অনেকদিন বাদে মিষ্টির মুখে সেই ঝকঝকে হাসিটা খোলা বারান্দার রোদের মত খেলা করছে আনন্দে। নিভু আলোতে মেজাজী কফি আর স্যান্ডউইচে জন্মদিনের আগের সন্ধ্যেটা বেশ আনন্দে ভরলো। মিষ্টির বারান্দার ফুলগুলো আজ দোলা দিল খুশিতে ওদের জমানো কথার দোলায়।
হঠাৎই মিষ্টির হাতে টিকিট দুটো ধরিয়ে দেয় জোজো।
-''কি এটা?"
-" খুলেই দেখ।"
টিকিটটা খুলেই মিষ্টির চোখটা আরেক পশলা খুশির বৃষ্টিতে ধুয়ে যায়।
-" দার্জিলিং!"
-"হ্যাঁ।"
-" আমরা যাচ্ছি?"
" আমাদের নামই তো লেখা আছে টিকিটে।"
-" তোমার অফিস?"
-" যাবো না। ছুটি নিয়েছি।"
-" ফেরার পথে কালচিনি আর শিলিগুড়ি হয়ে আসব তো?"
-" হ্যাঁ ম্যাডাম,আসব। অনেকদিন মা বাবা আর শ্বশুর স্যারকে দেখিনা।"
জোজোর কথা শুনে হেসে ফেলে মিষ্টি।
-" ইশ্ যদি দুষ্টুটা থাকতো এখানে।"
-" ম্যাডাম এখন চারমিনারে প্রেম করছে নিজামের সাথে। আমরাও একটু ভেসে যাই।আর এইগুলো ট্রলিবন্দ করে ফেল। কাল সকালেই কিন্তু যাওয়া আমাদের।"
-" কি আছে এতে?"
-" কাল দেখো। তোমার প্রিয় বুটিকের.."
মিষ্টির হাসিটা জোজোকে ছুঁয়ে যায়। কতদিন বাদে বৌটাকে হাসিখুশি দেখছে।
পাহাড়ী ঝর্ণার মত উচ্ছ্বল মিষ্টি গোছানোতে ব্যস্ত হয়ে যায়।
বোন দুবার যখন গেছে যখন ওর যাওয়া হয়নি তাই পাহাড়ের রানীকে আবার দেখা কাছ থেকে অনেকদিন বাদে।
যদিও সোমদাকে বলে এসেছে সবটাই মানে ঘোরা কাজ দুটোই একসাথে করে আসবে এবার। উত্তরের কিছু খবর ঝুলিতে ভরতে হবে এই ফাঁকে।
অফিসের পথে আজও দাঁড়িয়ে উত্তমা,আজ ঠিক করেছে ফোনটা আগেই করবে। গাড়িটা কিছুতেই মিস্ করা যাবে না আজ।
বার বার রিং করতে গিয়েও কিছুতেই কানেক্ট হয় না ফোন। অপর দিক থেকে অবশেষে শব্দ আসে ফোন সুইচড্ অফ। ঠোঁট কামড়ায় উত্তমা। নিকুচি করেছে ফোনের,ফোন সুইচড্ অফ কেন?কোন মিটিংয়ে নাকি?
অফিসে এসে এদিক ওদিক তাকায় উত্তমা নির্দিষ্ট ঘরে দেখেনা উত্তীয়কে।
তবে খবরের অফিসে খবর হাওয়ায় ভাসে কানে আসে আজ শুধু নয় কয়েকদিন এখন অফিসে আসবে না উত্তীয়। যথারীতি মেজখজটা খাপ্পা হয়ে যায়।
মুখ দিয়ে গালাগাল বেরিয়ে আসে," গেল কোথায় মালটা? নিশ্চয় বৌ নিয়ে ফূর্তি করছে।"
জোজো ততক্ষণে অনেকটা দূরে কলকাতা থেকে পাশে অবশ্যই মিষ্টি।
************************
দীপ্তর সাথে এই প্রথম একা এইভাবে সময় কাটানো দুষ্টুর। সত্যিই জীবন যে কখন কি গল্প বলে তা কেউ জানেনা তেমন করে। ছোট থেকে যে ছেলেটাকে দেখেছে বাবার আদরে আর একটু বেশি নজরে থাকতে সেই ছেলেটা আজ ওর মনের অনেকটা জুড়ে রয়েছে একদম। অথচ একটা সময় রাগও করেছে বাবার বাড়াবাড়ি দেখে। মনে হত ওদের আদরে ভাগ বসাচ্ছে কেউ। আর তুলনা তো একদম সহ্য করতে পারত না। যদিও বাবা তেমন কিছু বলত না কখনই।
দুষ্টুর ছেলেমানুষী,ওর বেশি কথা বলা ছটফটে ভাবটা ছুঁয়ে যায় দীপ্তকে। তবুও যেন একদম খুব কাছে টানতে এখনও একটু আড়ষ্ট দীপ্ত। হয়ত মাস্টারমশাই ওদের আসেপাশে কোথাও আছেন এখানেই। যার কাছে সবসময় শুনেছে.." জীবনে সংযম থাকা খুব জরুরী। অসংযম জীবনযাত্রার ফল সবসময় ভালো হয়না।"
একথা নিজের জীবনে ঠোকর খেয়ে অনেকবার বুঝেছে দীপ্ত। দুষ্টু ছবি তোলার জন্য,সুন্দর নক্সা খচিত দেওয়ালে হেলান দিয়েছে। ওর ফুলকারি নক্সাকাটা ওড়না দুলছে একটু দূর থেকে ওকে কোন রাজকন্যা অথবা নবাবী আমলের সুন্দরীদের মতই লাগছে।
-" কি হল? কি দেখছো? হয়ে গেছে তোলা?"
ঘাড় নাড়ে দীপ্ত,আসলে মুঠোফোনের সাথে সাথে কিছু মুহূর্ত মনের কোণে যত্নে বন্দি হয়ে যায়।
হায়দ্রাবাদের স্থাপত্যে আজ আবার নতুন করে লেখা হল দীপ্তর জীবনে একান্তে কাটানো কয়েকটা দিনের কথা।
দেখতে দেখতে একটা দিন কেটে গেলো। প্রত্যেকটা দিনের প্রতি মুহূর্তকে যত্নে মুঠোতে ধরতে চায় ওরা। দুষ্টুর জীবনে একটা সময় মানসপ্রেম ছিল জোজোকে ঘিরে। মনে মনে কতগুলো রঙীন ছবি সাজিয়েছিল প্রেমকে ধরতে চেয়ে। সেই স্বপ্নের রঙ এখন সত্যি হয়ে ধরা দিয়েছে বাস্তবে।
দিনে অন্ততঃ দুবার নিয়ম করে বাবা মায়ের সাথে কথা বলে দুষ্টু। তার মধ্যেও অনুর নানা রকম চিন্তা। রবীনকে বলেও হয়না,দুই বোন কথা বলে।
" দিদি আমাদের দুষ্টুর কোন তুলনা হয়না,দেখবি ওর বুদ্ধি দিয়ে সবটাই বুঝে চলবে। আজকালকার ছেলেমেয়েদের থেকে অনেক বেশি ম্যাচিওরড।"
হয়ত বোনের কথাই ঠিক,দুষ্টুর বুদ্ধি আর লড়াই ওকে নিয়ে গেছে এক স্বপ্নের ভবিষ্যতে।
দীপ্তর সাথে ভবিষ্যতের স্বপ্নের জাল বোনে দুষ্টু।
-" আমি ভাবছি কবে ট্রেনিং শেষ হয়ে বাড়িতে যাবো। আর ভালো লাগছে না।''
গোলকুন্ডা ফোর্টের নিরিবিলিতে বসে দীপ্তর ঘাড়ে মাথা রাখে দুষ্টু ওর এলোমেলো চুল ছুঁয়ে রাখে দীপ্তকে।
-" কি ভালো লাগছে না শুনি?"
-" এত নিয়ম আর মিসিং ইউ।"
-" আমি তো পাশে বসেই। একদম ছুঁয়ে আছি তোমাকে,এভাবেই থাকব। ভাবনা কি?"
হাসে দীপ্ত," কবে যে বিয়েটা হবে? মা বলছিল সেদিন।''
দুষ্টু গুনগুন করে,'এমনি করে যায় যদি দিন যাকনা।'
হাত মুঠো করে দীপ্ত,"হুঁ মাঝে মাঝে তব দেখা পাই করেই জীবন কাটবে।"
-" ভালোই তো তাহলেই মিঠেভাব থাকবে। নাহলে দিদির মত ঝগড়া হবে।"
হঠাৎই ফোন বেজে ওঠে.." নাম করতেই দিদি,এখন ভিডিও কল কেন?"
-" আমাদের ওপর নজর রাখছে মনে হয়। বোনকে একা রেখে ভরসা পাচ্ছেনা।"
ফোন ধরে দুষ্টু পাহাড়ের মেঘ কুয়াশায় ঝলমল করে ওঠে মিষ্টির মুখটা.." বল তো আমি কোথায়?"
-" দিদিইইই তুই দার্জিলিংয়ে! কাল মাঝ রাতে যখন হ্যাপি বার্থডে করলাম তখন তো বললি না?"
-" সারপ্রাইজ শালী জী। শুধু তুমি হনিমুন করবে তা হয় নাকি? তাই আমরাও এসেছি। ফেরার সময় শিলিগুড়ি আর কালচিনি হয়ে ফিরবো। একদম ঝোড়ো সফর।"
দার্জিলিং এক নিমেষে ওদের দুজনকে নিয়ে যায় অতীতে। দীপ্তর মনে পড়ে দুষ্টুর সাথে প্রথম দেখা হয়ে যাওয়া পাহাড়ের বাঁকে। দুষ্টুর মনে পড়ে সেই এলোমেলো ভীতু দীপ্তকে যে দুষ্টুকে অ্যাভয়েড করতে চেয়েছিলো। ধরা দেয়নি বাবাকেও।
হায়দ্রাবাদ আর দার্জিলিং হাত মেলায় মনের সুখে। দিদিকে কি সুন্দর লাগছে দেখতে, নতুন পোশাকে ঝলমল করছে ওরা। সত্যিই জোজোদা দিদির খুব খেয়াল রাখে। ফোনটা কেটে একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায় দুষ্টু।
-" কি ভাবছো? চোখদুটো এমন আনমনা কেন?"
-" দিদির কথা ভাবছি,আমারও মন উড়ে গেল দার্জিলিংয়ে। সেই প্রথম দেখার কথা খুব মনে হল।
-" ভাগ্যিস দেখা হয়েছিল! না হলে হয়ত কোনদিন নিজেকে খুঁজেই পেতাম না।"
দীপ্তকে আরও বেশি জড়ায় দুষ্টু,ওর আড়ষ্টতা কাটিয়ে দিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায় প্রেমে। মন ভালো করা সকাল বিকেলগুলো ছটফটিয়ে চলে যায় দেখতে দেখতে।
দুটো মন কাছাকাছি আসার সুযোগ পেল নিভৃতে আর একান্তে। দুষ্টুর কেজো মনে লাগল আলসেমির দখিনা বাতাস।
দীপ্তর মনটা একটু খারাপ লাগে দুষ্টুর চলে যাওয়ার দিন গুটিসুটি মেরে এগিয়ে আসছে। অবশ্য ট্রেনিংয়ের ফাঁকে ওরও অবকাশ হয়না পুরোপুরি সময় দুষ্টুকে দেবার। তবুও তো দুষ্টু ছিল কোথাও একটা কাছাকাছি। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যেত ওকে,আলতো আদরে একটু বাড়তি কথায় ভেসে যেত দুজনে। সময় যে কখন কেটে যেত এভাবেই।
***********************
স্বপ্নের মত কয়েকটা দিন কাটিয়ে মিষ্টিরও ফেরার সময় হয় ছোট্ট বাসায় আবার। কালচিনির চা বাগান আর মা বাবার আদরের মিঠে আস্বাদে একটু ঝাপসা হয় চোখের কোণ। অনু রবীনও ঐ একটা দিন দু চোখ ভরে দেখে মেয়ের মুখের হাসিটা। স্কুলের অনেক কাজের মাঝেও রবীনের মনে হয় ভালো থাক ওরা। সেই ছোট্টবেলার দুই রাজকন্যার জীবন ভরে থাক সুখে আর শান্তিতে।
-" মা কতদিন বাদে এলাম,বোনটা আবার নেই এখন। ও থাকলে ভালো হত।"
ওদিক থেকে দুষ্টুরও মনে হয় কত মজা হচ্ছে বাড়িতে। হলই বা একটা দিন তবুও সবাই মিলে এক হওয়া আবার আগের মত করে।
দীপ্ত বোঝায়," আর তো কয়েকটা মাস,তারপর সবাই থাকবো একসাথেই কাছাকাছি।"
অনেকদিন বাদে ছেলে বৌমা আসাতে ওদের শিলিগুড়ির বাড়িও জমজমাট হয়ে ওঠে। মিষ্টিকে শাশুড়িদের কাছে রেখে জোজো ব্যস্ত হয়ে যায় যে কাজগুলো নিয়ে এসেছে সেগুলো সারতে।
দার্জিলিংয়ের মনকাড়া ছবিগুলো মিষ্টিকে বারবার নিয়ে যায় ঐ দুটো দিনে। সত্যিই ভীষণ ভালো কেটেছে ঐ দুটো দিন। আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়ে জোজো হয়ত পূরণ করতে চেয়েছে সব শূন্যস্থান এভাবেই। কানে কানে ফিসফিস করে বলেছে," আর বেশি দেরী করবো না। এবার কেউ কি আসবে আমাদের মাঝে? যদি তুমি বল।"
-" আগে দুষ্টুর বিয়ে হোক খুব আনন্দ করি তারপর।"
জোজোর হাসিতে হোটেলের ঘর ভরেছিল," তারপর কি একসাথে দুইবোনের খবর আসবে? মানে বিয়ের মতই।"
জোজোর মুখে হাত রেখেছিল মিষ্টি আদরে।
নির্বাচনের সময় এগিয়ে আসছে,তার আগেই কিছু খবর আগাম পায় জোজো। ওর মুখটা গম্ভীর হয় দেখে। এই এলাকাটায় কাজ করতে হয় দুষ্টুকে সেটা দেখলো। মেয়েটা সব সামলে নিশ্চয় ঠিক থাকবে আশা করা যায়। খবরটা ওকে দিতে হবে। মাঝেমধ্যে ভাবলে একটু অসহায় লাগে ওর এত বেশি পড়াশোনা করেও আইএএস আর আইপিএস দের মাথার ওপরে ছড়ি ঘোরায় সেই সমাজের মাথারা। সত্যিই কি পড়াশোনার প্রকৃত মূল্যায়ন হয়?
*********************
কয়েকটা দিন কাটিয়ে আজ আবার উড়োজাহাজের পথটুকু একলা কাটিয়ে কাজের জায়গায় ফেরা দুষ্টুর। আদরে আব্দারে দীপ্তর বুকে মাথা রাখে দুষ্টু," তাড়াতাড়ি সব ভালোভাবে শেষ করে চলে এস।"
-" আবার কবে আসবে?"
দুষ্টুর সেই গানটা গাইতে ইচ্ছে করে আসবো আরেকদিন আজ যাই।
হাত নেড়ে এয়ারপোর্টে ঢোকে দুষ্টু। মনটা একটু ভারী হলেও প্রকাশ করেনা।
আজ আর তেমন ভালো লাগেনা ফ্লাইটে বসে।আসার দিনের সেই উৎসাহটা আজ আর নেই।
বেশ কিছুটা সময় কেটে যায় এভাবেই। বেশ অনেকটা সময় পরে মাটি ছোঁয় আকাশযান। মাটিতে পৌঁছেই ফোনটা অন করে দুষ্টু।জোজোদার মেসেজে চোখটা আটকে যায় হঠাৎই, খবরটা পেয়ে মনটা ভারী হয়ে ওঠে দুষ্টুর।
এতদিন ধরে চেষ্টা করে আইএএস পরীক্ষায় র্যাঙ্ক করা। স্বপ্নকে মুঠোয় ধরা অনেক কষ্টে। এখনও যুদ্ধ চলছে জীবনে। আর দীপ্ত,সে তো এখনও ভবিষ্যতের দিনগুলো ভালো হবে বলে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করছে। কম তো লড়াই করেনি ছেলেটা জীবনে। হয়ত এতদিনে একটু স্বস্তি পেয়েছে,তবে ছেলেটার জীবনে কি কখনও শান্তি আসবে না? কেমন যেন একটা দীর্ঘশ্বাস বাইরে বেরিয়ে এসে হাওয়াকে আরো ভারী করে। দুষ্টুর কাজের জায়গা থেকে এবার ভোটে দাঁড়াচ্ছে রূপসী বিশ্বাস। জোজোদা মেসেজ করেছে। অদ্ভুতভাবে একটা শুভদিনে ঐ অশুভ মেয়েটাকে চিনেছিল ওরা। সেদিনের ঐ ঘটনা এখনও চোখ বুজলে দেখতে পায় দুষ্টু। হয়ত বা দীপ্তর মনের আনাচে কানাচে আজও সেই দুঃস্বপ্নের দিনগুলো চুপিসারে বাসা বেঁধে আছে।
গাড়িতে উঠতে উঠতে বারবারই মনটা তেতো হয়ে যায় দুষ্টুর। এত পড়াশোনা শিখেও হয়ত একদিন ঐ মেয়েটাকেই ম্যাডাম ম্যাডাম বলে ডাকতে হবে ওকে। কথায় কথায় ধমকি বা হুমকি সহ্য করতে হবে।
হয়ত বা ট্রান্সফারও হয়ে যাবে কোন প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আর মা বাবার কাছে উইকএন্ডে চলে আসা হবেনা। হয়ত বা দীপ্তর সঙ্গেও একসাথে থাকা হবেনা।
আচ্ছা ওদের বিয়েটা হবে তো? কত স্বপ্ন উড়ে উড়ে আসে দুষ্টুর উদাসী মনে কাজের ফাঁকে। লাল পলাশ হাতছানি দিয়ে ডাকে। পলাশের পাপড়ি সাজায় থরে থরে কত স্বপ্ন। সে গুলোর কি হবে?
ফোনটা বেজে ওঠে নিজের ছন্দে,দীপ্ত ফোন করেছে। এপার থেকে একরাশ দুঃশ্চিন্তা মাখা ওর গলাটা হ্যালো বলে ওঠে।
-" শুধুই টেক্সট? ফোন করলে না কেন? তুমি ঠিক আছো তো? মানে গাড়ি এসেছে? তুমি কি শিলিগুড়িতে মিষ্টির সাথে দেখা করে যাবে?"
এক ঝাঁক প্রশ্ন ছুটে আসে ওপার থেকে।
দুষ্টু নিজের ক্লান্ত মনটাকে একটু আলতো প্রসাধনের প্রলেপ দেয় একমুঠো হাসি মাখিয়ে।
দীপ্ত ভেসে যায় ওর হাসিতে সবটাই যেন স্বপ্ন মনে হয়। কখন যে এল আর কখন ফিরে গেল বুঝতেই পারেনা।
-" ওরে বাবা কত প্রশ্ন। তুমি হয়ত ব্যস্ত তাই ফোন করিনি। ফ্রী হলেই করতাম। গাড়ি এসেছে,আমি উঠে বসেছি তাতে। আবার কয়েকটা দিন বাদে পরিচিত মাটির গন্ধ। এখানে অবশ্য কোন নিজাম নেই,তাই একটু ফাঁকা লাগছে। তবে মায়ের কাছে ঘুরে একদম ফিরবো নিজের আস্তানায়। অনেকদিন মাকে বাবাকে দেখিনা। তাছাড়া তোমার উপহারের ঝুলিটাও পৌঁছতে হবে। আমি ঠিক আছি একদম,শুধু বুকে একটা ব্যথা। অবশ্য ওটা কোন রোগ নয় এই কিছু না বলতে পারার যন্ত্রণা। দিদিরা চলে গেছে।দেখা হলনা। যাক পরে হবে দেখা কখনও।"
দীপ্ত বেশি কথা বলতে পারে না,দুষ্টুর মত খিলখিলিয়ে হাসতে পারে না। তবে শুধু অনুভব করল আর ভরে গেল।
দীপ্তকে ছেড়ে আবার ভাবনায় ডুবে যায় দুষ্টু,জানলা দিয়ে চোখটা বাইরে যায় উত্তরের আকাশেও বসন্তের ছোঁয়া। পাতা ঝরানো গাছগুলো আবার সেজেছে সবুজের ছোঁয়ায়। কচিপাতা দুলছে হাওয়ায়। শিমুলের কাঁটাওয়ালা রুক্ষ ডালে আজ লাল কুসুমের আনাগোনা বলে দেয় বসন্ত এসেছে। দুষ্টুর শরীর মনও ভরেছে বসন্তের আদরে আর দীপ্তর ভালোবাসার নরম চাদরে।
বাড়িতে পৌঁছে মাকে জড়িয়ে ধরে দুষ্টু নরম আদরে," এই দেখ,যেভাবে পাঠিয়েছিলে সেভাবেই ফেরত এসেছি। এবার নিশ্চিন্ত তো। উঃ বাবা কত চিন্তা করে আমার মা। সারাদিন শুধু মেয়েদের চিন্তা।"
একটু লজ্জা পেয়ে ঠোঁট ফোলায় অনু," মা হলে বুঝবি কত জ্বালা মা হওয়ার।"
" তোমার কোন জ্বালা নেই মা আমরা তোমার লক্ষ্মী মেয়ে বাবাও লক্ষ্মী ছেলে।"
" ঠিক বলেছিস দুষ্টু,আমরা সবাই লক্ষ্মী এমন কি আমাদের ছেলে দুটোও।"
" বাবা মোটেও নয়,তোমার বড় জামাইটি কিন্তু একদম মোটেই শান্ত নয়। আরেকজনের কথা এখনই বলছি না।"
অনেকদিন বাদে মায়ের হাতের রান্না চেটেপুটে খেলেও চিন্তাগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারলো না দুষ্টু। অথচ ভালো লাগছে না কারও সাথে শেয়ার না করলে। আচ্ছা বাবাকে কি বলবে?
***********************
কয়েকদিন বাদে অফিসে এসেছে জোজো,অনেকটা কাজ করে নিয়ে এলেও এদিকে জমেছে বেশ কিছুই। ঢুকতেই আওয়াজ শুনলো দার্জিলিংয়ের বাতাস একটু দিয়ে যা ভাই। কলকাতায় যা গরম পড়েছে। আহা কদিনেই বেশ সুন্দর লাগছে।
ফাইল নিয়ে ঢুকছিল উত্তমা,ওদের টুকরো কথাগুলো কাঁচ হয়ে বিঁধলো কানে। টেরিয়ে একবার দেখল ওদিকে। ভুল বলেনি ওরা,হলুদ টি শার্টে আর আসমান ছোঁয়া নীলে আরও বেশি হ্যান্ডসাম লাগছে উত্তীয়কে। বৌয়ের আদরে গদগদ হয়ে ফিরে এল আর কি। ভেতর থেকে কেউ যেন বলে ওঠে এত সহজে হাল ছাড়লে হবে? ভালো জিনিসের জন্য একটু অপেক্ষা করতে হয়। সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হবে।
এর মধ্যেই হঠাৎই একদিন দেখা হয়ে গেছিল সোম স্যারের সাথে না বলতেই ওকে লিফ্ট দিলেন। মাঝবয়সী লোকগুলো একটু এমনি হয়। একদম সামনের দরজা খুলে পাশেই বসতে দিলেন খুব প্রশংসা করলেন ওর ড্রেস সেন্সের। ড্রপ করার সময় ওর লিপস্টিকের তারিফও করলেন। তবে এমন প্রশংসা তো কতই শোনে ও। শুধু একজনই কিছু বললো না।
ওদিকে না গিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে উত্তমা। আপাততঃ ওকে সোম স্যারের নজরে আসতে হবে। তাহলে ও যা ভাবছে তাই হবে। মানে উত্তীয়র সাথে বাইরের ট্রিপে ও যেতে পারবে।
মিষ্টির গায়ে এখনও জড়িয়ে আছে জোজোর আফটার শেভের প্রিয় গন্ধটা। বসন্ত বোধহয় একটু বেশিই আবেগী করে দেয় মানুষকে। তাই দার্জিলিংয়ের রেশ রয়ে গেছে এখনও। প্রতিদিনের আদরের পারদ ও বেড়েছে।
জোজোর মনেও ঘুরেফিরে আসে একটা নাম রূপসী বিশ্বাস।মেয়েটাকে যেমন দেখেছিল মানে দেখলই বা আর কতটুকু তার থেকে এখন একদম আলাদা লুক। পলিশ করা মুখ,সোজা চুল,পিঠের প্রায় অনেকটা দেখা যায় এমন গভীর গলার ব্লাউজ। দীপ্তর কাছে এই নামটা বেশ কয়েকবার শুনেছে।
খাওয়াদাওয়ার পর বাবার কাছে বসে পেপারে চোখ রাখে দুষ্টু। তারপর টুকটাক কথার ফাঁকে রূপসীর কথাটা বলে।
বাবার মুখে চিন্তার রেখাগুলো একবার ওঠানামা করেই স্থির হয়ে যায়," তোর এত চিন্তা কিসের শুনি? ওরা রাজনীতি করবে আর তুই কাজ করবি।"
" কিন্তু বাবা কাজের নীতির ওপর যখন রাজনীতি এসে ছড়ি ঘোরাবে তখন তো আমি সইতেই পারব না। অসম্মানের চেয়ে সরে যাওয়া ভাল।"
" এত ভাবিসনা দুষ্টু। সব ঠিক হয়ে। আমার মা তো সাক্ষাৎ মুশকিল আসান।"
" না বাবা আমি দীপ্তর কথা ভাবছি। ওর জীবনের কালো দিনগুলো যেন ফিরে না আসে। মানতে পারবে না ও। হয়ত বা ভেঙে পড়বে।"
**************************
মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। রূপসীর ভোটে দাঁড়ানোর খবর পেয়েছে দীপ্তও। মন খারাপ হয়েছিল প্রকাশ করেনি। শুধু বলেছিল অত ভেবোনা সব ঠিক হয়ে যাবে। আর ওর মনে উঁকি দিয়েছিল শোনা কিছু ঘটনার চিত্র কখনও আইএএস আর আইপিএস দের হাত জোড় করে দাঁড়াতেও হয় রাজনৈতিক নেতাদের
সামনে। শিক্ষা মাথা নিচু করে ক্ষমতার কাছে।
দুষ্টু সেদিন কাজে ব্যস্ত হঠাৎ করেই বাইরে একটু শোরগোল শোনে তারমধ্যেই বার্তা পায় বাইরে বেশ জোরে কারা যেন অনেক কিছু বলতে বলতে যাচ্ছে। মোদ্দা কথা হল ... উনি এবার আমাদের দলের হয়ে দাঁড়িয়েছেন। একটু দেখবেন মানে ভোটটা উনাকেই দেবেন। আর তার সাথে জয়জয়াকার শোনা গেল রূপসী বিশ্বাসের।
আবার একটা তেতো স্বাদ গিলে ফেলে কাজে মন দিল দুষ্টু। চারদিকে পোস্টার আর দেওয়াল লেখনের ছড়াছড়ি।
অফিসের রাজীববাবু বললেন হঠাৎই সেদিন,"ম্যাডাম বুঝলেন ঐ যে ওপরে ওঠার জন্য সিঁড়ি লাগে। নাহলে তো আমি আর সুধীর ও দাঁড়াতে পারতাম ভোটে। আমাদের পাড়াতেই তো থাকে।"
দুষ্টু একটা ফাইলের খোঁজ করে তখনকার মত চুপ করাতে চাইলেও চলে যেতে যেতে শুনতে পায়," আরে শিশির বলে একটা ছেলেকে বিয়ে করেছিল তো থাকলো কদিন? এখন তো বাড়ির সামনে সবসময় গাড়ি একবার অমুক বাবু তো তমুক বাবু। আসলে ওরা তো আগে অন্য পার্টি করত। তবে গিরগিটির রঙ বদলাতে তো আর সময় লাগেনা।"
কিছু করার নেই, এখন ভোটের আগে কত মানুষের কত অমূল্য সময় কেটে যায় এইসব মুখরোচক আলোচনা শুনে আর দেখে।
*******************
সামনের পাতা ঝরা বট গাছটার মত নিজেকে আজকাল বৃদ্ধ ডানা ভাঙা লাগে শিশিরের। সাইকেলটা রেখে গলি দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই পাশের ঘরে হাসাহাসির শব্দ পায়। জুতোটা খুলে হাওয়াই চটি গলিয়ে চলে যায় কলঘরে। সাবান আর শ্যাম্পুর গন্ধে ম ম করছে কলঘর। তার সাথে মিশে আছে রূপসীর গায়ের গন্ধ। নাকটা আটকে আসে শিশিরের ভেতর থেকে বন্ধ হয়ে আসে শ্বাস। আজকাল এই গন্ধগুলো অসহ্য মনে হয় ওর। অথচ একটা সময় সস্তার সেন্ট আর পাউডার মেখে যখন রূপসী পাশে বসত তখন পুরো লাট্টু হয়ে যেত শিশির।
রূপসীর শ্যামলা রঙ,ছিপছিপে শরীর আর সাজানো দাঁতের হাসিতে ঘায়েল হয়েছিল শিশির। ওর থেকে জুনিয়র ছিল। কিন্তু কয়েকদিন যেতেই বুঝে গিয়েছিল ওরা এই মেয়ের ক্ষমতা আছে,এক কাপ চায়ে চুমুক দিয়ে থাকতে পারে অনেক ঘন্টা। শাড়ির ফাঁক দিয়ে উঁকি মারা নাভিদেশ মাকড়শার জালের মত আটকাতে পারে যে কোন পতঙ্গকে। ওর চোখ আর হাসি হঠাৎই রহস্যের কুয়াশায় ঢাকতে পারে যে কোন সাদামাটা নীল মেঘকে।
" আমি আছি দাদা, মনে হয় সি আর হবার ভোটটা আমিই পাব। রূপসী বিশ্বাস সব পারে।"
সব পারা রূপসীকে নিজের কাজে লাগিয়েছিল শিশির। কখনও অধ্যাপক ঘেরাও,কলেজে স্ট্রাইক আবার কখনও দীপ্তর মত ব্রিলিয়ান্ট ছেলের ব্রেনটাকে নিয়ে লোফালুফি খেলতে নিজের খেয়ালে।
রূপসী প্রথমে সি আর তারপর জিএস আর ধীরে ধীরে শিশিরকে ছাড়িয়ে এই জায়গায়।
এক সময় যে রূপসী হঠাৎই একদিন শিশিরের ঘরে ঢুকে ওকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল আজ ওর ঘরে শিশির ঢুকতে গেলে ওকে রীতিমত ভাগিয়ে দেয়।
" এই যাও তো এখন মাঝরাতে স্বামীগিরি ফলাতে এসো না। পার্টি করেন উনি! ভিখিরি পার্টি,এখনও সাইকেলে চেপে ঝান্ডা নিয়ে ঘুরে বেড়ান। যাও যাও পাশের ঘরে ঘুমোও। আজই সবে বডি স্পা করে এলাম। আমার শরীরের এখন অনেক দাম। "
" মুখ সামলে কথা বল রূপসী এখনও তুমি আমার বৌ মনে রেখ। মনে আমার সব আছে। সেদিনের সেই মেয়েটা মাঝে এসে না পড়লে তোমাকে আমি বিয়ে করতাম নাকি?"
" কিন্তু আমার সাথেই তো বিয়ে ছিল সেদিন তোমার।"
এক ঝলক আবার দীপ্তকে মনে পড়ে রূপসীর। যেই রূপসীকে ছোঁয়ার সবাই আনচান করত। তাকে পাত্তাই দেয়নি দীপ্ত।অথচ ওর সুগঠিত চেহারা আর বুদ্ধি এখনও মনে আছে বেশ রূপসীর। আর মেয়েটাকে ও দেখে নেবে চেয়ারে একবার বসলে।
" -আমাকে হাতের পুতুল করেছ তুমি। কত কাজে লাগিয়েছ আমাকে মনে পড়ে?"
-"তার বিনিময়ে ফ্রী করে দিয়েছিলাম কলেজে। বইপত্র কিছুই কিনতে হয়নি। কলেজ না করে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করেই ভালো নম্বর পেয়ে পাশ করেছো। মনে পড়ে?"
-" হ্যাঁ মনে পড়ে। আর নিয়েছ কতটা সেটা মনে পড়ে?"
শিশির অনর্গল বকে যায় ওর মুখ থেকে মদের গন্ধ ভেসে আসে। ড্রয়ারে রাখা বোতলটা থেকে কিছুটা পানীয় গলায় ঢেলে চিৎকার করতে করতে শিশিরকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় রূপসী। ফুঁসতে ফুঁসতে বেরোয় শিশির -"তোর খুব দেমাক বেড়েছে। যার হাত ধরে উঠেছিস তার মাথায় পা রেখেছিস! "
-"বেশ করেছি,যা এখান থেকে।"
এক মুহূর্তে মুখোশে ঢাকা মুখ থেকে বেরিয়ে আসে অশ্রাব্য গালাগাল। অসুখী দাম্পত্যের কর্কশতা ছিন্নভিন্ন করে রাতের নীরবতা। রূপসী ঠান্ডা ঘরে নিজের মত শুয়ে পড়ে। শিশির ওদের পুরোনো টিনের ঘরে। পাশের ঘরে নিশ্বাস ফেলেন শিশিরের মা।
-"ঠাকুর মুক্তি দাও। কি আছে ওদের কপালে কে জানে?"
*******************
অফিস থেকে এসে জোজো কথাটা বলাতে মিষ্টির মনটা খারাপ হয়ে যায়। একা থাকতে সত্যি ভালো লাগেনা। বললেই শাশুড়ি আর মা যে কেউ চলে আসবে। তবুও কি দরকার বিরক্ত করার?
ইশ্ ভালো লাগেনা,"তুমি আবার যাবে বাইরে?"
- " আমারও কি যেতে ইচ্ছে করছে? কিন্তু উপায় নেই।"
সোমদার কাছে শুনে জোজোরও ঠিক ভালো লাগেনি কিন্তু কিছু করার নেই।
সোমদা বললেন," উত্তমার মধ্যে ট্যালেন্ট আছূ। ভালো কথা বলতে পারে। দেখতেও সুন্দরী স্মার্ট। ওকে একটু ট্রেনিং দিয়ে নাও দেখবে দারুণ কাজ করবে। আমার অত সময় নেই কাজ শেখানোর মত। তাই একটা দুটো বাইরের কাজ একসাথে করা,ইন্টারভিউ নেওয়া এইসব করলেই বুঝে যাবে ব্যাপার গুলো ভালো করে।"
কেন যেন তবুও মিষ্টির কাছে বলতে পারেনা পুরোটা জোজো।
- " কবে যাচ্ছ শুনি?"
-" এখন দেরি আছে কয়েকদিন। মাকে বলব নাহলে এসে এক সপ্তাহ থেকে যাবে। আমি জানি খুব প্রবলেম হবে। আর কয়েকটা দিন ড্রাইভার নিয়ে যাবে তোমাকে।"
মিষ্টির মনটা কেন যেন ভালো লাগছে না কদিন ধরেই। দুষ্টুর কাছে শুনেছে রূপসীর কথা। ঐ মেয়েটার জন্য একটা বড় বিপদ হচ্ছিলো সেদিন। কোনদিন কি ওরা ভালো থাকতে পারবে না?
দুষ্টুর গাড়িটা সেদিন মিছিলের সামনে পড়ে, একটু অসহ্য লাগলেও ও জানে ওর গাড়িকে ওরা সাইড দিতে বাধ্য। তবে অঞ্চলের মান্যগণ্য একজন যখন এসে রীতিমত অফিসে হাজির হল তখন ওর মনটা সত্যি কেন যেন খারাপ হয়ে গেল। কিছুই না ভোট সংক্রান্ত একগাদা নির্দেশাবলী জানাতে আসা। যদিও ওর এখন প্রচুর কাজ,সরকারী প্রতিটা নির্দেশ এই কদিন একদম খুঁটিনাটি দেখতে হচ্ছে। দায়িত্ব বাড়ছে তাতে ক্ষতি নেই,শুধু আত্মসম্মান বিকোনোর কথা মনে হলেই মনটা মেঘ কুয়াশায় ঢেকে যায়।
হায়দ্রাবাদে বসে দীপ্ত বুঝতে পারে সবটা। আজকাল পাহাড়ী ঝর্ণার মত দুষ্টুকে আর খুঁজে পায়না দীপ্ত। একগাদা কাজের বোঝায় ভারাক্রান্ত দুষ্টু। পদমর্যাদা শুধু পদই দেয়না মোকাবিলা করতে হয় সেখানে অনেক বিপদও। হলঘরে বসে টিভি দেখতে গিয়ে টিভিটা বন্ধ করে দেয় দীপ্ত। মোবাইল স্ক্রল করে ওর আর দুষ্টুর ছবি দেখে। মনটা এক নিমেষে ভালো হয়ে যায়।
আজ বাবার সঙ্গে অনেকটা সময় কথা বললো ওরা দুই বোন। বাবার সাথে কথা বললে মনটা সত্যিই ভালো হয়ে যায়। চলার পথে বাবার পজেটিভ চিন্তা সবসময় ওদের সামলে রেখেছে। বাবা সবসময় বলে আজও বললো সব ঠিক হয়ে যাবে,সব পারবি সামলাতে,আমার রাজকন্যারা সেরা,তারা সব পারে।
**********************
শিশিরকে পার্টি অফিসে ডেকে পাঠায় অখিলদা।
-" আরে এতদিন এই পার্টিতে আছো এটা কি হচ্ছে? তোমার বৌ যা শুরু করেছে আমাদের ক্যান্ডিডেট তো এবার মনে হচ্ছে কোন ভোটই পাবেনা। দল বদল করে ফেললো এক রাতেই। কাজটা কি ভালো হল? কিছু বল ওকে।"
চুপ করে থাকে শিশির,আজকাল জীবনটা ভুলে ভরা লাগে। প্রতিদিন ঝামেলা,আজকাল ওকে গুন্ডা দিয়ে পেটানোর হুমকিও দেয় রূপসী। অথচ এই রূপসীকে ও তৈরি করেছিলো নিজের হাতে।
-" বলেছিলাম,শোনেনি। জানোই তো ওর স্বভাবটা এমনি বরাবর। যেখানে জল উঁচু সেখানেই যায় ও। আর ভালো লাগেনা আমার।"
-" বাড়ির বৌ বলছ ভালো লাগেনা। তা তুমিও যাচ্ছ নাকি ওখানে?"
-" হ্যাঁ প্রথমে বলেছিল ও আমি যাইনি। এখন তাই উঠতে বসতে অপমান করে। জানোই তো সেই কলেজ লাইফ থেকে এই পার্টিতে আছি। আদর্শ বলে তো একটা কথা আছে।"
-" আদর্শ? ওসব আবার আছে নাকি আজকাল। নিজেকে প্রমাণ করার জায়গা তো এখন একটাই। শোন কাল আমাদের ক্যান্ডিডেটের সাথে ঝামেলা হয়েছে ওদের। ঐ পাড়ার পার্টি অফিস ভাঙচোর করে তালা দিয়েছে আমরা কিন্তু ছাড়বো না। তখন বলতে এস না আমার বৌ হয়। আগেই তাই সাবধান করছি।
শিশির বলে," আমাকে ওসব বোলোনা কিছু কাজ থাকলে বলো। আর সামনের সপ্তাহে সমাবেশ আছে তার জন্য যা বলেছো সব করছি। মোটামুটি লোক জমা করতে হবেনা প্রচুর।"
অখিলদাকে একটু খুশি দেখে শিশির,যদি ওরা জেতে তবে হয়ত এবার ওর একটা হিল্লে হয়ে যাবে।
দেখা যাক সময় কি বলে?
*********************
শপিং মলে গিয়ে জামাকাপড় হাতে চেঞ্জিং রুমের দিকে যায় উত্তমা। চার পাঁচদিন লাগবে বলেছে সোম স্যার। কাজের ফাঁকে একটু ঘোরাফেরা করার সময় নিশ্চয় পাবে। উঃ ভীষণ আনন্দ হচ্ছে এই কয়েকটা দিন একদম নিজের করে পাবে উত্তীয়কে। মানে মাঝে ওর বৌ,অফিস কিছুই থাকবে না। কাজ থাকবে বাট সেটাও তো একসাথেই করবে।
আয়নায় নিজেকে মাপে উত্তমা,ও এখনও কতটা সুন্দর তা আয়না বলে দেয়। ওর ক্লিভেজ পুরো দেখা যাচ্ছে গেঞ্জিটা পরলে সাথের মিনি স্কার্ট টাও দারুণ। নিজেকে একটা চুমু দিল নিজেই। এমন পার্টনার পেতে ভাগ্য লাগে সত্যিই ম্যাদামারা ছিল ওর এক্স হাজবেন্ড। কাকে বিয়ে করেছিল বুঝলোই না কোনদিন। নিজেকে সামলায় উত্তমা না না আবার অতীতে কেন? ঐ লোকটাকে নিয়ে ভাবনা আর নয়। এখন ওর সামনে আছে একটা দারুণ সুযোগ সেটাকেই কাজে লাগাতে হবে। এই কদিন সোম স্যারের সাথে একটু সঙ্গ দিয়ে এই অফারটা পেয়ে গেছে। তাই পুরোটাই দারুণ করে এনজয় করতে চায় উত্তমা।
বাইরে ততক্ষণে জমছে উত্তমার অপছন্দের পোশাকের ভিড়। ক্লান্ত মেয়েটা একটা একটা করে বক্স থেকে তুলতে থাকে সেগুলো।
আজ খুশির প্রজাপতিরা ভিড় করেছে ওর মনের চারপাশে। কিছু উড়ে বসছে ওর খোলা বুকে উঁকি দেওয়া ট্যাটুতেও। নিজেকে সামলায় উত্তমা। মনে মনে কল্পনা করে উত্তীয়র মিষ্টি বাঙালী বৌটাকে, লম্বা চুল আর হাতে শাঁখা পলার ভিড়ে এখনও বন্দিত্বের ছাপ। নতুন বিয়ে হয়েছে অবশ্য, একদম গাইয়া ছাপোষা বাঙালী বৌ।
************************
হায়দ্রাবাদের ট্রেনিং কিছুদিনের মধ্যেই শেষ হবে দীপ্তর। কেন যেন বারবার দুষ্টুর কথা মনে হচ্ছে। ইচ্ছে করছে একদম সোজা চলে যায় ওর কাছে। মেয়েটা কেন যেন খুব চাপের মধ্যে আছে সবদিক দিয়ে।
যদি কিছুটা কমে চাপ ওকে দেখলে। হঠাৎই ওর চোখের সামনে ভেসে উঠলো রূপসীর নাম লেখা পোস্টারের ছবি। মনটা অস্থির হল,যে অতীত ভুলতে চেয়েছে সব সময় তা কেন আসে ঘুরে ফিরে? ওদিক থেকে দুষ্টু বকা দেয়, " একদম না, নিজের কাজ শেষ করো মন দিয়ে। বাবা তো আছে এদিকে। মা কদিন আমার কাছেই আছে এখন।"
রবীনের চাপ বেড়েছে অনেক,আজকাল সবদিক সামলাতে একটু অস্থির লাগে। তবুও সামলাতে হয়।
পর্দা ঠেলে ঘরে ঢোকেন প্রকাশবাবু, " স্যার আজ একটু তাড়াতাড়ি যাব। কিছু ব্যক্তিগত কাজ আছে।"
রবীন জানে কাজটা কি? কিন্তু কিছু বলতে পারেনা। বেশ অনেকটা ফান্ড এসেছে আঞ্চলিক কমিটির হাত দিয়েই। স্কুলের সাজগোজ চলছে। আর সেই কাজেই উনি চলে যান প্রায়ই। কত কিছু যে হজম করতে হয় এইভাবে। কিছু করার নেই।
জোজোর ব্যাগ গোছাতে গোছাতে নাকটা টানে মিষ্টি। সন্ধ্যে থেকেই চোখটা ছলছল করছে,খুব ঠাণ্ডা লেগেছে কদিন ধরেই। এখনও পাত্তা নেই তার,ফোন করে বলে দিয়েছে কি কি লাগবে। অবশ্য সবটাই জানে মিষ্টি তাই গুছিয়ে রাখছে।
অফিস থেকে ফিরে অবাক হয়ে যায় জোজো," কত কাজের হয়ে গেছে আমার বৌটা! সব রেডি? যাক আমি নিশ্চিন্ত। ইশ্ তোমার তো মুখটা বেশ লাল হয়েছে। ডঃ দেখাতেও গেলেনা,আমি খুব চিন্তায় থাকবো। ওষুধ খাও এক্ষুনি।"
" ও তুমি ভেবোনা,ঠিক হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি চলে এস। ভালো লাগেনা আমার।"
মিষ্টিকে ছাড়তে কি ওরও ভালো লাগে? কিন্তু কিছু করার নেই। টিকিট এখনও হাতে পায়নি। অবশ্য স্যার বলেছেন সকালে পৌঁছে দেবেন এয়ারপোর্টে সমস্যা নেই কোন। উত্তমা মেসেজ করেছে। উত্তর দেয়না জোজো। মিষ্টি ওষুধ খেয়ে ওর বুকের কাছে ঘুমোচ্ছে। এখন ফোনে থাকলে ওর ঘুমটা ভাঙবে। নিজের সাজানো সংসারে অশান্তির ছোঁয়া চায়না জোজো। উত্তমা আর অফিস এক পাশে থাক। অন্য দিকে থাক ওর এই ভালোবাসার একফালি ঘর।
আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ে জোজো। ভোরবেলা অ্যালার্ম বাজতেই অফ করে হাত বাড়িয়ে। চাদরে মুখ ঢেকে ঘুমোচ্ছে মিষ্টি। রেডি হয়ে ওকে ডাকবে। ততক্ষণে আবার মেসেজে চোখ রাখে জোজো। উত্তমাকে একটা উত্তর দিতে যায়।
সকালের রোদের ছিটে চোখকে জাগায় মিষ্টির চমকে উঠে পড়ে। কাল ওষুধ খেয়ে খুব ঘুমিয়ে পড়েছিলো। আজ তো জোজোর চলে যাওয়া। তাহলে কি?
জোজোকে বিছানায় না দেখতে পেয়ে আর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে ও চলে গেছে অনেক আগে। হয়ত মিষ্টির শরীর খারাপ তাই আর ওকে ডাকেনি। নিজের আর বরের ওপর খুব অভিমান হয় মিষ্টির। একবার ডেকেও গেলো না? ও এলে আর কথা বলবে না। ফোন সুইচ অফ করে রাখবে একদম।
দরজা দিয়ে বাইরে আসে মিষ্টি,ডাইনিং স্পেশে এসে জল খেয়ে আবার শোবে সেটাই ভাবে। হঠাৎই পাশের ঘরে চোখ পড়ে। একি ল্যাপটপ খোলা! এটা তো ওর সাথেই থাকে।
দরজা দিয়ে ভেতরে উঁকি মারতেই চোখে পড়ে সোফায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে ঘুমোচ্ছে জোজো।
হঠাৎই যেন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয় ওর। দুশ্চিন্তাও হয়। তাহলে কি ফ্লাইট মিস্ করলো নাকি? এখানে ঘুমিয়ে কেন? না ডেকে আর পারেনা তখন।
একটু চমকে উঠলেও পরক্ষণেই মিষ্টিকে জড়িয়ে ধরে সোফায় শুইয়ে দেয় জোজো।
-" এত চোখ ছলছল,সর্দি জ্বর এই সব দেখে কি আর যেতে ইচ্ছে করে নাকি? তাই আর গেলাম না।"
-" তোমার চাকরির কি হবে? এত ইমপর্টেন্ট কাজ,মিটিং সেইসব?"
-" যায় যাবে চাকরি,আগে আমার মিষ্টি তারপর সব। বলে দিয়েছি বৌয়ের জ্বর যাব না।"
এতদিনে কাজপাগল ছেলেটাকে ভালো চেনে মিষ্টি।বোঝে মজা করছে ও কোন কারণে যাওয়াটা ক্যানসেল হয়েছে। ভোররাতে উঠে কাজ করতে করতে ঘুমিয়েছে এখানে।
ভোরবেলায় এয়ারপোর্টে যাবার পিক আপ ছিল। সারারাত প্রায় ঘুম হয়নি উত্তমার। ভোরবেলাতেও একদম ঝকঝকে করে নিজেকে সাজিয়েছে যত্নে। বাইরে হর্নের আওয়াজে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নামে। নিশ্চয় উত্তীয় আগে উঠেছে, তেমনি কথা ছিলো।
গাড়ির দরজা খুলে যায় আবছা অন্ধকারে সোম স্যারকে দেখতে পায় উত্তমা। ভরাট গলায় ভেসে আসে," গুডমর্ণিং ইয়ঙ্গ লেডি। প্লিজ কাম চলে এস তাড়াতাড়ি। লাগেজ বাহাদুর তুলে দেবে।"
এখন কিছু বলা সাজেনা তবুও গাড়িতে উঠে উত্তমা বলে," স্যার আপনি? মানে উত্তীয়দার তো যাওয়ার কথা ছিল। সকালে আমাকে মেসেজও করেছে একটু বাদে বেরোবে বলে।"
বস সুলভ হাসিতে ভরে ওঠে সোমের মুখ," হোয়াই? আর ইউ নট এনজয়িং মাই কম্পানী?"
কিছু বলতে পারেনা উত্তমা। ওর চুপসে যাওয়া মুখটা অনেক কিছু বলে দেয় সোমকে। মনে পড়ে যায় নিজের ঘর ভাঙার গল্পটা। সামনে ভেসে ওঠে মিষ্টির মুখটা,প্রথমেই প্রণাম করে দাদা বলে ডেকেছিল সোমকে। রবীন স্যার তখন বাঁকুড়ায় আর সোমের তখন ক্লাশ এইট। এক কথায় মনে পড়ে গেছিল অঙ্ক স্যারকে। সম্পর্কে তো বোনই হয় মিষ্টি। শিক্ষকের শিক্ষার যত্নে বেড়ে ওঠা মহীরুহ কত জায়গায় ছড়িয়ে থাকে এভাবেই।
ঠোঁটে সিগারেট চেপে সোম বলে," দেখলাম তোমার প্রথম বাইরের ট্রিপ। আর আমারও একটা আর্জেন্ট কাজ পড়লো দিল্লীতে।কাল অনেক রাতে জানলাম। তাই এবার সবটা সামলাবে একা তুমি। পেছনে আছি আমি। দেখি কেমন করছো।"
ট্রলিতে সাজানো পোশাক আর লিপস্টিকের সারি অসহ্য লাগে হঠাৎই উত্তমার। সোম ওর হাতে একটু চাপ দেয় -" ডোন্ট বি নার্ভাস,আমি আরও ভালো শেখাতে পারবো তোমায়। উত্তীয় তো এই সেদিনের ছেলে। অভিজ্ঞতার একটা দাম তো আছেই।"
কথাটার অর্থ হয়ত অনেকটা গভীর,বুঝতে পারে উত্তমা কিন্তু কিছু করার নেই।
*********************
Comments
Post a Comment