#স্বপ্ন_না_সত্যি#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
কদিন থেকেই লম্বা ফর্দ হচ্ছে,অবশ্য সবটাই দীপার মাতৃদেবী নন্দার ডিপার্টমেন্ট। নন্দার ভীষণ চিন্তা অতদূরে পোস্টিং কে জানে কিভাবে থাকবে এই মেয়ে? সব সময় তো ওকেই সবটা গুছিয়ে দিতে হয় মেয়েকে। ছোট থেকেই পড়া পাগল তাছাড়া অনেক ভুগেছে একটা সময়, তাই খুব রুগ্ন মেয়েটা।
একটা সময় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হত বাঁচবে তো মেয়েটা? অথচ ওকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই তো এত তোড়জোড় মানে নন্দার একার লড়াই।
বারান্দায় সেই খোঁড়া কাকটা এসে এই সাতসকালেই ওর মত করে দাবী জানাচ্ছে খাবারের। কেন যেন নন্দার খুব মায়া ওর ওপরে।বিস্কুটের কৌটো থেকে একটা বিস্কুট নিয়ে বাড়িয়ে দেয় ওর দিকে, মানে ঐ জানলার শেষ প্রান্তের বাড়ানো জায়গাটাতে। ও নিজের প্রাপ্য পেয়ে খুশি হয়ে উড়ে যায়। নিচে কলিংবেল বাজে টুংটাং করে একটু বিরক্ত হয় নন্দা,ইশ্ এই সময়ে আবার কে এলো?
একটু বিরক্ত হয়েই দরজা খুললো নন্দা..ওহ্ ম্যাগাজিনটা আবার আলাদা করে দিয়ে গেলো।
মেয়েটা ঘুমোচ্ছে একটু শান্তিতে,কদিন বাদেই তো চলে যাবে। চাকরি না করলে হয়ত নন্দাও রওনা দিতো মেয়ের পেছন পেছনই কিন্তু উপায় নেই,সবই তো দেখতে হবে। মেয়ে বকুনি দিয়েছিলো," এত মন খারাপ কোরোনা মা,এই তো বন্ড পোস্টিংয়ের তিনটে বছর তারপর ঠিক কলকাতা চলে আসবো সুযোগ পেলেই।আমিও তো তোমার কথা মনে করবো মানে তোমাকে খুব মিস্ করবো।"
" কিন্তু তুই ওখানে একা একা সব ঠিক করে সামলাতে পারবি তো?"
" মানে? আমি কি এখনো বাচ্চা নাকি মা?"
নাহ্ তা নয় মানসিক দিক দিয়ে খুবই শক্ত করে গড়েছে নন্দা মেয়েকে ছোট থেকেই..শুধু একটু বেশি আদুরে এই যা।
দীপার গড়ন লম্বা গায়ের রঙ বেশ কালো, যদিও মা বলে শ্যামলা। তবে দীপা এইসব নিয়ে মাথা ঘামায়না। অবশ্য কলেজে পড়াকালীন একদম শোনেনি যে তা নয়..." আরে ঐ যে ঘোর অমাবস্যা মানে সবচেয়ে কালো মেয়েটা তার নাম নাকি দীপাবলি।" তবে তখন কে ভেবেছিলো এই ঘোর অমাবস্যা একদিন ইউনিভার্সিটি ফার্স্ট হয়ে একদম জোছনার আলো ছড়াবে। এখন তাই দীপাবলি নামে সবাই তাকে চেনে শুধু মা আদর করে কখনো দীপা,দীপু বলে ডাকে। এক ঢাল কোঁকড়া চুল পিঠ ছাপিয়ে নেমেছে। একটা সময় নন্দা হিমসিম খেতো ঐ চুল শ্যাম্পু করাতে আর বাঁধতে। এখন অবশ্য নিজেই সব সময় একটা জটা মত পাকিয়ে ক্লিপ দিয়ে আটকে রাখে,নন্দা বললে বলে সময় নেই। চোখদুটোতে কালো দীঘির ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ আর মুখে ভুবনভোলানো হাসি মেয়ের।