Skip to main content

অনলাইনে পরিবার

"ছাদটা তো ওদেরই দখলে চলে গেলো মনে হচ্ছে।অথচ একটা সময়ে কত সাধ করেছিলে ছাদ ছাদ করে। ছাদে বাগান করবে,এক কোণে দোলনা দুলবে তাতে বসে দুজনে দোল খাবো।ছেলে বৌমা নাতি নাতনি সবাই মিলে ছাদে বসে চা খাওয়া হবে। তা আর হলো কই?

শেষে ছাদ দখল করলো ভাড়াটিয়া,একটু কাকিমা কাকিমা করলো আর তুমি গলে গেলে একেবারে।এখন তো দুটিতে ছাদে উঠছে,গল্প করছে,তোমার সাধের দোলনাতে দোল খাচ্ছে বসে আহা আহা।"

"তা আমি তো হাঁটু ব‍্যথাতেই মরি আজকাল ছাদে উঠি কম। ওরা উঠছে উঠুকনা। তোমার অসুবিধা কোথায়?"

"না অসুবিধে আর কি,নিজের হাতে গড়া জিনিস যখন অন‍্য লোকে ভোগ করে গায়ে লাগে বৈকি।"

" কি সুন্দর গাছ লাগিয়েছে ছাদে দেখেছো? প্রত‍্যেকদিন মিনি ছাদে উঠে গাছগুলোতে জল দেয়।"

" দেখেছি বলেই তো রাগ হচ্ছে। তোমাকে জিজ্ঞেস না করেই গাছ লাগিয়ে ফেললো।বুঝতে পারছো তো কি ফন্দী ওদের? তাই বলেছিলাম বাড়িটা ভাড়া দিয়োনা। তা তোমার নাকি আর একা একা থাকতেই ভালো লাগছেনা।"

" আরে জিজ্ঞেস করেছিলো। কত ভালো লাগে বলো একা একা,ছেলেটা দুবছর দেশে আসেনা।জানিনা এ বছরও আসবে কিনা।

তবুও তো দুটো প্রাণী আছে বাড়িতে তাও একটু কথা বলি মাঝে মাঝে।"

" হ‍্যাঁ নিজেরাই প্রেম করে বাঁচেনা তা উনার সাথে আবার কথা বলবে।"

" তা তো করবেই,কতটুকু বয়েস ওদের এখনি তো ভালোবাসাবাসির সময়।"

"একদিন দেখি দোলনায় জড়াজড়ি করে বসে ইশ্!"

হাসেন মিনতি.." তুমিও যেমন!গেছো কেন ছাদে ঐ সময়? একটা কাশি দিয়ে তো উঠবে।"

" নিজের বাড়িতে নিজের ছাদে উঠবো তাও কাশি দিতে হবে। কি আশ্চর্য কথা!"

মিনতি যতই মিনি আর অরূপকে সাপোর্ট করুকনা কেন সুকোমলের একদম পছন্দ নয় এই আধুনিক ছেলেমেয়েদের আদিখ্যেতা।বিয়ের পর পর কি সুন্দর করে মিনতি শাড়ি পরে কপালে সিঁদুরের টিপ দিয়ে সাজতো। আর এই যে মিনি না চিনি সারাক্ষণ একটা ঢোলা পেন্টলুন আর গেঞ্জি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিক সেদিক। পেছন থেকে দেখলে ছেলে বলেই অনেক সময় ভুল হয়।

কদিন শরীরটা ভালো নেই তাই একদম ঘরে আটকানো অবস্থা। মিনতি না করলেও সেদিন বাইরে বেরিয়েছেন জোর করে।আরে না বেরোলে সংসারটা চলবে কি করে? এই তো বলছো অনেক কিছুই নেই।

তবে ভারী ব‍্যাগ বয়ে এতটা হেঁটে আসতে খুব কষ্ট হয়েছে। ঢোকার মুখেই বাঁধা পান.." আপনি কোথায় গেছিলেন কাকু?"

এমনিতেই খুব একটা পছন্দ নয় ওদের সুকোমলের, তাই বাড়তি কথা বলতেও ভালো লাগেনা,সংক্ষেপে বলেন.." কাজ ছিলো তাই গেছি।"

" আমাকে বলতে তো পারতেন। কি কাজ ছিলো?"

" মানে আমার কি কাজ তাও তোমাকে বলতে হবে?"

ওদের কথা শুনে মিনতি উঁকি দেন..শোনেন অরূপ বলছে..

" হ‍্যাঁ এক ছাদের তলাতেই যখন আছি তখন বলবেন,বললে কি আছে?"

" যত্তসব পাকামি" বলে ব‍্যাগটা নিয়ে ওপরে উঠতে গিয়ে একটু টাল খান।হাত থেকে ব‍্যাগটা নিয়ে ওপরে তুলে দেয় অরূপ।

বাধা দিতে পারেননা সুকোমল। ওপরে এসে গজগজ করতে থাকেন.." আমি কোথায় যাবো ওদের বলতে হবে?বলে দিয়ো এত তেল দিয়ে লাভ নেই সামনের বছর হয় ভাড়া বাড়াবে নাহলে বাড়ি ছাড়বে।"

তবুও যখন দুজনের কিছু ওষুধ পাওয়া গেলোনা তখন মিনতিই বললেন.." অরূপকে বলি একবার? অনলাইনে যদি পায় দেখবে?"

" ছাড়ো তো অনলাইনের কারবার।এরপর স্বামী ছেলেপুলে সব অনলাইনে কিনো। এখন তো তাই হয়েছে। এই ভাড়াটেটাও তো তোমার ছেলে বোধহয় অনলাইনেই খুঁজে পেয়েছে।"

" খারাপ তো কিছু পায়নি, ভালোই তো হয়েছে। ওদের দেখে আমাদের বিয়ের পরের সময়গুলো মনে পড়ে যায়।"

" হুঁ তুমি কি ঐ পেন্টলুন পরে নেত‍্য করতে?"

" তাতে কি যখনকার তেমন,আমার তো খারাপ লাগেনা বেশ ফ্রী থাকা যায়।"

কয়েকদিন বাদে বেল বাজতেই দরজা খোলেন দেখেন ঢাউস ব‍্যাগ এসেছে একটা।

" এসব কি আবার? না না আমি নেবোনা।"

ছেলেটি জানায়.." আপনারই স‍্যার,পেমেন্ট করা আছে শুধু রিসিভ করে নিন।"

মিনতি ছুটে আসে.." ঐ তো এসে গেছে যাক বাবা এবার নিশ্চিন্ত।"

বাড়িতে যে কত বড় ষড়যন্ত্র চলছে তা বুঝতে পারেন..চাল,ডাল,তেল,আটা,একগাদা মাসকাবারি জিনিস এসেছে। তার সাথে একঝুড়ি ফল আর আনাজও।

" এই সব কে অর্ডার দিয়েছে শুনি,তোমার ঐ হতচ্ছাড়া পাকা ভাড়াটে তাইনা?"

" হ‍্যাঁ অরূপ আর মিনি বলছিলো কাকুর এত কষ্ট করে কি দরকার ভারী ব‍্যাগ টানার। কখন বিপদ আপদ হয়। কি লাগবে লিস্ট দেবেন আনিয়ে দেবো সব।"

" কেন যে লোকের কাছে সুযোগ নিতে যাও। এরপর ওরাও সুযোগ নেবে দেখো।"

ততক্ষণে ফোনটা বেজে ওঠে.." বাবা পেয়ে গেছো সব জিনিস তো? ফলগুলো খেয়ো ঠিকমত বুঝলে। আর কোন সমস‍্যা হলে জানিয়ো। আমরা ভালো আছি।"

ফোনটা পেয়ে আনন্দে মুখটা আলো হয়ে ওঠে সুকোমলের.. ও তাহলে ছেলের কান্ড এইসব।

একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলেন.." বুঝলে মিনতি এখন অনলাইনের পরিবার,একদম চব্বিশ ঘন্টা অন। একটা সময় আমরা বাজারে যেতুম,রেশন আনতুম,গ‍্যাসের দোকানে যেতুম। অবসরে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি গল্প করতে যেতুম।এখন আড্ডা,গপ্প সবই তো অনলাইনে, মানে অনলাইন ছাদের তলায় পরিবার। আর ছেলেটাও বাজার করে দিচ্ছে,টিকিট কেটে দিচ্ছে ও দেশে বসে অনলাইনে। ভাবা যায়!"

বেলটা বাজে আবার.." উফ্ আবার কলিংবেল!"

দরজা খুলতেই মুখটা বাড়ায় অরূপ.." কাকিমা ওষুধগুলো এসে গেছে। একটু দেখে নেবেন সব ঠিকঠাক আছে কিনা?"

" ভেতরে এসোনা?"

" একটু কাজ করছি।আসবো পরে।"

"বাহ্! ভালোই ব‍্যবস্থা করেছো।আমাকে বাড়ি বসিয়ে এবার আরো অথর্ব করে দাও। ওকে ওষুধের কথা বলার কি দরকার ছিলো?"

" কেন এক ছাদের তলায় থাকি,তাই ও তো আমার মেনলাইনের পরিবার,যার সাথে মুখোমুখি দেখা হয়।"

মাঝে কেটে গেছে কয়েকটা মাস ছাদের টবে ভর্তি নানা রঙের ফুল ফুটেছে।আজকাল ছাদে কম ওঠেন সুকোমল। তবে ছাদের শোভা দেখে চোখ ফেরাতে পারলেননা।

" সব মিনির হাতের গুণ বুঝলে,অরূপ গাছ এনে দেয় আর ও যত্ন করে।কদিন আমিই বারণ করেছি জল টেনে টেনে দিতে।বলেছি আমি দেবো। আমাকে একটু বাজার থেকে কাঁচা আম এনে দেবে?"

" তুমি কাঁচা আম খেয়োনা,আ্যসিড হবে।"

" ধুর আচার বানাবো মিনির জন‍্য।এই সময় ভালো লাগবে ওর মুখে। বেচারার বাপের বাড়িতে মা নেই,শ্বশুরবাড়ি দূরে।"

সুকোমল আর কিছু বলেননা বাজার থেকে মিনতির অর্ডারের সব এনে দেন।সারা বাড়িতে ছড়িয়েছে আচারের গন্ধ। মিনতি শিশি শুকনো করে টেবিলে রাখেন।

কলিংবেলটা বাজে দরজা খোলেন সুকোমল.." কাকু একটু আসছি,একটা কথা বলার ছিলো আমাদের এগ্ৰিমেন্টটা তো এই মাসে শেষ হবে।আমি ফ্ল্যাট দেখছি আসলে মিনির তো।"

" দেখেছো তো মিনতি তোমার মেনলাইনের পরিবারের কান্ড। সাধে কি আমি পাকা ছেলেমেয়ে বলি এদের? নাতি নাতনি নিয়ে আমরা একটু সুখ ভোগ করবো তা নয় ছাদে ফুল ফুটিয়েই ওরা চলে যাবে।"

"এখন তো তোমাদের যাওয়া হবেনা বাবা অনেকদিন বাদে বাড়িতে খুশির ফুল ফুটেছে। আমার অনলাইনের পরিবারের সাথে যে মেনলাইনের পরিবারও চাই। সম্পর্কের মিঠে সুতোটা ছিঁড়ে যেয়োনা।"

অরূপ হাসে,পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে মিনি। ওর হাতে আচারের শিশিটা দিয়ে পিঠে হাত দিয়ে মিনতি বলেন.." দেশে বিদেশে অনলাইনে, মেনলাইনে ছড়িয়ে আছে আমাদের পরিবার।ভালোবাসায় ভালো থাক সবাই। ছেঁড়া ছেঁড়া সম্পর্কের সুতোগুলো হোক মজবুত একটু আদর আর যত্নের ছোঁয়ায়।"

সমাপ্ত:-

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...