ছোট্ট কাঁচের আয়নায় স্বপ্নের বিন্দী আঁকছিল মেহেক। ততক্ষণে যত্নে আঁচড়ে বেঁধেছে ওর কোমর ছাপানো চুলকে। নিজেকে দেখে হারিয়ে যায়,ওর ডাগর দুই চোখে খেলে যায় কত মিঠে স্বপ্ন। হঠাৎই শুনতে পায় মা ডাকছে।
-"মেহেক জলদি আ যা বিটিয়া।"
-" আয়ি মাজী।"
লাল টুকটুকে শালোয়ার কামিজ পরে কোমরে ওড়না জড়িয়ে মায়ের কাছে এসে দাঁড়ায় মেহেক। অপরিচিত একজনকে দেখে অবাক হয়ে যায়। নাকে ভারী নথ পরা একজন মহিলা বসে আছেন মায়ের সাথে। একদমই অপরিচিত আগে তো কখনও দেখেনি। তবে মায়ের সাথে ওঁর কথা শুনে বুঝতে পারে মেহেককে দেখে খুব খুশি হয়েছেন।
-" বহত খুবসুরত বিটিয়া তেরি। ইতনি বড়ি চটি! থোড়ি সি শামলী মগর উসমে ক্যায়া লেড়কা তো বহত সুন্দর। জোড়ি আচ্ছি বনেগী।"
মেহেক আর দাঁড়ায় না সেখানে দৌড়ে ঘরে চলে যায়। বুঝতে পারে ওর বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। কান্না পায় ওর এখনই ওর বিয়ে দিয়ে দিতে চাইছে কেন মা? সবে তো একটা পাশ দিয়ে এখন বারো ক্লাশে পড়ছে ও। দাদারা উঠতে বসতে বারবার বলে মেয়েদের বেশি পড়াশোনা করতে নেই তাহলে বিয়ে দেওয়া মুশকিল হবে।
মেহেকের বাবা নেই বেশ কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। এখন দাদারাই অভিভাবক। বড়দাকে বলতে গিয়ে শুনেছিল অনেক পড়েছে একটা পাশ দিয়েছে আর বেশি পড়তে হবে না। এবার ভাবীর সাথে কাজকাম শিখে নে।
ছোট্ট একটা কষ্টের ডেলা গলায় উঠে আটকে গেছিল মেহেকের। ওর কথা কেউ শোনেনি আর মেয়েদের কোন কিছুই বেশি করা নাকি ভালো নয়। মেয়েরা জোরে হাসবে না,জোরে কথা বলবে না,বেশি খাবে না। অবাক হয়েছিল এইসব শুধু মেয়েরাই করবে কেন?
নদীর ধারে বটগাছের তলায় খুশবুর সাথে বসে আছে মেহেক। মনটা সত্যিই ভালো নেই। বাড়ি থেকে দাদারা উঠে পড়ে লেগেছে ওর বিয়ের জন্য। কেউ ওর কথা শুনছে না। সামনের সপ্তাহেই ছেলের বাড়ি থেকে ওকে দেখতে আসবে।
-" তু বোল ঘরমে অভি শাদী নেহি কর না।" খুশবু বলে।
চোখটা ছলছল করে মেহেকের," কিতনি বার বোলি কোই শুনে তব তো।"
হঠাৎই পাশে এসে দাঁড়ায় শ্যাম,ওকে দেখে খুশবু ইশারা করে," দেখ মিঠিয়া শ্যাম ভাইয়া আ গয়া। বাত কর তু। ম্যায় চলি ঘরমে কাম হ্যায়। বাদ মে মিলেঙ্গে।"
মেহেকের বন্ধুরা ওকে মিঠিয়া বলে ডাকে। শ্যাম খুশবুর জেঠতুতো দাদা,পাটনায় কলেজে পড়ছে। শ্যামের খুব ভালো লাগে মেহেককে। কত ছোটবেলা থেকে দেখছে ওকে। একদম শামলী সি,তিখি সি,ভোলি,মিঠি। রাতে ঘুমের মধ্যে চোখ বন্ধ করে মেহেককে দেখে ঘুম ভেঙে যায় শ্যামের। কিন্তু ওর বাবা যা রাগী হয়ত কিছুতেই মেনে নেবে না ছেলের প্রেম গরীবের মেয়ে মিঠিয়ার সাথে। ওর বাবা এই গ্ৰামের মুখিয়া। আর শ্যাম বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। তবুও সুযোগ পেলেই একটু নিরিবিলিতে বসে মিঠিয়ার সাথে গল্প করতে করতে আনন্দে ভেসে যায় শ্যাম।
হয়ত মেহেকও বুঝতে পারে শ্যামের চোখের ভাষা,একটু ভালো লাগার ছোঁয়া ওকেও ভাসিয়ে নিয়ে যায় তবুও কখনও সাহস পায়নি কিছু বলতে। তবে ওর খুব ভালো লাগে শ্যামের সাথে কথা বলতে।
তবে শ্যাম তো এখানে ছিল না কখন এল?
অবাক হয়ে মেহেক জিজ্ঞেস করে," তুম আচানক! কব আয়ে?"
-" কুছ দের পহেলে।"
শ্যামের সাথে টুকরো কথায় অনেকটা সময় কেটে যায়। নদীতে তখন অস্তগামী সূর্যের কিরণের মাখামাখি। মেহেকের খুব ইচ্ছে করে শ্যামকে বলতে ওর সমস্যার কথা। কিন্তু শ্যামকে বলেই বা কি হবে? ওর বাবা এমনিতেই পছন্দ করেন না মেহেক শ্যামের সাথে মেশে। আর শ্যাম কিই বা করতে পারবে?
মেহেকের চোখে আজ সেই খুশির ঝলক দেখে না শ্যাম।
বারবার কথার মাঝেই দেখেছে অন্যমনস্ক ওকে তাই জিজ্ঞেস করে," আজ কুছ উদাস তুম। কুছ হুয়া?"
মেহেকের চোখটা ছলছল করে,শ্যামের বুকটা কাঁপে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে। মেহেকের কালো গভীর দীঘির মত চোখে মেঘের ঘনঘটা। হয়ত এখনই বৃষ্টি হয়ে ঝরবে।
ওর পানপাতার মত মুখটা থমথমে লাগে হঠাৎই।
শ্যাম নিজেকে সামলাতে পারে না মেহেকের হাতটা ধরে নিজের হাতে। মাথা নিচু করে মেহেক,চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে।
হঠাৎই পেছনে একটা বজ্রগম্ভীর আওয়াজ শোনা যায়, " বাবুয়া তু ইহা কিঁউ? এ ছোড়ি কি ইতনি সাহস যো মেরে ছোড়া কো ফসা রহা... হাঁ.."
বাবার গলার আওয়াজে চমকে ওঠে শ্যাম। তাড়াতাড়ি হাত ছেড়ে দেয় মেহেকের। তারপরই মেহেকের ওপর অত্যাচার শুরু হয় হীরালাল শর্মার। হঠাৎই ওর লম্বা চুলের বেণী শক্ত হাতে ধরেন চেপে। চোখ বন্ধ করে শ্যাম এই দৃশ্য দেখলে ওর বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। এমন ভাবে মাকেও তো চুলের মুঠি ধরে বাবা অত্যাচার করেছে এক সময়। মায়ের ঘোমটা খুলে ছড়িয়ে গেছে এলো চুল পিঠের ওপর। মার খেয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে মা,না খেয়ে থেকেছে কতদিন।
শ্যাম লুকিয়ে ওদের মোটা থামের আড়াল থেকে দেখেছে সেই দৃশ্য ছোটবেলায়। তবে সেদিনের পর আর মায়ের গায়ে হাত দিতে সাহস পায় না বাবা। শ্যাম বড় হবার পর একদিন দেখেছিল মায়ের অগ্নিমূর্তি। ওদের গ্ৰামের কালী মাইয়ার মত লেগেছিল মাকে,আগুন জ্বলছিল মায়ের দুইচোখে। কোমর ছাপিয়ে নেমেছিল মায়ের খোলাচুল। বাবার টানাটানিতে বুকের কাপড় খুলে গড়াচ্ছিল মাটিতে। ওদের উঠোনে মা তখন লাফাচ্ছে মনে হচ্ছে কোন দেবতার ভর নেমেছে..." সাবধান জী,মেরে বাল মত পকড় না। তেরা নাশ হো যায়েগা। ছোড় দে,ছোড় দে মুঝে। ও মহাভারত য়্যাদ হ্যায় না। "
মাকে দেখে বাবাকে কেমন যেন গুটিয়ে যেতে দেখেছিল শ্যাম। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে মেহেক। আজ শ্যাম নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না," উসকো ছোড় দিজিয়ে পিতাজী। বাল মত পকড় না উসকো। ছোড়িয়ে,ছোড়িয়ে উসকো।"
চোখদুটো রাগে লাল হয়ে যায় হীরালালের ছেলের সাহস দেখে। ঐ মেয়ের জন্য বাবার মুখে মুখে কথা বলছে ছেলেটা! রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে," তু আজ আ ঘর মে তব দেখ।"
মেহেক ছাড়া পেয়ে প্রাণপণে ছুটতে থাকে বাড়ির দিকে। ওর কোমর ছাপানো মোটা সাপের মত বিণুনীকে সামনে করে জাপটে ধরে থাকে যত্নে। রাগে দুঃখে দুচোখে জল গড়িয়ে পড়ে।
তবে এখানেই সব শেষ হয়ে যায় না হীরালালের দাপটে অস্থির হয়ে যায় ওর দাদারা। দাদাদের চড়ে লাল হয়ে যায় মেহেকের গাল। শেষ পর্যন্ত গ্ৰামে বদনামের ভয়ে ভোর রাতেই মেহেককে নিয়ে ওর মা আর দাদারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। না হলে ওদের গ্ৰামে থাকতে দেওয়া হবে না বলে দিয়েছে হীরালাল।
হীরালালের অসভ্য গালাগালি আর হুমকি শুনে ঘরের মধ্যে থেকেই কেঁপে উঠেছিল মেহেক।
-" ছোড়িকো শাদী দে জলদি। বেসরম রান্ডী। ভেজ দু ক্যায়া মেরে লড়কো লোগ কো,উঠাকে লে যায়েগা।"
দাদার হাত পায়ে ধরে কাঁদতে থাকে মেহেক," মুঝে পড়নে দো ভাইয়া। মেরা এক্জাম হ্যায়,মুঝে কালেজমে পড়না হ্যায়।"
ওর দাদারা ওর মুখ চেপে ধরেছিল," বে সরম তেরে লিয়ে আজ ইতনা কুছ হো গয়া। হায় রাম অব ক্যায়া হোগা?"
ওর বিধবা মা ডুকরে কেঁদেছিল।
ওদিকে শ্যামকে বাঁচাতে গিয়ে হীরালালের চড় গিয়ে পড়ল ওর মায়ের গালে।
মায়ের বাপের বাড়ির শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে কুৎসিত ভাষাগুলো ধাক্বা খেল ওদের চার দেওয়ালে। বছর কুড়িতে পা দেওয়া শ্যাম বুঝতে পারল বয়েসটা আঠেরো পার হলেও ওর কোন স্বাধীনতা নেই। কথায় কথায় বাবা টাকার কথা শোনায়, ও আর ওর মা অন্নধ্বংস করছে সে কথাও বলে।
নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে শ্যামের,রাতে কিছু খায় না। মাকে দেখে অবাক হয়ে যায়। যে লোকটা একটু আগেই চড় মেরেছে গালে তার জন্য নরম করে আটা মেখে রুটি বানাচ্ছে।
মা ঘরে আসতেই শ্যাম বলে," চল মা ভাগ চলে হম দোনো।"
" কাহা যায়েঙ্গে ঘর ছোড়কে? বেটা আচ্ছা সে পড় লিখ লে তব হাম দোনো চলা যায়েঙ্গে।"
দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্যাম কিন্তু ততদিন ওর মিঠিয়ার কি হবে? বাবার লোকজন চারদিকে ছড়িয়ে আছে বাবা তো ওদের ছাড়বে না। কিন্তু কি যেন একটা বলতে চেয়েছিল মেয়েটা? তা তো শোনা হল না।
মেহেকের কথা ভাবতে ভাবতে অনেকটা রাত পর্যন্ত জেগে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে শ্যাম বুঝতেই পারেনি।
ঘুম ভাঙতেই দেখে বেশ অনেকটা বেলা হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি বিছানা ছাড়ে শ্যাম। খুশবুর কাছে যেতে হবে এখনি। ওর কাছে জানতে হবে মেহেকের কথা। দরকার হলে খুশবুকে দিয়ে ওকে চিঠি পাঠাবে।
কাকার বাড়িতে এসে দাঁড়ায় শ্যাম," চাচী খুশবু?"
- " খুশবু বিটিয়া,শ্যাম আয়া জলদি আ যা।"
শ্যাম জানে ওর বাবার জন্য কাকাও একটু এড়িয়ে চলে ওদের। তবুও ওকে আসতেই হয়েছে দরকারে।
খুশবু আসতেই ওর সঙ্গে বাগানের বড় আম গাছটার তলায় এসে দাঁড়ায় শ্যাম। খুশবুকে সব কথা বলে। খুশবু ভাবতেই পারেনি ও চলে আসার পর এত বড় ঘটনা ঘটেছে। শুধু ভগবানকে মনে মনে স্মরণ করে বলল যে ভাগ্যিস ও ওখানে ছিল না। তাহলে হয়ত ওর বাবার হেনস্থার শেষ থাকত না।
-" ও মিঠিয়া কুছ বোলনা চাহতি থি মগর বাবুজী আ গয়া। ক্যায়া বাত? তুঝে কুছ মালুম?"
খুশবু চারদিকে তাকায়,ওর নিজেরই এখন ভয় করছে শ্যামের সাথে কথা বলতে। তবুও আস্তে আস্তে বলে," উসকি শাদী কি বাত হোগি ভাইয়া। উসকি মন নেহি শাদী করনে কো।"
শ্যামের বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে আবার। যাকে ভালো লাগে কিন্তু ভালোবাসার কথাই বলা হল না তার বিয়ে হয়ে যাবে? না আজই মেহেককে নিয়ে ও পালিয়ে যাবে। যেখানে হোক। তারপর বিয়ে করে নিলে কেউ ওদের আলাদা করতে পারবে না।
গলার কাছটা আটকে আসে তবুও বলে," তু মিঠিয়া কো মেরা এক খত দেগি?"
-" ভাইয়া মগর ও তো চলি গয়ি।"
-" কাঁহা?"
-" কুছ পতা নেহি, কোই নেহি উসকি ঘর মে।"
শ্যাম আর দাঁড়ায় না সেখানে। নিশ্চয় বাবার হুমকির ভয়ে ওরা স্টেশনে চলে গেছে ট্রেনে করে কোথাও চলে যাবে বলে। এখনি ওকে যেতে হবে স্টেশনে। সাইকেল নিয়ে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে পড়ে শ্যাম। প্রায় তিন কিলোমিটার টানা সাইকেল চালিয়ে পৌঁছায় স্টেশনে। ওর মাথা তখন আর ঠিক মত কাজ করছে না। ছোট্ট গ্ৰামের স্টেশনে তখন ধূসর মন খারাপের গল্প জড়ানো। কিছু লোকজন বসে আছে কিন্তু মিঠিয়ারা কোথাও নেই।
মন খারাপের হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে আচ্ছন্নের মত ফেরে শ্যাম। অনেকক্ষণ রোদে সাইকেল চালিয়ে বাড়িতে এসে শরীরটা এলিয়ে দেয়। রাতে ধুম জ্বর আসে শ্যামের। জ্বরের ঘোরে বিড়বিড় করে মিঠিয়া তু কাঁহা?
***************************
মেহেক ততক্ষণে অনেক অনেক দূরে। সারারাত ওরা কেউ ঘুমোয়নি বাড়িতে। দুই দাদা মা আর বৌদি জিনিসপত্র গুছিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে একদম প্রথম ট্রেনে উঠে পাড়ি দিয়েছে মেহেকের মাসির বাড়ির পথে। সকালে ট্রেনে উঠলে পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে যাবে। ওদের গ্ৰামের ভোরবেলার সূর্যও সেদিন মন খারাপ করল মেহেকের জন্য। কিন্তু মুখিয়ার তান্ডবে গ্ৰামে বাস করা অসম্ভব হয়ে যাবে। এরপর হয়ত মেহেকের আর বিয়েও হবে না। তারপর মুখিয়ার পোষা ছেলেরা যদি মেহেককে তুলে নিয়ে যায়!
চলে যাওয়া ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেনি ওরা। একেবারে বোনের বিয়ে দিয়েই ফিরবে। এমনিতেই ছেলে পক্ষের মেহেককে দেখতে আসার কথা ছিল মাসির বাড়িতেই। কারণ তারা এতটা আসতে চায়নি। যাক ভালোই হল।
ট্রেনের দুলুনিতে মেহেকের চোখ জড়িয়ে আসে। ওদের গ্ৰাম কখন চলে গেছে পেছনে। দুই দাদার মুখ থমথমে। বুঝতে পারে মেহেক ওদের মাথায় এখন অনেক চিন্তা। বিকেল বিকেল ওরা পৌঁছে যায় মাসির বাড়িতে। মায়ের সাথে মাসির কি কথা হয়েছে জানে না মেহেক। তবে এখানে এসে মোটামুটি ওকে ঘরেই বন্দি করে রেখেছে মাসি। অবশ্য মেহেকেরও কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই। ওর মনে এখন আতঙ্ক ঘুরে ফিরে আসে। শ্যামের বাবার হুঙ্কার, ওর চুলের মুঠি ধরে টানা,আর পিঠে খামচে দেওয়া এখনও আগুনে পোড়ায় মেহেককে। কি করেছিল এমন ও?
শ্যাম ওর হাত ধরেছিল। সেটাই অপরাধ? অথচ শ্যামকে তো ছোটবেলা থেকেই দেখছে। তবে ছোটবেলায় দেখা শ্যামের চোখের ভাষা পাল্টেছে হাতের স্পর্শে অনেক বেশি আদুরে নির্ভরতা।
আগামীকাল মেহেককে দেখতে আসবে ছেলের বাড়ি থেকে। মা গিয়ে বজরঙবলীর কাছে পুজো দিয়ে এসে ওর কপালে টিপ পরিয়ে দেয়। আর বজরঙবলীর ধাগা পরিয়ে দেয় হাতে।
" হে ভগওয়ান পার কর দো ইয়ে বোঝ কো।"
চমকে ওঠে মেহেক,বিছানায় গিয়ে কান্নায় লুটিয়ে পড়ে। মা এ কথা বলতে পারল! ও মায়ের বোঝা!
মেহেকের কলেজে পড়ার স্বপ্ন আরও কত স্বপ্ন মুছে যায়। খুব রাগ হয় শ্যামের ওপর। কেন ওর হাত ধরেছিল শ্যাম? ও তো কখনও শ্যামকে বলেনি ও শ্যামকে পছন্দ করে। শ্যামের সাথে কথা বলতে ভালো লাগত ওর। হোলিতে খুশবুর সাথে রঙ খেলতে গিয়ে শ্যাম মাখিয়ে দিয়েছিল ওকে ইচ্ছেমত গুলাবী রঙ। আজও চোখ বুজলে অনুভব করে সেই প্রথম ছোঁয়ার মুহূর্ত মেহেক। বেশ কয়েকদিন শ্যামের মাখানো রঙ আদরে জড়িয়ে রেখেছিল ওকে,সাবান মেখেও ওঠেনি। তবে এত তাড়াতাড়ি যে সব রঙ ফিকে পড়ে যাবে ভাবেনি।
মেহেককে এক দেখাতেই ছেলের বাড়ির লোকজন পছন্দ করে নিল। ছেলের গায়ের রঙ সত্যিই ফরসা মেহেকের তুলনায়,তাছাড়া চাকরি করে সুতরাং আর আপত্তি করার কিছু নেই। যদিও মেহেক ছেলের তুলনায় কালো বলে পণের টাকা একটু বেশিই দিতে হবে তাতেও রাজি হয়ে গেল ওর দুই দাদা। এক দেখাতে যখন পছন্দ হয়েছে তখন আর কি এসে যায় তাতে? তবে ছেলে মেহেকের চেয়ে প্রায় দশ বছরের বড়। তাতে কি এসে যায় আর ছেলেদের আবার বয়েস হয় নাকি?
বারবারই মেহেকের শরীরে চোখ আটকে গেছে সমীরের। থোড়ি শামলী মগর চিকনি কোমর,লম্বি বাল,কালি আঁখে মোটামুটি ফিদা করে দেয় সমীরকে।
যদিও ওর ভাবী একটু কালো রঙ নিয়ে আপত্তি করেছিল তবুও পাত্তা দেয়নি সমীর। বলেছিল," হাঁ কর দো ভাবী মুঝে পসন্দ হ্যায় লড়কি।"
মাথা নিচু করে বসে ছিল মেহেক ওর তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করেনি ওর হবু বরকে। বিয়ে যখন করতেই হবে তখন আর ভেবে কি হবে? ওর চোখের জল শুকিয়ে গেছে গত কদিন কেঁদে কেঁদে। স্বপ্নগুলো ভেঙে ছড়িয়ে পড়েছে অন্ধকার মেঝেতে টুকরো টুকরো হয়ে। মায়ের কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হয়েছিল কানে..বোঝ কো উঠালো ভগবান।
*************************
বেশ কিছু ধার দেনা হয়ে গেলেও একদম এক কথায় বিয়েটা হয়ে গেল। খুব কাঁদলো মেহেক, তবে ওর চোখের জল ঝরল নীরবে। শুধু মাকে একটা চিঠি লিখে দিয়ে এল খুশবুকে দেওয়ার জন্য। সমীর শক্ত মুঠোতে ধরল মেহেকের হাত। মেহেককে সাজ গোজ করে লাল জরির শাড়িতে একদম ফিল্মি হিরোইনের মত লাগছে। সমীর হাত রাখছে মেহেকের শরীরে, যখন বাপের বাড়িতে কান্নাকাটি করে মেহেক ক্লান্ত শ্রান্ত তখন ওকে জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসে সমীর। মেহেকের শরীরটা কেমন যেন কেঁপে ওঠে একজন অপরিচিত মানুষের ছোঁয়ায়। তবুও মনকে বোঝায় আজ থেকে এই মানুষটাই ওর সব বৌদি তাই বলে দিয়েছে।
সমীরদের বাড়ি বিহারের প্রত্যন্ত গ্ৰামে,ওদের অবস্থা বেশ ভালো। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা, মা, দাদা,বৌদি আর ভাই আছে। চার বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। তবে বিয়ে উপলক্ষ্যে সবাই এসেছে। অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে মেহেক,একমুঠো চাল পেছনে ছুঁড়ে সব ঋণ শোধ করে এসেছে মায়ের। ওর বিধবা মা আঁচল পেতে চালটা নিয়ে কাঁদলেও বাঁচলো হাঁপ ছেড়ে অন্ততঃ ছেলেদের আর পথে বসতে হবে না। গ্ৰামে গিয়ে বলতে পারবে শহরে চাকরি করা ছেলে এক দেখায় বিয়ে করে নিয়ে গেছে মেহেককে।
শ্বশুরবাড়িতে এসে অনেক লোকজনের মধ্যে পড়ল মেহেক। প্রথমেই এ বাড়ির লোকজন একটু নাক উঁচু করল ওদের বাড়ি থেকে তেমন কিছু দহেজ পাওয়া যায়নি। নোকরিওয়ালা ছেলে আর তার এমন শামলী বৌ। মেহেকের মন খারাপ হয় কিন্তু কিছু বলতে পারে না। এইজন্য ভেবেছিল পড়াশোনা করবে,চাকরি করবে। কিন্তু হল কই? প্রত্যন্ত গ্ৰামের বাড়িতে ওর মত মেয়ে হয়ে জন্মানোই বোধহয় অভিশাপ। ওরা ভাবে মেয়ে মানেই সংসারের ঘানি টানবে আর বাচ্চা পয়দা করবে,ওদের আবার কিসের আজাদী?
ওর বড় জা মাথার ঘোমটা একদম বুক পর্যন্ত নামিয়ে দেয়," ঘুঙ্গট মত খোল না কিসি কো সামনে সমঝি।"
পাড়ার অনেকেই বৌ দেখতে এসেও ওর জায়ের দাপটে বৌয়ের নাক দেখে চলে গেল। ওর জা বড়লোকের মেয়ে। তবে শাশুড়ি যথেষ্ট ছড়ি ঘোরায় সংসারে। বড় জায়ের নাম মিছরি, লম্বা চওড়া পেটানো চেহারা। মাথায় কোঁকড়া চুল আর রঙ ফর্সা তবে ব্যবহারে বেশ মিস্টি মাখানো তাই ভালো লাগে মেহেকের। এ বাড়িতে আসার পর থেকে তো বড়ি জিজিই দেখভাল করছে ওর।
তবে ওর শহরে কলেজে পড়া দেওরের কথা শুনে চমকে উঠল মেহেক। মিস্টি খাওয়ানোর সময় ওর নরম হাতটা শক্ত করে হাতটা চেপে ধরেছিল রাকেশ। মেহেকের খুব অস্বস্তি হয়েছিল অথচ ওর জা আর ননদেরা তখন হাসছে আর মজা করছে। দেওরের মুখে মিস্টি দিতে গিয়ে ওর জিভের ছোঁয়া হাতের আঙ্গুলে লেগেছিল। তাড়াতাড়ি হাতটা সরাতে গিয়েই হাতটা চেপে ধরে বলেছিল," ছোটি ভাবী ইতনি শরম না করো। দেবর মতলব মালুম হ্যায় ক্যায়া? হামারা ভি কুছ অধিকার হ্যায় না তুম পর?"
এখনও মুখিয়ার চুলের মুঠি ধরা আর পিঠে খামচে দেওয়া মনে আছে মেহেকের। আজ আবার যেন শিউরে উঠল দেবরজীর কথায়। ঘোমটার আড়াল থেকেই সমীরকে খোঁজার চেষ্টা করল। ওর জা অবশ্য বলছে তখন," ছোটি থোড়া সামালকে রহ না। ইয়ে বড়া নটখট হ্যায়। তু তো বড়ি হ্যায় না। কান পকড়কে দেনা এক থাপ্পড়।"
রাকেশকে তখন আদুরে স্বরে বলতে শুনলো," বড়ি ভাবী...ইতনি সি ছোটি লড়কি মুঝে থাপ্পড় মারেগি!"
ওর গাল টিপে দিয়ে জা বলে," এ ভাবী বোল,মিঠাই খা লিয়া অব যা বাহার মে।"
মেহেকের গলাটা কেন যেন আটকে আসে,এ কোন কয়েদখানায় এসেছে? এখানে নদীর পাড় নেই,ক্ষেত নেই, ওর লম্বা চুলের টানটান বিণুনী ঝুলিয়ে এদিক ওদিক যাওয়ার স্বাধীনতা নেই। মাস্টারজী নেই,স্কুল নেই,খুশবু নেই,মা,দাদা,ভাবী কেউ নেই। আরও একজনও নেই যার কথা মাঝে মাঝেই মনে হয়। সারাক্ষণ ভারী ঘুঙ্গট ঝুলছে বুক পর্যন্ত। মাঝে মাঝে মনে হয় কতদিন সূর্যকে দেখেনি। হাত পা ছুঁড়ে সাঁতার কাটেনি নদীর মিঠে জলে। আচ্ছা খুশবুকে যে চিঠি পাঠিয়েছিল সেটা কি ও পেয়েছে? মা কি ফিরে গেছে গ্ৰামে?
মেয়েকে ভালোভাবে বিদায় করে বিয়ের কদিন পরেই ওরা ফিরে আসে গ্ৰামে। ছেলেগুলো অনেকদিন গ্ৰাম ছাড়া। বাড়িঘর কেমন আছে কে জানে?যদিও পাশের ঘরের লছমীকে দুটো গাইয়ের দায়িত্ব দিয়ে এসেছে। তবুও মনটা আনচান করছে খুব। মেহেকের সাথে বোনের ছেলেকে পাঠিয়ে দায় সেরেছে মোটামুটি ওরা। জানে এই বিয়েবাড়িতে ওখানে গেলেই একদফা গালাগালি খেতে হবে। ওদের তেমনি রেওয়াজ। চাচীদের ফিরতে দেখেই দৌড়ে আসে খুশবু।
" চাচী আ গয়ি.…মিঠিয়া কিধার?"
চাচীকে চুপ করে থাকতে দেখে বুঝতে পারে ওর ছোটবেলার সাথী মিঠিয়া আর গ্ৰামে ফিরবে না। খুশবুকে দেখে আজ চোখের জল বাধা মানে না মেহেকের মায়ের অঝোরে জল ঝরতে থাকে। যে চোখের জল লুকিয়ে রেখেছিল এতদিন তা আজ অলকানন্দার বাঁধভাঙা ঢেউ। কেঁদে ফেলে খুশবুও তারপর চিঠি হাতে দৌড়ে বাড়ি এসে চিঠি খুলে পড়তে বসে। চিঠির মনখারাপের শব্দের ছোঁয়ায় বারবার ভিজে যায় ওর চোখ দুটো। কত স্বপ্ন দেখেছিল মেয়েটা সব ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। সত্যি বোধহয় মেয়ে হওয়া অভিশাপ তারপর যদি গরীব ঘরে জন্ম হয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে খুশবু," কব ঔরত কো ভি দিন আয়েগী খুলকে জিনে কো।"
পুরো চিঠিটায় একবারও শ্যাম ভাইয়ার কথা লেখেনি মেয়েটা। বুঝতে পারে ওর খুব অভিমান হয়েছে শ্যাম ভাইয়ার ওপর।" মগর শ্যাম ভাইয়া বহত বহত চাহা তুঝে পাগলী একদম দিলসে। কিতনা বুখার থা উসে তুঝে তো মালুমই নেহি।"
একা একাই বিড়বিড় করে খুশবু। এ গল্প যখনকার তখন কোন ফোন ছিল না ওদের হাতে যে সব খবর দেবে মেহেককে। তাই মনের কথাগুলো মনেই গুমরে মরে। শুধু মাকে গিয়ে বলে," মা ম্যায় বহত পড়ুঙ্গী মুঝে শাদী নেহি করনা।"
ওর মা ওকে আদরে জড়ায়,দুটো সন্তান মারা যাবার পর এই মেয়ে তাই বড় আদরের ওদের। তাই মেয়ে বড় হোক ইচ্ছে মত," আচ্ছা বাবা যো তেরি মর্জি।''
তবে সবার ভাগ্যে কি নিজের মর্জি মত চলা থাকে? হয়ত থাকে না। মেহেকের আজ সুহাগ রাত। বাড়িতে অনেক লোকজন,ননদ,ননদাই,জায়ের বাপের বাড়ির লোকজন। ওর জায়ের বাপের বাড়ি থেকে খুব ভারী রূপোর পায়েল আর কানের ঝোলা দুল দিয়েছে মেহেককে। মিছরি সেই পায়েল ওকে পরাতে পরাতে বলে," অব ঠিক হ্যায়,ইতনা ভারী পায়েল বান্ধ দিয়া যো তু দৌড় না সকেগী। ধীরে ধীরে সমঝকে চলনা।"
পায়ে ভারী পায়েল পরে পা ফেলতেই অসুবিধা হয় মেহেকের। মনে হল ওর পায়ে কে যেন লোহার বেড়ি পরিয়ে দিল। ওর হাতে দুধের গ্লাস ধরিয়ে দেয় মিছরি," উসকো পিলা দেনা পুরা। ইয়ে লে পান।"
মাথার ঘুঙ্গট টেনে খাটের ওপরে বসে থাকতে থাকতে একটু ঝিমুনি আসে মেহেকের। বাইরেটা বেশ নিঝুম হয়ে এসেছে ততক্ষণে। সমীর ঘরে ঢোকে অনেকটা রাত্রে। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে বেশ অনেকটা দেরি হয়ে গেছে ঘরে আসতে,একটু নেশাও হয়ে গেছে। দরজার আওয়াজ পেয়ে সোজা হয়ে বসে মেহেক। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে দুধের গ্লাসটা দেয় সমীরের হাতে। ও বলে," ওহ্ ইয়ে কিসকো পিনা হ্যাঁয়। মুঝে তো অভি স্রিফ নেশা চড় গয়া।"
হঠাৎই মেহেককে জড়িয়ে ধরে সমীর ওর ঘোমটা খুলে পড়ে। ওকে জোরে চেপে ধরে দুধটা খাইয়ে দেয় ওকে। সমীরের গায়ে আর মুখে মদের গন্ধ। মেহেকের কেমন যেন দম আটকে আসে। সমীর বলতে থাকে," তুম পি লো আচ্ছা সে। আজ দেখেঙ্গে কিতনা দম হ্যায়।"
মেহেকের গালে তখন মালাইয়ের আদরের মাখামাখি। তারমধ্যে নিজের এলোপাথাড়ি আদর মাখাতে থাকে সমীর। ওর শরীরে ডুবে যেতে থাকে চেপে ধরে ওকে। মেহেকের কেমন যেন দম আটকে আসে ছটফটিয়ে ওঠে ও।
সমীর ওকে আরও জোরে চেপে ধরতে ধরতে বলে," পতি পরমেশ্বর হোতা হ্যায় সমঝা। উসে উনকো কাম করনে দো।"
নেশার ঘোরে আরও উন্মত্ত হয় সমীর। মেহেক ওর কুমারীত্ব উজাড় করে দান করে পতি পরমেশ্বরকে। তারপর একটা সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সমীর আদরে জড়িয়ে ধরে ওকে ঘুমিয়ে পড়ে। অদ্ভুত একটা যন্ত্রণা হয় মেহেকের সারা শরীরে। নিজের শাড়ি জামাকাপড় নিয়ে ভোরে গিয়ে বাথরুমে ঢোকে। সারা শরীরে জল ঢালতে থাকে মেহেক। জলের ধারায় ওর ক্লান্ত ক্ষতবিক্ষত শরীরটা অনেকটা শীতল হয়। সূর্য ওঠার আগেই নতুন বৌকে জামাকাপড় কাচতে দেখে খুশি হয় শাশুড়িমা।
" তবিয়ত ঠিক হ্যায় তো তেরা? শোয়ি নেহি ক্যায়া রাত মে?"
ঘোমটার আড়ালে মাথা নাড়ে মেহেক। তাড়াতাড়ি করে ঘরে গিয়ে ঢোকে। সমীর তখনও ঘুমোচ্ছে। আলতো হাতে বিছানাটা ঠিক করে নিজেকে গুছিয়ে নেয় মেহেক। গাঢ় করে মেটে সিঁদুর টানে সিঁথিতে। কপালে পরে বিন্দী। মাথার লম্বা চুল আঁচড়ে খোঁপা বাঁধে। এটা শ্বশুরবাড়ি এখানে চুল খুলে ঘুরতে নেই বলে দিয়েছে মা। আবার খুব গ্ৰামের কথা মনে পড়ে মেহেকের। জানলায় এসে দাঁড়ায় দূরে পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। আনমনা হয়ে যায় মেহেক। হঠাৎই সমীর ওকে কাছে ডাকে। রাতে নেশা করে আসার জন্য একটু দুঃখ প্রকাশ করে তারপর আবার কাছে টেনে নেয় ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়। হঠাৎই দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ শোনে মেহেক," ছোটি অভি তক ঘরমে কিঁউ? আ যা বাহার। কাম হ্যায় বহত।"
নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অপ্রস্তুত মেহেক ছুটে যায় মল বাজিয়ে। ওর অবস্থা দেখে হেসে ওঠে মিছরি। আস্তে আস্তে কানে কানে বলে," বহত দর্দ হুয়া মালুম হোতা হ্যায়। ইয়ে লোগ হ্যায় অ্যায়সে। সামাল লেগি সব দেখনা ধীরে ধীরে।"
একটু একটু করে সমীরদের সংসারে এভাবেই মানিয়ে নেয় মেহেক। ওদের নিয়ম ছোট বৌ এলে বড় বৌয়ের ছুটি তাই মেহেককে সংসারের অনেকটাই সামলাতে হয় এখন। সারাদিন সংসারের কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে মেহেক। তবুও নিজেকে ভেঙ্গেচুরে আবার গড়ে নেয় মেহেক,বুঝতে পারে এটাই এখন ওর আস্তানা। এখানে শরীর,শ্রম আর মন দিয়ে চলতে হবে। যদিও বড় জা হিসেবে মিছরি জিজি খুব একটা খারাপ নয়। সারাক্ষণ সাজগোজ আর হাসি মজাক নিয়ে থাকে। তবুও গ্ৰামের নিন্দুকেরা মিছরির মুখ দেখে কোন ভালো কাজে যায় না কখনও। মিছরির বাপের বাড়ির টাকায় কেনা বড় ট্রাক্টরে সমীরদের জমিতে ভালো ফসল ফললেও সমীরের বড় ভাই রাজীব আর মিছরির বিবাহিত জীবনে এই পাঁচবছরেও কোন সুখের ফসল ফলেনি।
জিজির হাসির মধ্যে কোথাও যেন একটা দুঃখের ছোঁয়া দেখতে পায় মেহেক। তবে জিজি নিজেকে সব সময় সাজিয়ে রাখে। অবশ্য সমীর মেহেকের শরীরের সাথে আদরে ভাব করতে করতে বলে, ভাবী যতই সাজগোজ করুক না কেন আমার মেহেক সবচেয়ে খুবসুরত।
আদর ভাগাভাগিতে আজকাল অভ্যস্ত হয়ে গেছে মেহেক। সমীরের হুঁশ কম,সারাদিন অফিসে চাকরি করে এসে মনের সুখে দাঁড় বায় মেহেকের ময়ূরপঙ্খী শরীরে।
মেহেক সমীরের বুকের ওপর শুয়ে বলে," মুঝে পড়াই করনা হ্যায় জী। "
প্রথমে একটু আপত্তি করলেও মেহেকের কথা ফেলতে পারে না সমীর। কিন্তু বইপত্র তো সব বাপের বাড়িতে। তাই সেখানে যেতেই হয় একবার,ওর শাশুড়ি রাগ করে দ্বিরাগমনেও পাঠায়নি ওকে। বাপের বাড়ি থেকে কোন আমন্ত্রণই তো আসেনি। তবুও বাড়িতে অনেক বুঝিয়ে সমীর বলে মেহেকের মন খারাপ হচ্ছে এক দুদিনের জন্য বাপের বাড়ি যেতে চাইছে। মিছরি আর শাশুড়ি প্রথমে আপত্তি করলেও রাজি হয় সমীরের কথায়।
বিয়েতে পাওয়া নতুন শাড়িগুলো গুছিয়ে নেয় মেহেক। কতদিন যায়নি বাপের বাড়ির গ্ৰামে,এখন তো ওর বিয়ে হয়ে গেছে। আর মাথা নিচু করে থাকবে না। ওর অনেক কিছু রয়ে গেছে ওখানে সেগুলো নিয়ে আসবে। সমীর বলেছে ওকে প্রাইভেটে পরীক্ষা দেওয়ানোর ব্যবস্থা করবে।
বাপের বাড়ির গ্ৰামের স্টেশনে নেমে টাঙ্গা থেকে চারদিক দেখতে দেখতে যায় মেহেক। দেখে যেন আর মন ভরে না। সমীর হাসে," আরে ঘুঙ্গট খোলকে ইতনা ক্যায়া দেখ রহি হো?"
" ও তুম নহি সমঝোগে,লেড়কে হো না। আপনা ঘর তো নহি ছোড়া।"
নিজের বাড়িতে এসে প্রজাপতির মত ছটফট করে মেহেক। জামাই মেয়েকে চোখে হারাচ্ছে দেখে শান্তির শ্বাস ফেলে ওর মা। খুশবু ছুটে আসে খবর পেয়ে। ওকে দেখে জড়িয়ে ধরে আনন্দে," আরে তু তো বহুত খুবসুরত হো গয়ি রে।"
মেহেকের চোখেমুখে ফুটে ওঠে দুষ্টুমির হাসি," শাদী করলে তব তু ভি হো যায়েগী খুবসুরত।"
-" না বাবা মুঝে কলেজ পড়না হ্যায় শ্যাম ভাইয়াকা মাফিক।"
মেহেকের আকাশে ওড়ানো মনটা মুখ থুবড়ে পড়ে মাটিতে একটা দীর্ঘশ্বাস মাটিতে মিশে যায়। পড়ার তো ওরও খুব ইচ্ছে কিন্তু হবে কি তা? তবে খুশবু অবাক হয়ে গেল যে একবারও শ্যাম ভাইয়ার কথা জিজ্ঞেস করল না মেহেক। অথচ কত কষ্ট পেয়েছে ভাইয়া ওর জন্য। সেই যে গেছে কতদিন আসেনা বাড়িতে। হয়ত ভালো বর পেয়ে মেহেক সব ভুলে গেছে।
হঠাৎই মেহেক বলে ওকে অবাক করে দিয়ে," ও কঁহা? "
-" আ গয়া ম্যায়।"
চমকে ওঠে ওরা দুজনেই কখন যে সমীর এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারেনি। ভাগ্যিস নামটা নেয়নি মেহেক। খুশবু একটু সামলে নিয়ে সমীরের সাথে গল্প করে।
অনেক কথাই মেহেকের জানা হল না। মাত্র মাঝে একটা দিন তারপরেই ওকে চলে যেতে হবে। তার মধ্যে গুছিয়ে নিতে হবে বইপত্র আর অন্য কিছু জিনিস। তাছাড়া সমীর সবসময় ওর আসেপাশেই আছে,লজ্জা পায় মেহেক। বৌদি মজা করে বলে বরকে তো একদম আঁচলে বেঁধেছিস। এই কত কাঁদছিলি বিয়ে করবি না বলে। খুশবু নিজেও ভাবে কি দরকার শ্যাম ভাইয়ার কথা ওকে বলে? ভালো থাক মেহেক।
বাপের বাড়ি ছাড়তে মন না চাইলেও ভারী মল ঝমঝমিয়ে ঘুঙ্গট টেনে টাঙ্গাতে ওঠে মেহেক। চোখ থেকে জলের ফোঁটা ঝরে পড়ে।
ওর মা যতটা পারে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ঝুড়ি করে ফল মিস্টি,ডাল,ভুট্টা,নতুন কাপড়,গরুর দুধের প্যাড়া পাঠিয়ে দেয়।
**************************
সমীরের দূর্বলতা টুকু এতদিনে বুঝে নিয়েছে মেহেক তাই ওকে খুশি করে জায়ের নানা ফাই ফরমায়েশ খাটে। অবসর সময়ে লুকিয়ে চুরিয়ে একটু একটু করে পড়াশোনা শুরু করে মেহেক। ওকে কলেজে পড়তে হবে,চাকরি করতে হবে। স্কুলে সবসময় মাস্টারমশাইরা ওর বুদ্ধির তারিফ করতেন। বইয়ের সাদা কালো পাতায় হাত বোলাতে বোলাতে কতই না রঙীন স্বপ্নের জাল বুনতে থাকে মেহেক। হঠাৎই দরজায় আওয়াজ হয়। একটু সতর্ক হয় ও সময় নিয়ে দরজা খোলে ততক্ষণে আরও দুবার দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হয়েছে। মিঠে গলায় মেহেক আওয়াজ দেয়," কৌন, আ রহি হুঁ বাবা।"
দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ওর সামনে দুহাত বাড়িয়ে দরজা আটকায় রাকেশ," ইতনি দের? ক্যায়া চল রহা জী অন্দর মে ভাবী ?"
রাকেশকে দেখে খুব অস্বস্তি হয় মেহেকের,ওর বিয়ের পর যে কদিন রাকেশ এখানে ছিল তার মধ্যেই মেহেকের মন বুঝে গেছিল রাকেশের স্বভাব মোটেই ভালো নয়। আর মেহেকের বয়েস কম হওয়ার জন্য ও বড় বৌদি হিসেবে কোন পাত্তাই দেয়না মেহেককে। এতদিন বাড়িতে ছিল না রাকেশ,শহরে কলেজের হোস্টেলে ছিল। নিশ্চয় ছুটিতে বাড়িতে এসেছে।
মেহেককে সরিয়ে দিয়ে রাকেশ ঢুকে আসে ঘরে,খাটে গড়িয়ে পড়ে। মেহেককে ডাকে .." আরে ভাবী আ যাও থোড়া গপসপ মারে।"
মেহেকের অস্বস্তি হয় একলা ঘরে রাকেশের সাথে। রাকেশ বালিশ ধরে টানে হঠাৎই ওর বইদুটো বেরিয়ে আসে। অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে চোখ রাখে রাকেশ," ও তব ছুপ ছুপকে ইয়ে হো রহা থা। শাদী কে বাদ ওহ্ কামসূত্র ছোড়কে ইস্ পাঠ্য পুস্তক মে ভাবী!
রাকেশ একটা বাজে ইঙ্গিত করে। তবে কথাটা ছড়িয়ে যায় বাড়িতে। অশান্তি শুরু হয়। শ্বশুর, শাশুড়ি জানতে পেরে রাগ করেন। রাগ হয় মিছরিরও মনে হয় একেই তো ওর বাচ্চা হয়নি তারপর পড়াশোনাও তেমন জানে না। এই নতুন বৌ ওর মাথার ওপর উঠবে এবার। রাকেশ আনন্দ পায় বাড়িতে অশান্তি লাগিয়ে দিয়ে। মেহেক ভয়ে গুটিয়ে থাকে। তবে সমীর দমে যায় না নতুন বৌ মেহেকের মুখে হাসি ফোটাতে বাড়ির লোককে বুঝিয়ে রাজি করে। রাকেশ মিছরিকে বলে," ভাইয়া জরু কা গোলাম বন গয়া। দেখনা একদিন ইয়ে ছোটি ভাবী ক্যায়া ক্যায়া করেগী।"
সকলের শাপ শাপান্ত মাথায় নিয়েও মেহেক প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে গেল। খবর গেল ওর বাপের বাড়িতেও। মা একটু গজগজ করল," শাদী হো গয়ি অব পড়াই কোন কাম কি? ইয়ে লেড়কি ভি বহত জিদ্দী।"
তবে মেহেকের ভাগ্যে হঠাৎই ভিড় করে এল কালো মেঘ। অনেক কষ্টে সমীরকে বুঝিয়ে রাজি করেছিল মেহেক কলেজে পড়ার জন্য। সমীর ওর শরীরে মুখ ডুবিয়ে বলেছিল," বহত হো গয়া পড়াই,বারা ক্লাশ পাশ হো গয়ি। অব ছোড় দে। ঘর বসানা হ্যায় না। মুঝে বাচ্চা চাহিয়ে।"
সমীরের কাছে নিজেকে উজাড় করে দিতে দিতে মেহেক বলেছিল," অভি নেহি,কুছদিন বাদ।"
তবে সমীরের ঘর বসানোর স্বপ্ন হঠাৎই এলোমেলো হয়ে গেল এক দমকা ঝড়ে। মেহেকের জীবনের সব রঙীন ঝলমলে রঙ এক ঝটকায় হয়ে গেল ফ্যাকাসে। মেহেকের তখন কলেজে ভর্তি হওয়ার কথা চলছে। বাড়ির অশান্তি আর ছোট ভাইয়ের অনেক ইন্ধন সত্যেও ফর্ম তুলে আনে সমীর। তবে মনে কেমন যেন এক দোটানা চলতে থাকে। সেদিন বাড়ি ফিরতে বেশ অনেকটা দেরি হয় সমীরের। মেহেক উদগ্ৰীব হয়ে অপেক্ষা করে। সমীর টলতে টলতে আসে। আজকাল তেমন ভাবে সমীর মদ খেয়ে আসে না। হঠাৎ কি হল ভেবে অবাক হয় মেহেক। ফর্মটা ওর হাতে দিয়ে বলে," মেরা ঘর বসে না বসে তু জি লে আপনা জিন্দেগী।"
সমীরের গলার সুরে অভিযোগ শুনতে পায় মেহেক। বুঝতে পারে আজ বন্ধুদের পাল্লায় পড়েছিল সমীর। আর মনের জ্বালা কমাতে ভরপেট মদ খেয়ে এসেছে। মিছরি একবার এসে দাঁড়িয়েছিল দরজায় সমীর বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়ার পর মেহেককে বলেছিল," ইতনি জিদ্দী কিঁউ রে তু ? কিতনি পড়েগী হাঁ। তব শাদী কিঁউ কি? আজ দেবরজী কো বহত চড় গয়া। অব সামাল উসকো।"
সমীরকে সামলাতে পারেনি মেহেক,পরের দিনের ভোরের আলো আর দেখেনি সমীর। হসপিটালের ডঃ বলেছিল কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। পুলিশও এসেছিল,মেহেককে কিছু জিজ্ঞাসাবাদও করেছিল। তবে তার থেকে খুব একটা বেশি ঝামেলা হয়নি। তবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো রাকেশ আর ওর শাশুড়ি। গালাগালি দিয়ে বাপের নাম ভুলিয়ে দিয়েছিল মেহেকের। " ডাইন,খা গয়ি না উসকো। লে অব পড় কিতনা পড়না। ঘর সে নিকলেগি তো...মারকে হাড্ডি টুট দেগি তেরি।"
*****************************
সমীর চলে যাওয়ার পর মেহেক বুঝেছিল যে কোন কারণেই স্বামীর মৃত্যু হোক না কেন অপয়া নাম মেয়েদেরই হয়। বাড়ির সবার রাগ এসে পড়ল ওর পড়াশোনার ওপর। মেহেকের নাকি সমীরের ওপর কোন টানই ছিল না। যত প্যায়ার ছিল বইয়ের সাথে তাই ছেলেটা অকালে চলে গেল। কদিন ঘরেই আটকে রেখেছে ওরা মেহেককে। সমীরকে কতটা ভালোবাসত তা বুঝতে পারে না মেহেক। কিন্তু সমীরের দেওয়া সিঁদুর যে ওর রক্ষাকবচ ছিল তা বুঝল ভালো করেই এই কদিনে। একটা সময় গালাগালি থামলো।
হঠাৎই মেহেক দেখল যে দাদারা ওকে আপদের মত বিদায় করে বেঁচেছিল তারা ওকে নিয়ে যেতে এসেছে বাপের বাড়িতে। কি করবে ঠিক ভেবে পায় না মেহেক। হঠাৎই মিছরি আর ওর শাশুড়ি এসে ঘরে দাঁড়ায়। ওর দাদাদের বলে," অব মেহেক ইস্ পরিবার কি আমানত হ্যায়। কাহা যায়েগি ঘর ছোড়কে?"
বদ্ধ ঘরে দম আটকে আসে মেহেকের পাতলা সাদা কাপড়ের ঘোমটার আড়ালে দাদাদের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে। সত্যিই তো ওখানে গিয়ে কি করবে? ওখানে তো মুখিয়া আছে। আজও মুখিয়ার চুলের মুঠি ধরে টানের কথাটা মনে পড়ে মেহেকের। রাগে গাটা জ্বলে ওঠে ইচ্ছে করে ভেঙে গুড়িয়ে দিতে হাতটা। আজকে ঐ শয়তানটা ওর জীবন তছনছ করেছে। নাহলে তো ও বিয়েই করত না এখন। কদিন মিছরি এসে শুয়েছে মেহেকের কাছে রাজীব রাগ করে তাই দুদিন ধরে মেহেক একাই শুয়েছে ঘরে। রাতে শুয়ে কিছুতেই ঘুম আসে না মেহেকের, গত দুই রাত প্রায় না ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। আজ রাকেশের ছিঁড়ে নষ্ট করে দেওয়া বইয়ের তলা থেকে বের করে ওর খাতাটা। মনে যা আসে সেটাই হিজিবিজি করে লিখতে থাকে। লেখে ওর অসম্মানের কথা মায়ের অবহেলার কথা। বাইরে একটা রাতজাগা পাখির ডাক শোনা যায়। চোখের জল মুছে বালিশে মাথা দেয় মেহেক মনে মনে সমীরকে বলে এত কি নেশা করার ছিল তোমার। আমি তো সবটা তোমাকে দিয়েছিলাম। বলতেই পারতে তুমি চাও না মন থেকে আমি পড়াশোনা করি। কেন এভাবে চলে গেলে? তারপর কখন যে কান্নাভেজা চোখদুটো জড়িয়ে আসে বুঝতেই পারেনি।
হঠাৎই চমকে ওঠে মিছরির ডাকে," ছোটি উঠ জলদি বহত দের হো গয়া।"
আজ অন্য দিনের মত মেহেককে রান্নাঘরে আসতে বলে না মিছরি। বরং ওকে বলে তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নিতে সমীরের অফিসে যেতে হবে আর ব্যাঙ্কে যেতে হবে। ভাসুরের সাথে এই প্রথম কোথাও যাচ্ছে মেহেক। একবার জিজিকে বলেছিল," তুম চলো না জিজি সাথ মে।" মিছরি রাজি হয়নি।
মেহেক যা পড়াশোনা জানে সেটা দিয়েই বুঝতে পারে সমীরের যা কিছু আছে সেটা ও পাবে তাই ওকেই আসতে হয়েছে সই করতে।
হঠাৎই সংসারে মেহেকের কদর বেড়ে গেল। সবাই ওর সাথে ভালো ব্যবহার করতে শুরু করল শুধু পাওনা টাকাটা শাশুড়ির সাথে জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে রাখতে হল। তবে মিছরি বলল," কুছ আলগ সে রাখ দেনা,বাদ মে কাম আয়েগা। পুরা নহি দেনা।"
আজকাল কেন যেন এই বাড়িতে মিছরিকেই ভালো লাগে মেহেকের। একটু আদর,স্নেহ মায়া আর ভালো খাবার যা কিছু পাবার সেটা পায় মিছরির কাছ থেকেই। হয়ত নিরাপত্তাও পায় অনেকটাই। কাউকে তো একটা আশ্রয় করে বাঁচতে হবে। শাশুড়ি তো ওকে সহ্যই করতে পারে না।
এ বাড়ির সব জায়গায় আর ওর ঘরে ছড়িয়ে সমীরের স্মৃতি। রাতটুকু নিজের মত কাটায় মেহেক,নিজের মনের কথা লিখে খাতার পাতা ভরাতেই কেটে যায় রাত। শুধু রাকেশ বাড়িতে এলেই ভয় করে ওর।
মেহেকের শরীরে এখন ভরা যৌবন,রাকেশের মনে আগুন জ্বালায় ছোটি ভাবীর হিলহিলে কোমর,এক মাথা লম্বা চুল আর ঈষৎ ভারী নিতম্ব। নিজেকে আড়াল করতে চাইলেও রাকেশ ইচ্ছে করেই ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। নানা অছিলায় ছুঁতে চায় ওকে। রাকেশের চোখে সর্বনাশ খেলা করে যেন। কি করবে মেহেক বুঝতে পারে না। মাঝে মাঝে ভয় করে খুব। রাতে ঘুমোতে পারে না একটা অদ্ভুত ভয় বুকে চেপে বসে মনে হয় কেমন করে নিজেকে বাঁচাবে?
হঠাৎই একদিন বন্দী দশা থেকে মুক্তির সুযোগ চলে আসে। মিছরি আর রাজীবের সাথে ওর শাশুড়িমা ওকে পাঠাতে রাজি হয় গুরুজীর আশ্রমে। জিজির জন্য নাকি ওখানে জপ তপ পূজা হবে। শাশুড়ি বলেন," তু ভি চলি যা সাথমে শান্তি আ যায়েগী মন মে। বংশ নাশ হো যায়েগা হমারা মালুম হোতা হ্যায়।" শাশুড়ির গলায় ক্ষোভ ঝরে পড়ে। মেহেক দেখে বড়ি জিজি চুপ করে দাঁড়িয়ে কথা শোনে। অবাক লাগে ওর জিজি কিছু বলছে না কেন?
মাঝ রাতে হঠাৎই মিছরির ঘর থেকে চাপা কান্না শোনে মেহেক। সাথে ওর ভাসুরের হুমকি। ইস্ বার জরুর কুছ খবর লানা,নহি তো দুসরি শাদী কর লেঙ্গে হম।"
অবাক হয়ে যায় মেহেক জিজির সুখী দাম্পত্যে যে অসুখের বাসা তা কোনদিন আগে বুঝতে পারেনি। ঘরে এসে রাতে ঘুম আসে না ওর বারবার কানে বাজে চাপা কান্নার আওয়াজ।
**************************
অনেকদিন বাদে ট্রেনের মিঠে হাওয়ায় শরীরটা জুড়িয়ে যায় ওর। সেদিনের পর থেকে ভাসুরকেও আর ভালো লাগে না ওর। তবুও নতুন জায়গায় যাওয়ার আনন্দে মনটা একটু অন্যরকম লাগে। জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে উদাস হয়ে যায় মেহেক। শুধু জিজিকে একটু চুপচাপ লাগে,অন্য সময় কত কথা বলে। গুরুজীর আশ্রমের লাগোয়া একটা বাড়িতে ওদের থাকার ব্যবস্থা হয়। জায়গাটা শুনশান চারদিকে অনেক গাছপালা আর ফুলের বাগান। আর বেশ কিছুটা দূরে গ্ৰামের থেকে। গুরুজীর চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না মেহেক। ওর মাথায় ঘোমটা ছিল। বাবা বলে," ঘুঙট খোল,ম্যায় ভি দেখুঁ কোন সা অবশকুন হ্যায় তুঝমে যো পতি কো মদ হো গয়্যা।" বাবার কথায় মিছরি ওর ঘোমটা খুলে দেয়। মেহেকের দিকে সোজা তাকিয়ে বাবা সে চোখে এক অদ্ভুত দৃষ্টি। মেহেক মাথা নিচু করে। বাবা বলতে থাকেন," ইয়ে তো সাক্ষাৎ লছমী হ্যায় মগর কুছ শনি কে দোষ হ্যায় ইসমে। প্রতিবিধান কর না হ্যায় সঙ্কটনাশিনী যজ্ঞ করনা হোগা। যজ্ঞ নেহি করনে সে ঘোর অমঙ্গল হোগা।"
মিছরি আর রাজীব মাথা নাড়ে গুরুদেবের কথা শুনে। কথা হল মিছরির জন্য পুত্রপ্রাপ্তি যজ্ঞ আর মেহেকের জন্য সঙ্কটনাশিনী যজ্ঞ হবে। রাজীব আর মিছরি গুরুদেবকে প্রণাম করে। রাজীব বলে," আশীর্বাদ দিজিয়ে বাবা মুঝে বংশ কো রাখনা হ্যায়।"
মেহেক বুঝতে পারে এই জন্যই ওকে শাশুড়ি এখানে পাঠিয়েছে। কিন্তু সত্যিই কি অমঙ্গল দূর হবে? মা ওকে রাগ হলেই বলত ও বাবাকে খেয়েছে। তারপর পরে বলত ওর জন্য আজ ওরা গ্রামের বাইরে। কি দরকার ছিল শ্যামের সাথে দেখা করার? জওয়ান লেড়কি মগর বেসরম। কান্নায় ভেঙে পড়েছিল ও আর ওকে মা ধমকেছিল।
হঠাৎই মনে পড়ে যায় শ্যামের কথা। সমীর মারা যাবার বেশ কিছু দিন পর খুশবু একটা চিঠি দিয়েছিল বলেছিল ও কলেজে ভর্তি হয়েছে। যদিও মা বাবা বিয়ে করাতে চায় কিন্তু ও না বলে দিয়েছে। তবে ওর একজনকে ভালো লাগে। ওর মাসীর দেওরের ছেলে। মেহেককে বারবার বলেছিল আবার জীবন শুরু করতে আর পড়াশোনা করতে। ওর জন্য এখনও কেউ অপেক্ষায় আছে। চিঠিটা পড়ে খুব রাগ হয়েছিল, খুশবু কি চায় ওকে এখান থেকেও ওরা তাড়িয়ে দিক। তাড়াতাড়ি চিঠিটা ছিঁড়ে, জলে ভিজিয়ে ফেলে দিয়েছিল পেছনের বাগানে।
*******************************
মেহেকরা চলে যাবার পর কদিন জ্বরে ভুগে বিছানা নিয়েছিল শ্যাম। কারও সাথে কোন কথা বলতে ইচ্ছা করেনি। তারপর চলে গেছিল হস্টেলে। বাবার খরচে পড়াশোনা করতে আর ইচ্ছে করেনি।
মাঝে মাঝেই মনে পড়ে যায় মায়ের মার খাওয়ার দৃশ্য আর মেহেকের চুলের মুঠি ধরে বাবার সেই রক্তচক্ষু শাসনের সাথে নোংরা গালাগালির কথা। এখন অনেকগুলো টিউশনি করে শ্যাম তাতেই চলে যায় ওর দিন। মুখিয়া বেঁচেছে ছেলেকে কোন খরচ দিতে হয় না বলে। নিজেকে অনেকটা স্বাধীন লাগে শ্যামের অন্ততঃ উঠতে বসতে বাবার কথা শুনতে হয় না। শুধু মায়ের জন্য মাঝে মাঝে বাড়ি আসে। তখন এলোমেলো পায়ে হাঁটে জমির আলপথে অথবা নদীর পাড়ে মনে মনে মিঠিয়ার সাথে। খুশবুর কাছে শুনেছিল মেহেকের বর খুব ভালো দেখতে। মেহেককে চোখের আড়াল করে না। শুনে মনে হয়েছিল ভালো থাক মিঠিয়া,ওর না হলেও অন্য কারও মন জুড়ে থাক। কিন্তু যখন শুনেছিল মেহেকের তাসের ঘর ভেঙেছে। খুব দেখতে ইচ্ছে হয়েছিল ওকে।
আশ্রমে তোড়জোড় শুরু হয়েছে যজ্ঞের। যদিও গুরুদেবের ইচ্ছা ছিল আগে সঙ্কটনাশিনী যজ্ঞ হবে তারপর পুত্রপ্রাপ্তি যজ্ঞ। কিন্তু রাজীবের সাথে কি যেন কথা হয় আর তাতেই মত বদলে বলেন এখনই নাকি সঠিক সময় পুত্রপ্রাপ্তি যজ্ঞের। আজ রাত থেকেই শুরু হবে যজ্ঞ।
মেহেক নিজের ঘরে শুয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ কারণ কোন বিধবা মহিলাকে দেখতে নেই এই যজ্ঞ। অনেকক্ষণ ঘুম আসে না ছটফট করে তারপর একটা সময় ঘুমিয়ে পড়ে। রাজীব আর মিছরি যজ্ঞে বসেছে অনেকক্ষণ,হোমের গন্ধে আর চরণামৃতের স্বাদে কেমন যেন আচ্ছন্ন লাগে ওদের। একটা সময় গুরুদেব চ্যালাকে বলেন রাজীবকে ঘরে পৌঁছে দিতে। ওর কাজ শেষ হয়ে গেছে,এবার শুধু মিছরিকে শোধন করা হবে।
ভোর রাতে দরজায় এসে ধাক্কা মারে মিছরি তবে দরজা এমনিতেই খুলে যায়,রাজীব তখন চিৎপাত হয়ে ঘুমোচ্ছে অঘোরে। মিছরির সারা শরীর তখন টলছে পরনের শাড়ি এলোমেলো,পিঠে ছড়িয়েছে ওর কোঁকড়ানো চুল। সারা মুখ মাখানো মেটে সিঁদুরে। রাজীবকে ঝাঁকাতে থাকে মিছরি,উঠিয়ে উঠিয়ে জী। ছোটি কিধার? ছোটি? মাঝের কাপড়ের পর্দা সরিয়ে তাড়াতাড়ি মেহেককে ডাকতে যায় মিছরি। দেখে বিছানা ফাঁকা। কোনরকমে নিজের আঁচল গুছিয়ে বুকে রাখে। চুলটা জড়ো করেই পা টেনে ছুটে আসে বারান্দায় দেখে মেহেক স্নান করে ভিজে কাপড়ে উঠে এসেছে বারান্দায়। আবছা অন্ধকারে দেখে হাঁটুর নিচে ঝুলছে ওর সোজা চুল। মাথায় কোন ঘোমটা নেই,খোলা গায়ে শাড়ি জড়ানো। ওকে দেখেই চেঁচিয়ে ওঠে মেহেক চাপা গলায়," রাত মে শোয়ি নেহি ক্যায়া। আভি কোই নাহাতা হ্যায়। জলদি চল ইহা সে নিকলনা হ্যায় অভি।" বলেই মেহেককে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। মেহেকও কাঁদে অঝোরে। দুজনের কান্নার ঝরে পড়া জলে ভিজে যায় মাটি।
মেহেক নিজের ঘরে ঢুকে যায়। ভিজে কাপড় মাটিতে ফেলে শুকনো কাপড় জড়ায়। ও ঘর থেকে জিজির চাপা ডাক শুনতে পায়," উঠিয়ে জী। অভি নিকলনা হ্যায়। ও পাষন্ড গুরুজী এক কামুক পিশাচ। হে ভগওয়ান মেরে সর্বনাশ কিয়া,ইজ্জত লুটা মেরা। ইয়ে জরুর আপকো মালুম থা। উঠিয়ে উঠিয়ে।"
ঝরঝর করে চোখের জল পড়ে মিছরির ওর সন্তান হয়নি বলে যে ওকে এভাবে গুরুজীর হাতে তুলে দেবে শাশুড়িমা ও ভাবতেই পারেনি। অনেক ডাকাডাকি করে তোলে রাজীবকে সব শুনে প্রথমে চুপ করে বসে থাকে তারপর কিছুক্ষণ বাদে বলে ," তু বলি না,মুঝে ঘোট হ্যায়। উসি লিয়ে বাচ্চা নহি হো রহা হ্যায়। তব তো মাজী বোলি গুরুজীকি আশ্রম মে আনে কো। ইস মে কুছ বুরা নহি হ্যায়। মহাভারত য়্যাদ হ্যায় না,ব্যাসদেব তো অ্যায়সেই বংশরক্ষা কিয়া। দো রানী কো সহবাস করনা পড়া উসকে সাথ। দাসী কো ভি।"
রাগে ফেটে পড়ে মিছরি," কামুক গুরুজী,শয়তান কাহাকা। ভগওয়ান কা লাখ কৃপা যো ছোটি বাঁচ গয়ি। তুমহারা মা কো সামলনে দো ঘরকে কাম। হম অব নহি যায়েগী উস ঘরমে। ছোটি তু বাঁচ গয়ি নহি তো।"
চুপ করে এক সন্তানহীন নারীর ধর্ষণের কথা শোনে মেহেক। তারপর ক্লান্ত শরীরে রওনা দেয় ওরা আশ্রমের গন্ডী পেরিয়ে রাস্তার দিকে। সকাল সকাল স্টেশনে পৌঁছলে ট্রেনটা পেয়ে যাবে।
*****************************
আগে থেকেই কথা ছিল,সাতদিন আশ্রমে থেকে রাজীব মিছরিকে বাপের বাড়িতে রেখে ফিরে আসবে। কিছুদিন বাপের বাড়ি আর দিদির বাড়ি থাকবে মিছরি। মেহেক বাড়িতে ফিরে আসবে রাজীবের সাথে। কারণ এদিকে সংসার সামলাবে কে?
জেদ করে মেহেককেও ছাড়ে না মিছরি। তাতে অবশ্য বেঁচেছে ও। ঐ বাড়িতে আজকাল কেমন যেন ভয় করে ওর। মিছরি গজগজ করতে থাকে বুঝুক বুড়িয়া কাম করুক একা কিছুদিন। কিছুতেই ওর অপমান ভুলতে পারে না,নিজেকে গলায় ফাঁস জড়িয়ে মেরে ফেলতে ইচ্ছা করে মিছরির। সমানে দোষারোপ করে স্বামীকে কোন কিছুতেই যেন মাথা ঠাণ্ডা হয় না ওর। ইচ্ছে করে খুন করতে শয়তানটাকে।
বাপের বাড়িতে কিছুদিন কাটিয়ে মনের জ্বালা ভুলতে চেষ্টা করে মিছরি। মাঝ বয়েসী বুড়োটার নখের আঁচড় আর কামড় এখনও যেন তাড়া করে বেড়াচ্ছে ওকে। সত্যিই আর ফিরতে ইচ্ছে করে না শ্বশুরবাড়িতে। অথচ মা বাবা বলে ওটাই নাকি ওর নিজের ঘর। মনে মনে গালি দেয় মিছরি কেন যে মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছিল কে জানে? শুধুই কি দাসত্ব করার জন্য? প্রথম থেকে মা বাবা শিখিয়েছিল মেয়েরা অন্যের সম্পত্তি হয়। ভালো করে পড়াশোনা পর্যন্ত শেখা হয়নি ওর। সব কথা মনে এলে নিজেই থুতু ফেলে মাটিতে ঘেন্নায়।
বড়ি জিজির বাবার অনেক বড় বাড়ি, দোতলার ঘরে ও আর জিজি শোয় একসাথে। কত রাত অবধি জিজি লুকিয়ে কাঁদে,গালাগালি করে রাগে। মেহেক চুপ করে শোনে সব কথা মাঝে মাঝে ছোট আলো জ্বালিয়ে ওর খাতাটা বার করে লেখে নিজের জীবনের কথা। মেহেককে দেখে অবাক লাগে মিছরির। মেয়েটার জীবনে যেন কিছুই আর নেই। অথচ কতই আর বয়েস। পড়াশোনা করতে কত ভালোবাসে কিন্তু ঐ বাড়িতে আর কোনদিন ওর পড়াশোনা হবে না। তবুও মেয়েটাকে বাঁচাতে পেরেছে গুরুজীর হাত থেকে এটাতে কিছুটা শান্তি লাগে।
দুদিন হল মিছরি দিদির বাড়িতে এসেছে। ওর বড়দি বিধবা আর নিঃসন্তান। প্রচুর সম্পত্তির মালকিন। এই নিয়েও অনেক কথা শুনেছে মিছরি। রাগ হলে শাশুড়ি বংশ নিয়েও কথা বলেছে কত। তবে একটা কথা মিছরি কাউকে বলেনি যে ওর বাপের বাড়ির ডাক্তার পেটের ছবি তুলে বলেছে যে ওর মা হওয়ার তেমন আশা নেই। বাচ্চা হবার থলিতে কি সব গন্ডগোল আছে। অপমানের ভয়ে সে কথা রাজীবকেও বলেনি মিছরি। দেখতে দেখতে বেশ কিছুদিন কেটে গেছে।
রাজীবের কাছে সব শুনে রাগে ফোঁসে ওর মা," রহেনে দো ম্যায়কে, ছোড় দো উসকো। তব সমঝেগি। দুসরি শাদী কর দেঙ্গে হম তেরা।"
কদিন ধরেই মেহেক ভালো করে খেতে পারে না। শরীরটা কেমন যেন অস্থির লাগে,মাথা ঘোরে। সেদিন রাতে খেতে বসে বমি করল মেহেক। মিছরির দিদির অদ্ভুত লাগে মেহেককে দেখে। অদ্ভুত চুপচাপ মেয়েটা,সারাদিনে হয়ত চারটা কথা বলে। সব সময় কি যেন ভাবে। না হলে লেখাপড়া করে। কিন্তু হঠাৎ বমি করছে কেন?
**************************
" ছোটি পেট সে! নহি এ ক্যায়সে!" মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে মিছরির। আশ্চর্য ভাবে গুরুদেবের কামনা বাসনার শিকার মিছরি হলেও মা হতে চলেছে মেহেক। ওরা দুই বোন মেহেককে দরজা বন্ধ করে আটকে রাখে। মিছরি সমানে কপাল চাপড়ায় আর গালাগালি করে। অদ্ভুত রকম চুপচাপ মেহেক ওর চোখে অবিশ্রান্ত জলের ধারা। শোভার মায়া হয় মেয়েটাকে দেখে, নিজের কম বয়েসের কথা মনে পড়ে। বিধবা মেয়েমানুষের কত জ্বালা। এমনভাবে একসময় ও নিজেও হেনস্থা হয়েছিল দেওরের কাছে,এমন কি শ্বশুর পর্যন্ত শুতে এসেছিল ওর সাথে। ভেবেই বমি আসে এত বছর বাদেও। ভাগ্যিস বাবা মা পাশে ছিল তখন আর ছিল স্বামীর কিছু টাকা। সেই টাকা ব্যবসায় লাগিয়ে আজ এত কিছু করেছে। শোভা মিছরিকে বোঝায়," থোড়া প্যায়ার সে সমঝা উসে। বাত কর ধীরে,জানলে কৌন হ্যায় ইসকে পিছে? মালুম হোতা হ্যায় ঘরকে হি কোই হোগা। চিল্লানা মত। ডঃ সে বাত করুঙ্গী ম্যায়,কুছ তো করনা হোগা।"
দিদির কথা শুনে অবাক হয়ে যায় মিছরি। জানতেই হবে ওকে কি করে হয়েছে এমন?
মিছরি মেহেককে বোঝাতে শুরু করে, বারবার ভালো কথায় জানতে চায় কে করেছে এমন ওর সাথে? সত্যিই তো বাড়ি থেকে কোথাও যায়নি মেয়েটা। তবে কি গুরুজীই কখনও? কিন্তু কখন? নাকি রাকেশ? রাকেশের খারাপ নজর আছে মেহেকের ওপর।
মিছরির ভালো ব্যবহারে ভেঙে পড়ে মেহেক আর নিজেকে সামলাতে পারে না হঠাৎই লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে কান্নায়। ওর কাছে সব ঘটনা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় মিছরি। যে রাতে গুরুজী মিছরি আর রাজীবকে নিয়ে যজ্ঞ করেছিল সেখানে পূজার চরণামৃত আর প্রসাদে নেশার জিনিস মেশানো ছিল তা নিজেও বুঝতে পেরেছিল পরে মিছরি। ওদের শোবার জন্য যে দুটো ঘর ছিল তাতে মাঝখানে একটা চটের পর্দা টাঙানো থাকত। দুদিন মেহেককে নিয়ে মিছরি শুয়েছে এক ঘরে মেঝেতে আর রাজীব অন্য ঘরে চৌকিতে।
সেদিন রাতে মেহেক ঘুমিয়ে পড়েছিল দরজা বন্ধ করে। ও জানত জিজির পূজা সেরে আসতে দেরি হবে। হঠাৎই দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ পায় জোরে জোরে চমকে উঠে ও কান পাতে দরজায়.." কৌন?"
ওদিক থেকে ভাসুরের গলার আওয়াজ শুনে দরজা খুলে দেয় মিছরি। রাজীব টলতে টলতে এসে ঘরে ঢোকে,বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। মেহেক জিজ্ঞেস করে, "জিজি কাহা?"
উত্তর পায় না কোন। দরজা বন্ধ করে পর্দা টেনে শুয়ে পড়ে মেহেক। কিছুক্ষণ বাদে শুনতে পায়- " মিছরি পানি, পানি দো। গলা শুখ রহা। মিছরি..."
তাড়াতাড়ি উঠে ঘরের মেঝেতে রাখা মাটির কুজো থেকে জল নিয়ে গিয়ে দাঁড়ায়," উঠিয়ে, পানি।"
কোন রকমে জল ওর হাত থেকে নিয়ে জল খেয়েই শক্ত হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে রাজীব। সমীরদের ভাইয়েরা সবাই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। তার মধ্যে রাজীব সবচেয়ে বেশি লম্বা আর মজবুত। একা হাতে চাষবাস গরু মোষ সব সামলায়। ওর শক্ত লোহার মত হাতের বাঁধনে ছটফট করতে থাকে মেহেক একটা নরম রোগা পায়রার মত। আপ্রাণ বলতে থাকে ছোড়িয়ে মুঝে,ছোড় দিজিয়ে। নিজেকে ছাড়াবার অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় মেহেক। রাজীবের তখন নেশার ঘোর কোন কথাই কানে আসে না ওর। জাপটে বিছানায় শুইয়ে নিজের কামনা চরিতার্থ করে এক সময় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে।
" উস্ রাত মে হম দোনো কি ইজ্জত লুট গয়ি জিজি। মগর হম তুমকো কুছ নেহি বোল সকি তুমহারা হালত দেখকে। ক্যায়া করতি ম্যায় তুম বোলো? জান লেতি ক্যায়া দাদা কি?"
স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে মিছরি। ছিঃ একজন ধর্ষকের স্ত্রী সে। রাজীবের ওপর ঘৃণায় গা গুলিয়ে ওঠে। গালাগালি করে নিজের ইচ্ছেমত," শালে শুয়ার, বিবিকো দুসরে মরদ কো পাস ভেজকে খুদ ইজ্জত লুট রহা থা ছোটি বহুকা "
হঠাৎই আবার কি যেন একটা মনে পড়ে যায়। সত্যিই তো রাজীবের ব্যবহারে কোন অস্বাভাবিকতা দেখেনি। মেহেককে বরং খুব চুপচাপ লেগেছে। রাজীবের সামনে খুব একটা আসেনি যে কদিন ও এখানে ছিল। হঠাৎই আবার মনে হল স্নান করার পর রাজীবের গায়ে আঁচড়ের দাগ দেখে বলেছিল," ইয়ে ক্যায়সে হুয়া হাঁ?"
রাজীব বলেছিল," মালুম নেহি,জ্বল রহা হ্যায় বহত।"
রাগ করে মিছরি বলেছিল," চুড়েল নে নুচ লিয়া মালুম হোতা। জ্বল জ্বলকে মর তু আর তেরা মা।"
তাড়াতাড়ি এসে মেহেককে তুলে বসায়," তুঝে ক্যায়া লাগতা হ্যায় ও জান বুঝকে ইয়ে সব কিয়া?"
মেহেক কাঁদতে কাঁদতে বলে," মুঝে মালুম নেহি কুছ জিজি। আচানক জেঠজি কুদ পড়া মুঝপে তব ও তুমাহারা নাম পুকারা পহেলে।"
মিছরির মনে পড়ে যায় যজ্ঞের সময় সারা ঘর যখন ধূপ ধুনোতে ভর্তি তখন ঐ বদমাশ গুরু কি যেন একটা ঢেলে ঢেলে খাচ্ছিল। আর কিছুটা মাটির গ্লাসে করে দিচ্ছিল রাজীবকে। বলছিল," পি লে বেটা,ইস সে জোস আ যায়েগা। বীর্যবান বনেগা তু। পুত্র জরুর হোগা। পি লে মন ভর কে।"
মিছরিকেও দিয়েছিল সেই ঝাঁঝালো তরল চরণামৃত বলে। গা গুলিয়ে এসেছিল ওর,খেতে পারেনি পুরোটা। তবে রাজীব খেয়েছিল অনেকটা।
হঠাৎই উগ্ৰ মূর্তি ধরে মিছরি," মান লিয়া উসে কোই হুঁস নেহি থা। তু? তুঝে তো সব মালুম থা। কিউঁ নহি চিল্লায়ি হাঁ? তুঝে ভি মজা মিলা না? ইয়ে বাচ্চা তুঝে গিরানা পড়েগা সমঝি। নহি তো জান সে মার দুঙ্গী তুঝে। ইশ দুনিয়ামে সব লোক বেইমান। ছোটি বহেন জ্যায়সী দেখি তুঝে নহি তো কব রাকেশ তুঝে খারাব কর দেতা।"
মিছরি সমানে চড় মারে মেহেকের গালে। চিৎকার শুনে দরজার বাইরে আর থাকতে পারে না শোভা। তাড়াতাড়ি ঘরে এসে মেহেককে বাঁচায়। অদ্ভুত চুপচাপ মেয়েটা। মিছরির কাছে সব শুনে অবাক হয়ে যায় শোভা। কান্নায় ভেঙে পড়ে মিছরি। শোভা ওকে বুঝিয়ে ঠান্ডা করে পাশের ঘরে নিয়ে যায়। একা চুপচাপ বসে থাকে মেহেক এখন কি করবে ও? সমাজে কোথাও ওর ঠাঁই হবে না। কথাটা তো এবার সবাই জানবে। এর থেকে মরে যাওয়াই ভালো। না ও আর বাঁচতে চায় না।
চোখের জলে বিছানা ভিজিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝতেই পারেনি। হঠাৎই দরজার আওয়াজে ঘুম ভাঙে। বুঝতে পারে অনেকটা রাত হয়ে গেছে। শোভা আর মিছরি দুজনেই ঘরে এসেছে হাতে একটা ল্যাম্পটা টেবিলে রেখে মিছরি ওর মাথার এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দেয়। শোভা ওর হাতটা টেনে নেয়। সহানুভূতি পেয়ে ডুকরে কাঁদে মেহেক," মুঝে জহর দে দো জিজি। মুঝে মরনা হ্যায়।"
মিছরি ওকে ধমকায়," ফির কভি না বোলনা মরনে কো বাত। জিন্দেগী খুশি সে জিয়েগী তু। দিদি তুঝে পড়ায়েগি।" অবাক হয়ে তাকায় মেহেক শোভার দিকে। শোভার মুখে খেলা করে স্নেহের হাসি।
***************************
মা যা খুশি বলুক না কেন। মিছরির জন্য রাজীবের মন খারাপ করে খুব,সব যেন এলোমেলো লাগে। খুব রেগে আছে মিছরি। ঠিক করে ওকে এবার আনতে যাবে। এতদিনে নিশ্চয় ওর রাগ কমে গেছে। হঠাৎই খুশির খবর নিয়ে আসে একটা চিঠি। মিছরি মা হতে চলেছে,তবে ডঃ একদম বেড রেস্টে থাকতে বলেছে ওকে তাই এখন আসতে পারবে না। দিদির বাড়িতেই থাকবে,আর মেহেকও ওখানেই থাকবে ওর দেখভালের জন্য। খুশির খবরে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় রাজীব,ওর মা গুরুজীর ছবিতে মালা পরিয়ে লাড্ডু চড়ায়।
রাজীব রওনা দেয় নতুন কাপড়জামা আর মিঠাই নিয়ে ট্রেনে করে।
মেহেকের শুরু হয় এক নতুন পরীক্ষা। মিছরি যখন রাগে অস্থির তখন শোভা ওকে বোঝায়," ছোটি ধ্যান সে শুন,ইয়ে বাচ্চা রাজীবকা। তেরে বাচ্চা নহি হোনে সে ও বদমাশ দুসরা শাদী করেগা জরুর। নহি তো ফির সে ও গুরুকে পাস তুঝে লে যায়েগা। তু এ বাচ্চা রাখ লে। দুনিয়া কো মালুম হোগা এ তেরা বাচ্চা। শরম সে মেহেক কিসিকো কুছ নহি বোলেগি। বদলে মে উসকো কলেজ মে প্রাইভেটমে পড়ায়েঙ্গে হম। দোনো কাম এক সাথ চলেগা।"
দিদির কথা শুনে অবাক হয়ে যায় মেহেক,এত বুদ্ধি দিদির! কথাটা খারাপ বলেনি। সতীন আনার থেকে এ বরং ভালো। সত্যিই তো বড় অসহায় মেয়েটা। ওর তো কোন দোষ ছিল না।
-" মগর ও মান জায়েগী?"
-" বাত করকে দেখ তো পাগলী। তু সচমুচ পাগল হো গয়ি।"
অদ্ভুত ভাবে মিছরির কান্না দেখে মেহেক মেনে নিল সবটাই। শুধু বারবার বলতে লাগল," মুঝে পড়না হ্যাঁয় বড়ি দিদি। "
শোভা অবাক হয়ে যায় মেয়েটাকে দেখে। সত্যিই বোধহয় মেয়েরা কখনও দেবী। মিছরি কে মা বানানোর জন্য কতবড় ত্যাগ করছে মেয়েটা! কত বড় অন্যায় মেনে নিয়ে চুপ করে বসে রইল।
রাজীবকে দেখে ভেতরটা জ্বলে উঠল মিছরির। মনে পড়ে গেল সব কথা আবার। তবুও চুপ করে রইল। আনন্দে আত্মহারা রাজীব,বারবার বলল ওখানে গেলে খুব যত্ন করবে মিছরিকে। শোভা রাজি হল না। বলে দিল এটা শহর এখানে ভালো চিকিৎসা হবে,আর ওর সবসময় ডাক্তার লাগবে কারণ মিছরির অনেক সমস্যা আছে। তাছাড়া প্রথম বাচ্চা তো বাপের বাড়িতেই হয়। মেহেককে কদিন একটু তফাতেই রাখল শোভা। ওর কারখানার ম্যানেজারকে দিয়ে ব্যবস্থা করে বেশ কিছু বইপত্র এনে দিয়েছে ওকে। রাজীবকে দিয়ে ওর কাগজপত্র আনিয়েছিল বুদ্ধি করে শোভা। মেয়েটা পাগলী সারাদিন বই নিয়ে থাকে আর লেখে কি সব খাতায়। নিজের শরীরের কোন যত্ন নেই। শোভাকে আর মিছরিকেই ওর যত্ন করতে হয়। নিয়ম করে ডাক্তার দেখানো আর ভালোমন্দ খাওয়াতে হয়।
ছোটি ভাবিকে বাড়িতে না দেখে রাগে জ্বলে ওঠে রাকেশ অসভ্যর মত বলে," বড়ি ভাবি পেট সে হ্যায়। ছোটি ভাবী তো নহি হ্যায়। ক্যায়া কর রহি উধার? ইধার ঘরকে কাম কৌন করেগি?"
মায়ের আর দাদার ধমক খেয়ে চুপ করে। আসলে শোভাকে বেশ ভয় পায় রাকেশ তাই সাহস হয় না আর ওখানে যেতে। নাহলে ইচ্ছে করছিল টেনে নিয়ে আসতে ওখান থেকে। শুধু মনে মনে ভাবে আসুক এখানে তারপর দেখে নেবে.....
*****************************
মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো মাস। মিছরিকে একটু আড়ালে আড়ালেই রাখে শোভা। আর মেহেক তিনতলায় ছাদের ঘরে থাকে। বাপের বাড়িতে বলে দিয়েছে গুরুজীর আদেশ তাই খুব সামলে রাখতে হয়েছে ওকে যাতে নজর না লাগে। যত্নে তেল মাখাতে মাখাতে মেহেকের পেটে কান রাখে মিছরি। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে চায় সন্তানের অস্তিত্ব। এর মধ্যে শোভা বারণ করলেও রাজীব এসেছিল হঠাৎই একদিন। তবে মিছরি ওর কাছে শুতে যায়নি,বলেছিল ডাক্তারের বারণ আছে। ইচ্ছে করেই ওরা একটা ভুল তারিখ বলে দিয়েছিল রাজীবকে। শোভা বলে দিয়েছিল সে সময় আসতে।
দিদির বাড়ির যত্নে বেশ ভরন্ত হয়েছে মিছরি। কোন কাজকর্ম নেই শুধু ভালো মন্দ খাওয়া। রাজীব বলল," ইতনি খুবসুরত ক্যায়সে হাঁ? মালুম হোতা লেড়কি হোগা। মগর মুঝে তো লড়কা চাহিয়ে।"
মিছরি দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল," তুমলোগ য্যায়সে আউর এক জানোয়ার। হ্যায় না?"
ওর কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল রাজীব,কিন্তু কিছু বলতে পারেনি।
দুদিন আগেই মেহেককে শহর থেকে সরিয়ে নিয়ে অনেকটা দূরে একটা নার্সিংহোমে ভর্তি করেছে শোভা। অনেকটা খরচ হবে সবটা করতে, তবুও বাঁচুক বাচ্চাটা। নিজের পেটে হাত রাখে শোভা,ওর বর যখন মারা যায় দুমাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল। কিন্তু বাঁচাতে পারেনি বাচ্চাটাকে। হঠাৎ একদিন দেওর এসে চড়াও হয়েছিল ওর ওপর। ধস্তাধস্তিতে পড়ে গিয়ে রক্তে ভেসে গিয়েছিল শোভা। মনে হলে এখনও ভেতরটা কাঁপতে থাকে। ও থাকলে আজ হয়ত এই মেয়েটার মতই হত বয়েসে।
রাজীব রওনা দিয়ে আসার আগেই চিঠি আসে লড়কা হুয়া। আনন্দে পাগল হয়ে যায় রাজীব। জয় গুরুজীকি বলতে বলতে হাজির হয় ততদিনে প্রায় দশ বারো দিন পার হয়ে গেছে। মেহেক অনেকটা ভালো এখন। মিছরি কোল আলো করে বসে আছে বাচ্চা নিয়ে। রাজীব চোখ সরাতে পারে না," বিলকুল মেরে য্যায়সে। বাপ কা বেটা।"
মিছরি মেজাজ করে বলে," বাপ কা বেটা না গুরুজীকা বেটা ক্যায়া মালুম?"
-" উস্ বাত কো ভুল যা অব। ইয়ে মেরা হি বেটা হ্যায়। কব আওগি ঘরমে?"
শোভা আর মিছরি দুজনেই বলে এখন যাবে না। বাড়িতে গেলেই রাজ্যের কাজ করতে হবে। একদম শরীর সারিয়ে যাবে।
মিছরি অবাক হয়ে যায় রাজীবের কথা শুনে," তব ছোটি বহুকে ভেজ দো,ঘর মে বহত প্রবলেম হো রহা হ্যায়।"
ওর কথা শুনে মিছরির মাথায় আগুন জ্বলে যায়," ছোটি মেরে সাথ আয়ি থী মেরে সাথ যায়েগী।"
রাজীবের অবাক লাগে,এর আগের বার এসেও দেখেনি ছোটি বহুকে এবারও দেখতে পাচ্ছে না। তাই বলে," দেখাই নহি দে রহি কাহা গয়ি ও?"
" তুম সে মতলব? কাম কর রহী কুছ ওপর মে। বড়ে হো ভুল গয়া ক্যায়া?"
হঠাৎই ছেলে কেঁদে ওঠে,শোভা তাড়াতাড়ি ওকে কোলে নিয়ে চলে যায় ঘরে। মেহেক বুকের অমৃত ধারায় শান্ত করে ওকে। আজকাল মুন্নার কান্না শুনলেই ওর বুকের ভেতরটা টনটন করে। অদ্ভুত একটা আনন্দ আর সুখ হয় ওকে কোলে নিয়ে। জিজি ওকে কেন যেন বেশি দিতে চায় না তবে রাতে মুন্নাকে মাঝে নিয়ে ওরা ঘুমায়। সারা রাত ছেলের খেয়াল মেহেকই রাখে।
দেখতে দেখতে প্রায় একটা বছর হয়ে আসছে। এবার মিছরিকে যেতেই হবে শ্বশুরবাড়িতে। রাজীব এর মধ্যে অনেকবার এসে ঘুরে গেছে। মিছরি আবার অভ্যস্ত হয়ে গেছে পুরোনো দাম্পত্যে। মুন্নাকে পেয়ে ভুলে গেছে সব কিছু। ভেবেছে জো হুয়া ও আচ্ছাই হুয়া। রাজীব যে রাতটা থাকে মুন্নাকে নিয়ে মেহেক আর শোভা শুয়ে পড়ে। মনের সুখে আদর করে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে দুধ খাওয়ায় মেহেক। প্রথমটা অবাক হলেও এখন রাজীবের গা সওয়া হয়ে গেছে বরং অনেকদিন বাদে মিছরিকে পুরোপুরি কাছে পেয়ে শরীরের খেলায় মেতে ওঠে। অনেক ঘৃণা আর রাগ বুকে চেপেও মিছরি ওর উন্মুক্ত বুকে রাজীবের আঁচড় সহ্য করে।
মেহেক পড়াশোনা অনেকটা এগিয়ে নিয়েছে এর মধ্যেই। কলেজের একটা পরীক্ষাও দিয়েছে প্রাইভেটে। ওর রেজাল্ট শুনে অবাক হয়ে গেছে শোভা। মেয়েটার এত ইচ্ছে পড়ার! অথচ কত কি সহ্য করছে মেয়েটা। তার মাঝে দু একটা চিঠি লিখেছে বাড়িতে। সেখান থেকেই জানতে পেরেছে খুশবুর বিয়ে হয়ে গেছে। খুশবুর খুব ইচ্ছা ছিল মেহেক আসুক,কিন্তু ওকে ডাকতে পারেনি। সেটা দুঃখ করে জানিয়ে চিঠি লিখেছে। শুনেছে মেহেক ওর বর পুলিশ অফিসার শুনে ভালো লেগেছে ওর। খুশবুর কপালটা ভালো তাও তো জীবনে ওর মনের মানুষকে পেয়েছে।
খুশবু লিখেছে," মেরে অ্যাড্রেস সামালকে রাখনা। আ যানা কভি বহত মজা হোগা। মেরে ও বহত আচ্ছে হ্যায়। তু শাদী মে আনে সে কিতনা আচ্ছা হোতা।"
বুঝতে পারে মেহেক ও বিধবা বলে ওকে কেউ ডাকেনি। অবশ্য ওর যাওয়ার কোন উপায় ছিল না তখন। মাঝে মাঝে মনে হয় গ্রামের সবাই ওকে ভুলে গেছে এমনকি নিজের মা,দাদারাও।
শ্বশুরবাড়িতে ফেরার আগে মুন্নাকে বোতলের দুধ খাওয়ানো অভ্যেস করাতে হিমসিম খায় মিছরি। চিৎকার করে অস্থির হয় ছেলে। বই ফেলে ছুটে আসে মেহেক দৌড়ে তারপর আদরে অমৃত খাইয়ে শান্ত করে ছেলেকে।
মিছরি ওকে ধমক দেয়," উসকা আদত মত খারাব কর না ছোটি। উধার যাকে ক্যায়া করেগি বোল?"
চোখে জল আসে ওর," জিজি,মুন্না নেহি শোয়েগা মেরে পাস মে? মেরে পড়াই নেহি হোগা?"
শোভা ওকে ভরসা দেয়,"জরুর হোগা,ম্যায় লে আউঙ্গী তুঝে উস টাইম মে,যব তেরা এক্জাম আয়েগা।"
ছেলে কোলে এসে উঠোনে দাঁড়ায় মিছরি,শাশুড়ি এসে নজর কাটায় তাড়াতাড়ি। পাড়ার বৌরা ভিড় করে এসেছে দেখতে। শোভা প্রচুর জিনিসপত্র পাঠিয়েছে ওদের সাথে। সবাইকে মিস্টিমুখ করে বিদায় করে শাশুড়ি। দেখতে দেখতে বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেছে। খুব সাবধানে মেহেকের কাছ থেকে বাঁচিয়ে রাখে ছেলেকে মিছরি। ওকে দেখলেই কান্না জুড়ে দেয় ছেলে। সারাদিন নানা কাজে কেটে যায় ওর। শুধু রাতে ওর ঘরে নিয়ে আসে ছেলেকে,নাহলে বেটা কিছুতেই ঘুমায় না। দরজা বন্ধ করে বুকের দুধ খাইয়ে ছেলেকে ঠাণ্ডা করে ঘরে নিয়ে আসে মেহেক। অনেক সময় ভোরবেলা কান্নাকাটি করলে মেহেকের কাছে দিয়ে কাজ সারে মিছরি।
শহর থেকে ছুটিতে বাড়ি এসেছে রাকেশ। অনেক দিন বাদে বাড়িটা ভরা ভরা লাগে। বাড়িতে নতুন বাচ্চা এসেছে। বড়া ভাইয়ার মেজাজ খুশ। ভাবী ছেলে কোলে নিয়ে দেমাকে এদিক ওদিক ঘুরছে। কিন্তু ছোটি ভাবি কই? বেশ তো এতদিন বড়ি ভাবীর বড়লোক দিদির বাড়ি আরাম করে এল। হঠাৎই স্নান করে বেরোতে দেখল মেহেককে। মেহেকের লম্বা চুলের জলে পেছনটা ভিজেছে। শরীরে জড়ানো আসমানী রঙের পাতলা শাড়ি। ভেজা শাড়ির ভালোবাসায় ফুটে উঠেছে শরীরের খাঁজ। রাকেশ চোখ সরাতে পারে না। অদ্ভুতভাবে লক্ষ্য করে আগের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর হয়েছে ছোটি ভাবী,শাড়ির ভেতর দিয়েও স্পষ্ট ভারী বুক। সারা শরীর লাবণ্যের মাখামাখিতে একদম ঢলঢলে।
হঠাৎই রাকেশকে দেখে চমকে ওঠে মেহেক। মনে পড়ে যায় সমীর মারা যাবার পর কি ভাবে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল রাকেশ ওকে। তাড়াতাড়ি আঁচলে সারা শরীর ঢাকতে ঢাকতে ঘরের দিকে পা বাড়ায়। রাকেশ পান খাওয়া দাঁত বার করে হাসে," আরে রুকো ভাবী,কিতনে দিন বাদ মে মোলাকাত। থোড়ি মিঠি বোলি তো কর দো। ম্যায় তেরি লাডলা দেবর। মালুম হ্যায় না।"
মেহেক বলে," আয়ি বাদ মে।"
রাকেশ ততক্ষণে ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে উঠোন থেকে। ওর কান ঘেঁষে বলে যায়," থোড়ি সি মোটি মগর বহত খুব সুরত হো গয়ি হো। রাজ ক্যায়া হ্যায় জী ছোটি ভাবী?"
রাকেশের ইঙ্গিতে গা গুলিয়ে আসে মেহেকের। এরা ভাইরা সত্যিই অদ্ভুত। একজন মিছরি ভেবে ওর ইজ্জত নিল,তারপর সব বিলকুল ভুলে গেল? আরেকজন যাকে ও ভরসা করেছিল সে ওকে ফাঁকি দিল। আর এ ওকে সারাক্ষণ ত্রাশে রেখেছে। তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে বইপত্র আলমারিতে রেখে তালা দেয় মেহেক। শরীরটা কেন যেন কাঁপে। বিধবা হওয়ার জন্য আরও কত কি সইতে হবে মুখ বুজে কে জানে? পড়াশোনা শিখে এই বাড়ি থেকে কোথাও চলে যাবে। কিন্তু কোথায় যাবে ও? থাকবে কোথায়? এরা কি ওকে যেতে দেবে? আচ্ছা শোভা দিদি যদি ওকে রাখে। খুব মনে হয় শোভার কথা মেহেকের। পরীক্ষার সময় শোভা ওকে নিয়ে যাবে বলেছে । সত্যিই দিদি খুব ভালোবাসে ওকে।
*************************
রাতে বাচ্চাটার চিৎকারে ঘুমাতে পারে না রাকেশ। বাড়ির লোকজন মিছরিকে বলে কেন এত কাঁদে রাতে ছেলে? মিছরি ঘোমটার আড়ালে বলে," মালুম নেহি বোতল সে দুধ তো পিলা রহি হু। শায়েদ পেট মে দর্দ হোগা।" সবাই জানে অনেক ইঞ্জেকশন নিয়ে মিছরির দুধ শুকিয়ে গেছে।
ছেলের কান্নাতে মেহেকেরও বুকটা টনটন করে। ওদের ঘরের পাশেই রাকেশের ঘর। তাই মিছরি রাতে আনতে পারে না বাচ্চাটাকে মেহেকের কাছে। দরজা বন্ধ করতে দেখলে যদি সন্দেহ করে? অনেক ভুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেও ঘুম ভাঙলেই বায়না শুরু। রাজীবও আজকাল বিরক্ত হয় ছেলের কান্নায়।
সেদিন ছেলেটা খুব কাঁদছে। ওকে বিছানা থেকে তুলে কোলে নিয়ে পায়চারি করতে করতে নিজের ঘর থেকে রাকেশের ঘরের দিকে তাকায় মিছরি। আলো জ্বলছে ঘরে। এত রাত পর্যন্ত জেগে কি করছে কে জানে? সেদিন বলেছিল," অব শাদী কর লে ছোটে।"
পাত্তাই দিল না সিধা বলল," মুঝে আজাদ রহনা হ্যায় ভাবী। ও ঘুঙ্গট ওয়ালা লেড়কি মুঝে নহি চাহিয়ে।"
ওর কথা শুনে অবাক হয়ে গেছিল।
ছটফট করে মিছরি ও জানে মেহেক রাতে ঘরের কোণে কেরোসিনের বাতি জ্বালিয়ে চুপচাপ বই পড়ে নাহলে লেখে দরজা জানলা বন্ধ করে।
একটা সময় পায়চারি করতে করতে আর ভালো লাগে না। শুলেই কাঁদছে ছেলেটা আর রাজীব মোষের মত ঘুমাচ্ছে। গালাগালি দেয় মিছরি ওকে,ওর ঘুম ভাঙে না। আবার খেয়াল করে, দেখে রাকেশের ঘরের আলো নিভে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তারপর ওর ঘরে গিয়ে কড়া নাড়ে আস্তে। মেহেক দরজা খুলে দেয়। ওর কোলে ছেলেকে দিয়ে চলে যায় মিছরি।
হঠাৎই একদিন রাকেশের চোখে পড়ে যায় ভোরবেলায় বড়ি ভাবীকে মুন্নাকে কোলে নিয়ে ছোটি ভাবীর ঘর থেকে আসতে। অবাক লাগে ওর,তাকিয়ে দেখে চারদিকে এখনও আবছা অন্ধকার! মুন্না ছোটি ভাবীকে ঘর মে?
সত্যিই আজকাল আর রাতে খুব একটা কাঁদে না বাচ্চাটা। শয়তানের চোখ থেকে বোধহয় কিছুই আড়াল করা যায় না। ঠিক তেমনি রাকেশ বারান্দার অন্ধকারে থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে আন্দাজ করল কিছুটা। তবে প্রমাণ চাই ওর তাই একদিন ভোরের হালকা আলোতে পেছনের জানলার ফুটো দিয়ে দেখল মেহেকের অনাবৃত স্তনে হাত দিয়ে ঘুমাচ্ছে বাচ্চাটা।
কিছুক্ষণ বাদেই মিছরি এসে দরজায় আওয়াজ করতেই মেহেক চমকে উঠে কাপড় ঠিক করে ওকে জড়িয়ে চুমু খেয়ে চুপচাপ দিয়ে দেয় ওর কোলে।
রাকেশের আনন্দে নিজের পিঠ চাপড়াতে ইচ্ছা করল। তার মানে ওর সতী সাবিত্রী সেজে থাকা ছোটি ভাবী আসলে মুন্নার মা। মাথাতে প্রশ্নের জট পাকিয়ে যায় রাকেশের। তাহলে বাচ্চাটার বাবা কে? জানতেই হবে ওকে। এবার পর্দা ফাঁস হবে ওর ভাবীদের। তারপর নিজেকেই বোঝায় খুব সাবধানে এগোতে হবে ওকে। বড় ভাবীকে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা নেবে কারণ বাজারে ওর অনেক দেনা। নিজে যা কামাই করে তা মদ,মেয়েছেলে আর জুয়াতে চলে যায়। আর এবার থেকে বাইরের মেয়েছেলের কাছে ও যাবে না রখেল করে ছোটি ভাবীকে রাখবে। যখন ইচ্ছে ওর জওয়ানী ভোগ করবে,"শালী সতী সাবিত্রী সাজতি। মালুম তো হোতা হ্যায় বড়া ভাইয়া কে সাথ ভী শোয়ি, ম্যায় বাদ রহুঁ কিঁউ হাঁ। আরে দেবর হুঁ ম্যায় তেরি।" মেহেককে ভোগের আনন্দে ঘরের কোণে রাখা বোতল থেকে গ্লাসের পর গ্লাস ঢালে গলায় রাকেশ মনে মনে ডুবে যায় মেহেকের অনাবৃত বুক আর ভারী নিতম্বে।
পরের দিন মুন্নাকে হঠাৎই লুফে নেয় মিছরির কোল থেকে। ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে ওকে নিজেই বলে ওঠে," বিলকুল বড়া ভাইয়া যাইস্যা হুয়া হ্যায়। তুমারি কুছ নেহি হ্যায় মুন্না মে। আরেব্বাস ইয়ে বিউটি স্পট মুন্না কো ভি হ্যায়!"
হঠাৎই কেমন যেন চমকে ওঠে মিছরি। ওর চমকে ওঠা চোখ এড়ায় না রাকেশের তাই গলায় আরও জোর এনে বলে," ছোটি ভাবীকে গাল মে হ্যায় না অ্যায়সা এক বিউটি স্পট। চাঁদ মে কলঙ্ক য্যায়সা। লাগতা হ্যায় মুন্না চাচী পর গয়া।"
মেহেকের মত যে মুন্নার গালেও একটা তিল আছে সে নিয়ে ওরা তেমন কেউ মাথা ঘামায় নি। আজ হঠাৎই রাকেশ একথা বলাতে চমকে ওঠে মিছরি। কি বলতে চায় রাকেশ তাহলে ও কি কোনভাবে সন্দেহ করেছে নাকি কিছু? কিন্তু কি করে জানবে? বড়িদিদি অনেক টাকা খরচ করে সব ঠিকঠাক করে দিয়েছে এমনকি বার্থ সার্টিফিকেট পর্যন্ত। মেহেক রান্নাঘরে ছিল,ঘোমটার আড়ালে চমকে ওঠে ও নিজেও। কি বলতে চায় শয়তানটা?
রাকেশ হো হো করে হেসে ওঠে হঠাৎই," আরে বড়ি ভাবী তুম তো ডর গয়ি,ম্যায় তো মজাক কর রহা। দেখু দেখু মুন্না তুঝমে কুছ হ্যায় ক্যায়া তেরে মা য্যায়সা।"
মিছরি গলায় শাসনের সুর এনে বলে," ক্যায়া ম্যায় ডরু তুঝসে? কান পকড়কে দুঙ্গী এক থাপ্পড়। অব তেরা শাদী করানাই পড়েগা।"
তাড়াতাড়ি মুন্নাকে ওর কাছ থেকে নিয়ে ঘরের দিকে যায় মিছরি, বুকের ভেতরটা কাঁপে। মেহেক রান্নাঘরে আগুনের তাপে ঘামে হঠাৎই। মনে মনে ভাবে যেভাবেই আসুক মুন্না পৃথিবীতে, ও বড় আদরের ওদের। দিদির মুখ চেয়ে আর পড়াশোনার বিনিময়ে ও সন্তানের জন্ম দিতে রাজি হয়েছিল। এখন ঐ নিষ্পাপ মুখটা বড় মায়ায় আটকেছে ওকে। ওর যাতে কোন ক্ষতি না হয়।
************************
শকুনির পাশার মত গুটি সাজায় রাকেশ। একবার যদি কথা বের করতে পারে আর চিন্তা নাই হাতে ধন আর লক্ষী দুই এসে যাবে এবার। কি করবে বড় ভাইয়াকে বলবে? তারপরেই হঠাৎ গালাগালি দিয়ে ওঠে," ভইষ য্যায়সা দিমাগ উসকা। এ রাজ ও দোনো ভাবীকো মালুম হ্যায়। ছোটিকো একেলে পানে সে ভী চলেগা।"
হঠাৎই সুযোগ এসে গেল.....
সেদিন বাড়ি ফাঁকা মা আর দাদার সাথে রাকেশেরও জ্ঞাতির বিয়েতে যাবার কথা। মেহেক বিধবা তাই যাবে না, তাছাড়া শ্বশুর অসুস্থ তাকে দেখতে হবে। আর মেহেকের জন্যই মিছরি থেকে গেল বাড়িতে মুন্নার ছুতো নিয়ে। অনেকদিন বাদে দুই জা নিশ্চিন্তে মুন্নাকে কাছে নিয়ে শুতে পারবে।
সকালেই ওরা সবাই চলে গেছে পরদিন ফিরবে। তাড়াতাড়ি রাতের খাওয়া শেষ করে ঘরে যাবার উদ্যোগ নেয় মেহেক আর মিছরি। হঠাৎই সদর দরজায় আওয়াজ শুনে দরজা খুলে দেয় মেহেক দেখে রাকেশ দাঁড়িয়ে। অবাক হয়ে যায় মিছরি," তু ইধার ক্যায়সে? অব তো শাদী চল রহা হ্যায়।"
" পেট মে দর্দ থা ইশ্ লিয়ে চলা আয়া গাড়ি পকড়কে।"
রাকেশের মুখ থেকে মদের গন্ধ পায় মিছরি। দরজা বন্ধ করে ঘরের দিকে এগোয় মিছরি। ঠিকই ছিল আজ মেহেকের সাথে শোবে। হঠাৎই মিছরির হাতটা চেপে ধরে রাকেশ," আরে ভাবী এক বাত তো বোলকে যাও মুন্না কিসকে বেটা?"
" তু যা ঘরমে,বেকার কে বাত মত করনা। কাল জনম সার্টিফিকেট দেখ লেনা। আর তু কৌন হ্যায় ইতনে সওয়াল করনে কো হাঁ?"
" সওয়াল ভি করনা হ্যায় আর জবাব ভি জান না হ্যায় মুঝে। কাঁহা সে উঠা লায়ি হ্যায় এ বাচ্চা বোলো? ইয়ে হামারা বংশ কি চিরাগ! হা হা ম্যায় বড়া ভাইয়া যায়স্যা বুদ্ধু নেহি সমঝি।"
" তেরা দিমাগ অব ঠিকানা মে নেহি হ্যায় শো যা অভি। কাল বাত হোগা,আনে দে তেরা ভাইয়া কো।"
বিষাক্ত সাপের মত হিস হিস করে ওঠে রাকেশ," সচ বাতাও ভাবী,শোনে কো ইতনি জলদি ক্যায়া? রাত তো অভি বাকি হ্যায়।"
এতক্ষণ মেহেক ঘরে ছিল মুন্নাকে কোলে নিয়ে। কেন যেন ভয়ে কাঁপছিল ওর শরীরটা। বাইরে ততক্ষণে জোর বাকবিতন্ডা লেগেছে হঠাৎই মিছরির গায়ে হাত দেয় রাকেশ ওকে টানতে টানতে মেহেকের ঘরে নিয়ে আসে। মিছরির লম্বা চওড়া চেহারা, রাকেশ ওকে টানতে হিমশিম খায়। মিছরির শাড়ির আঁচল খুলে মাটিতে গড়ায়। চিৎকার করতে থাকে মিছরি গালাগালি করে আর অভিশাপ দেয়। কিন্তু ফাঁকা জায়গায় ওদের বাড়ি কার কানে পৌঁছাবে এত রাতে সে আওয়াজ?
" তেরি বেটে কো শর মে হাত ডালকে বোল এ তেরি বেটা হ্যায়।"
" কিঁয়ু রে,তু যো বোলেগা ও করনে হোগা ক্যায়া?"
হঠাৎই লাফিয়ে গিয়ে মিছরিকে ছেড়ে মেহেককে ধরে রাকেশ। খরগোশের মত কাঁপতে থাকে মেহেক। মুন্না ওর কোল থেকে ছিটকে পড়ে বিছানায় কাঁদতে থাকে।
" ঠিক হ্যায় তু না বোলেগি তো ইয়ে বোলেগি রাজ ক্যায়া হ্যায়। বোল মুঝে আজ রাজ ক্যায়া হ্যায়? নহি তো সব কো বোল দুঙ্গা ম্যায়।"
মিছরি তেড়ে ওঠে," ছোড় দে ছোটি কো। ছোড় দে উসে।"
রাকেশের টানাটানিতে মেহেকের শাড়ি খুলে যায়, দুহাত দিয়ে নিজেকে আড়াল করতে চায় মেহেক কিন্তু পারে না। ওর অনাবৃত বক্ষে হাত দেয় রাকেশ,খামচে ধরে ওকে। টেনে ছিঁড়ে ফেলে ব্লাউজ। লজ্জায় আতঙ্কে কাঁপতে থাকে মেহেক প্রাণপণে চিৎকার করে ওঠে," জিজি বাঁচাও মুঝে।"
হাসে রাকেশ ওর মুঠোতে ধরা তখন মেহেকের লম্বা চুল, ওকে টেনে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে ওর বুকে চেপে বসে," এ কল যুগ হ্যায় ছোটি ভাবী য়হা পর ভগবান শ্রী কৃষ্ণ নহি আয়েগা। দোনো ভাইয়া কো সাথ শোয়া তু মালুম হোতা। অব মুঝ সে শরম ক্যায়সী দ্রৌপদী জী।"
নিজের চুল ছাড়ানোর জন্য চেষ্টা করে মেহেক কামড়ে দেয় রাকেশের হাতে। " পাপ লাগে গা তুঝে। বিনাশ হোগা তেরা।"
গালাগালি দিয়ে ওঠে রাকেশ," শালী অভি বোল এ বাচ্চা কিসকি হ্যায়। তুঝে সব মালুম। নহি তো দেখ ক্যায়সে লাগে। মুঝে তু ভি চাহিয়ে আউর পয়সা ভি চাহিয়ে। নহি তো এ রাজ রাজ নহি রহেগা। দেখুঁ তো কিতনা সতী হ্যায় তু? আজ তুঝে নাঙ্গা করকে দেখনা মুঝে।"
ততক্ষণে মেহেককে অর্ধনগ্ন করে ফেলেছে রাকেশ। ওর বুকের ওপর বসে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে রাকেশ পৈশাচিক খেলায়। ওর শরীরের চাপে দম আটকে আসে মেহেকের। হঠাৎই আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়ে রাকেশ। ওদের মন্দিরে রাখা পুরোনো তলোয়ার দিয়ে ওর মাথায় মেরেছে মিছরি।
*********************
গলগল করে ঝরে পড়া রক্তে ভিজেছে মেহেকের শরীরও। কিছুক্ষণ কেউ কথা বলতে পারে না। ছিন্নমস্তার মত দাঁড়িয়ে আছে মিছরি। হাতে তলোয়ার।
হঠাৎই চিৎকার করে ওঠে মেহেক," জিজি ইয়ে তুমনে ক্যায়া কিয়া? খুন কর দি ! অব ক্যায়া হোগা?"
ঠান্ডা গলায় মিছরি বলে," মুন্না কো দেখনা তু। কিতনে বার মেরে লিয়ে ইজ্জত লুটাগী তু? ইয়ে পিশাচ হামলোগ কো জিন্দা মার দেতে। নরক কর দেতে মুন্নাকা জীবন। যো হুয়া আচ্ছা হি হুয়া।"
খারাপ খবর আগুনের চেয়েও বোধহয় দ্রুতবেগে দৌড়োয় তাই ভোর হতে হতেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো ডাইন মেহেকের কথা। স্বামীকে খেয়েছে এখন খুন করলো দেওরকে। সবাই দেখল হাতে তলোয়ার নিয়ে খোলা চুলে সারা শাড়িতে রক্ত মাখামাখি আর ছেঁড়া ব্লাউজ নিয়ে মেহেক বসে আছে মাথা নীচু করে। যে বৌয়ের মুখ সহজে কেউ দেখতে পারত না আজ সে পাথরের মূর্তি যেন। অনেকেই কৌতূহলী হয়ে দেখতে চাইল মেহেকের শরীর আরেকটু খুঁটিয়ে। বিধবা হওয়ার পরেও এত চেকনাই! দেওরের আর কি দোষ? ভরা জওয়ানি নিয়ে সামনে দিনরাত ঘুরলে আর কি হবে? মাথা ন্যাড়া করে জুতোর মালা পরিয়ে একদম ঘোল ঢেলে সারা গ্ৰামে ঘোরানো উচিত এমন বৌকে।
শুধু ডুকরে ডুকরে কাঁদছে মিছরি ছেলেকে বুকে চেপে। পুলিশ আসাতে পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে কাঁদে," উসে ছোড় দিজিয়ে উসকি কোয়ি কসুর নেহি। ও জানোয়ার উসকি ইজ্জত মে হাত ডালা মেরে সামনে।"
রাজীব মিছরিকে ধরে রাখতে পারে না। পাগলের মত চিৎকার করতে থাকে ওর শাশুড়ি," ইশ্ ডাইন কো লে যাইয়ে সাহাব। দোনো বেটো কো খা গয়ি। অব তো বড়া বেটে কো ভী খা যায়েগী।"
চিৎকার করে ওঠে মিছরি," তেরে বেটে লোগ উসকো খায়া। উসকি কুছ কসুর নেহি।"
মেহেককে ওরা জিপে তোলে। মিছরি পাগলের মত ছুটে আসে ওর দিকে কিন্তু কিছু বলতে পারে না। শুধু জড়িয়ে ধরে কাঁদে হাউহাউ করে। মুন্নার মাথায় হাত রেখে যে ওকে দিয়ে শপথ করিয়ে নিয়েছে মেয়েটা - " জিজি ইস্ দুনিয়ামে মেরি কোই নেহি। তুঝে তো মুন্না কো সামলনা হ্যায় বড়া করনা হ্যায়,তুম তো উসকে মা হো। মুঝে ফাঁসী হো যায়ে তো হোনে দো। তুম মুখ নেহি খোলনা। ইয়ে রাজ হমেসা রাজ রহ যায়েগা। "
কয়েকদিন নানা ভাবে ওকে জেরা করেছে পুলিশ একটা কথাও ওর কাছ থেকে আদায় করতে পারেনি। জেলের পরিবেশ নরকের মত। নানা ছুতোয় অনেকেই ওকে ছুঁতে চায়,অত্যাচার করে চরমে। তবুও পাথরের মত শক্ত হয়ে রয়েছে মেয়েটা। এই কদিন শ্বশুরবাড়ির বা বাপের বাড়ির কেউই আসেনি ওর সাথে দেখা করতে। দুদিন বাদেই ওর কেস কোর্টে উঠবে জানে ওর ফাঁসী হয়ে যাবে খুনের অপরাধে। ক্লান্তিতে শরীর এলিয়ে আসে মেহেকের।
সমানে অত্যাচার চলছে ওর ওপর,ওর লম্বা চুলের গোছা শক্ত করে ধরা মহিলা পুলিশের হাতে। কটকট করে ওঠে যন্ত্রণায় মাথা চিৎকার করে ওঠে," ছোড় দো মেরে বাল, ম্যায় তো বোল দিয়া ম্যায় খুনী হুঁ ফির কিঁউ?"
ওরা হাসে হা হা করে। তারপর হঠাৎই একটু অপ্রস্তুত হয়ে থমকে দাঁড়ায়। পুলিশের বড় কর্তা ঢুকেছে।
মেহেক নিজেকে সামলায়,ওর চুল লুটোচ্ছে মাটিতে। মেহেকের সামনে একটা ছবি ধরে বড় সাহেব," পহেচানতে হো ইসে?"
মেহেকের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়ে," খুশবু....আপ?"
" আপ মিঠিয়া হ্যায় না? খুশবু মেরে বিবি। পেপার সে মালুম হুয়া উসকো। ঘাবড়াইয়ে মত হম সব হ্যায় আপকে সাথ।"
মেহেকের চোখটা ভিজে যায় আবার খুশবু ওকে মনে রেখেছে? ভুলে যায়নি আর সবার মত?
মাঝে কেটে গেছে আরেকটা দিন। অত্যাচার কিছুটা কমেছে। তবুও জেলের পরিবেশে দম আটকে আসে মেহেকের।
খবর পায় শোভাও,মিছরি কাতর মিনতি করে," বড়ি দিদি বাঁচালো উসকো। নহি তো অনর্থ হো যায়েগা। মেরে জওহর রাখলো।"
চোখটা জড়িয়ে গেছিল মেহেকের,হঠাৎই কর্কশ গলার চিৎকারে চমকে উঠে বসে। ওর উকিল এসেছে কথা বলতে হবে। অবাক হয়ে যায় মেহেক কে উকিল পাঠালো ওর জন্য? জিজি?
গারদ ধরে দাঁড়ায় মেহেক,ওপারে শোভাকে দেখে অবাক হয়। আস্তে আস্তে বলে," বড়ি দিদি তুম! মেরে পড়াই পুরা নহি হুয়া।"
বড় টনটন করে চোখের কোলটা মেয়েটার জন্য। কত পড়তে ভালোবাসে মেয়েটা!
-" সব হোগি পাগলী। পহেলে তো নিকলনা হোগা জেল সে। ম্যায় তেরে লিয়ে ওকিল সাহেব কো লায়া। উসে বাত করনা হ্যায় তেরে সাথ।"
-" মুঝে কুছ কহনা নেহি। তুম বেকার পয়সা বরবাদ নহি করনা মেরে লিয়ে।"
-" বেকার কিঁউ ম্যায় তেরি দিদি না? তু তো বোলি ম্যায় তেরি মা য্যায়সী। লে বাত কর লে ওকিল সাহাব সে।"
মেহেকের মাথার চুলে জটা পড়েছে বেশ কদিন তা আঁচড়ানো হয়নি। চুড়ো করে মাথার ওপরে বাঁধা। আজকাল আর মাথায় ঘোমটা টানে না ও। ওর বিষণ্ণ মুখটা দেখে আবার কান্না পেল শোভার।
ও বলল,"ক্যায়া বাত করু ম্যায়। বড়ি দিদি মুঝে এক কলম আর এক কিতাব মিলেগা? সাথ মে কুছ কাগজ লিখনে কে লিয়ে। "
ওর সরল মায়ামাখা মুখটা দেখে কিছু বলতে পারে না শুধু বলে,"মিলেগী জরুর। মিছরি বহত য়্যাদ কর রহী হ্যায় তুঝে। হর পল রো রহী বেচারী।"
চুপ করে থাকে মেহেক ও জানে জিজি বড় দিদিকে এখানে পাঠিয়েছে। মুন্নার কথা খুব জানতে ইচ্ছে করলেও কিছু বলে না।
শোভাকে তাড়া দেয় ওরা,যেতে বলে কারণ এবার উকিল ওর সাথে কথা বলবে।
মাথা নিচু করে মেহেক ও উকিলকে কিছুই বলবে না। ও তো মরে যেতেই চায়। শুধু চলে যাবার আগে ওর জীবনের গল্প লিখে যাবে,কিছুটা লেখা আছে। বাকিটা লিখবে। হয়ত কোনদিন বই হয়ে বেরোবে সেই গল্প। কিন্তু তখন ও থাকবে না এই পৃথিবীতে।
উকিলের কথা শুনে আর মাথা নিচু করে থাকতে পারে না মেহেক। এ গলা যে ওর খুব পরিচিত। কে এই উকিল? শ্যাম ল কলেজে পড়ত কিন্তু এত গুলো বছর পরে যে শ্যাম এসে দাঁড়াবে ওর সামনে এভাবে ভাবতে পারেনি মেহেক। না না কিছুতেই ও ধরা দেবেনা শ্যামের কাছে। ওর বাবার জন্যই তো আজকে ওর এই অবস্থা। কই কোনদিন তো আর শ্যাম খোঁজ নেয়নি ওর?
শ্যামের কোন প্রশ্নের উত্তর দেয় না মেহেক শুধু বলে," ম্যায় এ খুন কিয়া,ম্যায় মরনা চাহতি হুঁ। মুঝে মরনা হ্যায়। আপ চলে যাইয়ে। মুঝে কুছ কহনা নেহি।"
কতগুলো বছর ঐ লম্বাচুলের মেয়েটাকে মনে করে শ্যামের কেটে গেছে। আজ পর্যন্ত অপরাধবোধ ওকে তাড়া করে যখনই শোনে মেহেকের দুর্ভাগ্যের কথা। কিছু না বলে শুধু বলে গেল," বাত তো তুমকো করনা হী পড়েগা। জীবন অমূল্য হ্যায়। জিনা হোগা তুমকো।"
আজ কপালটাকে পাথরে ঠুকে ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছা করে ওর। কেন ঐ ছেলেটা ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আজ? ও কি নিজে থেকে এসেছে না বড়ি দিদি এনেছে? নাকি খুশবু পাঠিয়েছে ওকে? হাজার প্রশ্নের ভিড়ের মাঝে মেহেকের কিশোরী বেলা ওকে ডাকে হাতছানি দিয়ে।
পরপর তিনদিন এসেছে মেহেকের সাথে দেখা করতে শ্যাম। প্রতিবার মনে হয়েছে কতক্ষণে আবার ওর সাথে দেখা হবে? সারাটা দিন আইনের বইয়ে মুখ ডুবিয়ে রাখে শ্যাম। ওর সিনিয়ার মিশ্রা সাহেবের সাথে কথা বলে এ ব্যাপারে যে করেই হোক বাঁচাতে হবে মেহেককে। কিন্তু মেহেক কেন একটুও সাহায্য করছে না? ওর মন থেকে কি একেবারেই মুছে গেছে শ্যাম?
এক মাথা চুলে প্রায় জটা লেগেছে মেহেক যেন এক তপস্বিনী।
***********************
মেহেক আজ কাঠগড়ায়,আদালতের ভেতরে বেশ ভিড়। অধিকাংশ পুরুষ তার মধ্যে রাকেশের বন্ধু বান্ধবও কিছু আছে। ডাইনকে দেখতে ভিড় করেছে অনেকেই। সাদা থান জড়ানো মেহেক মেরুদন্ড সোজা করে এসে দাঁড়ায় ওর চোখেমুখে কোন ভয়ের চিহ্ন নেই। সরকারি পক্ষের উকিলের জেরায় পরিস্কার বলে খুন ও করেছে বাড়িতে রাখা তলোয়ার দিয়ে। যা শাস্তি হয় ও মাথা পেতে নেবে। শ্যাম বারবার প্রমাণ করার চেষ্টা করতে থাকে রাকেশ যদি ওকে ধর্ষণ করার জন্য ধরে ওর ওপর অত্যাচার চালাতে থাকে তখন ও কিভাবে খুন করবে? তলোয়ার কোথায় পাবে?
নিশ্চয় এই খুন অন্য কেউ করেছে মেহেক সেই দোষ নিজে নিচ্ছে। মৃদু গুঞ্জন জোরে হতে থাকে।
মেহেক দৃঢ় গলায় বলতে থাকে সেই রাত্রে বাড়িতে কেউ ছিল না তাই ঐ তলোয়ার ও খাটের পাশে রেখেছিল। রাকেশ যখন ওর জিজিকে ঠেলে ফেলে দেয়,মুন্নাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় তখন ও পেছন থেকে ওকে মারে।
শ্যামের অদ্ভুত লাগে মেহেকের কথা। বারবার মনে হয় কোন রহস্য আছেই। ওকে মেহেকের সাথে আবার কথা বলতে হবে।
শ্যামের ওকে অপরাধী না প্রমাণ করতে চাওয়ার মরিয়া ভাবে বুক কাঁপে মেহেকের। পরদিন জিজিকে হাজিরা দিতে হবে শুনেছে। যদি জিজি কিছু বলে দেয়?
এতদিন শ্যামের সাথে ভালো করে কথা বলেনি মেহেক ও পুরুষদের ঘেন্না করে। পুরুষরা ভালোবাসা বোঝে না ওরা সামান আর সম্পত্তি করে রাখে ঔরত কে। শ্যাম এসেছে আবার, মেহেককে অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করে যায়। কখনও মাথা নাড়ে আবার কখনও চুপ করে থাকে। অবাক হয়ে যায় শ্যাম, একটা সময় এই মেয়েটা ফুলঝুরির মত কথা বলত। এখন কি হল! হঠাৎই বুকের ভেতর থেকে একটা কাগজ বের করে শ্যামের হাতে দেয় আর ইশারা করে চলে যেতে।
রাতে ঘরে এসে চিঠিটা পড়তে পড়তে অবাক হয়ে যায় শ্যাম। এই মেয়েটা কি ওর চেনা মেহেক? এত লাঞ্ছিত হয়েও এত মহান কেউ হতে পারে? হয়ত কোথাও এসে সহ্যশক্তি দ্রৌপদীকেও ছাড়িয়ে গেছে।
চিঠির শেষে বারবার বলেছে," মুন্না কো বড়া হোনা হ্যায়। জীনা হ্যায়। উসকে লিয়ে জিজিকো বাঁচা লো। কোই কালা ছায়া না পড়ে উসকি জিন্দেগী মে।"
অনেক সওয়াল জবাব হলেও মিছরি আর রাজীবও বারবার মেহেকের পক্ষেই কথা বলল। যদিও ওর শাশুড়িমা মৃত্যুদণ্ড চাইল ডাইন বৌয়ের। তবুও মেহেকের কম বয়েস,খুন করার কারণ সব বিচার করে এবং শ্যামের অক্লান্ত পরিশ্রমে পাঁচ বছরের জেল হল মেহেকের।
অনেক কাঁদলো মিছরি,আসল খুনী তো ও কিন্তু শাস্তি পেল মেয়েটা। শোভার বুকটা ফেটে গেল মেয়েটার জন্য। শ্যাম দেখল মোহনপুর গ্ৰামের একটা সাধারণ ছটফটে প্রজাপতির মত সরল সাধাসিধে মেয়ে হঠাৎই দেবী হয়ে উঠেছে।
********************************
দেখতে দেখতে কেটে গেছে পাঁচটা বছর। এর মধ্যে জেলে বসে পড়াশোনা করে মেহেক বি.এ পাস করে ওকালতি পড়ছে । তবে শ্যাম দেখা করতে চাইলেও রাজি হয়নি কখনও দেখা করতে। শ্যামের কথা মনে হলেই ওর বাবার কথা মনে পড়ত মেহেকের। মুছে ফেলতে চেয়েছে শ্যামকে মন থেকে। আর কোন পুরুষ কে ওর জিন্দেগীতে দখলদারি করতে দেবে না এবার থেকে ও বাঁচবে নিজের মত।
শুধু মুন্নার জন্য খুব মন খারাপ করে। কিন্তু আর কি কোনদিন দেখতে পারবে মুন্নাকে? জিজি তারপর থেকে আর আসেনি,ও জানে কেন আসতে পারে না। শুধু বড়ি দিদি মাঝে মাঝে আসে। ওঁর কাছেই মুন্নার ছবি দেখেছে। শুনেছে মুন্না এখন স্কুলে যায়।
ভালো কাজ করার জন্য ছয় মাস আগেই ছুটি হয়ে গেছে মেহেকের। কিন্তু ও কোথায় যাবে? ওকে জেলে নিয়ে যাবার পরই নাকি মা মারা গেছে খবর শুনে। দাদারা কোন খোঁজ নেয়নি খুনী বোনের। তাহলে? টাকা পয়সা যা পেয়েছিল তখনই শাশুড়ি ধমকে হাতিয়েছিল। সামান্য কিছুই ছিল হাতে।
অনেকদিন বাদে বাইরের আলো দেখে মেহেক। মনে হয় পৃথিবীটা কত সুন্দর। হঠাৎই শোভাকে দেখতে পায় মেহেক। এগিয়ে আসে শোভা," চল ঘর মে। অভি সে হামারা পাস রহেগী তু।"
" নহি দিদি,ম্যায় এক খুনী হুঁ। এক কাম করনা মুঝে কোই আশ্রম মে ডাল দো।"
" আশ্রম ক্যায়সা হ্যায় তুঝে মালুম নেহি? ইয়ে সমাজ খুনী হ্যায় তু নেহি। ম্যায় অব ইস উমর মে কিসি সে ডরতী নেহী।"
রাস্তার ওপারে গাড়িতে চুপ করে বসে ছিল শ্যাম। কাঁচটা নামিয়ে শোভার সাথে মেহেককে যেতে দেখে নিশ্চিন্ত হয়। আজ আর নয় কাল একবার যাবে মেহেকের সাথে দেখা করতে। কেন যেন মনটা ছটফট করে ওর সাথে একটু কথা বলার জন্য।
পরের দিন শ্যামকে দেখে অবাক হয় না শোভা। ওকে ভেতরে আসতে বলে। মেহেককে দেখে অবাক হয়ে যায় শ্যাম, এ কাকে দেখছে ও? মেহেকের মাথার লম্বা চুল গতকালও ছিল চূড়ো করে বাঁধা মাথার ওপরে। আজ সম্পূর্ণ মুন্ডিত মস্তক ওর। পরনে ধবধবে সাদা শাড়ি,মেহেক যেন এক সন্নাসিনী যাকে আর কিছুই স্পর্শ করে না।
" এ তুনে ক্যায়া কিয়া মিঠিয়া? তেরে বাল!"
অনেকদিন বাদে শ্যামের কাছে ওর পুরনো আদরের নামটা শুনে চমকে ওঠে মেহেক তবে ধরা দেয় না। বলে," পাঁচ সাল কি অশৌচ থা না। পাঁচ সাল কিঁউ বলু অশুদ্ধ হো গয়া ও বাল পহেলেই ইস লিয়ে কাট ডালা। কিতনে পাপী নে হাত ডালা মেরে বালমে।"
মেহেকের কথাগুলো বিঁধে যায় শ্যামকে মনে পড়ে যায় পুরোনো কথা যেদিন ওর বাবা চুল ধরে টেনেছিল ওর।
-" পাপী লোগ কো আপনা করম কি শাস্তি মিল গয়া। পাপা ভি অব বিস্তর মে। প্যারালিসিস হো গয়া। মাম্মি কো দেহান্ত হো গয়া।"
নিজের মত কথা বলে যায় শ্যাম তবে মেহেককে তা ছোঁয় না একটুও।
গলায় ক্লান্তি এনে বলে,"তুম অব ঘর যাও। মেরে কাহানী তো তুমহে সব মালুম হ্যায়। মিঠিয়া কব কি মর গয়ি। মেহেক ভী মর গয়ি।"
****************************
মাঝে কেটে গেছে আরও দুটো বছর। মেহেককে আশ্রয় দেওয়ার জন্য রাজীব মিছরিকে আসতে দেয় না শোভার কাছে। মাঝে মাঝে লুকিয়ে ফোন করে শুধু। শোভা কথা বললেও মেহেক কথা বলে না। মাতৃত্বকেও অনেক কষ্টে মেরে ফেলেছে মেহেক। আর দূর্বল হতে চায় না।
শুধু খুশবু মাঝে মাঝেই ফোন করে। ভালো আছে খুশবু,ও একটা স্কুলে পড়ায়। ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে ওর। খুশবু ওকে কিছু বলে না এখন শ্যামের কথা। দু একদিন বলেছিল প্রথমে," তুঝে মালুম হ্যায়, ভাইয়া অভি ভি শাদী নহি কিয়া। ও তুঝে চাহতা রে পাগলী। ফের ঘর বসালে মিঠিয়া। বহত প্যায়ার করেগা তুঝে ভাইয়া।" ভালোবাসার কথা আর সহ্য হয় না মেহেকের। তাই বলে," ফির সে ইয়ে বাত মত কর না। ম্যায় খুনী,ডাইন,ধর্ষিতা, বিধবা( বাকিটা বলতে পারে না যে বিধবা হয়েও সন্তানের জন্ম দিয়েছে) কিঁউ তু খারাব করনা চাহতি উসকে জিন্দেগী মুঝ সে জোড়কে?"
পরনে সাদা শাড়ির ওপর কালো কোট আর মাথায় সাদা পাগড়ী জড়িয়ে মেহেক দাঁড়ায় ওর মত অনেক মেয়েদের পাশে বিনা পারিশ্রমিকে। কখনও তার জন্য হুমকিও পায় ফোনে, উঠাকে লে যাউঙ্গী,জান সে মার দুঙ্গী শালী।"
শান্ত গলায় মেহেক বলে," গিদর জ্যায়সে বাত মত কর না। হিম্মত হ্যায় তো সামনে আকে দেখ জ্বল যায়েগা।"
রীতিমত পড়াশোনা আর শরীরচর্চা আজ মেহেককে করেছে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। তার জন্য ওর কৃতজ্ঞতার শেষ নেই শোভার কাছে। বোনের জায়ের জন্য কে এত করে? একদিন শোভাকে জিজ্ঞেস করেছিল এ কথা? উত্তর পেয়েছিল," তেরি জীবন কি পুরা মহাভারত তো মুঝে পতা। কুছ পাপ তো ম্যায়নে ভি কিয়া না? উসে কুছ তো সংশোধন করনে দে।"
অবাক হয়েছিল শুনে। পরে জানতে পেয়েছিল বড়ি দিদিই জিজিকে বলেছিল মেহেকের বাচ্চাটাকে নষ্ট না করতে। হয়ত সেখান থেকেই মেয়েটার দুর্ভাগ্যের শুরু,কথাটা ভেবে খারাপ লাগে আর অনুতাপ হয় শোভার।
সেদিনের পর আর শ্যাম শোভাদের বাড়ি আসেনি কখনও। সরকারী চাকরি নেওয়ার জন্য অনেকটা দূরে চলে এসেছে শোভার শহর ছেড়ে। বাবুজীও মারা গেছে। ও এখন একদম একা। কোর্ট থেকে এসে টিভিটা অন করে বসে। হরিয়া চা দিয়ে যায়। ওর বাড়িটা পাহাড় লাগোয়া,ঝাড়খণ্ডের এই জায়গাটা খুব সুন্দর। চারদিকে বেশ সবুজ আর পাখির মেলা গাছে গাছে। মাঝে মাঝে নিজেকে শেকড় বিহীন গাছের মত লাগে শ্যামের। দেশের বাড়ির সব কাজ শেষ করে বাড়ি জমি বিক্রি করে দিয়েছে বাবা মারা যাবার পর। সেই টাকা কিছুটা দিয়েছে অনাথ আশ্রমে মায়ের আর বাবার নামে। কিছুটা দিয়ে ও সাহায্য করে দুঃস্থ মানুষদের। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে পাপের টাকা অন্ততঃ কিছুটা পুণ্যের কাজে লাগুক।
হরিয়া অনেকক্ষণ আগে খবরের কাগজটা দিয়ে গেছে। ইংরেজি খবরের কাগজ পড়ার পর হিন্দী কাগজে চোখ রাখে শ্যাম হঠাৎই নজরে পড়ে ছবিটা,যদিও সাদা কালো ছবি তাও চিনতে অসুবিধা হয় না মেহেককে। বিনা পারিশ্রমিকে নিগৃহীতা মেয়েদের জন্য কাজ করছে এই দেশেরই কেউ যে নিজেও একসময় হিংসার শিকার হয়েছে। ছবিটা দেখে হঠাৎই কেন যেন আবার মনে হল মিঠিয়ার কথা খুব।
যত্নে পেপার কাটিংটা রেখে দেয়। আচ্ছা মেহেক এখন কোথায় থাকে? একবার যদি দেখা হত।
খুশবুর সাথেও অনেকদিন দেখা হয় না। বাড়ি বিক্রি করার সময় একটু অশান্তি হয়েছিল কাকার সাথে তারপর আর যোগাযোগ নেই। কোথায় এখন থাকে ওরা কে জানে? সেই বিয়ের সময় একবার দেখেছিল ওর বরকে। এখন হয়ত দেখা হলে চিনতেই পারবে না।
ভাবতে ভাবতে অনেকটা রাত হয়ে গেছে। হরিয়া ডাকে," বাবু খানা দে দুঁ?"
" ক্যায়া হ্যায় আজ ডিনার মে?"
" চিকেন,রোটি অওর সব্জী।"
" নহি খানা আজ।" বাচ্চাদের মত বায়না করে শ্যাম।
হরিয়া ওর পুরোনো লোক আদেশের সুরে বলে," বহত হো গয়া,হম অব চলে যায়েঙ্গে দেশ মে। তুম সামালো খুদ কো।"
শ্যাম জানে আর কিছু করার নেই তাই খেতে বসে। হরিয়া আবার বলে," এক শাদী কর লো বাবুয়া।"
শ্যামের মন ভেসে যায় পেপারের ছবিটাতে। ঘরে এসে অনেকক্ষণ চোখ রাখে ছবিটাতে। মেহেককে দেখে কিন্তু এই মেহেক সম্পূর্ণ অপরিচিত ওর কাছে। শুধু মনে মনে বলে অনেক লড়াই করেছে মেয়েটা ওর এইটুকু জীবনে। যেখানেই থাক ভালো থাকে যেন মিঠিয়া।
**************************
সেদিন কোর্ট থেকে ফিরছিল শ্যাম,এইটুকু পথ হেঁটেই যাতায়াত করে বেশিরভাগ। ভালো লাগে হাঁটতে হাঁটতে চারিদিক দেখতে দেখতে যেতে। নদীর পাশ দিয়ে কালো পিচের পথ দিয়ে আসতে আসতে থমকে দাঁড়ায় শ্যাম। আকাশে তখন কনে দেখা আলোর লুটোপুটি। হঠাৎই একটা পুলিশের জিপ এসে পাশে দাঁড়ায়। মুখ বাড়াতেই চিনতে পারে শ্যাম, নতুন অফিসার মিঃ চৌবে। আজই আলাপ হয়েছে কোর্টে কদিন আগেই নাকি বদলি হয়ে এসেছেন এখানে। ওদিক থেকে আওয়াজ আসে," আ যাইয়ে স্যার ছোড় দুঙ্গে আপকো। "
শ্যাম হাত নেড়ে বলে ঠিক আছে ও চলে যাবে। এটুকু পথ হাঁটতেই ভালো লাগে ওর। তবুও পুলিশ আর উকিল কেউ বোধহয় কারও থেকে কম যায় না তাই শ্যামকে উঠতেই হল জিপে এবং জিপ সোজা এগিয়ে চলল একটু গতি বাড়িয়ে দিয়ে। অবাক হল শ্যাম, আজই আলাপ হয়েছে এর মধ্যেই লোকটা হঠাৎই ওকে নিয়ে যাচ্ছে কোথায়? দু তিনবার গাড়ি চালানোর মধ্যেই বলে," আরে কিধার যা রহে হম। মেরে ঘর তো উস তরফ থা। রোকিয়ে প্লিজ। এ ঠিক নহি।"
ওদিক থেকে উত্তর আসে এক ক্রিটিকাল কেস হ্যায়,উসি লিয়ে হামকো আপকো উঠানা পড়া আচানক।"
রাগে চিৎকার করে ওঠে শ্যাম," আপ কো মালুম হ্যায় আপ ক্যায়া কর রহা?"
" বহত আচ্ছা সে মালুম হ্যায়।"
গাড়ি ততক্ষণে পাহাড় ঘুরে ওপরে উঠতে শুরু করেছে। শ্যাম জানে এ দিকটা খুব নিরিবিলি এদিকে অনেক জঙ্গলও আছে। লোকটার মতলব কি?
ততক্ষণে পাহাড়ের টিলার কোলে সমতলে এসে দাঁড়িয়েছে জিপটা। একটু আদেশের সুরেই পুলিশ অফিসার শ্যামকে নামতে বলে। নেমে আসে শ্যাম,ওর ফর্সা মুখে তখন রাগে লাল রঙ জমেছে।
" আইয়ে জী অন্দর তো আইয়ে, বোলা না এক সিরিয়াস কেস হ্যায়।"
গেটের বাইরে থেকে জোরালো গলায় ডাক দেয়," সোনা,একবার বাহার আ যাও।"
দরজা খুলে দৌড়ে যে এসে শ্যামের সামনে দাঁড়ায় তাকে দেখে অবাক হয়ে যায় শ্যাম," আরে খুশবু তু! কিতনি মোটি হো গয়ি!"
খুশবুর চোখের কোলে জল ছলছল করে। শ্যামের কাছে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে," মুঝে য়্যাদ হ্যায় ভাইয়া,ম্যায় তো সমঝি ম্যায় মর...."
খুশবুর মুখে চাপা দেয় শ্যাম," পাগলী,কিঁউ নহি য়্যাদ আয়েগা হাঁ। তব তেরে ও পতিদেব তো ডাকু য্যায়সে হ্যায়। মুঝে কিডন্যাপ করকে উঠা লায়া... হাঁ।"
ততক্ষণে কানে হাত দিয়ে পঙ্কজ এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে শ্যামকে।
খুশবু হাসে," ভাইয়া তুম উসে ভি পহেচানা নহি? শাদী মে নহি মিলা ক্যায়া?"
সত্যি লজ্জা লাগে শ্যামের এবার। অযথা টুকরো অশান্তি কিভাবে দূরে সরিয়ে রেখেছে আত্মীয়দের।
অনেকদিন বাদে বাড়ির খাবার খেয়ে মনটা ভালোলাগায় ভিজে গেল শ্যামের। হরিয়া খুব খুশি হল খুশবু বিটিয়ার কথা ফোনে শুনে। খুশবুর মেয়ে তো মামাকে ছাড়তেই চাইল না। তবুও সব ছেড়ে ফিরতে হল শ্যামকে ওর আস্তানাতে। শুনল পঙ্কজের হঠাৎই এখানে ট্রান্সফার হওয়াতে খুশবু এসেছে সব গুছিয়ে দিতে। খুশবুর চাকরির জন্য সবসময় এসে থাকতে পারবে না। তবে পঙ্কজের কাছে ভাইয়ার কথা শুনেই আদেশ দিয়েছিল," উসে পকড়কে লানা ইধার য্যায়সে ভি হো।"
পঙ্কজ হেসে বলেছিল," জো আজ্ঞা ম্যাডাম জী।"
খুশবু যে কদিন ছিল বেশ কেটেছিল শ্যামের। অনেকদিন বাদে মনে হচ্ছিল মোহনপুরেই আছে। শুধু মেহেকের কথা ওকে জিজ্ঞেস করতে পারল না বরং খুশবু বলল," ভাইয়া অব শাদী কর লো। লড়কি দেখুঁ ক্যায়া।"
অদ্ভুতভাবে শ্যাম দেখল এই কদিনের এত কথা গল্প আর খাওয়া দাওয়ার মাঝে খুশবুও একবারও ওর নাম নিল না। হয়ত বরের সামনে কিছু বলতে চায় না।
মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। শোভা অবাক হয়ে যায় মেহেককে দেখে। মেয়েটা যা রোজগার করে তার একটা ভাগ মুন্নার জন্য রেখে দেয়। শোভা বললে বলে," কিঁউ বড়ি দিদি,মুন্না মুঝে পহচানে না পহচানে উসকো তো হক হ্যায় না মেরে রুপিয়া মে।"
মিছরির মরমে মরে যেতে ইচ্ছা করে এ কথা শুনে,কে জানে কোন জন্মের সম্পর্ক ছিল এই মেয়েটার সাথে? অথচ রাজীব আর শাশুড়ির ভয়ে দিদির বাড়ি ছাড়তেও হয়েছে ওকে। হয়ত ওর পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে বড়ি দিদি।
এলোমেলো ভাবে কাটছিল শ্যামের দিনগুলো। আজকাল পঙ্কজের সাথে মাঝে মাঝে আড্ডা হয়। খুব ভালো ছেলে পঙ্কজ। হঠাৎই একদিন পঙ্কজ বলে," ও যো সোনা কি দোস্ত হ্যায় না মেহেক উসে য়্যাদ হ্যায় না? আপ হি তো সামালা উসকি কেস। অব তো খুদ হী আগ কি গোলা বন গয়ি।"
পঙ্কজের কথা শুনে শ্যাম বলে," তুম পহেচানতে হো উসকো?"
" হাঁ পহেলে দেখা জেল মে। কুছ মহিনা পহেলে কোর্ট মে ভি মোলাকাত হুয়া। মগর অব বহত চেঞ্জ হো গয়ি। বড়া বড়া ওকিল লোগ কা প্যান্ট গিলা কর দেতি। কভি শুনা হ্যায় উসকি আওয়াজ?"
শ্যাম মাথা নাড়ে,পঙ্কজকে আর কিছু বলে না। পঙ্কজের মুখে খেলা করে টুকরো হাসির ছোঁয়া।
মাঝে বেশ কিছু দিন পঙ্কজ বেপাত্তা,অবশ্য বলে গেছিল বাড়িতে যাবে। খুশবুর কপালটা ভালো। শ্বশুরবাড়িতে ভালো আছে বোনটা। আর পঙ্কজও খুব সম্মান করে আর ভালোবাসে ওকে। দেখে শ্যামের ভালো লাগে। আসলে বোধহয় যে কোন সম্পর্ক গড়তে গেলে নিজেদের বোঝাপড়ার মাঝে সম্মানটা জরুরী।
হঠাৎই একদিন পঙ্কজ এসে হাজির। কদিন বাড়িতে থেকে বেশ আনন্দে ঝলমল করছে, ওকে দেখে ভালো লাগে শ্যামের যাক আড্ডা দেওয়া যাবে। খুশবু,মেয়ে, আর সবাই কেমন আছে জানতে চায়।
" আরে ভাইয়া জী ও তো আয়ী মেরে সাথ,আপ জরুর আ যানা কাল।"
শ্যাম একটু ভাবে,তারপর দেখে পরপর দুদিন ছুটি আছে যাওয়া যাবে। পঙ্কজ আর অপেক্ষা করে না," কাল তব উঠা লেঙ্গে আপকো।" ওর কথাটা শুনে শ্যামের হাসি পায় আবার।
পরদিন কিছু চকোলেট আর খেলনা কিনে মোটামুটি তৈরী শ্যাম। আজকাল মনে হয় আপন বলতে তো ঐ বোন আর ওর মিস্টি মেয়েটাই। আর মামাজী খুব প্রিয় বিন্দুর।
যথারীতি অফিস ফেরত পঙ্কজ এসে হাজির সুতরাং একদম চেপে বসা ওর গাড়িতে। আজকে মনটা ভালো লাগছে শ্যামের। অনেকদিন বাদে আবার দেখা হবে বোনের সাথে। ওর সাথে কথা বললে মোহনপুর পৌঁছে যায় কখন বুঝতেই পারে না।
বিন্দু বারান্দায় খেলছিল পঙ্কজের জিপের আওয়াজ পেয়েই দৌড়ে আসে," মামাজী আ গয়ে। মামাজী মামাজী আজ মেরি বার্থডে হ্যায়।"
শ্যাম পঙ্কজের দিকে তাকিয়ে চোখ পাকায়," পঙ্কজ পহেলে বোল না চাহিয়ে থা।"
" ভাইয়া,পহেলে বোলনে সে পুরা দুকান উঠা লেতে আপ। কুছ সারপ্রাইজ আচ্ছা হোতা হ্যায়।"
ততক্ষণে বিন্দু শ্যামের কোলে উঠে গেছে।
" মাম্মী কিধার রে বিন্দু?"
বিন্দু ভেতরের দিকে হাত দেখায়। তবে ভেতরে গিয়ে সব কিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায় শ্যামের। বাগান পেরিয়ে বসার ঘরে ঢুকে দেখতে পায় ভেতরের ডাইনিং সাজানো চলছে। খুব হাসি আর গল্প চলছে কাজের সাথে সাথে।
পঙ্কজ বলে," দেখো ভাইয়া,উসে মালুম নেহি পড়া তুম আয়ে হো। ইতনে গপসপ মে বিজি। আও মেরে বহন কে সাথ মিল লো।"
একটু অস্বস্তি হয় শ্যামের হঠাৎই অপরিচিত কাউকে ওদের বাড়িতে দেখে। পঙ্কজ ভেতরে গিয়ে ডাকতেই ঘুরে দাঁড়ায় ওরা। খুশবুর চোখে খেলা করে একটা দুষ্টুমির হাসি। শ্যাম বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকে। এতদিন বাদে কাকে দেখছে সামনে? এটা তো মিঠিয়া।
শ্যামকে দেখে অবাক হয়ে যায় মেহেক। নিজের আপনজন তেমন কেউ না থাকাতে ওদের পুরোনো বন্ধুত্ব আবার দৃঢ় হয়েছিল পঙ্কজের হাত ধরেই, পঙ্কজ নিজেই মিলিয়ে দিয়েছিল ওদের দুই বন্ধুকে। কেন যেন প্রথম দিন জেলে দেখে খুব মায়া হয়েছিল মেয়েটার ওপর। তারপর ওরা বেশ কয়েকবার এসেছে শোভা দিদির বাড়িতে। পঙ্কজ তো মাঝে কিছুদিন ছিল ভাগলপুরে। সেই সময় খুশবুর সাথে অনেকদিন আড্ডা মারতে ওদের বাড়িতে চলে গেছে,মনটা হাল্কা হয়েছে। পঙ্কজকে এখন নিজের দাদার মতই লাগে ওর। খুশবুর সাথে কথা বললে মেহেক ফিরে পায় ওর ছেলেবেলার দিনগুলো। খোঁজ পায় দাদাদের। ওরা ওকে ভুলে গেলেও ও যে কিছুই ভুলতে পারেনি।
খুশবুর আব্দারে আর পঙ্কজের বায়নাতে কদিনের ছুটি নিয়ে ঘুরতে আসা এখানে। যদিও প্রথমে খুব আপত্তি করেছিল," বড়ি দিদি,ম্যায় চলি যাউ তো তুম একেলি পর যাওগে। নেহি নেহি।"
শোভাই জোর করে পাঠিয়ে দেয় ওকে," অব সচমুচ পাগল হো জায়েগী। রাতদিন কাম অওর কাম। রাঁচী বহত আচ্ছা শহর হ্যায়, যা ঘুমকে আ। ফোন করনা ব্যাস।"
তবে এখানে শ্যাম আছে জানলে কিছুতেই আসত না এখানে। খুশবুর দিকে তাকায় মেহেক কিন্তু কিছু বলতে পারে না। শ্যাম অবাক হয়ে তাকিয়ে ওর দিকে। মেহেকের লম্বা চুল ওর শরীরকে ঢেকেছে,সৌন্দর্য্য যেন উপচে পড়েছে। তাহলে মিঠিয়া আবার চুল রেখেছে। অথচ কিছুদিন আগেই তো ওর পাগড়ী বাঁধা ছবি দেখেছে পেপারে।
বিন্দু মেহেককে দেখেই ছুটে যায় ওর কাছে লাফ দিয়ে কোলে উঠে পড়ে। পঙ্কজ এগিয়ে আসে নিঃস্তব্ধতা ভাঙতে.." ভাইয়া জী এ মেরে বহেন মেহেক। শায়েদ আপ ভী পহেচানতে হো।"
পঙ্কজের মুখের টুকরো হাসি অনেক কিছু বলে যায়। শ্যাম বুঝতে পারে না কি কথা দিয়ে শুরু করবে।
খুশবু বলে," ভাইয়া অভি আয়ি,এক মিনিট মে।" এই বলে মিঠিয়াকে নিয়ে কিচেনের দিকে চলে যায়। কিচেনে একরাশ অভিমানে বলে মেহেক," ইসি লিয়ে মুঝে লায়া ইধার পকড়কে। কালই চলা যাউঙ্গী ম্যায়। ইতনে দিন তো তু তেরি ভাইয়া কি নাম ভী নেহি লিয়া।"
" পাগলী খুদ জল রহী হ্যায়, একবার তো দেখ ক্যায়া হাল বানায়া ইসকা। অভি তক শাদী নহি কিয়া। মা বাপ কোই নেহি হ্যায়। তেরে চলে যানে কে বাদ এক মাহিনা বিস্তর মে থা। তব সে কোই পয়সা নেহি লিয়া আঙ্কেল সে। জমিন ঘর বেচকে অনাথ আশ্রমমে ডালা সব কুছ। পাপা বোলা জমিন উসে দেনে কো, উসে ভী নেহি দিয়া বোলা পাপকে সম্পত্তি মে ক্যায়া কাম তুমহারা।"
এভাবে কথা বলতে কোনদিন শোনেনি খুশবুকে। হঠাৎই কেন যেন নিজের রাগটা আর ধরে রাখতে পারে না। খুশবু আবার বলে," এক অনজান আদমী য্যায়সে বাত কর। নেহি বাত করনা তো মত কর। মগর কাল মত চলা যানা। বিন্দু বহত রোয়েগী।"
হঠাৎই খুশবু জড়িয়ে ধরে মেহেককে। দুজনেই কেঁদে ফেলে রান্নাঘরের আড়ালে। পঙ্কজ যে কখন এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারেনি ওরা।
" সোনা কুছ চায়ে নাস্তা..আচ্ছা ঠিক হ্যায় ম্যায় বাদ মে।"
পঙ্কজকে ইশারা করে খুশবু। ফ্লাক্সের চা আর স্ন্যাক্স নিয়ে বসার ঘরে যায় দেখে বিন্দু আপনমনে খেলনা হাতে বকবক করছে আর শ্যাম বাইরের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে।
বিন্দুকে তৈরি হবার জন্য ভেতরে পাঠিয়ে পঙ্কজ শ্যামের ঘাড়ে হাত রাখে," ভাইয়া সব ঠিক হো যায়েগা, চায়ে পি লিজিয়ে। কেক কাটনা হ্যায় তো।"
বিন্দুর বায়না মামাজী আর আন্টির সাথে কেক কাটবে তাই পাশাপাশি দাঁড়াতে হয় শ্যাম আর মেহেককে। মেহেকের পরনে হালকা গোলাপী রঙের শাড়ি ওর লম্বাচুল এলোমেলো করে জড়ানো মাথায়। কয়েক গোছা অবাধ্য চুল ছড়িয়ে পড়েছে গালে। বিন্দু কেক কাটে সবার হাততালিতে ঘর ভরে যায়। শ্যাম তাকায় মিঠিয়ার দিকে,হাসছে মিঠিয়া। বিন্দুর গালে কেক মাখিয়ে দিচ্ছে। বিন্দু সবাইকে কেক খাওয়ায়।
প্রথমে একটু জড়তা থাকলেও একটু একটু করে কথা শুরু হয়ে যায় শ্যামের সাথে মেহেকের। শ্যাম বলে," কুছদিন পহেলে তুমকো দেখা নিউজপেপার মে। বহত আচ্ছা লাগা মুঝে। তব উস টাইম ও পাগড়ী থা..."
শ্যামের কথা শুনে হাসে খুশবু," ভাইয়া, ইয়ে বাল ভি নহি রহেগী। ডোনেট কর দেগি ক্যান্সার পেশেন্ট কে লিয়ে। মেরি সহেলী লাখো মে এক হ্যায়।"
কয়েকদিন সময় যে কিভাবে কেটে যায় বুঝতেই পারে না শ্যাম। প্রতিদিনই দেখা হয়েছে ওদের। পঙ্কজ নিজেই উদ্যোগ নিয়ে বেড়াতে নিয়ে গেছে কাছাকাছি সব জায়গাতে। হয়ত যাতে শ্যাম আর মেহেক কাছাকাছি আসতে পারে। প্রজাপতির মত কখনও শাড়ি পরে আবার কখনও শালোয়ার কামিজ পরে ছুটে বেরিয়েছে মেহেক বিন্দুর সাথে। আবার মাঝে মাঝে আইনের আলোচনাও হয়েছে।
রাতে বাড়িতে ফিরতে না ইচ্ছে হলেও ফিরতে হয়েছে শ্যামকে। একটু একটু করে হারিয়ে যাওয়া মিঠিয়াকে আবার যেন খু়ঁজে পাচ্ছে শ্যাম। খুশবু বুঝতে পারে মেহেক বদলাচ্ছে একটু করে। কিন্তু কিছু বলতে পারে না। শুধু পঙ্কজকে বলে বহত জিদ্দী হ্যায়। উসে সমঝ নে দো। ভাইয়া কো খোয়া হুয়া প্যায়ার কো জিতনে দো।"
***********************
প্রায় এক সপ্তাহ হল ফিরে এসেছে মেহেক তবে মনটা এখনও মাঝে মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছে পঙ্কজ ভাইয়ার বাড়িতে। খুশবু আর বিন্দু তো এখনও আছে ওখানে। মেহেকের ফিকে জীবনে যেন হঠাৎই রঙিন রঙ তুলির আঁচড় পড়েছে। শোভার ভালো লাগে আজকাল অনেকক্ষণ মেহেককে ফোনে কথা বলতে দেখে।
"কৌন ফোন কিয়া রে? শ্যাম? মুঝে দো বাত কর না হ্যায় মুঝে।"
" ওহ্ বড়ি দিদি,তুম ভি না... খুশবু বাত কর রহি থী। আচ্ছা বাবা ওহ্ যব কল করেগা দে দুঙ্গী ম্যায়।"
শোভা রাগ করলেও মেহেককে কিছুতেই বাধা দেওয়া গেল না। আবার মাথার চুল কেটে ফেলল মেহেক। শোভা রাগ করে বলল," যো কুছ করনা অব করলে। শাদী কে বাদ ইয়ে সব নহি চলেগী।"
অবাক হয়ে যায় মেহেক," শাদী! কিসকে? দিদি পাগল হো গয়ি ক্যায়া।"
শোভা ওর মাথায় হাত রাখে," মেরে বাদ তেরি ক্যায়া হোগা? এক জীবন সাথী সব কো চাহিয়ে।"
হঠাৎই মেহেক ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে," তুমহারা থা কোই?"
" মা,বাপ,ভাই,বহেন সব থা। আর অব তো তু হ্যায়।"
শোভার ঘাড়ে মাথা রাখে মেহেক। ওর মাথায় হাত রাখতে গিয়ে আবার রাগ করে শোভা।
মাঝে কেটে গেছে কয়েকটা মাস। হঠাৎই একদিন খুশবু আর পঙ্কজ আসে বিন্দুকে নিয়ে। আবার বাড়িতে আনন্দের আসর বসে। তবে খুশবু এবার সোজাসুজি শোভাকে বলে," বড়ি দিদি উসকো বোলো ও ব্রত কব ছোড়েগি মেরে ভাইয়া কো চলে যানে কে বাদ হাঁ?
খুশবুর কথা শুনে চমকে ওঠে মেহেক," কোথায় চলে যাচ্ছে শ্যাম? নাকি অন্য কিছু? সত্যিই তো কদিন ফোন করেনি শ্যাম। বলছিল ফোনটা কাজ করছে না।
হঠাৎই বলে ওঠে," ক্যায়া হুয়া উনকো? ভাইয়া আপকো মালুম নেহি?"
হঠাৎই হেসে ওঠে খুশবু," অন্দর মে প্যায়ার মগর ইনকার করেগি।"
কথায় কথায় খুশবু যখন বলল এবার একেবারে পাত্রপক্ষ হয়ে বিয়ের মেহেকের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে ওরা। চমকে ওঠে মেহেক। শ্যাম তো ওর জীবনের সব কিছু এখনও জানেই না। জানলে হয়ত ওকে কখনই মানতে পারবে না।
" নহি ইয়ে শাদী কভি নহি হোগা। "
" কিঁউ নেহি হোগা বোল।"
মেহেক কিছু বলে না, শুধু বলে," মুঝে বাত করনা হ্যায় উসসে। ও সমঝেগা জরুর।"
পঙ্কজ ইশারায় থামতে বলে খুশবুকে। চুপ করে যায় শোভাও বুঝতে পারে মেয়েটার জীবনের কথা তো অনেক। সত্যিই তো শ্যাম তো কিছুই জানে না।
শুধু মিঠিয়ার সাথে কথা বলার জন্যই শ্যাম এসেছে ভাগলপুরে। অনেকদিন ওকে দেখে না। তাছাড়া ও নিজেই শ্যামকে আসতে বলেছে। মেহেকের মুখে চোখে ওর অবাধ্য ছোট ছোট চুলগুলো ছড়ানো। কি করে শুরু করবে ভেবে পায় না। কোর্টের লড়াকু মেয়েটার আজ যেন ভাষা হারিয়েছে। শ্যাম ওকে চুপ করে থাকতে দেখে বলে," মুঝে কুছ শুননা নেহি,ব্যাস জিন্দেগী কে বচা হুয়া কুছ কদম চলনা চাহতা হুঁ তুমহারে সাথ।"
মেহেক নিজেকে সামলে বলতে শুরু করে সেই রাতের কথা যেদিন ওর ভাসুর ওকে নিজের ধর্ষণ করেছিল অজান্তেই নাকি সজ্ঞানে তা আজও বুঝে ওঠেনি। মুন্না ওরই ছেলে,শুধু দিদির জন্য ওর মত এক বিধবাকে মা হতে হয়েছিল সেদিন।
শ্যাম জানত খুনটা মেহেক করেনি,ওকে বাঁচাতে মিছরি করেছিল। কিন্তু বাকিটা জানত না। আজ বাকিটা জেনে মেহেকের প্রতি ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা বেড়ে গেল আনেকটা।
কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। ওকে চুপ দেখে মেহেকই বলল, " ক্যায়া নেহি হুঁ ম্যায়...ডাইন,বিধবা,খুনী,ধর্ষিতা। ক্যায়া করোগে উসকে সাথ দো কদম চলকে? শাদী করকে ঘর বসালো।"
মা মারা গেছে,মেহেক চলে গেছে,বাবার অপমান সব সহ্য করেও কোনদিন চোখ ভেজেনি শ্যামের আজ হঠাৎই চোখটা ভিজে যায়। আস্তে আস্তে বলে তোমাকে একসময় বান্ধবী বলে ভাবতে ভালো লাগত,তারপর প্রেমিকা। কিন্তু আজ কেন যেন মনে হচ্ছে তোমার মত দেবীকে জীবনসঙ্গিনী করার মত যোগ্যতা আমার নেই । ওর কথা শুনে অবাক হয়ে যায় মেহেক। আর কিছু বলতে পারে না। হঠাৎই দরজায় এসে দাঁড়ায় শোভা," পাগলী হাঁ তো কর দে অব।"
*******************
মেহেকের বিয়ের খবর মিছরির কানেও যায়। ভীষণ মনটা ভরে যায় ওর। কত অপরাধের বোঝা কাদার মত জমে রয়েছে মনে। মেয়েটার দুর্ভাগ্যের জন্য নিজেকে দায়ী মনে হয় সবসময়। অথচ মুন্নার মাথায় হাত দিয়ে শপথ করিয়ে নিয়েছিল সেদিন যাতে ও মুখ না খোলে। মিছরি বিয়েতে যাবে জানতে পেরে শ্বশুরবাড়িতে শুরু হয়ে যায় ভীষণ অশান্তি। রাগে ফেটে পড়ে রাজীব," যো দিল মে আয়ে কর ফির মত আনা ইধার।"
মিছরি গর্জে ওঠে," ইতনা গুস্যা কিঁউ তুমলোগকা হাঁ। তব কোর্ট মে কিঁউ বোলা ও নির্দোষ হ্যায়। দোষ তুমহারা ভাইয়া কিয়া। হাম দোনো কা ইজ্জত মে হাত ডালা? বোলো? হাম যায়েঙ্গে ইসবার। জরুর যায়েঙ্গে মুন্না কো লেকর।"
চিৎকার করে ওঠে রাজীব," যাও,যো মর্জি কর। হামারা বেটা নহি যায়েগা উধার এক খুনী কে পাস।"
ভেতরে মিথ্যের চাষ করতে করতে ক্লান্ত মিছরির মনের কথা হঠাৎই বাঁধ ভাঙে," কিসকা বেটা? তুমহারা? হাঁ। মগর বেটা উসকি ভী।"
রাজীব মিছরিকে চেপে ধরে," ক্যায়া বোলি তু? ফির সে বোল।"
আজ আর কাউকে ভয় পায় না মিছরি। পাপের বোঝা,সাজানো সংসার আর অপদার্থ স্বামীকে বয়ে বয়ে ক্লান্ত আর অনুতপ্ত নিজেও। মুন্না একতলায় দাদীর কাছে শুয়েছে। মিছরির সব ক্ষোভ আছড়ে পড়ে আজ। ওর কাছে সব শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় রাজীব মনে করার চেষ্টা করে সেই রাতে কি হয়েছিল। কিন্তু মনে করতে পারে না সবটা। রাকেশকে যে ও নিজে খুন করেছে মুন্নার পরিচয় বাঁচাতে আর ছোটিকে অসম্মানের হাত থেকে বাঁচাতে তাও আজ বলে দিল মিছরি।
" উসে খুনী মত কহেনা,খুনী তো ম্যায়। ইতনে দিন মুন্না সে উসে আলগ রাখা! মুঝে নিকাল দোগে তো দো চলা যাউঙ্গী ম্যায়।"
রাজীব ওর মুখে চাপা দেয়," চুপ হো যা পাগলী দিবার কো ভি শুনাই দেতা হ্যায়।"
হাউহাউ করে কেঁদে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মিছরি। আজ অনেক বছর বাদে অপরাধের বোঝা নামিয়ে খুব হাল্কা লাগছে ওর। বাইরে তখন ভোরের আবছা অন্ধকার দু একটা পাখি ডাকছে ওদের বাগানে। রাজীব জড়িয়ে রাখে মিছরিকে, আজ সত্যিই খুব অপরাধী লাগে নিজেকে। কি করে মুখ দেখাবে ছোটি বহু কে? এতদিন জেদ করে কোনদিন মিছরিকে দিদির বাড়ি যেতে দেয়নি।
আস্তে আস্তে বলে," মুঝে মাফ কর দো মিছরি। মাফি তো মুঝে উস সে ভী ....নহি নহি হাম নহি যায়েঙ্গে। শাদী মে মুন্না কো লেকে তু চলি যানা।"
মেহেকের রঙ ঝরে যাওয়া মনের পর্দায় আজ আবার লাল সবুজের মেলা। ওর মাথার ঘন চুল নেমেছে পিঠের নিচে। যত্নে ওর হাতে মেহেন্দী লাগায় খুশবু।
" মিঠিয়া দেখ কিতনা রঙ আয়া তেরি হাত মে,ভাইয়া কা নাম লিখা হ্যায় যো।"
হঠাৎই নিচ থেকে একটা পরিচিত আওয়াজে চমকে ওঠে মেহেক। মেহেন্দী পরা ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়, "বড়ি জিজি,মুন্না! খুশবু মুন্না আয়া।"
খুশবু অবাক হয়ে দেখে মেহেককে মাতৃত্বকে কত গোপনে লুকিয়ে রেখেছিল মেয়েটা আজ তা বাঁধভাঙা ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়েছে।
মিছরি ছুটে ওপরে আসে ছেলেকে নিয়ে সাথে শোভা। মেহেককে দেখে আজ ওর চোখে আনন্দ অশ্রুর বাঁধভাঙা ঢেউ উপচে পড়ে," ছোটি,মুঝে মাফ কর দে বহেন। মুঝে মাফ কর দে।"
মেহেকের চোখের জল গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে হঠাৎই। কেন যেন আজ শোভা কালো কোট পরা বীরাঙ্গনা মেহেকের সাথে আজকের মেহেককে মেলাতে পারে না। মনে মনে ভাবে মনটা হয়ত মানুষের একই থাকে শুধু পরিস্থিতির চাপে বদলে যায় মানুষ।
খুশবু তাড়াতাড়ি নিচে নেমে আসে,ওরা হাল্কা হোক নিজেদের মত। মুন্না একদিকে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছে অবাক হয়ে। হঠাৎ মেহেক ওকে হাতের ইশারায় ডাকে। এগিয়ে আসে মুন্না। " মুঝে পহচানতে হো বেটা? কিতনা বড়া হো গয়া জিজি!"
মুন্না ঘাড় নেড়ে আস্তে আস্তে বলে," তুম তো ছোটি মা,মুঝে পতা হ্যায়। তুম সব রো রহি কিঁউ শাদী মে?"
মা ডাকটা শুনে মনটা উথালপাথাল করে মেহেকের। তবুও নিজেকে সামলায় অনেক কষ্টে।
" তুঝে বহত দিন বাদ দেখা না ইসি লিয়ে। আ যা মেরে পাস। আজ পুরা দিল ভর গয়্যা জিজি মুন্না কো দেখকে।"
খুশবু আর পঙ্কজের ব্যস্ততা তুঙ্গে,একদিকে কনেযাত্রী আরেকদিকে বরযাত্রী। খুশবুকে ছাড়া চোখে অন্ধকার দেখে শোভা। ওরও তো অনেকটা বয়স হয়েছে,তবুও কেন যেন মনে হচ্ছে আজ ওর নিজের মেয়েরই বিয়ে। বারবার চোখ ভিজে যাচ্ছে শোভার। এতদিন মেয়েটাকে জড়িয়ে ভালো থেকেছিল এখন থাকবে কি করে একা? সেকথা বলতেই মেহেক জড়িয়ে ধরে," বড়িদিদি ইসি লিয়ে ম্যায় রাজি নহি থা। মগর হম তো ইধারই রহেঙ্গে তুমহারা পাস। মেরে প্র্যাকটিস কা ক্যায়া হোগা তব। যব যব ছুট্টি পড়েগা তব.." বাকি কথাটুকু আর বলতে পারে না গলাটা আটকে আসে। কেন যেন বারবার ঠিকানা পাল্টাতে মন চায় না আর। মেয়ে হয়েছে বলে কি ওর কোন ঠিকানা থাকবে না?
মেহেকের ইচ্ছাতে খুব ছোট করেই সারা হচ্ছে বিয়ে। আজ মুন্নাকে অনেকদিন বাদে নিজের হাতে সাজাচ্ছে মেহেক সেই ছোট্টবেলার মত। মিছরি ব্যস্ত বিয়ের কাজে। ওকে সাজিয়ে পাগড়ী বেঁধে কপালে একটা চুমু দেয় মেহেক।
বাইরে বাজনা বাজে,শ্যামের মনে আজ আনন্দের সোনালী আলোর লুটোপুটি। সত্যিই বোধহয় স্বপ্নেরা কথা বলে কখনও। তাই তো দেরিতে হলেও আজ ওদের দুজনের স্বপ্নই সত্যি হয়েছে। অনেকদিন দেখা হয়নি ওদের। তাই গাড়িতে ওঠার আগে খুশবুকে বলেছিল," মিঠিয়াকি ও চটি হ্যায় তো?"
চোখ পাকায় খুশবু," ভাইয়া কিঁউ উসকে বালকে পিছে পড়ে হো তুম হাঁ?"
খুশবু বুঝতে পারে আজও লম্বা বিণুনী বাঁধা মিঠিয়া ঘুরে বেড়ায় ভাইয়ার চারদিকে। ওর সেদিনের অপমান মানতে পারেনি হয়ত ভাইয়া।
মেহেকের কন্যাদান শোভাই করে। খুব আপত্তি করেছিল শোভা," তু সচমুচ পাগলী। ম্যায় বিধবা হুঁ,মালুম?"
হাসে মেহেক," তো ক্যায়া, এক বিধবা দুসরে বিধবা কো সম্প্রদান করেগি। আচ্ছাই হোগা।"
আবার দ্বিতীয়বার সুখের খোঁজে গাঁটছড়া বাঁধে শ্যামের সাথে মেহেক। তবে এবার সবই আলাদা। সেই লম্বা ঘুঙ্গট নেই,ভয় নেই,অচেনা বাড়িতে মানিয়ে নেওয়া নেই। শুধু অনেক আগে ফেলে আসা পছন্দের কাউকে আবার বরণ করে নেওয়া সঙ্গী হিসেবে।
একটা সময় জেলখানার অন্ধকারে মেহেকের মনে হয়েছিল ওর জীবনে শুধুই রাতের অন্ধকার। সেই সব স্মৃতি মিছে করে অনেক আলো দিয়ে সাজিয়েছে শ্যাম ওদের সুহাগ রাতের ঘর। মেহেকের কাছে এসে দাঁড়ায় শ্যাম আলতো হাতে ধরে ওর মুখটা। মেহেকের হাসিতে মুক্তো ঝরে। মজা করে বলে," পহেলে বার দেখ রহে হো ক্যায়া?"
" এক বাত কহুঁ,ইয়ে তুম সাজা লেনা থোড়া আপনে বালো মে।"
" ক্যায়া হ্যায় ইয়ে?"
একটু থমকে যায় হঠাৎই শ্যাম তারপর ছোট ভেলভেটের ব্যাগ মেহেকের হাতে দেয়। মেহেক খুলে দেখে পাঁচটা সোনার ফুল..
" ইয়ে মাজী কা...বহত আচ্ছা লাগতা মুঝে।"
- মেহেক হঠাৎই উঠে দাঁড়ায়," তুমহারা পিতাজী নে দিয়া ক্যায়া?"
চমকে ওঠে শ্যাম," নহি নহি এ নানী নে দিয়া মা কো।"
" আপনে হাত সে ডাল দো মেরি বাল মে।"
পর পর ফুলগুলো লাগাতে থাকে শ্যাম মেহেকের মাথায়। ঠিক যেমন মা লাগাত। তারপরেই মনে পড়ে সেই রাতটার কথা যেদিন বাবার অত্যাচারে খুলে পড়েছিল মায়ের মাথার ফুলগুলো এদিক ওদিক ছড়িয়ে। শ্যাম ফুলগুলো কুড়িয়ে রাখছিল চোখ মুছতে মুছতে। মায়ের সুন্দর করে বাঁধা খোঁপা মুহূর্তে লুটিয়ে পড়েছিল অপমানে....." ছোড় দো বাল পাপ লাগেগা।"
মায়ের কথাটা আজও ভুলতে পারেনি শ্যাম।
বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মেহেক,শ্যামের মনে তখন অতীত আর বর্তমান মিলে এক হয়ে যাচ্ছে। মেহেক মাথা রাখে শ্যামের বুকে। ওর ভালোবাসার স্পন্দন স্পর্শ করে মেহেককে। শুধু মনে হল কে জানত একটা মেয়ের জীবনে দুবার সুহাগ রাত আসবে? তবে দুবার দুরকম সুহাগ রাত।
শ্যাম মিঠিয়ার অপূর্ণ জীবনে ছুঁইয়ে দিতে চায় পূর্ণতার জাদুকাঠি যত্নে। ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে ভুলিয়ে দিতে চায় ওর তিক্ত অতীতকে।
*****************************
তবে অতীত হয়ত কখনই পেছন ছাড়ে না মানুষের তাই আদালতের ডাকসাইটে অ্যাডভোকেট হয়েও আজও মাঝে মাঝে উঠে আসে মেহেকের অতীত আর শ্যামের বিরুদ্ধে আসে একজন খুনী বিধবাকে বিয়ে করে সমাজকে নষ্ট করার অভিযোগ। তবুও মেহেক বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে সূর্যোদয় দেখে শ্যামের সাথে। হারিয়ে যায় মোহনপুরে ফেলে আসা ওর মেয়েবেলার স্মৃতির গন্ধে।
শ্যাম কখনই স্বামী হতে চায়নি সব সময় বন্ধু হতে চেয়েছে মেহেকের। শরীরের চেয়েও বেশি করে ভালোবাসতে চেয়েছে ওর মনটাকে। বুঝতে চেয়েছে মিঠিয়া কি চায়? পুরুষের জয় নারীর হৃদয় জিতে নেওয়াতেই এই কথা বিশ্বাস করে শ্যাম। মেহেকও জানে পুরুষের বিশ্বাস অর্জনই হয়ত প্রথমে নারীকে করতে হয়। তাই খোলা জীবনের সবটুকু গোপনীয়তা মেলে ধরেছিল শ্যামের সামনে।
মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর,মেহেকের একরাশ ঘন কালো চুলে এখন রূপোলি সুতোর আল্পনা। শোভাদিদির কাছে এখন বড়ি জিজি চলে এসেছে মুন্নাকে নিয়ে। হঠাৎই চলে গেছিল ওর ভাসুর রাজীব,শ্বশুর শাশুড়ি তার অনেক আগেই চলে গেছিল। তাই মিছরি একদম একা হয়ে গেছিল গ্ৰামে। অত বড় বাড়িতে পাগলের মত লাগত। তাছাড়া মুন্না কলেজ পাশ করে ইউনিভার্সিটি পড়ে,হস্টেলে থাকে দিল্লীতে। তাই মিছরি পুরোপুরি ভাবেই চলে এসেছে অতীতকে পেছনে ফেলে দিদির কাছে। শোভার শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। মিছরি আর মেহেক বকলেই বলে বয়েস কি আর কম হল? শুধু খুশবু আর পঙ্কজ ভাইয়ার সাথে ওর বন্ধুত্বটা তেমনি রয়ে গেছে।
মিছরি আসার আগেই মেহেক পুরোপুরি ভাবে শ্যামের কাছে চলে এসেছে। আজকাল মাঝে মাঝে ক্লান্ত লাগে। মনে হয় অনেক তো লড়াই হল আর কত? এখানে কোর্টের কেস, অনাথ আশ্রম, মহিলা আশ্রমে মেয়েদের পড়াশোনা দেখা এই নিয়ে বেশ ভালো সময় কেটে যায়। নিজেদের মাঝে কাউকে আসতে দেয়নি মেহেক। হয়ত খুনীর ছেলে বা মেয়ে এই অপবাদ তাকেও তাড়া করত। তার থেকে এই ভালো। তাছাড়া মুন্না আছে খুশবুর মেয়ে বিন্দু আছে ওদের দেখলেই মন ভরে যায় মেহেকের।
শ্যামের বুকে মাথা রাখে মেহেক, " যো হুয়া আচ্ছাই হুয়া। আশ্রম মে কিতনে লোগ মা বোলকে পুকারতা মুঝে। প্যায়ার ভী করতা।"
শ্যাম হয়ত চেয়েছিল একটা সময় কেউ আসুক। কিন্তু তারপর মেনে নিয়েছে মেহেকের ইচ্ছেকেই।
মুন্না এখন অক্সফোর্ডে। ও যখন ওখানে গেল তখন মেহেকের খুব আনন্দ হয়েছিল। বাবা,কাকা আর বংশের তেমন কারও মত বোধহয় হয়নি ছেলেটা। অবশ্য মিছরি বলে মহেন্দ্র মানে মুন্না একদম ওর ছোট মায়ের মত হয়েছে পড়াশোনা ছাড়া কিছুই বোঝে না। অনেক বড় বড় জার্নালে মহেন্দ্রর লেখা বের হয়। মিছরি তেমন পড়াশোনা জানে না। শুধু মেহেক দেখালে সেই লেখাতে হাত বোলায় যত্নে।
মাঝে মাঝেই বলে," একবার যা দেখকে আ কাহা রহতা হ্যায়,ক্যায়া করতা হ্যায় উধার।"
" তুম যাও না জিজি,দেখকে আও ক্যায়া চল রহা হ্যায় উধার।"
মেহেকের কথায় হাসি ছড়িয়ে পড়ে। শ্যাম ওকে ইশারা করে। আসলে বিন্দুও মাস ছয়েক আগে ওখানে গেছে। বিন্দু আর মুন্না দুজনেই মেহেকের খুব প্রিয়। মেহেক বুঝতে পারে মহেন্দ্রকে নিয়ে বিন্দুর মনে স্বপ্নের আনাগোনা। কোথা দিয়ে যে এতগুলো বছর কেটে গেছে বুঝতেই পারেনি মেহেক। সত্যিই বোধহয় ভালো সময় খুব তাড়াতাড়ি কেটে যায় আর খারাপ সময় কাটতেই চায় না।
***************************
বিন্দুকে প্রথমে ধরে ফেলেছিল খুশবু। বোধহয় মায়ের চোখে ধরা পড়ে সব কিছুই। পঙ্কজকে বলেছিল," মহেন্দ্র আচ্ছা লেড়কা। মগর উসকা পরিবার মুঝে পসন্দ নেহি।"
পঙ্কজ ওর ঘাড়ে হাত রেখেছিল," কোন হ্যায় অব বোলো তো উস্ পরিবার মে? ইতনা টেনশন মত লো। মহেন্দ্র বহত আচ্ছা লেড়কা। জান পহেচান মে হ্যায়। আর মিঠিয়া কে তো জান হ্যায় ও। ছোটি মা য্যায়সে হ্যায় বিলকুল মহেন্দ্র।"
খুশবু পঙ্কজের কথা শুনে মেলাতে চেষ্টা করে,সত্যিই একদম মিঠিয়ার মত হয়েছে ছেলেটা। পড়াশোনা নিয়ে থাকে,খুব ভালো লেখে। মিঠিয়া যেমন কাহানী লেখে ঠিক তেমনি কাহানী আর কবিতা লেখে ছেলেটা। এমন কি ওর গালেও একটা----- মনটা হঠাৎই থমকে যায় খুশবুর। ভাবনারা পথ হারায়।
যদিও শ্যাম কখনও মহেন্দ্রর জন্মকথা আর কারো সাথে ভাগ করেনি। সব সময় মেহেককে খুশি রাখতে চেয়েছে। ওর একসময়ের দুর্ভোগের জন্য নিজেকেই দায়ী বলে মনে হয়েছে বারবার। তারপর ওকে কাছে পেয়ে সব সময় চেষ্টা করেছে খুশি রাখতে ওকে।
অনেকদিন বাদে বাইরে যাওয়া একসাথে তাও আবার বিদেশে। আগে মাঝে মাঝেই যাওয়া হত এভাবে বেড়াতে। তারপর বিন্দুর পড়ার চাপে অনেকদিন কোথাও যায়নি খুশবু। আবার যাচ্ছে দুই বন্ধু একসাথে বাইরে সাথে পঙ্কজ আর শ্যামও আছে। তবে মেহেকের এবার যাওয়া একদম মহেন্দ্রর আবদারে। যদিও মেহেক বারবার মিছরিকে বলেছিল," জিজি,তুম ভি চলো।"
কেন যেন মিছরি কিছুতেই রাজি হয়নি যেতে," তু যা। আসলি মা তো তু হ্যায়। তেরি আঁখো সে দেখুঙ্গী উসে ম্যায়। বহত সারা ফোটো লে আনা।"
শোভাও বলেছিল মিছরি চলে গেলে কি করে হবে? আজকাল সত্যিই শরীরটা ভালো যাচ্ছে না শোভার।
মুন্নাই সব ঠিক করে দিয়েছিল। প্রথমে ওদের সাথে দেখা করে ওখান থেকে ইউরোপ ট্রিপ করে আবার শেষে ওদের ওখানে আসা। মুন্না কাজের জন্য ওদের সঙ্গে না থাকতে পারলেও বিন্দু সারাটা ট্রিপ ওদের সাথে ঘুরলো। বিন্দুর সঙ্গে থাকাতে খুব ভালো করে ল্যুভার মিউজিয়াম দেখল ওরা। মেহেক অবাক হয়ে দেখলো মানুষের সৃষ্টি। যে মানুষ কখনও ধ্বংস করে সেই আবার স্রষ্টাও হতে পারে। জীবনের ক্যানভাসে কত ছবি আঁকার সুযোগ ভগবান মানুষকে দিয়েছেন। একটা সময় নিজেকে নষ্ট মনে হলেও আজ মেহেকের মনে হয় সবটাই নষ্ট হয়ে যায়নি জীবনে।
আইফেল টাওয়ার সীন নদী দেখে ওরা মুগ্ধ হয়ে যায়। লন্ডনের খুঁটিনাটি দেখায় বিন্দু ওদের ঘুরিয়ে।
পঙ্কজ মেয়েকে দেখে গর্বিত হয়,কে বলবে সেদিনের ছোট্ট মেয়েটা এত স্মার্ট হয়ে গেছে!
শ্যাম মজা করে মামার মত হয়েছে না বাবার মত কে জানে?
ছেলেমেয়েদের জন্যই ওদেরও বিদেশে আসা হল। তবে মেহেকের মনে ভাসে মাঝে মাঝেই মুন্নার মুখটা। এখানে এসে ছেলেটা যেন রোগা হয়ে গেছে। ভালো করে খায় কি না কে জানে? বিন্দুকে বলতেই ও বলে," খানা পিনা ছোড়কে লিখতা হ্যায় হমেশা। বড়ি চাচী উসকো আদত খারাপ কিয়া।"
খুশবু বকে মেয়েকে," তু ভি কম ক্যায়া? হাঁ"
মেহেকের মনটা কাঁপে একটু তবুও এ কথা জিজিকে বলতে পারবে না। জিজিই ওকে সব সময় হাতে করে খাইয়ে অভ্যেস খারাপ করেছে। ছেলের চেহারা খারাপ হয়েছে শুনলে হয়ত কাঁদতে বসবে।
দুটো দিন হয়েছে ওদের ট্যুর শেষ করে মেহেক আর শ্যাম ফিরে এসেছে মুন্নার অ্যাপার্টমেন্টে। পঙ্কজ আর খুশবু আছে কিছুটা দূরে বিন্দুর কাছে। একটা সপ্তাহ একটু ছেলেমেয়েদের সাথে কাটানো। আগামীকাল মহেন্দ্রর প্রথম বই পাবলিশ হয়ে আসছে ওর খুব ইচ্ছে ছোটিমা আর ছোটাবাবা ওর সাথে থাকুক। মেহেক খুশবু আর পঙ্কজকেও বলেছিল আসতে। বিন্দুই বলল কাল কিছু টুকটাক কাজ আছে ওদের ওরা পরে আসবে।
মেহেক নিজেও লেখে,এর মধ্যে বেশ কয়েকটা বই ছাপানো হয়েছে। শুধু নিজের জীবনীটাই লেখা হয়নি। যা লিখতে শুরু করেছিল সেগুলো কোথায় কে জানে? কিছু নিজেই নষ্ট করে ফেলেছে।
মহেন্দ্রকে আজ ভীষণ ভালো লাগছে, আসেপাশে অনেক বিদেশী। তার মধ্যে মহেন্দ্রর লম্বা চেহারা,ব্যক্তিত্ব আর সরলতা নজর কাড়ে। অডিটোরিয়ামের সামনের আসনে বসে অবাক হয়ে দেখছিল মেহেক মুন্নাকে। বিন্দুটা যে কেন আজ এলো না কে জানে? এত ভালো একটা অনুষ্ঠানে খুশবু আর পঙ্কজ ভাইয়া থাকতে পারল না!
ঝরঝরে ইংরেজিতে যখন মহেন্দ্র বলল ওর ইংরেজিতে লেখা প্রথম নভেল ও ছোট মাকে দিতে চায়। চোখটা ভিজে গেল মেহেকের। শ্যাম ওর হাতে হাত রাখে।
অনেকটা আঁধার পেরিয়ে আজ চকচকে আলোর সামনে দাঁড়িয়েছে মেহেক। এক ধর্ষিতার অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান কখন যে সময়ের সাথে সাথে অনাস্বাদিত মাতৃত্বের ছোঁয়ায় অতি প্রিয় হয়ে উঠেছিল বুঝতেই পারেনি। আজ সেরা সম্মান পাওয়া সেই সন্তানের হাত থেকে। বইয়ের প্রথম পাতাটা খোলা,তাতে লেখা 'মাই ট্রিবিউট টু ছোটি মা'। চোখটা ঝাপসা হয়ে যায় আবার। কিন্তু হঠাৎ মহেন্দ্র ওকেই বইটা দিচ্ছে কেন? মেহেকের মনের প্রশ্ন ভেসে যায় সমবেত হাততালিতে। মহেন্দ্র ওকে জড়িয়ে ধরেছে। হঠাৎই মহেন্দ্রর দিকে চোখ পড়ে মেহেকের। মহেন্দ্রর চোখে জল কেন? ছেলেটা কাঁদছে হঠাৎই তবে খুব আড়াল করে সবার থেকে।
****************************
সারা দিনের আর সন্ধ্যার কোলাহল শেষে রাতের শহর ক্লান্তিতে চোখ বুজেছে। চারদিক নিস্তব্ধ, বাইরে বেশ ঠাণ্ডা হাওয়া,তারই মাঝে শোনা যাচ্ছে বৃষ্টির ঝুপঝাপ। শ্যাম অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছে। হয়ত ঘুমিয়েছে মহেন্দ্রও। মেহেক বেডসাইড ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে রকিং চেয়ারে বসে একমনে ডুব দিয়েছে মহেন্দ্রর লেখা বইটাতে...'যাজ্ঞসেনা'
পড়তে পড়তে হারিয়ে যায় মেহেক,মন ডুবে যায় কোথায় কোন সীমাহীন তেপান্তরে। চলচিত্রের স্লাইডের মত একটা একটা করে দৃশ্য জীবন্ত হয়ে ওঠে চোখের সামনে। এ যে ওরই লেখা,যার মধ্যে মহেন্দ্র ভরে দিয়েছে আবেগ,অনুভূতি আর সমাজের নিষ্ঠুরতার কথা নিজের মত করে। কিন্তু এ লেখা মহেন্দ্র পেল কোথায়?
অনেক বছরের পুরোনো স্মৃতিতে ডুব দেয় মেহেক। সমীর মারা যাবার পর একটা সময় একাকীত্ব থেকে মুক্তি পেতে পাগলের মত নিজের সব কথা লিখত খুব গোপনে। যখন মুন্না পেটে তখনও লিখে গেছে সব কথা। তারপর যখন জেলে চলে যায় তখন কোথায় যে হারিয়ে গেছিল সে খাতা কে জানে? অনেকবার শোভাকে দিয়ে মিছরিকে খবর দিয়েছিল খাতাটা ওকে দেবার জন্য। কিন্তু তখন তো যোগাযোগ হয়নি মিছরির সাথে। একটা সময় নিজেকে তৈরি করতে গিয়ে ভুলেই গেছিল সব। আজ আবার সব কথা ভেসে উঠছে সামনে। শুধু ভাষাটা ইংরেজী।
বইটার প্রায় শেষে চলে এসেছে মেহেক,এখানে তো শুধু মহেন্দ্রর কথা। ওর মাকে চিনতে শেখা, মায়ের মত হতে চাওয়া সব কিছু লেখা আছে মুখ্য চরিত্র অনিরুদ্ধর নামে। একদিন যৌবনে পা রেখে পুরোনো বইপত্র বাছাই করতে করতে হঠাৎই আবিস্কার করা একটা পুরোনো বাঁধানো খাতা। ভেতরে হাতের লেখা মুক্তোর মত। পড়তে পড়তে সারা রাত কেটে গেছিল। খুব রাগ হয়েছিল পুরোটা পড়ার পর এই সমাজের ওপর। মনে হয়েছিল সেই মহাভারতের যুগ থেকে আজ অবধি মেয়েরা কি এমনি সম্পত্তি হয়ে থাকবে? কিন্তু বুঝতে পারেনি প্রথমে কার খাতা এটা? এমন গল্প কে লিখেছে? এ তো জীবনের গল্প।
বইয়ের শেষটা পড়তে খুব ভয় করে মেহেকের। বারবার গল্পে উঠে এসেছে এক নারীর কথা,কখনও দুই নারীর কথা। এক বন্ধ্যা নারী যাকে ধর্মের নামে লম্পট গুরুদেবের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল সহবাস করে গর্ভবতী করানোর জন্য।
দ্রৌপদী সত্য রক্ষার্থে পাঁচজনের স্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু যাজ্ঞসেনা বাধ্য হয়েছিল একই পরিবারের তিন ভাইয়ের কামনা চরিতার্থ করতে। দুঃশাসনেরা এ যুগেও আছে,যারা বারবার নারীর চুলের মুঠি ধরে টেনে ধরে নগ্ন করে।
গল্পে অনিরুদ্ধ বারবার বলেছে যাজ্ঞসেনার ত্যাগ, সহ্য ক্ষমতা আর ধর্ষিতা হওয়ার কথা। এমন কি যাজ্ঞসেনার বন্দিনী থেকে গোপনে সন্তানের জন্ম দিয়ে মা হয়ে অন্যের কোলে সন্তান তুলে দেওয়ার কথাও।কিন্তু গল্প শেষ হয়েছে অসমাপ্ত ভাবেই। অনিরুদ্ধ লিখেছে সে খুঁজে চলেছে যাজ্ঞসেনাকে যার অভিশাপে ধ্বংস হয়েছে একটা পুরো বংশ। যাজ্ঞসেনাকে যে ওকে খুঁজে পেতেই হবে। কিন্তু এই এত বড় পৃথিবীতে কোথায় খুঁজবে তাকে?
হঠাৎই মেহেকের শরীরে কেমন যেন একটা কাঁপুনি শুরু হয় দীর্ঘ অনেকগুলো বছর পরে আবার যেন এক অদ্ভুত প্রসব যন্ত্রণা শুরু হয়। বইটা বন্ধ করে বাথরুমে যাবে বলে বাইরে আসে মেহেক। ওরা এসেছে বলে ছেলেটা লিভিং রুমে শুয়েছে। চশমাটা খোলা একপাশে। বইয়ের মধ্যে মুখ শুয়ে আছে ছেলেটা। মেহেকের খুব ইচ্ছা করল ওকে আদর করতে। কি জানতে চায় ছেলেটা? বইটা পড়ে মনে হল একটা অদ্ভুত কষ্ট পাচ্ছে। তবে কি ও সব জানে? কই বড়ি জিজি তো কিছু বলেনি ওকে। বড়ি জিজি একটা সময় ওকে দিয়ে শপথ করিয়ে নিয়েছিল মুন্না যে ওর ছেলে কোনদিন যেন কেউ জানতে না পারে। তাহলে ওর জীবনের এত কথা কি করে জানলো মুন্না? ঠিক যেন মনে হচ্ছে ওর হয়ে কেউ লিখেছে ওর জীবনের গল্প। মেহেকের পুরো জীবনের কথাই মোটামুটি ফুটে উঠেছে বইটাতে।
এক ফালি বারান্দায় বসে আছে মেহেক,ঘরে থাকতে কেন যেন আর ভালো লাগছে না। ভোরবেলার প্রকৃতি ওর খুব প্রিয়। একটা সময় অনেক রাতেই ঘুম হত না,ভোরের আলো দেখত চুপচাপ বারান্দায় দাঁড়িয়ে।
হাল্কা আলোর সাথে লুকোচুরি খেলছে প্রকৃতি গতরাতের ঝুরো ঝুরো বৃষ্টির পর। আনমনা হয়ে যায় মেহেক হঠাৎই কাঁধে একটা স্পর্শ পায়। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে মহেন্দ্র।
মেহেকের মন ভিজে যায় ছেলেকে দেখে। একটা সময় যে ছেলেকে ছেড়ে বরাবরের জন্য চলে আসতে হয়েছিল ওকে ভুলতে চেয়েছিল পুরোনো সব স্মৃতি। সেই ছেলেকেই হঠাৎই জিজি এনে দাঁড় করিয়েছিল ওর সামনে বিয়ের দিনে। কোন জড়তা ছাড়াই মুন্না ওকে ডেকেছিল ছোটি মা বলে। কাছে টেনে নিয়েছিল মুন্নাকে মেহেক। অদ্ভুত একটা ভালোলাগা ছুঁয়ে গেছিল ওকে। অনিচ্ছাকৃত শারীরিক সম্পর্কের ফলে যে সন্তান জন্মেছিল সে হয়ত অবৈধ সন্তান তবুও একটা সময় শুধুমাত্র জিজির অনুরোধে তাকে তিল তিল করে বড় করেছিল নিজের বুকের অমৃত সুধা দিয়েছিল উজাড় করে।
.'ছোটি মা শোয়ি নহি ক্যায়া? ইতনে শুভে মে বাহার আয়ি উঠকে?'
..'তেরে ওহ কিতাব মুঝে শোনে নেহি দিয়া রাত মে। ক্যায়া দর্দ থা উসমে মালুম হোতা...'
বাকি কথাটা মুখের বাইরে প্রায় চলে এসেছিল কিন্তু গিলে ফেলে মেহেক। প্রায় বলেই ফেলেছিল এত কষ্ট এত অনুভূতি দিয়ে লেখাটা ঠিক যেন মনে হচ্ছিল কেউ আমি নিজেই নিজের কথা লিখেছি।'
মেহেকের চোখের দিকে চোখ রেখেছে মহেন্দ্র আজ ছোটি মায়ের চোখের ভাষা পুরোটা ও পড়তে চায়।
' ক্যায়া মালুম হুয়া মা?'
এক মুহূর্তের জন্যে চমকে ওঠে দুজনেই। মাতৃত্ব কি সত্যিই এত মিস্টি হয়? মহেন্দ্রের চোখে হাসির ঝলক। মেহেক তৃষ্ণার্ত হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে যদি ভুল করে বলে ফেলা নামে আরেকবার ডাকে মুন্না।
-' আচানক মা বোল দি। তুমহে বুরা নেহি লাগা তো? '
মেহেক মাথা নাড়ে, বুকের ভেতরটা কাঁপে। মা ডাকটা বারবার কানে ভাসে। মহেন্দ্র আবার জিজ্ঞেসা করে বইটা পড়ে কি মনে হয়েছে?
মেহেক আস্তে আস্তে বলতে থাকে মনে হচ্ছে যেন সব ঘটনা মহেন্দ্রর নিজের চোখে দেখেছে। এত সুন্দর করে সব লেখা যেন পুরো ঘটনাকে একদম চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলো মেহেক। সবটাই একদম সিনেমার মত।
--' ইয়ে মুভি নেহি সচ্ হি তো হ্যায়। ম্যায়নে খুদ দেখা সব।'
অবাক হয়ে যায় মেহেক মুন্না কি সব এলোমেলো কথা বলছে! ও কি করে দেখবে! তাহলে জিজী কি ওকে সব বলেছে?
-' তু নে দেখা সব? কব?'
হাসে মহেন্দ্র আবার। ওর হাসির মাঝে কেন যেন নিজের ছোটবেলার হারিয়ে যাওয়া ঝর্ণার মত হাসির আওয়াজটা খুঁজে পায়।
-' দেখা তো, ম্যায় ভী শোয়া নেহি কিতনে রাত। যাজ্ঞসেনা মেরা জীবন কো পুরা বদল দি।'
মহেন্দ্রের কথার কি উত্তর দেবে বুঝতে পারেনা মেহেক। গল্পের মধ্যেও যাজ্ঞসেনাকে বারবার খুঁজেছে মহেন্দ্র, এক অদ্ভুত যন্ত্রণা অনুভব করেছে ওর জন্য।
তবুও মেহেক বলে,' তু নে উসকো দেখা? কাঁহা?'
-' উসে দেখা উসকি কাহানী মে।'
নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করে মেহেক কিন্তু পারে না। বাইরের হাল্কা হিমেল হাওয়াতেও ওর কপালে জমে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
-' কাঁহা মিলা উসকি কাহানী? কৌন বাতায়া তুঝে?'
মুখে মিছরি জিজির কথাটা এলেও বলতে পারে না মেহেক।
এরপরের ঘটনার আকস্মিকতায় মেহেকের সারা শরীর কেঁপে ওঠে। মহেন্দ্র ওর পায়ের কাছে বসে হাঁটুতে মাথা রাখে বিড়বিড় করে বলতে থাকে ছোট চাচা একটা সময়ে তোমাকে কলি যুগের দ্রৌপদী বলেছিল। তোমার চুল ধরে হিড়হিড় করে টেনে এনে তোমার বুকে চেপে বসেছিল,ছোট্ট আমি বিছানায় বসে চিৎকার করে কেঁদেছিলাম। হয়ত এখন হলে তলোয়ার আমিই ধরতাম পাপীর মাথা কেটে ফেলতাম আমার মায়ের ওপর অত্যাচার করার জন্য। কিন্তু সন্তান হয়ে তো আমি কিছুই করতে পারিনি তোমার জন্য মা। ভাগ্যিস তোমার লেখা একটা খাতা আমি খুঁজে পেয়েছিলাম তোমার ঘরের পুরোনো জিনিসের মধ্যে। হয়ত মা পড়াশোনা জানত না তাই ওটা রয়ে গেছিল সবার চোখের আড়ালে। নাহলে আমার নকল জন্ম সার্টিফিকেটের মত কবেই ওটা পুড়িয়ে দিয়ে লোপাট হয়ে যেত সব কিছুই। কোনদিনই জানতে পারতাম না আমার ছোটি মা যাকে সবাই খুনী বলে সেই আমার আসল মা...
মেহেকের চোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝরছে আর সেই ঝরে পড়া টুপটাপ জলে ভিজছে মহেন্দ্রর মাথার চুল। ওর হাতদুটো শক্ত করে মেহেককে আঁকড়ে ধরে আশ্রয় খুঁছজে ওর কোলে।
চোখের জল মুছে মেহেক আবার জানতে চায় সব কথা তো লেখা ছিল না ঐ খাতাতে তাহলে বাকিটা কোথা থেকে জানলো মুন্না?
-' মা নে বোলি। ওহ্ ভী এক বেচারী অওরত। সংসারমে রহেনে কে লিয়ে মা বননে কে লিয়ে কিতনে কুছ সহেনা পড়া।'
নিজেকে সামলাতে পারে না আজ মহেন্দ্রও এখানে আসার আগে পুরোনো জিনিস ঘাঁটতে গিয়ে হঠাৎই মেহেকের খাতাটা নজরে আসে ওর। মা বারবার বকছিল,বাড়িই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে সুতরাং কি দরকার পুরোনো জিনিসপত্র আর বইখাতা দেখার। সব বিক্রি করে দিলেই হবে।
তবুও একবার কিছু দরকারি জিনিস আছে কি না তা দেখতে গিয়ে জীবনের সবচেয়ে দরকারি জিনিসটা খুঁজে পেয়েছিল হঠাৎই। দুই রাত্রি ঘুমোতে পারেনি,তারপর বারবার বার্থ সার্টিফিকেট বের করে দেখেছিল। তাহলে কার জন্ম দিয়েছিল ছোটি মা? সে কি সত্যিই বেঁচে আছে? কিন্তু এই খাতা যে বারবার বলছে সে আছে বেঁচে। তাহলে কি ও নিজেই ছোটিমার সেই সন্তান? তারপর অনেকটা কষ্ট নিজের ভেতরে চাপতে চাপতে একটা সময় বেপরোয়া হয়ে গেছিল মহেন্দ্র মায়ের কাছে জানতে চেয়েছিল পুরোটা। বুকটা কেঁপে উঠেছিল মিছরির,কি বলবে এই ছেলেকে? কি করে আর গোপন করবে সত্যিটা? ইশ্ কেন যে ছোটি চলে যাবার পর এতদিন ধরে ঐ ঘরের পুরোনো জিনিসপত্র রেখে দিয়েছিল?
মহেন্দ্রের বুদ্ধি,সাহস আর ধৈর্য্য দেখে অবাক হয়েছিল মিছরি। ছেলেটার চেহারাটাই বোধহয় শুধু বাপের মত কিন্তু বুদ্ধি,সাহস আর ধৈর্য্য সবটাই পেয়েছে মেহেকের কাছ থেকে। সেদিনের পুরো রাতটা কেটে গিয়েছিল মিছরির মুন্নাকে সবটা বলতে। মুন্না একটা সময় মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়েছিল। মিছরি থেমে গিয়েছিল ও ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে। কিন্তু মহেন্দ্র তখন ঘটনার ঘনঘটায় একদম ডুবে গেছে খাতায় লেখা ঘটনা আর মায়ের মুখে শোনা ঘটনা সব মিলিয়ে কখনও চলে গেছে ছোটিমার বাপের বাড়িতে,কখনও ওর মাসির বাড়ি আবার হঠাৎই চমকে উঠেছে সেই কালো অন্ধকার রাতটার ছবি দেখে। উঃ কি ভয়ানক যন্ত্রণা এই দুই নারীর! একজনকে বন্ধ্যাত্ব মুছতে তুলে দেওয়া হয়েছে ভন্ড গুরুদেবের হাতে। আরেকজন ধর্ষিতা ভাসুরের দ্বারা ঘটনার বিভৎসতায় হঠাৎই কেমন যেন গা গুলিয়ে ওঠে মহেন্দ্রের অনেকটা বমি হয়ে যায়,চোখেমুখে ঠান্ডা জল দিয়ে কিছুটা ভালো লাগে।
তারপর শুরু হয় আরেক চুক্তির জীবন। পড়াশোনা শেখার জন্য আর সমাজের কলঙ্কের ভয়ে সবার অন্তরালে অবৈধ সন্তানকে প্রতিপালন করে এক বন্ধ্যা নারীর হাতে তুলে দেওয়া। আর সব শেষে হয়ত ওর জন্যই খুনের দায় নিজের মাথায় তুলে শত অসম্মান অপবাদ সহ্য করে জেলের দমবন্ধ করা পরিবেশে দিন কাটিয়েছিল ছোটি মা। না না ওর নিজের মা।
পুরোটা শেষ করে চোখের জলে ভেসে মিছরি মেঝেতে গড়িয়ে কেঁদেছিল,' ম্যায় তেরা মা নেহি ও ছোটিই তেরা আসলি মা। মুঝে মাফ কর দে বেটা।'
কিছুক্ষণ হতভম্বের মত বসেছিল মহেন্দ্র। তারপর পরম নির্ভরতায় মাথা রেখেছিল মিছরির কাঁধে,' তুম তো যশোদা মাইয়া মেরা আর ও দেবকী।'
**********************
আকাশে সূর্যের সাত রঙের ছটা,কুয়াশা কেটে উঠেছে ঝলমলে রোদের হাসি। মেহেক স্তব্ধ হয়ে শোনে সবটা তার মানে জিজী ইচ্ছা করেই ওদের এখানে মুন্নার কাছে পাঠিয়েছে।
ঘুম ভেঙে চোখ বুজেই হাতটা বাড়িয়ে মিঠিয়াকে খুঁজেছে শ্যাম। এটাই ওর অভ্যেস বরাবরের প্রথমে মিঠিয়াকে খুঁজে ওর মুখটা ভালো করে দেখে দিন শুরু করে শ্যাম। রাতে অনেক সময়ই রাত জেগে কাজ করে মিঠিয়া,সকালে শ্যামই আগে বিছানা ছাড়ে। গতকাল রাতে মিঠিয়াকে বইটা হাতে নিতে দেখেই বুঝেছিল আজও রাতে দেরি করে ঘুমোবে মিঠিয়া। কিন্তু সকালে ওকে বিছানায় দেখতে না পেয়ে বুঝতে পেরেছিল সারা রাতই ঘুমোয়নি মিঠিয়া।
বারান্দায় এসে একবার দেখেই বুঝতে পেরেছিল মিঠিয়ার অতীতের বন্ধ করে রাখা গোপন বাক্সের চাবি হঠাৎই খুঁজে পেয়েছে মহেন্দ্র। আর মিঠিয়া লুকোতে পারবে না কিছুই ছেলের কাছ থেকে। মিথ্যে মেঘের চাদর ছিঁড়ে গিয়ে আজ চারদিকে শুধুই ঝলমলে সত্যি রোদের খেলা। থাক এই অবসরটুকু ওরা একদম ওদের নিজের মত। নিজেকে ফ্রেশ করে কিচেনে এসে কফি বানিয়ে নেয় শ্যাম।
জীবনে মেহেককে নিজের করে পেতে চেয়েছিল শ্যাম। ওকে খুশি দেখতে চেয়েছিল। তাই যতটা পেরেছে নিজের মত করে চেষ্টা করেছে ওকে খুশি রাখতে। মুছে দিতে চেয়েছে অতীতের সব অন্ধকার। একটা সময় নিজেকে খুব অপরাধী লাগত এই ভেবে যে ওর জন্যই মিঠিয়াকে গ্ৰাম ছাড়তে হয়েছে। মেহেকও ওকে ভালোবাসা দিয়েছে উজাড় করে। শ্যাম হয়ত এনে দিয়েছিল এক খুশির ঝাঁপি ওর জীবনে। যে প্রেমের স্বাদ কোনদিন পায়নি জীবনে। তবে এই প্রেম ছিল পরিণত বয়েসের তাই ছিল না তাতে হয়ত কৈশোরের সেই দামাল উচ্ছ্বলতা তবে গভীরতা ছিল সাত সমুদ্রের সমান। তাই দুজনেই দুজনের প্রেমে বিভোর হয়ে আছে এতদিন। তবুও মেহেকের মনের আনাচে কানাচে ছিল কিছু অন্ধকার জমে। আজ হয়ত ওর আত্মজ মুছে দিতে চেষ্টা করছে অতীতের জমে থাকা আঁধারের রাশি। মাতৃত্বকে আর সন্তানের কাছ থেকে লুকিয়ে বাঁচতে হবে না ওকে। হয়ত মাঝে চলে গেছে অনেকগুলো দিন তবুও জীবনের বাকি দিনগুলো ভালো থাক মিঠিয়া।
হঠাৎই অনেকটা চোখের জমা জল আছড়ে পড়ে মেহেকের গাল বেয়ে। অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে বুক। চিরকাল শুনে এসেছে ও রাক্ষসী,অপয়া, অলক্ষী। আজ ওর ছায়া পড়ে এলোমেলো হয়ে যাবে না তো মহেন্দ্রের জীবন? বিন্দু মানে ওর পরিবার কি মেনে নেবে মহেন্দ্রের এই পরিচয়? খুশবু কি এত কিছু জেনেও আবার বাড়িয়ে দিতে পারবে বন্ধুত্বের হাতটা ওর দিকে?
মেহেকের কান্না ভিজিয়ে দেয় শ্যামের মন আর কেন যেন থাকতে পারে না আড়ালে।
শ্যাম মেহেকের মাথায় হাত রাখে,ওর এলোমেলো চুল গুছোতে চায়। নিজেকে ধরে রাখতে পারে না মেহেক,' সমঝাও এ পাগল কো। ম্যায় মা নেহি ছোটি মা হুঁ। ইয়ে রাজ ছুপাকে রাখনা বেটা হমেশা।'
শ্যাম অবাক হয়ে যায় মিঠিয়াকে দেখে যার যুক্তিকে কাটতে ঘামে ভিজে যায় অনেক বাঘা উকিলের কোট সে আজ একটা শিশুর মত অবুঝ। অনেকদিন বাদে সন্তানকে কাছে পেয়েও তাকে স্বীকার করতে চায় না সমাজের ভয়ে। কিন্তু ছেলের যুক্তিতে আজ মেহেকের সব কথাই খড়কুটোর মত ভেসে যায়। শ্যাম অবাক হয় মহেন্দ্রকে দেখে সত্যিই কি করে ছেলেটা এত ভালো হল? যেমন দেখতে,তেমনি পড়াশোনায় আর মানুষ হিসেবে একশো ভাগ খাঁটি। কোন মিশেল নেই ওর মধ্যে।
অনেকটা ঝড়ের পর একটু শান্ত মেহেক। এর মধ্যে মিছরির সাথে কথা বলে অনেক কান্না কেঁদেছে । জল ঝরেছে মিছরির চোখেও তবুও আজ ওর আর দিদির মনটা খুব হাল্কা লাগছে। একটা গভীর অপরাধের বোঝা আজ নেমে গেছে মন থেকে। তাই মেহেককে অনেকটা বুঝিয়ে মিছরি বলে,' আপনা লো উসে। তেরে আপনা বেটা যো হ্যায়,জনমদাত্রী মা হ্যায় না তু?'
কথাটা বলতে বলতে ঢোক গেলে মিছরি,গলাটা কেমন যেন কান্নায় ভেজে। কেবলমাত্র একটা সন্তানের জন্ম দিতে না পারায় কম অসম্মানিত হতে হয়নি ওকে।
' ম্যায় তো যশোদা মাইয়া। তু তো মেরে লালা কে দেবকী মাইয়্যা না।'
-' তুম হি সব হো জিজি,সামালা উসকো ইতনে সাল তক। তুমহারা সাহারা হ্যায় ও।'
আবার চোখ ভেজে মিছরির সত্যিই তো এই ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে এতগুলো বছর মা ডাক শুনে নকল মায়ের অভিনয় করতে করতে কখন যে মুন্নার সাথে নাড়ীর টান শক্ত করে বাঁধা হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি। নকল সার্টিফিকেট কখন যে ভালোবাসার আঁচড়ে আসল হয়ে গেছে জানেই না। মুন্না ছোটির কাহানী খুঁজে না পেলে হয়ত কোনদিনই খুলত না রাজ। আর ছোটিই তো বারবার বলে দিয়েছিল কোনদিন যেন মুন্না জানতে না পারে এই কথা।
মেহেক বুঝতে পারে জিজি কাঁদছে তাই আবার বলে,' তুমহারা রহেগা মুন্না হমেশা জিজি। কুছ তো বোলো অব।'
মিছরি হাসে এবার ওর হাসির তরঙ্গ অনেক হাজার কিলোমিটার দূরে মেহেককে ছুঁয়ে যায়। মিছরি বলে আজ কেন যেন খুব হাল্কা লাগছে ওর।
-' বহুত খুশ হুঁ ম্যায় আজ ছোটি। তেরে বেটা তুঝে মিল গয়া।'
মেহেকের বুকটা কাঁপে,' মগর বিন্দু?খুশবু? ক্যায়া কহেগী ও।'
কলিং বেলটা বাজে টুংটাং শব্দে,মায়ের আদরে পাশে বসে থাকা মুন্না চলে যায় ছুটে দরজার দিকে। শ্যাম এসে বসে মেহেকের পাশে। ওর ঘাড়ে মাথা রাখে ও মিছরি তখনও ফোনে ওকে বুঝিয়ে যাচ্ছে।
বাইরের ঘর থেকে বিন্দুর গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে কান পাতে মেহেক খুশবু আর ভাইয়া এলো নাকি? কি বলবে ওদের? তাড়াতাড়ি করে ফোনটা রাখে। বুকের ভেতর একটা অস্বস্তি হয়।
শ্যামকে বলে ও যেন বাইরে ওদেরকে বলে মেহেকের শরীর ভালো নেই ও ঘুমোচ্ছে।
-' মা,বিন্দু আয়ি আন্টি আঙ্কেল নেহি আয়ে অব। কোই বাত নেহি মা উসে সব মালুম হ্যায়।'
ছোট থেকে এই দুই ছেলেমেয়ে মেহেকের প্রাণ সেটা শ্যাম জানে। আর বিন্দুর যত বায়না আন্টি আর মামাজীর কাছে তাই বিন্দুকে দূরে সরিয়ে রাখা কিছুতেই সম্ভব নয়।
বিন্দু আজ কিছুটা শান্ত, আস্তে আস্তে ঘরে এসে মেহেকের ঘাড়ে হাত রাখে তারপর ওর গলা জড়িয়ে ধরে। শ্যাম ঘর থেকে যাবার আগে বলে যায়,' তু সমঝা অব উসে। বাত করো তুম দোনো ম্যায় চলা কিচেন মে। আজ তো মালুম হোতা ভুখা রহেনা পড়েগা।'
কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ায় বিন্দু,' দেখো মা টেবিল মে মা খানা প্যাক কর দিয়া সব। ইভিনিং মে হম সব সাথ মে ডিনার করেঙ্গে।'
বিন্দুকে আলতো আদর করে শ্যাম মেরে লাডলী বিটিয়া বলে তারপর বাইরে চলে যায় জানে এই একান্ত অবসরটুকু ওরা একসাথে কাটাক।
মেহেকে দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকে কি বলবে বিন্দুকে বুঝতে পারে না। ওকে একা রেখে শ্যাম আর মুন্না দুজনেই চলে গেছে।
হঠাৎই বিন্দু বলে ওঠে,' উস স্টোরি ম্যায় নে এডিট কিয়া আন্টি। মুঝে সব মালুম। ক্যায়সা ডর তুমহারা? উসে আপনা লো অব।'
চাপা গলায় মেহেক বলে ওঠে,' মগর খুশবু,ভাইয়া..ও ক্যায়া..'
-' উনে ভী মালুম হ্যায় সব। ও তো প্রাউড হ্যায় তুমহারে লিয়ে। তুমহারা লাইফ তো এক লিজেন্ড হ্যায়।'
বিন্দুর কথার মাঝে হারিয়ে যায় মেহেক সত্যি কি ওর জীবন এক অনন্য গল্পকথা? নাকি পদে পদে অসম্মানিত হওয়া এক নারীর কাহিনী?
************************
লন্ডনের দিনগুলো প্রায় শেষ হয়ে আসছে আগামীকাল ওরা চলে যাবে এরমধ্যে অনেকটা ঝড়ের পর শান্ত মহেন্দ্র আবার নতুন করে ওর জন্মদাত্রী মাকে পেয়ে। বারবার শুধু মনে হচ্ছে আরো আগে কেন পেল না মাকে? তাহলে হয়ত ওর আদর ভালোবাসা দিয়ে মুছিয়ে দিত মায়ের সব কষ্ট।
খুশবু নিজেই আরও বেশি কাছে টেনে নিয়েছে মেহেককে চুপিচুপি বলেছে কানে কানে কেন যেন ওদের বারবারই মনে হয়েছে এত সুন্দর আর বুদ্ধিমান ছেলে কিছুতেই বড়ি জিজির হতে পারে না। আর মহেন্দ্রর গালের তিলটা তো একদম...
হারিয়ে যায় মেহেক অতীতে একদিন ঐ তিল দেখিয়ে ওর ছোট দেওরও আঙুল তুলেছিল ওর দিকে।
মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন,মেহেকের মন এখন মাতৃত্ব সুখে ভরপুর আগের থেকে অনেক বেশি সময় কথা বলতে হয় ছেলের সঙ্গে। চেষ্টা করে সবসময় ওর ভালো মন্দতে জড়িয়ে থাকতে। মা ডাকটা ভরিয়ে রাখে সবসময়।
ওকে খুশি দেখে ভালো লাগে শ্যামেরও তবে মাঝে মাঝে নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। মন বলে ওঠে ফিসফিসিয়ে এমন একটা সন্তান তো ওর নিজেরও হতে পারত ওকে ডাকত বাবা বলে,আঙ্কেল বলে নয়। মহেন্দ্রের প্রতি প্রথম থেকেই প্রচ্ছন্ন স্নেহ থাকলেও আজ মেহেক যখন মা ডাক শুনছে তখন যেন সাথে ওর নিজেরও বাবা ডাক শুনতে বড় ইচ্ছে করে।
ওদের নিজেদের কোন সন্তান না হলেও,ভালোবাসার অলকানন্দা কুলকুল ধ্বনিতে বয়ে গেছে সেই ছোটবেলা থেকে আজও। শ্যামের ভালোবাসার গভীরতায় নিজেকে সম্পূর্ণ ভাসিয়ে দিয়েছে মেহেক কখনও বা ডুবে গেছে ভালোবাসার অতলে। মুঠোতে করে যত্নে সাজিয়েছে ওর ক্ষততে শ্যামের ভালোবাসার প্রলেপ।
সব সম্পর্কই কি শুধু যৌনতা আর সন্তানের জন্য হয়? হয়ত একে অপরের মনের প্রতিটা অনুভূতিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আর ভালোবেসে পাশে থাকার নামই বন্ধন।
শোভার শরীর খুবই ভেঙে পড়েছে ওদের সবার ইচ্ছে এবার মহেন্দ্র আর বিন্দুর বিয়েটা এবার হয়ে যাক। তাই সবার ইচ্ছেতে এক বসন্তের সন্ধ্যায় সানাইয়ের সুর আর ভালোবাসার সুর এক হয়ে গেল।
এবার অনুষ্ঠানে আর কোন কাটছাট নয় একদম পরিপূর্ণ জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ের অনুষ্ঠান। বড়ি মাসির তেমনি ইচ্ছে যে মরার আগে অন্ততঃ ছেলের বিয়েটা ভালো করে দেখে যাবেন।
খুশবু আর পঙ্কজেরও খুব ইচ্ছে বিয়েতে যেন কোন ত্রুটি না থাকে। সব কিছুর মধ্যে পঙ্কজ বলে,' অগর ভাইয়াকো মুন্না পাপা মানলে তো সব কুছ পুরা হো যাতা।'
- ' কিঁউ ভাইয়া কুছ বোলা ক্যায়া? ভাইয়া তো পাপা য্যায়সেই হ্যায়। বিলকুল মুন্নাকা দোস্ত কে মাফিক।'
বিন্দু মাকে লেহেঙ্গাটা পরে দেখাবে বলে এসে ঘরের দরজাতে দাঁড়িয়ে পড়ে। ছোট থেকে মামাজীর অনেক আদর ও পেয়েছে সত্যি তো সবাই আন্টির কথা বলে কিন্তু মামাজীই বা জীবনে কি পেল? কত সুন্দর করে ওকে বিটিয়া রানী বলে ডাকে।
পঙ্কজ হঠাৎই বিন্দুকে দেখে কথা পাল্টায়। যদিও অনেকদিন মেয়েটা বাইরে বাইরে তবুও আজ পিতৃত্বে জমা হয়েছে অন্য অনুভূতি মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে চলে যাবে। তাই হঠাৎই শ্যাম ভাইয়ার কথা মনে হল ছোট থেকে বিন্দুকে খুব ভালোবাসত ভাইয়া।
শোভার বাড়ি আজ আবার হাসছে। মনটা ভালো শোভারও। বারবার মেহেককে ডাকছেন সব যেন ঠিক ভাবে হয়। মেয়েদেরও নিজের বাড়ি হয় সেটা বোধহয় প্রথম শোভাই বুঝিয়েছিল ওকে। বড়িজিজির বাড়ি খুব চেনা ওর। আকাশে কনে দেখা আলোর লুটোপুটি, ছেলের বিয়ের সব বিধি নিয়মে হাত লাগিয়েছে মেহেক। যদিঝ নিজে তেমন কোন নিয়ম মানে না তবুও মিছরি জিজির ইচ্ছেতে কোন কিছুই অপূর্ণ রাখেনি। কারণ লোক সমাজে আর সার্টিফিকেটে আজও মিছরিই মুন্নার মা। শ্যাম ব্যস্ত ছেলেকে সাজাতে,শেরোয়ানি পরে মহেন্দ্র ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ছেলেটার মুখে বড্ড বেশি মিঠিয়ার ছায়া। শ্যামের ওকে দেখে কেমন যেন অদ্ভুত ভালো লাগায় মনটা ভরে যায়। মনে হয় হয়ত সন্তান না থেকেও বিন্দু আর মুন্নাকে এত কাছে পেয়েছে সেটাই ওর জীবনের পরম পাওয়া।
মুন্না ডাকে মা....মেহেক হাতে করে ওর মাথার পাগড়ী নিয়ে দাঁড়ায় কেন যেন খুব আনন্দ হয় ছেলেকে বরবেশে দেখে। মেহেকের হাত থেকে পাগড়ী নিয়ে শ্যামের কাছে এসে দাঁড়ায় মুন্না ওর একদম কাছে এসে বলে..' পাপা ইয়ে ডাল দো না ঠিক সে।'
অবাক হয়ে যায় শ্যাম হঠাৎই ভেতরটা কেমন কেঁপে ওঠে ও মেহেকের দিকে তাকায়। ঘরে তখন শুধুই ওরা। মেহেক কেন যেন আর নিজেকে সামলাতে পারে না। বাবা আর মাকে ততক্ষণে নিজের বাহুবন্ধনে শক্ত করে বেঁধেছে মুন্না। সত্যিই বোধহয় বিন্দু ওর জীবনে একটা পরশ পাথর। বিন্দুই তো বুঝিয়েছে ওকে যে মানুষটা ওর মাকে এত বছর সামলে রেখেছে আর ভালো রেখেছে তাকে বোধহয় বাবা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। জীবনের সার্টিফিকেটই হয়ত সব কিছু বলে না তার পরেও থেকে যায় ভালোবাসার বন্ধন। আর ভালোবাসায় বাঁধতে হলে সম্পর্কে সম্মানটা খুব জরুরী।
হঠাৎই ক্যামেরা ঝলসে ওঠে হয়ত ঘরে ঢুকেই এমন দৃশ্য দেখে ক্যামেরা ম্যানও হাত ছাড়া করতে চায় না। ভালোবাসার মুহূর্তের এক ঝলক পৌঁছে যায় বিন্দুর কাছেও মাথার ওড়নাটা সামলাতে সামলাতে পাপার কাছে দৌড়ে আসে বিন্দু,' মুন্না পাপা বোলা মামাজী কো।' চকচকে ফোনের স্ক্রীনে ছবিটা দেখে পঙ্কজ আর খুশবুর মনটাও ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,' খুশ রহো হমেশা ভাইয়া।'
জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে আজ আবার এক নতুন পথে পা রাখা ওদের সবার। হয়ত মহেন্দ্র আর বিন্দুই নতুন করে বাঁধলো সেই সূত্র। একসাথে দুই মা আর বড় মাসির আশীর্বাদের টিকা মাথায় নিয়ে পাপার হাত ধরে মুন্না পা বাড়ালো ওর জীবনসঙ্গীনীর হাত ধরতে। অনেকগুলো দুঃস্বপ্নের দিন কাটিয়ে আজ মনটা খুব হাল্কা মেহেকের জীবনের শুরুতে অনেক যুদ্ধ করলেও দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে শুধুই আজ ভালো স্বপ্ন দেখার দিন।
Comments
Post a Comment