Skip to main content

সেই বিষণ্ণ দিন

জীবনের পথে হাঁটি হাঁটি পা করে চলতে চলতে একটা সময় বাবা মায়ের কড়া শাসন আর স্নেহের ছত্রছায়া ছেড়ে পা দিলাম নতুন জীবনে। মেয়ে থেকে বৌমা..হলাম কারো স্ত্রী। হলুদের দাগছোপ আর সিঁদুরের রাঙা ছোঁয়ায় পাল্টে গেলাম এক নিমেষে,সিঁথেতে তখন কারো হাতের ছোঁয়া আর মনে ভালো লাগার আবেশ।
                  নতুন পথে পা বাড়িয়ে নতুন একদল মানুষের সাথে ভাবসাব করে নিয়ে পথ চলার শুরু। হয়ত খুব একটা মসৃণ না হলেও সেই পথ সবার মতই টক,ঝাল,তেঁতো মিঠেতে ভরা এক স্বাদ যে স্বাদ কখনো অবসাদ আনলেও কখনো শিখিয়েছে জীবনের পথে চলতে আর বুদ্ধিকে শান দিতে।
                         শিখতে শিখতে কখন যে কাটিয়ে দিয়েছি পঁচিশ বছর বুঝতে পারিনি। আমার বিয়ে হয়েছিলো আমাদের দেশের বাড়িতে,নিতান্ত পাড়া গাঁ সেখানে বিউটি পার্লারের বালাই ছিলোনা। অবশ‍্য তখন আমিও তেমন কেতাদুরস্ত ছিলামনা।

আজও অনেক সাজগোজের মাঝে মিস্ করি সেই সরল সাধাসিধে মুখখানা,আর স্বপ্নদেখা চোখদুটো। অবশ‍্য মিস্ করার তালিকায় তো অনেক কিছুই..কত কি বলবো? আমার ছিপছিপে চেহারা,ফ্রক আর গাউনের হাতছানি এমন কি পার্লারের সুতোর শাসনবিহীন আমার ভ্রূ জোড়াও।

             তবুও একটা সাধ ছিলো তাই বরকে বলেছিলাম," বিয়েতে তো পার্লার থেকে সাজা হয়নি। এবার কিন্তু সাজবো,আমার অনেক দিনের ইচ্ছে।"
                 আমার পঁচিশ বছরের বিবাহবার্ষিকী কত আশা কত স্বপ্ন মনে বাসা বেঁধেছে আরেকবার ফিরে নিজেকে দেখা...দুই সন্তানের জননী এক লড়াকু মায়ের চোখে আজও কত আশা। বিশেষ দিনের প্রস্তুতি চলছে কিছুদিন আগে থেকেই। আমার আপন বলতে আমার মা বাবা,একমাত্র সন্তান আমি। বাবা মা আর আমার এক দিদি এলেন নির্দিষ্ট দিনের চারদিন আগে। এসেই বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন খুব শ্বাসকষ্ট।উনি সিওপিডির পেশেন্ট ছিলেন..আমি অপেক্ষা না করে নার্সিংহোমে ভর্তি করলাম। একদিন থাকার পরই ছুটি হলো..ততক্ষণে মনের রঙ অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে নার্সিংহোমে ছুটোছুটি করে। 
             বাবা বেশ সুস্থ হয়ে উঠলেন একদিনেই বললেন," অনুষ্ঠান হবে, আমি তো ভালো আছি একদম।আর চিন্তা নেই।"
       অনেক আগে থেকেই সাজানোর জন‍্য কলকাতার এক নামী পার্লারে ওদের নিয়ম অনুযায়ী পুরো টাকাই দেওয়া ছিলো। তাই সাজতে গেলাম সেখানে নির্দিষ্ট দিনে। ওরা তখন এক কনেকে সাজাতে ব‍্যস্ত আমাকে নিয়ে তেমন মাথাব‍্যথা নেই ওদের।নতুন কনেকে নিয়ে ফটোশুট চলছে। আমার উত্তেজনা বাড়ছে তখন,ওদিকে সবাই আমার অপেক্ষা করছে। ফাউন্ডেশন মাখিয়ে আর মেকআপ করে বিভিন্ন শেডের আইশ‍্যাডো দিয়ে চোখ সাজিয়ে যখন আমাকে ওরা রেডি করলো নিজেকে পেত্নী ছাড়া আর কিছুই মনে হলোনা। মনে হলো সব ধুয়ে মুছে ওখান থেকে চলে আসি ততক্ষণে বারবার ফোন আসছে বরের,কখনো ছেলের।
       অনেকটা সময় নষ্ট হলো এভাবে, সবার সাথে কাটাতে পারলামনা সময়টা। তবে আমাকে দেখে বাবার ছুটে আসাটা আজও ভুলতে পারিনা। ভিড়ের মধ‍্যে বাবাকে প্রণাম করতে এগিয়ে যাই,আমার চারদিকে ননদ ননদাইরা। তারমধ‍্যেই দেখি বাবা আমার একটা ফটো তোলার জন‍্য খুব চেষ্টা করছে। আজও সেই দৃশ‍্যটা ভাসে চোখের সামনে। সেদিন ছিলো রবিবার, সত‍্যি সবাইকে সামলে সেদিন বাবার সঙ্গে আর মায়ের সঙ্গে বেশি সময় কাটাতে পারিনি। কারণ সন্ধ‍্যেটা পুরো কেটে গেছিলো পার্লারে সাজের অপেক্ষায়।
     মা পরে বলেছিলো," এর থেকে তুই নিজেই তো ভালো সাজতে পারিস। চোখগুলো কেমন করে দিয়েছিলো ওরা! অত বড় চোখগুলো।"
        কিছু বলতে পারিনি সত‍্যিই মনটা খুব খারাপ হয়েছিলো। শুধু ছেলে বলেছিলো..." স্পেশাল লাগছিলো তোমাকে মা। একটু মেকআপ নিতে হয় এইসব দিনে।"
                   পরের রবিবার বাবা ভেন্টিলেশনে।সোমবার ভোরবেলা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। বারবারই মনে হয়েছিলো, এই অনুষ্ঠানে না এলে হয়ত ভালোই থাকতেন বাবা। অতটা জার্নির ধকল বোধহয় নিতে পারেনি। নাকি আমার বিবাহবার্ষিকী আর সাজগোজ কোনটাই দরকার ছিলোনা?বেশ তো কাটিয়েছিলাম এতগুলো বছর নিজের গতে বাঁধা জীবনে হঠাৎই ঘটা করার কি দরকার ছিলো? পঁচিশের পূর্ণের সেই দিন আজও ভুলতে চাই...বিশ্বাস করো সত‍্যিই ভুলতে চাই। তবে কি সত‍্যিই সব ভোলা যায়? আমার নতুন বেনারসী পরা হাসিমুখের পাশে তসরের পাঞ্জাবী আর ধুতি পরা বাবা আর বালুচরী পরা মায়ের ছবিখানা যে মাঝে মাঝেই উঁকি মেরে যায়।
      তবে পার্লারে সাজা আর আমার হবেনা..মেয়ে বলে," দাদার বিয়েতে তুমি সাজবে তো মা পার্লারে?"
         এক ঢোক তেতো স্বাদ নীলকন্ঠীর মত গিলে নিয়ে বলি আর নয়..একবার গিয়ে শিক্ষা হয়ে গেছে।
        

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...