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে নন্দা এমন মেয়ে দেখার আগেই অমিতাংশু চলে গেলো। শাশুড়িমা ছেলে ছেলে করলেও মেয়ে হলেও মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারতোনা কিছুতেই মানুষটা। অথচ দিব্যি শ্বশুর বাড়ির লোকজন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো।আর যা বলেছিলো তা মনে করতে চায়না নন্দা...সেই কান্না মেশানো লজ্জার আর অপমানের দিনগুলো।
নন্দার ঘরে অমিতাংশুর কোন বড় ছবি ইচ্ছে করেই রাখেনি ও, হয়ত রাখতে চাইলে ওদের দুজনের একসাথে তোলা কোন ছবি থেকে আলাদা করে রাখতে পারতো তবুও কেন যেন অতীত নিয়ে আর বাঁচতে না চেয়ে ভবিষ্যতের দিকেই বেশি তাকিয়েছে নন্দা বারবারই মনে হয়েছে ওকে বাঁচতে হবে সন্তানের মুখ চেয়ে।
দীপা নিশ্চিন্তে পাশবালিশ জড়িয়ে ঘুমোচ্ছে। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে এখন স্কুলে ছুটি চলছে কয়েকদিন তাই বাড়িতে থেকে মেয়েকে গুছিয়ে দিতে পারবে। নন্দার দীপা হবার আগে দুটো সন্তান নষ্ট হয়ে গেছে কেন হয়েছে জানেনা,প্রথমবার জা পাঠিয়েছিলো ছাদে কাপড় আনতে ওদের শ্বশুরবাড়ির সেই মস্ত বাড়ির ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে উঠে মস্ত বড় ছাদে। বেশ অনেকগুলো কাপড় নিয়ে যখন নামছে হঠাৎই পা পিছলে গিয়ে অনেকটা গড়িয়ে পড়ে যাবার পর চোখ মেলে শুনেছিলো সে নেই। কেন যেন মনে হয়েছিলো সিঁড়িতে কিছু একটা পিচ্ছিল ছিলো,অথচ যখন গেছিলো কাপড় আনতে তখন তো শুকনো সিঁড়ি।
ভয়ে শাশুড়িমাকে বলতে না পারলেও অমিতকে বলেছিলো,কিন্তু অমিত যখন বললো.." কি থাকবে সিঁড়িতে? আমি তো উঠেছিলাম একটু বাদেই কোথায় পড়েছো দেখতে, কিছু তো ছিলোনা।"
" আমার পায়ের তলায় দেখেছিলে? কিছু ছিলো।"
" নন্দা আমি তো তখন বাড়িতে ছিলাম না,বৌদিই খবর দেয় আমাকে তখন এমনিতেই মাথার ঠিক নেই।"
তবুও মা ষষ্ঠীর কৃপায় আবার সন্তানসম্ভবা হলো নন্দা। জায়ের মুখটা কেন যেন খুব শুকনো দেখেছিলো নন্দা।আসলে জায়ের তখনো কিছু হয়নি,ওর থেকে পাঁচ বছর আগে বিয়ে হয়েছিলো।শ্বশুরবাড়িতে আদর বেড়েছিলো নন্দার।
যদিও অমিতাংশু যখন হঠাৎই কাউকে না বলে কয়ে নন্দাকে বিয়ে করে এনেছিলেন তখন মুখ ভার হয়েছিলো সবার...এ কি কথা! চন্ডীপুরের জমিদার বাড়ির ছেলে শেষে বন্ধুর বোনকে হঠাৎই বিয়ে করে আনলো? তারপর সেই মেয়ে সুরূপা নয় কুরূপাই বলা চলে। কারণ কি? না হঠাৎই তার বিয়ে ভাঙাতে বাবা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তাই বাধ্য হয়েই পরোপকারী ভালো মানুষ বন্ধুর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিলো বোনকে।
নন্দার দাদার বন্ধু ছিলো অমিতাংশু।মাঝেমধ্যে কলকাতা গেলেই ওদের বাড়িতে চলে আসতো অমিত। বড়লোক বাড়ির ছেলে বলে তেমন একটা কিছু আলাদা ব্যাপার ছিলোনা। বলতো," আগে ছিলো অনেক কিছু এখন পুকুরের জলে ঘটি ডোবেনা।"
নন্দা প্রচলিত অর্থে সুন্দরী না হলেও কুরূপা নয়। সবেই বি.এ পাশ করেছে তখন,বিয়েও ঠিক হয়ে গেছিলো।আশীর্বাদ হয়ে গেছিলো,বিয়ের জোগাড় তখন সব হয়ে গেছে আর দুদিন বাকি। ঠিক সেই সময় পাত্রপক্ষ জানালো তাদের একখানা গাড়ি চাই,নাহলে বিয়ে হওয়া সম্ভব নয় এখানে। অবাক হয়ে গেছিলো সবাই,বাড়িতে তখন এক বিপর্যস্ত অবস্থা,অমিতও এসেছিলো নন্দার দাদার অনুরোধে কদিন আগেই। সুতরাং নির্বন্ধ হোক আর যাই হোক শেষে অমিতই বিয়ে করে ফেললো জমিদারী বংশের মান রাখতে নন্দাকে।
গায়ের রক্তটা তো চৌধুরী বাড়ির,নাইবা থাকলো তেমন কিছু।তবুও ওর সামনে একটা বিপর্যস্ত পরিবার আর ও কিছু করবেনা তাই হয়? তাই এগিয়ে এসেছিলো.." ওরা বিয়ে করবেনা না করুক,আমি বিয়ে করবো নন্দাকে। পরশুই বিয়ে হবে ভাবিসনা। অবশ্য একবার নন্দার সাথে কথা বলে নে।"
ওর দাদা চিন্তিত মুখে বলেছিলো," কিন্তু তোদের বাড়ির লোক মেনে নেবে তো নন্দাকে?"
" সে সব পরে দেখা যাবে", বলে নন্দাকে বিয়ে করে ফেলেছিলো অমিতাংশু।
অবশ্য পরে নন্দাকে শুনতে হয়েছিলো হয়ত দাদার বন্ধুর সাথে আগে থেকেই কিছু ছিলো।কিছু মানুষের পেছন থেকে কলঙ্ক আর দুর্ভাগ্য বোধহয় যায়না।
চন্ডীপুরের চৌধুরী পরিবারের ছোট বৌ হয়ে এসেছিলো শহরে মানুষ হওয়া নন্দা।বাড়িতে অনেক লোকজন তবে কালের আঁচড়ে বাড়িখানা একটু জরাজীর্ণ, গেট দিয়ে ঢুকে গোপালের মন্দির তারপর উঠোনের শিউলিতলা আর টগর গাছের সারি পেরিয়ে একখানা বড় বাঁধানো কুয়ো তারপর অন্দর মহল। গেটের বাইরে আনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর শাশুড়িমা এসেছিলেন বরণ করতে সাথে জা আর আরো লোকজন। রাগে ওর মুখের দিকে তাকাননি পর্যন্ত।
নন্দার মনে পড়েছিলো বাবার আর দাদার মুখখানা। মাকে অনেকদিনই হারিয়েছে তবুও শাশুড়ির আদর সেভাবে পায়নি কখনো।
প্রথম বার বাচ্চা নষ্ট হওয়ার পর শুনেছিলো একদম চলা ফেরার ঠিক নেই নাচুনি মেয়ে তাই এমন হয়েছে। তবে দ্বিতীয় বারের সুখবরে শাশুড়িমা বললেন.."ছেলে হোক। আমাদের বংশধর আসুক। অবশ্য মনে হচ্ছে এবার ছেলেই হবে তাইনা বড়বৌমা?"
নন্দার বড় জা মালতী সুন্দরী তবে এখনো কোলে সন্তান আসেনি।তাই নিত্যদিন ওঝা তান্ত্রিকের কাছে দৌড়তো হাত ভর্তি মাদুলী তাবিজ কবজ। ওর ভাসুর বাইরে বাইরেই থাকতেন ব্যবসার কাজে, মাঝে মাঝে আসতেন বাড়িতে। নন্দার কেন যেন মনে হত বড়দি ওকে ঠিক সহ্য করতে পারেনা। অমিতাংশুর সাথে দোতলার ঘরে অনেক নিভৃতে নন্দার মনে হয়েছে ঘরে যেন কে আড়ি পেতেছে অথবা কারো নিঃশ্বাসের শব্দ শুনছে আসেপাশে। "আমাদের যেন কেউ দেখছে জানো।"ও বলাতে অমিত বলেছে ,"সত্যি তুমিও যেমন,কে দেখবে শুনি? ওপরে তো তেমন কেউ থাকেনা।"
তবে একদিন নন্দা কলঘরে যাবার জন্য দরজা খুলতে একটা ঘোমটা টানা লাল ডুরে শাড়ি পরা কাউকে সরে যেতে দেখেছিলো। হঠাৎই মনে হয়েছিলো আজ বড়দি তো এমন একটা শাড়িই পরেছিলো। তবে নিচে এসে দেখেছিলো জায়ের ঘরের দরজা ভেজানো,পরে দেখেছিলো দিদির পরনে হলুদ লাল জড়ি পাড় শাড়ি। নিজেকে কেমন যেন পাগল পাগল লেগেছিলো নন্দার মনে হয়েছিলো একজোড়া চোখ ওকে দেখে পাহারা দেয় সারাক্ষণ।ওদের দাম্পত্যের সুখ সহ্য করতে পারেনা হয়ত ওর সন্তান...আর ভাবতে পারেনি নন্দা। অবশ্য এবার শাশুড়ি ওকে চোখে চোখে রেখেছেন..ছাদে কাপড় তোলা বন্ধ,নিচের ঘরে শোয়ার ব্যবস্থা হয়েছে।দেখতে দেখতে পাঁচমাসে পা দিয়েছে শাশুড়িমা গোপালের পুজো দেবেন অন্নভোগ হবে,পরমান্ন হবে।আর সেই পরমান্ন দিয়ে পঞ্চামৃত হবে নন্দার।
পুজো শেষে পরমান্ন দিয়ে পঞ্চামৃত হলো নন্দার। ও হঠাৎই তাকিয়ে দেখলো জায়ের চোখটা কেমন যেন জ্বলছে,ভয় হলো নন্দার। তারপর কি জানি কি হয়েছিলো... সন্ধ্যে থেকেই পেট ব্যথা প্রচণ্ড তারপর রক্তের স্রোত নেমেছিলো পা বেয়ে। নন্দার আর শাশুড়িমায়ের সব আশা শেষ হয়ে গিয়েছিলো...আক্ষেপ করে আঁচলে মুখ চাপা দিয়ে বলেছিলেন," অভিশাপ,অভিশাপ কে জানে কার অভিশাপে এই বাড়িতে হয়ত আর কোনদিন সন্তানই আসবেনা। আমরা বোধহয় কোনদিনই আর নাতির মুখ দেখতে পারবোনা।"
পাশ থেকে জা বলেছিলো," সারাদিন দুটিতে একজায়গায় আছে বরকে তো একেবারে আঁচলে বেঁধে রেখেছে। এই সময় সাবধানে থাকতে হয় কত।"
লজ্জায় যন্ত্রণায় মুখ ঢেকেছিলো নন্দা।খুব কেঁদেছিলো অমিতাংশুর কাছে বলেছিলো.." একটা কথা বলবো,বড়দিদি আমাদের সুখটা দেখতে পারেনা।"
" ছিঃ এমন বলতে নেই,সারাদিন সংসারের কাজ করে দাদা থাকেনা এখানে।তারপর বাচ্চাও হয়নি তাই হয়ত মন খারাপ থাকে।"
" কিন্তু আমার কেন এমন হলো? দুবারই এমন হলো!"
নন্দা বুঝতে পারে অমিত কিছুই বুঝতে পারবেনা। তাই হয়ত ওকেই সাবধান হতে হবে।
না পেরে বৌদিকে বলেছিলো যখন বাপের বাড়ি এসেছিলো। বৌদি বলেছিলো.." এরপর আর কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। তেমন বুঝলে এখানে চলে আসবি।দশটা মাস এখানে থেকেই যাবি।"
অনেক কথা আর হাহাকারের মধ্যে কেটে গিয়েছিলো দুটো বছর।লোকজন এলেই শাশুড়ির হাহাকার শুরু হত," একজনের কোন খবর নেই। আর আরেকজনের তো থাকলোই না। অভিশাপ অভিশাপ। কার নজর যে পড়লো কে জানে?"
********************
হঠাৎই একদিন খবর এলো বাবার অসুখ,শাশুড়িমা একটু আপত্তি করলেও অমিত নিয়ে চলে এসেছিলো কলকাতায়। কিছুদিন থেকে গিয়েছিলো নন্দা ওখানে, আর তার মধ্যেই কানে এসেছিলো অনাগত অতিথির পায়ের শব্দ। ভেবেছিলো অমিত যখন আসবে সামনের মাসে তখন ডাক্তার দেখিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বলবে। এবার আর যাবেনা ঐ বাড়িতে, একদম বাচ্চা হওয়ার পরেই যাবে।
তবে অমিতের আর এসে পৌঁছনো হয়নি কলকাতা, হঠাৎই নাকি বুকে ব্যথা হয়েছিলো তারপর সব শেষ।
খবর পেয়ে নন্দাকে নিয়ে গেছিলো ওর দাদা বৌদি তবে ওখানে থাকার মত পরিস্থিতি আর ছিলোনা। আজও সে কথা ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয় নন্দার। জমিদার বাড়ির ভেতরের হাড়কঙ্কাল সবই বেরিয়ে এসেছিলো। ও সন্তানসম্ভবা জেনে ওর চরিত্র নিয়ে টানাটানি হয়েছিলো শোকের বাড়িতে।
....." সে কি ঠাকুরপো তো কখনোই বলেনি একথা? সে নিশ্চয় জানতো,মানে যার সন্তান সে জানবেনা? "
কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো নন্দা, " আসলে ও জানতোনা। ওখানেই ধরা পড়েছিলো,ভেবেছিলাম দেখা হলে বলবো।"
তারপর শুনতে হয়েছিলো..নন্দা চরিত্রহীন,এখন সম্পত্তি নেওয়ার জন্য এইসব ফন্দি ফিকির করছে। আগে পরীক্ষা হবে তবে দেখা যাবে। নন্দা অবাক হয়েছিলো কি পরীক্ষা? জা শাশুড়িকে কথা বলতে দেয়নি বলেছিলো, "এখানে থাকতে হলে...বাচ্চা নষ্ট করে থাকতে হবে।" শাশুড়িমাও অদ্ভুতভাবে বলেছিলেন আসলে নন্দাই অপয়া তাই বাচ্চা স্বামী কিছুই রাখতে পারেনি। ছেলেই নেই,তার আবার বাচ্চা আসবে কোথা থেকে?
পরদিনই চন্ডীপুরের পাট চুকিয়ে দাদা বৌদির সাথে ফিরে এসেছিলো নন্দা। একটা অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়ে গেছিলো জীবনের।
***********************
বিষাদ, লড়াই আর বিস্মৃতির মধ্যে এসেছিলো কালী পুজোর দিন দীপাবলি। বাবা শখ করে ঐ নাম রেখেছিলেন। এখনো মেয়ের দিকে তাকালে নন্দার মনে হয় ওর ঐ মায়া মাখানো মুখটাই হয়ত লড়াই করে নতুনভাবে বাঁচতে শিখিয়েছে ওকে।
বাবা চলে গেছেন অনেকদিন আগে তবে বাবা থাকতেই ওদের কলুটোলার বাড়িটাতে চলে এসেছিলো নন্দা মেয়েকে নিয়ে। তারপর থেকেই একার লড়াই। দীপাবলিকে মনের মত মানুষ করেছে নন্দা তবে চন্ডীপুরের ছোঁয়া বাঁচিয়ে। তেমনভাবে কখনো জানতে দেয়নি ওকে বাবার বাড়ির কথা। শুধু মাঝে মাঝে রূপকথার মত গল্প করেছে ওখানকার গোপাল মন্দিরের, বিশাল ছাদের,দোতলায় ওদের শোয়ার ঘরের। বাবার দুএকটা ছবি দেখেছে দীপাবলি, তবে ও জানে মা ওর সব।বাবাকে তো কখনো চোখেই দেখেনি শুধু গল্প শুনেছে। হঠাৎই একদিন বলেছিলো ছোটবেলায়," মা আমাদের কেউ নেই?"
নন্দা ওকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো," তোর আমি আছি আর আমার তুই। আর কি চাই? মা আছেনা?"
তারপর আর কোনদিন দীপাবলি এই প্রশ্ন করেনি।
এমবিবিএস পরীক্ষায় ইউনিভার্সিটিতে সবার প্রথম হয়ে মেডিসিনে এমডি করে চাকরিতে যাবে আর কদিন বাদেই দীপাবলি। নন্দার মনটা সত্যিই খারাপ, কোনদিন মেয়েকে ছেড়ে থাকেনি।
" মা একটুও চিন্তা কোরনা,ওখানে কোয়ার্টার দেবে। আমি ভালো থাকবো,ফোন করবো। আর চলে আসবো ছুটি পেলেই।খুশি তো?"
প্রথমে একটু মন খারাপ থাকলেও গত ছয়মাসে মোটামুটি সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে।এর মধ্যে তিনচারবার এসে ঘুরেও গেছে।
*****************
গাছপালা ঘেরা ওদের হসপিটাল, চারদিকে সবুজের ছোঁয়া আর লালমাটি।দীপাবলি এমনিতে খুব মিশুকে তাই কিছুদিনের মধ্যেই সবার প্রিয় হয়ে উঠেছে। তারমধ্যে রেখাদি মাঝে মাঝেই চলে আসে ওর কোয়ার্টারে।যদিও রেখাদি নার্স তবুও খুব ভালো লাগে ওর অদ্ভুত একটা মায়ের ছোঁয়া রেখাদির মধ্যে,মাঝে মাঝেই বাটি ভরা পোস্ত অথবা মাছের চচ্চড়ি এনে বলতো.." ম্যাডাম এটা খাবেন।"
প্রথমটা শুনে খুব অস্বস্তি হয়েছে দীপাবলির..ওর থেকে অনেকটা বড় একজন মহিলা।একটু বাধা দিয়েছিলো দীপাবলি.." ম্যাডাম আপনিটা বাদ দেওয়া যায় না?"
রেখাদি হেসে বলেছিলো..." আসলে পদমর্যাদা বলে একটা কথা আছে। নাম ধরে ঠিক ডাকতে পারিনা ওভাবে তুমি বলে। আচ্ছা আমি বাড়িতে এলে মেম বলে ডাকবো নাহয়।"
দীপাবলি শুনে হা হা করে হেসেছিলো.." মেম? আমি? তারা তো সাদা ধবধবে।"
এই নিয়ে একচোট হাসাহাসি হয়েছিলো। তারপর থেকে একটা বন্ধন হয়ে গিয়েছিলো রেখাদির সাথে। নন্দাও নিশ্চিন্ত হয়েছিলো যাক কেউ তো আছে যারা মেয়েটার খেয়াল রাখে অন্ততঃ।
দেখতে দেখতে একটা বছর পার হয়ে গেছে হঠাৎই মেয়ে আদুরে গলায় ফোন করে..." মা আমি রেখাদির সাথে যাবো,খুব ধরেছে মেয়ের বিয়েতে যাবার জন্য।"
নন্দা জানে রেখা অবিবাহিত.." রেখার মেয়ে কোথা থেকে এলো? তুই তো কোথাও যেতেই চাসনা।"
" রেখাদির ভাইঝি গো ওরাই তো নাকি উনার ছেলেমেয়েদের মত। কি করবো বলো এত ধরেছে আর পারছিনা অবশ্য ডঃ দাসও যাবেন।"
*********************
ডঃ দাসের সাথে বিয়ের দিন গাড়ি করে গেলেও রেখাদির অনুরোধে দীপাবলিকে থেকেই যেতে হলো। অবশ্য আগামী তিনদিন ওর অফ। কেন যেন ওদের আন্তরিকতা মন কেড়ে নিলো ওর। আসলে কখনো তো মা ছাড়া এত ভালোবাসার তেমন কাউকে পায়নি অবশ্য মামা মামী ভালোবাসে।তবুও কোন বিয়েবাড়িতে এভাবে কখনো আসেনি আগে। তাই রেখাদির অনুরোধ আর ফেলতে পারেনা।
বিয়ের পরের দিন দুচোখ ভরে সবুজকে দেখলো দীপাবলি। কি সুন্দর গ্ৰামখানা! মায়ের কাছে একটা গ্ৰামের গল্প বহুদিন আগে শুনতো মাঝে মাঝে আর বলতো.." তুমি গেছো ওখানে মা কখনো? আমাকে নিয়ে যাবে সেখানে? আমি গোপালের মন্দির দেখবো।ডাকের সাজের প্রতিমা দেখবো।"
মা ওকে কোলের কাছে টেনে বলতো.." ও সব এখন গল্প কথা।সেই কবে তোর বাবার সাথে গেছিলাম ওখানে বেড়াতে তখন আমি নতুন বৌ।"
রেখাদিদের বাড়ির সাথে মায়ের গল্প না মিললেও খুব সুন্দর বাড়ি ওদের। একটু এগোলেই ধানগাছ মাঠ আলো করেছে ধানের সোনালী শিষে হাওয়া আলতো ছোঁয়ায় আদর করে যাচ্ছে। রেখাদির ভাইঝি লিপি খুব মিস্টি মেয়ে বারবার বলে গেছে.." ডঃ মেম তুমি কিন্তু আমার বৌভাতে যাবে।"
" আমার অতটা গাড়ি জার্নি ঠিক সহ্য হয়না মানে বাসে করে। আসলে অভ্যেস নেই তো।"
না বললেও ছাড় পাওয়া গেলোনা,ঝকঝকে ইনোভা এসে দাঁড়িয়েছে দরজায় দীপাবলি বুঝতে পারে সবটাই ওর জন্য। গাড়ি চলতে শুরু করে,অন্য কনেযাত্রীরা সব বাসে। গাড়িতে রেখাদি,ও আর রেখাদির দাদা বৌদি আর ভাইপো।তাড়াতাড়ি রওনা দিয়েছে ওরা পিচের রাস্তা ছাড়িয়ে গাড়ি চলতে থাকে অনেকটা যাবার পর দুবরাজপুর আসে।দীপাবলি বলে ওঠে..." যাক এসে পড়েছি তাহলে।"
রেখাদি হাসে," আরেকটু ডঃ মেম,আরো আধ ঘন্টাখানেক লাগবে।"
একটা বড় গেটের সামনে এসে গাড়িটা দাঁড়ায়।ভালো করে তাকিয়ে দেখে দীপাবলি, মনে হচ্ছে বেশ পুরোনো জমিদারবাড়ি।তবে আজ একদম জরাজীর্ণ, বিয়ের জন্য মনে হচ্ছে কিছুটা অংশ রঙ করা হয়েছে। ডানদিকে দুর্গামন্ডপ,উল্টোদিকে আরেকটা বাড়ি ওখানে বোধহয় খাওয়াদাওয়া হবে।
ততক্ষণে বাস থেকে তত্ত্ব নামছে,কেমন যেন অবাক লাগে দীপাবলির খুব কাছ থেকে একটা বিয়ে দেখলো। পড়াশোনা করতে করতেই এতদিন কেটে গেছে,কেউ বিয়ের কথা বললে মা বলে," যেদিন ও বলবে বিয়ে করবে দেবো।আগে নিজের পায়ে দাঁড়াক।"
আর ও হেসে মাকে জড়িয়ে বলতো," তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবোনা।"
দীপাবলি লক্ষ্য করে গেট ছাড়িয়ে কিছুটা গিয়েই সবাই দাঁড়িয়ে পড়ছে,মন্দিরের দরজা খোলা পুরোহিত মশাই আরতির জোগাড় করছেন। সবাইকে দেখে ও নিজেও ঠাকুর প্রণাম করলো,ভেতরে গোপালের মূর্তি।তারপর এগিয়ে যেতে দেখলো বাঁদিকে শিউলি গাছ আর টগর গাছ। তারপর বড় একখানা কুয়ো সিমেন্ট বাঁধানো।
লিপি খুব খুশি ওকে দেখে।কিন্তু দীপাবলির মন কেমন যেন আনমনা কোথায় যেন বারবার হারিয়ে যাচ্ছে অতীতের গলিপথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে।এই কি তবে সেই বাড়ি? যে বাড়ির কথা মায়ের কাছে শুনেছে মাঝে মাঝেই,একটা সময় ও নিজেও মনে মনেই পৌঁছে যেতো সেই বাড়িতে। বলতো ,"কোথায় সেই বাড়ি মা?"বললে মা এড়িয়ে যেতো..বলতো "সেই কবে গেছি সেখানে ভুলেই গেছি সেই জায়গা।"
আজ যেন সবটা চেনা লাগে দীপাবলির। লিপির বরের সাথে আলাপ হয়েছিলো সেদিনই হঠাৎই দীপাবলি রেখাদিকে বলে," এমন বাড়িতে সত্যি কোনদিন আসিনি।কত পুরোনো বাড়ি! খুব দেখতে ইচ্ছে করছে বাড়িটা।"
রেখাদি হাসে,"ডঃ মেম বলেছে সুতরাং এইটুকু তো করতেই হবে। নতুন জামাই বুঝেছো তো।"
নতুন জামাইয়ের কাকা নিজেই দায়িত্ব নিলেন সানন্দে," আসুন,আসুন অনেক বড় পুরোনো বাড়ি আমাদের,সরিকরা মিলে বাস করি।যতটা পারি ঘুরে দেখাই। অন্য সময় অন্ধকারে পড়ে থাকে আজ বিয়েতে সেজেছে।"
এ বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরতে ঘুরতে মনে হয় এ বাড়ি যেন অনেকদিনের চেনা ওর। এই তো সেই ঘোরানো সিঁড়ি..ফুটবল খেলার মাঠের মত ছাদ। আর ঐ তো দোতলার ঘর যার জানলা দিয়ে দুগ্গাঠাকুরকে দেখা যেতো। খুব চেনা,ভীষণ চেনা।
হঠাৎই দীপাবলি জিজ্ঞেস করে..." আচ্ছা এই পাড়াতে অমিতাংশু চৌধুরী বলে কেউ থাকতেন?"
ভদ্রলোক অবাক হয়ে যান..." হ্যাঁ, কিন্তু সে তো অনেক আগের কথা। আমাদের বড় তরফ সম্পর্কে দাদা হতেন আমাদের।কিন্তু তিনি তো অনেক আগে..মানে মারা গেছেন।"
" আচ্ছা তাদের কি কেউ আছে এই বাড়িতে?"
ভদ্রলোক অবাক হয়ে তাকান ওর দিকে তবুও বলে যান.." না না বৌদিকে অপবাদ দিয়ে তাড়িয়েছিলো ওরা।সেই থেকে লক্ষ্মীছাড়া মোটামুটি, জেঠিমা জ্যাঠামশাই নেই। শুধু বড় বৌদি আর তার পঙ্গু ছেলে পাপের মাশুল গুনছে। আপনি চেনেন নাকি ওদের কাউকে?
" না শুনেছিলাম আমার এক আত্মীয়ের কাছে। খুব ভালো লাগলো এই বাড়িতে এসে। আপনি একটু এগোন আমি কয়েকটা ছবি তুলি।"
হাতের সেলফোনটায় হাত দেয় দীপাবলি প্রথম নম্বরটাই মায়ের...." হ্যালো,মা আমি এখন চন্ডীপুরে লিপির বৌভাতে এসেছি,কি আশ্চর্য তোমার বলা গল্পের সঙ্গে জায়গাটা একদম মিলে যাচ্ছে। সেই গোল ঘোরানো বারান্দায় আমি দাঁড়িয়ে আছি এখন, যেখানে বসে সবাই অন্নকুটের প্রসাদ নিতো।.."
অবাক হয়ে যায় নন্দা..দীপা চন্ডীপুরে! হয়ত একেই বলে শিকড়ের টান। হয়ত ঐ মাটিতে আজও ভাসে কোথাও অমিতের নিঃশ্বাস তাই বোধহয় মেয়েটাকে ছুঁয়ে নিলো এভাবেই....কিন্তু ও তো কখনো চন্ডীপুর নামটাই বলেনি দীপাকে তাহলে?
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment