খোকনের মুখে কথাটা শুনে মাথাটা গরম হয়ে যায় অখিলের এর মধ্যেই ফোন এসেছে উপর মহল থেকে।
ফোনে অনেক কথা শুনতে হল ওপাশ থেকে কর্কশ গলায় বলে উঠলো বড়দা..." ওখানে বসে কি করছিস শুনি? আরে দলের একটা একটা করে লোক ওদের দলে নাম লেখাচ্ছে। আর মিডিয়ায় বলছে অনেক কিছু জানি। পুরো দলটাই দুর্নীতি ভরা তাই বেরিয়ে এলাম ওখান থেকে। সব কটা বদমাশ, এবার আমাদের সব গোপন কথা কানাকানি হবে। মিডিয়া কি ছাড়বে? সব কথা আদায় করে ছাড়বে পেটে চাপ দিয়ে।"
শিশির যে এভাবে দল বদলে ফেলবে ওরা স্বপ্নেও ভাবেনি কখনও। একদম ছাত্রাবস্থা থেকে পার্টি করে শিশির। ওদের দলের একনিষ্ঠ কর্মী ছিল বহুদিন ধরে। শিশিরের হাত ধরে কত তরুণ ছাত্রছাত্রী এসেছে ওদের দলে। এগিয়ে দিয়েছে দলকে একটা নতুন দিশার দিকে। সেই শিশির যাকে হাতে করে গড়েছে একটা সময় দল সে এই কাজ করাতে চারদিকে একটা অস্থির অবস্থা সৃষ্টি হয়। নিজেকে সামলাতে পারেনা অখিল মুখ থেকে কর্কশ গালাগালি বেরিয়ে আসে," শ্লা সেই বেইমানি করল। যত নষ্টের গোড়া ঐ রূপসী বিশ্বাস। ছিঃ ছিঃ একদম স্পাইনলেশ একটা।"
-" দাদা এখনই যা বলে বেড়াচ্ছে চারদিকে আমাদের আর আমাদের দলের সম্বন্ধে। তোমাকেও ফাঁসাবে চিন্তা নেই। ঐ যে সেবার চিটিংয়ের কেসটা হলো না? সবাই বলছে তুমি নাকি সব টাকা পয়সা এদিক ওদিক করেছ। সাথে আবার অন্য অনেকে আছে। শিশির বারবার বলছে ও সব জানে।"
-" শোন ফাঁসাতে আমিও জানি। ঐ শিশির নিজেকে কি ভাবে? ও যা বলবে পাবলিক খাবে? আমিও দেখব কতদূর যেতে পারে ছেলেটা। এই তো কিছুদিন আগেই এসে বৌয়ের সম্বন্ধে কত কিছু বলছিল। দেখব দেখব কি করে শয়তানটা।" ঢোক গিলে মুখ মোছে অখিল।
টিভির পর্দায় চোখ রাখে রবীন,তবে বিশেষ মাথা ঘামায় না এমন রূপসী আর শিশির সমাজের কোটরে কোটরে লুকিয়ে আছে। তবে এইসব করে খুব তাড়াতাড়ি সংবাদের শিরোনামে চলে এল দুজনেই। দীপ্তর কাছে বা দুষ্টুর কাছে একটা সময় শুনেছিল ওদের নাম। কিন্তু তখন তো কলেজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল ওদের কান্ডকারখানা। এখন ক্ষমতার লোভে উঠতে চায় ওপরে। একটা সময় দীপ্তর মত মেধাবী ছেলের সর্বনাশ করেছিল ওরা।এখন সমাজের,রাজ্যের অথবা দেশের সর্বনাশ করবে।
শিশির আর রূপসীকে এক দলে দেখে মনটা আরও তেতো হয়ে যায় দুষ্টুর। দীপ্তর মনে ভিড় করে আসে অতীতের তিক্ত স্মৃতি। মনে মনে ভাবে আবার দুটোতে এক জায়গায় হয়েছে, এরপর আর ওদের পায় কে?
আজকাল টিভি খুলতে আর ভাল লাগে না দুষ্টুর মতবদল আর দলবদলের খবর সারাক্ষণ। আদর্শ পরিবর্তিত হচ্ছে সারাক্ষণ। আঙুল তুলছে এ ওর দিকে আর দোষে ভরা যারা তারাই অন্যের দোষ দেখাতে ব্যস্ত।
রূপসী শিশিরকে কতটা ভালোবাসে জানে না শিশির। তবে শিশির আর নিতে পারছিল না নিত্যদিনের অশান্তি আর অপমান। আর সত্যিই তো এতদিন এই দলে আছে দল কিই বা দিয়েছে ওকে? এখনও দলের একজন সাধারণ কর্মী হয়েই জীবন কাটছে ওর। আর রূপসী সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে তরতরিয়ে উঠে গেছে কোথায়।
তাই হঠাৎই সিদ্ধান্ত নিয়ে দলবদল করেছে শিশির। ভাবতেই পারেনি এতটা ওয়েলকাম পাবে সবার কাছে। রাতারাতি শিশির এখন সংবাদের শিরোনামে। দিন সাতেকের মধ্যেই ভোল বদল হয়েছে শিশিরের। শিশির এখন আর সাইকেলে চড়েনা,নতুন বাইক এসেছে। তাছাড়া রূপসীর গাড়ি তো আছেই। মাঝে মাঝেই দুজনকে একসাথে দেখা যায়।
রূপসী আজকাল আর খুব একটা খারাপ ব্যবহার করেনা ওর সাথে। তবে শোবার ঘর এখনও এক হয়নি, চোখ বুজে অনেক কিছুই সহ্য করছে শিশির। তবুও যদি একটা জায়গা করে নিতে পারে।
*************************
উইন্ডো সিটটা নিজে থেকেই ছেড়ে দেয় উত্তমাকে সোম। উত্তমার সকালের চাঙা মুডটা নেতিয়ে পড়েছে অনেক আগেই। ঠোঁটের আবছা হওয়া লিপস্টিকে আর নতুন করে রঙ চাপাতে ইচ্ছে করে না। তবুও নিজেকে বলে হোল্ড অন উত্তমা,চিয়ার আপ এই তো ওঠার শুরু। ভালোই হয়েছে প্রথম বাইরের ট্রিপ তাও আবার বসের সাথে। এর পর হয়ত প্রমোশন হবে,উত্তীয়র চেয়ে আরও অনেক অনেক ওপরে উঠে যাবে।
এটাই তো চেয়েছিল জীবনে,সাফল্যকে হাতের মুঠোয় আনতে দরকারে কাঁটা গাছের ডাল ভেঙে ফুলদানিতে সাজাতে পারে উত্তমা। ফ্লাইটের জানলা দিয়ে ভেসে যাওয়া মেঘেরা হাতছানি দেয় ওকে বলে ভাসিয়ে দাও নিজেকে একদম হাল্কা করে। ওপরে উঠে যাবে চোখের পলকে।
-" ইয়ঙ্গ লেডি চুপচাপ কেন? মুড অফ? "
-"নো স্যার ওকে,মানে ঠিক আছি আমি। আসলে ফ্লাইটে কানে তালা ধরে।"
-" ওহ্ আমি ভাবলাম আমার আসাটা ঠিক ভালো লাগেনি তোমার। হঠাৎই একটা কাজ পড়ে গেল তাই আমিই চলে এলাম। অন্য কেউ হলে বসকে পেয়ে খুব খুশি হত। আসলে আমাকে একাই তো অনেক কিছু হ্যান্ডেল করতে হয়।"
-" মাই প্লেজার স্যার,আপনার সাথে একসাথে কাজ করবো।"
-" দেন চিয়ার আপ,কফি নেবে? বা অন্য কিছু? এক সেকেন্ড তোমার ঠোঁট আজ এত ফ্যাকাসে কেন? রাঙিয়ে নাও।"
হাসে উত্তমা হাসে সোমও। একটু আধটু ফ্লার্ট করতে ভালোই লাগে। জীবনে একটু রঙ যদি থাকে ক্ষতি কি? অবশ্য প্রথম দিকে যখন একটা সামান্য চাকরি করত তখন এই কথাটা শুনেছিল ওর প্রথম পক্ষের থেকে। আজকাল এগুলো প্রথম,দ্বিতীয়, তৃতীয় পক্ষ বলেই মনে রাখে সোম। অথচ খুব ভালোবাসত ওকে,প্রথম প্রেম তো। মানে একটা মধ্যবিত্ত গ্ৰাম্য ছেলের বোকা বোকা প্রেম আর সরল চাউনি জয় করতে চেয়েছিল একটা মেয়ের মন। কিন্তু পারেনি একটা সময় টাকাটাই ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আজ হাতে প্রচুর টাকা,পক্ষে বিপক্ষে প্রচুর নারী। নিজেকে মাঝে মাঝেই বলে আমি সোম আমি সব পারি। কিন্তু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে আর সেই সরল চাউনিটা তাকাতে পারে না। আর কাউকে তেমন ভালোবাসতে পারে না।
তবে ভালোবাসার বাসাটা বাঁচাতে এখনও পারে তাই বোধহয় হঠাৎই চলে আসা এখানে। কাজ অবশ্যই ছিল,রথ দেখা আর কলা বেচা দুইই হবে। কফিতে চুমুক দিয়ে সোম ভাবে কি করছে উত্তীয় এখন? সকালের সুখবর পেয়ে বেশ একটা জমাটি বাসী প্রেম উপভোগ করে ঘুমোচ্ছে। বা হয়ত দুটোতে খুনশুটি করছে। মনে হল আবার সোম সব পারে,হয়ত চাউনিটা হারিয়ে গেছে,বোকামিটাও তবুও বুদ্ধি দিয়ে সমাধান করতে পারে অনেক কিছুই।
**********************
আরও অনেকটা কাছাকাছি, অনেকটা বেশি আদর আর ভালোবাসার চাদর গায়ে দিয়ে সকালটা অদ্ভুত ভালোলাগার মধ্যে কেটে গেল ওদের দুজনেরই। কিন্তু একটু হলেও অবাক হল জোজো হঠাৎ সোমদা চলে গেল কেন? যদিও উত্তমার সাথে যেতে প্রথম ও আপত্তিই করেছিল। যাক যা হয়েছে হয়েছে বোনাস ভালোবাসার সাথে বোনাস কিছু কাজও আছে এদিকে সেগুলো সামলাতে হবে ।
দুষ্টু ফোন করে মিষ্টিকে অভ্যেসমত ," দিদি ঠিকঠাক আছিস তো? দেখ না আমারও খুব চাপ যাচ্ছে। নাহলে কদিন ঘুরে আসতাম।"
" আসতেই পারিস,ভালোই মজা হবে। তিনজনে মিলে কোথাও একটা চলে যাব লঙ ড্রাইভে।" জোজো বলে ওঠে।
-" আরে আমি তো ভাবলাম তুমি চলে গেছ দিল্লী। বাবা হঠাৎ কি হল?"
-" তা জানিনা বাপু,ওপর মহল থেকে খবর এল আমি তো আহ্লাদে আটখানা। বৌ ছেড়ে যেতে কার ভালো লাগে?"
কথা আর খুনশুটির মাঝে ওরা দীপ্তকেও অ্যাড করে নেয় বেশ একটা আড্ডা জমে যায়। রাজনৈতিক আলোচনা একটু শুরু হয়েছিল তবে দুষ্টুই চুপ করতে বলে," ওসব ছাড় অন্য কথা বলো। বাবা ঠিকই বলে পুরোনো ঘুঁণধরা কাঠামোর ফাঁকে ফাঁকে কত কি যে আছে বলা মুশকিল। এই সবাই শুনে নাও এবার আচ্ছা তুমিই বলো না এবার।"
-" বাবা এত ভনিতা করার কি আছে শুনি? আমার বিরহিণী শ্যালিকা এবার খুব তাড়াতাড়ি দীপ্তর ঘরণী হবে। কারণ মহারাজ আর কিছুদিনের মধ্যেই একদম প্রশিক্ষণ শেষে পদার্পণ করবেন মালা হাতে। না না মালা তো তুই হাতে রাখবি।"
-" ইশ্ তুমিও যা একটু ওদের কথা বলতে দাও। আইএএস আর আইপিএস অফিসারের প্রেমটা কত গাঢ় হল দেখি। " মিষ্টি একটা খোঁচা মারে জোজোকে।
সকালের আড্ডার পর একদম খুশি মনে কাজে লেগে পড়ে দুষ্টু। সত্যি ভীষণ চাপের মধ্যে কাটছে।
কদিন ভাল করে ঘুমোতে পারেনি অখিল সবসময়ই একটা চিন্তা। বারবারই সাংবাদিকদের শিশির বলেছে অনেক কিছুই জানে সে। কিন্তু কি জানে এখনও তা বলেনি। সামনের শনিবার সাংবাদিক সম্মেলনে নাকি ওরা দুজনেই থাকবে। বিপরীতে থাকবে অখিলও আর ঐ নৌকা দলের মুস্তাফা আলি আর গামছা দলের পানু মোদক। শেষে ঐ শিশিরের সাথে মুখোমুখি বসতে হবে? হয়ত এমন কিছু বলবে যাতে খুব খারাপ ফল হবে এবার। কিন্তু কি করা যায়?
রাতের অন্ধকারে জটলা চলে অখিলের বাড়িতে।
-" আপনি বললে স্যার ওর পা ভেঙে শুইয়ে রাখতে পারি। এমনিতেই একটা ঠ্যাং ভাঙা খুঁড়িয়ে হাঁটে।"
-" ধ্যাৎ তোদেরও যেমন মাথা মোটা। মুখকেই তো যত ভয়। ঠ্যাং নিয়ে করবো কি?"
-" বড় পাখনা গজিয়েছে শ্লার তাহলে কি একদম মুখবন্ধ করিয়ে দেব।"
-" সত্যিই তোদের মুখটা গঙ্গাজল দিয়ে ধুতে হয়। এই নে চরণামৃত খা। জয় মা তুমি দেখ।"
মায়ের ছবিতে মোটা জবা ফুলের মালা ঝুলিয়ে গান ধরেন অখিল..' সকলি তোমারি ইচ্ছা ইচ্ছাময়ী তারা তুমি। তোমার কর্ম তুমি করো মা লোকে বলে করি আমি।'
*************************
প্রথমবার বাইরে আসা অফিসের কাজে,প্রথম ভিআইপি মিট করা। সব কেমন স্মুথলি হয়ে গেল অবাক হয়ে ভাবে উত্তমা। হয়ত যা হয়েছে ভালোই হয়েছে আর যা হবে ভালোই হবে। ভিআইপি মিটের পর ডিনার করে আসতে আসতে বেশ রাত হয়ে যায়।
উত্তমা সোমের গা ঘেঁষে বসেছে,গাড়ি চলছে দ্রুতবেগে হোটেলের দিকে। রাতের শহর নেশা ছড়ায় তখন যাযাবর চোখে। নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে হাত নাড়ে সোম। উত্তমা বলে," স্যার ইউ নিড এনি হেল্প?"
" নো টেক রেস্ট,রাতে বিছানায় একদম একা না শুলে আমার ঘুম আসেনা। কাল দেখা হবে। গুডনাইট।"
উত্তমার চোখ ভাসে স্বপ্নে,মন ভেসে যায় মেঘেদের সাথে পাল্লা দিয়ে অনেক দূরে। আয়নার সামনে এসে চেঞ্জ করতে গিয়ে মনে পড়ে উত্তীয়র মুখটা। মুখ বেকিয়ে বলে,থাক তুমি তোমার ঐ সাদামাটা মিষ্টি না কি যেন বৌকে নিয়ে। আই অনলি নিড সাকসেস। আমি ওপরে উঠব আর তুমি দেখবে।
নরম বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেয় সোম,সারাদিন বাদে এটুকুই শান্তি। এই শান্তির মধ্যে কাউকে এনে অশান্তি বাড়াতে আর ভালো লাগেনা। ওর তিন নম্বর স্ত্রী মায়া বলে সোম ঠান্ডা হয়ে গেছে একদম সরীসৃপের মত। তাই নিজের শরীরের উত্তাপের পারদ ঠিকঠাক রাখার জন্য মাঝে মাঝেই রাতে বাড়ি থাকেনা মায়া। অবশ্য সোমের কাছে তা ম্যাটার করে না এখন মনে হয় সবই মায়া। অফিসিয়ালি ওরা হাজবেন্ড ওয়াইফ,সেভাবেই হাতে হাত রেখে যায় পার্টিতে। এ ব্যাপারে মায়াকে কিছু বলতে হয় না,আর সেই জন্যই মায়াকে আর ছাড়তে পারেনি। মায়ার মধ্যে ন্যাকামো নেই,সবটাই খোলামেলা সাফ বলে দেয়," তুমি তোমার মত থাক। আমি আমার মত কিন্তু কাজের সময় একদম পারফেক্ট কাপল আমরা। "
হাসে সোম মন্দ কি? এই তো ভালো। তাই বাংলা নববর্ষের পার্টিতে সোমের ধুতির সঙ্গে ম্যাচিং পোশাকে মায়া যায় কপালে জ্বলজ্বলে লাল টিপ পরে। আবার ওয়েস্টার্ন পার্টিতে গাউন পরে হাতে রেড ওয়াইনের গ্লাস নিয়ে একদম মধ্যমণি মায়া।
সোমের ফোনে টুংটাং জলতরঙ্গ বাজে,স্ক্রীনে মায়ার ছবি ভেসে আসে। খুব দায়িত্বশীল বৌ মায়া,তাই সারাদিন বাদে একবার খবর নিয়ে নেয়।
" হ্যালো, সারাদিন ঠিক ছিল তো? আর ইউ ফ্রী? মানে ডিস্টার্ব করছি না তো?"
" একদম ডার্লিং,তোমার ঠান্ডা সরীসৃপ এখন যান্ত্রিক শীতল ঘরে ঢুকে শান্তিতে শরীরটাকে বিছিয়েছে নরম বিছানায়। কেউ নেই চারপাশে।"
" তোমার সুন্দরী অ্যাসিসটেন্ট,সে কোথায়?"
" ভিডিও কল করো নিশ্চিন্তে। সে আমার ঘরে নেই। তার উত্তাপ নেবার ক্ষমতা আমার নেই। শুধু তাপকে চাপা দেবার জন্য এখানে আসা।"
সোমের হেয়ালী বোঝে না মায়া। তবে এটুকু জানে সোম মিথ্যা বলে না। বরং দরকারে টুকটাক মিথ্যে ওকেই বলতে হয়। এই তো যেমন দিদির বাড়ি এসেছে বলে চলে এসেছে মন্দারমণি রজতের সাথে। অদ্ভুতভাবে ওর ব্যাপারে কিছুই জিজ্ঞেস করেনা সোম। শুধু বলে," সোনারপুরে দিদির বাংলোটা বেশ হয়েছে কিন্তু ঘরে বসেই সমুদ্রের জোয়ারের ঢেউভাঙার শব্দ শোনা যায়। দেখো আবার ভেসে যেয়োনা। ওকে গুডনাইট।"
বুকটা তিরতির করে কাঁপে মায়ার,লোকটার কি একটা অদৃশ্য চোখ আছে? উফ্ অদ্ভুত বিঁধিয়ে কথা বলতে পারে। সবসময় বলে," আমাদের সাংবাদিকদের কখনও ইন্দ্রের সহস্র চক্ষুর চেয়েও বেশি চোখ রাখতে হয়।"
রজত ওর গলা জড়িয়ে তুলে নিয়ে যায় ওকে ব্যালকনি থেকে। রজতের শক্ত বাহুবন্ধনে তিরতির করে কাঁপে মায়া। বয়েসে ওর থেকে ছোট হয়েও কানায় কানায় মায়াকে ভরে দেবার ক্ষমতা রজতের আছে।
************************
সকালে খবরের কাগজে চোখ রেখেই চোয়াল শক্ত হয় অখিলের। কত রঙ্গই জানে এই মেয়েছেলেটা,অথচ একসময় মিরিকে গিয়ে হোটেলে শুয়েছেও শালী আমার সাথে। মুখ থেকে গালাগালি বেরিয়ে আসে দুই অক্ষর, তিন অক্ষর, চার অক্ষর মিলিয়ে।
নাহ্ একটা কিছু করতেই হবে। হাতে আর বেশি সময় নেই,শিশিরকে কিছুতেই মিডিয়ার সামনে কথা বলতে দেওয়া যাবেনা। অবশ্য ব্যবস্থা সব পাকা হয়ে গেছে মোটামুটি, এখন পাখনা মেলে উড়ুক শালা যত পারে। পিপিলিকার মরণ পাখা গজিয়েছে এবার পাখা ছিঁড়ে ফেলতে হবে।
শিশিরের মনে এখন সুখের বাসা,যাক একটু হলেও রূপসী এখন ওকে পাত্তা দেয়। তবে কখন যে কোথায় যায় মেয়েটা সেটা এখনও ঠিক জানতে পারলো না শিশির। রাতে এখনও ওর ঘরে বসে নেতাদের মজলিস যেখানে শিশিরের উপস্থিতি নাম মাত্র একজন কর্মী হিসেবে। গা জ্বলে যায় শিশিরের,একদিন ও নিজেই মই বেঁধে রূপসীকে উঠিয়েছিল গাছে। এখন ওকেই পাত্তা দেয়না মেয়েটা,মানে ওর বৌ। বললে ফোঁস করে ওঠে," চিরকাল মই বেঁধেই গেলে। আর কি মুরোদ আছে তোমার? একদম আমাকে ঘাটাবে না। আমি নিজের ক্ষমতায় আজ এই জায়গায় এসেছি। ঐ বুড়ো ভাম অখিলটা,এবার দ্যাখ রূপসী কি করতে পারে।"
অখিলের কামনার প্রতিটা দাগের জ্বালা আজও চোখ বুজলে অনুভব করে রূপসী। ব্যাটা ভক্ত সেজে ঘুরে বেড়ায় আসলে একটা ভন্ড শয়তান,লম্পট।
টিভি দেখতে দেখতে বারবার বি বি চ্যানেলের অ্যাডটা চোখে পড়ে যায় দুষ্টুর। কাল এক ঝাঁক উঠতি নেতা বসবে জনতার দরবারে। তাদের কাছ থেকে জানা যাবে অনেক অজানা তথ্য।
রাতে দীপ্ত ফোন করলে আজকাল প্রেমের বদলে পলিটিক্যাল গেমের কথাই বেশি হয়।
দীপ্ত কিছুটা শুনে বলে," দেখেছো তো আমাদের মধ্যে সেই কাজ ঢুকে গেছে। যতই ওদের ভুলতে চাই তবুও ওদের ছায়া ঘোরে আমার চারপাশে। হাতে তো মাত্র কয়েক মাস আর কি হবে জানিনা।"
-" কিচ্ছু হবেনা তুমি একদম ভেবো না। তবে বাবা কিন্তু বারবার বলছে তুমি এলেই আমাদের সোশ্যাল ম্যারেজটাই আগে দেবে। মা,মাসি,মামু সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।"
" দাঁড়াও আগে তো পোস্টিং হোক। কত স্বপ্ন আমার দুষ্টু আচ্ছা সেগুলো কি পূরণ হবে?"
দুষ্টু রাতের নিরিবিলি জোছনায় ডুবে যায় স্বপ্নগুলো খুঁজে দিতে দীপ্তকে। আর দীপ্ত সেগুলো মুঠোয় ভরে। এভাবেই অনেকটা রাত্রি হয়ে যায় ঘুমিয়ে পড়ে দুষ্টু।
পরদিন বেশ বিকেলের দিকে হঠাৎই জোজোদা ফোন করে। দুষ্টু ওর স্বভাবেই বলে ওঠে," কি হল আবার? বৌয়ের সাথে ঝগড়া? আমি কিন্তু এখন খুব ব্যস্ত।"
- " তুই আমাকে তো বলতে দে,কিছু খবর শুনেছিস? জোজো বলে।
-" কি খবর? না তো কিছু জানিনা।" বুকটা কেন যেন কাঁপে দুষ্টুর। দীপ্তর কিছু হল নাকি?
-" একটা বাজে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে শিলিগুড়ি যাবার পথে। রূপসী বিশ্বাস গুরুতর জখম। হসপিটালে ভর্তি। পুলিশ শিশিরকে গ্ৰেপ্তার করেছে।"
-" মানে? আরেকবার বল। আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না।
"আরে আমাদের কাছে খবর গেছে ঐ এরিয়ার সাংবাদিক মারফত। গন্ডগোল হতে পারে খুব একটা তাই পুলিশ এখন ধামাচাপা দিয়ে রেখেছে ব্যাপারটা। তবে শুনেছি অবস্থা ভালো না। গাড়িটা নাকি ব্রেকফেল করেছিল। সঙ্গের একজন স্পট ডেড আর ড্রাইভার ও খুব জখম হয়েছে।"
মুখের ভেতরটা তেতো লাগে দুষ্টুর অনেকদিন ধরেই একটা দুশ্চিন্তা ওদের তাড়া করে এসেছে। তবে এরকম একটা খবর! কারও মৃত্যু কামনা করেনি কোনদিন। শুধু এটাই আশা রেখেছে একদিন ঝড় থেমে যাবৈ পৃথিবী আবার শান্ত হবে। আর সেই শান্তি মাখা পৃথিবীর একটা ছোট্ট কোন নিভৃত কোণে ওরা বাসা বাঁধবে সেই বাসায় কিচির মিচির করবে খুব ভোরে ওঠা পাখির দল।
-" আমি তো ভাবতেই পারছি না। কি অবস্থা! আর ওর স্বামী শিশিরকে পুলিশ গ্ৰেপ্তার করেছে! কেন হঠাৎ? কিছুদিন আগেই তো দুজনে এক হয়ছছে এক দলে নাম লিখিয়ে।"
-" ও ভেতরে অনেক খবর আছে,আমি এখন রাখছি রে। একটু চাপ আছে। সোমদা নেই তো।"
সোমদাকে এখন দুষ্টুও চেনে,বাবার পুরোনো ছাত্র তাই আরও ভালো লাগে। তবে জোজোদা বলেছে," শোন আমার শ্বশুর স্যারের সব ছাত্র আমাদের মাণিকজোড়ের মত পিওর নয় বুঝলি। সোমদার অনেক কেস আছে। তবে এখন তো একদম সেলেব সাংবাদিক।''
সোমদার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই দুষ্টুর। একবার দেখা হয়েছে,কথা বলে ভালো লেগেছে। আর বাবাও খুব খুশি পুরোনো ছাত্র পেয়ে।
দুষ্টুর মনটা অদ্ভুত একটা খারাপ লাগায় ভরা। আচ্ছা এই খবরটা কি দীপ্তকে দেবে? রূপসী আর শিশিরের সাথে বেশ কয়েকটা বছর কাটিয়েছে ও। ওদের অত্যাচারের ট্রমা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি পুরোপুরি। ফোনে হাত রাখে দুষ্টু। কি বলবে? সেই ফেলুদা ঢঙে বলবে নাকি,আপদ বিদায় হলো মনূ হচ্ছে। নাহ্ থাক সরকারী চাকরির অনেক জ্বালা সেইসব বলার দরকার নেই তারপর সামনেই ভোট। ও নিজেই জানতে পারবে।
***********************
টিভি আর খবরের কাগজে দ্রুত খবর ছড়িয়ে পড়ে। যেদিন প্রেস মিট করার কথা ছিল। সেদিনই এই দুর্ঘটনা? কি করে হল? সত্যিই কি শিশিরের হাত ছিল এর পেছনে? নাকি আছে অন্য কোন গভীর চক্রান্ত?
যে গাড়িটাতে শিশিরের যাওয়ার কথা ছিল সে নাকি সেটাতে ইচ্ছাকৃতভাবে না উঠে রূপসীকে উঠতে বলে। দুজনেই যখন শিলিগুড়ি যাবে তখন আগে আর পরে কেন? একসাথে গেলেই চলত। তাহলে কি শিশিরের চক্রান্ত সবটাই? নাকি অন্য কেউ আছে শিশিরের পেছনে। রূপসী বিশ্বাস মরেও মরেনি এখন কদিন ধরে নিউজ চ্যানেলে একটাই কথা ঘুরে বেড়াচ্ছে। শিশির এখনও পুলিশ হেফাজতে। দুষ্টু বুঝতে পারে আপাতত শিশিরের ক্যারিয়ারটা একদম গেল শেষ হয়ে। তবে সত্যিই কি এভাবেই সব শেষ হয়? তাহলে কত আসামী স্বামী হয়ে শাসনের নামে শোষণ করত না। যাক সে যা হবে তা হোক।
অনেকদিন বাদে বাড়িতে এসেছে দুষ্টু। অনেক কাজের চাপের মাঝে চাবাগানের সবুজে ওর ক্লান্ত মনটা চাঙা হয়ে ওঠে। কতদিন বাদে গুটিসুটি মেরে বাবার কোলের কাছটাতে বসে কথা বলা। বাবা বলে," পৃথিবীতে এখনও কিছু নাশ আর বিনাশের কাজ প্রকৃতি অদৃশ্য হাতেই করে চলেছে বুঝেছিস। তাই হয়ত আমাদের কল্পনার বাইরেও অনেক কিছু ঘটে। তুই অত কিছু ভাবিস না মন দিয়ে কাজ কর।"
রান্নাঘর থেকে এসে ওদের বাবা মেয়ের কাছে বসে অনুও," ঐ সব ভারী কথা আর ভালো লাগেনা,যেমন আমার মেয়েরা আর তেমন হয়েছে জামাই দুটো। সারাক্ষণ কাজ নিয়ে পড়ে আছে।"
-"তুমি তো ভাগ্যবতী অনু,এমন মেয়ে জামাই কজনের আছে। তারপর কিছুদিন বাদে আমাদের রাণুর ছেলেটা আবার ডাক্তার হয়ে যাবে। উঃ আমি তো একদম নিশ্চিন্ত।" হাসে রবীন।
-" তুমি এখনও নিশ্চিন্ত বাপু, দেশে বিদেশে কত ছাত্র ছড়িয়ে আছে তোমার বলতো? জোজোর বসও তো তোমার ছাত্র।"
-" ঠিক বলেছ অনু তাই তো মাস্টার হবার সুখ আছে। কখনও না কখনও আসতেই হবে বাপু তোমাকে আমার কাছে। তারপর আমরাই জন্ম দিই সমাজের কৃতী সন্তানদের। তবে আজকাল একথা জোর দিয়ে বলতেও পারিনা অনু।"
-" কেন গো?"
-" ও তুমি বুঝবে না। দুষ্টু কে বলো কথাগুলো। আর দেখাবে না জিনিস গুলো।"
-" হ্যাঁ রে দুষ্টু ঠিক করেছি সামনের ফাল্গুনে তোর বিয়েটা দেব। দীপ্তর মা আর মামা এসেছিলেন ওদেরও তাই ইচ্ছে।"
ছটফটে দুষ্টুও লজ্জা পায় একটু," দীপ্ত রাজি আছে? মানে ও বলছিল আগে পোস্টিং হবে তবে।"
" হ্যাঁ তখন সব হয়ে যাবে আমরা হিসেব করে নিয়েছি। তবে নতুন চাকরি। তবুও আমরা সবাই চাইছি এবার বিয়েটা হয়ে যাক।"
বাবার কথার ওপর কোনদিনই কথা বলতে অভ্যস্ত নয় ওরা। তাই দুষ্টুর মনে ডানা ঝাপটায় রঙীন প্রজাপতিরা আর দূরে বাজতে থাকে সানাইয়ের সুর। মনে পড়ে যায় দিদির কথাও," আমরা কোন প্ল্যান করতে পারছি না।"
-" মানে আবার কি প্ল্যান করবি? বিয়ে হল হানিমুন হল!"
লজ্জা পেয়েছিল মিষ্টি। তবে জোজো বলেছিল," সারাদিন ফাইল নেড়ে তোর মাথাটা গেছে। মাসি হতে ইচ্ছে করে না তোর?"
দুষ্টু বুঝেই জড়িয়ে ধরেছিল মিষ্টিকে," দিদি তাড়াতাড়ি নিয়ে আয়।"
-" আগে তোর বিয়েতে আনন্দ করে নিই তবে।"
অনু আলমারির চাবি খোলে,গয়নার বাক্সটা এনে দুষ্টুর সামনে রাখে।
-" তোর জন্য এগুলো বানিয়েছে। তুই তো কিছু পরবিও না,আর কিনবিও না তবে তোর বাবার শখ তাই আমরা দুজনে মিলে কিনেছি।"
দুষ্টুর গলায় হারটা পরায় অনু,মুহূর্তে রূপে একটা আলাদা বদল আসে মেয়েটার। রবীন তাকিয়ে দেখে আর বুকটা কেমন যেন খালি হয়ে যায়। মনে হয় এই তো সেদিন মেয়েটা হল এর মধ্যেই কতগুলো দিন পার হয়ে গেল। সময় যে কিভাবে যায়?
আজকাল নিজের জীবন বৃক্ষকেও মাঝে মাঝে ক্ষয়িষ্ণু মনে হয় রবীনের। কেন যেন মনে হয় আর কত দিনই বা রয়েছে বাকি? তারপরেই মনে হয় যা আছে বাকি তাকে ভরিয়ে রাখবে কাজে,হাসিতে আর আনন্দে। সময়ের প্রতি মুহূর্তে দেখবে নতুন ভালো থাকার স্বপ্ন ছড়িয়ে দেবে তা ছাত্রদের মাঝে।
বিছানায় শুয়ে ঘুম আসেনা দুষ্টুর বারবারই কানে আসে রাত জাগা পাখিদের কোলাহল। আজকাল বাড়িটা ফাঁকা হয়ে গেছে। মনে পড়লো দিদির বিয়ের কথা। কত লোকজন এসেছিল বাড়িতে,আনন্দে আর সানাইয়ের শব্দে ভরে গেছিল বাড়ি। তার মধ্যেই অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছিল ও আর দীপ্ত। তবে রেজেস্ট্রীর নোটিশ এত তাড়াতাড়ি দেবে ভাবেনি। যদি ঐ রূপসী মাঝে না থাকত।
মনটাকে সামলে নেয় দুষ্টু,রূপসী এখন নেই। সে আজ অতীত তবুও কালো ছায়া ঘোরে মাঝে মাঝেই স্মৃতিতে। হঠাৎই একটা স্পর্শ পায়," এখনও ঘুমোসনি। আয় চল তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিই।"
মায়ের আঁচলের গন্ধ নিতে নিতে ডুবে যায় দুষ্টু, ঘুম ভরে আসে দুচোখে। তার সাথে মায়ের টুকরো কথা মাখিয়ে দেয় স্বপ্নের কাজল ওর গভীর দুই চোখে।
***********************
খুব আশা ছিল শিশিরের নিশ্চয় হলুদ দলের সবুজ দা বা নীল দলের অখিলদা ওকে এসে ছাড়িয়ে নেবে। কিন্তু কই কেউ তো এলো না। দুইদলই ওকে মোটামুটি গিরগিটি বলে জেলের ঘানি টানতে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু অপরাধ কি ওর? তা নিজেও জানেনা।
রূপসীর গাড়িতে ও যাবে গিয়েছিল কারণ এক জায়গায় তো যাবে দুজন সুতরাং অসুবিধা কোথায়?
রূপসী ওকে উঠতে দেয়নি বলেছিল," এই শোন বর বৌয়ের সম্পর্ক সব জায়গায় দেখাতে এসো না তো। এই গাড়িতে পচাদা যাবে। আগে থেকেই কথা আছে। তুমি শুধু একটু দেখে নাও গাড়িটার চাকায় হাওয়া আছে কি না? আর তেল কতটা আছে? পচাদার ড্রাইভার চালাবে গাড়ি। তুমি পচাদার অলটোতে যাবে।"
শিশিরের বলতে ইচ্ছে করলেও সাহস পায়নি,ও গাড়ির কাজ জানে বলে মেকানিকের কাজ ওকেই করতে হবে? যাক হয়ত ওর কপালের জোর ছিল তাই বেঁচে গেছে। পচাদাটা আধমরা হয়ে আছে তবে বলেছে যে ও যখন এসেছিল তখন নাকি শিশির গাড়ি নিয়ে খুটখাট করছিল। শালা,নিজে আধমরা হয়ে একদম মেরে গেল শিশিরকে।
কত ঢলাঢলি না করেছে ঐ লোকটার সাথে রূপসী। কিন্তু এভাবে কতদিন জেলের ঘানি টানবে?
অখিলদা মাঝে একদিন এসে একটা কাষ্ঠহাসি দিয়ে গেছে," কেন যে দলটা ছাড়লি শিশির? সেই তো জেলে পচে মরছিস। কে কাকে ফাসাবে কে জানে? আমার খুব ইচ্ছে ছিল রে তোর ইন্টারভিউ শোনার।"
দাঁত কিড়মিড় করে শিশির ওর অবস্থা দেখতে এসেছে। অখিল ওর চাউনিটা দেখে মনে মনে ভাবে বড় লাফিয়েছিলি না এবার পচে মর শালা।
*********************
দিল্লীর কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। সোমকে দেখে অবাক হয়েছে উত্তমা। প্রথমটা স্যারকে দেখে কেমন যেন একটা মুড অফ হয়ে গেছিল। দুদিন লিফ্ট নিতে গিয়ে মনে হয়েছিল লোকটা সুবিধার নয়। কে জানে কি উদ্দেশ্যে উত্তীয়কে সরিয়ে নিজে এসেছে? তবে কি এই লোকটা কোন প্রস্তাব দেবে নাকি ওকে?
পরে বুঝেছিল ডোন্ট জাজ আ বুক বাই ইটস কাভার। সব মানুষের প্রথম লুক এক কথা বলে না। আর সেভাবেই তো কত ঠকে যাই আমরা তার কোন হিসেব নেই। বরং উত্তমা নিজেই চেয়েছিল ওর অস্ত্র কাজে লাগাতে। অবশ্য সেটাকে পাত্তাই দেয়নি ভদ্রলোক। সোম বুঝেছিল মেয়েটা কাজের তবে কিছুটা অকাজেরও মানে সব জায়গায় ওর হাজার ভোল্টের আলো জ্বালাতে চায়। তার কোন দরকার নেই। যাক সুখের বাসায় অযথা আয়লা বা ফণির মত কোন ঝড়ের দাপট যে লাগতে দেয়নি এখানেই হয়ত অনেক পাওয়ার সুখ।
আজকের রাতে একটা স্পেশাল ডিনার দেবে ঠিক করেছে উত্তমাকে। কারো মুখের হাসি দেখতে খুব ভালো লাগে সোমের। এই যেমন মায়ার ফোনের হাসিটা খুব মায়াবী লাগে, বুঝতে পারে ভরে আছে মায়া। থাক,যে যার মত ভরে থাক,শুধু এই মিথ্যে গুলো কেন যে বলে মায়া কে জানে?
দুদিন মন্দারমণিতে কাটিয়ে খুশি মনে ফিরছে মায়া। সোমের ট্রিপগুলোকে এভাবেই কাজে লাগায়। রজতের চাই টাকা,আর ওর চাই শরীর। সোমের হাই সুগার, কেন যেন আর শরীর তেমন জাগে না। আর আগের দুটো বৌ ওকে শেষ করে দিয়েছে। তবে সোম এখনও করবীকে ভালোবাসে। ওটাই বোধহয় ওর প্রথম আর শেষ ভালোবাসা। মায়া ওর অভ্যেস, এই মানে ঘরে একটা বৌ আছে। সিঙ্গেল বা ডিভোর্সী নয়।
তবে নিজের সবটা খোলামেলা করে বলতে নিজেরই ভালো লাগে না মায়ার। তাছাড়া সোম তো বলেই দিয়েছে," আমাদের দাম্পত্যে থাকবে না অনিচ্ছার সহবাস আর কৈফিয়তের শৃঙ্খল। ঘর দিলাম তোমায় তবে গৃহিণী বা ঘরণী না হলেও হবে। সঙ্গিনী হয়ে থেক।"
এত বড় ব্যাঙ্কোয়েটে এমন গালা ডিনারে কোনদিন আসেনি উত্তমা। স্যার বলাতে আজ ও সেঝেছে একদম নিজের মত করে। ওর শখ করে কেনা ড্রেসটা আজ কাজে লেগে গেল। উত্তীয়র মধ্যবিত্ত মাথাটা যদিও ঘুরলো না তবে অনেকেই আজ নাচতে চাইল উত্তমার সাথে ডান্স ফ্লোরে। উড়ন্ত প্রজাপতির মত উত্তমাকে দেখে সোম। ওর শিকারী চোখে আজ আগুন মাঝে মাঝেই এসে গ্লাস ভরে নিচ্ছে পছন্দ মত পানীয়তে। একটা সময় সোমকেও নিয়ে যায় টেবিল থেকে তুলে। অভ্যস্ত পায়ে নাচের তালে পা মেলায় সোমও। তারপর একটা সময় পার্টি শেষে একটু বেসামাল উত্তমাকে ধরে রাখে সামলে।
আজ উত্তমার চোখে আমন্ত্রণের চাউনি,সোম ওকে ঘরে পৌঁছে তাচ্ছিল্যের সাথে নিজের ঘরে চলে যায়। উত্তমা বিড়বিড় করতে করতে বিছানায় গড়ায়। সোমের দেওয়া ফুলের বোকেটা আর পারফিউমটা পড়ে থাকে ওর বিছানার পাশে। ঘুমের ঘোরে হঠাৎই মনে হল আবার কথাটা," ইউ হ্যাভ ফ্র্যাগরেন্স উত্তমা সো ওটাকেই তোমার আইডেন্টিটি করো।"
সব পুরুষই হয়ত একরকম নয় কেউ ঘর ভাঙে আবার কেউ গড়ে। আবার সব নারীও একরকম নয়। তাই প্রথম দেখাতেই সবাইকে একরকম না ভাবাই ভালো। তবে সত্যিই কি মানুষ চেনা এত সহজ? হয়ত এক ছাদের তলায় অনেক দিন থাকলেও চেনা যায়না।
যেমন সোম চিনতে পারেনি করবীকে। খুব ভালোবেসে বোকা হয়েছিল। বৈভবে হারিয়ে গিয়েছিল করবী মধ্যবিত্ত সোমকে ছেড়ে। তারপর একসময় ডুবে গেছিল অবসাদে। নিজের অনুতাপেই দগ্ধ হয়ে পুড়ে মারা গিয়েছিল। কে জানে পুড়েছিল না পোড়ানো হয়েছিল? আজ করবী থাকলে দেখত সোম কোথায় পৌঁছে গেছে। হয়ত ভালোবাসার যন্ত্রণাই ওকে নিয়ে এসেছে এত দূরে।
**************************
বারান্দায় মরসুমী ফুলের ছড়াছড়ি, আদরে হাত বোলায় মিষ্টি। জোজোর একটা খুব ভালো অভ্যেস আছে যে কোন সেলিব্রেশনে একটা গাছ তো থাকবেই ওর হাতে।
ওর কথায়," গাছ আর সুগন্ধ অনেকদিন মানুষকে মনে রাখায়। এই যেমন সুগন্ধ গায়ে ছড়ালে মনে পড়ে যায় মানুষটাকে। তেমনি গাছে জল দিতে গেলেই মনে পড়ে যায় কে দিয়েছে কেন দিয়েছে। আর তখনই আরেকটু ভালোবাসা বেড়ে যায়।"
" শুধু ভালোবাসার কথা সারাক্ষণ,আর কত আদর চাই শুনি?"
" অনেক অনেক আদর চাই। ভালোবাসায় ভরে থাক আমাদের ভালো বাসা।"
একটা সময় মায়ের কষ্ট দেখেছে জোজো। ওদের সংসারটা ভাঙতে বসেছিল শুধু একটু ভালোবাসা আর ভালো ভাষার অভাবে। ভালোবাসা বাঁচাতে ভালো ভাষারও দরকার হয়। সঙ্গীকে একটু সহানুভূতিতে ভালো কথা বললে সম্পর্কে অন্য মাত্রা যোগ হয়। এটা খুব ভালো বোঝে জোজো। তাই তো মিষ্টির অভিমানকে কখনও ভারী হতে দেয় না,জমতে দেয় না অভিযোগ।
************************
রূপসী আর নেই,দীপ্তর স্বপ্নে আজকাল আর আতঙ্ক ছড়ায় না রূপসী। তবে স্মৃতি বড়ই হিসেবী,ভালো লাগা আর খারাপ লাগাকে চট করে কিছুতেই ভুলতে দেয় না। তবুও দুষ্টু বলে," এবার বেশি বেশি করে ভালো লাগা স্টোর কর। দেখবে খারাপ লাগা ভ্যানিশ হয়ে যাবে। মনে কর আমাদের পুরুলিয়ার প্রথম অনুরাগ। সেই আমরা হাঁটতে গেছি ভোরে উঠে মনে পড়ে?"
দীপ্ত ডুবে যায় মনের গভীর থেকে ভালোলাগা খুঁজে আনতে, মনে পড়ে প্রমিস করেছিল দুষ্টুকে সাথে নিয়ে ডুবে যাবে পলাশরঙা ভালোবাসায়। চা বাগানের সবুজে ছড়িয়ে দেবে পলাশের লাল রঙ।
" সব মনে আছে,তোমার হাতে হাত রেখে দেখবো পলাশের অনুরাগ। নুয়ে পড়ে কুড়াবো পলাশ ভরে দেব তা তোমার আঁচলে। তুমি ছড়িয়ে দেবে রঙ।"
দুষ্টুর মনে উড়ে এসে বসে রঙীন প্রজাপতির দল,বালিশে মুখ ঢুকিয়ে বলে," কত ভালো কথা বল তুমি!"
একটু লজ্জা পায় দীপ্ত, মুঠো ভরে রাখে স্বপ্নগুলো। কে জানে সেগুলো সত্যি হবে কিনা?
মাঝে কেটে গেছে বেশ অনেকগুলো দিন। ভোটের বাদ্যি শেষে জয়পতাকা উড়েছে। রূপসীকে বিদায় করে একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। শিশিরের মুখও খোলেনি তাই এই অঞ্চলের সিটটা পাকা হয়ে গেল ওদের প্রার্থীদের আবার। আকাশে উড়লো অকাল বসন্তের আবীর।
অনেকদিন বাদে নিজের শহরে পা রেখেছে দীপ্ত। তবে এয়ারপোর্টে এসে অবাক হয়ে যায়। স্যারও এসেছেন! নিজের খুশিকে কেন যেন বুকে চেপে রাখতে পারে না দীপ্ত। স্যারের আলিঙ্গনে চোখটা ভিজে যায় বলে ওঠে," স্যার আমি পেরেছি। আমি নষ্ট হয়ে যাইনি। অবশ্য অনেকটাই ওর জন্য।"
দুষ্টুর মুখে পরিতৃপ্তির হাসি। এমন করে কজন স্বীকার করে? আর দীপ্তর এই সরলতাই ওকে মুগ্ধ করে। তবে ও কিছু বলার আগেই বাবা বলে ওঠে," সেই জন্যই তো আমার আদরের মেয়েটাকে নিশ্চিন্তে তোর হাতে..."
বাকি কথাটা বলতে পারে না রবীন। গলাটা আটকে আসে আবেগে। দীপ্ত হাতে হাত রাখে স্যারের। আজ গর্ব হয় সেই শীর্ণকায়, ন্যাড়া মাথা ছোট্ট ছেলেটার জন্য। নাহ্ মানুষ চিনতে ভুল করেনি রবীন। তবে রবীনের শিক্ষায় দুষ্টুও পরশপাথর হয়ে আলো জ্বালাতে শিখেছে অন্যের জীবনে।
এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়ে ওরা অবাক হয়ে যায় ওরে বাবা এ যে পুরো দলবল এসেছে।
" দিদি! তুই আসবি বলিস নি তো? আর এই যে পাজি জামাইবাবু।"
হাসে মিষ্টি," ওর জন্যই তো আসা হল। জানিস তো ওকে। হঠাৎ করে বলল আমরাও যাব। ব্যাস আর কি?"
ততক্ষণে জোজো জড়িয়ে ধরেছে দীপ্তকে," ওয়েলকাম চ্যাম্প। কতদিন বাদে এভাবে জড়িয়ে ধরলাম বল। উঃ কি যে ভালো লাগছে! দারুণ হ্যান্ডসাম হয়েছিস কিন্তু। একদম পাক্বা আইপিএস লুক।"
'' হবে না, যা টাফ ট্রেনিং! উঃ নেওয়াই মুশকিল হয়ে যায়।"
আজ খুব আনন্দের দিন রবীনের একসাথে সবাই হয়েছে কতদিন বাদে। দীপ্তর মাকে আগেই নিয়ে এসেছেন কালচিনিতে। আজ সত্যিই বাড়িটা একদম জমজমাট হবে অনেকদিন বাদে। মিষ্টি বাবার কাছে এসে আদর নেয়। ওরা দুই বন্ধু গল্পে ব্যস্ত।
" তোরা এখন যাবি তো আমাদের সাথে?"
" যাব বাবা,তবে একটু বাদে। তুমি একটা রাঁধুনি বসিয়ে বরং প্যান্ডেল বেঁধে ফেল। আমার শাশুড়িমা মাসিমণি,ভাইয়া সবাই আসছি একসাথে। তোমরা এগোও বাবা আমরা আসছি।"
" তাহলে তো বিয়েটা হয়ে গেলেই হয় এখনি আর কি?" জোজো উৎসাহের সুরে বলেই ফেলে।
দীপ্ত আর দুষ্টুর চোখাচোখি হয়ে যায় চকিতেই। দুষ্টুর চোখ দুটো নেচে ওঠে মজায়। সত্যি এই ছেলেটা একই রয়ে গেল।
ও কিছু বলার আগে রবীনই বলে দেয়," প্যান্ডেল আর রান্নার লোক সব রেডি আছে কারণ গোপন তথ্য এসেছে আমার কাছে আগেই। দেখা যাক কি হয়।"
বাপরে স্যার শ্বশুরমশাই কথা বলেছেন সুতরাং আর কোন কথা নয়। তাই একদম চুপ।
**********************
আয়োজন অবশ্য রবীন করেই রেখেছে আগে থেকে কারণ রাণুই খবর দিয়েছে সব। আর এতদিন বাদে দীপ্ত এল তারপর আবার ওর জন্মদিন। আর কাল মিষ্টির বিয়ের তারিখ সুতরাং পার্টি তো হবেই। তাছাড়া মাস্টারমশাইরা সবাই দেখতে চায় দীপ্তকে সুতরাং মিস্টির ব্যবস্থা হয়েছে ঢালাও।
দিদিরা চলে যেতেই গাড়িতে স্টার্ট দেয় দুষ্টু,অনেকদিন বাদে আজ বাড়ির গাড়িতে ড্রাইভিং সীটে বসেছে। ওরা বসুক সামনে,রবীন পেছনের সীটে গা এলিয়ে দিয়েছেন। মাঝে মধ্যেই দুজনের চোখ মিলে যাচ্ছে। দুষ্টু হেসে আবার মন দিচ্ছে সামনের দিকে। আজ মন উড়ে চলেছে প্রজাপতির মত সবুজ ছাড়িয়ে বহু দূরে।
বাস স্ট্যান্ড আসতেই রবীন নেমে যাবার উদ্যোগ করেন কারণ কিছু জিনিস একটু বেশি করে পৌঁছোতে বলতে হবে।
" বাবা আমি অপেক্ষা করি একটু।"
" না না তোরা যা আমি আসছি।"
বাবাকে আর বলতে পারে না তবুও ঐটুকু ফাঁকেই দীপ্তকে নিয়ে দলছুট হয়ে দুষ্টু উড়ে যায় ভোকাট্টা ঘুড়ির মত।
একটু নিরিবিলিতে গাড়িটা থামায়,নদীর পাশটা বড় সুন্দর লাগছে আজ। চা বাগানে বিকেলের ছায়ার ঠান্ডা পরশ। তার মাঝেই দীপ্তর হাতে হাত রাখে দুষ্টু। দীপ্ত ওকে জড়ায় আদরে। অনেকক্ষণ ধরে হয়ত এই মুহূর্তটাই চাইছিল ওরা। একটু আদরের ছোঁয়া ভুলিয়ে দেয় অনেকগুলো না দেখা দিনের কথা মনে হয় কাছাকাছি ছিল এতদিন।
সন্ধ্যার আগেই সবাই এসে পড়ে। বাড়িতে হৈ চৈ। তার মধ্যে দীপ্ত এসে মায়ের কোলে মাথা রাখে,"কতদিন পরে তোমার আঁচলের গন্ধ আর গায়ের গন্ধ পাচ্ছি মা। কতদিন বাদে তোমায় দেখছি।"
দুষ্টু দেখে ওর মতই দীপ্তও মায়ের স্নেহে ভিজতে চায় অনেকদিন বাদে।
-" তুইও আয় মা,একসাথে দেখি দুটোকে।"
জোজো এসে সব জোগাড় যন্ত্র শুরু করে দেয়। উহ্ কতদিন বাদে একটা সুন্দর গেটটুগেদার। তাই আনন্দে মনটা নেচে ওঠে।
দীপ্তর কেক কাটা হলে ওকে আঙটিটা পরিয়ে দেয় দুষ্টু। আর রবীন একদম শখ করে দুই ছাত্র কাম জামাইয়ের জন্য বানিয়েছেন কমপ্লিট স্যুটের সেট সেটা দেন।
ওদের দেওয়া নেওয়ার মাঝে হঠাৎই দীপ্ত দুষ্টুর হাতে একটা খাম দেয়। অবাক হয় দুষ্টু," কি আছে এতে?"
-" দেখ খুলে।"
খামটা খুলে অবাক হয়ে যায় দুষ্টু," তুমি যে বললে,আরও কয়েকদিন দেরি হবে। অতদূর চলে যাবে আবার?"
সবাই অবাক হয়ে যায়, এমন কি হল?
-" ওর পুরুলিয়াতে পোস্টিং হয়েছে বাবা। দেখ এতক্ষণ চুপ করে আছে বলেনি। বলছে এখনও খবর আসেনি।"
সবাই হৈ হৈ করে ওঠে শুনে।
-"আবার পুরুলিয়া!"
রাণু বলে,"ওহ্ দারুণ হল একদম সবাই মিলে ঘুরে আসবো।
ওদের কথার মাঝে একটু আলাদা হয় দীপ্ত আর দুষ্টু ওদের সেই প্রিয় জায়গাটায়। দীপ্ত ওকে বলে," এমনি তো কথা ছিল। পলাশের রঙ এনে ছড়িয়ে দেব চা বাগানে।"
দুষ্টু ভেসে যায় আবেগের ঘোরে। মন উড়ে চলে যায় আলোর গতিবেগকে অনেক অনেক পেছনে ফেলে তক্ষুণি পুরুলিয়া। পলাশ গাছে হেলান দিয়ে কত কথা বলে ফেলে দীপ্তর সাথে তার মাঝে হঠাৎই ঝরে পরে একটা পলাশ ফুল ওর ঠোঁটে। ওর ভাবনার মাঝে দীপ্তর ঠোঁট ছুঁয়ে গেছে ওকে আচমকাই। নিজেকে আরও কাছাকাছি এনে দীপ্তর কাছে আদরের সুরে বলে ওঠে," আজ জন্মদিন তাই একটু বেশিই আদর করে দিলাম। আর একটা আমার পক্ষ থেকে পুরুলিয়ার জন্য।"
তবে বেশিক্ষণ হারিয়ে যাওয়া হল না ফিরে আসতেই হল। কারণ জোজোদা মানে জামাইবাবু হয়ত এবার হাতেনাতেই ধরবে ওদের যাই হোক সাংবাদিকের চোখ তো।
ওরা আবার যোগ দেয় আড্ডায় জোজো মিষ্টির দিকে তাকিয়ে হাসে। ধরা পড়ে গেছে দুষ্টু,তখনও আবেশ জড়িয়ে ওকে।
অনেকদিন বাদে যেন একটা প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেওয়া সবারই দরকার ছিল। জোজোর অফিসের ঝামেলা নেই। আজকাল উত্তমার মিস কল ঢোকে না খুব একটা। সোমদা উত্তমাকে আলাদা সেকশনে পাঠিয়েছেন। আজকাল প্রোমোশনের পর অফিসের গাড়িই ওকে লিফ্ট দেয়।
দুষ্টুর অনেকটা নিশ্চিন্ত লাগে দীপ্ত এসে যাওয়াতে অন্ততঃ মাসে একটা দিন তো দেখা হবে।
কতদিন বাদে ওদের কালচিনির বাড়িতে সবাই,ঠিক ছোটবেলায় যেমন হত তেমনি মজা করছে।
ওদের কথার মাঝেই দীপ্তর মা বলে ওঠেন," আমি তো ছেলের সাথেই চলে যাব। ও ছাড়া আর কে আছে আমার?"
" আমরা সবাই আছি মাসিমা। আর দুষ্টু তো আছেই।"
" হ্যাঁ ঐ মেয়েই তো সব করেছে এতদিন। ডাক্তার দেখানো ওষুধ আনা সব। তবে এবার ওদের বিয়েটা হয়ে যাক তাড়াতাড়ি।"
জোজো মুখ ফসকে বলতে যায়,বিয়ে তো হয়েই। মিষ্টি ওকে বকুনি দেয়।
ওদের কথার মাঝেই রাণু বলে ওঠে আচ্ছা দুষ্টুর বিয়েটা যদি পুরুলিয়ায় হয় তবে কেমন হয় জামাইবাবু?"
'' কি যে বল? এখানে আমার সব পরিচিত লোকজন। এসব ছেড়ে মেয়েকে নিয়ে যাব ওখানে? তাছাড়া দুষ্টুর অফিসের লোকজন?"
" কেন আমার বিয়ের সময় যায়নি শিলিগুড়ি থেকে বরযাত্রী? এবার নাহয় কনেযাত্রীই যাবে।"
মণিমার কথা শুনে হারিয়ে যায় দুষ্টু কি বলবে বুঝতে পারে না। দীপ্তও ওর দিকে তাকিয়ে হাসে। ওর চোখেমুখে খুশির ছোঁয়া।
দীপ্তর মা হেসে বলেন," তাহলে তো বেশ হয়,একদম অন্যরকম। মানে কনে যাবে কনেযাত্রী নিয়ে বিয়ে করতে। দীপ্তর কাছে যে মেয়েটা কাজ করত ওর খুব ইচ্ছে ছিল দাদাবাবুর বিয়ে দেখার সবসময় বলত কত্ত লাচব গাইব।"
" মা একবার খবর পেলেই চলে আসবে ঠিক দলবল নিয়ে ওরা।"
রবীন হাসে," এখানে মনে হচ্ছে আমার কিছু বলার জায়গা নেই। ভোটে জিতে গেছে প্রস্তাবটা। তাই অগত্যা আমাকে বোধহয় এবার কোচ ভাড়া করতে হবে কনেযাত্রী নিয়ে যেতে।"
বিয়ের আলোচনায় ভেসে যায় সবাই। তার মধ্যেই মিষ্টি বলে," দীপ্তর জন্মদিনের কেকটা কাটা হবে কখন? সবাই বিয়ের আনন্দে ভাসছ। এই বোন কি রে?"
এত জমজমাট একটা জন্মদিন বোধহয় জীবনে কখনও পায়নি দীপ্ত। সত্যিই দুষ্টু ওর না পাওয়া গুলো ভরিয়ে দিয়েছে।
উৎসবের মেজাজ চললো আরও দুটো দিন পরের দিন মিষ্টি আর জোজোর বিয়ের তারিখ সুতরাং সেটাও একটা আনন্দের দিন। মিষ্টির ভালো লাগে এইজন্য যে ওর শাশুড়িমা মানে মামণির কোন ইগো নেই। দিব্যি এখানে এসে হৈ চৈ করে যাচ্ছেন। জোজো বলে একটা সময় মা অনেক আনন্দ হারিয়েছে জীবনে কিছুটা নিজের দোষে আবার কিছুটা ভাগ্য দোষে তাই এখন পুরোটাই চেটেপুটে নিতে চায়।
চা বাগানের সবুজে আনন্দের রঙের ছড়াছড়ি। মিষ্টি প্রেম,ভালোবাসা আর দাম্পত্য সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তার মধ্যেই দীপ্ত পেল স্কুল থেকে কৃতী ছাত্রর সম্বর্ধনা। সবারই মন ভরে গেল,জোজোরও মনে হল এমন ভালো বন্ধু ছিল বলেই হয়ত ও জীবনে কিছু একটা হতে পেরেছে।
দীপ্তর জন্মদিনে সেরা উপহারটা বোধহয় জোজোই দিয়েছে। ওর একদম পুচকে সময় থেকে স্কুলে পড়ার নানা মুহূর্ত তারপর বড় হওয়ার সময়ে খেলায় জেতার ছবি,জীবন যুদ্ধে জেতার ছবি এমন কি রাজকন্যা জেতার ছবিও আছে তাতে। পুরোনো ছবির ঝাঁপি দেখতে দেখতে হারিয়ে যায় দীপ্ত," এত ছবি কোথা থেকে পেলি?"
" এটাই তো আমার কাজ খবরের সাথে ছবি মিলিয়ে দেয়া সেভাবেই পেলাম। অবশ্য অনেকটাই স্যার শ্বশুরের কাছে ছিল। তোকে খুব ভালোবাসে,তাই সব গুছিয়ে রেখেছিল স্কুলে বুঝলি।"
হঠাৎই ওদের কথার মধ্যে ঢুকে যায় রবীন," তোকেও খুব ভালোবাসতাম। কত মিস্টি খাইয়েছি মনে নেই? তারপর তো নিজের মিষ্টি মেয়েটাকেই দিয়ে দিলাম এই পাজি ছাত্রটার হাতে।"
অনেকদিন বাদে আবার পুরোনো দিনগুলো খুব মনে হল জোজোর। আর রবীনের মনে হল এমনি একটা ছেলের হয়ত দরকার ছিল মিষ্টির জন্য। না হলে মেয়েটা হয়ত খারাপ দিকেই চলে যেত। হয়ত যা হয় ভালোর জন্যই হয়।
******************************
আজ প্রথম কাজের জায়গায় এল দীপ্ত,ঝকঝকে কোয়ার্টার। আগে যেখানে থাকত সেটার থেকে অনেক অনেক ভালো। মা তো বলেই ফেলেছে," এত বড় জায়গায় মাত্র দুজনে থাকব কি করে বাবা? তাড়াতাড়ি বিয়ে কর। এখানে কত কাজের লোকজন আমাকে তো কিছুই করতে হবে না।"
" কেন করবে মা? সারাজীবন কি শুধু কষ্টই করবে নাকি? আর বিয়ে করে যাকে আনবো মানে তোমার ঐ দুষ্টু বৌ। সে কি আমার কাছে বসে থাকবে? তার অফিস নেই নাকি? সেও তো মস্ত বড় অফিসার।"
হেসে ফেলে দীপ্ত এবার, তারপর আবার সিনিয়রও।
মা আদরের স্বরে বলে," যা হয় হোক বদলি নেবে না হয়। আর কিছুদিন বাদেই বিয়েটা হোক। আমি বলেই এসেছি রবীন বাবুকে দিন দেখতে। আর কিছু শুনব না আমি।"
" বেশ যা খুশি কর তুমি আমি একটু কাজ বুঝে নিই এবার।"
ছেলেকে দেখে চোখটা ঝাপসা হয় মায়ের। সেই জীর্ণ শীর্ণ একহারা ছেলেটা আজ আইপিএস অফিসারের পোশাক পরেছে। চোখদুটো যেন দেখতেই চায় আর দেখতেই চায়। মায়ের পায়ে হাত দেয় দীপ্ত। মায়ের আশীর্বাদে ভরে ওঠে মনটা। হঠাৎই ফোনটা বেজে ওঠে,মানে বাজবেই এটা তো জানা।
ভিডিও কলে এসেছে দুষ্টু।
-" একবার ভালো করে দেখতে দাও তোমাকে। দেখি কেমন মানিয়েছে।"
- " দেখ তবে তাড়াতাড়ি, গাড়ি এসে যাবে এক্ষুণি।"
-" বুঝেছি,কালচিনির দুষ্টুর জন্য আর সময় নেই আইপিএস দীপ্তময়ের।"
-" তুমি যদি একবার এসে দাঁড়াও ঐ দূরের পলাশ তলায় মাথায় জড়াও লাল পলাশের মালা।
আমি ভুলেই যাব কোথায় কি কাজ আছে,
মন বলবে সব ছেড়ে আজ পালা।"
-"ইশ্! পুলিশের মুখে কবিতা!"
-" কেন পুলিশরা কি প্রেম করতে পারে না?"
ওদের খুনশুটির মাঝেই দুষ্টু অ্যাড করে নেয় বাবাকে। জানে বাবার কতটা ভালো লাগা জড়িয়ে আছে দীপ্তকে নিয়ে। মুগ্ধ চোখে দেখেন রবীন আর ভাবেন সত্যিকারের শিক্ষা হয়ত কখনও বিফলে যায় না।"
বাইরে গাড়ির শব্দ শোনা যায় কথা বলতে বলতেই গাড়ির সামনে আসে দীপ্ত,"আসি স্যার।"
-" জয়ী হও জীবন যুদ্ধে।"
দেখতে দেখতে একটা সপ্তাহ কেটে গেছে অনেকটাই কাজ বুঝতে এর মধ্যেই এসেছে একটা দুটো চ্যালেঞ্জও। তবে আগের চাকরিটা দীপ্তকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। তাই হয়ত এখানে কাজ করতে অনেকটা সুবিধা হয়েছে। সেদিন অফিসে বসে আছে হঠাৎই বাইরে একটু গন্ডগোল শুনতে পায় দীপ্ত। তবে দুটো তিনটে ধাপ পেরিয়ে ওর সাথে দেখা করতে যারা এসেছে তাদের দেখে অবাক হয়ে গেল।
আগের কোয়ার্টারে ওরাই সামলাত দীপ্তর সংসার আর তার সাথে অফিস কলিগও। বুঝতে পারে ওদের মারফতেই খবর পেয়েছে ওরা। হঠাৎই নিরাপত্তার বেষ্টনী পেরিয়ে আবেগের স্রোতে ভাসলো দীপ্ত।
********************
মাঝে কেটে গেছে বেশ কয়েকট মাস,শীতের ছোঁয়া কাটিয়ে পলাশের ডালে ডালে মধুপের আনাগোণা। কুঁড়ি থেকে কদিন বাদেই ফুটবে ফুল। কৃষ্ণ,বেবি আর রাণুর তৎপরতায় রবীনকে মেনে নিতে হয়েছে সবার আব্দার। দীপ্তর বিয়েটা পুরুলিয়া থেকেই হচ্ছে। প্রথমে কৃষ্ণ বলেছিল," মামার বাড়ি থেকেই হোক বিয়েটা রবীনদা। তুমিও তো এখানেই বিয়ে করেছিলে। আমরা আবার একটু আনন্দ করব মানে বাড়ি আবার সাজবে।"
তবে দীপ্ত একটু আপত্তি করেছিল," মামু বিয়েটা তো পুরুলিয়াতেই হচ্ছে কিন্তু জায়গাটা যদি আমি ঠিক করি তুমি রাগ করবে না তো?"
কৃষ্ণর প্রথমে একটু কিন্তু কিন্তু মনে হলেও জায়গাটা দেখে আর কিছু বলতে পারেনি। অনেক আগে এসেছিল এদিকটা। কিন্তু এত ভালো যে একটা রিসর্ট হয়েছে একদম পাহাড়ের কোলে আর লেকের আঁচলের কাছে তা ভাবেতেই পারেনি। এইটুকু স্বাধীনতা দেওয়াই যেতে পারে ছেলেটাকে।
ছবি দেখে মিষ্টি লাফাতে থাকে," তুই যে এত রোমান্টিক তা তো আগে বুঝিনি। ইশ্ কি দারুণ জায়গাটা। এত বার পুরুলিয়া গেছি কিন্তু ওখানে তো যাইনি কখনো।"
হাসে দীপ্ত," বন্ধুর কাছ থেকেই শেখা সব। ওর শালীর যাতে কোন অভিযোগ না থাকে দেখতে হবে তো? অফিসের কাজে এসেছিলাম এদিকটায় কিছুক্ষণের ব্রেক নিয়েছিলাম। তারপর সত্যিই ভালো লেগে গেল জায়গাটা।"
- " আমি তো ভেবেছিলাম দুই অফিসারের বিয়ে হয়ত উদয়পুর প্যালেস বা অন্য কোথাও হবে।" মজার সুরে বলে মিষ্টি।
-" তুই তোর বোনকে তো জানিস একদম মাটির গন্ধ মেখে মাটির কাছাকাছি থাকতে ভালোবাসে। ওর প্রেম মানেই তো চা বাগান আর পলাশ।"
সেই প্রথম প্রেমের মঞ্জরী ফোটার দিনেই যে কথা দিয়েছিল দুষ্টুকে তা আর বলতে পারে না দীপ্ত এক মনে শোনে মিষ্টির কলকলানি," ওখানে ময়ূরও আছে? কত পাখি রে ওখানে।"
" বিয়ের কদিন ওখানেই তো থাকবি,সব দেখবি একটু একটু করে।"
-" ওহ্! আমার খুব ভালো লাগছে। বোনকে দেখ এখনও অফিস আর কাজ নিয়ে ব্যস্ত।"
কাজের গুরুত্ব নিজেও বোঝে দীপ্ত আর ও ভালো করেই জানে কদিনের ব্রেক নেবে দুষ্টু তাই সব গুছিয়ে নিচ্ছে।
সব কিছু গোছানোর ফাঁকে একদিন একটু যেতেই হয়েছে বাজারে। যদিও দিদির বায়না ছিল কলকাতা যাবার কিন্তু হল না। শিলিগুড়িতে সব পাওয়া যায় এখন। তবুও দিদিকে একদম বলে দিয়েছে," তোর বিয়েতে সব করেছি আমি এবার তুই বাজার করবি।"
জোজোকে নিয়ে একটু একটু করে গুছিয়ে সব কিনেছে মিষ্টি। মাঝে একদিন দীপ্তও এসেছিল,ওরা দুই বন্ধু মিলে সেদিন কেনাকাটা করেছে। ওগুলো নাকি প্রাইভেট কেনাকাটা তাই মিষ্টি বাদ। অবশ্য এইটুকু স্বাধীনতা ওদের দেওয়াই যায় পরে দেখা যাবে কি কিনেছে?
রবীনের ছাত্রদল ছড়িয়ে আছে চারদিকে সুতরাং ট্রেনের দুটো কোচ মোটামুটি ওদের জন্য রাখা হয়েছে। সবার আনন্দের কোলাহলে ভরেছে স্টেশন। শেষ মুহূর্তেও দুষ্টু কিছু কাজ সেরে নিয়ে দিব্যি লাল কুর্তা আর হলুদ পাজমায় উঠে পড়ে ট্রেনে।
রবীন মজা করে বলল," মেয়ের বিয়ে দিতে যাচ্ছি না বেড়াতে যাচ্ছি কে জানে?"
রাণু বলে," বেড়াতেই তো যাচ্ছি। এখানে কনে কোথায় কেউ বুঝবে না। আর আমাদের কনে তো বিয়ে করতে যাচ্ছে।"
- " তোরা আর ওকে মাথায় তুলিস না। কে বলবে দুদিন বাদে বিয়ে?"
-" মা সবচেয়ে মজা তো তোমার, দীপ্ত ওখানে সব ব্যবস্থা করেছে তুমি শুধু অর্ডার দেবে আর চলে আসবে।"
রবীনের সাথে তেমনি কথা হয়েছে দীপ্তর একদম যৌথভাবে একসাথেই গায়ে হলুদ,বিয়ে,বৌভাত এমন কি ফুলশয্যা করেই সবাই ফিরবে।
***********************
দুষ্টুর অবস্থা এখন শ্রী রাধিকার মত। অনেকটা পথ পেরিয়ে উত্তরের সবুজ থেকে ছুটে আসা লাল পলাশের দেশে শ্রীকৃষ্ণের সাথে মিলনের আকাঙ্ক্ষায়। তবে মিলনের আশায় তো প্রাণ যায় যায় অবস্থা। তবে সারাটা রাস্তা ভীষণ ভীষণ ভালো কেটেছে। পুরুলিয়া স্টেশন থেকে একদম দীপ্তর পাকা বন্দোবস্ত।
রুক্ষ উষর পথ পেরিয়ে বসন্তের পুরুলিয়া মন ভরিয়ে দেয় দুষ্টুর। পাহাড়ের বুকে লাল মাটির আলপনা। কোথাও টিলা,আবার কোথাও বা একটু উঁচু পাহাড়। তার মধ্যেই মাঝে মাঝে দিগন্ত বিস্তৃত ফাঁকা মাঠ। কোথাও মাথা উঁচু করে রেখেছে কিছু গাছ। আবার কোথাও শিমুল পলাশ বলছে লালিমায় লাল হয়ে বসন্ত এসে গেছে।
জোজো দুষ্টুর কানে কানে বলে," নেশা নেশা লাগছে তাই না? "
হঠাৎই মুঠোফোনে গানটা বেজে ওঠে নেশা লাগিল রে। লজ্জা পায় দুষ্টু কিন্তু হার মানে না," কার নেশা লেগেছে কে জানে? গাড়িতে বড়রাও আছে কিন্তু।"
রবীনের মনেও আসে অতীতের সুখস্মৃতি পলাশের পথ বেয়ে,অনুর দিকে তাকায়," এই বেশ ভালো বল। একটু অন্য রকমের বিয়ে। দুষ্টুটা তো আমাদের ছেলের মতই।"
কথাটা বলেই বুকটা কাঁপে রবীনের একটা সময় দুষ্টুকে কত অবহেলা করেছে অনু। আর আজ সেই মেয়ে নয়নের মণি।
পাহাড় জঙ্গল আর লাল মাটির পথ বেয়ূ গাড়ি এসে দাঁড়ায় পাহাড়ের কোলে আদরে বসে থাকা রিসর্টের সামনে যার পা ধুইয়ে দেয় আদরূ গাঢ় সবুজ রঙের লেকের জল। একরাশ নিস্তব্ধতা চারদিকে।
হঠাৎই নিস্তব্ধতা ভাঙে ওদের কোলাহলে। অপর প্রান্ত থেকে বেজে ওঠে আদিবাসীদের ঢাকঢোল আর ওদের বাজনার সুর। দুষ্টুর মনে তখন মহুয়ার মাতাল করা গন্ধ আর কানে বিয়ের বাজনার সুর।
সবুজ ঘাসে পা ডোবায় ওরা শুধু দুষ্টুকে নামতে দেয়না বরপক্ষ। বৌ হেঁটে যাবেক তা হবার লয় সুতরাং দুষ্টুর জন্য আসে একটা রঙ বেরঙের পালকি। ওরা ওর হলুদ ওড়নাটা জড়িয়ে দেয় ওর মাথায়। মিষ্টি বলে," নে একদম ফুল এসেন্স বিয়ের। দীপ্তটা যে এত রোমান্টিক জানা ছিল না।"
রিসর্টের কটেজ আর তাবু গুলো এখন পুরোটাই ওদের। দুষ্টুকে নিয়ে ওরা নামিয়ে দেয় বোগেন ভেলিয়ার আদরে ঘেরা সাজানো তাবুর সামনে। অবাক হয়ে যায় দুষ্টু। এতক্ষণ বুঝতে পারেনি কিন্তু এখন দুষ্টুর কেমন যেন সব অন্যরকম লাগছে। কিন্তু দীপ্ত কোথায়? ওদেরকে জিজ্ঞেস করে দীপ্তর কথা। জানতে পারে দীপ্ত কি একটা কাজে গেছে। অবাক হয় দুষ্টু পরশু ওর বিয়ে তার মধ্যে এখনও কাজ করে যেতে হচ্ছে। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক।
জায়গাটা দেখে অবাক হয়ে যায় রবীন ঠিক যেন মনে হচ্ছে এক টুকরো স্বপ্নের স্বর্গে পা রেখেছে ওরা। খাওয়া দাওয়া কোন কিছুতেই কোন ত্রুটি রাখেনি দীপ্ত। এতটা ভালো ব্যবস্থা হতে পারে ভাবতেই পারেনি। কুচোকাচা গুলো আর তার সাথে মিষ্টিও পা ভিজিয়েছে সবুজে। পাশে ঘুরছে দুঃসাহসী ময়ূর,কারণ ওদের কোন ভয় নেই মানুষ দেখে। ওরা বোধহয় অভ্যস্ত মানুষের সঙ্গে থাকতে। হাঁস মুরগী,ময়ূয,কোয়েল সবই ঘুরে বেড়াচ্ছে আপন খেয়ালে। লাল পলাশে আর শিমুলে বসন্তের হাতছানি। টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে পলাশের পাপড়ি মাটিতে। দুহাতে তুলে এনেছে কিছুটা অনুও,রবীনের হাতে দিতে চায়।
" তুমি না শাশুড়ি? এখনও ফুল কুড়োচ্ছো!"
হাসে অনু," আমি ফুল কুড়োচ্ছি তাতেই বলছ? ওদিকে তোমার শালীরা আর মেয়ে তো কুল কুড়োতে ব্যস্ত।"
ওদিকে থেকে রাণু ডাকে জামাইবাবুকে," ও জামাইবাবু, গাছটাকে একটু নাড়া দিন না। পড়ছে না তো ভালো করে কুল গুলো।"
" ইশ্ শাশুড়িদের কি অবস্থা!" ওদেরকে বললেও রবীনও ফিরে যায় নিজের ছোটবেলায়। মনে পড়ে ওদের বাকুড়ার বাড়িতে এমন একটা কুল গাছ ছিল। কুলের টকমিষ্টি স্বাদে ছেলেমানুষ হয়ে উঠেছে মেয়েগুলো। তার মধ্যেই মিষ্টির পেছনে লেগে পড়েছে ওরা,"কি ব্যাপার বল তো শুনি?তুই প্রথম এই কুলের সন্ধান পেয়েছিস কি খবর? কিছু খবর আছে নাকি তোর?"
জোজো ফটো তুলে ক্যামেরা বন্দী করে। বাইরে তখন সূর্যদেব অস্ত যাবার উদ্যোগে আর সেই আনন্দে তার রাঙা রঙে আকাশে তুলি বুলিয়েছে।
বসন্তের কোকিলের ডাক আর ফিঙের নাচে আনমনা হয় দুষ্টু বারবার। বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে ওর সাজানো অন্দর থেকে। হঠাৎই গাড়ির আওয়াজে বুঝতে পারে দীপ্ত আসছে। সামনে থেকে ওর ভালোবাসার আইপিএসকে দেখার লোভ সামলাতে পারে না দুষ্টু। আর কোন বারণই শোনে না অবাধ্য পা দুটো সত্যিই তো কতদিন দেখা হয়নি। কাজের গুরুত্ব আর পদের পদমর্যাদা দীপ্তকে অনেকটাই পরিণত করেছে। জোজো গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরেছে," শ্যাম বিহনে তো রাধার প্রাণ যায় যায়।"
সত্যিই এবার নেশা লাগে দুষ্টুর,নেশা হয়ত দীপ্তর চোখেও। আর প্রকৃতিতে তখন বসন্তের নেশা।
রাত্রি বেলায় মাসি আর মামী মামুরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে সব গোছাতে। আর তো হাতে মাত্র একটা দিন। তারপর কাল অনেক কাজ আছে। যদিও দীপ্ত সবটাই ব্যবস্থা রেখেছে। মনে হচ্ছে না পাওয়া কোন জিনিসই নেই। সব পেয়েছির দেশে ওরা এসে পড়েছে। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের হাতে দায়িত্ব দিয়ে সবটা করিয়ে নিয়েছে ওরা। শুধু গন্ধটা একদম মাটির গন্ধ।
হঠাৎই সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে বাইরে হৈ চৈ শুনে আর দেরি নয় ওরা এসে পড়েছে। অবাক হয় দুষ্টু কারা এসেছে। জোজো ডাকে," আয় দেখে যা, ওহ্ আমার তো দারুণ লাগছে।"
ছৌ নাচও আছে! ওরা সবাই অবাক হয়ে যায়।
রবীন হাসে," হ্যাঁ, আমাদের সংস্কৃতি কি কম সমৃদ্ধ! আজ ওদের রঙে আরও মধুর হবে আমাদের উৎসবের রঙ।"
দিদি যদিও বারবার বলে দিয়েছে," কাল থেকে আর অত প্রেমটেম করা যাবে না। নতুন বৌ হতে যাচ্ছ তাই তাবুতেও থাকতে হবে আটকে। অত লাফালাফি কিসের শুনি?"
তবে দুষ্টুর মনে রঙ লেগেছে তাই আজকের রাতের আনন্দকে একদম মুঠোতে ভরতে চায় আদরে। দুর্গা মা,সিংহ সবাই এসেছে। ওদের নাচে ভরে উঠেছে আনন্দে রিসর্টের পরিবেশ। ভাই বোনরা খুব খুশি। মণিমা বারবার বলছে সত্যিই এমন একটা বিয়ে সারা জীবন মনে থাকবে।
দীপ্তর চোখে দুষ্টুমি,দুষ্টুর চোখে মুগ্ধতা। আজ দুষ্টুর গভীর চোখদুটো বলছে এত কিছু পারো তুমি!
বাঘমুন্ডী পাঁঠা রান্নার গন্ধে ম ম করছে চারধার। নাচে গানে আর আড্ডায় সবাই ভরপুর। ওদের আনন্দের ফাঁকে দুষ্টু আর দীপ্ত হারিয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য পূর্ণিমার চাঁদের আলোয়। পাহাড় থেকে রাতজাগা ময়ূর ডাকে বারবার ময়ূরীকে। আর ওদের ডাকের মাঝেই কখনও কিচকিচ করে ওঠে পাখির দল আনন্দে। দুষ্টু মাথা রাখে দীপ্তর কাঁধে," এত কিছু করেছ কি করে?"
" কোনদিন তো তেমন কিছুই দিতে পারিনি স্যারকে তাই আজ ওঁর রাজকন্যাকে ভরিয়ে দিতে চাই।"
একটু নকল অভিমানের সুর ঝরে দুষ্টুর গলায়," সব তাহলে স্যারের জন্য আমার জন্য নয়।"
দীপ্ত দুষ্টুর হাত ধরে," পাগলী সবই তোর জন্য।"
দুষ্টুর হাসিতে ঝর্ণার সুর হঠাৎই খ্যা খ্যা করে আরেকটা হাসি শোনা যায়," ধরে ফেলেছি দুটোকে। দেখেছো কি কান্ড! তাবুর পেছন দিয়ে পাহাড়ের আঁচলে বসে প্রেম।"
" হ্যাঁ একটু গল্প করে নিই। এরপর তো ওগো শুনছ করেই দিন কাটবে।" ওদের হাসিতে কাঁপে পাহাড়। মিষ্টি আর ভাইবোনেরা এসে যোগ দেয় ওদের মাঝে। রবীন অনু আর দীপ্তর মা তখন বিয়ে নিয়ে গভীর আলোচনায় ব্যস্ত। "আজ যে বড় আনন্দ লাগছে দাদা। প্রথম যখন ওকে আপনার স্কুলে দিই সেদিন বলে ছিলাম যেমন দাদা দেখবেন ছেলেটাকে। আপনার ছেলে বলেই ভাববেন। আজ সেটা পুরোপুরি সত্যি হতে যাচ্ছে।"
রবীন অনুকে বলে," দেখেছ অনু আমার সন্তানেরা কোথায় কোথায় আছে? তারা ব্রতী এখন নানান কাজে।"
***********************
দিদির আর মণিমার অর্ডার এবার একটু শাড়ি পরে বৌ বৌ হতে হবে কারণ কাল বিয়ে। পাশের গ্ৰাম থেকে ওরা এসেছে দল বেঁধে ওদের নাচে যোগ দেয় মিষ্টিও। গতকাল থেকে নানান আয়োজন করেছে দীপ্ত। অনেকদিন বাদে লাল হলুদ শাড়িতে সেজে মিষ্টিকে নাচে পা মেলাতে দেখে খুব ভালো লাগে জোজোর। একটা সময় এই হাসিটা মিস্ করত ওর। নাচ গান আর হুল্লোড় এর মধ্যেই দুষ্টুর হাতে লাগে মেহেন্দীর রঙ। কাল সারা শরীর মাখবে হলুদ রঙ দীপ্তর অনুরাগে।
দীপ্তর আত্মীয়স্বজন কম তাই ভাগাভাগি করে ওরাই সব সামলে নিচ্ছে। সবাই খুশি,লেকের জলের হাঁসেদের সাথে ওদের কলকল্লোলে ভরেছে পুরো জায়গাটা। সানাইয়ের সুরে মনটা কেমন যেন করে রবীনের। আজ অনেকবারই মেয়েদের আর অনুর চোখে জল দেখেছে রবীন। মন হয়েছে ভারাক্রান্ত ওহ্ কেন যেন সব জেনেও মন ভালো লাগে না একটুও। মেয়েগুলো কত বড় হয়ে গেল,ওরা পর হয়ে যাবে। দুষ্টুকে সে কথা বলতেই বাবার গলা জড়িয়ে ধরে দুষ্টু," বাবা আমি তো তোমার কাছেই থাকব যেমন ছিলাম। তুমি একটুও মন খারাপ করো না।"
অনু বুঝতে পারে কতটা বুঝতে শিখেছে মেয়েটা। তবুও ওরা চারজন আজ আবার নিজেদের মধ্যে কত কথা বলে মন খুলে। দুই মেয়েকে আরেকবার বুকে জড়িয়ে ধরে অনু।
গায়ে হলুদ মেখে নিজেকে একদম অন্যরকম লাগে দুষ্টুর। দিদি ফোনে দীপ্তর হলুদ মাখা ছবি দেখায়। হাসে দুষ্টু,"ইশ্ ধুতি পরে হলুদ মেখে।"
" ছবি দেখেই আজ খুশি থাক,একদম রাতে পানপাতা সরিয়ে মুখ দেখবি।"
গোরুরা পায়ে ধুলো উড়িয়ে ঢাকে আকাশের লাল রঙ। আকাশে সূর্য পাটে যাবে একটু বাদেই। গোধূলি নামছে। দুষ্টুর বিয়ে গোধূলি লগ্নে। বৌয়ের সাজে দুষ্টুকে দেখতে একদম অন্য রকম লাগছে। অনু অবাক হয়ে যায় দেখে এত সুন্দর ওর মেয়েরা! অথচ একটা সময় দুষ্টুকে মিষ্টির পাশে দেখতে গিয়ে অনুর মনে হত মেয়েটা কালো হয়েছে। আজ যেন ওর রূপে লজ্জা পেয়েছে ঐ লাল পলাশ।
সবুজ মাঠের মাঝে বিয়ের মন্ডপ সাজানো হয়েছে। দীপ্তকে নিয়ে আসার কিছু বাদেই দুষ্টুকে নিয়ে আসে ওরা। আজ জোজো ওকে পিড়িতে আনতে আনতে ভাবে,একটা সময় হয়ত ওর কিশোরী মনে ওকে ভালোবেসে ফেলেছিল মেয়েটা। কিন্তু এখন শুধু ওর বলতে ইচ্ছে করছে রব নে বনা দে জোড়ি। সত্যিই দুষ্টু দীপ্তর জন্য। লাল বেনারসীতে সেজে মুখে পানপাতা দিয়ে আড়াল করেছে দুষ্টু। বাবার খুব ইচ্ছে বাঙালী আচার অনুষ্ঠান সব হোক তাই মালাবদল,শুভদৃষ্টি আর সাতপাকে সাতজন্মের বন্ধনে দীপ্তকে বাঁধলো দুষ্টু। সাজুগুজু আর আনন্দে খাওয়া দাওয়ায় ভরলো বিয়ে বাড়ি। মংলু,ফুলিয়ারা মাতলো আনন্দে। নাচে গানে আর সানাইয়ের সুরে এ যেন এক অন্য বিয়ে বাড়ি। দীপ্তর হাতে হাত রাখলো দুষ্টু,রবীনের মনটা কাঁপলো। দুষ্টুর চোখের পাতা ভারী হল। তবে দীপ্ত আদরে আর নির্ভরতায় ধরলো সেই হাত।
মিষ্টি ,মণিমা,ছোট মাসি,মামী সবাই ব্যস্ত নানান কাজে। অনু তখন টেন্টের বারান্দায় বসে গোল রূপোর থালার মত চাঁদের পানে চেয়ে মনে করে কত পুরোনো কথা দীপ্তর মায়ের সাথে বসে.." কি অদ্ভুত নিয়ম দেখেছেন দিদি। মায়েদের নাকি বিয়ে দেখতে নেই।"
পলাশ শিমুল আর মন্ত্রকে সাক্ষী করে দীপ্ত আর দুষ্টুর গাঁটছড়া বাঁধা হল। সিঁদুরের রঙের লালিমায় ভরলো দুষ্টুর সিঁথি। সুন্দর মুহূর্ত বন্দি হল জোজোর ক্যামেরায় মত্নে। সত্যিই বোধহয় দুষ্টু একটা সময় কখনই ভাবেনি এই ছেলেটাকে ও ভালোবাসবে। হয়ত নিয়তি ওপরে বসে গল্প লেখে নিজের মত করে। পাল্টে যায় চেনা গল্প অচেনা গল্পেরা নেমে আসে মানুষের জীবন সাজাতে।
দুষ্টু কাল চলে যাবে, যদিও প্রথমে ঠিক হয়েছিল সব সেরেই একদম যাবে ওরা কিন্তু দীপ্তর মায়ের খুব ইচ্ছে দুষ্টুর পায়ের ছোঁয়া পড়ুক দীপ্তর নতুন বাসস্থানে। যদিও বৌভাতের অনুষ্ঠান এখানেই হবে তেমনি ব্যবস্থা করা আছে। দূরত্ব খুব একটা নয় কাছাকাছিই তবুও অনুর চোখ ভরে মেয়েকে বিদায় দিতে। চোখে জল আসে মিষ্টিরও।
-" আচ্ছা এত কাঁদছো কেন তোমরা? কালই তো চলে আসবে। আর আমরা তো যাচ্ছিই সাথে নাকি?"
জোজোর কথা শুনে কৃষ্ণ বলে," ও বুঝবে না তুমি জামাই ছেলেপুলে হলে বুঝবে।"
মামার কথা শুনে হাসে জোজো সত্যিই বোধহয় মা বাবাকে অনেক কিছু সইতে হয়। যে পরিশ্রম আর সময় দিয়ে যত্ন করে ওঁরা আমাদের প্রতিপালন করি তার কিছুই ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয় না। বরং অনেক ক্ষেত্রে সুখের বদলে অশান্তি টুকুই তারা পান।
অল্প একটু পথ হলেও আজ ওরা পরম নির্ভরতায় একে অপরের হাত ধরে সবুজ মাঠে পা রেখেছে গাড়িতে ওঠার জন্য। দীপ্তর মনের ভালোলাগার ঘুড়িটা আজ লাগামছাড়া বাতাসে উড়ছে আনন্দে। আর ভয়ে ভয়ে দেখা নয়, নিজেকে গুটিয়ে রাখা নয় এবার দুষ্টুর সাথে খোলামেলা প্রেম করতে পারবে। তারপরেই ভাবে কে জানে প্রেমটা হবে তো? নাকি কাজের চাপে সবই যাবে?
দীপ্তর হাত ধরে ওর নতুন বাসায় পা রাখে দুষ্টু। আসেপাশের প্রতিবেশীরা ভিড় করেছে নতুন বৌ দেখতে। অবশ্য কনেযাত্রীদের কয়েকজন এখানেও এসেছে তার মধ্যে অবশ্যই আছে জোজো আর মিষ্টি।
কোয়ার্টারে পলাশ গাছে ফুল ফুটেছে তার পাপড়ি ঝরে পড়েছে মাটিতে। আলতো পায়ে হাঁটে দুষ্টু। শ্বেতপাথরের থালায় দুধে আলতায় ভাসছে পলাশের পাপড়ি। থমকে যায় দুষ্টু, এমন তো কখনও দেখেনি। কি করবে বুঝতে পারে না। ওপাশ থেকে জোজো বলে," চলে আয় পলাশে পা ডুবিয়ে চিরবসন্তের ছোঁয়া দিতে আমার বন্ধুর রুক্ষ জীবনে।"
পলাশ ছড়ানো মেঝেতে দুষ্টু পা রাখে ওর নতুন সংসারে। পরিপাটি ছবির মত করে সাজিয়ে রেখেছে দীপ্ত সবটাই একদম মনের মত করে।
দুষ্টুকে নিয়ে যায় ওরা দীপ্তর মায়ের কাছে, আদরে ছেলে বৌকে নিজের করে নেন। তবে দুষ্টুকে যে ঘরে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে গিয়ে ও অবাক হয়ে যায় দীপ্তর পাশে ওরও ছবি। কিন্তু এই ছবিগুলো কখন তোলা হয়েছিল?
" হয়েছিল তোলা গোপনে, এবার দীপ্ত সেগুলো নিয়ে এসেছে আমার কাছ থেকে ঘর সাজাবে বলে।"
ঘরের আনাচে কানাচে তখন ফ্রেমবন্দী প্রেম। অবাক হয়ে দেখে দুষ্টু,দিদি বলে "দেখে নাও যত খুশি। আজ রাতে আর বরের দেখা পাবি না। যদি কোন কথা থাকে সেরে নে। আমি সময় দিলাম। "
দীপ্তর চোখে তখন জয়ের হাসি দুষ্টুর মনকে জিতে নিয়েছে হয়ত এবার। আসলে শরীর জেতা যেমন সহজ মনকে জেতা বড়ই কঠিন। তাই আগে মনকে মনের কাছে আনাটাই জরুরী।
-" দুষ্টু বলে,এসব কখন ভেবেছ? আমি তো ভাবিইনি এত।"
-" যখন তুমি কাছে ছিলে না তখন ভেবেছি। আর এরপরও তো এই ছবি দেখেই আমায় থাকতে হবে। কদিন আর কাছে পাব?"
-" কালই কাছে পাবি,এখন চল বাইরে। আমার বোন এবার বিশ্রাম নেবে। দুই বন্ধুই সমান। এটাকে ভেবেছিলাম ভালো। ও মা বৌ ছেড়ে নড়তেই চায় না।"
-" দিদি তুই নিজেই তো এমন,বরকে চোখে হারাস।"
ওদের খুনশুটিতে ভরে ওঠে দীপ্তর একলা থাকা কোয়ার্টার নতুন গন্ধে।
লেকের দিকে তাকিয়ে উদাস লাগে মনটা রবীনের। আজ বড় ফাঁকা ফাঁকা উৎসবের রেশ শেষের দিকে। কাল বৌভাতের পর,আরও একটা দুটো দিন শ্বশুরবাড়িতে একটু গিয়ে ফেরা নিজের কাজে। মাঝে থেকে গেল কয়েকটা দিন স্মৃতির সিন্দুকে যত্নে।
*************************
গতকাল রাতে ভালো করে ঘুম আসেনি দুষ্টুর। মনটা চঞ্চল হয়েছে। দিদি আর মণিমা এখনও ঘুমোচ্ছে। পাশের জঙ্গলে পাখিরা অনেকক্ষণ জেগে গেছে। টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে শিমুল পলাশ। ছোট্ট একটা বাচ্চা ছেলে যত্নে কুড়োচ্ছে লাল পলাশের ফুল।
পা টিপে টিপে ওর কাছে এসে দাঁড়ায় দুষ্টু। ও একটু চমকে যায় তারপর বলে," ঐ পুলিশটো তোর কে?"
দুষ্টুর চোখে দুষ্টুমি খেলে," কোন পুলিশ?"
-" তুই ওর বৌ আমি জানি।"
-" তুই তো খুব দুষ্টু তোর নাম কি?"
ও ছুটতে ছুটতে বলে যায় ভুলুয়া।
-" ও শিবুয়ার ছেলে।" দীপ্ত যে কখন এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারেনি দুষ্টু। সাদা পাজামা আর লাল পাঞ্জাবি পরে ওকে খুব ভালো লাগছে।
-" এত তাড়াতাড়ি উঠলে যে?"দুষ্টু জিজ্ঞেস করে।
-"ঘুমের বারোটা বাজিয়েছে কালচিনির মেয়েটা। তাকে স্বপ্ন দেখেই রাত কেটে গেল। তারপর আজ তো আবার যেতে হবে ওখানে। আজকের রাতটা ওখানে থেকেই। মানে আজ তো আমাদের একসাথে থাকা।"
দীপ্তর কথা শুনে একটু লজ্জা পায় দুষ্টু কি সব বলছে যেন আজকেই শুধু একসাথে থাকা।
ওরা দুপুরেই চলে আসে সবাই। ওদের দেখে রবীনেরও ভালো লাগে। যাক এবার আবার সব ঠিকঠাক লাগছে।
মিঠে টিপটিপ জোনাকির আলোর সাজে সেজেছে রিসর্ট। আজ ছৌ নাচের সবাই আমন্ত্রিত। ওদের নাচ দেখতে বসেছেন অনেকেই। দুষ্টুর পরনে আজ পলাশ রঙের আগুন ঝরানো স্বর্ণচরী। পাতলা শাড়ির জড়ির সুতোর ফাঁকে ফাঁকে মিশে আছে আজ সোহাগের রঙ। খোঁপায় পলাশের মালা,হাতে পলাশের বাহুবন্ধনী। সিঁথির গাঢ় সিঁদুরের রঙ আগুন জ্বালিয়েছে দীপ্তর মনে। আজ বারবারই দেখতে ইচ্ছে করছে দুষ্টুকে।
সেই ডাকাবুকো মেয়েটা যে বেশিরভাগ পেয়ারা গাছে উঠে বসে থাকত সে আজ ওর জীবনসঙ্গিনী। হয়ত দুষ্টু না থাকলে জীবনের লক্ষ্যে কখনই পৌঁছনো হত না। আজ দীপ্তর চোখে একরাশ মুগ্ধতা। তার মধ্যেই বারবার ওর পেছনে লাগছে দুই বন্ধু।
" আমাদের সবার দাবী কিন্তু মানতে হবে। নাহলে আজ ঘরে ঢুকতে দেওয়া হবে না।"
দীপ্ত পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করতে করতে বলে," এ মন আজ বাঁধনহারা আর কোন বাঁধাই সে মানবে না। নে মানিব্যাগ দিলাম,আর কি চাই বল।"
টুকরো খুনশুটির জলশায় মিঠে হয়ে যায় বৌভাতের রাত। রবীনের ইচ্ছে একদম বাঙালী আর আঞ্চলিক খাওয়া দাওয়া হবে বৌভাতের অনুষ্ঠানে। তাই লুচি ছোলার ডাল আলুরদম বেগুনভাজা থেকে শুরু করে বাঘমুন্ডী পাঁঠা,বাঁশপোড়া মুরগী সবই আয়োজন করা হয়েছে। তার পাশাপাশি জোজোর বায়নায় কিছু কন্টিনেন্টাল ডিশ। গ্ৰামের মানুষ গুলোর মুখে আজ খুশির হাসি। নাচে,গানে আর খাওয়াদাওয়ায় জমজমাট চারদিক। লেকের জলে পড়েছে রঙীন আলোর ছায়া,ওদের কথা আর গল্প ছাপিয়ে মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে ময়ূরের ডাক।
দীপ্তর হাত ধরে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে দুষ্টু চারিদিকে আজ শুধুই আনন্দ। এত কর্মব্যস্ততার মধ্যে যে এত অভিনব একটা আয়োজনে ওর বিয়ে হবে ভাবেই নি দুষ্টু। বাবার মুখের মিঠে হাসি ছুঁয়ে যায় দুষ্টুকে।
একটা সময় বাবাকে বলেছিল," আচ্ছা বাবা আমি যদি বিয়ে না করি? সবাইকে কি বিয়ে করতে হয়?"
রবীন হেসে বলেছিলেন," সত্যিই হয়ত সবাইকে বিয়ে করতে হবে তার কোন মানে নেই। তবে এমন যদি সবাই ভাবে তাহলে তো জীবনধারার নদীতে জমবে পলি রে। মানুষ নিঃসঙ্গ হবে। প্রতিটা পশু পাখির মত মানুষেরও একটা সঙ্গী দরকার হয়।
আজ দুষ্টুকে উপযুক্ত জীবন সঙ্গীর সাথে দেখে অনেকটা নিশ্চিন্ত লাগে রবীনের। এমন ভাগ্য কজনের হয়? জীবন হয়ত সব কিছু দেয়না তবে যেটুকু দেয় তার স্বাদটুকু উপভোগ করে খুশি থাকতেই ভালো লাগে রবীনের।
আজ পাহাড়ের আঁচলের তলায় দাঁড়িয়ে খুশির টুকরো টুকরো রঙীন নুড়িতে পকেট ভরে রবীন সযত্নে। মেয়েদুটো ভালো থাকবে এই ভাবনায় নিজেকে পরিপূর্ণ লাগে। রাণু এসে পাশে দাঁড়ায়," জামাইবাবু, আজ যে কি একটা ভালো লাগার দিন বলে বোঝাতে পারব না। এই দুষ্টুকে আমি নিজের হাতে বড় করেছি। ও আজকে আবার এক পরিপূর্ণ নারী হয়ে উঠেছে। জীবন হয়ত এভাবেই আবর্তিত হয় অতীত,বর্তমান আর ভবিষ্যতে।"
ঐ দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে মন হারায় রবীনের।
************************
মন হারায় আজ দুষ্টুরও,চারপাশে একটু একটু করে ঘনিয়েছে নির্জনতার ঘেরাটোপ। বাইরের লোকজন চলে গেছে কিছুক্ষণ আগে। আকাশে এখন চাঁদ উঠেছে তার ধবধবে জোছনায় ভেসেছে পাহাড়। বাড়ির লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গল্পে ব্যস্ত। ওরা চারজন গিয়ে দাঁড়ায় লেকের সামনে। পাখিরা ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ। জোজো দীপ্তকে বলে," একটা খুব সুন্দর স্মরণীয় দিন উপহার দিলি। আগে জানলে এভাবে একটা বিয়ে আমিও করতাম। "
দিদির বিয়ের দিনটার কথা আজ আর মনে করতে চায় না দুষ্টু। তবুও মনে তো পড়েই। আসলে সব কিছুরই ভালো আর খারাপ দুটো দিকই আছে। ঐ ঘটনাটা না ঘটলে দীপ্ত হয়ত এত তাড়াতাড়ি আসতো না ওর জীবনে।
মিষ্টি বলে," সবার জীবনে কি সব কিছু একরকম হয় নাকি? তবুও নিজের জীবনে খুশি থাকাতেই মেলে আনন্দ। কত আনন্দ হল বোনের বিয়েতে। নিজের বিয়েতে এমন আনন্দ করা যেত নাকি?"
" দেখেছিস তো আমার বৌটার কত বুদ্ধি। এই জন্যই তো ওকে ছেড়ে একটুও থাকতে পারিনা।"
ওদের হাসির মধ্যে হৈ হৈ করে ছুটে আসে ভাইবোনরা আর সাথে মামী আর মাসিরাও.." কি রে ওদের কি ঘুমোতে দিবি না নাকি? দুষ্টু চল এবার। আমরাও দেখব কি সাজিয়েছে ওরা। কাউকে ঢুকতে দেয়নি স্পেশাল টেন্টে ব্যাপারটা কি দেখতে হবে।"
" হ্যাঁ চল এবার ছাড়পত্র দিলাম,কারণ মানিব্যাগ আমাদের কাছেই আছে।"
ছোট ভাইবোনদের হাসিমুখ দুষ্টুর মন ভালো করে দেয়।
টেন্টের দরজার পর্দা তুলে দেয় ওরা। দুষ্টু কিছুক্ষণ কথা বলতে পারে না। তারপর বলে," এত পলাশ কোথায় পেলে? গাছ থেকে এনেছো নাকি?"
" বেশ কয়েকদিন ধরে সঞ্চয় করেছে এখানকার গ্ৰামের মেয়েরা। খুব খুশি ওরা আসলে আমাদের ঘর সাজিয়ে ওদেরও কিছু রোজগার হল। রজনীগন্ধা দিয়ে তো সবাই ঘর সাজায়।"
দুষ্টু কার্পেটে পা রাখতেই বেজে ওঠে গানের সুর..মোর প্রিয়া হবে রাণী দেব খোঁপায় তারার ফুল।
কয়েকটা পলাশের পাপড়ি ঝরে পড়ে ওর মাথায়। আনন্দের আবেগে কেমন যেন ঝাপসা হয়ে যায় দুষ্টুর চোখদুটো। জীবনপাত্র যেন আজ কানায় কানায় পরিপূর্ণ। আজকের এই সুখটুকু আঁচলে বেঁধে ফিরে যাবে নিজের কাজের জায়গায়।
ওরা সব আনন্দে হেসে ওঠে," এই জন্য কড়া শাসনে আমরা ঢুকতে পারিনি। কত কি মাথায় আসে এদের।"
জোজো দুষ্টুর হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দেয়। ওর চোখেও খুশির ঝলক আর মিষ্টির চোখে দুষ্টুমির হাসি।
-" কি আছে এতে?"
-" তোর জামাইবাবু কাম দাদার কিছু উপহার।"
পলাশের রঙে আর দীপ্তর অনুরাগের রঙে রাঙা আজ দুষ্টু। সত্যিই পলাশের রঙে আজ রাঙা দুষ্টুর সবুজ হৃদয়। চা বাগানের প্রান্তরে আজ পলাশের পাপড়ির ছড়াছড়ি। দীপ্ত আদরে জড়িয়ে ধরে দুষ্টুকে ওর গলায় পরিয়ে দেয় ভালোবাসার উপহারে জড়ানো হারটা যার লকেটে লেখা ডি। দুষ্টু জিজ্ঞেস করে," ডি কে আমি না তুমি?"
-" তুমি ভেবে নাও তোমার মত। আমার ভাবনা আর তোমার ভাবনা মিলে যাক।"
জোজোদার দেওয়া প্যাকেটটা খুলে লজ্জা পায় ভীষণ দুষ্টু," ইশ্। এইজন্য তোমরা কলকাতা গেছিলে?"
ফোনটা টুং করে বেজে ওঠে মেসেজ ভেসে ওঠে স্ক্রীনে..আমরা খুব ভদ্র,আড়ি পাতিনি। এবার প্যাকেটে দেওয়া রাতের পোশাক পরে ঘুমিয়ে পর।
আজ হয়ত জেগে থাকার রাত তাই কোন নিষেধই মানে না মন। একটা সময় ফোনের দুপ্রান্তে জেগে থেকেছে দুজন। আজ পাশাপাশি শুয়ে বুকে মাথা রেখে রাত জাগার এক মধুর ক্ষণ।
পাশের পাহাড়ে ময়ূর ডেকে ওঠে। হঠাৎই নেটের জানলার পাশে একটা খসখস আওয়াজ হয়। দুষ্টু আরও নিবিড় হয়ে আসে দীপ্তর কাছে।
দীপ্ত ওর কানের কাছে বলে," আমাদের মত হয়ত রাত জেগে প্রেমে আছে কোন পাখি।"
দুষ্টু নিশ্চিন্তে মুখ ঢাকে মন প্রাণ দিয়ে ধরে রাখতে চায় এই বিশেষ দিনটাকে স্মৃতির মণিকোঠায় খুব আদরে আর যত্নে।
জীবনের ভালোলাগার মুহূর্তগুলো এভাবেই জড়িয়ে রাখুক ওদের। আমাদের সবার জীবনেই এমন কত ভালো লাগার ছোট ছোট মুহূর্ত আছে যেগুলো কে ঝেড়ে পুছে নিয়ে পুরোনো ঝুলি থেকে বের করলে হয়ত অনেকটাই ভালো থাকা যায়।
রবীনের কানেও আসে ময়ূরের ডাক, অনুকে বলে," জীবনের কতটা পথ পেরিয়ে এলাম বলতো দুজনে একসাথে? প্রথমে আমরা বেঁধেছিলাম ঘর। এখন আমাদের মেয়েরাও ঘর বাঁধছে ভালোবাসায় ভরে। ভালো থাক ওরা।"
(জীবনের গল্পের শেষ হয় না চলতেই থাকে উত্তরাধিকার সূত্রে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে। যে গল্প শুরু হয়েছিল একজন যুবক শিক্ষককে দিয়ে আজ তার ইতি টানলাম মধুর পরিসমাপ্তি তে। সবাইকে অনেক শুভেচ্ছা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা এতদিন এভাবে সাথে থাকার জন্য। আর যে যা জানতে চাও কল্পনা করে নাও।)
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment