#মোর_মাহুত_বন্ধুরে#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
ট্রেনের কামরায় বসে নিঃশ্বাস ফেলি মোটামুটি জয়তু শান্তি বলে।আহ্ কিছুদিনের জন্য মুক্তি থিয়োরি,প্র্যাকটিক্যাল আর সব ক্রিটিক্যাল ক্লাশ থেকে । ট্রেন এগিয়ে যাচ্ছে উত্তরবঙ্গের দিকে সেখান থেকে পায়ে পায়ে এগোবে সবুজের সাথে হাত মেলাতে মেলাতে একদম আসামের দিকে। আমার মানে আমাদের গন্তব্য গৌহাটি। আমাদের দলে আছি চারজন তারমধ্যে আমাদের পথপ্রদর্শক আর এইকদিনের আশ্রয়দাতা কমলও আছে।মানে গৌহাটি পার হয়ে কাজিরাঙাতে ওর বাড়িতেই আমরা থাকবো কদিন। সত্যিই ছাত্র অবস্থায় খরচ করে বড় হোটেলে থাকার মত সামর্থ্য তখন ছিলোনা।
তাই কমল যখন প্রস্তাব দিলো তখন আমি,কল্যাণ আর ত্রিদিব একটু আমতা আমতা করে বিনয় প্রকাশ করলেও রাজি হয়ে গেলাম। এমন নেমন্তন্ন ঠিক ফেলে দেওয়া যায়না।
ত্রিদিবের টিফিন কৌটো থেকে বেরোলো লুচি আলুর দম প্রথমে সেটা কিছুটা খেয়ে গোটা দশেক স্টোর করলাম সকালের জন্য। তারপর রাতে আমার বাড়ি থেকে আনা কষা মুরগি আর কল্যাণের আনা ফ্রায়েডরাইস যৎসামান্য খেয়ে যার যার বাঙ্কে শুয়ে পড়লাম। মোটামুটি অক্টোবর মাঝামাঝি পেরিয়ে গেছে তখন।বাতাসে শীতের ওম্ আর ট্রেনের দুলুনির মধ্যে টুকটাক গল্প করতে করতে চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে ঘুমে।কমলকে বলে দিলাম ফারাক্কা ব্রীজ এলে যেন ডেকে দেয়।
কমল হাই তুলে বললো," ঘুম ভাঙলে ডাকবো। এখন ভাই বাড়ি যাচ্ছি অনেকদিন বাদে তাই মন ফুরফুরে। ফেরার সময় দেখাবো তেমন হলে।"
ত্রিদিব শেষে দায়িত্ব নিলো," আমার তেমন ঘুম হয়না ট্রেনে।আমি ডেকে দেবো।এখন ঘুমিয়ে পড়।"
যাক শান্তিতে চোখ বুজলাম সত্যিই ভোরে আর চোখ খুলতে ইচ্ছে করছিলোনা।ট্রেনের দুলুনিতে তখন আয়েশে চোখ বোজা। তবুও উপায় নেই আমার আব্দারেই দুই বন্ধু মরিয়া হয়ে ডাকাডাকি শুরু করলো," এই ওঠ, আমাদের ঘুমোতে না দিয়ে নিজে কেমন ঘুমোচ্ছ দেখ।"
দেখ শুনতে শুনতে আমিও উঠে পড়ে একদম লাফ দিয়ে লোয়ার বাঙ্কে নেমে দেখলাম আকাঙ্খিত ফারাক্বা ব্রীজ। তখন সবেই ভোরের আলো ফুটছে। চারিদিকে সবুজের হাতছানির মাঝেই গঙ্গার অবিরাম বয়ে চলা।
মালদাতে কিছু মিস্টি কিনে সেই রাতে রাখা লুচির সদ্ব্যবহার করে আবার জানলায় বসে উঁকিঝুঁকি সামনে পেছনে যতদূর দেখা যায়।
বেশ অনেকটা মানে প্রায় দুই রাতের ট্রেনজার্নির পর গৌহাটি এসে পৌঁছনোর পরে ওখান থেকে একখানা প্রাইভেট ট্যাক্সিতে কাজিরাঙার পথে। আসামের প্রাকৃতিক শোভা সত্যিই ভীষণ সুন্দর।চারিদিকে সবুজে সবুজ তার মাঝে মন ভরাচ্ছে নাম না জানা পাখির দল।
আমাদের স্বপ্নে তখন কাজিরাঙার পাখি,গন্ডার এইসব ঘোরাঘুরি করছে। কমলদের বাড়িতে এসে ওদের সবার অভ্যর্থনায় মন ভরলো। যদিও প্রথমে আমাদের মনে একটু অস্বস্তি ছিলো এভাবে হঠাৎই বন্ধুর বাড়ি হাজির হওয়া নিয়ে।কমল অবশ্য শুনেই বকুনি দিয়েছিলো," আরে হঠাৎ হবে কেন? আমিই তো বলেছি যেতে আমাদের বাড়িতে একবার গিয়ে দেখ খুব ভালো লাগবে। কাজিরাঙা, মাজুলি,কামাক্ষ্যা মায়ের মন্দির সব দেখাবো।"
আহা সব তাজা আর টাটকা,নদীর তাজা মাছ আর ওদের ক্ষেতের টাটকা সব্জি যেন কদিনেই চাঙা করে দিলো আমাদের।
" শোন আমার তো ফিরতে ইচ্ছেই করছেনা,এত খাওয়াদাওয়া ছেড়ে।"কল্যাণ বলে।
ত্রিদিব ওকে ধমকায়," শুধু খাবি না ঘুরে দেখবি? নতুন ক্যামেরা খানা বাবার কাছে বায়না করে কিনেছি ফটো তোলার জন্য সেটার কি হবে শুনি?"
কমল হেসে অস্থির ওদের কথা শুনে,"খাওয়া,ঘোরা,ছবি তোলা সব হবে।কিচ্ছু চিন্তা নেই। চল এখন বেরিয়ে পড়ি,জঙ্গলে যাওয়া আজ। ত্রিদিব মনের সুখে ছবি তুলবি আজ।"
**************************
দেখতে দেখতে কেটে গেছে কয়েকটা দিন। সেদিন গৌহাটি ঘুরে ফিরে আসতে আসতে বেশ রাত হয়ে গেছে। ওদের গ্ৰামের এই পথটুকু আমাদের হেঁটেই যেতে হয় গাড়ির রাস্তা থেকে নেমে। গোল ঘোরানো মাটির রাস্তা পেরিয়ে প্রায় ওদের বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছি হঠাৎই মনকাড়া গানের সুরে থমকে দাঁড়াই। অদ্ভুত মিস্টি কান্নাভেজা গলায় কে যেন গাইছে..' তোরা গেলে কি আসিবেন মোর মাহুত বন্ধুরে।'
নিজের অজান্তেই পা দুটো আটকে গেলো মাটিতে। আমার মা গান গায়,তাই বাড়িতে রেকর্ডের ছড়াছড়ি। খুব ছোটবেলায় গানটা শুনেছিলাম। মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,এই গানটাতে এত কান্না মেশানো কেন? মা হেসে বলেছিলো," সঙ্গীহারা কোন মাহুতের বৌয়ের গান এটা। হাতি ধরতে গিয়ে আর ফেরেনি সেই মাহুত। তার খোঁজে এই গান করছে সে একরাশ কান্না নিয়ে বুকে।"
কমলকে জিজ্ঞেস করি,কে গাইছে রে? নাকি রেকর্ডে?
" এই গান আসামের প্রাণের গান রে। আমাদের ঘরে ঘরে মেয়ে বৌ এই গান গায়। তবে এই গানটা গাইছে রঙ্গিনী পিসি,আমার পিসামশায় বেশ কয়েকবছর আগে জঙ্গলে গিয়ে আর ফেরেনি। কত খোঁজ করা হয়েছে।পাওয়া যায়নি রে।একসময় ওরা দুজনে এই গানটা গাইতো। কি যে ভালো লাগতো!"
কল্যাণ বললো,"তোর নিজের পিসি? এই কদিন দেখিনি তো?"
" না রে গ্ৰাম সম্পর্কে পিসি,এখন প্রায় আধপাগল। কোন সন্তান নেই তো।বাপের বাড়িতেই থাকে এখন। অনেকে বলে,পিসামশায় ওকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করেছে বাচ্চা হয়নি বলে। এমনিতে ঠিকই থাকে মন খারাপ হলে এই গানটা গায়। আজ বোধহয় পূর্ণিমা।"
কমলের কথায় আকাশের দিকে তাকাই চাঁদনী রাতের অপূর্ব সৌন্দর্য্য মন ছুঁয়ে যায়। আর তার সাথে ঐ কান্নাভেজা গানের আকুতি যেন হৃদয়কে ভরে দেয় কানায় কানায়।
********************
কমলদের বাড়ি থেকে বেশ অনেকদিন ফিরে এসেছি তবে তার রেশ রয়ে গেছে বহুদিন।ফিরে এসে মাকে গল্প করেছি গানের কথা। মা বললো," ইশ্ রেকর্ড যদি করা যেত!"
মা এ যে স্বতঃস্ফূর্ত এক গান যা হৃদয় নিংড়ে সমস্ত আবেগ নিয়ে গলায় মেখে স্বর থেকে সুর হয়ে বেরোচ্ছে। এই গান কানেই থেকে যাবে আজীবন আমার।
মা শুনে বললো,"ঠিক,ঐ মানুষটাকে তো বলা যায়না তুমি গান করো আমি শুনি বা রেকর্ড করি।"
" হ্যাঁ মা আর উনার যা মনের অবস্থা তাতে উনি গাইবেনও না। শুনেছি তেমন কারো সাথে কথাও বলেননা।"
ওহ্ এতক্ষণ তো বলাই হয়নি আমি কি পড়াশোনা করি। আমি আর কমল ডাক্তারীর ছাত্র,ত্রিদিব আর কল্যাণ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে যাদবপুরে। আমার মারফতেই কমলের সাথে ওদের বন্ধুত্ব। যথারীতি ত্রিদিব আর কল্যাণ আগে পাশ করলো,চাকরিও পেলো।আমি আর কমল তখনো পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি। ডাক্তার হওয়া যে সহজ নয় তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। যাক এমবিবিএস পাশ করলাম অবশেষে তারপরেও মুক্তি নেই উচ্চশিক্ষার জন্য আবার পরীক্ষাতে বসা। যথারীতি সুযোগ এলো মানে পেয়ে গেলাম নাকমুখ গুজে পড়াশোনা করে। আমি কলকাতাতেই রয়ে গেলাম,আর কমল শিলংয়ে চলে গেলো। তারপর ঐ যেটুকু যোগাযোগ ফোনে। যথারীতি কমল বারবার বলতে লাগলো "আরেকবার আয় মেঘের দেশে নিয়ে যাবো। এবার ফ্লাইটে আসিস।"
তা নাহয় এলাম তবে সেই আনন্দ কি হবে প্রথমবারের মত?
তারপর পড়াশোনা নাইটডিউটি,ওপিডি সবের তলায় ধামাচাপা পড়ে গেছে অনেককিছু। বয়ে গেছে আরো কিছুটা জল সময় নদীর।
**********************
হঠাৎই একদিন তমাল ডেকে পাঠালো ওদের ডিপার্টমেন্টে। সত্যি কথা বলতে এই সাইক্রিয়াট্রি ডিপার্টমেন্ট আমার একদম অপছন্দের।মানে ইন্টার্নশিপ করার সময় একজন মহিলা আমার গলা টিপে ধরেছিলো তারপর থেকেই ভালো লাগেনা,নিতে পারিনা ঠিক।
তাই ওকে গিয়ে তাড়া দিলাম কি বলবি বল হঠাৎ তলব কেন? তুই তো জানিস আমি ঠিক কমফোর্ট ফিল করিনা এখানে।
" আরে বোসোনা বলছি।"
হঠাৎই কানে আসে একটা গানের সুর,খুব প্রিয় একটা গান।যে গানের সুর কানে বাজে এখনো পূর্ণিমা রাতের চাঁদ দেখলেই।
" আরে কি করছো কি? ওদিকে যেয়োনা। তোমার অস্বস্তি হবে।"
আমার পা দুটো নিষেধের ধার ধারতে চাইলোনা।কে গাইছে রে?
" আর বোলোনা,কয়েকদিন আগে অ্যাডমিট হয়েছে একটা পেসেন্ট। কিছুই নাকি মনে নেই তার নাম ঠিকানা হীন হয়ে ঘুরেছে এতদিন।কোন একটা এনজিও দিয়ে গেছে এখানে। তবে গানটা দারুণ গায়,আহা একদম মন ভরানো।"
আমার কান তখন একদম গানের দিকে।অন্যমনস্ক হয়ে বললাম একটু রেকর্ড করবো গানটা?
" পাগল নাকি? সরি রাগ কোরনা।মানে তোমার ভালো লাগবেনা। আরে তোমার রেকর্ডিংটা চাই?"
আছে তোর কাছে?
" হ্যাঁ, কৃষ্ণা শুনতে চেয়েছিলো তাই করেছি।দাঁড়াও তোমাকে হোয়াটসঅ্যাপ করবো।"
তমালের হোয়াটস অ্যাপের গানটা বহুবার শুনেছি কাল থেকে। ওকে শেষে বলেই ফেললাম, ঐ লোকটার একটা ছবি তুলে দিতে পারিস?
" যা অবস্থায় এসেছিলো! এখন কিছুটা পরিস্কার।আচ্ছা দেখবো যদি সুযোগ পাই।"
ছবিটা পাবার পর আর দেরি করিনি এই কদিনের দ্বন্দ্ব সরিয়ে কমলকে ফোন করেছিলাম হ্যাঁ রে তোর রঙ্গিনী পিসি এখনো আছে?
অবাক হয়েছে শুনে কমল," কেন রে হঠাৎ? হ্যাঁ পিসি আছে তো। বয়েস তো বেশি নয় খুব।"
তোকে একটা গান পাঠাই শুনে দেখতো।
কিছুক্ষণ পরে একটা উচ্ছ্বাস নিয়ে কমল বলেছিলো," দারুণ গায় তো! একদম রঙ্গিনী পিসির মত দরদ গলায়।"
ছবিটা দেখে অবশ্য কমল চিনতে পারেনি।বলেছিলো," আমি তখন অনেকটা ছোট,দুএকবার দেখেছি।এখন ঠিক মনে পড়েনা। আচ্ছা বাবাকে পাঠাবো বলবো ঐ বাড়ির বঙ্কুকাকাকে দেখাতে।"
কাজের মাঝে কথাটা বারবারই উঁকি দিয়েছে মনে।পরদিনই কমল ফোন করে," বঙ্কুকাকাকে দেখিয়েছে বাবা,ওরা বলছে হতে পারে। অনেকটা মিল আছে। তবে রঙ্গিনী পিসি খুব অস্থির হয়ে গেছে গানটা শুনে পাগলের মত করছে। এখন মনে হচ্ছে না করলেই ভালো হত এইসব।"
এরমধ্যে তমালের ওখানে আবার গেছিলাম ভদ্রলোককে দেখে এসেছি।মাঝে মাঝেই মুখে সেই গান। বাড়ি আসতেই কমলের ফোন এলো.." শোন একটু হেল্প করিস,রঙ্গিনী পিসিকে আর রাখা যাচ্ছেনা। ওরা যাচ্ছে কলকাতা যদি সত্যিই লোকটা পিসামশাই হয়।
আমার বুকটা কেঁঁপে উঠলো উৎকন্ঠায়,যদি না হয়? তাহলে কি হবে? ওরা তো পরশুই এসে পৌঁছবে।
*********************
তমালকে আগেই বলে রেখেছিলাম উনাকে ব্যবস্থা করে কেবিনে রাখতে। রঙ্গিনী পিসি আর কাকুদের নিয়ে আমি আবার গেলাম হসপিটালে। অদ্ভুতভাবে দূর থেকেই শুনলাম সেই গানের সুর।রঙ্গিনী পিসিকে আটকে রাখা গেলোনা।বঙ্কুকাকার হাত ছেড়ে ছুটে গেলো গানের সুর শুনে। আমরাও ছুটে গেলাম পেছন পেছন। হঠাৎই শুনতে পেলাম রঙ্গিনী পিসি সেই কান্নাভেজা গলায় গানটা গাইছে। লোকটি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে গান থামিয়ে পিসির দিকে।হঠাৎই আবার গাইতে শুরু করলো তোমরা গেলে কি আসিবেন মোর মাহুত বন্ধুরে। দুজনের মেলানো সুরে তখন ভাসছে হসপিটালের কেবিন।রঙ্গিনী পিসির দুচোখে জল,জল বঙ্কুকাকার চোখেও। ডাক্তারদের মন শক্ত রাখতে হয় তাই আমি জানলার বাইরে তাকালাম ভরে যাওয়া চোখদুটো আড়াল করতে। হসপিটালের খোলা জানলা দিয়ে চোখে পড়লো কৃষ্ণচূড়া গাছটা ধুয়ে যাচ্ছে চাঁদের আলোতে।বুঝতে পারলাম আজ পূর্ণিমা,তাই বোধহয় পূর্ণিমায় গাওয়া গানের সুরই মিলিয়ে দিলো অনেক বছর পরে হারিয়ে যাওয়া দুটো পাগল মনকে।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment