর বন্ধু অতসীর বিয়েতে গেছিলো অতীন আর সেখানে গিয়েই এই কান্ড। সারাটা পথই বারবার মায়ের কথা মনে হয়েছে আর কেঁদেছে। বেশ কিছুটা সময় ধরে ওরা বাইরে আছে। বাড়ির কেউই আসেনি বুঝতে পারে কমলা বাড়ির লোক হয়ত অসন্তুষ্ট।
একটু পরে উলুর আওয়াজ পাওয়া যায়..ছেলের কাছে বরণডালা এনে চোখ মোছেন নিভা.."শেষে এইভাবে তোকে বিয়ে করতে হলো? কত কি ভেবেছিলাম তোর বিয়ে নিয়ে?"
"কোন উপায় ছিলোনা মা তুমি তো জানো চোখের সামনে অন্যায় কোনদিন আমি দেখতে পারিনা মা। "
ছেলের বৌয়ের মুখের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করেনা নিভার। কোনরকমে বরণ করে ঘরে তোলেন। লজ্জাতে মাথা নিচু করে থাকে কমলা।
টুকটাক একটু নিয়ম করার পরেই জিজ্ঞেস করে নিভা..."তা বৌয়ের নাম কি রে ছোটখোকা?"
অতীন হাসে.."তুমিই জিজ্ঞেস করো মা? ও তো বোবা নয় নিজেই বলবে। যদিও খুবই কম কথা বলে। কাল থেকে পাঁচটা কথাও বলেছে কিনা কে জানে? অবশ্য যা অবস্থায় বিয়ে হলো আর কিই বা বলবে। রীতিমতো লঙ্কাকান্ড করে বিয়ে।"
ছেলের কথা শুনে এবার ভালো করে বৌয়ের মুখের দিকে তাকায় নিভা, ইশ্ মনে হয় দেখে কতদিন খেতে পায়নি। একটু একখানা ছোট্টপারা মুখ। গায়ের রঙও তেমন ভালো নয়। তবে কপালখানা ভালো তাই একদম সোজা এই বাড়িতে।
"তোমার নাম কি? ভাইবোন কজন? বাড়ি কোথায়? তোমরা বাঙাল না ঘটি?
আমার নাম কমলা, ভাইবোন নেই, মা বাবাও নেই ,কাকারা ভাগলপুরেই থাকে। আমি বাঙালী।
কমলা কথা কম বললেও কমলার কথায় মনটা ছুঁয়ে যায় অতীনের। কি সুন্দর করে বললো বাঙালী।
কিন্তু নিভার গা জ্বলে যায়, এ মেয়ে তো মহা চালাক তাই আবার বলে.."তোমরা বিহারী নয় বাঙালী তা বুঝলাম। কিন্তু বাঙাল না ঘটি?"
কমলার কেমন আশ্চর্য লাগে, "আমার জন্ম এইদেশে তবে শুনেছি ঠাকুমা আগে বাংলাদেশে থাকতেন। "
তার মানে বাঙাল, কথাটা কাঁটার মতো বেঁধে নিভার মনে। আর এটাও বুঝতে পারে যে এই মেয়ে মোটেই বোকা নয় বাঙাল তো? একসময় ওপার থেকে এসে এপারের মানুষগুলোকে কোণঠাসা করেছিলো আর এবার তার ভদ্র সৎ ছেলেটাকে হাত করে এই বাড়িতে ঢুকলো।
***************
কমলার এই অযাচিত প্রবেশ বাড়ির কারো যে ভালো লাগেনি তা বুঝতে খুব বেশিদিন সময় লাগলোনা অতীনের।
কমলাকে রান্নাঘরে কখনোই ঢুকতে দেওয়া হতনা, কারণ বাঙাল রান্না কেউ খেতে পারবেনা এই বাড়িতে। ওর পরিবেশন ভালোনা, পুজোর কাজ জানেনা, এঁটো কাঁটার বিচার নেই এমন কত অভিযোগ।
কমলা মাঝে মাঝে বুঝতেই পারেনা ও বাঙাল বলে শাশুড়িমা অসন্তুষ্ট, নাকি কপালে কাঙাল বলে উনি ওকে ভালোবাসেন না।
খুব ইচ্ছে করে ওর একটু মায়ের আদর পেতে ওনার কাছে, কিন্তু সব সময়ই অবহেলা আর কথার আঁচড় ছাড়া তেমন কিছু জুটতোনা। অতীনও বুঝতো কমলা যেন বাড়ির একটা ফালতু কুড়োনো অচল পয়সা যার বাপের বাড়ি নেই বাপের বাড়ি থেকে তত্ত্ব আসা নেই। হয়ত তেমন চোখ ধাঁধানো রূপও নেই।
তবুও কমলার মনটাকে খুব যত্নে আগলায় অতীন সবার আড়ালে শোয়ার ঘরে। কমলা বই পড়তে ভালোবাসে কত রাত গল্প করতে আর গল্প শুনতেই সময় কেটে যায়। রাতের সোহাগের ছোঁয়ায় সকালে একটু দেরি হলে উঠতে বুঝতে পারে শাশুড়ির আর জায়েদের মুখ ভার হয়।
এর মধ্যেই অতীনের বদলি হয়ে গেলো কলকাতায়। হয়ত হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো সবাই। তাতেও শাশুড়িমা শোনালেন, "কিছুই তো তেমন জানেনা, কি জানি কি করে সংসার করবে?"
"মা চলুন না আপনি গিয়ে কদিন থেকে একটু দেখিয়ে দেবেন।" বলে কমলা।
অতীনও বলে, "মা চলোনা, একটু গুছিয়ে দেবে ওকে শিখিয়ে দেবে।"
"এক বছর তো রইলো এখানে বাবা, শেখার ইচ্ছে না থাকলে কি হবে? একেই বাঙাল তারপর আবার বিহারে মানুষ মা বাপ মরা মেয়ে কিছুই জানেনা।"
শাশুড়ির ঠোঁট উল্টানো দেখে চোখটা ছলছল করে কমলার। সত্যিই হয়ত কিছুই জানেনা আসলে মা বাবা না থাকলে যা হয়। শাশুড়িমাও কোনদিন ভালোবেসে কাছে ডেকে নিলেননা।"
***************
মাঝে কেটে গেছে আরো দুটো বছর; অতীন বাড়িতে এলেও মাঝে মাঝে কমলাকে নিয়ে মাকে নিয়ে যেতে পারেনি নিজের কাছে। কেন জানেনা এক অদ্ভুত ইগো মায়ের।
বিকেলবেলা চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে টিভি খোলেন নিভা.. রান্না দেখাচ্ছে হঠাৎই চোখ পড়ে যায় এতো ছোটবৌমা মানে কমলা। ডাক ছাড়েন বড় আর মেজো বৌমাকে। "দেখেছো কি অবস্থা! এখানে এক বছর থেকে গেলো কিছু বুঝলাম না এখন তো দেখি টিভির রাঁধুনি হয়ে রাঁধতে গেছে।"
"মা বাঙাল মেয়ে ভীষণ বুদ্ধি ওদের। কই আপনাকেও তো বলেনি রান্না করছে। আপনি বলবেন ঠাকুরপোকে ফোনে।"
বৌমারা বললেও ছেলেকে কথাটা বলতে ইচ্ছে করেনা নিভার। সত্যিই হয়ত বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়ে যাবে মেয়েটাকে। অভিমানের মেঘ অকারণে আরো কালো হলো।
তবুও একদম কোনদিনই যেখানে পা দেবেননা ভেবেছিলেন নিভা, হঠাৎই সেই ছোটছেলের বাসাতে পা রাখতে হলো ওদের কর্তা গিন্নীকে। বাবার পেসমেকার বসানোর পুরো দায়িত্ব হাসিমুখে নিলো অতীন।
হয়তো টানা এতোদিন এখানে না থাকলে নিভা বুঝতেই পারতেননা কমলা কি করতে পারে। শ্বশুরমশাইকে দেখতে যাওয়া ছুটে ছুটে। রান্না করা জামাকাপড় গুছোনো সময়ে নিভাকে খেতে দেওয়া সব এক হাতে। নিভার একেই মন ভালো নেই, তারপর আলাদা জায়গায় এসে বুঝতেই পারেননা কি করবেন। শুধু অবাক হয়ে ভাবেন শহরের মানুষেরা বোধহয় যন্ত্রের মত দৌড়য় আর সেই বোকা বোকা মেয়েটাও কেমন যেন পাল্টে গেছে কিছুদিনের মধ্যেই।
কয়েকদিন হলো কমলার শ্বশুরমশাই ফিরেছেন নার্সিংহোম থেকে, অতীন কলেজে চলে গেলে সব ওষুধ ঠিক সময়ে খাওয়ানোর দায়িত্ব কমলার।
রাতে অতীন বলে, "তোমার খুব চাপ পড়েছে বুঝতে পারছি একটু খেয়াল রেখো নিজেরও।"
স্বামীর বুকে মাথা রেখে কমলা বলে, "আমার কষ্ট হয়না কিছুই, যদি এই সুযোগে মায়ের একটু ভালোবাসা পাই।"
মনটা ছুঁয়ে যায় অতীনের একটু ভালোবাসার কাঙাল মেয়েটা।
******************
বাবা মোটামুটি ভালো এখন, মা ও এবার বাড়ি যেতে চান, হঠাৎই একদিন মাথা ঘুরে বমি করে শরীর খুব খারাপ হলো কমলার। ডাক্তার দেখানোর পর জানা গেলো কমলা মা হতে চলেছে।
খবরটা পেয়ে হাসতে হাসতে নিভা ছেলেকে বললেন, "ছোট খোকা তুই বড় খোকাকে বলে দে আমরা কয়েকটা দিন এখানে থেকেই যাবো। মা মরা মেয়ে আর তো কেউ নেই, একলা একলা বাড়িতে থাকবে তা তো হতে দিতে পারিনা। এদিকে এসো তো বৌমা চুলটা বেঁধে দিই, এই সময় খোলা চুলে থাকতে নেই।"
কমলার চুলে বিলি কাটছেন নিভা, চোখটা ছলছল করে কমলার, কতদিন বাদে যেন মাথায় মায়ের ছোঁয়া পাচ্ছে।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment